হযরত মাওলানা মুফতী সাইয়্যিদ মুহম্মদ আব্দুল হালিম
পীর ছাহেব ক্বিবলার দরবার শরীফে অবস্থানের আদব প্রসঙ্গ: দরবার শরীফের প্রত্যেকটি বিষয় এবং বস্তুর প্রতি ভদ্রতা, নম্রতা ও বিনয়ভাব সর্বদা বজায় রাখা। যখনই কেউ বিনীত-বিনম্র হয়েছে, নিজকে ক্ষুদ্র জ্ঞান করেছে তখনই আল্লাহ পাক-এর রহমতের দ্বার তার জন্য উন্মুক্ত হয়েছে। সুলতানুল আরিফীন হযরত বাইজিদ বোস্তামী রহমতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন আউলিয়াকূল শিরোমনি। আদত (অভ্যাস) অনুযায়ী একদিন তিনি রাতে ইবাদত-বন্দিগীতে লিপ্ত ছিলেন। বাইরে বের হওয়ার প্রয়োজন হলো। তিনি বাইরে বের হলেন। আর দেখতে পেলেন, আল্লাহ পাক-এর রহমত অকাতরে বর্ষিত হচ্ছে। তিনি মনে মনে চিন্তা করলেন, এই বরকত ও নিয়ামতপূর্ণ রাতে কুল-কায়িনাতের সকলের নাযাতের সুপারিশ করবেন দয়াময় আল্লাহ পাক-এর পবিত্র দরবারে। হাত উঠাবেন এমন সময় তাঁর বিনীত-বিনম্রতাসূলভ গুণাবলী জাহির (প্রকাশ) হলো। তিনি মনে মনে বলতে লাগলেন, “আমি কে! কি বা আমার যোগ্যতা আছে কূল কায়িনাতের সুপারিশ করার!! যেখানে আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হচ্ছেন সমস্ত কায়িনাতের জন্য রহমত; এ বিষয়টি তো তাঁরই সাথে একান্তভাবে সংশ্লিষ্ট। তিনিই হচ্ছেন এ কাজের জন্য একমাত্র মনোনীত।”আর অমনি গায়িবী নেদা হলো, “হে বাইজিদ! আপনাকে সুলতানুল আরিফীন (আউলিয়ায়ে কিরামগণের সুলতান তথা বাদশাহ্) হিসেবে কবুল করা হলো।” (সুবহানাল্লাহ) (তাযকিরাতুল আউলিয়া) সাইয়্যিদুত্ ত্বয়িফা হযরত জুনাইদ বাগদাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি একদিন এক ঈদের রাতে স্বীয় খানকা শরীফে বসা ছিলেন। চারজন রিজালুল গায়িব (লোক চক্ষুর অন্তরালে বিচরণকারী লোক যারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে মানুষদেরকে সাহায্য-সহযোগিতা করেন) তাঁর খিদমতে হাযির হলেন। সাইয়্যিদুত্ ত্বয়িফা হযরত জুনাইদ বাগদাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি প্রসঙ্গক্রমে তাঁদের একজনকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আপনি আগামী কাল ঈদের নামায কোথায় আদায় করবেন?’ উক্ত ব্যক্তি জবাবে বললেন, ‘মক্কা শরীফে।’ দ্বিতীয়জনকে বললেন, ‘আপনি কোথায়?’ তিনি বললেন, ‘মদীনা শরীফে।’ তৃতীয়জনকে বললেন, ‘আপনি?’ তিনি বললেন, ‘বাইতুল মুক্বাদ্দাসে।’ চতুর্থজনকে বললেন, ‘আপনি কোথায় ঈদের নামায আদায় করবেন?’ তিনি বললেন, ‘বাগদাদ শরীফেই আপনার মহান সান্নিধ্যে।” দরবার শরীফের প্রতি তা’যীম-তাকরীম ও আদব বা শিষ্টাচারপূর্ণ জাওয়াব শুনে তিনি খুশি হলেন এবং বললেন,
انت ازهدهم واعلهم وافضلهم.
