যামানার ইমাম, মুজাদ্দিদ ও হক্বানী উলামায়ে কিরামগণ সাইয়্যিদুল মুরসালীন, সাইয়্যিদুল আম্বিয়া, সাইয়্যিদুল বাশার, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ‘ক্বায়িম-মক্বাম’

সংখ্যা: ১২৯তম সংখ্যা | বিভাগ:

العلماء ورثة الانبياء وان الانبياء لم يورثوا دينارا ولادرهما وانما ورثوا العلم.

অর্থঃ “নিশ্চয়ই আলিমগণ নবী আলাইহিমুস্ সালামগণের ওয়ারিছ। আর নিশ্চয় নবী আলাইহিমুস্ সালামগণ কোন দীনার-দিরহাম রেখে যাননি। বরং ইল্ম রেখে গেছেন।” (তিরমিযী, আবু দাউদ, ইবনে মাযাহ্, আহ্মদ, মিশকাত, মায়ারিফুস্ সুনান, উরফুশ শাযী, বযলুল মাজহুদ, মিরকাত, লুময়াত, আশয়াতুল লুময়াত, শরহুত্ত্বীবী, আত্ তা’লীকুছ ছবীহ্, মুযাহিরে হক্ব)

হাদীছ শরীফে আরো ইরশাদ হয়েছে, হুযূর পাক  ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  বলেন,

ان الله يبعث لهذه الامة على رأس كل مأة سنة من يجدد لها دينها.

অর্থঃ- নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক এই উম্মতের জন্যে প্রত্যেক হিজরী শতকের শুরুতে এমন একজন ব্যক্তিকে পাঠাবেন যিনি উম্মতের দ্বীনের তাজদীদ বা সংস্কার করবেন। (আবূ দাঊদ শরীফ)

উল্লিখিত হাদীছ শরীফদ্বয় থেকে সুস্পষ্ট ও অকাট্যভাবে এটাই প্রমাণিত হলো যে, হক্কানী উলামায়ে কিরাম, ইমাম -মুজতাহিদ ও মুজাদ্দিদগণ আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কায়িম-মক্বাম বা স্থলাভিষিক্ত।

অর্থাৎ নবী-রসূলের অনুপস্থিতিতে নবী রসূল আলাইহিমুস্ সালামগণের ক্বায়িম-মক্বাম বা প্রতিনিধি হিসেবে দ্বীনের কাজের আঞ্জাম দিবেন হক্বানী উলামায়ে কিরাম ও মুজাদ্দিদগণ।

উল্লেখ্য, সত্যিকার ‘ওরাছাতুল আম্বিয়া’ বা নবী রসূলগণের ‘ক্বায়িম-মক্বাম’ সে ব্যক্তিই যে ‘ইলমে ফিক্বাহ ও ইলমে তাছাউফ’ উভয় প্রকার ইলমের অধিকারী।

কারণ আল্লাহ পাক-এর হাবীব ‘দুই প্রকার ইলম’ ওয়ারিছ স্বত্ত্ব হিসেবে রেখে গেছেন। যেমন, হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,

العلم علمان فعلم فى القلب فذاك العلم النافع وعلم على اللسان فذالك حجة الله عزوجل على ابن ادم.

অর্থঃ-”ইল্ম দু’প্রকার। (১) ক্বাল্বী ইল্ম (ইল্মে তাছাউফ) যা উপকারী ইল্ম, (২) জবানী ইল্ম (ইল্মে ফিক্বাহ্) যা আল্লাহ্ পাক-এর পক্ষ থেকে বান্দার জন্য দলীল স্বরূপ।” (দারিমী, বাইহাক্বী, দাইলামী, তারগীব ওয়াত তারহীব, তারীখ, আব্দুল বার, মিশকাত, মিরকাত, লুময়াত, আশয়াতুল লুময়াত, শরহুত্ত্বীবী, তা’লীকুছ ছবীহ্, মুযাহিরে হক্ব)

উপরোল্লিখিত হাদীছ শরীফের ব্যাখ্যায় ইমামে রব্বানী, মাহ্বুবে সুবহানী, ক্বাইয়্যূমে আউয়াল, হযরত মুজাদ্দিদে আল্ফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর বিখ্যাত কিতাব “মাকতুবাত শরীফে” উল্লেখ করেন,

উদূ লেখা ঢুকবে……………………………………..

