৩৩তম ফতওয়া হিসেবে
“মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র কুরআন শরীফ, মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র হাদীছ শরীফ, পবিত্র ইজমা শরীফ ও পবিত্র ক্বিয়াস শরীফ উনাদের দৃষ্টিতে সম্মানিত ও পবিত্র মাযহাব চতুষ্ঠয় উনাদের মধ্যে যে কোন একটি সম্মানিত ও পবিত্র মাযহাব মানা ও অনুসরণ করা ফরয ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া”- পেশ করতে পারায় মহান আল্লাহ পাক উনার পবিত্র দরবার শরীফ-এ শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি।
সম্মানিত হানাফী মাযহাব অনুসরণ করার ব্যাপারে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
উনার নির্দেশ মুবারক
(গত সংখ্যার পর)
মুজাদ্দিদুয যামান হযরত মাওলানা শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার বর্ণনায় মাযহাব সম্পর্কে উনার অবস্থান যেমন সুস্পষ্ট হয়েছে, মাযহাব চতুষ্টয়ের কোনো একটি অবলম্বন করার গুরুত্ব ও অপরিহার্যতা এবং হানাফী মাযহাবের বৈশিষ্ট্যের প্রতি নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নির্দেশমূলক ইঙ্গিতও রয়েছে। তবে কেউ কেউ নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার এই মহাসম্মানিত নির্দেশ মুবারক উনার সম্পর্কে বলে থাকে-স্বপ্ন কারও জন্য দলীল নয়। মাযহাব চতুষ্টয়ের কোন একটি অবলম্বন করা আবশ্যক এ বিষয়ে আমাদের আলিমগণ শত শত কিতাব লিখেছেন। সেখানে তারা সম্মানিত ও পবিত্র কুরআন শরীফ ও সম্মানিত ও পবিত্র হাদীছ শরীফ থেকে অসংখ্য দলীল পেশ করেছেন।
তাছাড়া আপনি কি লক্ষ্য করেছেন, স্বপ্ন কে দেখেছেন এবং কাকে দেখেছেন? দেখেছেন পবিত্র হাদীছ শরীফ জগতে সবার উস্তাদ। সকলের স্বীকৃত বিশ্ববরেণ্য যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছ হযরত মাওলানা শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি। আর যাকে দেখেছেন তিনি হলেন, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিয়্যীন নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ।
এ ব্যাপারে তিনি নিজেই ইরশাদ মুবারক করেন-
عَنْ حَضْرَتْ اَنَسٍ رَضِیَ اللهُ تَـعَالٰى عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ رَاٰنِيْ فِي الْـمَنَامِ فَـقَدْ رَاٰنِىْ حَقًّا فَاِنَّ الشَّيْطَانَ لَا يَـتَمَثَّلُ بِيْ
অর্থ: হযরত আনাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, যিনি আমাকে দেখেছেন অবশ্যই তিনি আমাকেই দেখেছেন। কেননা, শয়তান আমার মহাসম্মানিত আকৃতি মুবারক ধারণ করতে পারে না। (বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ)
এবার বলুন, মুজাদ্দিদুয যামান হযরত মাওলানা শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি কি নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বাধ্য না অবাধ্য? তিনি যদি নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার অনুগত উম্মতই হয়ে থাকেন তাহলে তিনি উনার নির্দেশ মুবারক মেনেছেন কি-না?
