-হযরত মাওলানা মুফতী সাইয়্যিদ মুহম্মদ আব্দুল হালীম
প্রসঙ্গ : স্বীয় শায়খ বা মুর্শিদ ক্বিবলা-উনার মুহব্বত ও সন্তুষ্টির লক্ষ্যে নিম্নলিখিত দশটি মাক্বাম হাছিল করার কোশেশ করবে।
রিয়াযত-মাশাক্কাত তথা কাম ও মোহ ত্যাগ করতঃ আত্মার চিকিৎসা করা শরীয়তের নির্দেশ
পূর্ব প্রকাশিতের পর
আল্লাহ পাক তিনি বলেন, æতারা সংসার জীবনের প্রতি সন্তুষ্ট থাকে এবং তাতে আনন্দ অনুভব করে।” আল্লাহ পাক তিনি আরো বলেন, æপরকালের তুলনায় পার্থিব জীবন ক্ষণস্থায়ী সম্পদমাত্র।” আল্লাহ পাক তিনি বলেছেন, æজেনে রাখ, এই পার্থিব জীবন খেল তামাশা, সৌন্দর্য প্রদর্শন তোমাদের পরস্পরের মধ্যে প্রতিযোগিতা এবং ধন ও জনের বৃদ্ধি এসব তোমাদের জন্য মন্দ। আমরা আল্লাহ পাক উনার নিকট এসব থেকে মুক্তি চাচ্ছি।”
দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ছূফীদের মধ্যে যাঁরা উচ্চ সংযমের অধিকারী, আনন্দের সময় তারা তাদের হৃদয়কে ধন-সম্পদ দ্বারা পরীক্ষা করে দেখেছেন যে, তখন হৃদয় কঠিন, ঘৃণিত এবং জঘন্য হয়। আল্লাহ পাক উনার যিকির ও আখিরাতের স্মরণের ফলাফল থেকে দূরবর্তী হয়ে যায়। তাঁরা দুঃখের সময় উনাদের হৃদয়কে পরীক্ষা করে দেখেছেন যে, তখন তা কোমল, দয়ালু, নির্মল এবং যিকিরের প্রভাবে কবুল হবার উপযুক্ত হয়। তদ্দারা তারা অবগত হয়েছেন যে, দীর্ঘস্থায়ী দুঃখে মুক্তি লাভ করা যায় এবং স্ফূর্তি ও অনর্থক জিনিসের উপাদানের মধ্যে থাকলে দূরবর্তী হবার কারণ ঘটে। উনাদের প্রবৃত্তি যাতে লোভ করতে না পারে সেজন্য লোভের পথ অতি যতেœর সাথে নিজের উপর উনারা বন্ধ করে দিতেন। উনারা জানতেন যে, হালাল কার্যের হিসাব দিতে হবে, হারাম কার্যের শাস্তি হবে এবং সন্দেহজনক কার্যের জন্য তিরস্কার অনিবার্য। সেটাও এক প্রকার শাস্তি। যে ব্যক্তিকে ক্বিয়ামতের ময়দানে হিসাব দিতে হবে, তাকে শাস্তি ভোগ করতে হবে। উনারা এই শাস্তি থেকে নিজেদেরকে মুক্তি দিয়েছেন এবং প্রবৃত্তি থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করত আল্লাহ পাক উনার যিকিরের মুহব্বত অর্জন করেছেন। উনারা প্রবৃত্তির সাথে বাজ পাখির ন্যায় ব্যবহার করতেন। যখন কেউ বাজ পাখিকে সুশিক্ষিত করতে ইচ্ছে করে সে তখন তাকে জঙ্গল থেকে ধরে এনে নিজের বাধ্যগত করে ও শিক্ষা দান করে। প্রথমে সে তাকে একটি অন্ধকার কক্ষে রেখে দেয়। তার ডানা দুটো সেলাই করে দেয়, যেন সে শূন্যে উড়ে যেতে না পারে এবং চতুর্দিকের বস্তুসমূহ দেখতে না পারে। তাকে সে অনুগ্রহ করে কিছু কিছু খাদ্য খেতে দেয় এবং তাতে মালিকের প্রতি তার প্রীতি জন্মে এবং সে মালিককে মুহব্বত করে। যখন সে তাকে ডাকে, সে উত্তর দেয়। যখনই মনিবের স্বর সে শোনে অমনি সে তার নিকট চলে যায়।