অর্থঃ- “আলিমগণ নবী আলাইহিমুস্ সালামগণের ওয়ারিছ” এ হাদীস শরীফে বর্ণিত আলিম তারাই, যাঁরা নবী আলাইহিমুস্ সালামগণের রেখে যাওয়া ইল্মে আহ্কাম (ইল্মে ফিক্বাহ্) ও ইল্মে আসরার (ইল্মে তাছাউফ) উভয় প্রকার ইল্মের অধিকারী। অর্থাৎ তিনিই প্রকৃত ওয়ারিছ বা স্বত্বাধিকারী। আর যে ব্যক্তি শুধুমাত্র এক প্রকার ইল্মের অধিকারী, সে ব্যক্তি নবী আলাইহিমুস্ সালামগণের প্রকৃত ওয়ারিছ নন। কেননা পরিত্যক্ত সম্পত্তির সকল ক্ষেত্রে অংশীদারী হওয়াকেই ওয়ারিছ বলে। আর যে ব্যক্তি পরিত্যক্ত সম্পত্তির কোন নির্দিষ্ট অংশের অধিকারী হয় তাকে গরীম বলে। অর্থাৎ সে ওয়ারিছ নয় গরীমের অন্তর্ভুক্ত।”

হযরত মোল্লা আলী ক্বারী রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর মিশকাত শরীফের বিখ্যাত শরাহ্ “মিরকাত শরীফে” উল্লেখ করেন যে, মালিকী মায্হাবের ইমাম হযরত ইমাম মালেক রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন,

من تفقه ولم يتصوف فقد تفسق ومن تصوف وم يتفقه فقد تزندق ومن جمع بينهما فقد تحقق.

অর্থঃ- “যে ব্যক্তি ইল্মে ফিক্বাহ্ শিক্ষা করলো, কিন্তু ইল্মে তাসাউফ শিক্ষা করলো না, সে ফাসিক। আর যে ব্যক্তি ইল্মে তাসাউফ শিক্ষা করলো কিন্তু ইল্মে ফিক্বাহ্ শিক্ষা করলো না, সে যিন্দিক (কাফির)। আর যে ব্যক্তি উভয়টি শিক্ষা করলো, সে মুহাক্কিক তথা হক্কানী আলিম।”

অর্থাৎ যে ইল্মে ফিক্বাহ্ শিখলো, কিন্তু ইল্মে তাসাউফ শিখলোনা, সে হচ্ছে ফাসিক। আর যে বলে আমি মা’রিফাত করি বা ইল্মে তাসাউফ করি কিন্তু শরীয়ত বা ফিক্বাহ্ স্বীকার করেনা, সে হচ্ছে যিন্দিক। আর যিনি উভয়টাই শিক্ষা করলেন, তিনি হচ্ছেন মুহাক্কিক অর্থাৎ হাক্বীক্বী আলিম বা হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ক্বায়িম-মক্বাম।

স্মর্তব্য যে, কেউ কেউ বলে থাকে যে, ‘আলিমগণকে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ক্বায়িম-মক্বাম বলা যাবেনা।’

মূলতঃ তাদের এ বক্তব্য মোটেও শুদ্ধ নয়। তারা ‘ক্বায়িম-মক্বাম’ শব্দের তাহক্বীক্ব ও আরবী ভাষা সম্পর্কে নেহায়েতই অজ্ঞ হওয়ার কারণেই একথা বলে থাকে। বস্তুতঃ আলিমগণকে নবীগণের “ক্বায়িম-মক্বাম” বলা অবশ্যই জায়িয ও শরীয়ত সম্মত। নিম্নে এ সম্পর্কে দলীল-আদিল্লাহ ভিত্তিক সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো।

ক্বায়িম-মক্বাম’-এর অর্থ হলো- প্রতিনিধি, উত্তরাধিকারী, স্থলাভিষিক্ত ইত্যাদি। এটি দ্বীনি-দুনিয়াবী, পুরুষ-মহিলা সকল ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়। আর এটি ব্যবহার করা জায়িয ও শরীয়তসম্মত।

