-হযরত মাওলানা মুফতী সাইয়্যিদ মুহম্মদ আব্দুল হালীম
দরবার শরীফে অবস্থানরত কিংবা দরবার শরীফের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের প্রতি কোন প্রকার কু-ধারণা করবে না। যদিও তাদের কারো আমলের মধ্যে কোন ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়। (ধারাবাহিক) তিন. শত্রুর মুখে তুমি তোমার দোষ-ত্রুটি জেনে নাও। কেননা, অসন্তুষ্টি ও অপছন্দনীয়তার কারণে শত্রুর মুখ থেকে তোমার যে সমালোচনা হবে, তা সেই বন্ধুর তুলনায় বেশী উপকারী হবে, যে বন্ধু তোমার প্রসংশা বা ছানা-ছিফত করে তোমার দোষ-ত্রুটিগুলোকে গোপন রাখে। কিন্তু আফসূস! মানুষের স্বভাবই হচ্ছে, সর্বক্ষেত্রে দুশমনকে অবিশ্বাস করা, ফলে নিজের দোষ-ত্রুটির ব্যাপারেও তাকে অবিশ্বাস করা হয়। মনে করা হয়, হিংসার বশবর্তী হয়েই সে আমার সমালোচনা ও দোষ-ত্রুটি প্রকাশ করছে। অথচ প্রকৃত জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান ব্যক্তি শত্রুর বক্তব্য থেকে আত্মসংশোধনের উপকরণ গ্রহণ করে থাকে। চার. সাধারণ লোকজনের সাথে মিলেমিশে থাকবে। তাদের যেসব কাজ-কর্ম ও আচার-ব্যবহার তোমার অপছন্দ হয়, সেগুলো দিয়েই তুমি তোমার প্রবৃত্তির বিচার করবে। কারণ, মু’মিন মু’মিনের জন্য আয়নাস্বরূপ। কাজেই যেসব দোষ-ত্রুটি তোমার দৃষ্টিতে তাদের মধ্যে ধরা পড়েছে, সেগুলো তোমার মধ্যেও আছে। কেননা, প্রকৃতিগতভাবে মানুষের পরস্পর সামঞ্জস্য রয়েছে এবং তারা একে অপরের কাছাকাছি। সুতরাং সমকালীন লোকদের কারও মধ্যে কোন দোষ থাকলে অপর জনের মধ্যে সেটির মূল উপাদান, কিংবা অধিক পরিমাণ অথবা কিছু না কিছু থাকা স্বাভাবিক। অতএব, এ দর্পণ প্রক্রিয়া অবলম্বন করতঃ নিজের নফসের প্রতি সদা সতর্ক দৃষ্টি রাখবে এবং দোষ-ত্রুটি হতে নিজেকে সংশোধন ও পবিত্র করার চেষ্টা করবে।” স্মর্তব্য যে, পীর ছাহেব ক্বিবলা-এর দরবার শরীফে এই চার প্রকার লোকের সাক্ষাত পাওয়া অতি সহজ। যা আল্লাহ পাক ও তাঁর হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মা’রিফাত-মুহব্বত অন্বেষী সালিক বা মুরীদের মাকছূদে মঞ্জিলে (কাঙ্খিত মাক্বাম) পৌঁছার অত্যন্ত সহায়ক। আর সবসময় এ কথা মনে রাখবে যে, আমি পীর ছাহেব ক্বিবলার দরবার শরীফে অবস্থান রত ছূফীগণের রোগ সারাতে আসিনি। আমি নিজের রোগ মুক্তির জন্য দরবার শরীফে এসেছি। তাছাড়া কামিল পীর ছাহেবগণ বিভিন্ন পদ্ধতিতে স্বীয় মুরীদকে তা’লীম তরবিয়ত করে থাকেন। মুরীদের অভ্যন্তরীণ রোগ, তার অবস্থা, বয়স ও মেজাজ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতঃ তার দ্বারা কোন প্রকার রিয়াজত-মুশাক্কাত তথা সাধনা ফলপ্রসূ সেটা জানার পর মুর্শিদ তার সাধ্যানুযায়ী কষ্টের কাজ দিয়ে থাকে। উদাহরণতঃ মুরীদ মূর্খ তথা শরীয়তের বিধি-বিধান না জানলে তাকে ওযু, নামায ও বাহ্যিক ইবাদত-বন্দেগীর ইলম্ শিক্ষা দেন। সে যদি হারাম ধন-সম্পদ উপার্জন করে ও গুনাহে মশগুল থাকে তাহলে তা বর্জন করার আদেশ দেন। যখন তার