يايها النبى انا ارسلنك شاهدا ومبشرا ونذيرا وداعيا الى الله باذنه وسراجا منيرا.
অর্থঃ- “হে নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমি আপনাকে সাক্ষী, (বেহেশতের) সুসংবাদ বাহক, দোযখের ভীতি প্রদর্শক এবং আল্লাহর হুকুমে তাঁর প্রতি আহবানকারী এবং সিরাজুম মুনিরা তথা উজ্বল প্রদীপ করে প্রেরণ করেছি।” (সূরা আহযাব/৪৫)
ادع الى سبيل ربك بالحكمة والموعظة الحسنة.
অর্থঃ- “আপনি হিকমত ও উত্তম ওয়াজ-নসিহত তথা উপদেশ দ্বারা মানুষদেরকে আপনার রবের দিকে আহবান করুন।” (সূরা নহল্/১২৫)
স্মর্তব্য, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, রহমাতুল্লিল আলামীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জাহেলী যুগের পথহারা আল্লাহ বিমুখ মানুষদেরকে আল্লাহ্মুখী করার নিমিত্তে দ্বীনের দাওয়াত দানে নিম্নোক্ত হিকমত, অবলম্বন করেন।
প্রাথমিক পর্যায়ে দ্বীনের দাওয়াত
সর্ব প্রথম তিনি একান্ত আপন জনদের দ্বীনের দাওয়াত দেন। এ সময় ইসলাম গ্রহণের সৌভাগ্য লাভ করেন- মহিলাদের মধ্যে উম্মুল মু’মিনীন হযরত খাদীজাতুল কুবরা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা, বয়স্ক স্বাধীন পুরুষদের মধ্যে সিদ্দীকে আকবর হযরত আবু বকর সিদ্দীক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, বালকদের মধ্যে হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, গোলামদের মধ্যে হযরত যায়েদ বিন হারেছা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, পর্যায়ক্রমে আরো অনেকে ইসলাম গ্রহণ করেন।
প্রকাশ্যে দ্বীনের দাওয়াত
তিন বছর গোপনে ইসলাম প্রচারের পর আল্লাহ্ পাক-এর সুস্পষ্ট আদেশ হলো-
فاصدع بما تؤمر واعرض عن المشركين.
অর্থঃ- “এবং আপনাকে যে বিষয় আদেশ দেয়া হয়েছে আপনি তা প্রকাশ্যে প্রচার করুন এবং মুশরিকদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিন।” (সুরা হিজর/৯৪)
وانذر عشير تك الاقربين واخفض جنا حك لمن اتبعك من المؤمنين.
অর্থঃ- “এবং আপনার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় স্বজনকে (আযাবের) ভয় প্রদর্শন করুন এবং আপনার অনুগামী ঈমানদারদের জন্য স্বীয় করুণার বাহু নত করুন।” (সূরা শুয়ারা/২১৪, ২১৫)
মহান আল্লাহ্ পাক-এর নির্দেশ মুতাবেক তিনি সাফা পর্বতে আরোহণ পূর্বক উচ্চকক্তে বিপদ বার্তা ঘোষণা করলেন। তাঁর আহবানে সাড়া দিয়ে সকলেই তৎক্ষনাত হাজির হল। উপস্থিত জনতাকে উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন, আমি যদি বলি এ পর্বতের অপর দিক হতে একদল অশ্ব্যরোহী শত্রু তোমাদেরকে আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত, তবে কি তোমরা তা বিশ্বাস করবে? সকলেই সমস্বরে জবাব দিল, অবশ্যই আমরা বিশ্বাস করব, কারণ আপনিতো আল আমীন, জীবনে কখনো মিথ্যা বলেননি। আপনি সদা সত্যবাদী।
তখন সাইয়্যিদুল বাশার, উম্মতের কান্ডারী হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘আমি তোমাদেরকে এক আল্লাহ্ পাক-এর পক্ষ হতে কঠিন আযাবের ভয় প্রদর্শন করছি।” এ বাণী শ্রবণ পূর্বক তারা ক্রোধে অধীর হয়ে বিভিন্ন অসৌজন্য মূলক কথা বলতে বলতে সেখান হতে প্রস্থান করল, আর দূরাচার পাপিষ্ট, চির জাহান্নামী, লানতগ্রস্থ আবু লাহাব ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে অত্যন্ত ঘৃণিত বাণী উচ্চারণ করল। তাঁর স্ত্রী উম্মে জামিলা পথে কাটা বিছিয়ে রাখত। এর জবাবে আল্লাহ্ পাক সূরা লাহাব নাযিল করে আবু লাহাব ও তার স্ত্রীর শেষ পরিণতি জানিয়ে দিলেন।