‘ক্বায়িম-মক্বাম’-এর তাহ্কীক্ব বা বিশ্লেষণ

‘ক্বায়িম-মক্বাম’ আলাদা দু’টি শব্দ। ‘ক্বায়িম’ একটি শব্দ এবং ‘মক্বাম’ একটি শব্দ। উভয় শব্দই আরবী। শব্দ দু’টি যদিও আলাদা কিন্তু তার মাদ্দাহ (শব্দমূল) এবং মাছদার (ক্রিয়ামূল) এক ও অভিন্ন। মাদ্দাহ হচ্ছে  قوم (ক্বওম অর্থাৎ ক্বাফ, ওয়াও, মীম)। আর মাছদার হচ্ছেقوما  (ক্বওমান), قومة (ক্বওমাতান),  قياما(ক্বিয়ামান) ও قامة (ক্বামাতান)। এর অর্থ হলো দাঁড়ান বা খাড়া হওয়া।

        قائم ‘ক্বয়িম’ শব্দটি نصر (নাছারা) বাব থেকে ইসমে ফায়িল (কর্তাবাচক বিশেষ্য)-এর পুং লিঙ্গ, এক বচনের শব্দ। বহুবচন –

قيم، قيام، قوم، قيم، قوام.

 (কুওওয়াম, কুইয়াম, কুওয়ম, কুইয়াম, ক্বিইয়াম)। অর্থ- দন্ডায়মানকারী।

        مقام ‘মক্বাম’ শব্দটি ইস্মে যরফ্ (স্থানবাচক) এক বচনের শব্দ। বহুবচন مقامات (মক্বামাত)। অর্থ দাঁড়ানোর স্থান।

লুগাত বা অভিধান শাস্ত্রে

‘ক্বায়িম-মক্বাম’-এর ব্যবহার

‘ক্বায়িম’ শব্দটির অর্থ যদিও দন্ডায়মানকারী কিন্তু ব্যবহারের ক্ষেত্রে এর বিভিন্ন অর্থ হয়ে থাকে। যেমন- প্রথমতঃ قائم السيف (ক্বায়িমুস্ সাইফ্) অর্থ ‘তরবারির হাতল।’ অর্থাৎ ‘ক্বায়িম’ শব্দটির সাথে ‘সাইফ’ শব্দটি ইযাফত বা সংযোজিত হওয়ার কারণে তার অর্থ হয়েছে “হাতল”।

        দ্বিতীয়তঃ قائم الماء (ক্বায়িমুল মায়ি) অর্থ- ‘পানির ট্যাংক।’ অর্থাৎ ‘ক্বায়িম’ শব্দটির সাথে যখন ‘মায়ূন’ শব্দটি ইযাফত হবে তখন তার অর্থ হবে ‘ট্যাংক।’

        তৃতীয়তঃ قائم الدبه (ক্বায়িমুদ্ দাব্বাহ) অর্থ- ‘পশুর পা’। অর্থাৎ ‘ক্বায়িম’ শব্দটির সাথে যখন ‘দাব্বাহ’ শব্দটি ইযাফত হবে তখন তার অর্থ হবে ‘পা।’

        চতুর্থতঃ قائم السرير (ক্বায়িমুস্ সারীর) অর্থ-       ‘খাটের পায়া।’ অর্থাৎ ‘ক্বায়িম’ শব্দটির সাথে যখন ‘সারীর’ শব্দটি ইযাফত হবে তখন তার অর্থ হবে ‘পায়া।’

        পঞ্চমতঃ যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা তা হলো قائم مقام (ক্বায়িম-মক্বাম) অর্থাৎ ‘ক্বায়িম’ শব্দটির সাথে ‘মক্বাম’ শব্দটির ইযাফতকালে তার অর্থ হবে প্রতিনিধি, উত্তরাধিকারী, স্থলাভিষিক্ত, মুখপাত্র, সহকারী, প্রতিভূ, নায়িব, মিছদাক, জামিন, বদলী, অনুকল্প, যিম্মাদার, কারো পরিবর্তে কাজ করার জন্য নিযুক্ত ব্যক্তি, দ্বীন ইসলামের প্রচারক ও বিশেষজ্ঞ, অন্যের স্থান বা পদে অধিষ্ঠিত ইত্যাদি।

         উল্লেখ্য, قائم مقام (ক্বায়িম মক্বাম) শব্দটির সমার্থবোধক আরো কতিপয় আরবী শব্দ হচ্ছে رسول (রসূল) وارث (ওয়ারিছ), نائب (নায়িব), خليفة (খলীফা), مبعوث (প্রেরিত) ইত্যাদি।

        ক্বাওয়ায়িদ বা ব্যাকরণ শাস্ত্রে    ‘ক্বায়িম-মক্বাম’-এর ব্যবহার

        উপমহাদেশের সকল দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অপরিহার্য পাঠ্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত ‘হিদায়াতুন্ নাহু’ আরবী ক্বাওয়ায়িদ কিতাবের অনেক স্থানে ‘ক্বায়িম-মক্বাম’-এর বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন-

(১) نائب فاعل  (নায়িবে ফায়িল) এর সংজ্ঞায় বর্ণনা করা হয়েছে,

وهو كل مفعول حذف فاعله واقيم هو مقامه نحو ضرب زيد.