বাহ্যিক অবস্থা এবং বাহ্যিক ইবাদতের অলংকারে অলংকৃত হয় এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রকাশ্য গুনাহ থেকে পবিত্র হয়ে যায়, তখন তার অভ্যন্তরের দিকে মনোযোগ দিয়ে তার চরিত্র ও অন্তরের রোগ পর্যবেক্ষণ করেন। যদি জানা যায় যে, তার কাছে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ধন-সম্পদ রয়েছে, তবে সেগুলো দান-খয়রাত করতে বলেন, যাতে ধন-সম্পদের চিন্তা থেকে মুক্ত হয়ে যায়। আর যদি মুরীদের মধ্যে ঔদ্ধত্য ও অহংকার প্রবল দেখা যায়, তবে তাকে বাজারে ভিক্ষাবৃত্তির জন্যে পাঠিয়ে দেন কিংবা এরূপ অন্য কোন কাজের আদেশ দান করেন যাতে অন্তর হতে অহংকারের বীজ সমূলে উপড়ে ফেলতে পারে। কেননা, নফসের ঔদ্ধত্য ও অহমিকা লাঞ্ছনা ছাড়া দূর হয় না। আর ভিক্ষার চেয়ে অধিক লাঞ্ছনার কোন কাজ নেই। অহংকার অন্তরের মারাত্মক রোগ। আর যদি মুরীদের মধ্যে দৈহিক পরিপাট্য প্রবল দেখা যায়, তবে তাকে ময়লা ও আবর্জনার জায়গায় ঝাড়- দিতে বলেন এবং বাবুর্চিখানা ও ধোঁয়ার জায়গায় উঠা-বসা করার মত কাজ করতে দেন; যে পর্যন্ত তার মেযাজ থেকে পরিপাট্য দূরিভূত না হয়। আর যদি মুরীদের মধ্যে আহারের লালসা প্রবল দেখা যায়, তবে তাকে দীর্ঘ দিন পর্যন্ত রোযা রাখা, কম খাওয়ার আদেশ দেন এবং সুস্বাদু খাদ্য পাকিয়ে অন্যকে খাওয়াতে বলেন, কিন্তু নিজেকে খেতে নিষেধ করেন। ছবরের অভ্যাস ও খাওয়ার লোভ দূর না হওয়া পর্যন্ত এটা অব্যাহত রাখেন। যদি জানা যায়, মুরীদ যুবক ও বিবাহযোগ্য, কিন্তু স্ত্রীর ভরণ-পোষণে অক্ষম, তবে তাকে রোযা রাখার আদেশ করেন। এতে তার প্রবৃত্তি প্রশমিত না হলে বলেন যে, রাতে পানি দিয়ে সেহরী করবে এবং দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যায় খানা খাবে, পানি পান করবে না। এছাড়া গোশত ও তরকারী সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে দেন, যাতে তার নফস্ লাঞ্ছিত হয় এবং প্রবৃত্তি দমন হয়। কেননা, শুরুতে ক্ষুধা অপেক্ষা ভাল কোন চিকিৎসা নেই। যদি মুরীদের মধ্যে ক্রোধ প্রবল দেখা যায়, তবে সহনশীলতার আদেশ করেন এবং কোন বদমেযাজী ব্যক্তির আনুগত্য করতে বলেন। এভাবে তার নফস্ সহনশীলতায় অভ্যস্ত হয়ে যায়। সে মতে, কোন কোন বুযূর্গ সম্পর্কে বর্ণিত আছে, তাঁরা স্বীয় নফস্কে সহনশীলতায় অভ্যস্ত এবং ক্রোধের তীব্রতা হ্রাস করার জন্যে এমন লোকদের অধীনে কাজ করতেন, যারা উঠতে বসতে গালি দিত। এভাবে তারা নফসকে ছবর করতে বাধ্য করতেন এবং ক্রোধ দাবিয়ে রাখতেন। (ইহইয়াউ উলুমিদ্দীন) কাজেই দরবার শরীফে অবস্থানরত কিংবা পীর ছাহেব ক্বিবলার তরবিয়তপ্রাপ্ত ছূফীগণের কারো সম্পর্কে কোন প্রকার কুধারণা বা খারাপ মন্তব্য করবে না। আল্লাহ পাক-এর হাবীব, আখিরী নবী, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
اياكم والظن فان الظن اكذب الحديث ولا تحسسوا ولاتجسسوا ولا تنا جشوا ولا تحاسدوا ولا تباغضوا ولا تدابروا وكونوا عباد الله اخوانا.
