–হযরত মাওলানা মুফতী সাইয়্যিদ শুয়াইব আহমদ
আরবী সনের একাদশ মাস যিলক্বদ। এ মাসটি যিলহজ্জের পূর্ববর্তী মাস। এ মাসেই হজ্জের প্রস্তুতি শুরু হয়।
হজ্জের আদেশ দান প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন,
اتموا الحج والعمرة لله
অর্থঃ “আল্লাহ পাক এর জন্যেই তোমরা হজ্জ ও উমরাহ আদায় কর বা পূর্ণ কর।” (সূরা বাক্বারা-১৯৬)
এ আয়াত শরীফে আল্লাহ পাক বান্দাকে কেবলমাত্র আল্লাহ পাক-এর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্য ব্যতীত অন্য কোন উদ্দেশ্যে যেমন- আনন্দ ভ্রমন, ভিক্ষাবৃত্তি, ব্যবসা-বাণিজ্য, সুনাম-সুক্ষাতি, রিয়া বা লৌকিকতা এক কথায় গাইরুল্লাহ্র উদ্দেশ্যে হজ্জ ও উমরাহ করতে নিষেধ করেছেন।
আল্লাহ পাক আরো ইরশাদ করেন,
لله على الناس حج البيت من استطاع اليه سبيلا.
অর্থঃ “আল্লাহ পাক-এর জন্যেই মানুষের প্রতি হজ্জ করা ফরয- যার পথের সামর্থ ও নিরাপত্তা রয়েছে।” (সূরা আল ইমরান-৯৭)
অর্থাৎ, যার পথের সামর্থ ও নিরাপত্তা নেই তার প্রতি হজ্জ ফরয নয়। এ প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে-
عن ابى اما مة ر ضى الله تعا لى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم من لم يمنعه من الحج حاجة ظاهرة او سلطان جائر او مرض حابس.
অর্থঃ “হযরত আবূ উমামা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেন আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, কোন ব্যক্তির হজ্জ ফরয হওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধকারী বিষয় হচ্ছে, প্রকাশ্য বাধা (অভাব), অথবা অত্যাচারী শাসক অথবা গুরুতর অসুখ।” (মাছাবীহুস সুন্নাহ, দারিমী, মিশকাত, মিরকাত)।
অর্থাৎ, কোন ব্যক্তির হজ্জ করার সামর্থ না থাকলে অথবা অত্যাচারী শাসকের কারণে জান-মাল, ঈমান ও আমলের নিরাপত্তা না থাকলে অথবা কঠিন অসুস্থতা থাকলে তার উপর হজ্জ ফরয থাকবে না। অর্থাৎ হজ্জ ফরয হওয়া সত্ত্বেও তা সাকিত হয়ে যাবে।
উল্লিখিত আয়াত শরীফ ও হাদীছ শরীফের ভিত্তিতে সাব্যস্ত হয়েছে যে, “প্রত্যেক স্বাধীন, বালেগ, সুস্থ, দৃষ্টি শক্তি সম্পন্ন মুসলমানের যদি সাংসারিক প্রয়োজনীয় ব্যয়ের পর হজ্জে যাওয়া ও ফিরে আসা পর্যন্ত পরিবারবর্গের ভরণ-পোষণের অতিরিক্ত সম্বল ও পাথেয় থাকে, যানবাহনের সুষ্ঠ ব্যবস্থা থাকে এবং জান,মাল, ঈমান ও আমলের নিরাপত্তা থাকে, তবে তার প্রতি জীবনে একবার হজ্জ করা ফরয। মহিলাদের জন্য স্বামী অথবা কোন সৎচরিত্রবান মাহরাম সঙ্গে থাকতে হবে।”