খাদ্যের আয়োজন এ ঘটনার কয়েকদিন পর আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে নির্দেশ দিলেন মক্কার নেতৃস্থানীয়দের ডেকে একটি দাওয়াতের ইন্তেজাম করতে। আহারাদির পর ও দেখা গেল পাত্রে যে পরিমাণ খাদ্য প্রথমে ছিল সে পরিমাণ খাদ্য রয়ে গেছে। তখন আবু লাহাব কিছু এলো মেলো বক্তব্য পেশ করে স্থান ত্যাগ করল, অন্যরাও তার অনুগামী হলো। এভাবে পর পর তিনদিন একই ঘটনা ঘটলো, তাদেরকে কোন কথাই বলা সম্ভব হল না।
চতুর্থ দিন আখিরী রসূল, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমি আপনাদের নিকট একটি উৎকৃষ্ট সামগ্রী নিয়ে এসেছি, তা আপনাদের দ্বীন ও দুনিয়া উভয়ের জন্যই মঙ্গলজনক। এ দায়িত্বের গুরুভার বহন করতে কে আমার সহগামী হতে ইচ্ছুক? সকলেই নীরব হয়ে রইল। একমাত্র হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু দাঁড়িয়ে বললেন, আমি আপনার সঙ্গী হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করি।
কা’বা শরীফের প্রাঙ্গণে ঘোষণা মুসলমানদের সংখ্যা বেড়ে চল্লিশে পৌঁছল। নবগঠিত মুসলমানগণ ঈমানের দ্বীপ্ত তেজে বিপক্ষের বিপুল সংখ্যাধিক্য আগ্রাহ্য করে ক্বাবা শরীফের প্রাঙ্গণে আল্লাহ্ পাক-এর তাওহীদের বাণী ঘোষণা করলেন। কাফিরদের নিকট এ ঘটনা খুবই অপমানজনক মনে হল। তারা হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপর আক্রমণ চালাল, আক্রমণ প্রতিহত করতে গিয়ে শাহাদতের অমীয় সুধা পান করলেন হযরত হারেস বিন আবু জালা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু।
বিভিন্ন কবিলার নিকট দ্বীনের দাওয়াত
হজ্বের মৌসুমে মক্কায় মেলা বসত, আরবের সুদূর প্রান্ত হতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকজন মেলায় এসে যোগ দিত। সে সময় হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের নিকট দ্বীনের দাওয়াত দিতেন।
তায়েফে দ্বীন প্রচার কুরাইশদের অত্যাচার এমন কঠোর হয়ে উঠল যে, মক্কায় ইসলাম প্রচার করা একেবারেই অসম্ভব হয়ে গেল। অতঃপর হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পবিত্র মক্কা শরীফ হতে ৭০ মাইল দূরে তায়েফের বনী সকিফে ইসলাম প্রচারের নিমিত্তে আযাদ কৃতদাস, পালকপুত্র হযরত যায়দ বিন হারিসা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে সঙ্গে নিয়ে গমন করেন। সেখানে তিনি এক মাস ব্যাপী তায়েফের অভিজাত ও নেতৃস্থানীয়দেরকে দ্বীনের পথে আহবান করতে থাকেন। তারা কেউই দাওয়াত কবুল করল না বরং অনেক বিদ্রুপাত্মক কথা বলল। এমনকি তারা ইতর, বদমাইশ ও দুষ্ট বালকদের তার প্রতি লেলিয়ে দিল। তাদের প্রস্তরাঘাতে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পবিত্র দেহ মুবারক রক্তে রঞ্জিত হল। তখন আল্লাহ্ পাক-এর ফেরেশতা আগমন পূর্বক জানালেন- যদি আপনি আদেশ করেন তাহলে তায়েফের উভয় দিকের পাহাড় চাপা দিয়ে এ জালিমদের ধ্বংস করে দিব। কিন্তু রহমতের কান্ডারী হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন। আমি তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি। ক্ষমার ও উদারতার এ মহান দৃষ্টান্ত বিশ্ববাসী কখনো কি দেখেছে বা ভবিষ্যতে কি দেখবে?