মুজাদ্দিদুয যামান হযরত মাওলানা শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার ন্যায় যুগশ্রেষ্ঠ সম্মানিত আলিমের প্রতি যদি মাযহাব পালনের নির্দেশ হয় এবং উনাকে মাযহাবের অন্তর্ভুক্ত হতে হয় তাহলে সাধারণ জনগণ, নামমাত্র আলিম ও স্বঘোষিত মুজতাহিদ উনাদের করণীয় সম্পর্কে আপনারাই বিবেচনা করুন।
সম্মানিত হানাফী মাযহাবের অসংখ্য শ্রেষ্ঠত্ব ও বৈশিষ্ট্যসমূহ থেকে নিম্নে কিঞ্চিত আলোকপাত করা হলো-
সম্মানিত হানাফী মাযহাব মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র কুরআন শরীফ উনার সাথে সর্বাধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ
সম্মানিত ইসলামী শরীয়ত উনার মূল ভিত্তি হল পবিত্র কুরআন শরীফ। সম্মানিত ও পবিত্র কুরআন শরীফ মহান আল্লাহ পাক উনার কালাম, অকাট্যভাবে তা প্রমাণিত। তাই কোনো বিষয়ে দলীল-প্রমাণ পরস্পর বিরোধী হলে সম্মানিত হানাফী মাযহাব সম্মানিত ও পবিত্র কুরআন শরীফ উনাকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। সাইয়্যিদুনা হযরত ইমামে আ’যম রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার মাযহাব সম্মানিত ও পবিত্র কুরআন শরীফ উনার সঙ্গে সর্বাধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ। এখানে শুধু একটি উদাহরণ দেয়া হল ।
নামাযে (ইমামের অনুসরণ করা অবস্থায়) মুক্তাদির সম্মানিত ও পবিত্র সূরা ফাতিহা শরীফ পড়তে হবে কি-না? এ ব্যাপারে পবিত্র হাদীছ শরীফ ব্যাহ্যিকভাবে বিরোধপূর্ণ। কিন্তু সম্মানিত ও পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে দ্ব্যার্থহীন ভাষায় ঘোষণা করা হয়েছে-
وَإِذَا قُرِئَ الْقُرْاٰنُ فَاسْتَمِعُوْا لَهٗ وَأَنصِتُـوْا لَعَلَّكُمْ تُـرْحَمُوْنَ
অর্থ: আর যখন পবিত্র কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করা হয় তখন মনোযোগসহকারে তা শ্রবণ কর এবং চুপ থাক। অবশ্যই তোমাদের উপর রহম করা হবে। সুবহানাল্লাহ! (সম্মানিত ও পবিত্র সূরা আ’রাফ শরীফ: সম্মানিত ও পবিত্র আয়াত শরীফ ২০৪)
উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ সম্মানিত নামাযের ক্ষেত্রে নাযিল হয়েছে। তাই এ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মর্মানুসারে ইমামের সশব্দে পবিত্র কুরআন শরীফ পড়া অবস্থায় শ্রবণ করা ও চুপ থাকা যেমন ওয়াজিব, তেমনি নিঃশব্দে পড়া অবস্থায়ও কিছু না পড়া নীরব থাকা ওয়াজিব। তাই এ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মর্মকে প্রাধান্য দিয়ে সম্মানিত হানাফী মাযহাবে ইমামের পেছনে সম্মানিত নামায পড়াকালে মুক্তাদির জন্য পবিত্র সূরা ফাতিহা শরীফ পড়া নিষেধ। (তানাউল ইবাদত- ৩৮৫, আল মুগনী, ইবনে কুদামা-৬০৫, তাফসীরে ইবনে কাসীর পৃষ্ঠা ২/২৯২, লুবাব- ৫/১৪০, আহকামুল কুরআন-জাসসাস-৩/৫২, রুহুল মায়ানী- ৫/১৪০)
