অনেকেরই আশ্চার্যান্বিত হবার মত তথ্য হচ্ছে যে, পৃথিবীর তিনশ’ ভাষার মানুষের বাসস্থান লন্ডনে মুসলমানরা দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ। ৮০ লাখ লন্ডন অধিবাসীদের মধ্যে মুসলমানের সংখ্যা ১০ লাখেরও বেশী। অর্থাৎ লন্ডনে প্রতি সাতজনে একজন মুসলমান।
লন্ডনেও গড়ে উঠেছে মসজিদ-মাদ্রাসা, ইসলামিক সেন্টার, মুসলিম কমিউনিটি। প্রযুক্তির ও তথাকথিত আধুনিকতার বলয়ে থেকেও এখানেও রয়েছেন হিজাব পরিহিতা অনেক মুসলমান নারী এবং দাড়ী-টুপি পরিহিত মুসলমান। আল্লাহ পাক-এর রহমতে ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরীসহ লন্ডনের মাটিতে তাদের অবস্থান অনেক সুসংহত করতে তারা ইতোমধ্যে সমর্থ হয়েছেন।
এহেন অবস্থানে মুসলমানদের সামাজিক মর্যাদায় বসবাসসহ ইসলামের প্রচার-প্রসারের একটি পজিটিভ পটভূমিকা বর্তমান ছিল বটে।
কিন্তু তাই যেন চক্ষুশূল ছিল ইহুদী-খ্রিস্টান গোষ্ঠীর কাছে। মেষ শাবকের উপর পানি ঘোলা করার দোষ চাপিয়ে দেবার নেকড়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো তারা।
সুযোগটা করেছিলো নামধারী চিরন্তন মুনাফিকগোষ্ঠী। ইসলামে যা নেই তাই তারা করলো ইসলামের নামে। ১৯৯৮ সালে নাইজেরিয়াতে মার্কিন দূতাবাসে, ২০০১ সালে টুইন টাওয়ারে হামলা, ২০০৪ এ স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদে রেল স্টেশনে হামলার পর ৭ জুলাই লন্ডনে আবার বোমা হামলা চালালো। সকাল ৮টা ৫১ মিনিটে কিংকসের আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশনে ৯টা ১৭ মিনিটে ডাবল ডেকার বাসে অর্ধশতাধিক হতসহ আহত হয় সাতশ’এরও বেশী। তবে তড়িৎ ও উন্নত ব্যবস্থা গ্রহণের উছীলায় নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যায় আরো অনেকে।
লন্ডনে বৃহস্পতিবার ভয়াবহ বোমা হামলার দায়িত্ব স্বীকার করেছে চিহ্নিত বিশ্ব মুনাফিক সংগঠন আল কায়দা। তারা হামলা নেটওয়ার্কের আবু হাফস আল মাসরি ব্রিগেডের ইউরোপ শাখার নামে পাঠানো ইন্টারনেটে বিবৃতের মাধ্যমে হামলার কথা স্বীকার করে।
বিবৃতিতে বলা হয়, আবু হাফস আল মাসরি ব্রিগেডের একদল মুজাহেদিন লন্ডনে একের পর এক বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে।
স্প্যানিশ পত্রিকা এল মানদোতে গত শনিবার এক খবরে বলা হয়, স্পেনের গোয়েন্দা সংস্থা স্প্যানিশ ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স সেন্টার (সিএনআই) ইউরোপে আল কায়েদার হামলা সংক্রান্ত একটি মেসেজ গত শনিবার ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এম ১৫-এর কাছে হস্তান্তর করেছে। আরবি ভাষায় লেখা এই মেসেজের কপিতে স্বাক্ষরে ছিল আল কায়েদার ইউরোপীয় বিভাগের আবু হাফস আল মাসরি ব্রিগেডের নাম। গত ২৯ মে ইউরোপের মুজাহিদদের উদ্দেশ্যে প্রেরিত এই মেসেজের অংশ বিশেষে উল্লেখ ছিল, আমরা এখন বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা মুজাহিদদের প্রত্যাশিত হামলার আহ্বান জানাচ্ছি। স্প্যানিশ গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের বিশ্বাস, এই মেসেজে লন্ডনে গত বৃহস্পতিবারের হামলার ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে।
