পীর ছাহেব ক্বিবলার দরবার শরীফে অবস্থানের আদব প্রসঙ্গঃ পীর ছাহেব ক্বিবলার দরবার শরীফে অবস্থান করাকালীন সময়ে তাঁর খিদমতের যথাযথ আঞ্জাম দিবে। দরবার শরীফ-এর যাবতীয় কাজ নিজ হাতেই সম্পাদন করবে।
(ধারাবাহিক)
একদিন হযরত আবূ সাঈদ রহমতুল্লাহি আলাইহি ইমামুল মুত্তাক্বীন হযরত নিজামুদ্দীন বলখী রহমতুল্লাহি আলাইহিকে বললেন, “আমি এসেছিলাম আপনার নিকট বাইয়াত হওয়ার জন্য। আপনার মত মহান ব্যক্তিত্বের ছোহবত ইখতিয়ার করা (সংস্পর্শে থাকা) একান্ত জরুরী মনে করছি।” ইমামুল মুত্তাক্বীন হযরত নিজামুদ্দীন বলখী রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর আবেদন মঞ্জুর করলেন। তাঁকে স্বীয় ছোহ্বত দানের জন্য বাইয়াত করালেন। পরের দিন ইমামুল মুত্তাক্বীন হযরত নিজামুদ্দীন বলখী রহমতুল্লাহি আলাইহি খানকা শরীফ-এর দায়িত্বে নিয়োজিত খাদিমকে বলে দিলেন, “আজ থেকে আবূ সাঈদ-এর থাকার স্থান অন্যান্য ছূফীগণের সাথেই করে দাও। এখন থেকে তার জন্য বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে না। বরং অপরাপর ছূফীগণ যে খাবার খেয়ে থাকে সেও সেখান থেকে খাবে। কারণ এতদিন সে ছিল আমার পীর ছাহেব ক্বিবলার আওলাদ। সুতরাং পীর ছাহেব ক্বিবলার মতই তা’যীম-তাকরীম করা আমার দায়িত্ব ছিল। এখন থেকে সে আমার মুরীদ। সুতরাং তাকে মুরীদের মতই থাকতে হবে। পীর ছাহেব ক্বিবলার যেমন আদেশ তেমনি কাজ। পরের দিন থেকে সাধারণ ছূফী-সাধকগণের সাথে তাঁকে থাকতে দেয়া হলো। তরবিয়ত (লালন-পালন) চললো মুরীদের মতই। আর হযরত আবূ সাঈদ রহমতুল্লাহি আলাইহি স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলার খিদমতস্বরূপ পেলেন পীর ছাহেব ক্বিবলার আওলাদের কবুতরের পাহারাদারী। এক সময় অবস্থা এমন হলো যে, প্রতি রাতে কবুতর হারিয়ে যায়। কে বা কারা কবুতর চুরি করে তার কোন তথ্য পাওয়া যাচ্ছিলনা। পরিশেষে ইমামুল মুত্তাক্বীন হযরত নিজামুদ্দীন বলখী রহমতুল্লাহি আলাইহি সেই কবুতর পাহারা দেয়ার জন্য হযরত আবূ সাঈদ রহমতুল্লাহি আলাইহিকেই নিয়োগ করলেন। আর তিনি এ দায়িত্বকে আল্লাহ্ পাক-এর বিশেষ নিয়ামত মনে করে যথাযথভাবে পালনে ব্রতী হন; কিন্তু তারপরও কবুতর হারানো রোধ হলো না। পূর্বের মত প্রতি রাতেই কবুতর চুরি হচ্ছিল। তিনি সেই ব্যাপারে মহাচিন্তায় পড়ে গেলেন। রাত-দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করেও পীর ছাহেব ক্বিবলার খিদমত সুষ্ঠুভাবে পালিত না হওয়ায় তিনি মিয়্রমান। বাড়ীতে প্রবেশের সমস্ত পথ বন্ধ করার পরও কিভাবে প্রতি রাতেই কবুতর চুরি হয় তা নিয়ে তাঁর ভাবনার শেষ নেই। বিশেষভাবে অনুসন্ধান চালানোর পর তিনি দেখতে পেলেন, পীর ছাহেব ক্বিবলার বাড়ীর ভিতর প্রবেশের শুধু একটা পথ খোলা। আর তা হলো পানি চলাচলের রাস্তা। তিনি ভাবলেন হয়তো এই পথ দিয়েই বিড়াল ভিতরে প্রবেশ করে কবুতর ধরে খেয়ে