“দেশে কোনো স্বাধীনতা বিরোধী কিংবা যুদ্ধাপরাধী নেই”- তথাকথিত জামাতে ইসলামী ওরফে জামাতে রাজাকারের সেক্রেটারী মুজাহিদ ওরফে মইজ্জা রাজাকারের একথায় অনেকেই হতবাক ও ভাষাহীন ক্ষুব্ধ হয়েছেন। কেউবা ভীষণ প্রতিবাদী হয়েছেন। সোচ্চার কণ্ঠে আওয়াজ তুলেছেন। এসবের পাশাপাশি আমরা মনি করি, মইজ্জা রাজাকার তার অজান্তেই একটা ইতিবাচক দিকের সূত্রপাত ঘটিয়েছেন।
মইজ্জা রাজাকার যুদ্ধাপরাধী শব্দ ব্যবহার ও উচ্চারণ করেছেন। অর্থাৎ ইসলামের দোহাই বা সংযুক্তিটা তিনি নিজ থেকে বাদ দিয়েছেন। ইসলামের নামে গণতন্ত্র জপতে জপতে এখন তিনি নিখাদ গণতন্ত্রেরই পরিভাষা ব্যবহার করেছেন। এর দ্বারা মুক্তিযুদ্ধের সময় ইসলামের দোহাই দিয়ে যুদ্ধাপরাধ হালাল করার বিষয়টি সঙ্গত কারণেই তাদের জবানীতেই বৈধতা হারায়। এক্ষেত্রে ইসলামের সংযুক্তি বিসর্জিত হবার কারণে যুদ্ধাপরাধী কানসেপ্ট তাদের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে পুরোই তাদের প্রতি প্রযোজ্য হয়। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী এবং তাদের সহযোগীরা, বাংলাদেশে যে অপরাধ করেছিলো তা আন্তর্জাতিক অপরাধ। আন্তর্জাতিক ক্রিমিনাল কোর্ট এবং জেনেভা কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের তদন্ত ও বিচারের উদ্যোগ নিতে আইনত বাধ্য। এ অপরাধগুলো ছিলো তিন ধরনের। গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধ। ১৯৮১ সালে জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণায় বলা হয়, মানবেতিহাসে যত গণহত্যা হয়েছে তার মধ্যে স্বল্পতম সময়ে সব থেকে বেশি মানুষ নিহত হয়েছে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের গণহত্যা। দৈনিক গড়ে ৬ হাজার থেকে ১২ হাজার মানুষকে তখন হত্যা করা হয়। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধী রাজাকারের তথ্য প্রমাণাদি নেই তা নয়, যা আছে তা যথেষ্ট। এর থেকেও কম প্রমাণ নিয়ে আর্জেন্টিনায় নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে। এর বাইরে সম্প্রতি চিলি, কম্বোডিয়া ও কসোভোর গণহত্যার বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে। এ জন্য বিভিন্ন দেশের গোপনীয় গোয়েন্দা প্রতিবেদনগুলোকেও প্রকাশ করা যায়।
১৯৭৩ সালের ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনাল) অ্যাক্ট এখনো বহাল আছে। একই সঙ্গে ১৯৭৩ সালের প্রশাসনিক নির্দেশে ‘সাধারণ ক্ষমা’ ঘোষনাকে নতুন একটি প্রশাসনিক আদেশ দিয়ে অকার্যকর করা যায়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে যে অপরাধ সংঘটিত হয়েছিলো, তার তদন্ত ও বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক কমিশন ও ট্রাইব্যুনাল গঠনে বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে বিষয়টি উত্থাপন করতে পারে। জাতিসংঘ সনদের ৭নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নিরাপত্তা পরিষদ তার সদস্য রাষ্ট্র, পাকিস্তান, আমেরিকা, রাশিয়া এবং ভারতকে সহযোগিতা করতে বাধ্য। বাংলাদেশ কয়েকভাবে এ বিচারকার্য সম্পাদন করতে পারে। এক. কম্বোডিয়ার গণহত্যা তদন্ত ও বিচারের মতো দেশি বিদেশি মিশ্র অংশগ্রহণে। দুই. ১৯৯৩ সালে যুগো াভিয়ায় যেভাবে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিলো সেভাবে এবং তিন. চিলির মতো সম্পূর্ণ নিজস্বভাবে কয়েক ধাপে। চিলিতে স্বৈরশাসক পিরোশের আমলে গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য সত্যানুসন্ধাান কমিশন গঠন সত্য উপস্থাপনের ব্যবস্থা নেয়া হয়। এছাড়াও অপরাধীদের বিচার এবং ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের জন্যও সেখানে স্বতন্ত্র উদ্যোগ নেয়া হয়। ১৯৪৮ সালে গৃহীত জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী, জেনোসাইড বা গণহত্যা হলো, কোনো জাতিগত, ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর আংশিক বা সমগ্র জনম-লীকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে সেই জাতির সদস্যদের হত্যা করা, শারীরিক ও মানসিকভাবে ভীতসন্ত্রস্ত করা এবং তাদের জীবনধারণের উপায়ের মারাত্মক ক্ষতিসাধন করা। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের দেশীয় দোসরা মিলে ওপরে বলা ওই তিনটি লক্ষ্যে সর্বশক্তি নিয়োজিত করেছিলো। ওয়ারক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি এবং ট্রুথ কমিশন ফর জেনোসাইড ইন বাংলাদেশ এর আহ্বায়ক ড. এম এ হাসান যুদ্ধাপরাধ হিসেবে দাবি করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রমাণ হিসেবে আবশ্যিক বিষয়গুলো তালিকা আনেন। ১. গণহত্যায় নিহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়ন। কোথায়, কখন, কতজন, কার হাতে মারা গেছে, সাক্ষীদের নাম-ধাম ও বিবরণ ইত্যাদির নথিপত্র হাজির, ২. হত্যা-নির্যাতন, ধর্ষণ ও ধ্বংসকে যুদ্ধাপরাধ এবং গণহত্যার আন্তর্জাতিক সংজ্ঞাভুক্ত করে হাজির করা এবং ৩. প্রমাণ করা যে, একাত্তরের লড়াইটি কথিত গৃহযুদ্ধ ছিলো না, তা ছিলো স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং মূল আক্রমণটি পরিচালিত হয়েছিলো নিরস্ত্র জনগণের বিরুদ্ধে। এর পিছনে কাজ করেছে পাকিস্তানি শাসকদের জাতবিদ্বেষ। এই জাতবিদ্বেষ কোনো অংশের নাৎসি বাহিনীর ইহুদি বিদ্বেষের থেকে কম ভয়াবহ ছিলো না। সম্প্রতি জার্মান ও জাপানের যুদ্ধাপরাধীদের সামরিক ট্রাইব্যুনালে বিচার করা হয়েছে। সুতরাং বাংলাদেশেও এটি সম্ভব। যারা বলছে এদেশে কোনো যুদ্ধাপরাধী নেই তারা পক্ষান্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকেই অস্বীকার করছে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে তাদের বিচার হতে পারে। বাংলাদেশের সংবিধানের ৪৭ এর ৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সরকার চাইলে বাংলাদেশের সংবিধানে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে যে বিধান রয়েছে সংবিধান অনুযায়ী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করতে পারেন। ১৯৭২ এ দালাল আইনে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে প্রায় ৩৭ হাজার যুদ্ধাপরাধীকে গ্রেফতার করে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালে এদের মধ্যে অন্তত ২৬ হাজারের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তারা ছাড়া পেয়ে যায়। তবে বাকি ১১ হাজারের বিরুদ্ধে বিচার প্রক্রিয়া সচল ছিলো। ওই সময় ৫০০ জনের মতো যুদ্ধাপরাধীর অপরাধ বিভিন্ন আদালতে প্রমাণিত হওয়ায় সাজাও হয়। তবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর ১৯৭৫ এর ৩১ ডিসেম্বর সামরিক সরকার ক্ষমতা নেয়ার পর দালাল আইন বাতিল ঘোষণা করে। তখন ওইসব অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধী হাইকোর্টে আপিল করে ছাড়া পেয়ে যায়। ১৯৯০ সালের ৩০ নাভেম্বর থেকে কার্যকর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতায় প্রান্তিক পর্যায়ের দালাল ও রাজাকারদের ক্ষমা করা হয়েছে। হত্যা, লুটপাট, ধর্ষণ এবং স্বাধীনতা বিরোধী ষড়যন্ত্রের সঙ্গে সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত এবং নেতৃস্থানীয় কোন দালাল ও ঘাতককে এই ক্ষমা ঘোষণার আওতায় নেয়া হয়নি। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর ভারতে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার একটি বৈঠক হয়। সেখঅনে প্রথম ‘ট্রায়াল অব কোলাবরেটরস’ বা দালালদের বিচারের ধরণ নিয়ে আলোচনা হয়। পরবর্তী বৈঠক বসে ১৩ ডিসেম্বর। দুটো বৈঠকের সারবত্তা নিয়ে ১৫ ডিসেম্বর একটি গোপন নথি প্রকাশিত হয় এবং এর অনুলিপি প্রতিটি সচিবকে পাঠানো হয়। (লিংক-১) বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দালালদের বিচার করার জন্য বিচার বিভাগ গঠন করা হবে। সেখানে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় রেডিও এবং অন্যান্য সংবাদ মাধ্যমে ঘোষণা দিয়ে সব দালালদের গ্রেপ্তার করা হবে এবং তাদের বিচার করা হবে। এখন কাদের দালাল বলা হবে এবং ঠিক কী ধরনের অপরাধ দেশদ্রোহীতা এবং দালালি বলে চিহ্নিত করা হবে তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা পরবর্তী বৈঠকে করা হবে বলে নির্ধারিত হয়। কিন্তু পরদিনই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যায়। ১৯৭২ সালের ১জানুয়ারী অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজুরুল ইসলাম তার মন্ত্রী পরিষদ নিয়ে এক বৈঠকে গণহত্যা তদন্ত কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। হাইকোর্টে কর্মরত কিংবা অবসরপ্রাপ্ত কোন বিচারপতি বা সমপর্যায়ের কোন মনোনীত ব্যক্তির নেতৃত্বে কমিশন পাকবাহিনী ও তাদের দালালদের হাতে ক্ষতিগ্রস্থদের মৌখিক ও লিখিত সাক্ষাতকার নিয়ে তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করবেন বলে ঘোষণা দেয়া হয়। ২৪ জানুয়ারি ‘বাংলাদেশ দালাল আইন ১৯৭২’ নামে (লিংক-২) একটি অধ্যাদেশ জারি হয়। শেখ মুজিবর রহমান সাক্ষরিত সেই অধ্যাদেশে যুদ্ধপরাধী এবং দালালের সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে এভাবে, “কোন ব্যক্তি যদি একক বা দলগতভাবে বা কোনো সংস্থার হয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যা, লুটপাট, ধর্ষণে সহযোগিতা করে থাকে এবং স্বাধীন বাংলাদেশ বিরোধী কর্মকা-ে এবং বাংলাদেশের বিপক্ষে যুদ্ধে জড়িত থাকে।” কমপক্ষে ২ মাস কারাদ- থেকে সর্বোচ্চ মৃত্যুদ-ের শাস্তির বিধান রাখা হয়েছিল এই আইনে। অনেক ফাঁক ফোকর ছিল এ আইনে, যার ৭ম ধারায় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে সর্বময় কর্তৃত্ব দেয়া হয়েছিল। ওসি যদি কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ না আনেন তাহলে সেটা গ্রহণ করা হবে না, অন্য কোন আদালতে তার বিরুদ্ধে অভিােগ করা যাবে না- এমন অনেক গলদে ভর্তি ছিল আইনটি। সে সময় ১১ হাজারেরও বেশি দালাল ও রাজাকার তাদের গ্রেপ্তার করার জন্য আবেদন জানায়। ২৪ মার্চ নাগাদ ৭৩ টি বিশেষ আদালত গঠন করা হয় দালালদের বিচারে। এপ্রিল থেকে শুরু হয় বিচার। সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আগে ১৯৭৩ সালের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ৩৭ হাজার ৪৭১ জন অভিযুক্তের মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছিল ২ হাজার ৮৪৮ জনের মামলা। এদের মধ্যে মেয়াদে দ-াদেশ পেয়েছে ৭৫২ জন যার মধ্যে মৃত্যুদ-ে দ-িত হয় ১ জন এবং বেকসুর খালাস পায় ২ হাজার ৯৬ জন। এই দালল আইনটি পরে বাতিল হয়ে যায়। তবে ১৯৭৩ সালের ২০ জুলাই আন্তর্জাতিক আইনে যুদ্ধপরাধীদের সাজা দেয়ার জন্য নতুন আইন পাস হয়। ‘অ্যাক্ট নং ১৯, ১৯৭৩’ (লিংক-৩) নামের এই আইনে গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, যুদ্ধাপরাধে অপরাধীদের গ্রেপ্তার, বিচার এবং সাজা দেয়ার অধিকার রাখা হয়। এতসব তথ্য প্রমাণের পরও বাংলাদেশ যুদ্ধাপরাধী নেই এ কথাটি সেই বলতে পারে যে মহাযুদ্ধাপরাধী। যে যুদ্ধাপরাধকে অপরাধ মনে করে না। মানুষ কাটাকে কচু কাটার মত মনে করে মুক্তিযুদ্ধের সময় ৩০০ সদস্যের সশস্ত্র স্কোয়াডের হোতা, ঢাকার ফকিরাপুল এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের মা বোনদের সম্ভ্রম লুণ্ঠনে পৈশাচিক ও বীভ্যসতার কুখ্যাত নায়ক মানব কসাই মুজাহিদ ওরফে কুখ্যাত মইজ্জা রাজাকারের জন্য সেটাই স্বাভাবিক বটে। -মুহম্মদ আলম মৃধা, ঢাকা।
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা-৩২