‘সফর’ শব্দটি আরবী, যার আভিধানিক অর্থ হচ্ছে ভ্রমণ করা, রওয়ানা হওয়া, চলাফেরা করা ইত্যাদি। যিনি সফর করেন তাকে মুসাফির বলে। মুসাফির দু’প্রকার-
(ক) র্উফীঃ যে তিন দিনের পথ তথা ৪৮ মাইলের কম পথের মধ্যে সফর করে থাকেন।
(খ) শরয়ীঃ যে ব্যক্তি তিন দিনের পথ তথা ৪৮ মাইল অতিক্রম করে তাকেই শরয়ী মুসাফির বলে। আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হাবীবুল্লাহ, ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উভয় প্রকার সফর করেছেন।
সফর শব্দটি কুরআন শরীফের অনেক স্থানে বর্ণিত রয়েছে। যেমনঃ সূরা বাক্বারা-এর ১৮৪নং আয়াতে এসেছে,
فمن كان منكم مريضا او على سفر فعدة من ايام اخر.
অর্থঃ- “তোমাদের মধ্যে কেউ যদি রুগ্ন হয়, অথবা সফরে থাকে, তবে সে অন্য সময়ে রমাদ্বানের রোযা আদায় করতে পারে।”
সফরের সমার্থবোধক অনেক শব্দ পবিত্র কুরআন শরীফে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন বলা হয়েছে,
واذا ضربتم فى الارض فليس عليكم جناح ان تقصروا من الصلوة.
অর্থঃ- “আর যখন তোমরা যমীনে সফর করবে, তখন নামায কছর তথা সংক্ষেপ করলে তোমাদের কোন দোষ নেই।” (সূরা নিসা/১০১)
এখানে ضرب এর অর্থ হল সফর। অনুরূপভাবে সূরা বনী ইসরাঈলের ১ নং আয়াতে শরীফে ইরশাদ হয়েছে,
سبحان الذى اسرى بعبده ليلا.
অর্থঃ- “ঐ সত্তার পবিত্রতা বর্ণনা করছি যিনি তাঁর বান্দা মুহম্মদ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রাত্রিকালে সফর করিয়েছেন।
এটা ছাড়াও ‘সূরা নমল’-এর ৬৯ নং আয়াত শরীফের দ্বারাই সফরের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যেমন,
سيروا فى الارض.
অর্থঃ- “তোমরা যমীনে সফর কর।”
এখানে سير (সীরুন) শব্দের অর্থও হচ্ছে সফর। সফরের নির্দেশ আল্লাহ পাক এজন্যই দিয়েছেন, যেহেতু এতে অসংখ্য, কল্যাণ ও শেফা নিহিত রয়েছে, যা সূরা মুয্যাম্মিল ২০ নং আয়াতের মর্মার্থে জানা যায়।
তাই এ মহা অনুগ্রহকে উম্মতে মুহম্মদী কিভাবে ধারণ ও গ্রহণ করবে তার যাবতীয় তর্জ-তরীক্বা শিক্ষাদানের নিমিত্তে আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই সফর করে উম্মতে মুহম্মদীর জন্য বেশুমার রহমতের দ্বার উন্মুক্ত করে দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন এবং সফর করার প্রতি উদ্দীপনাও দিয়ে বলেছেন,
سافروا تصحوا.
অর্থঃ- “তোমরা সফর কর, সফরের কারণে সূস্থ থাকবে।” (মুসনদে আহমদ)
মূলতঃ আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমস্ত ক্বায়িনাতের মূল, তার নূর মুবারক থেকেই সবকিছুই সৃষ্টি, সমস্ত ক্বায়িনাত তাঁর মুবারক হাতের মুঠোয়, তারপরেও দুনিয়াবী নিযামে আমাদের শিক্ষা দ্বানের লক্ষ্যে তিনি সফর করেছেন। এ কারণে সফর করা আমাদের জন্য সুন্নত। তবে নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হায়াত মুবারকে সফরের দু’টি অধ্যায়ঃ (ক) ওহী নাযিলের পূবের্র সফর, (খ) ওহী অবতীর্ণের পরের সফর।
১। নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বেলাদত শরীফের পর পরেই সফরের অধ্যায় শুরু হয়। যেমন- হযরত হালিমা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা-এর গৃহে অবস্থান। (মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া)
২। ৬ বৎসর বয়সে পিতার রওযা মুবারক যিয়ারতের উদ্দেশ্যে মাতা হযরত আমিনা আলাইহাস্ সালাম-এর সঙ্গে মদীনা শরীফে সফর করেন।