বুঝা গেল, গোলাম, নাবালেগ, অসুস্থ, অন্ধ ও অমুসলমানের উপর হজ্জ ফরয নয়। আবার যাদের সাংসারিক প্রয়োজনীয় ব্যয়ের পর হজ্জে যাওয়া ও ফিরে আসা পর্যন্ত পরিবারবর্গের ভরণ-পোষণের অতিরিক্ত সম্বল ও পাথেয় নেই, যানবাহনের সুষ্ঠ ব্যবস্থা নেই, তাদের উপরও হজ্জ ফরয নয়। একইভাবে যাদের হজ্জের পথে প্রাণ নাশের আশংকা রয়েছে,মাল ছিনতাইয়ের ভয় রয়েছে, ঈমান ও আমল নষ্ট হওয়ার অর্থাৎ কোন কুফরী ও হারাম কাজ সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে তাদের উপরও হজ্জ ফরয নয়। আর মহিলাদের যদি স্বামী অথবা কোন সৎচরিত্রবান মাহরাম না থাকে তবে তাদের উপর হজ্জ ফরয হবে না।
শরীয়ত যার উপর হজ্জ ফরয করেনি সে যদি নফল হিসেবে হজ্জ আদায় করে। আর তা করতে গিয়ে হজ্জের শর্ত বা ফরয লঙ্ঘন করে তাহলে সে কবীরা গুণাহে গুণাহগার হবে। যেমন কোন ব্যক্তির সাংসারিক প্রয়োজনীয় ব্যয়ের পর হজ্জে যাওয়া ও ফিরে আসা পর্যন্ত পরিবারবর্গের ভরণ-পোষণের অতিরিক্ত সম্বল ও পাথেয় নেই অথচ হজ্জ করতে গেল। এদিকে পরিবারবর্গের ভরণ-পোষণের কষ্টের জন্য সে ব্যক্তির কবীরা গুণাহ হবে। আবার যে ব্যক্তির প্রাণ নাশের আশঙ্কা রয়েছে এটা জানা সত্বেও সে যদি হজ্জে রওয়ানা করে এবং পথে তাকে হত্যা করা হয়, এজন্য সে আত্মহত্যার গুণাহে গুণাহগার হবে। আবার যে ব্যক্তির মাল ছিনতাইয়ের ভয় রয়েছে এটা জানা সত্বেও সে যদি হজ্জে রওয়ানা করে এবং তার মাল ছিনতাই হয়ে যায়। এজন্য সেই উক্ত অপরাধের জন্য দায়ী হবে। একইভাবে যাদের ঈমান ও আমল নষ্ট হওয়ার অর্থাৎ কোন কুফরী ও হারাম কাজ সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এটা জানা সত্বেও তারা যদি হজ্জে রওয়ানা করে এবং তাদের দ্বারা কুফরী ও হারাম কাজ সংঘটিত হয় তাহলে এজন্য তাদের কুফরী ও কবীরা গুণাহ হবে। অনুরূপ মহিলাদের সাথে স্বামী কিংবা কোন সৎচরিত্রবান মাহরাম পুরুষ সঙ্গে না নিয়ে তারা যদি হজ্জে রওয়ানা করে এবং পথে কোন অশালীন কাজ সংঘটিত হয়। এজন্য তারাই কঠিন গুণাহে গুণাহগার হবে।
তাই হজ্জ ফরয হওয়ার জন্য উল্লিখিত সকল প্রকার কবীরা ও কুফরী গুণাহ থেকে বেঁচে থাকা শর্ত করা হয়েছে। এ মর্মে আল্লাহ পাকও তাঁর কালামে পাকে ইরশাদ করে জানিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন,
فمن فرض فيهن الحج فلا رفث ولا فسوق ولا جدال فى الحج وما تفعلوا من خير يعلمه الله وتز ودوا فان خير الزاد التقوى.