বাইতুল আরকামে দ্বীনের তা’লীম ও বাইয়াত কাফিরদের অত্যাচার চরম পর্যায়ে পৌঁছলে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত হযরত আরকাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এর গৃহে অবস্থান পূর্বক দ্বীনের তালীম দেন ও বাইয়াত প্রদান করেন।
প্রথম আকাবা
নুবুওওয়াত প্রকাশের দশম বছরে হজ্বের মৌসুমে মিনার আকাবা নামক স্থানে মদীনার খাজরাজ বংশীয় ছয়জন লোককে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম ইসলামের দাওয়াত দিলে তাঁরা ইসলাম গ্রহণ করে মদীনা শরীফে চলে যান। তাঁদের প্রচেষ্টায় পরবর্তী বছর বার জন মদীনাবাসী হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাতে বাইয়াত হন, এটাই ইতিহাসে প্রথম আকাবা হিসেবে পরিচিত। তাঁরা দেশে ফিরার সময় একজন মুয়াল্লিম-এর আবেদন করলে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত মুসাইয়্যাব ও হযরত উম্মে মাকতুম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমাকে তাদের সঙ্গে মদীনায় পাঠান।
দ্বিতীয় আকাবা
পরবর্তী হজ্বের বছর ৭৩ জন পুরুষ ও দু’জন নারী অতি গোপনে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাতে বাইয়াত হলেন। নারী দু’জনকে শুধু মৌখিকভাবে বাইয়াত করলেন।
উল্লেখ্য, বাইয়াত গ্রহণ কালে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনও কোন মহিলার হস্ত স্পর্শ করতেন না। তিনি শুধুমাত্র তাদের নিকট হতে মৌখিক স্বীকৃতি নিয়ে বলতেন, “যাও তোমাদের বাইয়াত গৃহীত হল।”
দ্বিতীয় আকাবার পর হতে মদীনা শরীফে ইসলামের দ্রুত প্রচার, প্রসার ঘটল। মক্কায় যে সমস্ত মুসলমান নির্যাতিত হচ্ছিলেন তারাও মদীনায় হিজরত করতে লাগলেন। কালক্রমে আল্লাহ্ পাকের নির্দেশক্রমে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও হিজরত করে মদীনা শরীফে তাশরীফ আনেন।
হযরত আবু আইয়ুব আনছারী
রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর গৃহে
হিজরতের পর হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আবু আইয়্যূব আনছারী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এর গৃহে দ্বীনের তালীম প্রদান করেন এবং বাইয়াত গ্রহণ করেন।
মসজিদে নববীতে দ্বীনের দাওয়াত
মসজিদে নববী নির্মাণের পর সাইয়্যিদুল বাশার, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মসজিদে নববীতেই দ্বীনের তালীম-তালক্বীন, বাইয়াত, এককথায় মসজিদে নববী হতেই সকল প্রকার দ্বীনী কার্যাদি পরিচালনা করেন।
রাজা-বাদশাহদের নিকট দ্বীনের দাওয়াত
সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হুদায়বিয়া সন্ধির পর বিভিন্ন দেশের রাজা-বাদশাহ্দের নিকট দূত মারফত ইসলামের দাওয়াত নামা পাঠান। ফলে আরব সীমানা পেরিয়ে ইসলামের অমীয় বাণী বর্হিবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি পর্যায়ক্রমে রোম, পারস্য, আবিসিনিয়া, আলেকজান্দ্রিয়া, ওমান, ইয়ামামা, বাইরাইন, ও সিরিয়ার বাদশাহদের নিকট যথাক্রমে হযরত দাহিয়াতুল কালবী, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে হুযাফা, হযরত আমর ইবনে উমাইয়া, হাতিব ইবনে আবি বালতায়া, হযরত আমর ইবনুল আস, হযরত সালীত ইবনে আমর, হযরত আলী ইবনে হাদরামী এবং হযরত শুজা ইবনে ওয়াহাব আসাদী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণকে দ্বীনের দাওয়াত নামাসহ প্রেরণ করেন।
বিদায় হজ্বের ভাষণে দ্বীন প্রচার
দশম হিজরীতে বিদায় হজ্বে আরাফার দিনে জামিউল কালিম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম যে ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন; দ্বীনের দাওয়াত ও প্রচার প্রসারে তা এক উজ্জ্বল স্মরনীকা ও দিক নিদের্শনা হয়ে থাকবে চিরকাল। ভাষণের শেষ পর্যায়ে তিনি সমবেত লক্ষাধিক জনতাকে সামনে রেখে আল্লাহ্ পাককে উদ্দেশ্য করে বলেন- اللهم هل بلغت.আয় আল্লাহ্ পাক! আমি কি দ্বীনের দাওয়াত সঠিকভাবে পৌঁছিয়েছি? সমবেত জনতা উচ্চস্বরে জবাব দিলেন, হে আল্লাহ্ পাক! নিশ্চয় তিনি আমাদের নিকট সঠিক ভাবে দ্বীন পৌঁছিয়েছেন।
অতঃপর তিনি বললেন, اللهم اشهد আয় আল্লাহ্ পাক! আপনি সাক্ষী থাকুন।
উল্লেখিত আলোচনা দ্বারা সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হল যে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দ্বীন প্রচার কোন নির্দিষ্ট সময়, কাল এর সাথে সম্পৃক্ত ছিল না। বরং তিনি সদা সর্বদা বিভিন্ন হিকমতে দ্বীনের দাওয়াত প্রদান করেন।
(দলীলসমূহঃ বিদায়া ওয়ান নিহায়া, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, সীরতে ইবনে হিশাম, সীরাতে ইবনে ইসহাক সহ সকল ইতিহাস, তাফসীর ও হাদীছ গ্রন্থসমূহ।)
-মাওলানা মুহম্মদ মা’ছূমুর রহমান