অর্থঃ- “তোমরা কারো সম্পর্কে মন্দ ধারণা থেকে বেঁচে থাক। কেননা ধারণা বা অনুমান করে কথা বলা জঘন্যতম মিথ্যার অন্তর্ভুক্ত। তোমরা গোয়েন্দাগীরি করনা। কারো কোন দোষের কথা জানতে চেষ্টা করোনা। ধোঁকাবাজী করোনা। পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ করোনা। পরস্পর শত্রুতা করোনা এবং একে অন্যের পিছনে লেগে থেকোনা। বরং তোমরা আল্লাহ পাক-এর বান্দা পরস্পর ভাই ভাই হয়ে যাও।” (বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ, মিশকাত শরীফ/৪২৭) ১৩. দরবার শরীফের প্রবেশ কাল থেকে প্রস্থান পর্যন্ত মন, মুখ ও শরীরের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে গর্হিত বা অপছন্দনীয় কথা-বার্তা, কাজ-কর্ম এবং আদবের খিলাফ আচার-আচরণ থেকে বিরত রাখবে। পীর ছাহেব ক্বিবলার ছোহবতের উদ্দেশ্যই হচ্ছে তাঁর জাহিরী-বাতিনী (বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ) উভয় গুণে গুণান্বিত হওয়া। আউলিয়া-ই-কিরামগণকে আল্লাহ পাক কুদরতীভাবে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ পাক খাছ গুণাবলী দ্বারা তাঁদেরকে বিভূষিত করেন। তাঁরা সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নায়িব বা প্রতিনিধি। সমসাময়িক উম্মতগণ নবীর অবর্তমানে নায়িবে নবী তথা পীর ছাহেব ক্বিবলা-এর গুণাবলীতে গুণান্বিত হন। আর আউলিয়া-ই-কিরামগণের গুণে গুণান্বিত হওয়ার জন্য মন, মুখ, চোখ, কান সহ শরীরের সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে যাবতীয় গর্হিত ও অপছন্দনীয় কাজ-কর্ম, কথা-বার্তা এবং আদবের খিলাপ আচার-আচরণ হতে বিরত রাখার জন্য রীতিমত রিয়াজত মুশাক্কাত করা আবশ্যক। উল্লেখ্য যে, সচ্চরিত্র বা উত্তম গুণাবলী দু’টি উপায়ে অর্জিত হয়। (১) আল্লাহ পাক-এর বিশেষ দান। অর্থাৎ জন্ম থেকে মানুষ পূর্ণ জ্ঞানী ও চরিত্রবান হয়। যেমন, নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালাম এবং বিশেষ শ্রেণীর আউলিয়া-ই-কিরাম। (২) রিয়াজত-মুশাক্কাত তথা অধ্যাবসায় ও সাধনার দ্বারা অর্জন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যে ব্যক্তি দানশীলতার চরিত্র অর্জন করতে চায়, সে কষ্ট সহকারে দানশীলদের কাজ অর্থাৎ অর্থ ব্যয় অবলম্বন করবে এবং মনের উপর জোর দিয়ে সব সময় এ কাজ করতে থাকবে। অবশেষে এটা তার অভ্যাসে পরিণত হবে। ফলে সে দানশীল হয়ে যাবে। অনুরূপভাবে কেউ যদি ফক্বীহ বা মুফতী হতে চায়, তবে প্রথমে সে ফক্বীহ বা মুফতীগণের কাজ-কর্ম, আচার-আচরণ, রীতি-নীতি অনুশীলন করবে। অর্থাৎ ফিক্বাহ ও ফতওয়ার মাসয়ালা-মাসায়িল বার বার মুখে উচ্চারণ করবে, যাতে অন্তরের উপর ফিক্বাহ ও ফতওয়ার তাছির বা প্রভাব প্রতিফলিত হয়। সেটা হয়ে গেলে সে ফক্বীহ বা মুফতী হয়ে যাবে। অপরাপর উত্তম গুণাবলী এমনিভাবে অর্জন হতে পারে। আর রিয়াজত-মুশাক্কাতের চুড়ান্ত ফলাফল হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট কাজে সে ব্যক্তি পরম আনন্দ ও ইতমিনান পাবে। (অসমাপ্ত)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৭১)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার: পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৭২)
হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (২৫৯) বিশুদ্ধ নিয়ত এবং তার ফযীলত ও গুরুত্ব (৩)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৭৩)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৭৫)