মুহম্মদ মনজুরুল হক, গুলবাগ, ঢাকা।
মুহম্মদ শরফুদ্দীন, দারোগাহাট রোড, চট্টগ্রাম।
সুওয়াল: ‘মাসিক আল বাইয়্যিনাত এবং ‘দৈনিক আল ইহসান’পত্রিকার বরাত দিয়ে ঢাকা শহরসহ দেশের বিভিন্ন জিলায় দেয়াল লিখনিতে বেশ কিছু মাসয়ালা উল্লেখ করা হয়েছে। যে মাসয়ালাগুলো মূলত: মানুষের ঈমান-আক্বীদা ও আমলের ক্ষেত্রে অতীব জরুরী। যেমন, ‘ইসলামের নামে ভোট, গণতন্ত্র ও নির্বাচন করা, মৌলবাদী দাবী করা, বেপর্দা হওয়া, ছবি তোলা, টিভি দেখা, টিভিতে প্রোগ্রাম করা, কুশপুত্তলিকা দাহ করা, ব্লাসফেমী আইন চাওয়া হারাম, নাজায়িয ও কুফরী।’ ‘যে সব মাওলানা টিভি চ্যানেলে প্রোগ্রাম করে তারা উলামায়ে ‘ছূ’ বা ধর্মব্যবসায়ী আলিম’ ইত্যাদি।
কিন্তু হাটহাজারী মাদ্রাসার মুখপত্র মাসিক মুঈনুল ইসলাম আগস্ট-২০০৫ ঈসায়ী সংখ্যায় এক জিজ্ঞাসার সমাধানে দলীলবিহীন ও মনগড়াভাবে হরতাল করা, লংমার্চ করা, মৌলবাদী দাবী করাকে জায়িয বলা হয়েছে।
আরো বলা হয়েছে, ‘টিভি চ্যানেলে প্রোগ্রাম করার কারণে (প্রোগ্রামকারী মাওলানাদেরকে) উলামায়ে ‘ছূ’ বলা জায়িয হবে না।’
এখন আমাদের সুওয়াল হলো- মাসিক মুঈনুল ইসলাম পত্রিকার প্রদত্ত্ব সমাধান কতটুকু সঠিক? তা কুরআন-সুন্নাহ্র দৃষ্টিতে জানতে ইচ্ছুক।
জাওয়াব: মাসিক মুঈনুল ইসলাম পত্রিকার উল্লিখিত জিজ্ঞাসার সমাধান সম্পূর্ণরূপে কুফরী হয়েছে।
কারণ, শরীয়তে কোন হারাম বা নাজায়িয বিষয়কে হালাল বা জায়িয সাব্যস্ত করা কুফরী। যেমন, আকাঈদের কিতাবে বর্ণিত রয়েছে,
استحلال المعصية كفر.
