মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (১১১)

সংখ্যা: ১৬২তম সংখ্যা | বিভাগ:

——–হযরত মাওলানা মুফতী সাইয়্যিদ মুহম্মদ আব্দুল হালীম————-

 

প্রসঙ্গঃ নিয়মিত শায়খ বা মুর্শিদের ছোহবত ইখতিয়ার করবে। আহলে যিকির তথা আওলিয়ায়ে কিরামগণের ছোহবত ইখতিয়ার করা ফরয।

হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে-

عن ابى هريرة رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم المرء على دين خليله فلينظر احد كم من يخالل.

অর্থঃ হযরত আবু হুরায়রাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ ফরমান- “মানুষ তার বন্ধুর আদর্শে আদর্শবান হয়। কাজেই তোমাদের প্রত্যেকেরই লক্ষ্য রাখা উচিত, সে কার বন্ধুত্ব  গ্রহণ করছে। (আহমদ ২:৩০৩, মাসাবীহুস্ সুন্নাহ ২:২৮৭)

সৎসঙ্গ মানুষকে ভাল করে অসৎ সঙ্গ মানুষকে খারাপ করে দেয়।

প্রবাদ রয়েছে- الصحبة متاثرة.

অর্থঃ ছোহবতের তা’ছীর (প্রভাব) রয়েছে। আওলিয়ায়ে কিরাম এর ছোহবত দ্বারা সৎ স্বভাবের অধিকারী হওয়া যায়। আর ফাসিক-ফুজ্জারের ছোহবতে থাকলে ফাসিক ফুজ্জারে  পরিণত হয়।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, মাহবুবে খোদা, আরিফ বিল্লাহ, সুলতানুল আরেফীন ওলীয়ে মাদারজাদ, হাফিজে মাদারজাদ হযরত মীর্জা মাজহার জান জানান রহমাতুল্লাহি আলাইহি প্রতি নিয়ত স্বীয় শায়খ-এর ছোহবত ইখতিয়ার করতেন। একদিন তাঁর শায়খ, কুতুবুল মাশায়িখ, সাইয়্যিদুল আওলিয়া, ইমামুশ্ শরীয়ত ওয়াত ত্বরীক্বত হযরত নূর মুহম্মদ বাদায়ুনী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বললেন- মীর্জা ছাহেব। আজ আপনার শরীর থেকে শরাবের গন্ধ আসছে। কারণ কি?

ইমামুশ শরীয়ত ওয়াত ত্বরীকত হযরত নূর মুহম্মদ বাদায়ুনী রহমাতুল্লাহি আলাইহি জানতেন, মীর্জা ছাহেব এমন এক ব্যক্তিত্ব, যিনি শরাব পান করাতো দূরের কথা, কোন দিন তা দেখেনও নি।

হাফিজে মাদারজাদ হযরত মীর্জা ছাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি সবিনয়ে জানালেন, “হযূর! বেয়াদবী ক্ষমা চাই। আপনার ছোহবতে আসার পথে একজন লোক আমার পাশ দিয়ে অতিক্রম করেছিল। তার শরীরে শরাবের গন্ধ ছিল। আর বিপরীত দিক থেকে বাতাস প্রবাহিত হচ্ছিল। মনে হয় তার শরীরের শরাবের গন্ধই আমার শরীরকে দুর্গন্ধ যুক্ত করেছে।

ইমামুশ শরীয়ত ওয়াত ত্বরীক্বত হযরত নূর মুহম্মদ বাদায়ুনী রহমাতুল্লাহি আলাইহি স্বীকৃতি দিলেন। বললেন, “সেটাই হবে। শরাবী ব্যক্তির শরীরের বাতাসে আপনার শরীর গন্ধযুক্ত হয়েছে।”

ফিকিরের বিষয়। সামান্যতম সময় শরাবী ব্যক্তির সংস্পর্শে তার শরীরের বাতাসের দ্বারা যদি হাফিজে মাদারজাদ, বিশিষ্ট ওলী আল্লাহ-এর শরীর গন্ধযুক্ত হয় তাহলে যারা চব্বিশ ঘণ্টা ফাসিক-ফুজ্জার, বিদয়াতী, বেশরা ব্যক্তির সংস্পর্শে সময়ক্ষেপন করে তাদের কি অবস্থা হতে পারে? আর তা পরিশুদ্ধ করতে হলে আওলিয়ায়ে কিরাম-এর কত বেশি ছোহবত ইখতিয়ার করা উচিত।

হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে-

عن ابن عباس رضى الله تعالى عنه ان النبى صلى الله عليه وسلم قال ان الهدى الصالح والسمت الصا لح والاقتصاد جزء من خمس وعشرين جزء من النبوة.

