[“যখন হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস্ সালাম বললেন, তিনি আমার প্রতিপালক- যিনি জীবন দেন ও মৃত্যু ঘটান। সে বললো, আমিও তো জীবন দেই ও মৃত্যু ঘটাই। হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস্ সালাম বললেন, আল্লাহ পাক সূর্যকে পূর্ব দিক হতে উদয় করেন। তুমি পশ্চিম দিক হতে উদয় করাও তো? অতঃপর যে সত্য প্রত্যাখান করেছিলো সে হতবুদ্ধি হয়ে পড়লো।”(সূরা বাক্বারা-২৫৮) সমূহ তাফসীরে বর্ণিত রয়েছে, এই নাফরমান ব্যক্তিই হলো- খোদাদ্রোহী, খোদা দাবীকারী নমরূদ। ১৭শ’ বছর সারা পৃথিবী রাজত্বকারী, খোদা দাবীকারী নমরূদকে শেষ করে দিতে মহান আল্লাহ পাক-এর একটা আদনা কানা-খোড়া মশাও ব্যয় হয়নি। (সুবহানাল্লাহ) সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা প্রেসিডেন্ট বুশের ঔদ্ধত্য যেন নমরূদের কাছাকাছি পর্যায়ে পৌঁছেছে। আজ একে হুমকি কাল ওকে ধাপকি, আজ এ মুসলিম রাষ্ট্র দখল, কাল ওই মুসলিম রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা এখন তার নিত্যনৈমিক্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইরাক দখল, আফগানিস্তান ধ্বংসের পর মক্কা শরীফে বোমা হামলার ঘোষণাও তারা দিয়েছে। সমস্ত মুসলিম বিশ্বকে করায়ত্ত করার হিংস্র আস্ফালনে তারা উম্মত্ত হয়েছে। কিন্তু মুসলমানরা যে আল্লাহ পাককে মানেন, সে আল্লাহ পাক যে নিমিষে তাদের সব মিথ্যা গর্ব আর হুমকি কিভাবে ধূলায় ধূসরিত করে দিতে পারেন; গত ২৯ আগস্ট-২০০৫ ঈসায়ী আঘাত হানা হ্যারিকেন ক্যাটরিনা এবং গত ২৪ সেপ্টেম্বর-২০০৫ ঈসায়ী আঘাত হানা হ্যারিকেন রিটা তার নগণ্য উদাহরণ মাত্র। এর সাথে আরো উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে যে, আলোচ্য হ্যারিকেন গুলোতে সূর্যের আলোর মত প্রকাশ হয়ে পড়েছে বর্তমান আমেরিকার সভ্যতার মুখোশের অন্তরালে তাদের জঘন্য রূপ। যে মানবাধিকার বুলি কপচিয়ে তারা মুসলিম দেশ গুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় অথচ তাদের দেশেই রয়েছে শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গের নির্মম বিভেদ। এছাড়া হ্যারিকেনগুলো আরো উন্মোচিত করেছে তাদের ঢেকে রাখা দারিদ্র্য, তাদের পৈশাচিক বেহায়াপনা মানসিকতা ও সংস্কৃতি। এছাড়াও খোদ বুশ প্রশাসনের গাফলতি, অনিয়মসহ আমেরিকা তথা গোটা পাশ্চাত্য সভ্যতার বিভিন্ন অপাঙ্ক্তেয় দিক- এ প্রসঙ্গেই এ নিবন্ধের আলোচনা।]
আমেরিকায় দারিদ্র্যতার করুণ চিত্র
১৯৮৮ সালে প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান যখন তার স্টেট অব দ্য ইউনিয়নের ভাষণে বলেন ‘বন্ধুগণ বেশ কয়েক বছর আগে ফেডারেল সরকার দারিদ্র্যতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলো এবং এই দারিদ্র্যকে জয় করা সম্ভব হয়েছে’বাস্তবতার নিরীখে তখনই তার বক্তব্য রীতিমত হাস্যরস সৃষ্টি করেছিলো। কিন্তু কেতাদুরস্ত ভাবটা বাইরে বজায় রেখেছিলো সব আমেরিকান প্রেসিডেন্টই। বুশ তার উদ্বোধনী ভাষণে বলেন, ‘মার্কিন নীতি অনুযায়ী আমরা জানি দরিদ্রতা আমাদের জাতির অঙ্গীকারের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। আর হ্যারিকেন ক্যাটরিনা আঘাত হানার পর দেয়া ভাষণে বুশ বলতে বাধ্য হন, ‘আমরা টেলিভিশনে দেখেছি এই অঞ্চলে কী গভীর দরিদ্রতা বিদ্যমান!’ পাশাপাশি বর্ণবাদের বৈষম্যের স্বীকারোক্তি করে তিনি বলতে বাধ্য। তিনি আরো বলেন, এবং এ দরিদ্রতার শেকড় বর্ণবাদী বৈষ্যমের ইতিহাসে প্রোথিত হয়ে রয়েছে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দরিদ্র্যতার ইতিহাসের শিক্ষক আলেকজান্দার কিসার বলেন দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা সমাধানে দেশটি কোনো প্রচেষ্টা গ্রহণ করেনি। তিনি বলেন, ‘৩০ বছর আগেও এ দেশে এমন ধারণা বিদ্যমান ছিলো যে, ইচ্ছে করলে আপনি দারিদ্র দূর করতে পারেন।’তার মতে, বর্তমানে এই আশাবাদী চেতনা কিংবা আত্মবিশ্বাস আর খুঁজে পাওয়া যাবেনা। শহরগুলোর মধ্যে নিউ অরলিন্সে যে গরিবী দৃষ্টিগোচর হয় আমেরিকার অন্য অনেক বড় শহরেও তার দেখা মিলবে বলে সংবাদ মাধ্যমে উল্লেখ করা হয়। নিউইয়র্কের হার্লেম শহরে প্রতি ৫০ জন শিশুর একজন মারা যায় দরিদ্র্যতার কারণে। গত ১৩ই সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বিশ্বের প্রায় ১৭০টি দেশের এই বিশ্ব সভায় অন্যবারের তুলনায় এবারে যুক্তরাষ্ট্রকে বেশ দুর্বল চিত্তে উপস্থিত হতে হয়েছে। এত দিনকার চাকচিক্যে মলিনতার ছায়া পড়ে গেছে। বিশ্বের বুকে এতদিন যুক্তরাষ্ট্র দাপটের সাথে সবকিছু করতে পারি’র ভাব নিয়ে চষে বেড়াত। যুক্তরাষ্ট্রের সেই ভাবমূর্তি আর নেই। বিশ্বের ধনী এবং সামরিক শক্তিধর দেশ যুক্তরাষ্ট্রের উপর দিয়ে সম্প্রতি বয়ে যাওয়া পরপর দু’টি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ক্যাটরিনা এবং রিটা সমাজের গভীরে প্রোথিত দারিদ্র্য জনগোষ্ঠীর কষ্টদায়ক করুণ জীবনের বাস্তব চিত্র প্রকাশ করেছে। দেশটির সোশ্যাল সিকিউরিটির সুবিধা বঞ্চিত অসংখ্য দরিদ্র জনগণের বঞ্চনার কাহিনী ফুটে উঠেছে। ফুটে উঠেছে তাদের বেদনাদায়ক জীবনের প্রতিচ্ছবি। মানুষ জানতে পারছে তাদের সন্তানদের অভুক্ত অবস্থায় ঘুমাতে যাওয়ার দুঃখ গাঁথা। দেশটির পরিসংখ্যান ব্যুরোর দেয়া জরিপ অনুযায়ী, ২০০৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি শক্তিশালী অবস্থানে থাকা সত্ত্বেও ওই বছর দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী জনগণের সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ৭০ লাখ যা ২০০৩ সালের তুলনায় ১ কোটি ১০ লাখ বেশী। এ তথ্য মতে, ২০০১ সালের পর থেকে দারিদ্র্যের হার নিয়মিতভাবে বাড়ছে। বেশ কয়েক বছর যাবৎ পরামর্শদাতা গোষ্ঠীগুলো এবং গবেষকরা বলছেন, এখনো পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ৪ কোটি ৫৮ লাখ মানুষ স্বাস্থ্যবীমা থেকে বঞ্চিত। শতকরা ২৫ ভাগ মার্কিনি কৃষ্ণাঙ্গ দরিদ্র জীবনযাপন করে থাকে। ৩ কোটি ৬০ লাখ মার্কিনিকে থাকতে হয় ক্ষুধার্ত। নিউইয়র্কভিত্তিক সংস্থা লিভিং সিটিজের প্রধান রেসি ফেডি বলেন, ক্যাটরিনার আগে খুব কম সংখ্যক লোক এ ধরনের কথা শুনতে চাইতো।’