মাহে জুমাদাল উলা ও জুমাদাল উখরা

সংখ্যা: ১৩১তম সংখ্যা | বিভাগ:

হযরত মাওলানা মুফতী সাইয়্যিদ শোয়াইব আহমদ

“জুমাদাল উলা’ মাসটি জলীলুল ক্বদর ছাহাবী হযরত সালমান ফারসী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর ওফাত মুবারকের মাস।   আর ‘জুমাদাল উখ্রা’ মাসটি আফদ্বালুন্ নাস বা’দাল আম্বিয়া হযরত আবু বকর ছিদ্দীক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর ওফাত মুবারকের মাস।

প্রতিটি মাস, দিন, তারিখ ফযীলতপ্রাপ্ত ও আলোচিত কোন না কোন অনুসরণীয় ব্যক্তিত্বের মুবারক জীবন প্রবাহের দ্বারা। অতএব, আলোচ্য মাস দু’টি হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম-এর কারণে বুযূর্গী-সম্মানের হক্বদার।

হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মুবারক ছোহবতের কারণে এমন ফযীলত হাছিল করেছেন যে, পূর্ববতী-পরবর্তী কোন উম্মতের পক্ষে তাঁদের সমকক্ষ ফযীলত হাছিল করা কখনই সম্ভব হবে না। তাঁরা অসাধারণ মর্যাদার অধিকারী। তাঁরা আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ছোহবতে যে নূর লাভ করেছিলেন সে নূর তাঁদের অসাধারণ মর্যাদার উৎস। তাঁদের সমাজ ছিল একটি আদর্শ মানব সমাজ। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁদের সততা, বিশ্বস্ততা, আত্মত্যাগ, সদাচরণ, আল্লাহভীতি, তাক্বওয়া, ইহসান, বীরত্ব, সাহসীকতা সবই ছিল নজীরবিহীন।  তাঁরা ছিলেন নিষ্কুলুষ ও পবিত্র চরিত্রের অধিকারী। তাঁরা সর্বকালের, সর্বযুগের, সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ মানব এবং হযরত রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আদর্শের উজ্জল প্রতীক। কথায়-কাজে, উঠা-বসায়, আচার-আচরণে ইত্যাদি যাবতীয় কর্মে হযরত রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আদর্শ তাঁদের মাঝে প্রতিফলিত হয়। তাঁরা ছিলেন রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বাস্তব অনুকরণকারী ও অনুসরণকারী ব্যক্তি। এ কারণেই তাঁদের মুবারক চরিত্রে এমন সামান্যতম কলঙ্কও প্রবেশ করেনি যার কারণে তাঁদের সমালোচনা করা যেতে পারে।  ছাহাবীগণের মর্যাদা সম্পর্কে কুরআন শরীফে বহু আয়াত শরীফ বর্ণিত রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে,

رضى الله عنهم ورضوا عنه.

অর্থঃ- “আল্লাহ পাক তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তাঁরাও আল্লাহ পাক-এর প্রতি সন্তুষ্ট।” (সূরা বাইয়্যিনাহ/৮)

السبقون الاولون من المهجرين والانصار والذين اتبعوهم باحسان رضى الله عنهم ورضوا عنه.

অর্থঃ- “মুহাজির ও আনছার অগ্রগামী ছাহাবীগণ এবং উনাদেরকে যারা উত্তমভাবে অনুসরণ করবে আল্লাহ পাক উনাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং উনারাও আল্লাহ পাক-এর প্রতি সন্তুষ্ট।” (সূরা তওবা/১০০)

فان امنوا بمثل ما امنتم به فقد اهتدوا.

অর্থঃ- “লোকেরা যদি ছাহাবীগণের ঈমানের মত ঈমান আনয়ন করে তাহলে তারা হিদায়াত লাভ করবে।” (সূরা বাক্বারা১৩৭) মহান আল্লাহ পাক তাঁর কালাম পাকে ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের সম্পর্কে উপরোল্লিখিত ঘোষণা এবং প্রশংসার পর কোন মুসলমানই তাঁদের সম্বন্ধে বিরূপ ধারণা বা সমালোচনা করতে পারে না। স্বয়ং আল্লাহ পাক যাদের প্রশংসা করে সততা, হিদায়াত ও ন্যায়নিষ্ঠ প্রভৃতির উপাধি এবং সাক্ষ্য শাহাদত ঘোষণা করেছেন, তাঁদের সম্বন্ধে বিপরীত ধারণা, সমালোচনা এবং ভাল-মন্দ বিচার করতে যাওয়া সুস্পষ্টতঃ আল্লাহ পাক-এর ঘোষণার প্রতি অনাস্থা প্রকাশ ব্যতীত আর কিছুই নয় এবং বলাবাহুল্য যে, কোন মুসলমানই এ ধরণের অভিশপ্ত ধারণা এবং দুঃসাহস করতে পারে না।

পবিত্র কুরআন শরীফে হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের উচ্চ প্রসংসা করে তাঁদেরকে হিদায়াতের মানদণ্ড বলে ঘোষণা করেন, তাঁদের ঈমান ও আদর্শকে পরবর্তীদের ঈমান আমলের শুদ্ধাশুদ্ধির কষ্টিপাথর রূপে নির্ণীত করেছেন। এটাই শেষ নয়, বরং হযরত রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও অনুরূপ সুস্পষ্টভাবে হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের উচ্চ প্রশংসা করে তাঁদের আদর্শ অবশ্যই উম্মতকে অনুসরণ করার নির্দেশ প্রদান করেছেন। তাঁদের সমালোচনা ও স্বকীয়তা বিনষ্ট করার অভিশপ্ত প্রচেষ্টা হতে রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উম্মতদেরকে বিরত থাকতে কঠোরভাবে নির্দেশ প্রদান করেছেন।