অর্থঃ- “কোন গুনাহ্র বিষয়কে অর্থাৎ হারাম বা নাজায়িয বিষয়কে হালাল বা বৈধ জানা কুফরী।” (আক্বাইদে নছফী)
উল্লেখ্য, ‘মাসিক আল বাইয়্যিনাত’এবং ‘দৈনিক আল ইহসান’পত্রিকার বরাত দিয়ে যে সকল মাসয়ালা বা ফতওয়া দেয়াল লিখনিতে প্রচার করা হয়েছে, হচ্ছে ও হবে তা সবই কুরআন ও সুন্নাহ সম্মত। এবং উক্ত মাসয়ালা বা ফতওয়ার পিছনে রয়েছে অকাট্য ও অসংখ্য দলীল-আদিল্লাহ। যেমনঃ
(ধারাবাহিক)
৩. মৌলবাদঃ “মৌলবাদ”শব্দটি মূলতঃ খৃষ্টান প্রোটেষ্ট্যান্ট সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতো। যারা বাইবেলের প্রতিটি বিষয়ের যথার্থতায় এবং আক্ষরিক ব্যাখ্যায় যুক্তিবিহীনভাবে, যাচাই-বাছাই ব্যতিরেকে, ধর্মান্ধের ন্যায়, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, চরমপন্থীদের মত বিশ্বাসী ছিল।
ইতিহাসঃ মৌলবাদ আমেরিকার প্রোটেষ্ট্যান্টদের একটি ব্যাপক আন্দোলনের নাম। মৌলবাদ আন্দোলন স্বাধীন চিন্তাবিদদের বিরুদ্ধে খৃষ্টধর্মের মূল তত্ত্বসমূহকে সংরক্ষণের জন্য হয়েছিল।
১৯১২ সালের দিকে কিছু বেনামী লেখক ১২টি ছোট ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভলিউমে “The fundamentals”নামে বই বের করে এবং এই বইয়ের নামকরণ থেকেই এই আন্দোলন Fundamentalist movement বা মৌলবাদী আন্দোলন নামে আখ্যায়িত হয়।
তাই মুসলমানদের মৌলবাদী বলা জায়েয নেই। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ পাক কুরআন শরীফে ইরশাদ করেন,
يايها الذين امنوا لاتقولوا راعنا وقولوا انظرنا واسمعوا وللكفرين عذاب اليم.
অর্থঃ- “হে ঈমানদারগণ! তোমরা রঈনা বলনা উনযুরনা বলো এবং শ্রবণ করো। আর কাফিরদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি।” (সূরা বাক্বারা-১০৪)
এ আয়াত শরীফের শানে নুযূলে বলা হয়, ইহুদীরা হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কষ্ট দেয়ার জন্য রঈনা শব্দ খারাপ অর্থে ব্যবহার করতো যার একাধিক অর্থ। একটি অর্থ হলো, “আমাদের দিকে লক্ষ্য করুন”যা ভাল অর্থে ব্যবহৃত হয়, আর খারাপ অর্থে, “হে মূর্খ, হে মেষ শাবক”এবং হিব্রু ভাষায় এটি একটি বদ্দোয়া।
হযরত ছাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের কেউ কেউ রঈনা শব্দের ভাল অর্থের প্রতি ইঙ্গিত করে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করলে, ইহুদীরা খারাপ অর্থ চিন্তা করে হাসাহাসি করত। এতে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কষ্ট পেতেন তবুও কিছু বলতেন না।
কেননা আল্লাহ্ পাক-এর রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওহী ছাড়া কোন কথা বলতেন না।
وما ينطق عن الهوى ان هو الا وحى يوحى.
অর্থঃ- “তিনি (হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ওহী ব্যতীত নিজের থেকে কোন কথা বলেন না।” (সুরা নজম/৩,৪)