অর্থঃ- “এমন সব মাফউল (কর্মপদ) যার ফায়িল বা কর্তাকে বিলুপ্ত করা হয়েছে এবং মাফউলকে ফায়িলের ‘ক্বায়িম-মক্বাম’ করা হয়েছে। যেমন- যায়িদ প্রহৃত হয়েছে।”

(২)     حرف نذاء (হরফে নেদা) বা আহবান সূচক অব্যয়-এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে,

حرف النذاء قائم مقام ادعو واطلب.

অর্থঃ- “আহবানসূচক অব্যয় ادعوا (আদউ) অথবা اطلب (আত্বলুবু) ফে’ল বা ক্রিয়ার ‘ক্বায়িম মক্বাম’ বা  স্থলাভিষিক্ত।”

(৩) غير منصرف (গায়রে মুনছরিফ)-এর  সংজ্ঞায় বর্ণিত হয়েছে,

غير منصرف وهو مافيه سببان او وحد منه يقوم مقامها.

অর্থঃ- “গায়রে মুনছরিফ ঐ ইসম্ যার মধ্যে নয় সববের দু’টি সবব অথবা দু’সববের ‘ক্বায়িম-মক্বাম’ একটি সবব বিদ্যমান থাকবে।”

কুরআন শরীফে ‘ক্বায়িম-মক্বাম’-এর ব্যবহার

পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, যে সকল শব্দ ‘ক্বায়িম-মক্বাম’-এর অনুরূপ অর্থ প্রদান করে তাহলো خليفة (খলীফা), رسول (রসূল), وارث (ওয়ারিছ), نائب (নায়িব), مبعوث (প্রেরিত) ইত্যাদি।

        এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ পাক তাঁর কালাম পাকে ইরশাদ করেন,

انى جاعل فى الارض خليفة.

অর্থঃ- “নিশ্চয়ই আমি যমীনে খলীফা (প্রতিনিধি) প্রেরণ করব।” (সূরা বাক্বারা/৩০)

فهب لى من لدنك وليا يرثنى ويرث من ال يعقوب.

অর্থঃ- (আল্লাহ্ পাক-এর নিকট হযরত যাকারিয়া আলাইহিস্ সালাম-এর দোয়া, “আয় আল্লাহ্ পাক! আমাকে আপনার  তরফ থেকে একজন ওলী দান করুন যিনি আমার এবং ইয়াকুব বংশের ওয়ারিছ বা স্থলাভিষিক্ত হবেন।” (সূরা মরিয়ম/৬)

لقد بعثنا فى كل امة رسولا.

অর্থঃ- “নিশ্চয়ই আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য একজন রসূল (প্রতিনিধি) পাঠিয়েছি।” (সূরা নহল্/৩৬)

        স্মরণীয়, রসূল শব্দটি একাধিক অর্থের জন্য ব্যবহৃত হয়। তার মধ্যে একটি অর্থ হচ্ছে ‘প্রতিনিধি।’

হাদীছ শরীফে

 ‘ক্বায়িম-মক্বাম’-এর ব্যবহার

এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম

বিশেষ করে হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু সম্পর্কে বলেন- তিনি হচ্ছেন,

خليفة رسول الله صلى الله عليه وسلم.

অর্থাৎ- “আল্লাহ্ পাক-এর রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খলীফা।”

তাঁর সম্পর্কে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো ইরশাদ করেছেন,

ابو بكر رضى الله عنه وزيرى يقوم مقامى.

অর্থঃ- “হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু আমার উজির এবং তিনি আমার ‘ক্বায়িম-মক্বাম’ বা স্থলাভিষিক্ত।” (দায়লামী, জামউল জাওয়াম, মাজমাউয্ যাওয়ায়িদ, কানযুল উম্মাল)

হযরত উমর ফারুক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু সম্পর্কে এক বর্ণনায় এসেছে,

وهو اول خليفة دعى بأمير المؤمنين.

