-হযরত মাওলানা মুফতী সাইয়্যিদ শোয়াইব আহমদ
স্বাগতম স্বাগতম- হে মাহে আ’যম। হিজরী সনের তৃতীয় মাস পবিত্র রবীউল আউয়াল। এ মুবারক মাসের বার তারিখ মুবারক দিনটি উম্মাহর জন্য সবচেয়ে খুশির, সবচেয়ে আনন্দের, সবচেয়ে মহান এবং সর্বশ্রেষ্ঠ ঈদের দিন। আরবীতে যাকে সাইয়্যিদুল আ’ইয়াদ, সাইয়্যিদে ঈদে আ’যম ও ঈদে আকবর নামে অভিহত করা হয়।
এ মহান মাসটি রহমত, বরকত, সাকীনা ও মাগফিরাতের খাছ মাস। কারণ, যিনি রহমতের মূল, রসূলুর রহমাহ, রহমাতুল্লিল আলামীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি এ মাসে যমীনে আগমন করেছেন, তাশরীফ নিয়েছেন। উনার মুবারক আগমণ ও মহান ফযীলত সমপর্কে কালামুল্লাহ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে,
واذ اخد الله ميثاق النبين لما اتيتكم من كتب وحكمة ثم جائكم رسول مصدق لما معكم لتؤمنن به وتنصرنه قال ءاقررتم واخذتم على ذلكم اصرى قالوا اقررنا قال فاشهدوا وانا معكم من الشهدين.
অর্থ:- “আল্লাহ পাক নবীগণের নিকট থেকে এই মর্মে অঙ্গীকার গ্রহণ করলেন যে, আমি আপনাদেদেরকে কিতাব ও হিকমত দান করবো। অত:পর যখন আপনাদের নিকট আমার (আখিরী) রসূল আগমণ করবেন, আগমণ করে আপনাদের প্রতি নাযিলকৃত বিষয়সমূহকে সত্য প্রতিপাদন করবেন তখন আপনাদের দায়িত্ব হলো, আপনারা (উনাকে পেলে) অবশ্যই উনার প্রতি ঈমান আনবেন এবং উনার খেদমত করবেন। এরপর আল্লাহ পাক বললেন, আপনারা কি আমার এ অঙ্গীকার স্বীকার করে নিলেন? উনারা বললেন, আমরা স্বীকার করে নিলাম। আল্লাহ পাক বললেন, আপনারা সাক্ষী থাকুন এবং আপনাদের সাথে আমিও সাক্ষী রইলাম।” (সূরা আলে ইমরান/৮১)
এ আয়াত শরীফ-এ আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার যমীনে আগমণের বিষয়টি বর্ণনা করেছেন এবং সেই সাথে সমস্ত নবী ও রসূল আলাইহিমুস সালামগণের উপর উনার শ্রেষ্ঠত্বের বর্ণনাও দান করেছেন। তা হলো এই, কোন নবীকে নুবুওওয়াত দেয়া হয়নি, কোন রসূলকে রিসালত দেয়া হয়নি ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ পর্যন্ত তারা আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতি ঈমান আনয়েিনর স্বীকৃতি না দিয়েছেন এবং উনার সাহায্য-সহযোগিতা করার স্বীকৃতি না দিয়েছেন।
এই একটি মাত্র আয়াত শরীফই কেু যদি ফিকির করে তাহলে তার জন্য আল্লাহ পাক উনার হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খতামুন নাবিয়্যীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মর্যাদা-মর্তবা, ফযীলত-সম্মান বুঝার জন্য যথেষ্ট। যদিও উনার মর্যদা-মর্তবার বর্ননা সমগ্র কুরআন শরীফ, শত শত হাদীছ শরীফ, তাফসীর, তারিখ, সীরাত, ফিক্বাহ ও ফতওয়ার কিতাবে বর্নিত রয়েছে। ‘মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বেমেছাল ফযীলত, মর্যাদা-মর্তবা উপলব্ধি করেই সমস্ত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালামগণ উনার উম্মত হওয়ার জন্য আল্লাহ পাক উনার নিকট আরজু পেশ করেছেন। আল্লাহ পাক উনার সকলের আরজুই কবুল করেছেন। তবে হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম উনার আরজু সরাসরি কবুল করা হয়েছে। যার কারণে হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার উম্মত হিসেবে পুনরায় যমীনে আগমন করবেন। (সুবহানাল্লাহ)