২. পবিত্র ছহীহ হাদীছ শরীফই হচ্ছেন সম্মানিত হানাফী মাযহাব উনার মূল ভিত্তি
সম্মানিত হানাফী মাযহাবের ভিত্তিই হল ছহীহ হাদীছ শরীফ উনার উপর। সাইয়্যিদুনা হযরত ইমাম আ’যম রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেছেন-
اِذَا صَحَّ الْحَدِيْثُ فَـهُوَ مَذْهَبِىْ
অর্থ: ছহীহ পবিত্র হাদীছ শরীফই আমার মাযহাব হিসাবে গণ্য। (হাশিয়া রদ্দুল মুহতার-১/৬৭-৬৮ এবং উকুদু রসমিল মুফতী পৃষ্ঠা- ১১৭)
এর ভিত্তিতে হাফিয ইবনে আব্দিল বার মালেকী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, সাইয়্যিদুনা হযরত ইমাম আ’যম রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি পবিত্র হাদীছ শরীফ গ্রহণের ক্ষেত্রে খুবই সতর্কতা অবলম্বন করতেন এবং যথাসাধ্য ছহীহ হাদীছ শরীফ উনার উপর মাসআলার ভিত্তি রাখতেন। (আল ইনতিকা ১৪২-১৪৫ পৃষ্ঠা)
তবে যেসব বিষয়ে ছহীহ পবিত্র হাদীছ শরীফ বিশুদ্ধভাবে পেঁৗছেনি সেক্ষেত্রে হাসান বা অন্য সূত্রে প্রাপ্ত যয়ীফ বা দুর্বল হাদীছ শরীফ সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণযোগ্য। সে ক্ষেত্রেও সম্মানিত হানাফী মাযহাব যে সতর্কতা অবলম্বন করেছে তা অন্য কারও পক্ষে সম্ভব নয়। (ইলামুল মুআক্কয়ীন ১/৬১)
এ বিষয়ে শাফিয়ী মাযহাবের মূল্যবান ও সুপ্রসিদ্ধ কিতাব ‘আল মিযানুল কুবরা’ প্রণেতা আব্দুল ওয়াহাব শারানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার বিস্তারিত বক্তব্যের কিঞ্চিৎ তুলে ধরা হলো-
وثم من العلماء من جعل الله تعالى على كلامه القبول ومنهم من لم يجعل عليه قبولا فيطعن فيه الناس وها انا قد ابنت لك عن صحة ادلة مذهب الامام الاعظم ابى حنيفة حمة الله عليه و ان جميع ما استدل به لـمذهب اخذه عن خيار التابعين وأنه لا يتصور في سنده شخص منهم بكذب ابدا وان قبل بضعف شيئ من ادله مذهبه فذالك الضعف انما هو بالنظر للرواية النازلين عن سنده بعد موته. وذالك لا يقدح فيما اخذ به الامام عند كل من استصحب النظر في الرواية وهو صاعد إلى النبي صلى الله عليه وسلم وكذالك تقول في ادلة مذهب اصحابه فلم يستدل احد منهم بحديث ضعيف فرد لم يأت إلا من طريق واحد ابدا كما تتبعنا ذالك انما يستدل احدهم بحديث صحيح، أو حسن أو ضعيف قد كثرت طرقه حتى ارتفع لدرجة الحسن ذالك امر لا يختص باصحاب الامام ابي حنيفة رحمة الله عليه بل يشاركهم فيه جميع الـمذاهب كلها كما مر ايضاحه و اترك يا اخى التعصب على الامام ابي حنيفة و اصحابه رحمة الله عليه اجمعين.