অর্থঃ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- “নিশ্চয়ই সচ্চরিত্রতা, উত্তম চাল-চলন এবং মধ্যম পন্থা অবলম্বন করা নুবুওওয়াতের পঁচিশ ভাগের এক ভাগ। (আহমদ-১:২৯৬, মাসাবীহুস্ সুন্নাহ ২:২৯৩)

আরো ইরশাদ হয়েছে,

عن عبد الله بن عمرو رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم ان من احبكم الى احسنكم اخلاقا.

অর্থঃ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহ পাক এর হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, “তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি আমার নিকট সর্বাপেক্ষা অধিক প্রিয়, যে উত্তম চরিত্রের অধিকারী। (বুখারী শরীফ, মাসাবীহুস্ সুন্নাহ ২:২৯৪)

হাদীছ শরীফে আরো ইরশাদ হয়েছে,

عن معقل بن يسار رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول ربكم يا ابن ادم تفرغ لعبا د تى املأ قلبك غنى وامللأ يدك رز قا يا ابن ادم لا تبا عد منى املأ قلبك فقرا واملأ يدك شغلا.

অর্থঃ হযরত মা’ক্বিল ইবনে ইয়াসার রদ্বিয়াল্লাহ তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, “তোমাদের রব বলেন, হে আদম সন্তান! তুমি আমার ইবাদতের জন্য ঝামেলা মুক্ত হও, আমি তোমাকে অভাব মুক্ত করবো এবং তোমার হাতকে রিযিক দ্বারা পূর্ণ করবো। হে আদম সন্তান! তুমি আমার কাছ থেকে দূরে সরে যেওনা। অন্যথায় তোমার অন্তর অভাব-অনটনে পূর্ণ হবে।  তুমি নানা রকম ঝামেলায় সবসময় পর্যুদস্ত থাকবে। (মুস্তাদরিকে হাকীম, আত্ তারগীব ওয়াত্ তারহীব ৪:৫৫)

উল্লেখ্য যে, আওলিয়ায়ে ক্বিরামগণের ছোহবত ছাড়া উল্লেখিত হাদীছ শরীফ সমূহের উপর আমল করা সম্ভব নয়। আল্লাহ পাক এবং আল্লাহ পাক-এর হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খাছ রহমত ও ইহসান লাভ করাও সম্ভব নয়। সচ্চরিত্রবান হওয়া, মধ্যম পন্থা অবলম্বন তথা সুন্নতের পরিপূর্ণ ইতায়াত করাও কল্পনাতীত।

ইমামুশ শরীয়ত ওয়াত তরীক্বত, ইমামুল আইম্মা, মুহইস্ সুন্নাহ, ছহেবে কুন ফাইয়াকুন, সুলতানুল হিন্দ, কুতুবুল মাশায়িখ মুজাদ্দিদে যামান, গরীবে নেওয়াজ রহমাতুল্লাহি আলাইহি ছোহবতের তা’ছীর সম্পর্কে বলেন,

তখন ছিল আমিরুল মুমিনীন, খলীফাতুল মুসলিমীন, ফারুকে আ’যম হযরত ওমর ইবনুল খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর খিলাফত কাল। ইরাকের বাদশাহকে গ্রেফতার করা হলো। আমিরুল মুমিনীন, খলীফাতুল মুসলিমীন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তাকে বললেন “তুমি ইসলাম কবুল করলে ইরাক রাজ্য তোমাকে ফিরিয়ে দেয়া হবে।” কিন্তু সে তাতে রাজী হলো না। আমিরুল মুমিনীন, খলীফাতুল মুসলিমীন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তখন বললেন- তুমি ইসলাম কবুল না করলে তোমাকে হত্যা করা হবে।” সে এবারও অস্বীকার করলো। আমিরুল মুমিনীন, খলীফাতুল মুসলিমীন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তাকে হত্যা করার জন্য তলোয়ার চাইলেন। বাদশাহ ছিল খুব চতুর। সে পান করার জন্য পানি চাইল। তাকে কাঁচের গ্লাসে পানি দেয়া হলো। সে বললো, আমি কাঁচের গ্লাসে পানি পান করব না।  সে বললো না, মাটির পাত্রে পানি আনা হউক।”

