৩৩তম ফতওয়া হিসেবে
“মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র কুরআন শরীফ, মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র হাদীছ শরীফ, পবিত্র ইজমা শরীফ ও পবিত্র ক্বিয়াস শরীফ উনাদের দৃষ্টিতে সম্মানিত ও পবিত্র মাযহাব চতুষ্ঠয় উনাদের মধ্যে যে কোন একটি সম্মানিত ও পবিত্র মাযহাব মানা ও অনুসরণ করা ফরয ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া”- পেশ করতে পারায় মহান আল্লাহ পাক উনার পবিত্র দরবার শরীফ-এ শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি।
সম্মানিত মাযহাব বিদ্বেষী যে ফিরকা বা দলটি নিজেদেরকে ‘আহলে হাদীছ’ বা ‘সালাফী’ নামে পরিচয় দিচ্ছে, প্রাথমিক পর্যায়ে তাদের কোন নাম ছিল না। প্রথমত যখন এই দলটির অপতৎপরতা ও বিষাক্ত ছোবল ক্রমশ: সমাজের মধ্যে প্রকাশ হতে শুরু করলো, তখন সমাজের সচেতন ও আহলে হক্ব মুসলমানগণ তাদেরকে “ওহাবী, লা-মাযহাবী বা গায়রে মুকাল্লিদ” নামে ডাকতো। তাই তারা এই বদনামী মূলক নামগুলো ধামা-চাপা দেয়ার উদ্দেশ্যে প্রথমত: নিজেদের নাম ঘোষণা করে ‘মুহাম্মদী’ বা ‘মুয়াহহিদ’ হিসেবে। এরপর তারা “মুহাম্মদী ও মুয়াহহিদ” নামের পরিবর্তে নিজেদের জন্য ‘আহলে হাদীছ’ নামটি চয়ন করে। এরপর তারা সৌদি আরব থেকে আর্থিক সুবিধা ভোগ করার স্বার্থে পেট চালানোর ব্যবস্থা হিসেবে নিজেদেরকে ‘সালাফী’ নামে পরিচয় দিতে শুরু করে। বর্তমানে তারা ‘আহলে হাদীছ’ বা ‘সালাফী’ নামে পরিচিত। মোটকথা, যুগে যুগে এরা সমাজের মধ্যে যখন যে নামে সুবিধা সে নামেই আত্মপ্রকাশ করেছে।
মিশকাত শরীফের বিখ্যাত গ্রন্থ মুজাহিরে হক্ব এর লেখক আল্লামা নওয়াব কুতুবুদ্দীন রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার বর্ণনা মতে, ‘আহলে হাদীছ’ নামক নতুন ফিরকাটির যাত্রা শুরু হয় ১২৪৬ হিজরী মোতাবেক ১৮৩১ ইংরেজী সনের পরে, ইংরেজ শাসন আমলে। এর পূর্বে ভারত উপমহাদেশে এমনকি সমগ্র পৃথিবীতে ফিরকা বা সম্প্রদায়ের আদলে বর্তমান অর্থে ‘আহলে হাদীছ’ নামে কোন দলের অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। এটিই সর্বপ্রথম ফিরকা। এই ভ্রান্ত ফিরকাটি আত্মপ্রকাশের পূর্ব পর্যন্ত এই ভারতবর্ষের সকল মুসলমান সম্মানিত হানাফী মাযহাবের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন এবং আলিম-জাহিল নির্বিশেষে সকলেই সম্মানিত হানাফী মাযহাবের অনুসরণ করতেন। আব্দুল হক্ব বেনারসী (মৃত্যু ১২৮৬ হিজরী) এই ভারতবর্ষে ভ্রান্ত ও বিষাক্ত এই দলটির/মতবাদটির গোড়াপত্তন করে। তাকেই আহলে হাদীছ মতবাদের মূল প্রতিষ্ঠাতা গন্য করা হয়।