واياك و تقليد الجاهلين باحواله وما كان عليه من الورع والزهد و الاحتياط في الدين فتقول ان ادلته ضعيفة بالتقليد فتحشر مع الخاسرين و تتبع ادلته كما تتبعناها تعرف ان مذهبه من اصح المذاهب
অর্থ: মহান আল্লাহ পাক তিনি কারো সাধনা কবুল করেন আর কারো সাধনা কবুল করেন না। তাই ব্যর্থরা সফলদের ওপর হিংসাত্মক আক্রমণে লিপ্ত হয়। আমি সম্মানিত হানাফী মাযহাবের সত্যতা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করেছি। সাইয়্যিদুনা হযরত ইমাম আ’যম রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি উনার মাযহাবের সব দলীল-প্রমাণ সর্বশ্রেষ্ঠ তাবেয়ীগণ থেকে গ্রহণ করেছেন, এসব সনদে কোনো সন্দেহজনক ব্যক্তি থাকার কল্পনাই করা যায় না। যদি বলা হয় কিছু সনদে দুর্বল রাবী রয়েছে, তবে জেনে রাখুন, তা সাইয়্যিদুনা হযরত ইমাম আ’যম রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার পবিত্র বিছাল শরীফের পর পরবর্তী যুগে হয়েছে। আর এভাবে আপনি পেয়েছেন। এক্ষেত্রে সাইয়্যিদুনা হযরত ইমাম আ’যম রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার থেকে মহাসম্মানিত হাবীব ও মাহবূব নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পর্যন্ত বিশুদ্ধ সনদের ব্যাপারে কোনো কথা বলা যাবে না ।
অনুরূপভাবে সাইয়্যিদুনা হযরত ইমাম আ’যম রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার অনুসারীগণও যয়ীফ হাদীছ শরীফ দলীল হিসেবে গ্রহণ করেননি। বরং ছহীহ হাসান ও বিভিন্ন সূত্রে গৃহীত যয়ীফ হাদীছ শরীফ গ্রহণ করে থাকেন যেগুলো সনদের আধিক্যে হাসান স্তরে পেঁৗছে যায়। আর এতটুকুর অবকাশ সব মাযহাবেই রয়েছে।
হানাফীদের চূড়ান্ত সতর্কতা সত্ত্বেও হানাফী মাযহাবের দলীল-প্রমাণকে দূর্বল বলা মানে দুনিয়া ও আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার শামিল। তাই এসব হঠকারিতা ও বিদ্বেষ পরিত্যাগ করে, হানাফী মাযহাবের দলিল-প্রমাণ অন্বেষণ করো, তাহলে বুঝতে পারবে যে, সম্মানিত হানাফী মাযহাবই সর্বাপেক্ষা ছহীহ মাযহাব। (আল মিযানুল কুবরা-১/৮৫)
উল্লেখ্য, এ অভিজ্ঞতাপূর্ণ তথ্য ও অনুসন্ধানের ফলাফল যিনি ব্যক্ত করেছেন তিনি হানাফী মাযহাবের কোনো আলিম নন, বরং তিনি শাফিয়ী মাযহাবের একজন অন্যতম খ্যাতিমান ইমাম। তিনিই হানাফী মাযহাবের বাস্তব ও সত্য বিষয়ে সাক্ষ্য দিয়ে উদারতার পরিচয় দিয়েছেন। আর যারা বলে সম্মানিত হানাফী মাযহাবে ছহীহ হাদীছ শরীফ উনার উপর আমল করা হয় না, তারা হয়তো হঠকারিতা ও বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে এমনটা বলে অথবা তারা ছহীহ হাদীছ শরীফ জানেন না বা ছহীহ হাদীছ শরীফ উনার উপর আমল করার শর্তাবলী ও নীতিমালা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। পবিত্র ছহীহ হাদীছ শরীফ উনার উপর আমল করার ক্ষেত্রে অন্যতম শর্ত হল, পবিত্র কুরআন শরীফ অথবা অপেক্ষাকৃত পবিত্র ছহীহ হাদীছ শরীফ বা মুতাওয়াতির হাদীছ শরীফ উনার সঙ্গে বিরোধপূর্ণ না হওয়া। এরকম আরো অনেক শর্তাদি রয়েছে। (কাওয়াইদ ফী উলুমিল হাদীস- ১২৬ পৃষ্ঠা, নসবুর রায়া-২/১৩৭, তালখীছুল হাবীর-১/১৭০, রদ্দুল মুহতার-৪/৩৭)
যেমন পবিত্র ছহীহ হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-
لَاصَلٰوةَ لِـمَنْ لَّـمْ يَـقْرَأْ بِفَاتِـحَةِ الْكِتَابِ
অর্থ: পবিত্র সূরায়ে ফাতিহা শরীফ পাঠ করা ব্যতীত কোনো নামায নেই। (বুখারী শরীফ-৭৫৫)
এই পবিত্র হাদীছ শরীফখানা সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ সনদে বুখারী শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত রয়েছে। এর ভিত্তিতে কেউ কেউ বলে থাকে মুক্তাদিকে ইমামের পেছনে নামায আদায়কালে পবিত্র সূরা ফাতিহা শরীফ পাঠ করতে হবে। কিন্তু পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার কয়েকটি বিষয় লক্ষ্যণীয়।