অথচ আমরা বিনা আরজু, বিনা চাওয়া, বিনা দোয়া-প্রার্থনায় সেই নবীয়ে দো’জাহাঁ, সাইয়্যিদুল আম্বিয়া, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার উম্মত হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেছি। এর শুকরিয়া হিসেবে আমাদের প্রতি কি করণীয়? আমাদের করণীয় এটাই যে, দায়িমীভাবে আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম উনার ছানা-সিফত করা, মর্যাদা-মর্তবা বর্ণনা করা, উনার প্রতি ছলাত-সালাম পাঠ করা এবং উনার পরিপূর্ণ ইতায়াত বা অনুসরণ করা যা মূলত: কুরআন-সুন্নাহরই আদেশ-নির্দেশের অন্তভুক্ত।
কিন্তু আফসুস এবং দুঃখের বিষয়, যখন আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মুবারক আগমনকে উপলক্ষ করে সেই দিনকে খুশির দিন বা ঈদের দিন হিসেবে পালন করা হয় তখন তা এক শ্রেণীর উম্মত দাবীদার লোকের গাত্রদাহের কারণ হয়ে যায়। তারা এর বিরোধিতা করে এবং বলে, ‘শরীয়তে দু’ঈদ ব্যতীত আর কোন ঈদের অস্তিত্ব নেই।” এ বক্তব্যের দ্বারা তারা যে হাদীছ শরীফ-এরই প্রকাশ্য বিরোধিতা করে কুফরী করে ফেললো তা তারা একটুও ভেবে দেখেনি।
হাদীছ শরীফ-এর ছহীহ কিতাব বুখারী, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, মুয়াত্তা মাীলক ইত্যঅদি কিতাবে ‘জুমুয়া এবং আরাফার দিনকে ঈদের দিন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এমনকি ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা অপেক্ষা জুমুয়ার দিনকে শ্রেষ্ঠ ও মহান বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তার কারণ স্বরূপ হযরত আদম আলাইহিস সালাম উনার সৃষ্টি, জান্নাত থেকে যমীনে প্রেরণ এবং আল্লাহ পাক উনার সাক্ষাতে গমণ করার কথা বলা হয়েছে। এ তিনটি হচ্ছে মুল কারণ। এছাড়া চতুর্থ কারণ বলা হয়েছে, জুমুয়ার দিনে একটি সময় রয়েছে যে সময় আল্লাহ পাক বান্দার দোয়া কবুল করেন আর পঞ্চম কারণ হচ্ছে, এ দিনেই ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে।”
এখন বলতে হয় যে, হযরত আদম আলাইহিস সালাম উনার জন্য যদি শুক্রবারের মর্যাদা রোযার ঈদ ও কুরআনীর ঈদের চেয়ে বেশী হয় তাহলে যেই আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সৃষ্টি না করলে হযরত আদম আলাইহিস সালামকেও সৃষ্টি করা হতো না, আসমান-যমীন, লৌহ-কলম, জিন-ইনসান, জান্নাত-জাহান্নাম ত্যিাদি কোন কিছুই সৃষ্টি করা হতো না, কোন বিশেষ সময়ও হতোনা এবং কিয়ামতও সংঘটিত হতোনা তাহলে সেই আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বিলাদত শরীফ-এর দিন, বিছাল শরীফ-এর দিন সোমবার এবং বারই রবীউল আউয়াল শরীফ-এর ফযীলত যে শুক্রবারের চেয়ে লক্ষ- কোটি গুণ বেশী হবে তা বলঅর অপেক্ষা রাখে না। তাই এ দিনকে সাইয়্যিদুল আ’ইয়াদ বা সর্বশ্রেষ্ঠ ঈদ বলা হয়েছে।
কাজেই আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে কথা বলতে হলে খুব সাবধানে বলতে হবে। অন্যথায় ঈমান নষ্ট হয়ে যাবে।