তিনি বলেন, দরিদ্রতা রাতারাতি তৈরি হয়নি। খ্যাতিমান সমাজকর্মী রেভারেন্ড সেসিল উইলিয়ামস বলেন, আমরা যে শুধুমাত্র দারিদ্র্য সম্পর্কে কম জানি তাই নয় বরং এসব দরিদ্র জনসাধারণের অধিকাংশই যে কৃষ্ণাঙ্গ সেকথাও আমাদের জানা নেই। তিনি বলেন, এটি হতাশাব্যঞ্জক যে আমরা প্রায় পুরো সময় ধরেই এ অবস্থায় রয়েছি। ফিলাডেলফিয়ার দরিদ্র এলাকার বাসিন্দা রোজমেরি কিউবাসের মতে, দারিদ্র্য দৃশ্যমান নয়। তিনি জানান, তার ব্লকে প্রতি ৫টি পরিবারের ৪টি পরিবারকে একটি মাত্র বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্টে গাদাগাদি করে থাকতে হয়। রোজমেরি বলেন, আপনি আমাদের দেশের গরিব জনগোষ্ঠীকে দেখতে পাবেন না। এর কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা গরিব লোকদেরকে কোনো পার্কের বেঞ্চে শুয়ে থাকতে দিচ্ছিনা। তিনি বলেন, আমরা দারিদ্র্য চেপে রেখেছি। অথচ এখনো বহু মানুষ অপুষ্টিতে ভুগছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ক্যাটরিনায় জানমালের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অগণিত। সর্বশেষ জানা যাচ্ছে যে, ক্যাটরিনার কারণে এ পর্যন্ত ২ লাখ ৭৯ হাজার লোক বেকার হয়ে পড়েছে। এছাড়া সর্বশেষ হ্যারিকেন রিটার কারণে আরো লক্ষাধিক লোকের বেকার হয়ে পড়ার আশংকা করা হচ্ছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার হ্রাস হয়ে পড়ছে। ফলে বিভিন্ন মহল থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। বীমা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, ক্যাটরিনার কারণে ২ হাজার ৬০০ কোটি মার্কিন ডলার বীমা ক্ষতির সম্মুখীন হবে মার্কিন বীমা শিল্প। সিএনএন, বিবিসি, এপি। এদিকে গৃহহীন হয়ে পড়াদের মধ্যে ২ লাখেরও বেশী পরিবার আগামী তিন থেকে পাঁচ বছর জরুরী বাসস্থানে থাকতে বাধ্য হতে পারে বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন এক মার্কিন কর্মকর্তা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় অর্থ বিভাগ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণে প্রাথমিক পর্যায়ে বলেছে যে, আনুমানিক ২০ হাজার কোটি ডলারের মত ক্ষয়ক্ষতি হবে। তবে চূড়ান্তভাবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৩০ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, গত ৪ বছরে আফগানিস্তান ও ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের দখলদারিত্বের যুদ্ধের আনুমানিক ব্যয় ধরা হচ্ছে ৩০ হাজার কোটি ডলার। তাই পর্যবেক্ষরা বলেছেন যে, একটা হ্যারিকেন দুইটা যুদ্ধের চেয়ে বেশী ক্ষয়ক্ষতি করে। হ্যারিকেন রিতা আঘাত হানার কারণে ব্যারেল প্রতি তেলের দাম ১.