১. পবিত্র হাদীছ শরীফখানা উল্লিখিত মর্মানুসারে পবিত্র কুরআন শরীফ উনার স্পষ্ট আয়াত শরীফ উনার বিরোধী। কেননা মহান আল্লাহ পাক তিনি পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন-
وَإِذَا قُرِئَ الْقُرْاٰنُ فَاسْتَمِعُوْا لَهٗ وَأَنصِتُـوْا لَعَلَّكُمْ تُـرْحَمُوْنَ
অর্থ: আর যখন পবিত্র কুরআন শরীফ তিলাওয়াত হয় তখন মনোযোগসহকারে তা শ্রবণ কর এবং চুপ থাক। অবশ্যই তোমাদের উপর রহমত বর্ষিত হবে। (সম্মানিত ও পবিত্র সূরা আ’রাফ শরীফ: সম্মানিত ও পবিত্র আয়াত শরীফ ২০৪)
ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, উক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ নামাযের ক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছে। তাই ইমামের স্বশব্দে পবিত্র কুরআন শরীফ তিলাওয়াত অবস্থায় শ্রবণ করা ও চুপ থাকা যেমন ওয়াজিব, নিঃশব্দে পড়া অবস্থায়ও কিছু না পড়ে চুপ থাকা তেমনি ওয়াজিব। (তাফসীরে ইবনে কাসীর-২/২১২)
সুতরাং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার সঙ্গে উক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার বিরোধ হওয়ায় পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার এই অর্থ ধরা যাবে না, বরং এর সঠিক ব্যাখ্যা খুঁজে বের করতে হবে।
২. লা-মাযহাবীদের ইমাম ইবনে তাইমিয়া ও আলবানীর গবেষণায় পবিত্র হাদীছ শরীফখানা সম্মানিত দ্বীন ইসলাম উনার প্রথম যুগে রহিত হয়ে গেছে বা এর উপর আমল করার বিষয় নিষেধাজ্ঞা জারী হয়েছে। সুতরাং এরূপ পবিত্র হাদীছ শরীফ যতই ছহীহ হোক তা আমলযোগ্য নয়। (আলবানী কৃত -ছিফাতু ছালাতিন নবী ৯৮ পৃষ্ঠা, আরবী মূলকপি মাকতাবাতুল মায়ারিফ থেকে মুদ্রিত)
ছহীহ পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার উপর আমল করার জন্য আরও একটি শর্ত হলো اِسْتِدْلَالٌ বা প্রমাণ হিসাবে পেশ করার পদ্ধতি সঠিক হওয়া এবং বিষয়বস্তু ও দলিলের মাঝে সামঞ্জস্য থাকা। যেমন ধরুন কেউ কেউ পবিত্র তারাবীহ নামায আট রাকায়াতের দলীল হিসাবে উম্মুল মু’মিনীন হযরত ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম উনার থেকে বর্ণিত পবিত্র হাদীছ শরীফ “নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি রমাদ্বান শরীফ কিংবা অন্যান্য মাসে (তিন রাকায়াত) বিতরসহ এগার রাকায়াতের বেশী পড়তেন না”, পেশ করে থাকে। কিন্তু পবিত্র হাদীছ শরীফখানা ইমাম বুখারী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি পবিত্র তাহাজ্জুদ নামাযের অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন। কেননা পবিত্র হাদীছ শরীফে পবিত্র রমাদ্বান শরীফ মাস এবং অন্য মাসের কথাও উল্লেখ রয়েছে।
মোটকথা এই পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যে রমাদ্বান শরীফ মাস ও অন্য মাসে আট রাকায়াত তাহাজ্জুদ পড়তেন সে কথাই বোঝানো হয়েছে। এই পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার ভিত্তিতে পবিত্র তারাবীহ নামায আট রাকায়াত প্রমাণ করার পদ্ধতি ভুল ও হাস্যকর।
অর্থাৎ পবিত্র হাদীছ শরীফখানা ছহীহ। কিন্তু পবিত্র তারাবীহ নামাযের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। তাই সম্মানিত মাযহাবে এই পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মূল্যায়ন পবিত্র তারাবীহ নামাযের ক্ষেত্রে না করে এর যথাস্থান তাহাজ্জুদের ক্ষেত্রে করা হয়। এতে পবিত্র হাদীছ শরীফ বর্জন হয়নি; বরং এ পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার যথাযথ মূল্যায়ন ও সঠিক ক্ষেত্রে প্রয়োগ হয়েছে। (ছহীহ বুখারী শরীফ ১১৪৮ পৃষ্ঠা)
যারা পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার এসব উছূল ও নীতিমালা মানে না অথবা জানে না তারাই মানার নামে হঠকারিতা, বিদ্বেষ ও জনগণকে বিভ্রান্ত করার চক্রান্তে লিপ্ত হয়। মহান আল্লাহ পাক সবাইকে হিফাযত করুন । আমীন!
