প্রসঙ্গঃ পীর ছাহেব ক্বিবলা-এর দরবার শরীফে অবস্থান করাকালীন সময়ে তাঁর খিদমতের যথাযথ আঞ্জাম দিবে। দরবার শরীফ-এর যাবতীয় কাজ নিজ হাতেই সম্পাদন করবে।
(ধারাবাহিক)
ইল্মে তাছাউফ (অন্তর পরিশুদ্ধকরণ ইল্ম) তথা আল্লাহ্ পাক এবং তাঁর হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মা’রিফত-মুহব্বত হাছিলের অন্যতম শর্ত হচ্ছে স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলা-এর খিদমত। কেননা, জাহিরী ইল্ম (ইল্মে শরীয়ত) কিতাবাদী পাঠ করে, কারো নিকট হতে শুনে কিংবা দেখে শিক্ষা করা যায়। কিন্তু ইল্মে তাছাউফ কিতাবাদী পড়ে, শুনে, দেখে শিক্ষা করার বিষয় নয়। এটা একান্তভাবে অন্তরের সাথে সংশ্লিষ্ট। সুতরাং মুর্শিদ ক্বিবলার মনসন্তুষ্টির মাধ্যমেই এটা হাছিল করতে হয়। আর সন্তুষ্টি পাওয়ার অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে খিদমত।
শাইখুল উলামা ওয়াল মাশায়িখ হযরত আবূ বকর শিবলী রহমতুল্লাহি আলাইহি একদিন সুলতানুল আউলিয়া, সাইয়্যিদুত্ তয়িফা হযরত জুনাইদ বাগদাদী রহমতুল্লাহি আলাইহিকে বিনীত স্বরে বললেন, “হে আমার শায়খ! আল্লাহ্ পাক এবং তাঁর হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আপনাকে যে সমস্ত নিয়ামত দান করেছেন তা দয়া করে আমার নিকট বিক্রি করুন অথবা আমাকে হাদিয়াস্বরূপ দান করুন।”
সাইয়্যিদুত্ তয়িফা হযরত জুনাইদ বাগদাদী রহমতুল্লাহি বললেন, “হে আবু বকর শিবলী! এ সমস্ত নিয়ামত এত অমূল্য, যার মূল্য পরিশোধ করার মত অর্থ তোমার কাছে নেই। দুনিয়া এবং দুনিয়ার মধ্যে যা কিছু আছে তার সবকিছু দিলেও এর মূল্য হবেনা। আর তোমাকে যদি বিনামূল্যে দেয়া হয় তবে তুমি তাঁর কদর করতে পারবেনা। সুতরাং রিয়াজত-মুশাক্কাত করেই হাছিল করার কোশেশ কর। আউলিয়া-ই-কিরামগণ যিকির-ফিকির, রিয়াজত-মুশাক্কাত করেই তা হাছিলের কোশেশ করেছেন।”
রইসুল মুহাদ্দিসীন, শাইখুল আলম, মুজাদ্দিদু মিল্লাত ওয়াদ্ দ্বীন, হযরত শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন-
“আব্বাজান (শাইখুল উলামা ওয়াল মাশায়িখ হযরত শায়খ আব্দুর রহীম মুহাদ্দিস দেহলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি) বলেন যে, আমার পীর ছাহেব ক্বিবলা সাইয়্যিদ আবদুল্লাহ আকবরাবাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি আমাকে দিয়ে কোন খিদমত করাতেন না। কখনো খিদমত করতে চাইলে যে কোন অজুহাতে তিনি আমাকে বিরত রাখার চেষ্টা করতেন। শায়খের এরূপ আচরণের কারণে এক রাতে আমি ভীষণভাবে চিন্তিত হয়ে পড়ি। সুতরাং অন্তরে উদিত ঐ খেয়াল শায়খকে অবহিত করার জন্য তাঁর হুজরা শরীফে চলে গেলাম। সময়টা ছিল খুব গরমের। তখন তাঁর শরীর মুবারকে জামা ছিল না। (আলাদা কাপড় দ্বারা শরীর মুবারক আবৃত ছিল।) শায়খ আমাকে দেখেই মধুমাখা কক্তে বললেন, ‘খোশ আমদেদ’। আস, শরীর থেকে ময়লা দূর করে দাও। তখন আমি সানন্দে ময়লা পরিষ্কার করতে লাগলাম। মাঝখানে তিনি বললেন, সমস্ত হাতকেই কষ্ট দিচ্ছ কেন? এ কাজতো দু’আঙ্গুল দিয়েই করা যায়। আমি তাই করলাম। অতঃপর বললেন, ইল্মে তাসাউফ শিক্ষার এ পথে মুরীদ থেকে খিদমত গ্রহণের যে শর্ত ছিল, তা তুমি পূর্ণ করেছ। আর কখনো এ জাতীয় দুশ্চিন্তা অন্তরে স্থান দিয়োনা। কারণ আমার ছোহবতের জাহিরী এবং বাতিনী সমস্ত হক্বই তোমাকে মাফ করে দিয়েছি।” (আনফাসুল আরিফীন/৫২)