অর্থঃ- ‘আপনি তাঁদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ জাহিদ (দুনিয়া বিরাগী) সুমহান ব্যক্তিত্ব এবং সবচেয়ে মর্যাদা সম্পন্ন।’ (ফাওয়ায়িদুল ফাওয়াদ) পূর্ববর্তী ইমাম-মুজতাহিদ এবং আউলিয়ায়ে কিরামগণ স্বীয় পীর ছাহেবের দরবার শরীফের প্রতি এরূপ ভদ্রতা, নম্রতা ও বিনয়ভাব বজায় রেখেছেন তা পরবর্তী সকলের জন্য স্মরণীয় ও বরণীয়। সুলতানুল আরিফীন হযরত আবুল হাসান খারকানী রহমতুল্লাহি আলাইহি মুরীদ-মু’তাক্বিদীনকে এই মর্মে ওছীয়ত করলেন যে, “আমার ইন্তিকাল হলে তোমরা যখন আমাকে কাফন পড়িয়ে দাফন করবে তখন আমার কবরকে স্বাভাবিক কবরের চেয়ে ত্রিশ গজ বেশী গভীর করবে। কারণ, বোস্তাম শহরের চেয়ে খারকান শহরটি উঁচু। আমার পীর ছাহেব ক্বিবলা যে দরবার শরীফে শায়িত আছেন তার তুলনায় আমার কবর উঁচু হওয়া হবে আদবের খিলাফ। সুতরাং ত্রিশগজ গভীর করলে সে বেয়াদবী হতে মুক্তি পাওয়া যাবে।” (তাযকিরাতুল আউলিয়া)
পক্ষান্তরে যারা আউলিয়ায়ে কিরামের দরবার শরীফের প্রতি বিনীত-বিনম্র হয়না, তা’যীম-তাকরীম করেনা তারা কতটুকু হালাকীর (ধ্বংস) সম্মুখীন হয় তা নিম্নোক্ত ঘটনার দ্বারা সহজেই অনুমান করা যায়। মাহবুবে ইলাহী হযরত নিজামুদ্দীন আউলিয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, একদিন এক ব্যক্তি সাইয়্যিদুল আউলিয়া, মাহবুবে সুবহানী, গাউছূল আ’যম হযরত বড় পীর ছাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর দরবার শরীফে আসলেন। খানকা শরীফের দরজার সম্মুখে এক ব্যক্তিকে দেখতে পেলেন যে, হাত-পা ভাঙ্গা অবস্থায় পড়ে রয়েছে। তার এরূপ দুরবস্থা দেখে তাঁর দয়া হলো। তিনি খানকা শরীফের ভিতরে প্রবেশ করতঃ গাউছূল আ’যম হযরত বড় পীর ছাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর খিদমতে আরজু জানালেন, যেন উক্ত ব্যক্তির দুরবস্থার কারণ বলেন এবং তার সুস্থতার জন্য দোয়া করেন। গাউসুল আ’যম, সাইয়্যিদুল আউলিয়া হযরত বড় পীর ছাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, “আমার সাথে বেয়াদবী করার কারণে তার ঐ অবস্থা হয়েছে।” উক্ত ব্যক্তি আবার সবিনয়ে আরজ করলেন, ‘হুযূর! কি সেই বেয়াদবী?’ গাউছূল আ’যম হযরত বড় পীর ছাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, সেই ব্যক্তি একজন আবদাল। গতকাল সে দুইজন আবদালসহ আকাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল। যখন আমার খানকা শরীফের নিকটবর্তী হলো তখন খানকা শরীফের আদব ও সম্মানার্থে একজন খানকা শরীফের ডান পার্শ্ব দিয়ে চলে গেলেন অন্যজন বাম পার্শ্ব দিয়ে চলে গেলেন। আর এই বেয়াদব আদবের কোন তোয়াক্কা না করে নিঃসংকোচে খানকা শরীফের উপর দিয়ে চলে যাচ্ছিল। যার কারণে সে নিচে পড়ে তার এই অবস্থা হয়েছে। মূলতঃ এটা তার বেয়াদবীর শাস্তি।” (ফাওয়ায়িদুল ফাওয়াদ)
উল্লেখ্য যে, যে কোন বস্তু হাছিলের জন্য অন্বেষণকারীর ন্যূনতম কিছু যোগ্যতা থাকা আবশ্যক। ইল্ম হাছিল করা বা আলিম হওয়ার জন্য ইল্ম এবং আলিমকে মুহব্বত করা প্রথম শর্ত। শিক্ষকের প্রতি যথাযথ তা’যীম-তাকরীম বজায় রাখা, তাঁদের প্রতি সুধারণা পোষণ করা আবশ্যক। কেননা যার মাধ্যমে ইল্ম পাবে এবং দুনিয়া-আখিরাতে সম্মানিত ও মর্যাদাবান হবে তাঁরই যদি কেউ হক আদায় করতে না পারে তবে আল্লাহ পাক এবং তাঁর হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হক আদায় করবে কি করে? সুতরাং ইল্ম হাছিলের পথে ইল্ম ও আলিমকে মুহব্বত করা তাঁদের যথাযথ সম্মান-ইজ্জত দেয়া শিক্ষার্থীদের প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য। পাশাপাশি শিক্ষাপোকরণ যেমন খাতা-কলম, বই-পুস্তক, চেয়ার-টেবিল, দোয়াত-কালি ইত্যাদির সম্মান ও ইজ্জত রক্ষা করা আবশ্যক। সর্বোপরি যে প্রতিষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট থেকে ইল্ম অর্জন করছে সেই প্রতিষ্ঠানের প্রতি মুহব্বত রাখা তাঁর তা’যীম-তাকরীম করা, যতœ নেয়া অপরিহার্য বটে। তবে অবশ্যই তা হতে হবে দ্বীনি প্রতিষ্ঠান। আল্লাহ পাক-এর হাবীব, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
المسجد بيت الله والمدرسة بيتى.
