(ধারাবাহিক)
১৩. দরবার শরীফের প্রবেশ কাল থেকে প্রস্থান পর্যন্ত মন, মুখ ও শরীরের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে গর্হিত বা অপছন্দনীয় কথা-বার্তা, কাজ-কর্ম এবং আদবের খিলাফ আচার-আচরণ থেকে বিরত রাখবে। রিয়াজত-মুশাক্কাতের চুড়ান্ত ফলাফল হচ্ছে, সে কাজে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি পরম আনন্দ ও ইতমিনান (শান্তি) পাবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন,
الا بذكر الله تطمئن القلوب.
অর্থঃ- “জেনে রাখ! আল্লাহ পাক-এর যিকির দ্বারাই অন্তর ইতমিনান শান্তি লাভ করে।” (সূরা রা’দ/২৮) হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,
جعلت قرة عينى فى الصلوة.
অর্থঃ- “সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “নামাযের মধ্যে আমার চোখের শীতলতা নিহিত রয়েছে।” সুতরাং যে পর্যন্ত সর্বপ্রকার খারাপ কাজ বর্জন করা এবং ইবাদত-বন্দেগী, যিকির-ফিকির, রিয়াজত -মুশাক্কাত খারাপ ও কঠিন মনে পর্যন্ত ত্রুটি থেকে যাবে। পূর্ণতা হাছিল হবে না। আর রিয়াজত-মুশাক্কাতও পূর্ণতায় পৌছবেনা। কেননা, আল্লাহ পাক বলেন,
انها لكبيرة الا على الخشعين.
অর্থঃ- “নিশ্চয়ই এটা কঠিন, কিন্তু যারা বিনয়ী তাদের জন্য কঠিন নয়।” (সূরা বাক্বারা/৪৫) স্মর্তব্য যে, যদি কেউ কোন কামিল পীর ছাহেবের ছোহবত ইখতিয়ার করে (সংস্পর্শে থেকে) মনের উপর জোড় দিয়ে কিছু দিন খারাপ কাজ বর্জন করতঃ ইবাদত-বন্দেগী, যিকির-ফিকির, রিয়াজত-মুশাক্কাত করতে পারে তাহলে বদ খাছলত হতে মুক্তি পাবে এবং নেক খাছলত (স্বভাব) অর্জন করতে পারবে; যা একান্ত করণীয় বটে। কেননা সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
اعبد الله على الرضاء فان لم تستطع ففى الصبر على ما تكرة تكره خير كثير.
অর্থঃ- “রেযার মাক্বামে উপনিত হয়ে তথা সন্তুষ্টিচিত্তে আল্লাহ পাক-এর ইবাদত-বন্দেগী কর। যদি তাতে সক্ষম না হও তবে তোমার অপছন্দনীয় বিষয়ে সবর (ধৈর্য্য ধারণ) করার মধ্যেও অনেক কল্যাণ নিহিত আছে।” অর্থাৎ ধৈর্য সহকারে ইবাদত-বন্দেগী, যিকির-ফিকির, রিয়াজত -মুশাক্কাতে মনোনিবেশ কর।” (ইহইয়াউ উলুমিদ্দীন) সুতরাং ইবাদত-বন্দেগী যিকির-ফিকির যত বেশী হবে ছাওয়াবও তত বেশী হবে এবং নফসও তত পবিত্র হবে। এছাড়া ইবাদত বন্দেগীর উদ্দেশ্য হচ্ছে অন্তরের উপর তার প্রভাব বিস্তার করা। কারণ যখন অন্তরের উপর প্রভাব বিস্তার করবে তখন সে সন্তুষ্টি চিত্তে আল্লাহ পাক এবং তাঁর হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আদেশ-নিষেধ, হুকুম-আহকাম সহজেই পালন করতে পারবে। যা নৈকট্য ও রেযামন্দি লাভের পূর্বাভাষ। আর এই প্রভাব বিস্তার তখনই সম্ভব, যখন ইবাদত-বন্দেগী, যিকির-ফিকির, রিয়াজত-মুশাক্কাত অধিক দীর্ঘ ও স্থায়ী হয়। সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যাকে সৌভাগ্যের আলামত বা নিদর্শন বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন,
طول العمر فى طاعة الله.
