ইসলােেমর আবির্ভাবের প্রায় এক শতাব্দীকালের মধ্যে থাইল্যান্ডে ইসলাম প্রবেশ করে। পরবর্তীতে দক্ষিণ থাইল্যান্ডে পাত্তানী নামে মুসলিম সালতানাত প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে ইউরোপীয় উপনিবেশিক আমলে মুসলমানরা প্রভাব-প্রতিপত্তি হারিয়ে ফেলে। প্রায় একশ’ বছর পূর্বে মুসলমান এলাকা থাইল্যান্ডের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। তবে অধিকার বঞ্চিত দক্ষিণের মুসলমানদের কেউ কেউ ক্ষুব্ধ হয়ে সরকার বিরোধী গোপন আন্দোলনে জড়িত হয়ে পড়েছে। উত্তর থাইল্যান্ডের মুসলমানরা সংখ্যায় কম। তবে তারা বিচ্ছিন্নতাবাদের পক্ষে নয়। তারা চায় যে প্রচারের মাধ্যমে মুসলমানের সংখ্যা বাড়ুক। থাইল্যান্ডের সর্বমোট মুসলমানদের সংখ্যা সঠিকভাবে প্রকাশ করা হয় না। কখনও বলা হয়, সংখ্যাগুলো চল্লিশ লাখ, আবার কখনও সোয়া কোটি। তবে বলা হয় তারা দেশের শতকরা পাঁচ শতাংশ। দেশের মোট জনসংখ্যা ছয় কোটি এক চল্লিশ লাখ। (জাতিসংঘ, ২০০৫) ইয়ালার কারাগারে বহু মুসলমান বন্দি রয়েছে। তাদের অপরাধ বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন করা। এ পর্যন্ত এক হাজার চারশ’ জন লোক নিহত হয়েছে দক্ষিণে। দক্ষিণের তিন প্রদেশে মালয়ী মুসলমান শতকরা আশিজন। প্রদেশগুলো হল ইয়ালা, নারাথিওয়াত ও পাত্তানি। ১৯০২ সালে তদানীন্তন শ্যাম দেশ বর্তমান থাইল্যান্ড এসব এলাকা নিয়ে নেয়। ১৯৭০ সালে পৃথক রাষ্ট্র গড়ার দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। ২০০৪ সালে তা জোরদার হয়। আন্দোলন দমাতে চলছে দক্ষিণের প্রদেশগুলোতে সামরিক শাসন, জরুরী আইন, গণগ্রেফতার, নির্যাতন, হত্যা ও ধরপাকড়, নিরীহ মানুষকেও ধরা হচ্ছে। প্রায় ছয়শ’ জন মালয়ী মুসলমান এখন বন্দি। আলোচনা নয়, শক্তি প্রয়োগকেই থাকসিন বেছে নেন মুসলমানদের আন্দোলন দমাতে। সামরিক বাহিনী ও পুলিশকে দক্ষিণে সংঘটিত হত্যা, নির্যাতনের অভিযোগে বিচারের সামনাসামনি হওয়া থেকে ছাড় দেয়ায় সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বহু ঘটনা ঘটেছে। থাকসিন মুসলমান এলাকায় নির্যাতনের প্রতীকরূপে চিহ্নিত ছিলেন, থাকসিনের মুসলিম নীতি সমালোচিত ছিল। দ’ুবছর দক্ষিণ থাইল্যান্ডের মুসলিম এলাকায় বিদ্রোহী দমনের নামে হত্যা করা হয় এক হাজার চারশ’র বেশী মুসলমান ও সৈনিককে। থাইল্যান্ডের রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ সাকরি লাংপুতেন বলেন, থাই সরকার মালয়ী মুসলমানদের একটা জাতি হিসেবে স্বীকার করে না। তারা বলে যে, আপনারা নৃতাত্ত্বিক ও জাতিগত উভয় দিক দিয়ে থাই। আর এটাই হচ্ছে আসল সমস্যা। তিনি বলেন, যদি সরকার মুসলমানদের সমান চোখে দেখে তাহলে দক্ষিণাঞ্চলের মুসলমানদের স্বাধীনতার আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়বে, এমনকি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। বৌদ্ধ শাসিত থাইল্যান্ডের মোট জনসংখ্যার শতকরা পাঁচভাগ মুসলমান। তাদের বেশীর ভাগই বাস করে থাইল্যান্ডের দক্ষিণে মালয়েশিয়ার লাগোয়া পাঁচটি প্রদেশে। এলাকাটিও আবার সরু স্থলভাগ দিয়ে মূল ভূখ- থেকে কিছুটা ভৌগোলিক দিক দিয়ে আলাদাই বলা চলে। পাত্তানী, নারাথিয়াত এবং ইয়ালা হচ্ছে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ। এগুলো একশ’ বছর পূর্বে থাইল্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আগে ছিল স্বাধীন মুসলিম সালতানাত। ভাষা এবং সংস্কৃতিও এই এলাকার স্পর্শকাতর বিষয়। মুসলামনরা চায় যে তারা যে ভাষায় কথা বলে অর্থাৎ মালয়ী ভাষাকে একটি সরকারি ভাষা হিসেবে মেনে নেয়া হোক। আর বৌদ্ধকেন্দ্রিক স্কুলগুলোতে এমন পাঠ্যসূচি তৈরী করা হোক যা মুসলিম মানসিকতার জন্য গ্রহণযোগ্য। পাঁচশ’ বছরের পুরনো ক্রয়েসি মসজিদের ইমাম মন্তব্য করেছেন, সরকার যদি ইসলামের উপর হস্তক্ষেপ বন্ধ করে তাহলে সহজেই সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। মসজিদের ইমাম সালে লে-টানু বলেন, আমরা চাই না যে, কোন অমুসলিম আমাদের বিশ্বাসের উপর হাত দিক। পর্যবেক্ষক মহল মন্তব্য করেন যে, সরকারের উচিত দক্ষিণাঞ্চলের সমস্যার আসল কারণগুলোর সমাধান করা। সরকার যদি অশান্ত দক্ষিণাঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা আনতে চায়, তাহলে ইসলামের উপর হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। থাই রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ সাকরি বলেন, থাই সরকার যদি বুঝত যে, শত শত বছর ধরে এই সমস্যা থেকে যাবে যদি এর সমাধান না করা হয়, তাহলে তারা এমন নীতি গ্রহণ করতো না। সাকরি বলেন, সরকার যদি সমস্যাগুলো না দেখে এবং এর কারণগুলো তালাশ না করে, তাহলে সংঘর্ষ দিন দিন বাড়তেই থাকবে এবং এক সময় আয়ত্তের বাইরে চলে যাবে। এর ভিতরেই তো এই এলাকার দুর্দশাপূর্ণ হালের কথা মুসলিম দুনিয়ার নজরে এসেছে। কিন্তু থাই সরকার এখনও এটাকে বড় সমস্যা হিসেবে না দেখে, সামান্য সমস্যা বলে উড়িয়ে দিচ্ছে। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি)-এর উপদেষ্টা ফ্রন্সিসকো লুইস ডেভিস বলেন, সহিংসতার ধরন বদলাচ্ছে, আর এক সময় এই সহিংসতা ছোট গলিপথ থেকে বিরাট আকার নিতে পারে। আইসিজি তাদের পূর্বের এক প্রতিবেদনে মন্তব্য করে যে, সরকার মুসলমানদের প্রতি যে অবিচার করা হচ্ছে তার সমাধান করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং মুসলমান নেতাদের সাথে দক্ষিণাঞ্চলেও সমস্যা সমাধানের ব্যাপারেও একটি খোলামেলা আলোচনার ব্যবস্থা করতেও ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। দক্ষিণ থাইল্যান্ডের মুসলমানরা বহুদিন থেকে এই অভিযোগ করে আসছে যে, চাকরি, শিক্ষা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপারে তাদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক ব্যবহার করা হচ্ছে। এছাড়াও কিছু স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার গোষ্ঠী থাই সরকারের মুসলিম নীতির সমালোচনা করেছে। জানুয়ারি, ২০০৬ তারিখে এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সরকারের প্রতি দক্ষিণ থাইল্যান্ডের মুসলমানদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহারের একটা তদন্ত করার দাবি জানিয়েছিল। খোদ থাইল্যান্ডের নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞগণ বলেন যে, থাই সরকারের বুঝা উচিত যে, দেশের দক্ষিণের মুসলমানদের একটা নিজস্ব পরিচিতি রয়েছে। তারা চায় তাদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসাবে বিবেচনা না করে সমাজের একটা অংশ হিসেবেই দেখা হোক। মুসলমানরা তো তাদের ধর্মকে বিসর্জন দিতে পারে না। আর এটা তো সবাই জানে যে, এলাকাটি পূর্বে স্বাধীন মুসলিম সালতানাত ছিল। হালে তা থাইল্যান্ডে যুক্ত হয়েছে। ব্যাংকক থেকে প্রকাশিত ‘এশিয়া টাইমস’ পত্রিকায় কলামিস্ট শর্ডন ডব্লিউ ক্রিসপিন লিখেছিলেন, ‘থাই মুসলিম মানবাধিকার কর্মী এবং আইনজীবী সোমাচাই নিলাপাইজিটকে অপহরণ এবং নিখোঁজের সাথে সম্পৃক্ততা স্বীকার করেছিল থাকসিন সরকার। এতো প্রকাশ্য মুসলমান বিরোধী রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। দক্ষিণে মুসলমান অসন্তোষ দমনে থাকসিনের নির্দেশে কঠোর নীতি নিয়েছিল থাই প্রশাসন। পাইকারীভাবে মুসলমানদের ধরে উপুর করে বেঁধে রাখা হতো। বন্ধ ট্রাকে করে বন্দিদের নিয়ে গেলে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে শত শত বন্দি ইন্তিকাল করে। এ ঘটনা অনেকটা বুশ ও তার মিত্ররা আফগানিস্তানে কালাইজঙ্গি বন্দি শিবিরে যা করেছিল তারই মত। আসলে হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে, “সর্ব কাফিরের ধর্ম এক।” এক্ষেত্রে বুশ আর থাকসিনের মধ্যে পার্থক্য নেই কোন। বর্তমানে থাকসিনের নেতৃত্বের অবসান হয়েছে। গত ১৯শে সেপ্টেম্বর ২০০৬ সেখানে সামরিক শাসন জারী হয়েছে। কিন্তু মুসলমানের অবস্থা যে তিমিরে ছিল সে তিমিরেই রয়ে গেছে। এমনকি সে রকম আশার আলোও দেখা যাচ্ছে না। বলার অপেক্ষা রাখে না, এর জন্য মূলতঃ মুসলমান নিজেরাই দায়ী। কেননা বিদায় হজ্জের মশহুর সে হাদীছ শরীফে অমোঘ ও স্পষ্টভাষায় উচ্চারিত হয়েছে, “আমি তোমাদের জন্য দু’টো বিষয় রেখে যাচ্ছি। ১. কুরআন ২. সুন্নাহ। যতক্ষণ তোমরা তা আঁকড়ে থাকবে ততক্ষণ কামিয়াবীর শীর্ষে থাকবে। আর যখনই তা থেকে বিচ্যুত হবে তখনই লাঞ্ছিত ও পদদলিত হবে।” শুধু থাইল্যান্ডেই নয় সারাবিশ্বে তথা মুসলিম বিশ্বেও মুসলমানরা একই কারণে চরমভাবে লাঞ্ছিত ও নির্যাতিত। কবি বলেন, ‘এই ঘরে আগুন লেগেছে, ঘরেরই আগুন থেকে।’
-মুহম্মদ আলম মৃধা, ঢাকা।
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা-৩২