ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৭৩)

সংখ্যা: ১২৫তম সংখ্যা | বিভাগ:

হযরত মাওলানা মুফতী সাইয়্যিদ মুহমমদ আব্দুল হালীম

 পীর ছাহেব ক্বিবলার দরবার শরীফে  অবস্থানের আদব ১২। দরবার শরীফে অবস্থান রত কিংবা দরবার শরীফের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বর্গের প্রতি কোন প্রকার কু-ধারণা করবে না। যদিও তাদের কারো আমলের মধ্যে  কোন ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়।  মনে রাখা আবশ্যক যে, পীর ছাহেব ক্বিবলার  দরবার শরীফ গাউছ-কুতুব, ওলী-আবদাল, ছূফী-দরবেশগণের আবাস। সেখানে আল্লাহ পাক এবং তাঁর হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মা’রিফত, মুহব্বতের অমীয় সুধা পানের পানঘাট। যা সাধারণ অসাধারণ সকলের জন্য উন্মুক্ত। সবাই তার চাহিদা এবং যোগ্যতানুযায়ী সেখান থেকে পান করে থাকে। কেউ পানে পরিতৃপ্ত কেউবা তার অন্বেষণে লিপ্ত। কেউ প্রাপ্ত কেউবা বঞ্চিত। কেউ আল্লাহ পাক এবং তাঁর হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দীদারে লিপ্ত কেউবা সৌন্দর্য দর্শনে ব্যস্ত। কেউবা হালে পরাস্ত কেউবা বাকা প্রাপ্ত। কেউবা ফানা ফিশ্ শায়খ কেউবা ফানা র্ফি রসূল আবার কেউবা ফানা ফিল্লাহ্-এর মাক্বামে উন্নীত। কেউবা বেলায়েতের মাক্বামে উপনীত হয়ে জীবন-মরণ কোশেশে লিপ্ত কেউবা কামালতে নুবুওওয়াত এবং রিসালতের হিস্সা পেয়ে পরম ইতমিনান্ বা পরিতৃপ্ত। কেউ আকর্ষিত কেউবা আকর্ষণকারী। কেউ মুরীদ আবার কেউবা মুরাদ। কেউ মুহিব কেউবা মাহবুব। কেউবা জলালী তবিয়ত প্রাপ্ত আবার কেউবা জামালী। এক কথায় বিভিন্ন হালের সালিকের সম্মিলন স্থান হচ্ছে পীর ছাহেব ক্বিবলার দরবার শরীফ। আর হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ, পীর ছাহেব ক্বিবলা-এর দরবার শরীফ হচ্ছে, আত্মার রোগের হাসপাতাল। হাসপাতালে যেরূপ বিচিত্র রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি থাকে সেরূপ পীর ছাহেব ক্বিবলার দরবার শরীফে আভ্যন্তরীণ রোগে আক্রান্ত রোগী থাকা অস্বাভাবিক নয়। তবে সকলেরই উদ্দেশ্য থাকে রোগ নিরাময় তথা ইছলাহ বা আত্মার পরিশুদ্ধি হাছিল করে মহান আল্লাহ পাক, তাঁর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং আপন শায়খ-এর হাক্বীক্বী সন্তুষ্টি রেযামন্দি লাভ করা। কাজেই তাঁদের প্রতি কুধারণা পোষণ করার অর্থই হচ্ছে নিজের ক্ষতি সাধন করা। নিজের ইছলাহ বা সংশোধনের পথ রুদ্ধ করা। সুতরাং সর্বক্ষেত্রে স্বীয় রোগ এবং তার নিরাময়ের প্রতি লক্ষ্য রাখা বুদ্ধিমানের কাজ। হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি স্বীয় “মুকাশাফাতুল ক্বুলুব” কিতাবের ২৫২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন, “আল্লাহ তায়ালা যখন কোন বান্দাকে কল্যাণ দানের ইচ্ছা করেন, তখন তাকে নিজের দোষ-ত্রুটির উপর দৃষ্টি রাখার তওফীক দান করেন। যে ব্যক্তি বুদ্ধিমান বা জ্ঞানী সে কখনও নিজের অন্যায়, অপরাধ ও দোষ-ত্রুটির ব্যাপারে গাফিল বা উদাসীন থাকতে পারে না। বস্তুতঃ স্বীয় নফস ও প্রবৃত্তির এলাজ বা চিকিৎসা করা তখনই সম্ভব, যখন  সংশ্লিষ্ট রোগ-ব্যাধি সম্পর্কে সচেতন হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে, অধিকাংশ লোকই নিজের আয়েব ও দোষের বিষয়ে এমন গাফিল যে, অন্যের দোষের সামান্য একটি কণাও দৃষ্টিগোচর হয়; কিন্তু নিজের পাহাড় পরিমাণ দোষও দৃষ্টিগোচর হয়না।  তিনি আরো বলেন, যে ব্যক্তি নিজের রোগ তথা দোষ-ত্রুটি সম্পর্কে অবগত হতে চায় তার উচিত নিম্নোক্ত চার পদ্ধতির অনুশীলন করাঃ এক. হক্বানী-রব্বানী পীর-মাশায়েখগণের ছোহবতকে লাজিম করে নেয়া। তিনি নফসের রোগ-ব্যাধি তথা দোষ-ত্রুটি নির্ণয় করতঃ যথাযোগ্য চিকিৎসার ব্যবস্থা করবেন। আর সে ব্যক্তির কর্তব্য হবে, পূর্ণ আনুগত্য ও ভক্তি সহকারে স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলার নির্দেশিত পথে রিয়াযত-মুজাহাদা তথা সাধনায় ব্রতী হওয়া। শায়খ ও মুরীদ এবং উস্তাদ ও ছাত্রের মধ্যে এরূপ সম্পর্কই হওয়া উচিত যে, শায়খ ও উস্তাদ নফসের রোগ ও দোষসমূহ চিহ্নিত করে সেগুলোর প্রতিকার করবেন আর মুরীদ ও ছাত্ররা মনোযোগ সহকারে রিয়াযত-মুজাহাদায় ব্যাপৃত হবে। কিন্তু বর্তমানে এরূপ খুব কমই নজরে পড়ে। বরং দেখা যায় যে, পীর ছাহেব এবং উস্তাদও যদি দোষ-ত্রুটি ধরিয়ে দেয় তবে সংশোধন করা তো দূরের কথা বরং পীর ছাহেব এবং উস্তাদের প্রতি বিরোধী হয়ে উঠে। (নাউযুবিল্লাহ) দুই. নফসের রোগ নির্ণয় করতে হলে এমন একজন কল্যাণকামী, খাঁটি, সত্যবাদী এবং অন্তরঙ্গ বন্ধু গ্রহণ করতে হবে, যে তোমার জাহির-বাতিন (বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ) যাবতীয় দোষত্রুটি সম্পর্কে তোমাকে সতর্ক করবে। জ্ঞানী-গুণী বুযূর্গানে দ্বীনের এটাই ছিল রীতি বা পদ্ধতি। আমিরুল মু’মিনীন, খলিফাতুল মুসলিমীন হযরত উমর ইবনুল খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন,