৩। ১২ বৎসর বয়সে সিরিয়ায় আবু তালিবের সঙ্গে সফর করেন।
৪। ১৭ বৎসর বয়স মুবারকে আরো একবার সিরিয়ায় চাচার সঙ্গে সফরে গিয়েছিলেন। (সীরাতুন্নবী)
৫। (খ) ওহী অবতীর্ণের পর যেসব সফর হয়েছিল। যেমন বাইতুল্লাহ শরীফ থেকে বাইতুল মুক্বাদ্দাস পর্যন্ত ইস্রা বা সফর করে সপ্ত আকাশ এমনকি আল্লাহ পাক-এর দীদার করেন।
সফর সম্পর্কে রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম-এর বরকতপূর্ণ বানী ও উপদেশ
১। আমার উম্মতগণ সিংহাসনে আরোহন করে রাজা বাদশার ন্যায় সমুদ্র সফর করবে। (বুখারী শরীফ)
২। সফরে যার নিকট প্রয়োজনের বেশী খাবার সামগ্রী থাকবে তার উচিত সহায় সম্বলহীনদের প্রতি লক্ষ্য রাখা। (মুসলিম শরীফ)
৩। সফর সঙ্গীদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি প্রধান যে তার সঙ্গীদের অধিক খেদমতকারী। (বাইহাকী শরীফ, বুখারী শরীফ)
৪। ঐ সফর কাফেলায় আল্লাহ পাক-এর রহমতের ফেরেশ্তা থাকেন না, যেই কাফেলায় কুকুর এবং ঘন্টা থাকে। (মিশকাত শরীফ)
৫। যদি সফর শুকনা মৌসুমে কর, যখন মাঠে ঘাস কুটা না থাকে, তখন দ্রুত চলবে। (মুসলিম শরীফ)
৬। সফরে একে অপর থেকে পৃথক পৃথক হয়ে অবস্থান করবে না। (আবু দাউদ শরীফ)
৭। মাঝ পথে অবস্থান করতে হলে, সবাই একই স্থানে অবস্থান করবে। (আবু দাউদ)
৮। রাত্রে কোন স্থানে যদি অবস্থান করতে হয়, তবে রাস্তায় অবস্থান করবে না, কেননা রাতে রাস্তায় বিভিন্ন প্রাণী ও বিষাক্ত পোকা মাকড় বেরিয়ে আসে। (মুসলিম শরীফ)
৯। সফর একা করবে না। (বুখারী শরীফ)
১০। একাকী সফরের বিপদ সম্পর্কে আমি যা জানি, তা যদি লোকেরা জানতো, তাহলে কোন আরোহীই তথা মুসাফিরই রাতে একাকী সফরে বের হতো না। (মিশকাত)
১১। সফরে চারজন হলে খুবই ভাল। (বুখারী শরীফ)
১২। সফরে তিনজন হলে একজনকে প্রধান বানিয়ে নিবে। (বুখারী শরীফ)
১৩ । তোমরা রাতে সফর কর। (বুখারী শরীফ)
১৪। শত্রুদের ভূখন্ডে কুরআন শরীফ সঙ্গে নিয়ে সফর করা নিষিদ্ধ। হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,
ان رسول الله صلى الله عليه وسلم نهى ان يسافر بالقران الى ارض العدو.
অর্থঃ নিশ্চয়ই রসূল পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পবিত্র কুরআন শরীফ সঙ্গে নিয়ে শত্রুদের এলাকায় সফর করতে নিষেধ করেছেন।
১৫। সফর হচ্ছে আযাবের একটি টুকরা (বুখারী শরীফ)
১৬। মুসাফিরের জন্য জুমু’য়ার নামায ফরয নয়। যেমন বর্ণিত আছে,
عن جابر ان رسول الله صلى الله عليه وسلم قال من كان يؤمن بالله واليوم الاخر فعليه الجمعة يوم الجمعة الامريض او مسافر او امرأة او صبى او مجنون او مملوك فمن استغنى بلهو او تجارة استغنى الله عنه والله غنى حميد.
অর্থঃ- “হযরত জাবির রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, হযরত নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ পাক-এর প্রতি এবং পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখে, তাঁর উপর জুমুয়া’র দিনে জুমুয়া’র নামায ফরয। তবে অসুস্থ, মুসাফির, মেয়ে লোক, বালক, উম্মাদ এবং ক্রীতদাস এদের প্রতি জুমুয়া’র নামায ফরয নয়। আর যে ব্যক্তি খেলাধুলা ও ব্যবসা বাণিজ্যের কারণে জুমুয়া থেকে বিমুখ থাকবে, আল্লাহ পাক তার থেকে বিমুখ থাকবেন। আল্লাহ পাক অমুখাপেক্ষী ও প্রশংসিত। (মিশকাত শরীফ)
আয় আল্লাহ পাক! আমাদেরকে সুন্নত মুতাবিক সফর করার তাওফিক দান করুন। (আমীন)
-মাওলানা মুফতী মুহম্মদ আলমগীর হুসাইন