অর্থঃ- “তিনিই প্রথম খলীফা যাকে ‘আমীরুল মু’মিনীন হিসেবে সম্বোধন করা হয়।”(মিশকাত, মিরকাত)

এবং খলীফা হিসেবে তিনি ছিলেন হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর ‘ক্বায়িম-মক্বাম।’ হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তাঁকে ইন্তিকালের পূর্বেই খলীফা নিযুক্ত করে যান।”

মূলতঃ হযরত ছাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম প্রত্যেকেই আল্লাহ্ পাক-এর রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ‘ক্বায়িম-মক্বাম’ ছিলেন।

এছাড়া যারা হক্কানী আলিম-উলামা তাঁরা প্রত্যেকেই রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ওয়ারিছ, নায়িব তথা ‘ক্বায়িম-মক্বাম।’

        এ সম্পর্কে হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে,

ان العلماء ورثة الانبياء وان الانبياء لم يورثوا دينا راولادرهما انما ورثوا العلم فمن اخذه اخذ بحظ وافر.

অর্থঃ- “আলিমগণ হচ্ছেন নবীগণের ওয়ারিছ বা ‘ক্বায়িম-মক্বাম’। নবীগণ কোন দীনার-দিরহাম মীরাছ রেখে যাননা। তারা মীরাছরূপে রেখে যান শুধুমাত্র ইলম্। সুতরাং যে ব্যক্তি ইল্ম গ্রহণ বা অর্জন করেছে সে পূর্ণ অংশ গ্রহণ করেছে।” (আহমদ, তিরমিযী, আবূ দাউদ, ইবনে মাজাহ, দারিমী)

অপর এক হাদীস শরীফে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,

علماء امتى كانبياء بنى اسرائيل.

অর্থঃ- “আমার উম্মতের আলিমগণ বণী ইসরাঈলের নবীগণের ন্যায় মর্যাদাবান বা তাঁদের ক্বায়িম-মক্বাম” (কানযুল উম্মাল)

কাজেই পুরুষ হোক অথবা মহিলা হোক যিনিই ইল্ম অর্জন করবেন বা হক্বানী আলিম হবেন, তিনিই নবীর ওয়ারিছ, নায়িব বা ‘ক্বায়িম-মক্বাম’ হবেন।

বলার অপেক্ষা রাখেনা, আল্লাহ্ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ছোহবত এবং দ্বীনি তা’লীম-তরবীয়তের মাধ্যমে পুরুষ ছাহাবী এবং মহিলা ছাহাবী সকলেই হাক্বীক্বী আলিম ও আলিমা হয়েছিলেন। অর্থাৎ তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নায়িব বা ‘কায়িম-মক্বাম।’

আবার তাঁদের মধ্যে যারা খাছ ‘ক্বায়িম-মক্বাম’ ছিলেন তাঁরা কেবল পুরুষই ছিলেন তা নয় বরং মহিলাও ছিলেন। যেমন হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা, হযরত ফাতিমা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা প্রমূখ।

        উল্লেখ্য, নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালামগণের খাছ ‘ক্বায়িম-মক্বাম’ মেয়েদের শানে কালামুল্লাহ্ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,

ليس الذكر كالانثى.

অর্থঃ- “হযরত মরিয়ম আলাইহাস্ সালাম এমন এক মহিলা যার সমকক্ষ পুরুষও নন।” (সূরা আলে ইমরান/৩৬)

আর হাদীস শরীফে হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা-এর শানে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,

خذوا نصف دينكم من هذه الحميراء.

অর্থঃ- “তোমরা দ্বীনের অর্ধেক শিক্ষা গ্রহণ করবে হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা থেকে।” (দাইলামী, কানযুল উম্মাল)

অর্থাৎ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহাকে ইল্ম (ফিক্বাহ ও তাছাউফ) শিক্ষা দানকারীনী তথা দ্বীন প্রচারকারীনী রূপে খিলাফত দান করেন বা খলীফা বা ‘ক্বায়িম-মক্বাম’ মনোনীত করেন।

সত্যিই আল্লাহ্ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বিদায়ের পর তাঁর ‘ক্বায়িম-মক্বাম’ হিসেবে হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা দ্বীনের ব্যাপক খিদমত করেছেন।

পরবর্তী যুগেও উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা ছিদ্দীকা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা-এর ‘ক্বায়িম-মক্বাম’ হিসেবে দ্বীনি খিদমতের আঞ্জাম দিয়েছেন অনেক মহিলা। তাঁদের মধ্যে হযরত রাবিয়া বছরী রহমতুল্লাহি আলাইহি এবং আরো অনেকে।