অর্থঃ “যে ব্যক্তির প্রতি হজ্জ ফরয সে যেন হজ্জ পালনের ক্ষেত্রে নির্জন অবস্থান ও তার সংশ্লিষ্ট কোন কাজ না করে এবং কোন প্রকার ফাসিকী বা নাফরমানীমুলক কাজ না করে এবং ঝগড়া-বিবাদ না করে। আর তোমরা যে নেক কাজ কর তা আল্লাহ পাক জানেন। তোমরা পাথেয় সংগ্রহ কর। নিশ্চয়ই উত্তম পাথেয় হচ্ছে তাক্বওয়া। (সূরা বাক্বারা-১৯৭)
উল্লেখ্য, ছবি তোলা এবং পর্দা লঙ্ঘন করা আল্লাহ পাক তাঁর হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রকাশ্য নাফরমানী। কেননা ছবি হারাম ঘোষণা করেছেন স্বয়ং আল্লাহ পাক-এর হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। আর পর্দা ফরয করেছেন স্বয়ং আল্লাহ পাক রব্বুল আলামীন।
কালামুল্লাহ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,
قاتلوا الذ ين لا يؤ منون با لله ولا با ليوم الاخر ولا يحرمون ما حرم الله ورسو له ولا يد ينون دين الحق.
অর্থঃ “তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করুন যারা আল্লাহ পাক-এর প্রতি এবং পরকালের প্রতি ঈমান রাখে না এবং সেই বস্তুগুলিকে হারাম মনে করেনা যেগুলিকে আল্লাহ পাক ও তাঁর রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হারাম করেছেন এবং সত্য দ্বীন (ইসলাম) গ্রহণ করে না। (সূরা তওবা-২৯)
এ আয়াত শরীফে আল্লাহ পাক তিন শ্রেনীর লোকদের বিরুদ্ধে জিহাদের আদেশ প্রদান করেছেন। তারমধ্যে এক শ্রেণী হলো ঐ সব লোক যারা আল্লাহ পাক ও তাঁর রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ঘোষণাকৃত হারাম বিষয়গুলোকে হারাম হিসেবে মান্য করে না।
স্মরনীয় যে, হজ্জ করা যেমন আল্লাহ পাক ও তাঁর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আদেশ তদ্রুপ পর্দা করা এবং ছবি তোলা থেকে বিরত থাকাও আল্লাহ পাক ও তাঁর হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আদেশ।
একটা আদেশ অমান্য করে আরেকটা মান্য করা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। এ মর্মে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন,
افتؤ منون ببعض الكتب وتكفرون ببعض فما جزاء من يفعل ذلك منكم الا خزى فى الحيوة الد نيا و يوم القيا مة ير د ون الى اشد العذاب وما الله بغا فل عما تعملون.
অর্থঃ “তোমরা কিতাবের কিছু হুকুম মানবে আর কিছু হুকুম অমান্য করবে (তা তো হতে পারে না)। যে ব্যক্তি এরূপ করবে তার পরিণাম হচ্ছে, সে পার্থিব জীবনে লাঞ্চিত হবে এবং পরকালে কঠিন আযাবে নিক্ষিপ্ত হবে। আর আল্লাহ পাক তোমাদের আমল সম্পর্কে বেখবর নন।” (সূরা বাক্বারা- ৮৫)
কাজেই, ছবি ও পর্দার আদেশ লঙ্ঘণ করে যারা হজ্জ করবে তাদের সে হজ্জ কস্মিনকালেও আদায় হবে না। এটাই কুরআন ও সুন্নাহর ফতওয়া। যা প্রকাশ করেন “হিজরী পঞ্চদশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ ও ইমাম, মুজাদ্দিদে আ’যম, ইমাম রাজারবাগ শরীফের হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলী।”
