মাহে মুহররমুল হারাম ও তার প্রাসঙ্গিক আলোচনা

সংখ্যা: ১৩৮তম সংখ্যা | বিভাগ:

-হযরত মাওলানা মুফতী সাইয়্যিদ শোয়াইব আহমদ

 আরবী বছরের প্রথম মাস মুর্হরম। আরবী বার মাসের মধ্যে যে চারটি মাসকে হারাম বা সম্মানিত বলে কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফে ঘোষণা করা হয়েছে, মুর্হরম মাস তন্মধ্যে অন্যতম। আসমান-যমীন সৃষ্টিকাল হতেই এ মাসটি বিশেষভাবে সম্মানিত হয়ে আসছে।  হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে, আল্লাহ পাক-এর হাবীব, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,

 اكرموا المحرم من اكرم المحرم اكرمه الله بالجنة ونجاه من النار.

 অর্থঃ- “তোমরা মুর্হরম মাসকে সম্মান কর। যে ব্যক্তি মুর্হরম মাসকে সম্মান করবে, আল্লাহ্ পাক তাকে জান্নাত দ্বারা সম্মানিত করবেন এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করবেন।” এ মাসেরই দশ তারিখ অর্থাৎ দশই-মুর্হরম “আশুরা” দিনটি বিশ্বব্যাপী এক আলোচিত দিন। সৃষ্টির সূচনা হয় এই দিনে এবং সৃষ্টির সমাপ্তিও ঘটবে এ দিনেই। বিশেষ বিশেষ সৃষ্টি এ দিনেই করা হয় এবং বিশেষ বিশেষ ঘটনা এ দিনেই সংঘটিত হয়।  আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ্, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে শুরু করে প্রথম নবী ও রসূল হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম পর্যন্ত প্রায় সকল নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালাম-এর কোন না কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনা এদিনে সংঘটিত হয়েছে। সঙ্গত কারণেই এ দিনটি আমাদের সবার জন্য এক মহান আনুষ্ঠানিকতার দিন, রহমত, বরকত, সাকীনা হাছিল করার দিন। তাই এ দিনে বেশকিছু আমলের কথা হাদীছ শরীফে বর্ণিত হয়েছে- ১. ১০ই মুর্হরম উপলক্ষ্যে দু’টি রোযা রাখা। অর্থাৎ ৯, ১০ অথবা ১০, ১১ তারিখ। শুধু ১০ তারিখ রোযা রাখা মাকরূহ। সম্ভব হলে উক্ত দিনে যারা রোযা রাখবে তাদের এক বা একাধিকজনকে ইফতার করানো। ২. সাধ্যমত পরিবারবর্গকে ভাল খাওয়ানো। ৩. গোসল করা। ৪. চোখে সুরমা দেয়া। ৫. গরীবদেরকে পানাহার করানো। ৬. ইয়াতীমের মাথায় হাত বুলানো।  এসব প্রত্যেকটি আমলই সুন্নত এবং অশেষ ফযীলত লাভের কারণ। যেমন এ প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে, “আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আশুরার রোযার ফযীলত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, এটা বিগত দিনের গুণাহ্র কাফ্ফারা স্বরূপ।” (মুসলিম শরীফ)  হাদীছ শরীফে আরো ইরশাদ হয়েছে, “হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, কোন ব্যক্তি যদি আশুরার দিনে তার পরিবারবর্গকে ভাল খাওয়ায়-পরায় তাহলে আল্লাহ পাক তাকে এক বৎসরের জন্য স্বচ্ছলতা দান করবেন।” (ত্ববারানী শরীফ) এ প্রসঙ্গে একটি ওয়াকেয়া বর্ণিত রয়েছে, এক ব্যক্তি ছিল গরীব, দিনমজুর ও আলিম। একবার অসুস্থতার কারণে তিনি তিন দিন যাবত কাজ করতে পারলেন না। চতুর্থ দিন ছিল আশুরার দিন। তিনি আশুরার দিনে ভাল খাওয়ার ফযীলত সম্পর্কে জানতেন। তখন ছিল কাজীদের (বিচারক) যুগ। কাজী ছাহেব ধনী ব্যক্তি ছিলেন। তার কাছে আশুরার ফযীলতের কথা বলে এবং নিজের অসুস্থ্যতা ও পরিবারের অভুক্ত থাকার কথা উল্লেখ করে ১০ সের আটা, ১০ সের গোশ্ত ও দুই দিরহাম চাইলেন যে, ‘এই পরিমাণ খাদ্যদ্রব্য হাদিয়া অথবা কর্জ হিসাবে দিন।’ কাজী ছাহেব তাকে যোহরের সময় আসতে বললেন। যোহরের সময় কাজী ছাহেব বললেন, আছরে আসতে। কিন্তু এরপরে আছরের সময় মাগরিব, মাগরিবের সময় ইশা এবং ইশার সময় সরাসরি না করে দিলেন। তখন গরীব, আলিম ব্যক্তি বললেন, হে কাজী ছাহেব! আপনি আমাকে দিতে পারবেন না সেটা আগেই বলতে পারতেন, আমি অন্য কোথাও ব্যবস্থা করতাম। কিন্তু তা না করে আমাকে সারাদিন ঘুরিয়ে এই শেষ মুহূর্তে না করছেন? কাজী ছাহেব সেই গরীব, আলিম ব্যক্তির কথায় কর্ণপাত না করে গেটের দরজা বন্ধ করে বাড়ীর ভিতরে প্রবেশ করলেন।  