“সত্য এসেছে, মিথ্যা দূরীভূত হয়েছে। নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই মিথ্যা দূরীভূত হওয়ার যোগ্য।” রহমানুর রহীম-এর এ আয়াত শরীফের প্রতিফলন আজ কুদরতীভাবে প্রতিপাদন হচ্ছে মাসিক আল বাইয়্যিনাত-এর ক্ষেত্রে। শুরু থেকে সব সময়ই মৌলবাদের পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছে তথাকথিত দৈনিক ইনকিলাব। মৌলবাদকে তারা দেখিয়েছে ইসলামী জজবা রূপে। মৌলবাদকে তারা ব্যাখ্যা করেছে ইসলামের চেতনা রূপে। সাফাই গেয়ে বলেছে, “মৌলবাদ শব্দ এসেছে মূল থেকে। যেহেতু ইসলাম সবকিছুর মূল, কাজেই ইসলামই মৌলবাদ।” অথচ এসবই নিরন্তর মূর্খতাসূচক, অজ্ঞতামূলক ও কুফরী বক্তব্য। ইসলাম কোন ‘বাদ’-এর মুখাপেক্ষী নয়। ইসলামকে প্রকাশের জন্য তার সাথে কোন ‘বাদ’ সংযুক্ত করা ইসলামের জন্য অবমাননাকর। যা মূলতঃ অন্যান্য সব বাতিল ও বিধর্মীয় মতবাদের কাতারে ইসলামকে অন্তর্ভুক্ত করার শামিল। ইহুদী, খ্রীস্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ, ব্রাহ্মণ, পুঁজিবাদ, ডারউইনবাদ, মার্কসবাদ, লেলিনবাদ, একেশ্বরবাদ ইত্যাদি সব ‘বাদ’ হতে পারে। কারণ এগুলো সব মানুষের তৈরী মতবাদ। কিন্তু ইসলাম কোন মতবাদ হতে পারে না। কারণ ইসলাম কোন মানুষের মতানুযায়ী তৈরী নয়। কোন মানুষের ‘বাদ’ নয়। ইসলাম হচ্ছে মহামহিমান্বিত আল্লাহ পাক-এর তরফ হতে, তাঁর হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি ওহীর মাধ্যমে নাযিলকৃত দ্বীন। সুতরাং ইসলাম দুনিয়াবী কোন ‘বাদ’-এর সাথে সম্পৃক্ত হতে পারে না। এবং মুসলমান কখনও মৌলবাদী হতে পারে না। কুরআন শরীফে আল্লাহ পাক নিজেই নাম রেখেছেন ‘মুসলমান।’ আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, “তিনি তোমাদের নাম রাখলেন মুসলমান।” এরপরও ধর্মব্যবসায়ীরা তাদের ধর্মব্যবসার কৌশলে মুসলমানদের মৌলবাদী পরিচয়ে উদ্দীপিত করেছে। ইসলামের নামধারী সব জামাত, দল, জোট, আন্দোলন এমনকি ছয় উসূল ভিত্তিক তাবলীগীরাও এ ব্যাপারে একাট্টা। আর তাদের মুখপত্র দৈনিক ইনকিলাবই সব সময় মৌলবাদের পক্ষে বিশেষ প্রচারণা চালিয়ে এ দেশে মৌলবাদের বিস্তার ঘটিয়েছে। মৌলবাদ- মূলবাদ এটিই ছিল তাদের জোরদার প্রচারণা। অথচ ‘মৌল’ আর ‘মূল’ শব্দদ্বয় পরস্পর সম্পৃক্ত নয়। ‘মৌল’ বলতে বুঝায় সে পদার্থকে যাকে বিভাজন করলে সে পদার্থ ছাড়া অন্য কোন পদার্থ বের হয় না। এর সাথে মূলের সম্পৃক্ততা পোষণ মূর্খতা বৈ কিছুই নয়। আর ‘মূলবাদ’ হিসেবেও যদি গ্রহণ করা হয় তবে তাও কুফরীর পর্যায়ভুক্ত হয়। কারণ কোন কিছুকে যদি মূল বলা হয় তবে তার সাথে তার কা-, শাখা-প্রশাখাকেও গ্রহণ করা হয়। ‘মূল’ একটা বিশেষ অস্তিত্ব প্রকাশ করে বটে কিন্তু স্বতন্ত্রভাবে কোন আদলের পরিচয় দেয়না। পূর্ণভাবে পরিচয় দিতে হলে তাকে কা-, শাখা-প্রশাখা ইত্যাদির সাথে সংযুক্ত হতেই হয়। তাহলে মূলের পাশাপাশি সেগুলোর স্বীকৃতির বাধ্যবাধকতাও এসে যায়। যেমন হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে, “ইসলাম ধর্ম পাঁচটি মূল স্তম্ভের উপর স্থাপিত।” অন্য হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে, “ঈমানের সত্তর-এরও অধিক শাখা প্রশাখা রয়েছে। তন্মধ্যে