তদ্রƒপ নফস বা প্রবৃত্তির অবস্থা। প্রথমত প্রবৃত্তি মালিককে মুহব্বতের নজরে দেখে না এবং তার কথাও শুনতে পারে না। যখন প্রথমে নির্জনতা দ্বারা তার চোখ ও কানকে অন্যান্য লোভনীয় বস্তু থেকে বিরত রাখে এবং তারপর তাকে আল্লাহ পাক উনার যিকির ও প্রশংসা কাজে নিযুক্ত করে তখন দুনিয়ার সুখ-সম্পদ এবং লোভের পরিবর্তে আল্লাহ পাক উনার স্মরণের মুহব্বত হৃদয়ে প্রবল হয়। প্রথমে তা মুরীদের পক্ষে কষ্টকর হয় বটে; কিন্তু পরিশেষে সে তাতে আনন্দ ও মুহব্বত লাভ করে। দুগ্ধ পোষ্য শিশুকে প্রথম দুধ ছাড়ানো কষ্টকর হয়ে উঠে। তখন তার কান্না ও চিৎকার চরমে উঠে। চেষ্টা-কোশেশ করে দুধ ছাড়াতে পারলে কিছুদিন পর এরূপ হয় যে, জোর করে তাকে দুধ পান করতে দিলেও সে তা পান করে না। তদ্রƒপ পশুর বেলায়ও প্রথমে এই অবস্থা হয়। সে প্রথমত লাগাম ও জিন থেকে ছুটে যায়। তার উপর আরোহণ করা দুষ্কর হয়ে উঠে। জোর করে তাকে তা করাতে হবে। তারপর সে তাতে আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হয়ে যায় এবং বাধ্য ও অনুগত হয়ে পড়ে। তদ্রƒপ প্রবৃত্তিকেও বাজ পাখি ও পশু এবং দুগ্ধপোষ্য শিশুর ন্যায় আদব শিক্ষা দিতে হয়। কেননা প্রবৃত্তি সম্বন্ধে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেছেন, ফেরেশতা হযরত জিবরাইল আলাইহিস সালাম আমাকে বলেছেন, যাকে ভালবাসতে চান তাকে ভালবাসেন কিন্তু তা থেকে আপনাকে পৃথক হতেই হবে।
কাজেই, যে ব্যক্তি যে বস্তুকে মুহব্বত করে তাকে নিশ্চয়ই সে বস্তু ত্যাগ করতে হবে; কিন্তু যার সাথে বিচ্ছেদ নেই (অর্থাৎ আল্লাহ পাক উনার যিকির) তা সৌভাগ্যবশত করে যাবে। এসব ব্যাপার প্রথম ধৈর্যবৃত্তি দ্বারা পূর্ণ করতে হবে। কেননা আখিরাতের তুলনায় এ পার্থিব জীবন ক্ষণস্থায়ী। এমন কোন বুদ্ধিমান বা জ্ঞানী লোক নেই যে, ছফরের কষ্ট একমাস সহ্য করে ও তাতে সন্তুষ্ট থেকে কোন শিল্পকাজ শিক্ষা করে না। সে বুঝে যে এরপর এক বছর বা বহু সময় সে সুখে থাকতে পারবে। অনন্ত জীবনের তুলনায় ইহলোকে প্রত্যেক জীবনই ক্ষণস্থায়ী; সুতরাং একমাস বা একবছর বা তদূর্ধ্ব সময় ধরে সে অতিরিক্ত জ্ঞান শিক্ষা লাভ করা যায় এবং তাতে অন্য জীবনে লাভ হয়, তাই চেষ্টা-সাধনা করে অর্জন করা অতি আবশ্যকীয় কর্তব্য। প্রত্যেক ব্যক্তির রিয়াযত-মাশাক্কাত বা চরিত্র উন্নতির লক্ষ্যে পরিশ্রম তার অবস্থার পার্থক্যের কারণে বিভিন্ন রকম হয়; কিন্তু মূল কথার পার্থক্য বা বিভিন্নতা নেই। অর্থাৎ সংযমের ধন-সম্পদ অধিকারে থাকলে মনে যে আনন্দ জন্মে তা ত্যাগ করবে। ধন এবং প্রবৃত্তির লোভ বর্জন করবে। ওয়াজ-নছীহত দ্বারা যে নাম যশঃ অর্জনের আশা করা হয়, তা ত্যাগ করবে। বিচার ও প্রভুত্ব দ্বারা সম্মান পাবার আশা ত্যাগ করবে। ছাত্র ও শিষ্য অধিক সংখ্যা পাবার আশা ত্যাগ করবে। কাজেই, প্রথমে আনন্দ ও স্ফূর্তির উপাদান ত্যাগ করবে। যদি তাকে তা থেকে কিছু না দেয়া হয় এবং তাকে বলা হয়, তোমার ওই জিনিস না পাওয়ায় তোমার ছওয়াব আখিরাতে হ্রাস পাবে