মাটির পাত্রে পানি আনা হলো। সে বললো, আমিরুল মুমিনীন, আপনি আমাকে ওয়াদা দিন যে, পানি পান না করা পর্যন্ত আমাকে হত্যা করবেন না। খলীফাতুল মুসলিমীন, রদ্বিয়াল্লাহ তায়ালা আনহু তাই করলেন। তখন বাদশাহ পানির পাত্রটি মাটিতে আছাড় দিয়ে ভেঙে ফেললো। আমিরুল মুমিনীন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বাদশাহ-এর বুদ্ধিমত্তা দেখে বিস্মিত হলেন এবং তাকে ক্ষমা করলেন। অতঃপর একজন সূফী হিসেবে মাশহুর ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর জিম্মাদারীতে দিলেন।

বাদশাহ কিছুদিন সেই সূফী ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর ছোহবতে থাকলেন। অতঃপর ইসলাম কবুল করলেন। (তায্কিরাতুল আওলিয়া)

সুলতানুল আরেফীন, সিরাজুস্ সালিকীন, খলীফাতুল্লাহ, বাহরু ইলমিদ্ দ্বীন, কুতুবুল আলম, ইমামুর  রাসিখীন, ইমাম হযরত বাইযীদ বোস্তামী রহমতুল্লাহি আলাইহি সহ অনেক আওলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম বলেছেন, আওলিয়ায়ে কিরাম-এর ছোহবতে থাকা, নির্জনে ইবাদত-বন্দেগী করার চেয়েও উত্তম। আর বদকার লোকের সংসর্গে থাকা বদকাজ করার চেয়েও নিকৃষ্ট। (তাযকিরাতুল আওলিয়া)।

তার হিকমত বা রহস্য সম্পর্কে আওলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণ বলেছেন, আমলের দ্বারা ফখর (গৌরব), রিয়া, (লৌকিকতা) ইত্যাদি পয়দা হতে পারে। আর নেককারগণের ছোহবতের দ্বারা ফখর, রিয়া ইত্যাদি সকল প্রকার বদ খাছলত দূর হয় এবং নেক খাছলত পয়দা হয়।

শাইখুল উলামা ওয়াল মাশায়িখ, সুলতানুল মুহাককিকীন, ফকীহুল আছর হযরত আবুল আব্বাস সাইয়ারী রহমাতুল্লাহি আলাইহিকে প্রশ্ন করা হলো মুরীদ রিয়াজত-মুশাককাত কিভাবে করবে? তিনি বললেন- শরীয়তের হুকুম-আহকাম মানবে। নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকবে। আর নেককার তথা আওলিয়ায়ে কিরামগণের ছোহবত ইখতিয়ার করবে। (তায্কিরাতুল আওলিয়া)

সাইয়্যিদুল আউলিয়া, মাহবুবে সুবহানী, কুতুবে রব্বানী, গাউসুল আযম, ইমামুশ শরীয়ত ওয়াত ত্বরীকত, মুজাদ্দিদুয্ যামান, খাজিনাতুর রহমাহ, ছহেবে কুন ফাইয়াকুন, লিসানুল উম্মাহ, সুলতানুল আরেফীন, সাইয়্যিদুনা ইমাম হযরত বড় পীর ছাহেব রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন- “শায়খ বা মুর্শিদের ছোহবত ব্যতীত নফস ও শয়তানের ষড়যন্ত্র হতে মুক্তি পাওয়া কখনই সম্ভব নয়। (তায্কিরাতুল আওলিয়া)

সাইয়্যিদুল কাওনাইন, ফকীহুল উম্মত, রসুঈল মুহাদ্দেসীন, তাজুল মুফাসসিরীন, আকরামুল আওলিয়া, ইমামুর রাসিখীন, আল্লামাতুদ্ দাহর মুসলেহুদ্দীন, হযরত শায়খ সাদী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, “তোমাদের সন্তানকে বাল্যকালেই আওলিয়ায়ে কিরাম এর ছোহবতে পাঠিয়ে দাও। তাহলে তার জন্য ওলী আল্লাহ হওয়া সহজ হবে। আর যদি সে উচ্চ স্তরের ওলী আল্লাহ নাও হয় তবে কখনো গোমরাহ বা পথভ্রষ্ট হবে না।” (চলবে)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (১০৭)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (১০৯)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (১১০)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (১১২)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (১১৪)