স্মর্তব্য যে, চরম হিংসা ও বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে একটি চিিহ্নত মহল সম্প্রতি সম্মানিত হানাফী মাযহাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে যে, হানাফী মাযহাবে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার যথাযথ মূল্যায়ন না করে ক্বিয়াস ও রায়কে প্রাধান্য দেয়া হয়। নাউযুবিল্লাহ! এ অভিযোগ নিছক উদ্দেশ্য প্রণোদিত, হিংসাত্মক, ভিত্তিহীন ও মিথ্যা। যারা পবিত্র কুরআন শরীফ-পবিত্র সুন্নাহ শরীফ নিয়ে কিছুটা গবেষণা করে বা হানাফী মাযহাব সম্পর্কে কিছু ধারণা রাখে তারাও এ ধরণের উক্তি করতে পারে না। বরং সম্মানিত হানাফী মাযহাবেই পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার যথাযথ মূল্যায়ন করা হয়। কোনো বিষয়ে একটি দূর্বল হাদীছ শরীফ খুঁজে পাওয়া গেলে যাবতীয় ক্বিয়াস ও রায়কে বাদ দিয়ে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাকেই প্রাধান্য দিয়ে এর ভিত্তিতে মাসআলা পেশ করা হয়। এই বাস্তবতা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। এ মর্মে অনুসরণীয় উলামাদের মূল্যবান বাণী স্বর্ণাক্ষরে লিখিত রয়েছে। এমনকি লা-মাযহাবীদের তথাকথিত ইমামরাও তা স্বীকার করে। নিম্নে প্রমাণ হিসেবে তাঁদেরই কয়েকজনের উক্তি পেশ করা হলো।
ইবনে হাযম তাঁর উছূলে ফিকহের প্রসিদ্ধ কিতাব ‘আল ইহকামে’ এবং ইমাম যাহাবী ‘মানাকিবে আবু হানিফায়’ লিখেন
اِنَّ ضَعيْفَ الْحَدِيْثِ اَوْلٰى عِنْدَ الْاِمَامِ اَبِيْ حَنِيْـفَةَ رَحْمَةُ اللهِ عَلَيْهِ مِنَ الرَّأْءِ وَالْقِيَاسِ اِذَا لَمْ يُـوْجَدْ فِي الْبَابِ غَيْرِهٖ
অর্থ: “কোনো মাসআলায় বিশুদ্ধ হাদীছ শরীফ না পাওয়া গেলে ক্বিয়াস ও রায়ের তুলনায় দুর্বল হাদীছ শরীফকে প্রাধান্য দেয়া সাইয়্যিদুনা হযরত ইমামে আ’যম রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার একটি মূলনীতি। (আল ইহকাম -৭/৯২৯, মানাকিব- ২১ পৃষ্ঠা)
লা-মাযহাবীদের স্বীকৃত ইমাম ইবনে জাওযী তিনি লিখেন-
وَاَصْحَابُ اَبِيْ حَنِيْـفَةَ رَحْمَةُ اللهِ عَلَيْهِ مُجْمِعُوْنَ عَلٰى اَنَّ مَذْهَبَ أَبِيْ حَنِيْـفَةَ رَحْمَةُ اللهِ عَلَيْهِ اَنَّ ضَعِيْفَ الْحَدِيْثِ عِنْدَهٗ اَوْلٰى مِنَ الْقِيَاسِ وَالرَّأْءِ