 رحم الله امرءا اهدى الى عيوبى.

অর্থঃ- “আল্লাহ তায়ালা সেই ব্যক্তির উপর রহম করুন, যে আমার দোষ-ত্রুটি আমাকে বলে দেয়।” তিনি ইমামুয্ যাহিদীন হযরত সালমান ফারসী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে জিজ্ঞাসা করতেন, আপনার দৃষ্টিতে আমার মধ্যে কি কি দোষ-ত্রুটি রয়েছে? তিনি বলতেন, কে আপনাকে এরূপ বিষয় বলার সাহস করবে?  হযরত উমর ইবনুল খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বারবার অনুরোধ করার পর  তিনি একদিন বললেন, আমি জানতে পেরেছি যে, আপনার দস্তরখানে দুই পদের তরকারী হয়। আর আপনার দুই জোড়া পোশাক রয়েছে- এক জোড়া দিনের অন্য জোড়া রাতের। তিনি পুনরায় অনুরোধ করলেন, এছাড়া আমার আরও কোন দোষ আছে কি? হযরত সালমান ফারসী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বললেন, না। হযরত আমিরুল মুমিনীন রদ্বিয়াল্লাহ তায়ালা আনহু বললেন, “যে দু’টি বলেছেন সে দু’টিও আমার জন্য যথেষ্ট অপরাধ।” তিনি ছহিবুস্ সির, হযরত হুযাইফাহ্ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে সময় সময় জিজ্ঞাসা করতেন, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আপনার নিকট মুনাফিকদের সম্পর্কে গোপন তথ্য বলতেন। আমার মধ্যে কি আপনি নিফাকের কোন আলামত লক্ষ্য করেন?  এতো প্রতাপশালী ও উচ্চ মর্যাদার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও হযরত উমর ইবনুল খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর মধ্যে আল্লাহ পাক-এর ভয় কি পর্যায়ে ছিল যে, নিজের নফসের বিষয়ে মোটেই নিশ্চিন্ত ছিলেন না। বস্তুতঃ জ্ঞান-বুদ্ধি ও চিন্তা-চেতনা যার পরিপূর্ণতা লাভ করে তার মধ্যে কখনও অহংকার ও আত্মম্ভরিতা স্থান পেতে পারে না। প্রতি মুহূর্তে সে নফসের চুল-চেরা হিসাব নিতে থাকে। কিন্তু বর্তমান যুগে এরূপ লোকের অস্তিত্ব একবারেই নগণ্য। সেইসঙ্গে এরূপ আহবার তথা বন্ধু-বান্ধবেরও অভাব যারা দ্বীনের ব্যাপারে কোনরূপ খাতির ও শৈথিল্য না করে প্রকৃত হিতাকাংখী হয়ে তোমার দোষ-ত্রুটি তোমাকে ব্যক্ত করবে কিংবা অন্ততপক্ষে বিদ্বেষমুক্ত মন-মানসিকতা নিয়ে স্বীয় ওয়াজিব দায়িত্বটুকু আদায় করবে। বরং বাস্তবে যা দেখা যায়, তা হচ্ছে অধিকাংশই আজকাল হিংসা-বিদ্বেষের শিকার অথবা স্বার্থের মোহে এমনভাবে লিপ্ত যে, প্রকৃতপক্ষে যা দোষ নয়, সেটাকেই দোষ বলে ব্যক্ত করছে কিংবা এমন শিথিলতা অবলম্বন করছে যে, যা প্রকৃতই দোষ সেটাকে দোষ বলে অভিহিত করছে না। এ জন্যেই কুতুবুল মাশায়িখ ইমাম হযরত দাঊদ তাঈ রহমতুল্লাহি আলাইহি লোকজন থেকে পৃথক হয়ে থাকতেন। একদা কেউ তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আপনি জনসাধারণের সংশ্রবে থাকেন না কেন? তিনি বলেছেন,