মাখদুমে জাহান, খাজায়ে খাজেগাঁ, হযরত খাজা সাইয়্যিদ আব্দুল্লাহ আকবরাবাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, (আমার শায়খ কুতুবুল আলম, সুলতানুল আউলিয়া) হযরত আদম বিন নূরী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর দরবার শরীফে পৌঁছে লক্ষ্য করলাম যে, শায়খের মুরীদগণ তাঁর বাড়ির যাবতীয় কাজ নিজেদের মধ্যে বণ্টন করে নিয়েছেন। কোন একটি কাজও ফেলে রাখা হয়নি। সুতরাং বেশ কিছু দিন আমাকে অপেক্ষা করতে হলো। অবশেষে একদিন লক্ষ্য করলাম যে, বন-জঙ্গল থেকে কাঠ আনার দায়িত্বে যারা নিয়োজিত, তারা দৈহিকভাবে অত্যন্ত দুর্বল ও জীর্ণ-শীর্ণ। এ দায়িত্ব পালন করা তাদের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়। আর আমি যেহেতু সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, যুবক। তাই এ কাজটি নিজের কাঁধে তুলে নিলাম। প্রতিদিন দুই বোঝা কাঠ মাথায় করে আনতে লাগলাম। কিন্তু শায়খের কাছাকাছি বসে কোন খিদমত করার সুযোগ হচ্ছিল না। কিছু দিন পর একবার শায়খ নদীর ঘাটে গোসল করতে যান। (তাঁর শরীর মুবারক কাপড় দ্বারা আবৃত ছিল। আর গোসলের উক্ত স্থানটিও ছিল পরিবেষ্টিত বা ঘেরা। কেননা উম্মুক্ত শরীরে এবং খোলা মেলা ভাবে গোসল করা সুন্নাতের খিলাফ। আর সুন্নাতের খিলাফ আমল করা আউলিয়া-ই-কিরামগণের স্বভাব বিরোধী কাজ। যা তাঁর মত মহান ব্যক্তিত্বের ক্ষেত্রে কল্পনাও করা অন্যায়। মুলতঃ সর্বক্ষেত্রেই আউলিয়া-ই-কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণের সম্পর্কে বিশুদ্ধ আক্বীদা পোষণ করা কতর্ব্য। কেননা তাঁদের শানে কুধারণা পোষণ করা, তাঁদের ছিদ্রান্বেষণ করা হালাকী বা ধ্বংসের কারণ।) মুরীদগণ শায়খের শরীর মুবারক ডলে ময়লা পরিষ্কার করতে শুরু করলো। আমিও তাদের সাথে শামিল হলাম এবং অন্য সবার তুলনায় আমার খিদমতই উত্তম বলে বিবেচিত হলো। ফলে শায়খ তখনই আমার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি (ফয়েজ) দান করলেন। এক দৃষ্টিতেই আমার মধ্যে তোলপাড় শুরু হলো। আমি সেই নদীর মধ্যেই বেহুশ হয়ে পড়ে গেলাম। সাথীরা আমাকে মৃতের মত ধরে শায়খের বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে আসলো। ছয়মাস পর পুনরায় নদীর ঘাটে শায়খের শরীর মুবারক পরিষ্কার করার সময় তিনি সস্নেহে আমার কুশল জানতে চাইলেন। তাঁর এ বিশেষ দৃষ্টিপাতে (ফয়েজ-তাওয়াজ্জুহ) এবারও আমি সংজ্ঞা হারালাম।
উল্লেখ্য যে, আমার যা কিছু অর্জন হয়েছে তা আমার পীর ছাহেব ক্বিবলা-এর এই দৃষ্টি তথা ফয়েয-তাওয়াজ্জুহ-এর অবদান, যা পর পর দু’বার শায়খ আমাকে দান করেছেন। (আনফাসুল আরিফীন/৫৪)
আফজালুল আউলিয়া, মাহবুবে ছোবহানী, ইমামে রববানী, হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, রাজা-বাদশাহদের মজলিসের সভাপতিত্বের চেয়ে আউলিয়া-ই-কিরাম-এর দরবার শরীফের ঝাড়ুদার হওয়াই উত্তম। (মাকতুবাত শরীফ)