এরপর ভ্রান্ত এই মতবাদটি নিয়ে সামনে অগ্রসর হয়- মিঞা নযীর হুসাইন দেহলভী। (মৃত্যু ১৩২০ হিজরী) সে স্বীয় রচনা-বক্তৃতা ও কু-মেহনতের মাধ্যমে এই মতবাদটিকে জনসাধারণের মাঝে পরিচিত করে তুলে। তার কু-মেহনতের ফলে এই ভ্রান্ত ও বিষাক্ত মতবাদটি প্রতিষ্ঠিত সংগঠন ও সংঘবদ্ধ ফিরক্বা হিসেবে রূপান্তর হয়। এজন্য সে আহলে হাদীছদের মুখপাত্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। মিঞা নযীর হুসাইনের সবচেয়ে বড় সহযোগী ছিলো নওয়াব সিদ্দিক হাসান খান ভুপালী। (মৃত্যু ১৩১৯ হিজরী) এই ভ্রান্ত মতবাদটি জনসাধারণের মাঝে প্রচার-প্রসার করার ক্ষেত্রে তার আর্থিক সহযোগিতা ছিল অন্যতম। এজন্য তৎকালীন যুগে সেও আহলে হাদীছের মুখপাত্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিল।
এরপর আহলে হাদীছ মতবাদের নেতৃত্বে আসে- মুহাম্মদ হুসাইন বটালভী লাহোরী। নবজন্মা ভ্রান্ত এই সম্প্রদায়টি প্রথমত: নিজেদেরকে ‘মুহাম্মদী’ নামে পরিচয় দিতো। কিন্তু এই হুসাইন বটালভী বিরামহীন চেষ্টা চালিয়ে তৎকালীন ইংরেজ সরকার কর্তৃক [মুহাম্মদী নামের পরিবর্তে আহলে হাদীছ’ নামটি নিজেদের জন্য বরাদ্দ করে নেয়। এরপর সে সরলমনা মুসলমানদের মধ্যে হাদীছ মানার চাটুকদার বুলি আওড়ে এই ভয়াবহ বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দেয়। ফলে মতবাদটি আরো প্রসিদ্ধি লাভ করে। নাউযুবিল্লাহ!
ভারতবর্ষের আহলে হাদীছ নামধারী এই সম্প্রদায়টির প্রাথমিক পর্যায়ে কোন নাম ছিল না। প্রথমত: তারা নিজেদেরকে ‘মুহাম্মদী’ নামে পরিচয় দিতো। পরবর্তীতে ‘মুহাম্মদী’ নামের পরিবর্তে ‘আহলে হাদীছ’ নামটি চয়ন করে। এই নামটি সরকারিভাবে বরাদ্দ করার জন্য তৎকালীন আহলে হাদীছ নেতা মুহাম্মদ হুসাইন বটালভী বিরামহীন চেষ্টা চালিয়ে যায়। তার চেষ্টার ফলে ইংরেজ সরকার [পাঞ্জাবের গভর্নমেন্ট সেক্রেটারী লেফটেন্যান্ট ডব্লিউ. এম. এন. বাহাদুর) ১৮৮৬ ইং সনের ৩ ডিসেম্বের গোপন চুক্তির ভিত্তিতে ‘আহলে হাদীছ’ নামটি তাদের জন্য লিখিতভাবে বরাদ্দ করে দেয় এবং সরকারী কাগজপত্রে তা রেজিস্ট্রিভুক্ত করে। বটালভী সম্পাদনায় প্রকাশিত তৎকালিন ‘এশাআতুস সুন্নাহ’ পত্রিকায়ও বিষয়টি প্রকাশ করা হয়। আজ পর্যন্ত এই নামই বলবৎ রয়েছে। (তাজাল্লিয়াতে সফদর, ৫/৩৫১)