তাৎক্ষণিকভাবে হামলার দায়িত্ব স্বীকার করেছে ‘সেক্রেড অর্গানাইজেশন অব আল কায়েদা ইন ইউরোপ’ বলে একটি নবঘোষিত আল কায়েদার সহযোগী প্রতিষ্ঠান। ঠিকানাবিহীন টেলিফোন বার্তায় ওই সংগঠনের মুখপাত্র ইশতেহার জারি করেছে, ইসলামী জাতি, উল্লাস কর। আরব বিশ্ব, উল্লাস কর। এমনকি গত ২১ জুলাই পাঠানো আরেক ই-মেইল বার্তায়ও তারা এরূপ স্বীকারোক্তি করে।
উল্লেখ্য, ইসলাম কখনোই এরূপ সন্ত্রাসী তৎপরতা অথবা নির্বিচারে হামলা সমর্থন করে না। সুতরাং ইসলামের নামে এরূপ সন্ত্রাসী তৎপরতা দ্বারা বিশ্ব মুনাফিক লাদেনের আল কায়েদা যে শুধু ইসলামের প্রতি অপবাদই দিয়েছে বা তার ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করার অপ্রপ্রয়াস চালিয়েছে তাই নয়, পাশাপাশি এর দ্বারা লন্ডন তথা গোটা ইউরোপ আমেরিকায় মুসলমানদের বড় বড় ক্ষতি করেছেন নিচের বিচ্ছিন্ন কয়েকটি চিত্রে তা প্রতিভাত হয়।
(১)
৯ জুলাই সিএনএনে লন্ডনের একজন মহিলা পাতালরেল যাত্রী বলেছেন, ট্রেনে আসার সময় তার কামরায় একজন আফ্রিকান মুসলিম উঠেছিলেন। তাকে দেখে অনেকের চেহারায় ভাবান্তর লক্ষ্য করেছেন তিনি। কয়েকজন যাত্রী কামরা বদল করেছেন।
(২)
বিবিসি জানায়, বাংলা টাউন রেস্তোরাঁ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজ মোহাম্মদ হক বলেছেন, বোমা হামলার ফলে লন্ডনে বসবাসকারী মুসলিম বাঙ্গালী কমিউনিটির মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সবাই আতঙ্কগ্রস্ত। কেউই ঘর থেকে বেরুনোর সাহস পাচ্ছে না। পরে কী ঘটবে, সেটা নিয়েই এখন সবাই চিন্তিত।
(৩)
উত্তরে মুসলিম কাউন্সিল অব ব্রিটেনের মহাসচিব আব্দুল বারী বলেন, আমরা এখনো জানি না, ঘটনা কে ঘটিয়েছে। তবে যেই ঘটিয়ে থাকুক, আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই। আর প্রভাব বলতে যেসব মুসলিম মেয়ে হিজাব পরে রাস্তায় বের হচ্ছে, শারীরিকভাবে না হলেও মৌখিকভাবে তাদের আপত্তিকর কথা বলছে। যাদের দাড়ি রয়েছে, তাদের দেখেও অনেকে কুটূক্তি করছে।
(৪)
লন্ডনে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা বিশ্বজুড়ে মুসলমানদের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে বলে মন্তব্য করেছেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ চিত্রলে এক বৈঠকে মোশাররফ লন্ডনে বোমা হামলার ঘটনাকে সন্ত্রাসবাদের উন্মুক্ত কার্যকলাপ বলে অভিহিত করেন। বলেন, এই ঘটনা গভীর প্রভাব ফেলবে। বিশেষত সারাবিশ্বের মুসলমানরা এর শিকার হবের।
এখন এখানকার প্রত্যেক মুসলমানই সন্দেহের শিকার হবেন। বাদামি চোখের পুরুষ বা নারী, মুখে দাড়িওয়ালা পুরুষ, স্কার্ফ পরা নারী সবাই।
(৫)