অর্থঃ- “সৌভাগ্যের আলামত হচ্ছে, আল্লাহ পাক-এর আনুগত্যে দীর্ঘজীবি হওয়া।” কাজেই ইলমে ফিক্বাহ্র অন্বেষী ব্যক্তি এবং দানশীলতার মত মহৎ গুণাবলী অর্জনের অভিলাষি যেমন দু’একদিনের অনুশীলনে ফক্বীহ (মুফতী) এবং দানশীল হতে পারে না, তেমনি যে ব্যক্তি সৎকার্য দ্বারা আত্মশুদ্ধি করতে চায়, সেও দু’ একদিনের ইবাদত-বন্দেগী, যিকির-ফিকির, রিয়াজত-মুশাক্কাত দ্বারা এই মর্তবা হাছিল করতে পারেনা। যে কোন মহৎ গুণাবলী অর্জন করা কিংবা খারাপ কাজ হতে বিরত থাকার জন্য দীর্ঘ মেয়াদী ইবাদত-বন্দেগী, যিকির-ফিকির, রিয়াজত মুশাক্কাত আবশ্যক। (ইহয়াউ উলুমিদ্দীন) সর্বোপরি আবশ্যক, আল্লাহ পাক-এর রহমত। কেননা, আল্লাহ পাক-এর রহমত ব্যতীত কোন কিছুই সম্ভব নয়। আর আল্লাহ পাক-এর সেই রহমত পাওয়ার উত্তম স্থান হচ্ছে, পীর ছাহেব ক্বিবলা-এর দরবার শরীফ। সুতরাং পরিবার পরিজন হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে দুনিয়াবী যাবতীয় আবিলতা, ঝামেলা হতে মুক্ত থেকে স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলার দরবার শরীফে অবস্থান করতঃ যদি তার মন-মগজসহ দেহের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে যাবতীয় গর্হিত ও অপছন্দনীয় কাজ-কর্ম, আচার-আচরণ হতে বিরত রাখতে পারে, তাহলে আল্লাহ পাক এবং তাঁর হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মারিফাত ও মুহব্বত হাছিল করতে পারবে।
والله تعالى اعلم بالصوب.
১৪। অযু-গোসল, খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি প্রাকৃতিক একান্ত প্রয়োজন ব্যতীত দরবার শরীফে অবস্থানের সবটুকু সময়ই স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলা-এর ছোহবতে (সান্নিধ্যে) কাটাবে। কবি যথার্থই বলেন,
উদূ লেখা ঢুকবে………………………………………….