থাকে। আর প্রকৃতপক্ষে সেটাই ঘটেছিল। সুতরাং তিনি রাতে বাড়ীতে প্রবেশের সমস্ত দরজা-জানালা বন্ধ করে পানি চলাচলের সেই রাস্তার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতেন। আর এভাবে রাত-দিন একটানা পরিশ্রমের কারণে যখন শরীর অবসাদগ্রস্থ হতো তখন তিনি পানি চলাচলের সেই নালায় মাথা রেখে গর্তের মুখ বন্ধ করে শুয়ে থাকতেন। এভাবেই অতিবাহিত হলো তাঁর রিয়াজত-মুশাক্কাতের অনেকগুলো দিন। একদিন রাতে মুষলধারে বৃষ্টি হলো। তিনি পানি চলাচলের নালায় মাথা রাখার কারণে পানি চলাচল বন্ধ হয়ে পীর ছাহেব ক্বিবলার বাড়ীতে পানি জমে গেল। পরের দিন সকালে বাড়ীর লোকজন পানি চলাচলের নালা নিষ্কাশন করার জন্য দেয়ালের অপর দিক থেকে শক্ত বাঁশ দিয়ে প্রেসার (চাপ) দিচ্ছিলেন। এক পর্যায়ে জোরে প্রেসার (চাপ) দেয়ার কারণে তাঁর মাথা মুবারক ছিদ্র হয়ে রক্ত বের হয়ে পানি লাল হয়ে গেল। এদিকে কোনভাবেই পানি নিষ্কাশণ করা যাচ্ছে না অপরদিকে পানি লাল হয়ে যাচ্ছে- যার জন্য তাঁরা ভাবনায় পড়ে গেলেন। এদিকে হযরত আবূ সাঈদ রহমতুল্লাহি আলাইহি মাথা মুবারকে আঘাত পাওয়ার কারণে ভাবলেন, মনে হয় বিড়াল ভিতরে ঢুকতে না পেরে মাথায় আক্রমণ করেছে। সুতরাং তিনি বিড়াল বিড়াল বলে চিৎকার করতে লাগলেন। চিৎকার শুনে লোকজন ছুটে এসে দেখতে পেলেন যে, পানি চলাচল করতে শুরু করেছে বটে; কিন্তু হযরত আবূ সাঈদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর মাথা মুবারক থেকে তখনও ফিন্কি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। লোকজন চিৎকারের কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। তখন তিনি বিড়ালের প্রসঙ্গ এনে তাঁর ধারণামূলক ঘটনা বর্ণনা করলেন। পরে তাঁকে তার পীর ছাহেব ক্বিবলা-এর কাছে নেয়া হলো। পীর ছাহেব ক্বিবলা আদ্যপান্ত ঘটনা শুনে চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেন। অতি অল্প সময়ে তিনি সুস্থতা লাভ করলেন। পরে পীর ছাহেব ক্বিবলা হযরত আবূ সাঈদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর স্বীয় কর্তব্য কাজে ইস্তিকামত (অটল), কর্তব্য-পরায়ণতা এবং সহিষ্ণুতা দেখে অত্যন্ত খুশী হয়ে খাছ (বিশেষ) তাওয়াজ্জুহ্-ফয়েজ দান করলেন। সাথে সাথে খিলাফত দিয়ে মুসলিম উম্মাহ্র হিদায়েতের দায়িত্ব ভার অর্পণ করতঃ স্বীয় ছোহবত থেকে আলাদা করে দিলেন। উল্লেখ্য যে, স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলার খিদমতের মাধ্যমে প্রত্যেক মুরীদকেই পীর ছাহেব ক্বিবলা-এর সন্তুষ্টি তালাশ করা কর্তব্য। তবেই তার পক্ষে আল্লাহ্ পাক ও তাঁর হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হাবীবুল্লাহ্ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মারিফত-মুহব্বত, সন্তুষ্টি-রেজামন্দি হাছিল করা সম্ভব। সুতরাং দরবার শরীফে অবস্থান করা