এর ফলশ্রুতিতে আল্লাহ্ পাক কুরআন শরীফের আয়াত নাযিল করে “রঈনা” শব্দের পরিবর্তে “উনযুরনা” শব্দ ব্যবহার করতে বললেন। কারণ “রঈনা” শব্দ ভাল খারাপ উভয় অর্থে ব্যবহৃত হলেও “উনযুরনা”শব্দ শুধুমাত্র ভাল অর্থেই ব্যবহৃত হত। তাই যে সকল শব্দ ভাল মন্দ উভয় অর্থেই ব্যবহৃত হয়, সে সকল শব্দের পরিবর্তে উপরোক্ত আয়াত মুতাবিক তার সমার্থক অর্থবোধক শব্দ ব্যবহার করতে হবে, যা শুধুমাত্র ভাল অর্থেই ব্যবহৃত হয়।
উপরোক্ত আয়াত শরীফ অনুযায়ী ‘মৌলবাদ’শব্দ মুসলমানদের জন্য ব্যবহার করা জায়েয নেই। কারণ ‘মৌলবাদ’শব্দটি দুু’অর্থে ব্যবহৃত হয়- আভিধানিক ও ব্যবহারিক। আভিধানিক অর্থে মৌলবাদের অর্থ হলো “যে কোন ধর্মের মূল তত্ত্ব বা মৌলিক বিষয়সমূহ বা মৌলিক মতবাদসমূহ।”আর ইসলাম কোন মতবাদ নয়।
আর ব্যবহারিক অর্থে ধর্মান্ধ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, চরমপন্থী আমেরিকান খৃষ্টান প্রোটেষ্ট্যান্ট সম্প্রদায়ের বাইবেল সম্পর্কীয় মতবাদকে মৌলবাদ বলে এবং এ অর্থেই এটা মশহুর।
শরীয়তের দৃষ্টিতে ‘মৌলবাদ’
নাজায়িয ও হারাম
‘মৌলবাদ’শব্দটি আভিধানিক অর্থে মন্দ না হলেও শরীয়তে গ্রহণযোগ্য নয়। আর ব্যবহারিক অর্থে তো খুবই খারাপ। কারণ খৃষ্টান প্রোটেষ্ট্যান্টদের প্রতি অবমাননামূলক উক্তি হিসেবে এর উৎপত্তি। আর খৃষ্টান প্রোটেষ্ট্যান্টদের সাথে বিশেষভাবে সম্পর্কযুক্ত।
এছাড়া কুরআন-সুন্নাহ্র কোথাও মুসলমানকে মৌলবাদী বলে সম্বোধন করা হয়নি। বরং “মু’মিন, মুসলিম, মুত্তাকী”বলে সম্বোধন করা হয়েছে।
যেমন “সূরা আলে ইমরানের”১৩৯ নং আয়াত শরীফে আল্লাহ্ পাক বলেন,
ولاتهنوا ولاتحزنوا وانتم الاعلون ان كنتم مؤمنين.
অর্থঃ- “তোমরা চিন্তিত হয়োনা, পেরেশান হয়োনা বরং তোমরাই কামিয়াবী লাভ করবে যদি তোমরা মু’মিন হতে পার।”
“সূরা আলে ইমরানের”১০২ নং আয়াত শরীফের আল্লাহ্ পাক বলেন,
يايها الذين امنوا اتقوا الله حق تقته ولاتموتن الا وانتم مسلمون.
অর্থঃ- “হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ্ পাককে ভয় করার মত ভয় করো। আর তোমরা মুসলমান না হওয়া পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করোনা।”
“সূরা হুজুরাতের”১৩ নং আয়াত শরীফে আল্লাহ্ পাক বলেন,
ان اكرمكم عند الله اتقكم.
অর্থঃ- “নিশ্চয়ই আল্লাহ্ পাক-এর নিকট ঐ ব্যক্তি সবচাইতে সম্মানিত যিনি তোমাদের মধ্যে মুত্তাক্বী।”
উপরোক্ত আয়াত শরীফসমূহে আল্লাহ্ পাক তাঁর বান্দাদেরকে “মু’মিন, মুসলমান ও মুত্তাক্বী” হওয়ার জন্য বলেছেন।
মুসলমান মাত্রই কুরআন শরীফ, হাদীস শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস অনুযায়ী চলবে। আর মুসলমানরা কখনো ধর্মান্ধ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, চরমপন্থী ইত্যাদি হতে পারেনা।
কাজেই, সকল মুসলমানের জন্যই খৃষ্টান প্রোটেষ্ট্যান্টের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তাদের অনুসরণে মৌলবাদী দাবী করা সম্পূর্ণ নাজায়েয ও হারাম।
উপরোক্ত আয়াত শরীফ ও হাদীছ শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে যে, দ্বীন-ইসলামের নিয়ম-নীতি, তর্জ-তরীক্বা ব্যতীত অন্য কোন নিয়ম-নীতি, তর্জ-তরীক্বা গ্রহণ করা যাবেনা। যদি কেউ বিধর্মী বিজাতীয়দের অনুসরণে কোন বদ্ প্রথা প্রচলন করে তাহলে সেই বদ্ প্রথা অনুযায়ী যারা চলবে তাদের সকলেরই গুণাহ্ যে বদ্ প্রথা প্রচলন করেছে তার উপর বর্তাবে।