অর্থঃ- “মসজিদ হচ্ছে আল্লাহ পাক-এর ঘর আর মাদ্রাসা হচ্ছে আমার ঘর।”
সুতরাং কোন দ্বীনি প্রতিষ্ঠানের প্রতি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করা, তার সম্মান-ইজ্জতকে ভূলুণ্ঠিত করা কঠিন গুণাহ্র কাজ। হক্বানী আলিম-উলামাগণ ফতওয়া দিয়েছেন যে, ‘যে কলম দ্বারা লিখা হয়েছে, সে কলম নিক্ষেপ করা বা ছুড়ে মাড়া মাকরূহ। কাগজকে ঢিলা-কুলুখ বানানো জায়িয নেই।’ (তরিকুল ইসলাম) অনুরূপ বেঞ্চ-টেবিলের উপর পা তুলে বসা, পা দ্বারা কাগজ মাড়ানো ইল্মের হুরমত-ইজ্জত লুণ্ঠিত হয় এরূপ সমস্ত কাজই গুণাহ্র কারণ। এমনিভাবে শিক্ষাপোকরণ যথা কালি-কলম, খাতা-পত্র, কিতাবাদী কিংবা কোন লিখাসহ ইস্তিঞ্জাখানায় গমন করা অনুচিত। ইমাম-মুজতাহিদ, আউলিয়ায়ে কিরামগণ ইল্ম ও আলিমের কিরূপ মুহব্বত ও তা’যীম-তাকরীম করেছেন তা সকলেই অবগত। বিশেষতঃ শিক্ষাপোকরণের প্রতি যে সম্মান প্রদর্শন করেছেন, হুরমত-ইজ্জত বজায় রেখেছেন শিক্ষানুরাগীদের আক্বলকে শানিত করার জন্য সে সম্পর্কে দু’একটি ঘটনার অবতারণা করা দরকার। আফজালুল আউলিয়া, ইমামে রব্বানী, হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর নাম মুবারক জানেনা এমন লোকের সংখ্যা খুবই কম। তিনি একবার অনেক ব্যস্ততার মধ্যে প্রাকৃতিক কারণে ইস্তিঞ্জাখানায় গেলেন। ভিতরে প্রবেশের পর তাঁর হাতের নখের ভিতর একটু কালি দেখতে পেলেন। আর সাথে সাথে ইস্তিঞ্জাখানা হতে বের হলেন। অত:পর ভালভাবে তা ধুয়ে আবার হাজত পুরণের জন্য ইস্তিঞ্জাখানায় প্রবেশ করলেন। অন্য একদিনের ঘটনা। তিনি মেহমান বেশে জনৈক মুরীদের বাড়ীতে তাশরীফ আনলেন। বসতে দেয়া হলো খাটের উপর। মুরীদের মন পড়ে থাকে সর্বদা স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলা-এর সন্তুষ্টি-রেজামন্দির প্রতি। জীবনের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে হলেও পীর ছাহেব ক্বিবলার সন্তুষ্টি চাই। উক্ত মুরীদের ক্ষেত্রেও তার একটুও ব্যতিক্রম হয়নি। সর্বোচ্চ আসনে তিনি বসতে দিলেন স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলা ইমামে রব্বানী, মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহিকে। আর তিনিও সানন্দে সেখানে বসলেন। কিন্তু একটু পরেই তিনি সেখান থেকে উঠে দাঁড়ালেন এবং মুরীদকে ইশারা করলেন খাটের উপর থেকে তোষক উঠাতে। দেখা গেল, সেই তোষকের নিচে এক টুকরা কাগজ। সে কাগজের টুকরাটি তিনি সরাতে বললেন। আর যথাযথভাবে সে আদেশ পালিত হলো। অত:পর তিনি সেখানে বসলেন। (তাযকিরাতুল আউলিয়া)
হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (২৫৮)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার: পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৭৮)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮০)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৭৬)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮২)