মূলঃ হযরত শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দিছে দেহ্লবী রহমতুল্লাহি আলাইহি, ভাষান্তরঃ মাওলানা মুহম্মদ ফজলুল হক
হযরত খাজা জিয়াউদ্দীন বারুনী
রহমতুল্লাহি আলাইহি
(৬২৯ হিজরী-৭৩৮ হিজরী)
পূর্ব প্রকাশিতের পর
অতীত যামানার মাশায়িখগণের তর্জ-তরীকা ছিল এই যে, যতক্ষণ পর্যন্ত কোন ব্যক্তি আল্লাহ পাক ব্যতীত অন্য কিছু থেকে আলাদা না হতো ততক্ষণে মুরীদ করা হতোনা। কিন্তু মহান আল্লাহ পাক-এর অন্যতম নিদর্শন যে হযরত শায়খ আবূ সাঈদ আবুল খায়ের রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর যামানা থেকে শুরু করে হযরত শায়খ সাইফুদ্দীন রাখঝিরী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর যামানা পর্যন্ত এবং অনুরূপভাবে হযরত শায়খ শিহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর যামানা থেকে আরম্ভ করে হযরত শায়খ ফরীদুদ্দীন রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর যামানা পর্যন্ত তাঁদের দরওয়াজায় আল্লাহ পাক-এর মাখলুকের (মানুষের) সর্বদা ভীর থাকত। রাজা-বাদশা, আমীর-উমারা ইত্যাদি প্রসিদ্ধ বিভিন্ন লোকদের আনাগোনা তাঁদের দরবারে ছিল। তারা পরকালের আযাব থেকে মুক্তির আশায় ঐ সকল মাশায়িখগণের দরবার শরীফে হাজির থাকতো। আর ঐ সকল মাশায়িখগণও তাদেরকে বাইয়াত করিয়ে নিতেন। অন্য যামানায় কারো জন্য ইহা সম্ভব হতো না যে, সে আল্লাহ পাক-এর ওলীদের মুয়ামিলাতকে অন্য কিছুর সাথে ক্বিয়াস করে নিজেই আমভাবে মানুষকে বাইয়াত করিয়ে নেয়া। সুতরাং তোমার প্রশ্নের সুস্পষ্ট জাওয়াব এই যে, “যা আমাকে বারংবার শুনানো হয়, যে ব্যক্তি আমার কাছে মুরীদ হবে তাকে সর্বাবস্থায় গুণাহ থেকে বিরত রাখা হবে। সে বাজামায়াত নামায আদায় করবে সঠিকভাবে ওযীফা পালন করবে ও নফল ইবাদত সঠিকভাবে পালন করবে। যদি আমি প্রথমেই তাকে বাইয়াত করানোর প্রকৃত শর্তাবলী আরোপ করি তাহলে সে এই সকল নেক কাজ থেকে মাহরূম থাকবে। দ্বিতীয় কথা হলো আমি যদি কাউকে বাইয়াত না করিয়ে তার থেকে সর্বপ্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করি তবে তাকে শায়খের ছোহবত অর্জনের নিয়ামত থেকে বঞ্চিত করা হলো। আমি দেখলাম একজন গরীব মুসলমান আমার কাছে এসে বলল যে, আমি সর্বপ্রকার গুণাহ থেকে তওবা করলাম। তখন আমি তার কথাকে সত্য স্বীকার করেই তাকে বাইয়াত করিয়ে নেই। বিশেষ করে এ কারণেও যে আমি আল্লাহওয়ালা লোকদের থেকে শুনেছি যে, আমার কাছে যে ব্যক্তি হাক্বীক্বীভাবে বাইয়াত হবে সে অবশ্যই গুণাহর কাজ থেকে বিরত থাকে। এ কারণেই আমি আমভাবে সকলকেই বাইয়াত করিয়ে থাকি। এর আরেকটি অন্যতম কারণ এই যে, একদা হযরত শায়খ নিজামুদ্দীন আওলিয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি আমাকে কলম ও দোয়াত হাতে দিয়ে তাবীজ লেখার নির্দেশ দিলেন এবং বললেন, যাদের তাবিজ দরকার তাদেরকে দিবে। যখন শায়খ রহমতুল্লাহি আলাইহি আমার মধ্যে জালালিয়াতের প্রভাব দেখলেন তখন বললেন, তুমি এখন দোয়া তাবিজ ইত্যাদি লিখা থেকে বিরত হয়েছ। অথচ ঐ সময় খুবই নিকটবর্তী যখন লোকেরা তোমার দরবারে আসবে তখন তুমি কি করবে? ইহা শ্রবণান্তে আমি শায়খ রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর কদমবুছী করে ক্রন্দনরত অবস্থায় আরয করলাম, আপনি আমাকে একজন সম্মানিত খলীফা হিসেবে মনোনিত করলেন অথচ আমি একজন তালিবে ইলম ছিলাম। আমি মানুষের সাথে মেলামেশার কারণে একাকীত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছি। আর তাবিজ-তুমার দেয়া বুযুর্গ লোকদের কাজ। আমার মতো অযোগ্য লোকের জন্য ইহা নয়। আমার জন্য আপনার মুহব্বতের মুবারক দৃষ্টিই যথেষ্ট। আমার সকল অনুনয় বিনয় শ্রবণান্তে শায়খ রহমতুল্লাহি আলাইহি আমাকে নির্দেশ দিলেন, তুমি ভালভাবে তাবিজ-তুমারের কাজ চালিয়ে যাও। আমি যখন খুব বেশী করে অনুনয় বিনয় করলাম তখন শায়খ রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর এক বিশেষ হাল জাহির হলো। এর পরে তিনি সোজা হয়ে বসে আমাকে কাছে ডাকলেন ও নিজের সামনে বসার নির্দেশ দিলেন। অতঃপর আমার শায়খ হযরত ফরীদুদ্দীন মাসউদ রহমতুল্লাহি আমাকে বললেন, ওহে নিজামুদ্দীন জেনে রাখ প্রত্যেক নেক বান্দা ও সৌভাগ্যশীলদের আল্লাহ পাক-এর দরবারে কোন সম্মান হবে কি হবে না? যদি আল্লাহ পাক-এর দরবারে তাঁদের কোন ইজ্জত- সম্মান হয়েই থাকে তবে আমি মহান আল্লাহ পাক-এর কাছে বলব, ততক্ষণ পর্যন্ত আমি জান্নাতে আমার পা রাখবনা যতক্ষনে আমার সকল মুরীদগণকে আমার সাথে জান্নাতে না নেয়া হবে। এই মহাবাণী বর্ণনার পরে হযরত নিজামুদ্দীন আওলিয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি মুচকী হাসতে লাগলেন এবং বললেন, আমাকেও এভাবেই খিলাফত দেয়া হয়েছে। তাতে আমার প্রতি সেই নির্দেশিত কাজ কখনো ভালোভাবে হোক আর না হোক আমি কখনো শায়খকে এ কথাও জিজ্ঞাসা করিনি যে অনেক লোক সারা জীবন মিথ্যা, কুফরী বিভিন্ন মাধ্যমেও এরূপ তাবিজ-তুমারের কাজ করে থাকে। কাজেই এর দ্বারা আমি কি আশা করতে পারি? বরং আমি আমার স্বচক্ষে ইহাও দেখেছি ও উপলব্ধি করেছি যে, আমার শায়খ রহমতুল্লাহি আলাইহি মহান আল্লাহ পাক-এর খাছ বান্দাদের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন। যেভাবে পূর্বোক্ত বুযুর্গগণ মাশুকে মাওলা বান্দাদের ফায়দা দিতেন। অনুরূপভাবে আমার শায়খও স্বীয় পেয়ালা দ্বারা সকলকে ফয়েজ দিতেন। কাজেই আমার শায়খ আম-খাছ সকলকে বাইয়াত করাতেন। সুতরাং আমিও সেই তরতীবে আম-খাছ সকলকে বাইয়াত করিয়ে থাকি।(চলবে)