ইতিহাস সাক্ষী, ভারতবর্ষে যাদের কারণে ‘আহলে হাদীছ’ মতবাদ প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে; যারা এই মতবাদকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে; যারা এই মতবাদকে প্রচার- প্রসার করেছে, তারা সে দিনের বৃটিশ যালিম নৌ দস্যুদের তল্পীবাহকদের নিষ্ঠাবান দোসর ছিলো। ইংরেজের দালালি ও চাটুকারিতার মধ্য দিয়েই এই উপমহাদেশে ভ্রান্ত মতবাদটির আবির্ভাব ঘটেছে। ভারতবর্ষে সর্বপ্রথম আহলে হাদীছ মতবাদের সূত্রপাত ঘটেছে আব্দুল হক্ব বেনারসীর মাধ্যমে। তার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি হলো- সে প্রথমত বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের আমীর এবং ত্রয়োদশ শতাব্দীর মহান মুজাদ্দিদ ও মুহম্মদিয়া ত্বরীকার ইমাম সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলবী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার মুজাহিদ বহিনীর কর্মী হিসেবে যোগ দিয়েছিলো। কিন্তু তার ভ্রান্ত-চিন্তাধারা ও অনৈতিক আচরণের কারণে সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলবী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি তাকে নিজ মুজাহিদ বাহিনী থেকে বহিষ্কার করে দেন। তৎকালিন ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ এ মর্মে উলামায়ে হারামাইনের কাছে ফতওয়া চাইলে, সেখানকার চার মাযহাবের মুফতীগণ তাকে স্পষ্টরূপে ভ্রান্ত, পথভ্রষ্ট ও হত্যাযোগ্য বলে ফতোয়াও জারি করেন। আভ্যন্তরীন দিক থেকে আব্দুল হক্ব বেনারসী ইংরেজের দালাল ছিলো এবং পরবর্তীতে সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার মুজাহিদ বাহিনীর বিদ্রোহী গ্রুপের মুখপাত্র মনোনীত হয়। এক পর্যায়ে সে ফতয়াও প্রদান করে যে, ভারতবর্ষের ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা হারাম। যেমন নাকি গোলাম আহমদ কাদিয়ানী ফতওয়া দিয়েছিল। নাউযুবিল্লাহ! (তুহফাতুল আরব ওয়াল আজম, ১/২৬; আন-নাজাতুল কামিলাহ, পৃ. ২১৪; তাম্বিহুদ দাল্লীন, পৃ. ৩১)
আহলে হাদীছ মতবাদের সেক্রেটারী তথা প্রাতিষ্ঠানিক রূপকার ছিলো হুসাইন বটালভী। এই বটালভীই ইংরেজ সরকার থেকে নিজেদের মতবাদের জন্য ‘আহলে হাদীছ’ নামটি বরাদ্দ করেছিলো। বটালভীর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি হলো- সে তৎকালীন ইংরেজ সরকারের দালাল ছিলো। এর প্রমাণ হলো- সে নিজের লিখিত বই ‘আল-হায়াত বা’দাল মামাত’-এর ৯৩নং পৃষ্ঠায় লিখেছে: ‘আহলে হাদীছ’ দলটি বৃটিশ সরকারের কল্যাণপ্রত্যাশী, চুক্তি রক্ষাকারী ও অনুগত হওয়ার বলিষ্ঠ প্রমাণ হচ্ছে: তারা বৃটিশ সরকারের অধীনে থাকাকে কোন ইসলামী রাষ্ট্রের অধীনে থাকার চেয়ে উত্তম মনে করে। নাউযুবিল্লাহ! এই বটালভী ইংরেজের বিরুদ্ধে জিহাদ করার বিপক্ষে ‘আল-ইকতিসাদ ফী মাসায়িলিল জিহাদ’ নামক যে গ্রন্থটি লিখেছে, তাতে সে জিহাদের বিধান রহিত বলে ঘোষণা করেছে। নাউযুবিল্লাহ!