১২ ডলার বৃদ্ধি পাচ্ছে। কেননা, হ্যারিকেন ক্যাটরিনার পর এই হ্যারিকেন রিটার আঘাতের ফলে নিউ অর্লিন্সে যুক্তরাষ্ট্রের সকল তেলের উৎপাদন ও উপকূলবর্তী এলাকায় শোধনের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। এর ফলে নিউইয়র্কে ব্যারেল প্রতি তেলের মূল্য ৬৭.৩২ ডলারে পৌঁছেছে। বর্তমানে আটলান্টিক মহাসাগরের উপর ঘূর্ণিঝড় চক্রের যে ভয়াবহ তান্ডব চলছে তা আগামী ১০ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত বহাল থাকবে। উল্লেখ্য, ক্যাটরিনার আঘাতের পর যুক্তরাষ্ট্র ইইউ এবং ন্যাট্যের কাছে জরুরি সাহায্য চেয়েছে। ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিশ্বের যেসব দেশ, ডাক্তার, জরুরি কর্মী, ডলার ও মানবিক সাহায্য পাঠিয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছে কিউবা, জাপান, চীন, নরওয়ে, পেরু, কাতার, আফগানিস্তান, ইতালি, ফ্রান্স, ইন্দোনেশিয়া, কুয়েত, জার্মানি, আর্জেন্টিনা প্রভৃতি। আন্তর্জাতিক রেডক্রস তো আছেই। তলাবিহীন ঝুড়ি নামক গরিব দেশ বাংলাদেশও ‘ঝুড়িতে তলা লাগিয়ে’ ১০ লাখ ডলার সাহায্য পাঠিয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ পাক-এর শুকরিয়া যে, ক্ষমতা ও অর্থদম্ভে দাম্ভিক আমেরিকা বাংলাদেশের মত গরীব দেশেরও সাহায্যের মুখাপেক্ষী হলো। আর এর দ্বারা প্রকারান্তরে এদেশের মুসলমানদেরই শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হলো।
লন্ডনে দারিদ্র্যতা
লন্ডনের গরীব মানুষগুলোর দূরবস্থার লুকোনো বৃত্তান্ত বৃটেন ও তাদের যোগসাজশে গড়া সরকার মার্কিনীদের মতোই এতোদিন গভীরের যন্ত্রণা চেপে রেখে এসেছে। লন্ডনের ৭৫ শতাংশ গৃহমালিক হাউজিং এস্টেট নামের বস্তীবাসীদের খবর কোনো দিন নেননি। গরীব লন্ডনবাসীরাও গরীব অলিয়েন্সবাসীর মতো দুর্ভোগকালে পরনের কাপড় ছাড়া অন্য কিছু সংগে নিতে পারতো না। লন্ডনের ২৭ শতাংশ লোকের কোনো সেভিংস নেই। গরীব ২৫ শতাংশের প্রত্যেকের গড়ে ২শ পাউন্ড ঋণ চেপে বসে রয়েছে। ১২ শতাংশ গৃহীর কোন ব্যাংক-একাউন্ট টুকু রয়েছে এমন লোকদের সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বাস ভাড়ার পরিমাণ ঋণও মঞ্জুর করে না।
উল্লেখ থাকে লন্ডনের অর্ধেকের চেয়ে বেশী সংখ্যক শিশু দারিদ্র্য রেখার নীচে জীবন ধারণ করে। ইউরোপীয় মূল্যবোধ, জনকল্যাণ রাষ্ট্র বা সুহৃদ সরকার ইত্যাকার গালভরা বুলিতে নিজেদের মগ্ন রাখা যেতে পারে, নগ্ন বাস্তবতা চাপা দেয়া সম্ভব হয় না। বৃটেন বিষয়ক জাতিসংঘ প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, চলমান কর্মকৌশল অনুসরণের মধ্য দিয়ে আগামী ২০২০ সালের মধ্যে শিশু দারিদ্র্য দূর করার কোন সম্ভাবনা নেই। অতবএ, যারা মনে করেন, “ইউরোপ ও আমেরিকা মানেই অর্থের অথৈ সাগর”- তাদের সে ভুল ধারণা আজ শোধরাবার সময় এসেছে।
-মুহম্মদ ওয়ালীউর রহমান, ঢাকা।
বিৃটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে বিৃটিশ ভূমিকা-১৫