তাই মুসলমান মাত্রই কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস অনুযায়ী চলবে। কারণ মুসলমান কখনো নাস্তিক, বিধর্মী, বিজাতীয়দের অনুসরণ-অনুকরণ করতে পারেনা।
কাজেই, সকল মুসলমানের জন্যই খৃষ্টান প্রোটেষ্ট্যান্ট সম্প্রদায়ের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে মৌলবাদ দাবী করা সম্পূর্ণরূপে নাজায়িয ও হারাম।
(চলবে)
মুহম্মদ আসিফ মহিউদ্দীন, পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম।
মুহম্মদ জাহিদ হুসাইন, মালিবাগ চৌধুরী পাড়া, ঢাকা।
সুওয়াল: ‘মাসিক আল বাইয়্যিনাত’ জুলাই-২০০২ ঈসায়ী সংখ্যায় আজ থেকে প্রায় দীর্ঘ তিন বৎসর পূর্বে মাসিক মুহীনুল ইসলামের মুনাজাত সম্পর্কে বক্তব্য খণ্ডন করতে গিয়ে যে জাওয়াব প্রদান করা হয়েছে তার জবাবে ‘মাসিক মুহীনুল ইসলাম’ জুন-২০০৫ ঈসায়ী সংখ্যার ‘জিজ্ঞাসা-সমাধান’ বিভাগে যা লিখেছে তার মূল বিষয়বস্তু হলো-
….. ৩. হযরত ছাহাবায়ে কিরাম একটি নিম্ন শ্রেণীর কাজকেও বর্ণনা করতে সংকোচবোধ করেননি। আর মুনাজাত এমন এক কাজ যা দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাযান্তে প্রকাশ্যভাবে পাঁচবার যদি করতেন তবে কেন তার কোন বর্ণনা করা হয়নি। …….
এখন সুওয়াল হলো- “ফরয নামাযের পর সম্মিলিতভাবে হাত তুলে মুনাজাত করা” সম্পর্কিত হাটহাজারীর খারিজী-ওহাবী মৌলবীদের উল্লিখিত বক্তব্য ও মন্তব্যসমূহ কতটুকু সঠিক, দলীলভিত্তিক ও গ্রহণযোগ্য? প্রতিটি বক্তব্যের দলীলভিত্তিক জবাব দিয়ে মুনাজাত বিরোধী বাতিল ফিরক্বার খপ্পর থেকে আমাদের ঈমান-আমল হেফাজত করবেন বলে আমরা গভীরভাবে আশাবাদি।
জাওয়াব: “ফরজ নামাযের পর হাত উঠিয়ে সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করার স্বপক্ষে কোন বর্ণনা নেই” হাটহাজারী মৌলভী ছাহেবদের এ বক্তব্য ডাহা মিথ্যা, বিভ্রান্তিকর ও দলীলবিহীন। কেননা “ফরজ নামাযের পর সম্মিলিতভাবে হাত উঠিয়ে মুনাজাত করা স্বপক্ষে একটি, দুটি নয় বরং অসংখ্য ফে’লী ও ক্বওলী হাদীছ শরীফ রয়েছে যে সকল হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, স্বয়ং আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাস্সাম, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুই হাত তুলে সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং নিজেও ফরজ নামাযের পর হাত তুলে সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করেছেন।
(ধারাবাহিক)
হযরত আসওয়াদ আমেরী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর বর্ণিত হাদীছ শরীফ দ্বারাও ফরজ নামাযের পর (ইজতেমায়ী) সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করা মুস্তাহাব প্রমাণিত হয়।
যেমন মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বায় উল্লেখ রয়েছে,
عن الاسود العامرى عن ابيه قال صليت مع رسول الله صلى الله عليه وسلم الفجر فلما سلم انصرف ورفع يديه وهعا.