মোটকথা, একদিকে এই সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ সরকারের হিংস্র থাবায় মুসলিম উম্মাহর হাজার-হাজার আলিম-ওলামা ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলছেন, হাজার-হাজার মসজিদ- মাদরাসা বন্ধ হচ্ছে, লক্ষ-লক্ষ পবিত্র করআন শরীফ উনার কপি ভস্মীভূত হচ্ছে। অপরদিকে এমন করুণ মুহুর্তে আহলে হাদীছ নামধারী এই নবজন্মা দলটি বৃটিশ সরকারের দালালি ও গোলামী করে তাদের আধিপত্য মজবুত করার হীনচেষ্টা চালিয়েছে। মূলত ইংরেজের দালালী করার জন্যই এই ভ্রান্ত দলটির উদ্ভব ঘটেছে ১২৪৬ হিজরী সনে। নাউযুবিল্লাহ!
আরব দেশে ইবনে আব্দুল ওয়াহাব নজদী নামে এক ব্যক্তি ছিল। তার প্রতিষ্ঠিত দলটি কখনো নিজেদেরকে “মুওয়াহহিদীন তথা একত্ববাদী বলে পরিচয় দিত; আবার কখনো ‘মুহাম্মদী’ নামে পরিচয় দিতো। তার তত্বাবধানে পরিচালিত এই মতবাদটি ইতিহাসে ‘ওহাবী মতবাদ’ নামে পরিচিত। ফলে বেশিরভাগ মুসলমান ওহাবী মতবাদকে একটি বাতিল মতবাদ মনে করলো। এই মতবাদের কর্মসূচীসমূহ থেকে কয়েকটি হলো: (১) তারা ‘তাবাররুক বিল-মাকান’কে অস্বীকার করতো। এর ভিত্তিতে তারা নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের স্মৃতি-বিজড়িত স্থানসমূহকে সমূলে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। নাউযুবিল্লাহ! (২) তারা ইলমে তাছাওউফ তথা শায়েখ বা পীর-মুরীদীকে সমূলে অস্বীকার করতো। নাউযুবিল্লাহ! (৩) তারা বুযুর্গদের মাজার শরীফ যিয়ারতের জন্য সফর করাকে হারাম মনে করতো। নাউযুবিল্লাহ! (৪) তারা মুজতাহিদ ইমামগণের তাকলীদ তথা মাযহাব মানাকে অস্বীকার করতো। নাউযুবিল্লাহ! এগুলো ছিল ওহাবী মতবাদের মূল কর্মসূচী। জমহুরে উলামায়ে কিরাম তাদের এসব কর্মসূচী ও চিন্তাধারাকে কুফরী আখ্যা দিয়েছেন।
মিসর, ইরাক, আফগানিস্তান, হিন্দুস্তান প্রভৃতি দেশের কিছু আলিমও ইবনে আব্দুল ওহাব নজদী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এই ‘ওহাবী মতবাদের চিন্তাধারায় প্রভাবিত হয়। ভারতবর্ষের কথিত আহলে হাদীছরাও (মাযহাব অস্বীকার করার সূত্রে মিল থাকায়) উক্ত ওহাবী মতবাদের চিন্তাধারায় প্রভাবিত হয়েছিল। একারণে তাদের অনুসরণে এরাও প্রথমত নিজেদেরকে ‘মুহাম্মদি’ বা ‘মুয়াহহিদীন’ নামে পরিচয় দিতো।
এখানে উল্লেখ্য যে, শাহ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিছ দেহলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার ফতওয়ার ভিত্তিতেই সর্বপ্রথম এদেশে সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে ‘স্বাধীনতা আন্দোলন’-এর সূচনা হয়। এই স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে আরব দেশীয় উপরোক্ত ‘ওহাবী আন্দোলন’-এর কোনই সম্পর্ক বা যোগসূত্র ছিল না। কিন্তু চতুর ইংরেজরা সমাজের মানুষের কাছে ইংরেজ বিরোধী এই জিহাদী আন্দোলনকে কলঙ্কিত করার লক্ষ্যে একটি অপকৌশল অবলম্বন করলো। তারা এই স্বাধীনতাকামী আন্দোলনটিকে ‘ওহাবী আন্দোলন নামে অপপ্রচার করা শুরু করলো। যাতে সমাজের মানুষের অন্তরে অতি সহজেই এই আন্দোলনের প্রতি অনীহাভাব সৃষ্টি হয়। নাউযুবিল্লাহ!