তিনি উল্লেখ করে বলেন, মুসলমানের মধ্যে পর্দাহীনতা ও ছবির প্রচলন এটা ইহুদী-নাছারাদের একটা বড় ষড়যন্ত্র। বিশেষ করে হজ্জের অনুমতি নিতে পুরুষ-মহিলা সবাইকে জমা দিতে হয় প্রায় দেড়ডজন ছবি। এছাড়া তাদেরকে ঘাটে ঘাটে ছবিও দেখাতে হয়। সবচেয়ে দুঃখজন হলো ইহুদী-নাছারারা সউদী সরকারকে তাদের তাবেদার বানিয়ে বাইতুল্লাহ শরীফ, সাফা-মারওয়া, মীনা, মুজদালিফা, আরাফার মতো পবিত্র স্থানে স্থাপন করছে প্রায় নয় হাজার ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা ও টিভি এবং রওযা শরীফসহ মসজিদে নববী শরীফে স্থাপন করেছে প্রায় ৫৪৩টি ক্যামেরা ও টিভি। অতিসত্বর আরো বাড়াবে বলে জানা যায়।
এখন কেউ বলতে পারে, ছবি ও বেপর্দার কারণে তাহলে কি হজ্জ করা বন্ধ থাকবে? এর জাওয়াবে বলতে হয় যে, হ্যাঁ, হজ্জ ফরয হলে তো অবশ্যই করতে হবে। সেজন্য যে দেশে হজ্জের জন্য ছবি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে সে দেশের সরকারকে বলতে হবে, তিনি যেন ছবি ব্যতীত হজ্জে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। এবং বিশেষ করে সউদী সরকারকে বলতে হবে, তিনি যেন ছবি ব্যতীত এবং মহিলাদের পর্দার সহিত হজ্জ করার সুষ্ঠু ব্যবস্থা করে দেন। আর মক্কা শরীফ ও মদীনা শরীফে স্থাপিত সি সি ক্যামেরা ও টিভি সরিয়ে ফেলেন। কারণ এসব হজ্জে মাবরূর হওয়ার ক্ষেত্রে অন্তরায়।
যদি দেশের সরকার এবং সউদী সরকার ছবি ব্যবস্থা তুলে না নেন এবং পর্দার সাথে হজ্জ করার সুষ্ঠু ব্যবস্থা না করেন তাহলে তারা হাদীছ শরীফে বর্ণিত সুলতানে জায়ের বা অত্যাচারী শাসক হিসেবে গণ্য হবেন। আর তাদের আমলটা হবে হাদীছ শরীফ অনুযায়ী হাজতে জাহেরা বা হজ্জের নিষেধকারী প্রকাশ্য বাধা যা বর্তমান থাকলে, ফরয হজ্জ ফরয থাকে না অর্থাৎ ফরয হজ্জ সাকিত বা রহিত হয়ে যায়।”
উল্লেখ্য, মহিলাদের হজ্জের সমস্ত শর্ত থাকার পরও শুধুমাত্র সৎচরিত্রবান কোন মাহরাম পুরুষ না থাকার কারণে তাদের উপর হজ্জের ফরয সাকিত বা রহিত হয়ে যায। বুঝা গেল, শুধু টাকা-পয়সা থাকলেই হজ্জ ফরয হয় না। বরং হজ্জ ফরয হওয়ার জন্য যেমন যাতায়াতের সামর্থ থাকা শর্ত তেমনি শর্ত হচ্ছে জান-মাল, ইজ্জত, ঈমান ও আমলের নিরাপত্তার।
এখন কেউ যদি সত্যিই আল্লাহ পাক-এর সন্তুষ্টির জন্যেই হজ্জ করতে চায় তাহলে তাকে উল্লিখিত শর্ত মুতাবিক হজ্জ করতে হবে। আর যদি কেউ গইরুল্লাহ্র উদ্দেশ্যে বা আলহাজ্জ ও হাজী খিতাব লাভের উদ্দেশ্যে হজ্জ করতে চায় তবে তার মাসয়ালা আলাদা।
কাজেই, এখনই মুসলমানদেরকে সজাগ ও সোচ্চার হওয়া উচিত। আল্লাহ পাক প্রত্যেককে যামানার মহান মুজাদ্দিদের ফতওয়া মুতাবিক আমল করার তাওফিক দান করুন। (আমিন)
মাহে ছফর ও তার প্রাসঙ্গিক আলোচনা
মাহে রবিউস্ সানী ও তার প্রাসঙ্গিক আলোচনা
মাহে জুমাদাল উলা ও তার প্রাসঙ্গিক আলোচনা