হযরত উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত, একদিন রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমদের ইখতিলাফ সম্পর্কে আল্লাহ পাক-এর কাছে জিজ্ঞেস করলে আল্লাহ পাক ওহীর মাধ্যমে জানালেন, ‘হে আমার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনার ছাহাবাগণ আমার কাছে আসমানের প্রতীক। যে কেউ তাঁদের কোন আদর্শ অনুসরণ করবে সে সুনিশ্চিত হেদায়াত লাভ করবে।’ রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা করে বলেন, ‘আমার ছাহাবাগণ নক্ষত্র সদৃশ। তাঁদের যে কোন জনের অনুসরণে তোমরা হিদায়াত লাভ করবে।’  (মিশকাত)

রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের সমালোচনা নিষিদ্ধ করে বলেন, আল্লাহ পাক-এর শপথ! তোমরা আমার ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের সমালোচনা করবে না। মনে রেখ, তাঁদের প্রতি বিদ্বেষ, ভালবাসা প্রকান্তরে আমরা প্রতিই বিদ্বেষ, ভালবাসা বই কিছু নয়। (তিরমিযী, শিফা)

 তিনি আরো বলেন, আমার ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণকে তোমরা গালি দিবে না। মনে রাখবে, আল্লাহ পাক-এর পথে তাঁদের যে কেউ ‘এক মুদ’ যব দান করেছেন, তোমরা উহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণ দান করেও তাঁদের সে এক মুদ যবের মর্যাদা লাভ করতে পারবে না।’ (তিরমিযী)

 তিনি আরো বলেন, আমার ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণকে কেউ গালমন্দ দিচ্ছে যদি দেখ, তাহলে বলো, তোমদের এ নিকৃষ্ট কাজের জন্য আল্লাহ পাক-এর লা’নত বর্ষিত হোক।’ (তিরমিযী)

 ইতিহাসের সূত্র ধরে অনেকেই হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের সমালোচনা করে, তারা অনেকেই ইতিহাসের সঠিক বর্ণনা সম্বন্ধে সচেতন নয়। তাই ইতিহাস পরিবেশিত বর্ণনাকে সত্য বলে মনে করে বিভ্রান্ত হয়।

অতএব, মনে রাখতে হবে যে, যদি ঐতিহাসিকের বর্ণনা কুরআন-সুন্নাহ্র বিরোধী হয় তাহলে বুঝতে হবে ইতিহাস চাপা পড়ে রয়েছে। সঠিক তথ্য পরিবেশিত হয়নি। ইতিহাসের বিশ্লেষণে কোন মতেই কুরআন-সুন্নাহ্কে বিসর্জন দেয়া চলবে না। এক কথায় বিরোধের ক্ষেত্রে কুরআন-সুন্নাহ্ হবে বিচারের মানদণ্ড, ইতিহাস নয়। ইতিহাসের কিছু বর্ণনা ছাহাবা চরিত্রের উচ্চ মর্যাদা, উন্নত আদর্শ সম্পর্কে জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সঞ্চার করে। যেমন, হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম সম্পর্কে, হযরত ইউনূছ আলাইহিস্ সালাম সম্পর্কে, হযরত যাকারিয়া আলাইহিস্ সালাম সম্পর্কে, হযরত ইমাম হাসান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর শাহাদাত, কারবালার ঘটনা, হযরত মুয়াবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ইত্যাদি সম্পর্কে।

বলাবাহুল্য, কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ বর্ণিত নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালাম এবং হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের মর্যাদা সম্পর্কে যথোচিত সচেতনার এবং ইতিহাস ও পরিস্থিতির সঠিক মূল্যায়নের অভাবই এ বিভ্রান্তির মূল কারণ।      এরূপ ক্ষেত্রে প্রথমেই মনে রাখতে হবে যে, নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালাম এবং হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের উচ্চ মর্যাদা কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফে বর্ণিত বর্ণনা পক্ষান্তরে এর পরিপন্থী বর্ণনা ও ঘটনা ইতিহাস বা ঐতিহাসিকের পরিবেশনা অসত্য।

মূলতঃ হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারী কাফির। আল্লাহ পাক বলেন,

ليغيظ بهم الكفار.

অর্থঃ- “কাফিররাই তাঁদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে থাকে।” (সূরা ফাতহ্/২৯) হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,

من غاظه اصحاب محمد صلى الله عليه وسلم فهو كافر.

অর্থঃ- “যে ব্যক্তি আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ছাহাবীদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে সে কাফির।”       হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের মুহব্বত ঈমানের অংশ বিশেষ, তাঁদেরকে অনুসরণ করা ওয়াজিব এবং তাঁরা আল্লাহ্ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভের ওসীলা।

সম্মানিত জুমাদাল ঊলা শরীফ ও সম্মানিত জুমাদাল উখরা শরীফ মাস এবং উনাদের প্রাসঙ্গিক আলোচনা

মাহে রবিউস্ সানী ও তার প্রাসঙ্গিক আলোচনা

মাহে রজব ও তার প্রাসঙ্গিক আলোচনা

মাহে শা’বান ও তার প্রাসঙ্গিক আলোচনা 

 মাহে রমাদ্বান শরীফ ও তার প্রাসঙ্গিক আলোচনা