যেমন, কেউ যদি একটা চুল নিয়ে বলে, এই চুল মুবারক আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার চুল মুবারক। যাদেরকে বলা হলো, তাদের সকলের উপর তখন ফরয হবে, সাথে সাথে তা বিশ্বাস করা। আর যদি সে মিথ্যা বলে থাকে, তাহলে তার পরিমাণ হবে জাহান্নাম। অনুরূপ আক্বাঈদের কিতাবে বর্ণিত রয়েছে, আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কদু পছন্দ করেছেন। এখন কেউ যদি বলে, ‘আমি কদু পছন্দ করি না’ তাহলে সে কাফির হয়ে যাবে। কারণ সে আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পছন্দকৃত জিনিস অপছন্দ করেছে।
অতএব, মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লা আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বিলাদত শরীফ তথা আগমণের দিনকে খুশির দিন বা ঈদের দিন হিসেবে পালন করা প্রত্যেকের জন্য ফরয-ওয়াজিব। এ মহান ঈদের ফযীলত সম্পর্কে হাদীছ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে, “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি একদা উনার নিজগৃহে সমবেত ছাহাবীগণকে আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বিলাদত শরীফ-এর ঘটনাসমূহ শুনাচ্ছিলেন। এতে শ্রবণকারীগণ আনন্দ ও খুশি প্রকাশ করছিলেন এবং আল্লাহ পাক উনার প্রশংসা তথা তাসবীহ-তাহলীল পাঠ করছিলেন এবং আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার উপর ছলাত-সালাম তথা দুরূদ শরীফ পাঠ করছিলেন। এমন সময় রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম তথা উপস্থিত হলেন এবং (মীলাদ শরীফ পাঠের অনুষ্ঠান দেখে) বললেন, তোমাদের জন্য আমার শাফায়াত ওয়াজিব।”
অন্য বর্ণনায় রয়েছে, “আল্লাহ পাক উনার রহমতের দরজা তোমাদের জন্য উন্মুক্ত করেছেন এবং সমস্ত পেরেশতাগণ তোমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছেন এবং যে কেউ তোমাদের মত এরূপ কাজ করবে, তোমাদের মত তারাও নাযাত (ফযীলত) লাভ করবে।” (কিতাবুত তানবীর ফী মাওলিদিল বাশীর ওয়ান নাযীর, সুবুলুল হুদা ফী মাওলিদি মুস্তফা ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)
কিতাবে আরো বর্ণিত রয়েছে,
من عظم يلة مولده بما امكنه من التعظيم والاكرام كان من الفائزين بدار السلام.
অর্থ:- “যে ব্যক্তি আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বিলাদত শরীফ-এর দিনকে সম্মান করবে এবং তার সাধ্য-সামর্থ্য অনুযায়ী পালন করবে; এর বিনিময়ে সে জান্নাত লাভ করবে।” (সুবহানাল্লাহ) (মা’ছাবাতা বিস সুন্নাহ)
আয় আল্লাহ পাক! আমাদের সকলকে আপনার প্রিয়তম হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মর্যাদা-মর্তবা উপলব্ধি করার, উনাকে পরিপূর্ণ ইতায়াত করার তাওফিক দান করুন এবং উনার মুহব্বত-মারিফাত, তাওয়াজ্জুহ ও যিয়ারত নসীব করুন। (আমীন)
মাহে যিলক্বদ ও তার প্রাসঙ্গিক আলোচনা
মাহে যিলহজ্জ ও তার প্রাসঙ্গিক আলোচনা –
মাহে মুহররমুল হারাম শরীফ ও তার প্রাসঙ্গিক আলোচনা
মাহে ছফর ও তার প্রাসঙ্গিক আলোচনা -হযরত মাওলানা মুফতী সাইয়্যিদ শোয়াইব আহমদ
সম্মানিত জুমাদাল ঊলা শরীফ ও সম্মানিত জুমাদাল উখরা শরীফ মাস এবং উনাদের প্রাসঙ্গিক আলোচনা