পরবর্তীতে ইংরেজদের সূরে সুর মিলিয়ে যে কোন ইসলামী আন্দোলনকে ‘ওহাবী আন্দোলন’ বলে আখ্যায়িত করার অপপ্রয়াস সূচীত হয়। যদিও ইসলামী আন্দোলনের ওলামা-মাশায়েখগণ উনাদের উদ্দেশ্য ও চিন্তাধারা কোন ক্ষেত্রেই আরব দেশীয় ‘ওহাবী আন্দোলন’-এর সাথে জড়িত নন। ভারতবর্ষের আহলে হাদীছদের চিন্তাধারা উক্ত আরব দেশীয় ‘ওহাবী আন্দোলন’-এর চিন্তাধারার সাথে মিল থাকায়, তারা প্রথমত নিজেদেরকে তাদের অনুসরণে মুহাম্মদী বা মুয়াহহিদীন নামে পরিচয় দিতো। একপর্যায়ে হুসাইন বটালভী চিন্তা করে দেখলো যে, ওহাবী শব্দটি ইংরেজের দুশমনদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। অতএব নামের ক্ষেত্রে যদি আমাদের নাম ইংরেজদের দুশমনের নামের সাথে মিলে যায়, তবে তো ইংরেজরা আমাদেরকে দুশমন মনে করবে। কাজেই এসব নাম আর রাখা যাবে না। অবশেষে সে ইংরেজ সরকারের কাছে লিখিতভাবে দরখাস্ত করলো যে, আমরা মুয়াহহিদ বা মুহাম্মদী দল নই অর্থাৎ আমরা আরবীয় ওহাবী দল নই। এককথায়, আমরা ইংরেজ বিরোধী নই; বরং ইংরেজের পক্ষের দল; যা বারবার প্রমাণিতও হয়েছে। কাজেই এসব নামের পরিবর্তে আমাদের জন্য ‘আহলে হাদীছ’ নামটি রেজিস্ট্রার করে দেয়া হোক। ইংরেজ সরকার তদন্ত করে দেখলো যে, প্রকৃতপক্ষেই এই দলটি ইংরেজ বিরোধী নয়; বরং ইংরেজের পক্ষের দল। তাই ইংরেজ সরকার তাদের জন্য ‘আহলে হাদীছ’ নামটি বরাদ্দ করে দিলো। এই হলো ইংরেজের মাধ্যমে ‘আহলে হাদীছ’ নামটি বরাদ্দ করার মূল রহস্য।
‘আহলে হাদীছ’ একটি পরিভাষা। এর অর্থ হলো: হাদীছওয়ালা বা হাদীছ চর্চাকারী। সারকথা, যারা পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার নকল- রেওয়ায়াত, জরাহ-তা’দীল, তাসহীহ-তাজয়ীফ তথা ইলমে হাদীছের চর্চাকে নিজেদের পেশা বা জীবনের একমাত্র সম্বল বানিয়ে নিয়েছেন, তাদেরকে পরিভাষায় “আহলে হাদীছ/আছহাবে হাদীছ/মুহাদ্দিছ” বলা হয়। সুনানে তিরমিযীতে ‘আহলে হাদীছ/আছহাবে হাদীছ/মুহাদ্দিছ’ পরিভাষাগুলো প্রচুর পরিমাণে ব্যবহৃত হয়েছে। তা দ্বারা এই পেশার ব্যক্তিবর্গকেই বুঝানো হয়েছে। উনারাই “প্রকৃত আহলে হাদীছ”।
এ প্রসঙ্গে মুসনাদে শাফিয়ী, মুসনাদে আহমদ ও তিরমিযীতে ইবনে মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত আছে, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-
نَضَرَ اللهُ عَبْدًا سَمِعَ مَقَالَتِي فَحَفِظَهَا وَوَعَاهَا وَأَذَاهَا