কুদওয়াতু আউলিয়া, সুলতানুল আরিফীন হযরত ইব্রাহিম ইবনে আদহাম রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর জীবনীতে তার বাস্তব প্রয়োগ ঘটেছে। তিনি বলখের বাদশাহী পরিত্যাগ করতঃ আউলিয়া-ই-কিরাম-এর দরবার শরীফের ঝাড়ুদারীকেই বেঁছে নিয়েছিলেন। যার চোখের ইশারায় বল্খের সমস্ত কাজ পরিচালিত হতো, তিনি তাঁর পীর ছাহেব ক্বিবলা-এর দরবার শরীফের ঝাড়ুদার। ময়লার পাত্র তাঁর মাথায় শোভা পায়। বন-জঙ্গল হতে কাঠের বোঝা বহন করে পীর ছাহেব ক্বিবলা-এর খিদমতে আঞ্জাম দেন।
তেমনি বাংলার মূলকের স্বনামধন্য, বেমেছাল ব্যক্তিত্ব, মহান আলিমে দ্বীন, হযরত শায়খ আলাউল হক রহমতুল্লাহি আলাইহি। যার রোবের (প্রভাব-প্রতিপত্তি) কারণে সমস্ত আলিম-উলামা সর্বদা তটস্থ থাকতেন। তিনি সেই প্রভাব প্রতিপত্তিকে জলাঞ্জলী দিয়ে জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত স্বীয় পীর ছাহেব, কুতুবুল মাশায়িখ, শাইখুল মিল্লাত হযরত আঁখি সিরাজুদ্দীন উছমান আওদাহী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর খিদমতকে ইহ্কাল ও পরকালীন মুক্তি তথা আল্লাহ্ পাক ও তাঁর হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মারিফত-মুহব্বত হাছিলের একমাত্র অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করলেন। যিনি ছিলেন এতদিন সমস্ত আলিম-উলামাগণের মাখদুম; তিনি আজ খাদিম। শীত-গ্রীষ্ম সকল ঋতুতে ছফর ও মুকিম সকল অবস্থায় স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলা-এর খিদমতে গরম পানি সরবরাহ্ এবং গরম খাবার পরিবেশনের নিমিত্তে স্বীয় মাথা মুবারকে গরম চুলা বহন করতেন। যার ফলশ্রুতিতে তাঁর মাথা মুবারক হতে সমস্ত চুল মুবারক উঠে গিয়েছিলো। (তাজকিরাতুল আউলিয়া)
যামানার ইমাম, ইমামুল আইম্মা, মুহ্ইস্ সুন্নাহ্, কুতুবুল আলম, মুজাদ্দিদুয্ যামান, মুজাদ্দিদে আ’যম, আওলার্দু রসূল, সাইয়্যিদুনা হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলীকে বলতে শুনেছি; তিনি বলেছেন, “হযরত আবূ সাঈদ রহমতুল্লাহি আলাইহি যেদিন হযরত নিজামুদ্দীন বলখী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর দরবার শরীফে এলেন সেদিন তাঁকে স্বসম্মানে যথাযথ তা’যীম-তাকরীমের সাথে সাদর-সম্ভাষণ জানিয়ে বরণ করা হয়েছিল। মেহমান হিসেবে যত মর্যাদা-মর্তবা, আদর-আপ্যায়ন করার দরকার তার কোন দিকই বাদ রইলনা। উপরন্তু পীর ছাহেব ক্বিবলা-এর আওলাদ বলে পীর ছাহেব ক্বিবলা-এর মতই সম্মান দেখানো হলো।
উল্লেখ্য যে, হযরত আবূ সাঈদ রহমতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন ইমার্মু রসিখীন, হুজ্জাতুল আশিকীন হযরত আব্দুল কুদ্দুস গাঙ্গুহী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর নাতি। আর ইমামুল মুত্তাক্বীন হযরত নিজামুদ্দীন বলখী রহমতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন তাঁর বিশিষ্ট খলীফা।
অত্যন্ত তা’যীম-তাকরীম, আদব এবং শ্রদ্ধার সাথে অনেক দিন অতিবাহিত হলো। বিশেষ মেহমান হিসেবে বিশেষ স্থানে থাকার ব্যবস্থাও করা হয়েছিল। (অসমাপ্ত)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার: পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৭২)
হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (২৫৯) বিশুদ্ধ নিয়ত এবং তার ফযীলত ও গুরুত্ব (৩)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৭৩)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৭৪)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৭৫)