অর্থ: সাইয়্যিদুনা হযরত ইমামে আ’যম রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার সকল অনুসারীদের ঐক্যমতে সাইয়্যিদুনা হযরত ইমামে আ’যম রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার নিকট ক্বিয়াস ও রায় অপেক্ষা জঈফ পবিত্র হাদীছ শরীফই শ্রেষ্ঠ এবং তুলনামূলক প্রাধান্যযোগ্য। (ইলামুল মুয়াক্কিঈন- ১/৭৭ পৃষ্ঠা)
অতঃপর ইবনে কাইয়্যিম অনেকগুলো উদাহরণের আলোকে উক্ত বিষয়কে আরও স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছেন, যেসব বিষয়ে বিশুদ্ধ কোনো পবিত্র হাদীছ শরীফ নেই, আছে শুধু জঈফ পবিত্র হাদীছ শরীফ তাও আবার ক্বিয়াস ও বাহ্যিক জ্ঞানের বিরোধী; এমতাবস্থায় সাইয়্যিদুনা হযরত ইমামে আ’যম রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি কিয়াস ও বাহ্যিক জ্ঞান-বিজ্ঞান উপেক্ষা করে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পবিত্র হাদীছ শরীফকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। পবিত্র হাদীছ শরীফ জঈফ হওয়া সত্ত্বেও এ বিষয়ে অপেক্ষাকৃত বিশুদ্ধ হাদীছ শরীফ না থাকায় তা গ্রহণ করে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার প্রতি যথাযথ মুল্যায়ন ও গুরুত্বারোপ করেছেন। (ইলামুল মুয়াক্কাইন ১/৭৭)
এতদসত্ত্বেও যারা বলে- সম্মানিত হানাফী মাযহাবে হাদীছ শরীফ অপেক্ষা ক্বিয়াস শরীফ বা রায়ের প্রতি বেশি গুরুত্বারোপ করা হয়, তাহলে তা হবে সাইয়্যিদুনা হযরত ইমামে আ’যম রহমতুল্লাহি উনার ও উনার সম্মানিত মাযহাবের প্রতি ন্যাক্কারজনক অপবাদ ও হিংসাত্মক আক্রমণ।
ইমাম শারানী শাফেয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি অত্যন্ত বিশুদ্ধ সনদে সাইয়্যিদুনা হযরত ইমামে আ’যম রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার কয়েকটি উক্তি এ মর্মে উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেন, সাইয়্যিদুনা হযরত ইমামে আ’যম রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেছেন, ‘আমি মহান আল্লাহ পাক উনার শপথ করে বলছি, যে বলে আমি পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র সুন্নাহ শরীফ উনার উপর ক্বিয়াসকে অগ্রাধিকার দেই সে অবশ্যই আমার উপর মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন অপবাদ দেয়। কোনো বিষয়ে পবিত্র কুরআন শরীফ-পবিত্র সুন্নাহ শরীফ উনার উক্তি থাকলে ক্বিয়াসের কোনো প্রয়োজন নেই। তবে পবিত্র কুরআন শরীফ-পবিত্র সুন্নাহ শরীফ উনাদের আলোকেই কিয়াস করতে হয়, যা সকল ইমাম উনাদের নিকট গৃহীত একটি নীতিমালা। (আল মিযানুল কুবরা-১/৭৯ পৃষ্ঠা)
পরবর্তী সংখ্যার অপেক্ষায় থাকুন।