অর্থঃ- এক মুহুর্তের জন্য আল্লাহ্ পাক থেকে গাফিল থেকোনা। সম্ভবতঃ আল্লাহ্ পাক-এর সান্নিধ্য তোমার প্রতি রহমত বর্ষণ করবেন আর সেই সময় তুমি গাফিল থাকবে, ফলে নিয়ামত হতে বঞ্চিত হবে।”
উল্লেখ্য যে, সর্বদা আল্লাহ পাক-এর রহমত বর্ষিত হলেও খাছ খাছ (বিশেষ) দিনে খাছ খাছ সময় এবং স্থানে খাছ খাছ রহমত বর্ষিত হয়ে থাকে। সেই রহমতের কোন হিস্সা (অংশ) মানুষের উপর পতিত হলে তিনি খাছ (বিশেষ) ওলী-আউলিয়াতে পরিগণিত হন। সেই রহমতের হিস্সা হরিণের উপর পড়লে তার মধ্যে মৃগনাভী পয়দা হয়। মাছের উপর পড়লে আম্বর হয়। শামুক ও ঝিনুকের উপর পড়লে মুক্তা পয়দা হয়। সাপ ও ব্যাঙের উপর পড়লে মানিক পয়দা হয়। কথিত আছে যে, শামুক ও ঝিনুক সেই রহমত লাভের আসায় সর্বদা আকাশ পানে তাকিয়ে থাকে। যখন সেই রহমতের হিস্সা তার উপর পতিত হয় সাথে সাথে সে পানির নিচে চলে যায়। আর সেখান থেকে পয়দা হয় মুক্তা। সালিক বা মুরীদের জন্য সেই রহমত লাভের অন্যতম স্থান হচ্ছে স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলার ছোহবত। সুতরাং সেই রহমত-বরকত হাছিলের জন্য মুরীদকে ঝিনুকের চেয়ে আরো অধিক আগ্রহ এবং গভীর মনোযোগের সাথে স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলার ছোহবত ইখতিয়ার করা আবশ্যক। আর সেই রহমত-বরকত তথা নেয়ামত পেলে ঝিনুকের মত পৃথিবীর সকল কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পীর ছাহেব ক্বিবলা-এর নির্দেশিত তরীক্বা মুতাবিক ইবাদত-বন্দেগী, যিকির-ফিকির, রিয়াজত-মুশাক্কাতে মনোনিবেশ করা উচিত। তবেই সে ব্যক্তি মকছুদে মঞ্জিলে (কাঙ্খিত মাক্বাম) অতি অল্প সময়ই পৌঁছতে সক্ষম হবে। তাছাড়া বিভিন্ন হাল ও মাক্বামে উন্নিত সালিকের সম্মিলন স্থল হচ্ছে পীর ছাহেব ক্বিবলা-এর দরবার শরীফ। সেই সমস্ত হাল ও মাক্বামের প্রতি নজর পতিত হলে মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হওয়ার সমূহ সম্ভবনা রয়েছে। আর হাছিল হলেও তা হবে অনেক সময় সাপেক্ষ। কেননা, প্রত্যেক জিনিসের আলাদা আলাদা তাছির (প্রভাব) আছে।
আগুনের কাছে গেলে গরম লাগে। ফ্যানের নীচে দাঁড়ালে বাতাস লাগে। তেঁতুল দেখলে জিহবায় পানি আসে। পিয়াজ কাটলে চোখে পানি ঝড়ে। অনুরূপ প্রত্যেক মানুষেরই ভিন্ন ভিন্ন তাছীর (প্রভাব) রয়েছে। তাদের সাথে মিলামিশার কারণে তাদের সেই তাছীর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির উপর পড়ে। আর সকলের পক্ষে সেই তাছীর কেটে উঠা সম্ভবপর হয়না। আর ছোহবতের তাছীর কত ক্রিয়াশীল তা ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়েনা। কেননা মানুষের সংস্পর্শে তোতা পাখি কথা বলে। স্বেচ্ছায় বন্দি জীবন যাপন করতে ভালবাসে। হাতি মানুষের সংস্পর্শে থাকার কারণে নিজের স্বকীয়তা ছেড়ে দিয়ে মানুষের বশ্যতা স্বীকার করে। হিংস্র কুকুর শিকারী হয়ে কাজ করে। আবার কামারের ছোহবতে শরীর দুর্গন্ধ যুক্ত হয়। আতর বিক্রেতার ছোহবতে সুগন্ধি হয়। ডাক্তারের ছোহবতে মানুষ ডাক্তার হয়। কৃষকের ছোহবতে থেকে কৃষক হয়। মাটি কিছু দিন আগুনের সংস্পর্শে রাখলে আগুনের রূপ ধারণ করে দামী ও কদরনীয় হয়ে যায়। ফুলের সংস্পর্শে থেকে সুগন্ধযুক্ত হয়ে মানুষের অন্তরকে মোহিত করার ক্ষমতা অর্জন করে। কাজেই যে যার ছোহবত ইখতিয়ার করবে তার তাছীরই তার উপর পড়বে। (অসমাপ্ত)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৭৩)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৭৪)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৭৬)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৭৭)