আর বর্তমানে উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা-এর ‘ক্বায়িম-মক্বাম’ হিসেবে দ্বীনি খিদমতের আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন যামানার মুজতাহিদ ও ইমাম, ইমামুল আইম্মা, মুহ্ইস্ সুন্নাহ, কুতুবুল আলম, মুজাদ্দিদুয্ যামান, আওলার্দু রসূল, রাজারবাগ শরীফের হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলী-এর সহধর্মিনী সাইয়্যিদাতুন্ নিসা, হাবীবাতুল্লাহ্ হযরত আম্মা হুযূর ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহাল আলীয়া।

এই হচ্ছে দ্বীনি ক্ষেত্রে ‘ক্বায়িম-মক্বাম’-এর বর্ণনা।

আর দুনিয়াবী ক্ষেত্রে ‘ক্বায়িম-মক্বাম’-এর ব্যবহার। যেমন পিতার অবর্তমানে সাধারণতঃ বড় ছেলে পিতার ‘ক্বায়িম-মক্বাম’ হয়ে থাকেন এবং মাতার অবর্তমানে সাধারণতঃ ‘ক্বায়িম মক্বাম’ হন বড় মেয়ে। এমনিভাবে রাজা-বাদশা, আমীর-উমরা সকলের ক্ষেত্রে ‘ক্বায়িম-মক্বাম’ হতে দেখা যায় বা হয়ে থাকে।

তাশবীহ্ অর্থে ‘কায়িম-মক্বাম’-এর ব্যবহার:

বালাগাত বা অলংকার শাস্ত্র যে তিনটি শাখার সমন্বয়ে গঠিত তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শাখা হলো ‘ইলমুল বয়ান।’ যার মাধ্যমে বক্তা একই বক্তব্য বিভিন্ন আঙ্গিকে প্রকাশ করার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে। আর ‘ইলমুল বয়ান’-এর অন্যতম অধ্যায় হচ্ছে ‘তাশবীহ্’। এটি যে অর্থে ও যে উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয় তার সাথে ‘ক্বায়িম-মক্বাম’-এর অর্থ ও উদ্দেশ্যের সাথে যথেষ্ট মিল রয়েছে।

তাশবীহ্ এর আভিধানিক অর্থঃ

এর আভিধানিক অর্থ- তুলনা করা, অনুরূপ হওয়া, উপমা দেয়া ইত্যাদি। আর পারিভাষিক অর্থ বর্ণনায় ‘দুরুসুল বালাগাত’ শাস্ত্রের মুছান্নিফ বলেন,

التشبيه الحاق امر بامر فى وصف باداة لغرض.

অর্থঃ- “কোন উদ্দেশ্যে একটি বস্তুকে অন্য একটি বস্তুর সাথে কোন গুণের দিক বিবেচনায় তাশ্বীহ-এর যে কোন একটি হরফের মাধ্যমে সম্পৃক্ত করাকে ‘তাশবীহ’ বলে।” এটিই তাশবীহ্-এর প্রসিদ্ধ সংজ্ঞা বলে কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

মূলতঃ কোন বিশেষ গুণ বা বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে মিল থাকার কারণে একটি বস্তুর সাথে অন্য একটি বস্তুকে তুলনা করার নামই তাশবীহ্।

কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফে তাশবীহ্-এর উদাহরণ ঃ

        এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ পাক ইরশাদ করেন,

فمثله كمثل الكلب.

অর্থঃ- “তার মেছাল একটা কুকুরের মেছালের মত।” (সূরা আ’রাফ/১৮৬) এ আয়াত শরীফে বালআম বিন বাউর যে নবীর বিরোধিতা করার কারণে তার প্রতি লা’নত বর্র্ষিত হয়েছিল তাকে কুকুরের সাথে তাশবীহ্ বা তুলনা করা হয়েছে। অর্থাৎ সে কুকুরের ‘ক্বায়িম-মক্বাম।’

আর আল্লাহ্ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,

ان اولادى كسفينة نوح.

অর্থঃ- “নিশ্চয়ই আমার আওলাদগণ হযরত নূহ্ আলাইহিস্ সালাম-এর কিস্তির মত।” (সিররুশ্ শাহাদাতাইন, হাশিয়ায়ে মিশকাত)

علماء امتى كانبياء بنى اسرائيل.

