মুহাদ্দিসে দেহলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি, ভাষান্তর: মাওলানা মুহম্মদ ফজলুল হক
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
মাওলানা ফখরুদ্দীন ঝরাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি
বর্ণিত আছে যে, হযরত নাছীরুদ্দীন চেরাগে দেহলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, যে জিনিষ হাছিল করতে আমার দু এক মাস সময় লাগে তা মাওলানা ফখরুদ্দীন ঝরাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর এক ঘন্টার মধ্যেই হাছিল হয়ে যায়। যখন দিল্লীর লোকদেরকে দেওগীর নিয়ে যাওয়া হলো তখন মাওলানা ফখরুদ্দীন রহমতুল্লাহি আলাইহিও তথায় গেলেন। সেখান থেকে তিনি কা‘বা শরীফ যিয়ারতের জন্যে রওয়ানা হলেন তথা হতে বাগদাদ শরীফ গিয়ে গভীর মনোযোগের সাথে হাদীছ শরীফের কিতাব মুতালায়া করেন। অতঃপর নিজের পুরাতন শহর দিল্লীতে আসেন। সেখানে একটি কিস্তিতে আরোহন করেন। তখন সেই কিস্তিতে ডুবে তিনি তথায়ই শাহাদাত বরণ করেন। বর্ণিত আছে যে, বাদশাহ সুলতান মুহম্মদ তুঘলক দিল্লীর লোকদেরকে তুর্কিস্থান ও খুরাসান দখল করার জন্য এবং তথা হতে চেঙ্গিসদেরকে বের করে দেয়ার জন্য দেওগীর প্রেরণ করেছিলেন। তখন সুলতান দিল্লীর বড় বড় আমীর ওমরাদেরকে নির্দেশ দিলেন- তারা যেন তথায় হাজির হয়ে একটি বড় তাবু খাটিয়ে তার মধ্যে একটি মিম্বর তৈরী করে। যেন উহার উপরে আরোহন করে লোকদেরকে কাফিরদের সাথে যুদ্ধ করার উৎসাহ দেয়া যায়। সেদিন বাদশাহ মাওলানা ফখরুদ্দীন ঝরাদী, শায়খ শামসুদ্দীন ইয়াহইয়া ও শায়খ নাছীরুদ্দীন চেরাগে দেহলভী রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণকে ও খাজা কুতুবুদ্দীন ওজীর ওস্তাদ (যিনি হযরত খাজা নিজামুদ্দীন আউলিয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর মুরীদ ও মাওলানা ফখরুদ্দীন ঝরাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর ছাত্র ছিলেন) এবং শহরের আরো বড় বড় আলিম-উলামাদেরকে প্রথমেই রাজ দরবারে ডাকলেন। তখন মাওলানা ফখরুদ্দীন ঝরাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি বারবারই বলতেছিলেন যে, রাজ দরবারে যাওয়াটা আমার জন্য সমিচীন নয়। আমি কোনভাবেই রাজ দরবারের নিয়ম-কানুন মানতে পারবোনা। যখন মাওলানা ফখরুদ্দীন ঝরাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর বাদশার সাথে সাক্ষাত হলো তখন খাজা কুতুবুদ্দীন ওজীর ওস্তাদ তাঁর সেন্ডেল মুবারক বোগোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন। বাদশা এ অবস্থা দেখেও চুপ থাকলেন। অতঃপর বাদশা মাওলানা ফখরুদ্দীন ঝরাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর সাথে কথাবার্তা বলতে লাগলেন। এক পর্যায় বাদশা তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, হুযূর! আমি চাচ্ছি লা’নতপ্রাপ্ত চেঙ্গিসদেরকে ধ্বংস করে দিতে। আপনি এ ব্যাপারে আমাকে সহযোগিতা করবেন কি? তিনি উত্তরে বললেন ইনশাআল্লাহ। তখন বাদশা বললেন, ইহাতো সন্দেহজনক বাক্য। তিনি তখন বললেন, ভবিষ্যত বাক্যের জন্য এরূপই বলতে হয়। বাদশা একথা শ্রবনান্তে বললেন, আমাকে কিছু নছীহত করুন যার উপর আমি আমল করতে পারি। তখন তিনি বললেন, গোস্সা বা রাগ ছেড়ে দাও। বাদশা বললেন, কোন গোস্সা বা রাগ? মাওলানা ফখরুদ্দীন রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, এর পুর্বের সাতজন বাদশা গোস্সার প্রতিফল পেয়েছেন। তখন বাদশা স্বীয় খাদিমদেরকে খানা আনার জন্য নির্দেশ দিলেন। যখন দস্তরখানা বিছানো হলো তখন ফখরুদ্দীন রহমতুল্লাহি আলাইহি অপারগ হয়েই কিছু খেলেন। যখন দস্তরখানা উঠানো হলো (খানা শেষ হলো) তখন উপস্থিত সকল উলামায়ে কিরামগণের জন্য সুতি কাপড়ের পোশাক এবং এক হাজার টাকা মূল্যের স্বর্ণের টুকরা আনা হলো। সকলেই উহা গ্রহণ করলেন। কিন্তু মাওলানা ফখরুদ্দীন ঝরাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর হাদিয়া খাজা কুতুবুদ্দীন ওজীর ওস্তাদ তার নিজের কাছে রেখে দিলেন। কারণ উহাতে ফখরুদ্দীন ঝরাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি হাত লাগাননি। সে কারণেই তাঁর ও অন্যান্যদের মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হল। যখন সকল বুযুর্গানেদ্বীনগণ চলে গেলেন তখন বাদশা খাজা কুতুবুদ্দীন ওজীর ওস্তাদ রহমতুল্লাহি আলাইহিকে লক্ষ্য করে বললেন, হে বদবখত! এটা কী অশোভনীয় কাজ করলে? আমার তরবারীর আঘাত থেকে তুমি ফখরুদ্দীন রহমতুল্লাহি আলাইহিকে বাঁচিয়ে দিলে? খাজা কুতুবুদ্দীন বললেন, হে বাদশা! তিনি আমার ওস্তাদ এবং শায়খ নিজামুদ্দীন আউলিয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর একজন খাছ খলীফা। তাঁর মর্যাদা মর্তবা রক্ষা করা আমার কর্তব্য। বাদশা গোস্সা করে বললেন, এখনই এই আক্বীদা থেকে তওবা কর, অন্যথায় তোমাকে হত্যা করে ফেলব। খাজা কুতুবুদ্দীন রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, যদি আমার ওস্তাদের সম্মান রক্ষার কারণে আমাকে শহীদ করা হয় তবে আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করব। আল্লাহ পাক তার সকল খাছ বান্দাগণের উপর রহমত নাযিল করুন। (আমিন)
(চলবে)
বিশ্ব সমাদৃত, হযরত আউলিয়া-ই-কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণের অনুপম মুবারক চরিত গ্রন্থ আখবারুল আখইয়ার-১০