মূলঃ হযরত শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহ্লভী রহমতুল্লাহি আলাইহি, ভাষান্তরঃ মুহম্মদ শামসুল আলম
হযরত নাছিরুদ্দীন চেরাগে দেহলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি (ধারাবাহিক) বর্ণিত রয়েছে যে, মাহবুবে ইলাহী হযরত নিযামুদ্দীন আউলিয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর মুরীদগণ একদা সামার মজলিস তৈরী করলো। মজলিসের মধ্যে সামার অনুষ্ঠান শুরু করলো। উক্ত মজলিসে হযরত নাছিরুদ্দীন চেরাগে দেহলভী রহমতুল্লাহি আলাইহিও উপস্থিত ছিলেন। তিনি ঐ মজলিস থেকে উঠে যাচ্ছিলেন। পীর ভাই ও সাথীগণ অনুরোধ জানালেন, তিনি যাতে মাহফিলে অবস্থান করেন। তাদের অনুরোধে তিনি বললেন, এটা সুন্নত বিরোধী তরীক্বা। আমি এটাকে কখনো সমর্থন করিনা। তখন সাথীগণ বললেন, তার অর্থ আপনি সামা বা কাছীদাকে নিষেধ ও নাজায়িয মনে করেন এবং স্বীয় মুর্শিদের তরীক্বার খিলাফ আক্বীদা পোষণ করেন? তিনি তাদের প্রশ্নের জবাবে বললেন, শায়খের ‘ক্বওল’ শরয়ী হুজ্জাত, দলীল নয়। সামা জায়িযের ব্যাপারে কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ থেকে দলীল পেশ করতে হবে। তখন সাথীদের মধ্যে অনেকে সুলতানুল মাশায়িখ রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর নিকট হযরত চেরাগে দেহলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর সামা সম্পর্কিত আক্বীদা পেশ করলেন। যেহেতু তিনি মূল বিষয়টি সম্পর্কে পূর্বেই ওয়াকিফহাল ছিলেন। যার দরুণ লোকদের (স্বভাব, বিশ্বাস অনুযায়ী) বললেন, হযরত নাছিরুদ্দীন চেরাগে দেহলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর আক্বীদা বিশ্বাসই হচ্ছে সঠিক এবং তিনি এ সম্পর্কে যা বলেছেন সেটাই হক্ব। ‘সিয়ারুল আউলিয়া’ গ্রন্থে বর্ণিত রয়েছে, হযরত নাছিরুদ্দীন চেরাগে দেহলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর মাহফিলে সামার সাথে সংশ্লিষ্ট কোন প্রকার বাঁশি, বাদ্যযন্ত্র থাকতো না। এমনকি মাহফিলের মধ্যে কোন প্রকার হাত তালি দেয়ারও রেওয়াজ ছিলনা। যখন তাঁর সাথে কোন ব্যক্তির এ সম্পর্কে আলোচনা হতো এবং উক্ত ব্যক্তিটি যদি বলতো, ওমুক এসব জানতো এবং বাদ্যযন্ত্র, যন্ত্রসঙ্গীত ইত্যাদি শ্রবণ করে থাকে। তখন তিনি তাকে বারণ করতেন এবং বলতেন, বাদ্যযন্ত্র, যন্ত্রসঙ্গীত, বাঁশী, রাগ-রাগীনি ইত্যাদি শরীয়ত মুতাবিক নিষেধ এবং নাজায়িয। ‘খাইরুল মাজালিসে’ বর্ণিত রয়েছে, এক ব্যক্তি হযরত চেরাগে দেহলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর নিকট এসে প্রশ্ন করলো যে, এটা কোথায় জায়িয রয়েছে যে, সামার মাহফিলে দফ, বাঁশি, সিতারা ইত্যাদি বাজানো হবে আর ছূফী-দরবেশরা তা শ্রবণ করে (হালের বশবর্তী হয়ে) নর্তন-কুর্দন করবেন? উত্তরে তিনি বললেন, বাদ্যযন্ত্রগুলো বিনা দলীলে এবং ইজমা ব্যতিরেকেই হারাম ও গুণাহ্র কাজ। যদি কেউ তরীক্বত থেকে ছিটকে পড়তে চায় তাহলে তো তাকে শরীয়তের মধ্যে ক্বায়িম থাকতে হবে। আর যদি সে শরীয়ত থেকেও চলে যেতে ইচ্ছুক হয় তাহলে তার ঠিকানা কোথায়? প্রথমতঃ সামা হচ্ছে একটি বিতর্কীত বিষয় এবং আলিমদের মধ্যে এ ব্যাপারে ইখতিলাফ রয়েছে। যদিও কিছু শর্ত-শারায়েত মুতাবিক এটা জায়িযও ধরে নেয়া হয়; তথাপি সামা বা কাছীদার সাথে সংশ্লিষ্ট বিবিধ প্রকারের বাদ্যযন্ত্র (যেমন, ঢোল, তবলা, বাঁশী, সেতারা) ইত্যাদি নিঃসন্দেহে নাজায়িয ও হারাম। ‘জাওয়ামিল কালিমে’ বর্ণিত রয়েছে, একদিন শায়খ নাছিরুদ্দীন মাহমুদ চেরাগে দেহলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি নিজ খানকা শরীফে বসা ছিলেন। (এমতাবস্থায় কোন শায়েরের একটি শে’রের উপর) তাঁর ওজদী হাল শুরু হয়ে গেলো। শে’রটি হলো, “তুমি নিজেই বললে যে, আশেকের উপর অত্যাচার জুলূম না করা চাই; কিন্তু পরে তুমিই তার ওজুদের উপর আঘাত হানলে। আর তুমি বেদিলদের উপর কঠোরতা না করা প্রসঙ্গেও বলেছিলে। অথচ সেই তুমিই পুনরায় ঐ কাজটি করে বসলে যা প্রথমে তুমি বারণ করেছিলে।” মাশহুর শায়ের মাওলানা মুগীস রহমতুল্লাহি আলাইহি স্বীয় একটি মাকতুবে ঐ মজলিসের সম্পূর্ণ হাল (অবস্থা) বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, এই শে’র প্রকৃতপক্ষে কোন হাক্বীক্বত অবস্থার উপর দলীল সাব্যস্ত হতে পারে না। কারণ, জুলূম ও কষ্ট যদি আল্লাহ পাক-এর দিকে নিছবত করানো বুঝায় তবে সেটা পরিষ্কার কুফরীর শামীল। অর্থাৎ আল্লাহ পাক কাউকে স্বেচ্ছায় জুলূম, অত্যাচার, কষ্ট, সাজা দেননা বরং বান্দার বদ আমলই তাঁকে কষ্টে মুছীবতে ফেলে। এই ধরনের কিছু (তাত্ত্বিকমূলক) বাণী হযরত মাওলানা ছাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর ‘মাকতুবে’ লিপিবদ্ধ করে তিনি সেটা হযরত মাওলানা মঈনুদ্দীন উমরানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর নিকট হাওয়ালা করেছিলেন। আর তিনি সেটা হাতে নিলেন এবং পূনরায় হযরত মাওলানা ছাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর নিকট দিয়ে দিলেন। এবং কিছুই বললেন না। অতঃপর মাওলানা ছাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহিকে তিনি খিরকা ও পাগড়ী পরিধান করিয়ে বিদায় দিলেন।