অর্থঃ- “আমার উম্মতের আলিমগণ বণী ইসরাঈলের নবীগণের মত বা তাদের ‘ক্বায়িম-মক্বাম’।” (কানযুল উম্মাল)

من زار عاما فكانما زارنى.

অর্থঃ- “যে ব্যক্তি আলিমকে দেখলো, সে যেন আমাকে দেখলো” ইত্যাদি।

এমনিভাবে তাশবীহ-এর উদাহরণ আরো বহু আয়াত শরীফ ও হাদীস শরীফে রয়েছে। তাশবীহ্-এর উপরোক্ত সংক্ষিপ্ত আলোচনা দ্বারা আশাকরি ‘ক্বায়িম-মক্বাম’-এর ব্যবহার ও প্রয়োগের বৈধতা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান হাছিল হবে।

সারকথা হলো এই যে, ‘মুশাব্বাহ্’ অর্থাৎ যাকে তুলনা করা হয় এবং ‘মুশাব্বাহ্ বিহী’ অর্থাৎ যার সাথে তুলনা করা হয় এ উভয়টি হুবহু বা সব দিক থেকে এক নয়। বরং এক বা একাধিক ওয়াজ্হে তাশবীহ্ অর্থাৎ  وصفবা গুণের ভিত্তিতে মুশাব্বাহ্কে মুশাব্বাহ বিহীর সাথে তাশবীহ্ বা তুলনা করা হয় বা দেয়া হয়। ঠিক একইভাবে ‘ক্বায়িম-মক্বাম’-এর ক্ষেত্রেও তাই। অর্থাৎ যিনি ‘ক্বায়িম-মক্বাম’ হন এবং যার ক্বায়িম-মক্বাম হন উভয় ব্যক্তি এক নন। বরং কোন কোন ক্ষেত্রে অর্থাৎ ছিফত বা গুণের দিক হতে এক। আর তার নামই হচ্ছে ‘ক্বায়িম-মক্বাম।’

উপরোক্ত দলীলভিত্তিক আলোচনা থেকে প্রমাণিত হলো যে, যামানার ইমাম, মুজতাহিদ, মুজাদ্দিদ ও হক্বানী উলামায়ে কিরামগণ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ‘ক্বায়িম-মক্বাম’ সাথে সাথে এটাও প্রমাণিত হলো যে, যারা বলে আলিমগণের ক্ষেত্রে ‘ক্বায়িম-মক্বাম’ ব্যবহার করা জায়িয নেই তাদের বক্তব্য অজ্ঞতামূলক, দলীলবিহীন ও অশুদ্ধ।

বরং সঠিক ও দলীলভিত্তিক ফতওয়া হলো- ‘ক্বায়িম-মক্বাম’ পুরুষ-মহিলা সকলের জন্যই ব্যবহার করা কেবল জায়িযই নয় বরং সুন্নতেরও অন্তর্ভুক্ত।

-মাওলানা মুফতী সাইয়্যিদ শিহাবুদ্দীন আহমদ

ফতওয়া বিভাগ- গবেষণা কেন্দ্র, মুহম্মদিয়া জামিয়া শরীফ হিজাব বা পর্দা ফরযে আইন হওয়ার প্রমাণ ও তার প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া – (১৮) প্রকাশিত ফতওয়াসমূহ

আউয়ালু শাফি’, আউয়ালু মুশাফ্ফা’, আউয়ালু মাঁই ইউহাররিকু বাবাল জান্নাহ্, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামই জান্নাতের মালিক

ছাহিবুল কাওছার, ছাহিবুল  মাহ্শার, ছাহিবুল  মাক্বামিল  মাহমূদ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের মত মানুষ নন

ছাহিবুল আয়াত, ছাহিবুল হাদীছ, ছাহিবুল বুরহান, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীছ শরীফ ব্যতীত কালামুল্লাহ শরীফ বুঝা এবং আমল করা সম্ভব নয়

ছাহিবুল মদীনাহ, ছাহিবুল মক্কাহ, ছাহিবুল হাত্বীম, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমস্ত ইলমের অধিকারী ॥ সুন্দর হস্তাক্ষরে লিখন তাঁর মু’জিযা ॥ তিনি মুয়াল্লিম হিসেবে হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু  তায়ালা আনহুমগণকে আক্ষরিক জ্ঞান শিক্ষা দিতেন