কালীন সময় যথা সম্ভব পীর ছাহেব ক্বিবলার খিদমত করার কোশেশ করবে। আল্লাহ্ পাকই তাওফিক দাতা। ১০। স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলার ছোহবত ইখতিয়ার করার উদ্দেশ্যে তাঁর দরবার শরীফে আগমন করবে। দুনিয়াবী কোন প্রয়োজন পুরণের নিয়ত অন্তরে রাখবে না। “পার্থিব কোন কাজ সম্পাদন করবে, পাশাপাশি স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলার ছোহবত ইখতিয়ার করবে”- এরূপ নিয়ত করা উচিত নয়। তবে যদি কেউ কোন প্রয়োজনের তাগিদে কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে করে আর পথিমধ্যে পীর ছাহেব ক্বিবলা-এর দরবার শরীফ নজরে পড়ে তবে সেক্ষেত্রে দরবার শরীফে যাওয়া এবং পীর ছাহেব ক্বিবলা এর সাথে মুলাকাত করতঃ উদ্দেশ্য পানে গমন করা দোষণীয় নয়। বরং সেটাই হচ্ছে আদব, রহমত-বরকত হাছিলের কারণ। সুতরাং সালিকের কোথাও গমন পথে যদি পীর ছাহেব ক্বিবলার দরবার শরীফ কিংবা অবস্থান স্থল অথবা মাজার শরীফ পড়ে তবে সেক্ষেত্রে দরবার শরীফে গমন না করা বা মাযার শরীফ যিয়ারত না করা আদবের খিলাফ। কোন কোন ক্ষেত্রে ক্ষতির কারণও বটে। কাজেই অতি অল্প সময় হলেও দরবার শরীফে কিংবা মাজার শরীফে গমন করতঃ দোয়া, বরকত, ফয়েজ-তাওয়াজ্জুহ কামনা করবে। ১১। দরবার শরীফে অবস্থানরত কোন ছূফীকেই কোন প্রকার কষ্ট দিবেনা। তাদের সাথে ঝগড়া-বিবাদ, মারা-মারি এবং ফিৎনা-ফাসাদ করবে না। পীর ছাহেব ক্বিবলার দরবার শরীফের অন্যতম আদব হচ্ছে, ছোট হোক, বড় হোক দরবার শরীফের সর্বস্তরের লোকদের সাথে ভক্তি, শ্রদ্ধা, স্নেহ ও মমতা রাখবে। কারণ দরবার শরীফে অবস্থান করার কারণে তাঁরা সর্বদা শ্রদ্ধার পাত্র। মনে রাখবে, তাঁরা পীর ছাহেব ক্বিবলার ছোহবতে সর্বদা ধন্য। এ ফযীলতের উপর অন্য কোন ফযীলত নেই। তাছাড়া সকলের হক্ব (অধিকার) যথাযথভাবে আদায় করা ছূফীগণের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। সুতরাং কারো হক্ব যেন কোন সময় নষ্ট না হয় তার প্রতি সবিশেষ যতœবান হবে। অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী ব্যবসার লাভ-লোকসানের খাতগুলোর প্রতি সম্পর্কে বিশেষ দৃষ্টি রাখে। কেননা, সে সম্পর্কে অভিজ্ঞতা না থাকলে ব্যবসায় কামিয়াবী লাভ করা যায়না। শুধু কষ্ট আর পরিশ্রমই সার হয়। কাজেই দরবার শরীফে অবস্থান রত ছূফীগণকে কষ্ট দিয়ে, তাদের হক্ব নষ্ট করে পীর ছাহেব ক্বিবলার সন্তুষ্টি লাভের আশা করা সুদূর পরাহত। (অসমাপ্ত)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৭১)
হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (২৫৯) বিশুদ্ধ নিয়ত এবং তার ফযীলত ও গুরুত্ব (৩)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৭৩)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৭৪)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৭৫)