وماذا اصنع باقوام تخفى عنى عيوبى.

অর্থঃ- “যারা আমার দোষ-ত্রুটি গোপন করে রাখে; সংশোধনের নিমিত্তে আমার নিকট ব্যক্ত করে না তাদের সংশ্রবে থেকে আমার কি লাভ হবে?” বুঝা গেল, আল্লাহ পাক-এর ওলীগণ মনে-প্রাণে চাইতেন, তাঁদের দোষ-ত্রুটি ব্যক্ত করে তাঁদেরকে যেন সর্তক করা হয়। কিন্তু আমাদের অবস্থা তো এই যে, যে  ব্যক্তি আমাদেরকে সদুপদেশ প্রদান করে; আমাদের দোষ-ত্রুটি ধরিয়ে দেয়, তাকে আমরা শত্রু মনে করি। সবচেয়ে নিকৃষ্টতম ব্যক্তি সাব্যস্ত করি। চিন্তার বিষয়- আমাদের এহেন দূরবস্থা ঈমানের নিম্নতম পর্যায়কেও অতিক্রম করে। কেননা, মন্দ স্বভাব মূলতঃ ধ্বংসাত্মক সাপ ও বৃশ্চিকের ন্যায়। যদি কেউ বলে তোমার পোশাকের ভিতর একটি বৃশ্চিক বা সাপ রয়েছে, তবে এই সতর্কীকরণের জন্য আমরা তার শোকরগুযার হই এবং তৎক্ষণাৎ তা দূর করতে উঠে পড়ে লেগে যাই, সেটাকে হত্যা না করা পর্যন্ত নিঃশ্বাস ফেলি না। পরিশেষে আনন্দ বোধ করি যে, সাপ বা বিচ্ছু থেকে বেঁচে গেছি। অথচ এই সাপ বা বিচ্ছুর  ক্ষতি আমাদের ইহজাগতিক দেহ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। এক দু’দিন পর তা নিরাময়ও হয়ে যেতে পারে।  পক্ষান্তরে, মন্দ স্বভাব ও দুশ্চরিত্রাবলীর ধ্বংসাত্মক প্রতিক্রিয়া মানুষের অন্তঃকরণকেও ধ্বংস করে দেয় এবং প্রবল আশংকা থাকে যে মৃত্যুর পর তা চিরকাল থেকে যাবে। এতদসত্ত্বেও আমরা আমাদের দোষ-ত্রুটি ও দুশ্চরিত্রাবলীর সাপ বা বিচ্ছু সম্পর্কে সতর্ককারীদের  শোকর গুযার হইনা। এসব মন্দ স্বভাব দূরীকরণে সচেষ্ট হইনা। উপরন্তু হিতাকাংখী, উপদেশ দাতার সাথে শত্রুতামূলক আচরণ করে বলি, “আপনিও তো অমুক অমুক অপরাধ ও অন্যায় কাজ করে থাকেন।” এরূপ আচরণের অনিবার্য  পরিণাম এই দাঁড়ায় যে, উক্ত ব্যক্তি পাপাচারে আরও অধিক মাত্রায় বল্গাহীন হয়ে উঠে। য    (অসমাপ্ত)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৭১)

 ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার: পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৭২) 

হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (২৫৯) বিশুদ্ধ নিয়ত এবং তার ফযীলত ও গুরুত্ব (৩)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৭৪)

 ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৭৫)