অর্থাৎ, “যে ব্যক্তি চারটি কাজ করবে মহান আল্লাহ পাক পরকালে তার চেহারা উজ্জ্বল করে দিবেন অর্থাৎ তাকে খুশি করে দিবেন। (ক) যে ব্যক্তি আমার পবিত্র হাদীছ শরীফ শ্রবণ করবে। (খ) পবিত্র হাদীছ শরীফগুলো স্মৃতিশক্তির মাধ্যমে/লিখিত আকারে স্মরণ রাখবে। (গ) পবিত্র হাদীছ শরীফগুলোকে বিনষ্ট হওয়া থেকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করবে। (ঘ) পবিত্র হাদীছ শরীফগুলো যেভাবে শুনেছে হুবহু অবিকৃত অবস্থায় অপরের কাছে পৌঁছে দিবে।” যার মধ্যে এই চারটি গুণ পাওয়া যাবে সে-ই প্রকৃত আহলে হাদীছ। পরকালে মহান আল্লাহ পাক এই চারগুণ বিশিষ্ট লোকের চেহারা-ই উজ্জ্বল করে দিবেন অর্থাৎ তাদেরকে খুশি করে দিবেন। সুবহানাল্লাহ!
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা স্পষ্ট বুঝা যায় যে, ‘আহলে হাদীছ’ হচ্ছে মুহাদ্দিছীনের একটি বিশেষ পরিভাষা। এই পরিভাষাটি হুসাইন বটালভীর প্রতিষ্ঠিত পরিভাষা নয়; বরং এটি তার জন্মের বহু পূর্ব থেকেই মুহাদ্দিছীনের মাঝে প্রচলিত ছিল। মুহাদ্দিছীনের ধারাবাহিকতা তো হুসাইন বটালভী থেকে শুরু হয়নি; বরং হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের যুগ থেকেই শুরু হয়েছে। অতএব আহলে হাদীছ পরিভাষাটি হুসাইন বটালভীর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রশ্নই উঠে না। এককথায়, যখন থেকে (অর্থাৎ দ্বীন ইসলাম উনার শুরু যুগ থেকে) দুনিয়াতে হাদীছ শরীফ চালু হয়েছেন, তখন থেকেই ‘আহলে হাদীছ’ পরিভাষাটিও চালু হয়েছে। সুবহানাল্লাহ!
পূর্বে বলা হয়েছে, যারা ইলমে হাদীছের চর্চাকে নিজেদের জীবনের একমাত্র সম্বল বানিয়ে নিয়েছেন, পরিভাষায় তাদেরকে ‘আহলে হাদীছ’ বলা হয়। ইসলাম উনার শুরুর যুগ থেকে ১২০০ বছর পর্যন্ত [হুসাইন বটালভীর জন্মের পূর্ব পর্যন্ত] আহলে হাদীছ বলতে এই পেশার লোকদেরকে বুঝানো হতো। উনারা প্রকৃত আহলে হাদীছ। যেমন: চার মাযহাবের ইমামগণ, ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম, ইমাম নাসাঈ রহমতুল্লাহি আলাইহিম প্রমূখ। উনারাই জাতির নিকট প্রকৃত অর্থে “আহলে হাদীছ/আছহাবে হাদীছ/মুহাদ্দিছ” নামে পরিচিত।