না। তাতে সে যদি অসন্তুষ্ট হয় ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়, তবে জানা উচিত যে, সে ওই লোকের অন্তর্ভুক্ত, যাদের সম্বন্ধে আল্লাহ পাক উনি বলেছেন, তারা পার্থিব জীবনে সন্তুষ্ট এবং তাতে শান্তি লাভ করে। এটা তার পক্ষে বিষতুল্য। তারপর যখন যে আনন্দের উপাদান ত্যাগ করে, সে যেন লোকজন থেকে পৃথক হয়ে একাকী থাকে। আর নিজের হৃদয়ের দিকে লক্ষ্য রাখে। যেন তা আল্লাহ পাক উনার যিকির এবং উনার সম্বন্ধে চিন্তায় নিমগ্ন থাকে, যে লোভ ও শয়তানের কুমন্ত্রণা তার হৃদয়ে প্রকাশ পায়, তা দমন করে রাখে। কেননা প্রত্যেক শয়তানী কুমন্ত্রণার একটি কারণ আছে এবং সে কারণ কর্তন না করা পর্যন্ত তা চলতে থাকে। অবশিষ্ট জীবন তার মধ্যে অতিবাহিত করতে হয়। মৃত্যু পর্যন্ত এ জিহাদের পরিসমাপ্তি নেই। (ইহয়াউ উলূমিদ্দীন-২/৪২৫)
রিয়াযত-মাশাক্কাত বা সাধানার শেষ সীমা হচ্ছে তায়াল্লুক মা’য়াল্লাহ বা আল্লাহ পাক উনার সাথে গভীর সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা, তায়াল্লুক মা’য়ার রসূল বা সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সাথে গভীর সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা এবং তায়াল্লুক মা’য়াশ শায়খ বা স্বীয় শায়খ বা মুর্শিদ ক্বিবলা উনার সাথে গভীর সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা । আর এই হাল বা অবস্থা তখন হাছিল হবে যখন অন্তর থেকে সবকিছুর আকর্ষণ মুক্ত হবে।
হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, হৃদয়ের সাথে সর্বদা আল্লাহ পাক উনাকে সংযুক্ত রাখার বিষয়টি অন্যান্য জিনিস থেকে হৃদয়কে মুক্ত করতে না পারলে সম্ভব হয় না। দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা-সাধনা না করলে অন্য চিন্তা হৃদয় থেকে দূর করা যায় না। যখন হৃদয় আল্লাহ পাক উনার সাথে সংযুক্ত হয়ে যাবে তখন আল্লাহ তায়ালা উনার দীদার তার নিকট প্রকাশ পাবে। সত্য তার নিকট উদ্ভাসিত হবে এবং আল্লাহ পাক উনার এমন সূক্ষ্ম তত্ত্বসমূহ তার নিকট প্রকাশ পাবে যা বর্ণনা করা সাধ্যাতীত এবং নিষিদ্ধ। যখন তন্মধ্যে কিছু আল্লাহ পাক উনার পথযাত্রীদের নিকট প্রকাশ পায় তখন তা ওয়াজ নছীহতরূপে বর্ণনা করার আগ্রহ জন্মে। কেননা, তাতে হৃদয়ের মধ্যে আনন্দ পাওয়া যায়, যা ইতঃপূর্বে কখনো পাওয়া যায়নি। সে আনন্দ সেই অর্থের আবির্ভাবের বিশদ বিশ্লেষণ উপদেশমূলক বাক্যের সৌন্দর্য তা বর্ণনা করার নিয়ম-পদ্ধতি কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ-এর প্রমাণ দ্বারা তা বর্ণনা করা এবং সুন্দর কথা দ্বারা তার বর্ণনার চিন্তার দিকে নিয়ে যাবে। কখনো শয়তান কল্পনার মধ্যে এই মন্ত্রণা নিক্ষেপ করে যে, যে সব মৃত আত্মা আল্লাহ পাক থেকে গাফিল হয়ে রয়েছে, তাদের জন্য এটা সঞ্জীবনী এবং তুমি