لكل نبى عدوا شياطين الانس و الجن
অর্থ: প্রত্যেক নবী-রসূলগণের শত্রু তারাই যারা জিন-ইনসানের মধ্যে শয়তান প্রকৃতির। (সূরা আনয়াম-১১২)
কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ মারফত জানা যায়, আল্লাহ পাক-এর প্রথম নবী ও রসূল হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম থেকে শুরু করে আখিরী রসূল হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত প্রত্যেক নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালাম-এর শত্রু ছিল। এমন একজন নবী কিংবা রসূল অতীত হননি যার কোন বিরোধিতা করা হয়নি বা শত্রু ছিল না।
অর্থাৎ হক্ব ও নাহক্বের দ্বন্দ্ব শুরু থেকেই। এবং যারা নাহক্ব বা বাতিলপন্থী যুগে যুগে তাদের কাজই হলো হক্বপন্থীদের বিরোধিতা করা, সমালোচনা করা। এই বিরোধিতা ও সমালোচনা থেকে রেহাই পাননি যিনি কুল-কায়িনাতের নবী নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও। শত্রুরা উনার বিরোধিতা করতে গিয়ে নামাযরত অবস্থায় উনার উপরে উটের নাড়ি-ভুড়ি নিক্ষেপ করেছে। উনার চলার পথে কাঁটা দিয়ে রেখেছে। উনার প্রতি ঢিল ছুড়েছে, উনাকে পাগল, যাদুকর, জিনে আছর করা রোগী, ধর্মত্যাগী ইত্যাদি বলে অভিযুক্ত করেছে। এমনকি ‘শিআবে আবু তালিব’-এ উনাকে অবরোধ পর্যন্ত করে রেখেছে।
এ প্রসঙ্গে বর্ণিত রয়েছে, আনুষ্ঠানিক নুবুওওয়াত লাভের পর নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রথমে মক্কাবাসীদেরকে গোপনে ইসলামের দাওয়াত দিতে শুরু করেন। মহিলাদের মধ্যে উম্মুল মু’মিনীন হযরত খাদীজাতুল কুবরা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা, বয়স্ক পুরুষদের মধ্যে হযরত আবু বকর ছিদ্দীক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এবং বালকদের মধ্যে হযরত আলী র্কারামাল্লাহু ওয়াজহাহু রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন। অতঃপর হযরত আবু বকর ছিদ্দীক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর প্রেরণায় হযরত সা’দ বিন আবী ওয়াক্কাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত জুবায়ের ইবনে আওয়াম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত তালহা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু প্রমুখ ইসলাম গ্রহণ করেন।
এরপর যখন فاصدع بما تؤمر ‘যা আপনাকে আদেশ করা হয়েছে তা প্রকাশ্যে প্রচার করুন” আয়াত শরীফ নাযিল হয় তখন নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রকাশ্যভাবে ইসলাম প্রচার করতে শুরু করেন। এর ফলে কুরাঈশরা তাঁর ঘোর শত্রুতে পরিণত হলো এবং বিভিন্ন প্রকার জুলুম করতে লাগলো। যারা ইসলাম কবুল করতেন তাঁদেরকেও কাফির কুরাঈশরা নানা প্রকার শাস্তি প্রদান করতে লগলো। এ অবস্থা দেখে নূরে মুজাস্সাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাহি ওয়া সাল্লাম বললেন, যারা (ঈমান আনার পর) নিজেদেরকে নিরাপদ মনে না করেন তারা যেন হাবশায় হিজরত করেন। সেখানকার বাদশাহ ন্যায়পরায়ণ। তিনি কখনো কারো উপর জুলুম করেন না। যখন আল্লাহ তায়ালা আমাদের শক্তি দান করবেন তখন চলে আসবেন। তাঁর