অর্থঃ- “হযরত আসওয়াদ আমিরী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত- তিনি তাঁর পিতা হতে বর্ণনা করেন। তাঁর পিতা বলেন- আমি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে ফজর নামায পড়লাম। যখন তিনি নামাযের সালাম ফিরালেন, ঘুরে বসলেন এবং উভয় হাত মুবারক উঠিয়ে মুনাজাত করলেন।” (মুছান্নেফ ইবনে আবী শায়বা)
ব্যাখ্যাঃ উক্ত হাদীছ শরীফে যে সমস্ত বিষয় রয়েছে তাহলো- হযরত আসওয়াদ আমিরী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর পিতা, তিনি বলেছেন,
صليت الفجر.
অর্থঃ- “আমি ফজর নামায পড়েছি।”
এর দ্বারা ফরজ নামায সাবিত হলো, অন্য কোন নফল নামায এটা হতে “এস্তেছ্না” বা বাতিল হলো। দ্বিতীয়তঃ انصرف বলা হয়েছে। এটা হতে বুঝা গেল, হাদীছ শরীফ বর্ণনাকারী হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে একা ছিলেন না, কেননা মাসয়ালা হলো ইমামের সাথে মুক্তাদী যদি একজন হয়, তাহলে তো মুক্তাদী ইমামের সাথে দাঁড়াবে। আর সাথে দাঁড়ালে তো انصرف হওয়ার অর্থাৎ ঘুরে বসার কোন প্রয়োজন নেই। সুতরাং انصرف শব্দ দ্বারা বুঝা গেল, জামায়াতে একাধিক মুক্তাদী ছিল, তাই তিনি মুক্তাদীগণের দিকে মুখ মোবারক ফিরিয়ে বসেছেন।
এক্ষেত্রে মুনাজাত বিরোধীগণ বলে থাকে যে, “হযরত আসওয়াদ আমিরী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত হাদীছ শরীফ দ্বারা হাত উঠায়ে সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করা প্রমাণিত হয়না। কারণ হাদীছ শরীফের শব্দগুলো একবচনে ব্যবহৃত হয়েছে।
কাজেই এর দ্বারা হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের মুনাজাত করা বুঝায় না। আর ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ সর্বক্ষেত্রে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অনুসরণ করতেন না, অনুরূপ এখানেও করেননি। যদি অনুসরণ করতেন, তবে তা হাদীছ শরীফে উল্লেখ থাকতো।”
মুনাজাত বিরোধীদের উক্ত বক্তব্যের জবাব হলো- হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুগণ অনেকক্ষেত্রে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অনুসরণ করেননি একথা সম্পূর্ণই অজ্ঞতাপ্রসূত। কারণ সর্বক্ষেত্রেই ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অনুসরণ করেছেন। তবে যেক্ষেত্রে আল্লাহ পাক ও তাঁর রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পক্ষ হতে কোন বিষয়ে অনুসরণ না করার নির্দেশ রয়েছে, তা ব্যতীত সবক্ষত্রেই অনুসরণ করতেন। তবে নিষেধকৃত বিষয় আমল না করাটাও অনুসরণ-অনুকরণের অন্তর্ভুক্ত।
এ প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফে বর্ণিত রয়েছে, একদিন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জুতা মুবারকসহ মসজিদে নামায পড়ছিলেন, এমন সময় হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস্ সালাম এসে বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ্ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনার জুতা মেুবারকে নাপাকি রয়েছে।” তখন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জুতা মুবারক খুলে ফেললেন। সাথে সাথে উপস্থিত সকল ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণও জুতা খুলে ফেললেন। তখন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “এ হুকুম তোমাদের জন্য নয়, এটা আমার জন্যে খাছ।”
এখানে আরো উল্লেখ্য যে, রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যা করতে দেখতেন, সাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণও তাই করতেন। আর যা বর্জন করতেন, তাঁরা তাই বর্জন করতেন, কখনো কি ও কেন প্রশ্ন করতেন না।
কাজেই মুনাজাত বিরোধীরা কি এরকম একটি ঘটনাও দেখাতে পারবেন, যেখানে নিষেধাজ্ঞা ব্যতীত হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অনুসরণ-অনুকরণ করেননি বা মুনাজাতে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণকে হাত উঠাতে নিষেধ করেছেন?