আল্লাহ পাক এবং উনার বান্দাদের মধ্যবর্তী ওসীলা মাত্র। তুমি উনার বান্দাগণকে উনার দিকে আহ্বান কর। এর মধ্যে তোমার কোন অংশ নেই এবং তোমার আত্মার জন্য কোন উপকার নেই। শুধু এটা গাফিল লোকদের জন্য। শয়তানের কুমন্ত্রণা এরূপেও প্রকাশ পায়- তোমার বন্ধু বান্ধবদের নিকট এটা প্রকাশ করে দাও, কেননা তারা তোমার চেয়ে এ বিষয় সুন্দর করে বুঝতে পারবে এবং জনসাধারণের মনকে তোমার দিকে আকর্ষণ করতে সমর্থ হবে। এরূপে যে তোমার অন্তরের মধ্যে হিংসা বিদ্বেষের বিচ্ছুকে জাগ্রত করে দেয় যদি তার সেই মন্ত্রণাকে তুমি গ্রহণ করো।
যদি সেই আলোড়ন সত্য হয় এবং লোকদেরকে সরল পথে আসার আহ্বান করবার তোমার লালসা হয়, তখন সেই আনন্দকে বড় করে দেখবে এবং বলবে, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ পাক উনার জন্য, যিনি আমাকে এ লোকগণ দ্বারা সাহায্য করেছেন, যারা উনার বান্দাগণের মঙ্গলের জন্য আমাকে পরামর্শ দিয়েছেন, সে ওই ব্যক্তির ন্যায়, যে কোন মৃত ব্যক্তির লাশকে নষ্ট হতে দেখলে তা বহন করে দাফন করা আবশ্যক মনে করে। শরীয়ত অনুসারে যে কার্যে সাহায্য করার জন্য তোমার নিকট কেউ আসলে তুমি আনন্দিত হও এবং তোমার কোন প্রকার হিংসা-বিদ্বেষ তার প্রতি থাকে না, তদ্রূপ গাফিল বা অসতর্ক ব্যক্তিগণ মৃত ব্যক্তির ন্যায়। বক্তাগণ তাদেরকে জাগ্রত এবং জীবিত করে; সুতরাং প্রত্যেক বক্তা সে বিষয়ে পরস্পরকে সাহায্য করে। তাতে তোমার আরো আনন্দিত হওয়া উচিত।
এরূপ অনেক কষ্টকর বিষয় দেখা যায়। মুরীদ বা ধর্মপথযাত্রীর তা থেকে সতর্ক হওয়া উচিত। কেননা যার নিকট প্রথম পথ উন্মুক্ত হয়েছে, তার উপর থেকে পথ কর্তন করে দেয়া শয়তানের বড় কুমন্ত্রণা। কেননা এই পার্থিব জীবনের প্রতি মানুষের আসক্তি প্রবল থাকে। এজন্যই আল্লাহ পাক তিনি বলেন,
بل تؤثرون الحياة الدنيا
অর্থাৎ- æবরং তোমরা পার্থিব জীবনকে ভালবাস।” তারপর তিনি বললেন যে, মন্দ মানব প্রকৃতির মধ্যে আদি থেকে বিদ্যমান এবং প্রাচীনকালের ধর্মগ্রন্থে তার বর্ণনা রয়েছে। আল্লাহ পাক তিনি বলেন,
ان هذا لفى الصحف الاولى صحف ابراهيم وموسى
অর্থাৎ- æনিশ্চয়ই এটা পূর্ববর্তী ধর্মগ্রন্থে আছে। হযরত ইবরাহীম খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম এবং হযরত মূসা কালীমুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনাদের ধর্ম গ্রন্থে।” এটাই মুরীদের রিয়াযতের পদ্ধতি এবং আল্লাহ পাক উনার দীদারের দিকে যাবার ক্রমিক সুশৃঙ্খল নিয়ম। (অসমাপ্ত)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে-১২০
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (১২১)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (১২২)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে-১২৪
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১২৫)