মনের দুঃখে লোকটি তখন কাঁদতে কাঁদতে বাড়ীর দিকে রওয়ানা হলেন। পথে ছিল এক খ্রীষ্টানের বাড়ী। একজন বয়স্ক ব্যক্তিকে কাঁদতে দেখে উক্ত খ্রীষ্টান তাঁকে কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলো। কিন্তুম বিধর্মী বিধায় খ্রীষ্টানকে প্রথমে তিনি কিছু বলতে চাইলেন না। অতঃপর খ্রীষ্টানের অধীর আগ্রহের কারণে তিনি আশুরার ফযীলত ও তার বর্তমান দুরাবস্থার কথা ব্যক্ত করলেন। খ্রীষ্টান ব্যক্তি তখন উৎসাহী হয়ে তাকে আশুরার সম্মানার্থে ১০ সের আটা, ১০ সের গোশ্ত, ২ দিরহাম এবং অতিরিক্ত আরও ২০ দিরহাম দিল এবং বললো যে, আপনাকে আমি আশুরার সম্মানার্থে প্রতিমাসে এ পরিমাণ হাদিয়া দিব। ঐ ব্যক্তি তখন তা নিয়ে বাড়ীতে গেলেন এবং খাবার তৈরী করে ছেলে-মেয়েসহ আহার করলো। অতঃপর দোয়া করলো, “আয় আল্লাহ পাক! যে ব্যক্তি আমাকে সন্তুষ্ট করলো, আমার ছেলে-মেয়েদের মুখে হাসি ফোটালো, আল্লাহ পাক! আপনি তার দিল খুশি করে দিন, তাকে সন্তুষ্ট করে দিন।”  ঐ রাতে কাজী ছাহেব স্বপ¦ দেখলেন, স্বপ্নে কাজী ছাহেবকে বলা হচ্ছে, হে কাজী! তুমি মাথা উত্তোলন করো। মাথা তুলে কাজী দেখতে পেলেন যে, তার সামনে দুটি বেহেশ্তের বালাখানা। একটি স্বর্ণের আরেকটি রৌপ্যের। কাজী ছাহেব বললেন, ‘আয় আল্লাহ পাক! এটা কি?’ গায়িবী আওয়াজ হলো, ‘এ বালাখানা দু’টি তোমার ছিল। কিন্তু এখন আর তোমার নেই। কারণ তোমার কাছে যে গরীব আলিম লোকটি আশুরা উপলক্ষে সাহায্যের জন্য এসেছিলেন তাকে তুমি সাহায্য করনি। এজন্য এ বালাখানা দু’টি এখন ওমুক খ্রীষ্টান লোকের হয়েছে।’ অতঃপর কাজী ছাহেবের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। ঘুম থেকে উঠে ওজু ও নামায আদায় করে সেই খ্রীষ্টানের বাড়ীতে গেলেন। খ্রীষ্টান কাজী ছাহেবকে দেখে বিস্ময়াভুত হলো। কারণ কাজী ছাহেব খ্রীষ্টানের পরশী হওয়া সত্ত্বেও জন্মের পর থেকে এ পর্যন্ত কোন সময় তার বাড়ীতে আসতে দেখেনি। অতঃপর  খ্রীষ্টান কাজী ছাহেবকে বললো, ‘আপনি এত সকালে কি জন্য এলেন?’ কাজী ছাহেব বললেন, ‘হে খ্রীষ্টান ব্যক্তি! তুমি গত রাতে কি কোন নেক কাজ করেছ?’ খৃষ্টান ব্যক্তি বলতে নারাজ। তিনি বললেন, ‘কি ব্যাপার হয়েছে আগে বলেন, তারপর বলবো।’ তখন কাজী ছাহেব বললেন যে, ‘এই ঘটনা ঘটেছে এবং তুমি নিশ্চয়ই সেই গরীব, আলিম লোকটিকে সাহায্য করেছ।’ তখন খ্রীষ্টান ব্যক্তি তা স্বীকার করলো। কাজী ছাহেব বললেন যে, ‘তুমি তো খ্রীষ্টান, তুমি তো এই বালাখানা পাবেনা। তোমার এটা নিয়ে কি ফায়দা হবে? তুমি তোমার এই নেক কাজ এক লক্ষ দিরহামের বিনিময়ে আমার নিকট বিক্রি করে দাও এবং তুমি তার কাছে প্রত্যেক মাসে যে ওয়াদা করেছ আমি তাকে তা দিয়ে দিব।’ খ্রীষ্টান ব্যক্তি বললো, ‘এটা কখনও সম্ভব নয় হে কাজী ছাহেব। তুমি সাক্ষী থাক, আমি কলেমা শরীফ পড়ে মুসলমান হয়ে গেলাম।” অতএব এটা ফিকিরের বিষয় যে, মুর্হরম মাস তথা আশুরাকে সম্মান করার কারণে আল্লাহ পাক উক্ত খ্রীষ্টানকে ঈমান দিয়ে দিলেন এমনকি জান্নাত নছীব করলেন।  (সুবহানাল্লাহ) এমনিভাবে উল্লিখিত প্রত্যেকটি আমলের ফযীলতের কথা হাদীছ শরীফে বর্ণনা করা হয়েছে। তা জেনে আমল করে মাসটির যথাযথ হক্ব আদায় করা প্রত্যেক মু’মিন-মুসলমানের দায়িত্ব ও কর্তব্য।

মাহে শাওয়াল ও তার প্রাসঙ্গিক আলোচনা –

 মাহে যিলক্বদ ও তার প্রাসঙ্গিক আলোচনা

 মাহে যিলহজ্জ ও তার প্রাসঙ্গিক আলোচনা

মাহে ছফর ও তার প্রাসঙ্গিক আলোচনা

 মাহে রবিউস্ সানী ও তার প্রাসঙ্গিক আলোচনা