অতএব, উক্ত হাদীছ শরীফ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু গণকে নিয়ে ফরজ নামাজের পর সম্মিলিত বা ইজতিমায়ীভাবে মুনাজাত করেছেন। সুতরাং ফরয নামাযের পর সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করা মুস্তাহাব।
প্রদত্ত সুওয়াল-জাওয়াবের টীকা ভাষ্যঃ
* ফরজ নামাযের পর মুনাজাত করার স্বপক্ষে গত সংখ্যায় অনেক ফে’লী ও ক্বওলী হাদীছ শরীফের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। যথাঃ তিরমিযী, ইলাউস্ সুনান, নাসাঈ, বুখারী, মুসলিম, আবূ দাউদ শরীফসহ মোট ১০টি দলীল দেয়া হয়েছে।
* এ সংখ্যা থেকে মুনাজাত বিরোধীরা হযরত আসওয়াদ আমেরী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর বর্ণিত হাদীছ শরীফ উল্লেখ করে সম্মিলিতভাবে মুনাজাতের বিপক্ষে যে কথা বলেছে তার শক্ত ও সঠিক জাওয়াব দেয়া হচ্ছে। (চলবে)
মুহম্মদ সেলিম আহমদ
পাহাড় কাঞ্চনপুর, টাঙ্গাইল।
সুওয়াল: হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে প্রকাশিত অখ্যাত মাসিক পত্রিকা ফেব্রুয়ারী-২০০৫ ঈসায়ী সংখ্যায় জিজ্ঞাসা-সমাধান বিভাগে, মাসিক আল বাইয়্যিনাত-অক্টোবর ২০০৩ ঈসায়ী সংখ্যায় প্রদত্ত মীলাদ-ক্বিয়ামের সমালোচনা করতে গিয়ে এবং একই বিষয়ে এপ্রিল-২০০৫ ঈসায়ী ও মে-২০০৫ ঈসায়ী সংখ্যায় এছাড়াও মাসিক মদীনা পত্রিকা ফেব্রুয়ারী-২০০৫ ঈসায়ী সংখ্যায় প্রশ্নোত্তর বিভাগে একই ধরনের জবাব দেয়া হয়েছে।
তাদের বক্তব্যগুলোর মধ্যে যে বিষয়গুলো আমার নিকট সন্দেহজনক তা নিম্নে উল্লেখ করা হলো-
৩. নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সম্মানে ক্বিয়াম করার প্রমাণ হাদীছ শরীফে উল্লেখ নেই। হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সম্মানে ক্বিয়াম করেননি। (নাউযুবিল্লাহ)
এখন আমার সুওয়াল হলো, ক্বিয়াম সম্পর্কিত তাদের উল্লিখিত বক্তব্য কতটুকু দলীল সম্মত? কুরআন, সুন্নাহ্, ইজমা ও ক্বিয়াসের দৃষ্টিতে দলীলভিত্তিক জাওয়াব দিয়ে আমাদের আক্বীদা, আমল হিফাযতে সহায়তা করবেন বলে আমরা আশাবাদী।
(ধারাবাহিক)
জাওয়াবঃ হাটহাজারী মৌলভী ছাহেবদের উক্ত বক্তব্য জিহালতপূর্ণ ও দলীলবিহীন। কারণ ক্বিয়াম করা হয় সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি তা’যীম প্রদর্শনার্থে ও আদব রক্ষার্থে। আর কুরআন শরীফে নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তা’যীম-তাক্রীম করার ও তাঁর প্রতি আদব রক্ষা করার কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
যেমন, আল্লাহ্ পাক তাঁর কালাম পাকে ইরশাদ করেন,
وتعزروه وتوقروه.