নিম্নতম শাখা হচ্ছে রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে ফেলা।” কাজেই দেখা যাচ্ছে মূল হিসেবে পরিচয় দিলে তার সাথে কা-, শাখা-প্রশাখা হিসেবে অন্য কিছুরও স্বীকৃতি দিতে হবে। সুতরাং মূলবাদ হিসেবে ইসলামের নামে মৌলবাদকে যারা গ্রহণ করেন তখন তারা তাদের অজান্তেই ইহুদী, খ্রীস্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ, পারসিক, ব্রাহ্মণ ইত্যাদি মতবাদকে গ্রহণ করে নেন। শুধু বিশেষত্ব এতটুকুই যে অন্যসব বাতিল ও বিধর্মীয় মতবাদের মাঝে তারা ইসলামকে মূল বা মূলবাদ হিসেবে মানেন। তবে পাশাপাশি অন্য সব কুফরী ও বাতিল মতবাদকেও তারা স্বীকৃতি দেন। তাদের মতানুযায়ী মূল না হলেও সেগুলোকে কাণ্ড আর শাখা-প্রশাখা বলতে হয় বটে। (নাঊযুবিল্লাহ) ভাবতেও আশ্চর্য লাগে এ ধরনের প্রচারণাই মৌলবাদী ও মৌলবাদীদের মুখপত্র ইনকিলাব এ যাবতকাল করে আসছে। শুধুমাত্র মুজাদ্দিদে আ’যম, ইমামে আ’যম, ইমামুল আ’ইম্মা, কুতুবুল আলম, মুহ্ইস্ সুন্নাহ, আওলাদে রসূল, রাজারবাগ শরীফের হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলী-এর বেমেছাল রূহানিয়ত, তায়াল্লুক মায়াল্লাহ্ আর ইল্মে লাদুন্নীর ব্যাপকতায় মাসিক আল বাইয়্যিনাত গত এক দশকেরও বেশী সময় ধরে মৌলবাদীদের বিপক্ষে প্রজ্ঞা ও ইখলাসের সাথে বিশেষ ভূমিকা রেখে চলছে। মৌলবাদীদের বিপক্ষে আল বাইয়্যিনাত-এর দলীল আজ মানুষের মুখে মুখে। সে কবেই আল বাইয়্যিনাতে বলা হয়েছে, ‘মৌলবাদের উৎপত্তি কোন নবী-রসূল, ইমাম-মুজতাহিদ, আউলিয়ায়ে কিরাম এমনকি সাধারণ মুসলমানের পক্ষ থেকে নয়। ইসলামের প্রতি জজ্বা প্রদর্শনের জন্যও নয়। বরং এর উৎপত্তি ১৯১২ সালে আমেরিকার ফিলাডোল ফিলায়। খ্রীস্টান প্রোটেস্ট্যান্টরা তাদের ধর্ম রক্ষার্থে এ Fundamentalism বা মৌলবাদের প্রচলন করেছিলো।’ উল্লেখ্য, আল বাইয়্যিনাত ধর্মব্যবসার বিপরীতে আল্লাহ পাক-এর রহমতে হক্ব মত ও হক্ব পথ প্রচারে নিবেদিত। কাজেই এর সাথে গায়েবী মদদ ও বরকত যুক্ত। আর তার তাছির এখন এতটাই ব্যাপক ও বিস্তার হয়েছে যে, এখন খোদ ইনকিলাবীরাও স্বেচ্ছায় আল বাইয়্যিনাত-এর তাজদীদকে মেনে নিচ্ছে। সারাজীবন মৌলবাদের পক্ষে প্রচারণা চালিয়ে এখন তারাও মৌলবাদ যে মুসলমানের বাদ নয় তা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। তথাকথিত ইসলামী দৈনিক, মৌবাদীদের মুখপত্র, দৈনিক ইনকিলাবের ২৭নং পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, “……‘মৌলবাদ’ একটি নতুন শব্দ। মার্কিনীরাই এই শব্দটির প্রথম উদ্ভাবক। রাজনীতি ক্ষেত্রে, ইউরো-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির পর উদীয়মান মুসলিম বিশ্ব শক্তির ভয়ে, মুসলমানদের কোণঠাসা করার জন্য এ শব্দটি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিয়েছে। তারা সাম্রাজ্যবাদ সমর্থক মুসলিমবিরোধী এজেন্টদের মুখে এ শব্দটি তুলে দিয়েছে। …. এঙ্গেলসের স্পষ্ট নিষেধ সত্ত্বেও তারা সারাবিশ্বেই ‘বামপন্থী’দের দিয়ে ‘বামপন্থা’র নামে মুসলমানদের টার্গেট করে, মৌলবাদীবিরোধী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। আর তাতে ক্ষতি হচ্ছে কেবল মুসলমানদেরই। …. ‘মৌলবাদ’ হলো ‘ভিত্তিবাদ’। যেসব