এদিকে নিউইয়র্কসহ যুক্তরাষ্ট্রের সর্বত্র বাংলাদেশীসহ বিভিন্ন দেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে দিনভর অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা ছিল লক্ষণীয়। এ সম্পর্কে আমেরিকার মুসলিম পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কাউন্সিলের এডিনা লোকাডিক আশঙ্কা প্রকাশ করেন, ‘লন্ডনে বোমা হামলাকারীরা ব্রিটেনের জন্মগ্রহণকারী মুসলমান হওয়ায় আমাদের সমাজেও উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের ভয়ের ব্যাপার হচ্ছে এখানেও যে কোন সময় এরকম ঘটনা ঘটতে পারে। এজন্য অনেকেই কাজ থেকে ছুটি নিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছেন সারাদিন।
(৬)
ওইদিকে লন্ডনে বোমা হামলার প্রতিক্রিয়ায় নিউজিল্যান্ডেও মসজিদসহ চারটি ইসলামী কেন্দ্রে লোকজন হামলা চালিয়েছে। পূর্ব লন্ডনে বাঙালি অধ্যুষিত স্টেপনি গ্রিন এলাকায় শনিবার একটি মসজিদে আক্রমণ হয়েছে। আক্রমণকারীরা মসজিদ ভাংচুর করে। তারা মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে মুসলমানদের অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে। মসজিদের দিকে ঢিল ছুড়ে মারে। এক পর্যায়ে তারা লাঠিসোটা নিয়ে মসজিদের ওপর চড়াও হয়ে দরজা-জানালায় আঘাত করতে থাকে। মসজিদের জানালা ভাংচুর করে।
স্টেপনি গ্রিন এলাকার মাইল্যান্ড রোডে অবস্থিত মাযাহিরুল উলুম মাদ্রাসা অ্যান্ড ইসলামী কালচারাল সেন্টারে দুষ্কৃতকারীরা এ হামলা চালায়। এখানে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করা হয়। শনিবার সাপ্তাহিক ছুটি থাকার কারণে মাদ্রাসাটি ছিল বন্ধ। বিকালে পাশ্ববর্তী একটি পানশালা থেকে কয়েকজন দুষ্কৃতকারী ওই মসজিদের আক্রমণ করে পালিয়ে যায়।
(৭)
লন্ডনে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় মুসলমানরা বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন জায়গায় হামলার শিকার হচ্ছেন। শুক্রবার নর্থ অব ইংল্যান্ডের লিডসের আমলী এলাকায় একটি মসজিদে অগ্নিসংযোগের খবর পাওয়া গেছে। সকালে লিডসের জামিয়াত তাবলিকুল ইসলাম মসজিদে কে বা কারা অগ্নিসংযোগ করে পালিয়ে যায়। অগ্নিকাণ্ডে মসজিদের ক্ষতিসাধিত হয়।
(৮)
এ ঘটনায় ব্রিটেনজুড়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে পুলিশ স্বীকার করেছে। পুলিশ জানায়, সন্দেহজনক অগ্নিকাণ্ড, লাঞ্ছিত করা, কটূক্তি এবং হুমকি দেয়ার মতো ৭০টি ঘটনা নথিবদ্ধ করেছেন। গত ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে লন্ডনে অন্তত ২ জন মুসলমানের ওপর শারীরিকভাবে হামলা চালানোর খবর পাওয়া গেছে। ব্রিটেনের অন্তত ২টি মুসলিম সংগঠনকে হুমকি দিয়ে হাজার ই-মেইল পাঠানো হয়েছে। মুসলিম কাউন্সিল অব ব্রিটেন (এমসিবি) ৩০ হাজারেরও বেশি হুমকি ও ঘৃণার বার্তা সংবলিত ই-মেইল পেয়েছে।
(৯)
মানবাধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক হেলসিংকি ফেডারেশন কর্তৃক প্রকাশিত ‘ইউরোপীয় ইউনিয়নে মুসলমানদের প্রতি বৈষম্য ও অসহিষ্ণুতা শীর্ষক এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সেই ১১ সেপ্টেম্বরের টুইন টাওয়ার হামলা, বালি বা মাদ্রিদ হামলার প্রতিটি ঘটনার পর ইউরোপে মুসলমানদের ওপর সরাসরি পাল্টা হামলা চালানো হয়েছে। প্রত্যেকটি ঘটনায় ইসলাম বিরোধী মনোভাব প্রবল হয়েছে, মসজিদের অবমাননা করা হয়েছে, মুসলমানদের ওপর হামলা হয়েছে।
(১০)
পূর্ব লন্ডন মসজিদের চেয়ারম্যান ড. আব্দুল বারী যেমনটি বলেছেন, তিনি তার চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ দেখেছেন। দ্য মুসলিম কাউন্সিল অব ব্রিটেনের ভাষ্যমতে, ১১ সেপ্টেম্বরের হামলার পর থেকে মুসলমানরা অত্যন্ত আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন।
(১১)
এখন আইন প্রণয়ন করে মুসলমানদের গাড়ি থামানো ও তল্লাশি করার ঘটনা ৩০০ শতাংশ বেড়ে গেছে। এরপর থেকেই মুসলমানরা তাদের জন্য কোন ধরনের হয়রানি অপেক্ষা করছে তা ভেবে আতঙ্কে থাকেন।
(১২)
গত ২৩-০৭-২০০৫ ঈসায়ী পত্রিকায় রিপোর্ট হয়, “ওদিকে সশস্ত্র পুলিশ পূর্ব লন্ডনের একটি মসজিদ ঘিরে রেখেছে। অলগেটের হোয়াইট চ্যাপেল সড়কের ওই মসজিদে বোমা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লে দ্রুত পুলিশ ঘটনাস্থলে ছুটে যায়। মুহূর্তেই মসজিদটি খালি করা হয়। পুলিশ সবাইকে ঘরের ভেতর থাকার পরামর্শ দেয়। গতকাল ছিল জুম্মার দিন। ৬ হাজারেরও বেশী লোক ওই মসজিদে শুক্রবার জুমার নামায আদায় করে থাকে। পূর্ব লন্ডন মসজিদে বোমা হামলার হুমকি দেয়া হয়। এরপরই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ মসজিদ প্রাঙ্গণ তল্লাশি করে। এক ঘণ্টা পর নিরাপত্তা বেষ্টনী তুলে নেয়া হয়। পুলিশ বলেছে, কোন কিছু পাওয়া যায়নি। পূর্ব লন্ডনের এই এলাকাটিতে বাংলাদেশীদের বসবাস অনেক বেশী। প্রায় ৬০ হাজার বাংলাভাষী এখানে বসবাস করছেন।
উল্লেখ্য, শুধু লন্ডনের এই মসজিদেই নয়। ইসলাম বিদ্বেষী ইহুদী-খ্রিস্টান গং এখন এতটুকু স্পর্ধা দেখাচ্ছে যে, তারা খোদ মক্কা শরীফ, মদীনা শরীফ সম্পর্কেও হুমকি দিচ্ছে।
“বেসরকারী রেডিও ও টিভিতে প্রচারিত পৃথক দু’টি সাক্ষাৎকারমূলক অনুষ্ঠানে কলোরাডো থেকে নির্বাচিত ক্ষমতাসীন রিপাবলিকান দলের কংগ্রেসম্যান ট্যানক্রিডোর বলেছে, সন্ত্রাসীরা যদি যুক্তরাষ্ট্রের আর কোন শহরে কখনো বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় কিংবা কয়েকটি শহরে পারমাণবিক হামলা চালায় তাহলে মক্কাসহ মুসলমানদের ধর্মীয় স্থানগুলো দখল করে এবং এসব স্থানে বোমাবর্ষণ করার মাধ্যমে সমুচিত জবাব দিতে হবে।”
মূলত: এত বড় সাহসের সুযোগ করে দিয়েছে বিশ্ব মুনাফিক লাদেন গং। আর এদেশীয় উলামায়ে ‘ছূ’রা লাদেনের ভক্ত এবং সহযোগী বটে।
-মুহম্মদ মাহবুবুর রহমান, ঢাকা।
বিৃটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে বিৃটিশ ভূমিকা-১৫