আদেশ অনুযায়ী আনুষ্ঠানিক নুবুওওয়াতের পঞ্চমবর্ষে ১২ জন মুসলমান হাবশায় হিজরত করেন। তাঁদের মধ্যে হযরত উছমান যুন্নূরাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এবং হযরত জুবাইর ইবনে আওয়াম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর নাম মুবারক উল্লেখযোগ্য। এটি ইসলামের প্রথম হিজরত নামে পরিচিত। এর কিছুকাল পরে হযরত জা’ফর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এবং আরো কয়েকজন হিজরত করেন। এইভাবে একে একে বেশ কিছু মুসলমান হিজরত করার পর মক্কা শরীফ-এর কাফিরদের গাত্রদাহ শুরু হলো। তারা কিছু উপঢৌকনসহ তাদের মধ্যে দু’ব্যক্তিকে দূতরূপে হাবশায় বাদশাহ নাজ্জাশীর নিকট প্রেরণ করলো। কাফিরদের দাবি, বাদশাহ যেন মুহাজির মুসলমানদের মক্কা শরীফ-এ ফেরত পাঠিয়ে দেন। বাদশাহ তাদের আবেদন না মঞ্জুর করলেন এবং তাদেরকে অপমানিত করে তাড়িয়ে দিলেন।
কাফিরদের প্রেরিত দূত হাবশা হতে অপমানিত হয়ে প্রত্যাবর্তনের পর কাফিরদের ক্রোধ আরো বৃদ্ধি পেল। তারা অঙ্গীকার করলো, বনী হাশিম এবং বনী তালিবের সাথে তারা কোন বিবাহ-শাদি দিবে না, ক্রয়-বিক্রয় করবে না এবং সর্বোতভাবে তাদের বর্জন করে চলবে। সমস্ত কাফিরদেরকে এই বিষয়ে অবহিত করার জন্য তখনকার নিয়ম অনুযায়ী তারা এই অঙ্গীকারপত্র খানায়ে কা’বা শরীফ-এর দরজায় লটকিয়ে দিল। প্রায় তিন বৎসর পর্যন্ত এই বয়কট বজায় ছিল।
বর্ণিত রয়েছে, এই বয়কটকালে ‘শিআবে আবু তালিব’ এ যারা অবস্থান করছিলেন তাদের মাঝে খাদ্য-পানিয় সম্পূর্ণ শেষ হয়ে যায়। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছল খাদ্যের অভাবে তাঁরা গাছের লতা-পাতা, ছাল-বাকলা পর্যন্ত খেয়ে শেষ করে ফেলেন। অবশেষে নিজেদের চামড়ার জুতা-সেন্ডেল সিদ্ধ করে তা চিবিয়ে ক্ষুধা নিবারণের চেষ্টা করেন।
অতঃপর ওহী মারফত নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানলেন যে, কাফিরদের এই অঙ্গীকারপত্র উই পোকায় বিনষ্ট করে দিয়েছে এবং একমাত্র ‘আল্লাহু’ শব্দ ব্যতীত সম্পূর্ণ অঙ্গীকারপত্র উই পোকায় খেয়ে ফেলেছে। তিনি চাচা আবু তালিবের নিকট ওহীর কথা ব্যক্ত করলেন।
আবু তালিব কোন কোন কুরাঈশ সরদারকে ডেকে এই ঘটনা অবগত করে বললেন, যদি এই কথা সত্য হয়, তাহলে অন্ততঃপক্ষে তোমাদের আত্মীয়-স্বজনদের সহিত সম্পর্কচ্ছেদ অঙ্গীকার প্রত্যাহার করে নেয়া উচিত। আবু তালিবের কথা শুনে তারা তৎক্ষণাৎ কা’বা শরীফ-এ গিয়ে অঙ্গীকারপত্র খুলে দেখতে পেল সত্য সত্যই ‘আল্লাহু’ শব্দ ব্যতীত আর সমস্তই উই পোকায় খেয়ে ফেলেছে।
এই ঘটনার পর খোদ কুরাঈশদের মধ্যেই অঙ্গীকার ভঙ্গের জন্য আন্দোলন শুরু হলো। কয়েকদিন পর তারা উক্ত অঙ্গীকারপত্র ছিঁড়ে ফেলে পুনরায় বনী হাশিম ও বনী তালিব গোত্রের সহিত প্রীতির মনোভাব প্রদর্শন করলো।
অতএব, ‘শিআবে আবু তালিব’-এর ঘটনা থেকে আজকে আমাদের জন্য যে বিষয়টা উপলব্ধি করার তা হচ্ছে, আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যিনি খাছ ক্বায়িম-মক্বাম, যামানার ইমাম, মুজতাহিদ, মুজাদ্দিদ হবেন তাঁর এবং তাঁর যারা অনুসারী হবেন তাঁদের অবশ্যই বিরোধিতা হবে।
হযরত উম্মু আহমদ খুবাইব