কিন্তু আশ্চর্যে্যর বিষয় হলো- আমাদের ভারত উপমহাদেশে ১২৪৬ হিজরীর পর থেকে ‘আহলে হাদীছ’-এর সংজ্ঞা বা পরিচিতি হলো- যে ব্যক্তি মাযহাব অমান্য করবে সে-ই আহলে হাদীছ। নাউযুবিল্লাহ! মাযহাবের প্রতি যে যত বেশি কটূক্তি করতে পারবে এবং ইমাম চতুষ্টয়ের সুক্ষ্মদৃষ্টি নিয়ে অপব্যাখ্যা করতে পারবে ও উনাদের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ নিয়ে সমালোচনা করতে পারবে, সে-ই প্রকৃত আহলে হাদীছ হিসেবে ধর্তব্য। নাউযুবিল্লাহ! অথচ যুগে যুগে যারাই “প্রকৃত আহলে-হাদীছ” ছিলেন, উনাদের মনোভাব ছিল খুবই স্বচ্ছ। এ কারণে উনারা সকলেই আহলে হাদীছ তথা হাদীছ শরীফ চর্চাকারী হওয়া সত্ত্বেও অকপটে মুজতাহিদীনে কিরাম উনাদেরকে সম্মান করতেন এবং নিজেরা মুজতাহিদ না হলেও কোন না কোন ইমামের মাযহাব অনুসরণ করে চলতেন। নিজেরা পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার কিতাব সংকলন করা সত্ত্বেও তাকলীদ বাদ দিয়ে ওইসব কিতাবের ওপর আমল করতেন না।
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ভারতবর্ষের এই নবজন্মা এই ফিরক্বাটি প্রকৃত আহলে হাদীছ নয়। বরং ‘জাল আহলে হাদীছ’। কারণ তাদের মধ্যে প্রকৃত আহলে হাদীছ হওয়ার শর্তটি (ইলমে হাদীছের চর্চাকে জীবনের একমাত্র সম্বল বানিয়ে নেয়া) অনুপস্থিত। এরা ইলমে হাদীছের চর্চা তো দূরের কথা; এদের অধিকাংশরা জীবনে একটি হাদীছও মূলগ্রন্থ থেকে পড়েনি, শেখেনি। পবিত্র হাদীছ শরীফ সম্পর্কে এদের কোন ধারণাই নেই। শুধু দলের ফরম পূরণ করেই ‘আহলে হাদীছ’ উপাধি পেয়েছে। এরা মাযহাবের ইমামদের সমালোচনা করাকে মহান আল্লাহ পাক উনার তাসবীহ পাঠ করা অপেক্ষা বেশি ছাওয়াব মনে করে। নাউযুবিল্লাহ! এরা বুখারী-বুখারী বলে চিল্লাচিল্লি করলেও জীবনে আসল বুখারী (তথা ইমাম বুখারী কর্তৃক আরবী ভাষায় রচিত কিতাবটি) পড়বে তো দূরের কথা, চোখেও দেখেনি। এদের নারী-পুরুষ যারা গণ্ডমূর্খ তারাও আহলে হাদীছ, এমনকি এদের নির্বোধ শিশুরাও আহলে হাদীছ! নাউযুবিল্লাহ!
স্মর্তব্য যে, অতীত যুগে “আহলে হাদীছ” নামের যে মুবারক জামায়াত ছিল, সেই মুবারক জামায়াতের মুবারক নামটি চুরি করে নিয়েছে এই মাযহাব বিদ্বেষী লা-মাযহাবীরা। তারা পুরাতন প্রচলিত নামের আদলে নতুন দল গঠন করেছে। মুসলিম উম্মাহ যেহেতু পূর্ব থেকেই ‘আহলে হাদীছ’ নামক পরিভাষার সাথে পরিচিত, তাই সুপরিচিত নাম ব্যবহার করেছে। যাতে করে সাধারণ মুসলমান তাদেরকে পূর্বযুগের প্রকৃত আহলে হাদীছ মনে করে প্রতারিত হয়। আসলে তারা হচ্ছে জাল আহলে হাদীছ।
(পরবর্তী সংখ্যার অপেক্ষায় থাকুন)