ধর্মগোষ্ঠী কোন ভিত্তি বা ‘দৃশ্যমান মাধ্যমে ব্যতীত সৃষ্টায় স্থাপন’ করতে পারে না; তাই ভিত্তিবাদী বা মৌলবাদী। যেমন, খ্রীস্টানরা ‘যিশু’কে আল্লাহ পাক-এর সঙ্গে ‘পুত্র সম্পর্কে’- সুসম্পর্কিত করে তাকে Son of God’ বলে। তারা যিশুর জন্মকে ‘বস্তুগত’ ‘ভিত্তিগত’ বা ‘যুক্তি সঙ্গত’ করে। তারা জাগতিক কার্যকরণ সম্পর্কের বশবর্তী হয়ে এ কথা ভাবতে পারে না যে, পিতা ব্যতীত পুত্রের জন্ম সম্ভব। তাই আল্লাহ পাক-এর ইচ্ছায় কুমারী মাতা মেরীর গর্ভের সন্তানরূপে যিশু খ্রীস্টের জন্ম, এ চিন্তায় অসমর্থ হয়েই তারা যিশু খ্রীস্টের জন্মের পূর্বোক্ত ভিত্তি আবিষ্কার করেছে। একইভাবে, যারা আকার দান না করে কোন দেব-দেবীর ধারণা করতে পারে না বলে মাটি, পাথর, বৃক্ষ, প্রাণী ইত্যাদি দ্বারা আকার দান করে অরাধ্য ও আরাধ্যদের বস্তু সম্পৃক্তরূপে উপলব্ধির প্রয়াস পায়, তারাও ভিত্তিবাদী বা মৌলবাদী। সেজন্য বিশ শতকের মধ্যভাগেও এদের ‘প্রগতিশীল’ বলে গণ্য করা হত। কিন্তু শব্দটি অত্যন্ত অসঙ্গতভাবে ‘তৌহীদবাদী’; ‘একত্ববাদী’ বা ’নিরাকারবাদী’ মুসলিম জাতির ওপর অপআরোপের ফলেই এর অর্থাবনতি ঘটে এবং এ শব্দ ঘোর নিন্দার্থে ব্যবহৃত হতে থাকে। অর্থাৎ ‘মৌলবাদ’-এর সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। সম্পর্ক নেই মুসলমানদেরও। (দৈনিক ইনকিলাব, ১৬ই ডিসেম্বর/২০০৪, ২৭ পৃষ্ঠা) পাঠক! একেই বলে মুজাদ্দিদের তাজদীদ। যে ইনকিলাবীরা সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে এখনও মৌলবাদের চেতনায় উদ্বুদ্ধ; গত কিছুদিন আগের ইনকিলাব খুললেও সেখানে মৌলবাদীদের পক্ষে ভুড়ি ভুড়ি লিখা পাওয়া যাবে যে ইনকিলাব, মৌলবাদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালায় বলে আল বাইয়্যিনাত-এর বিরুদ্ধে বেসামাল প্রপাগাণ্ডা চালিয়ে আসছে সেই ইনকিলাবই আজ আল বাইয়্যিনাত-এর তাজদীদ তাড়িত হয়ে মৌলবাদের বিপক্ষে নিবন্ধ প্রকাশ করেছে। অথচ ১৯৯৭ সালে ২২শে আগস্ট মানিক মিয়া এভিনিউ-এর সমাবেশে তাদের ইসলামী ঐক্যজোটের নেতারা বলেছে, ‘যারা ইসলামী মৌলবাদে বিশ্বাসী নয়, তারা কাফির, মুরতাদ, মুশরিক।’ একইভাবে তাদের স্বগোত্রীয় চর্ম নাই পীর ছাহেব বলেছিলো, “যারা মৌলবাদী নয় তারা অবৈধ সন্তান।” আর আজকে তাদেরই ইনকিলাব বলতে বাধ্য হয়েছে, “মৌলবাদের সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। সম্পর্ক নেই মুসলমানেরও।” মূলতঃ ইনকিলাবীরা এ সত্য এমনিতেই মানেনি। জামানার তাজদীদী মুখপত্র আল বাইয়্যিনাত-এর দলীলভিত্তিক প্রচারণার কারণে তারা আজ মানতে বাধ্য হয়েছে। মৌলবাদের বিপক্ষে আল বাইয়্যিনাত-এর দলীল এত বেশী সমৃদ্ধ ও অকাট্য এবং তার জোয়ারে জনমনে এতই সচেতনতা সম্প্রসারিত হয়েছে যে, মৌলবাদী ইনকিলাবীরাও এখন মৌলবাদীদের পক্ষে মুখ বুজে এখন মৌলবাদের বিপক্ষে মুখ খুলেছে। এটা আল্লাহ পাক-এর রহমতে জামানার তাজদীদী মুখপত্র মাসিক আল বাইয়্যিনাত-এর প্রকাশ্য বিজয় বটে। কুরআন শরীফে তাই ইরশাদ হয়েছে, “সত্য এসেছে, মিথ্য দূরীভূত হয়েছে, নিশ্চয়ই মিথ্যা দূরীভূত হওয়ারই যোগ্য। -মুহম্মদ ওয়ালীউল্লাহ, ঢাকা।
বৃটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে বৃটিশ ভূমিকা-১১