অর্থঃ- “তোমরা সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খিদমত কর ও তা’যীম কর।” (সূরা ফাত্হ-৯)
আর সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সম্মানে বা তা’যীমার্থে ক্বিয়াম করার প্রমাণ সরাসরি খোদ হাদীছ শরীফেও উল্লেখ আছে এবং হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সম্মানে ক্বিয়াম করেছেন।
যেমন, এ প্রসঙ্গে “শোয়াবুল ঈমান লিল্ বায়হাক্বী” কিতাবের ৬ষ্ঠ খণ্ডের ৪৬৭ পৃষ্ঠার ৮৯৩০ নং হাদীছ শরীফে উল্লেখ আছে,
قال أبو هريرة رضى الله تعالى عنه وهو يحدثنا كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يجلس معنا فى المجلس يحدثنا فإذا قام قمنا حتى نراه قد دخل بعض بيوت أزواجه فحدثنا يوما فقمنا حين قام…
অর্থঃ- “হযরত আবু হুরাইরা রদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু বলেছেন, রাবী বলেন এবং তিনিই আমাদের কাছে হাদীছ শরীফ বর্ণনা করেছেন যে, একদা সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, আল্লাহ্ পাক-এর রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের মাঝে মজলিসে বসে আমাদেরকে নছীহত করছিলেন। অতঃপর নছীহত শেষে যখন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাঁড়ালেন, আমরাও উপস্থিত সকল ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহুমগণ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সম্মানে যথাযথ আদবের সহিত দাঁড়িয়ে গেলাম, ততক্ষণ পর্যন্ত; যতক্ষন আমরা তাঁকে দেখতে পাচ্ছিলাম। এমনকি তাঁর আহ্লিয়াগণের কোন একটি হুজরা শরীফে প্রবেশ না করা পর্যন্ত আমরা হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সম্মানে যথাযথ আদবের সহিত দাঁড়িয়ে রইলাম।”
অতঃপর আরেকদিন আল্লাহ্ পাক-এর রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের মাঝে মজলিসে বসে আমাদেরকে নছীহত করছিলেন। অতঃপর নছীহত শেষে যখন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাঁড়ালেন, আমরাও উপস্থিত সকল ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহুমগণ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সম্মানে যথাযথ আদবের সহিত দাঁড়িয়ে গেলাম। ……
“ইরশাদুস্ সারী লি র্শাহি ছহীহিল বুখারী” কিতাবের ৯ম খণ্ডের ১৫৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
وفى حديث أسامة ابن شريك رضى الله تعالى عنه …. قال قمنا الى النبى صلى الله عليه وسلم فقبلنا يده.
অর্থঃ- “হযরত উসামা ইবনে শারীক রদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু-এর বর্ণিত হাদীছ শরীফে উল্লেখ আছে,…..তিনি বলেন; আমরা সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর তা’যীম-এর জন্যে উপস্থিত সকল ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহুমগণ দাঁড়িয়ে গেলাম। অতঃপর আমরা তাঁর হাত মুবারকে চুম্বন করলাম।”
ঞ্জঞ্জ“শোয়াবুল ঈমান লিল্ বায়হাক্বী” কিতাবের ৬ষ্ঠ খণ্ডের ৪৬৭ পৃষ্ঠার ৮৯২৯ নং হাদীছ শরীফে উল্লেখ আছে,
عن ابى هريرة رضى الله تعالى عنه قال كان رسول الله صلى الله عليه وسلم إاذا أراد ان يدخل بيتا قمنا له.
অর্থঃ- “হযরত আবু হুরাইরা রদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন; সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, আল্লাহ্ পাক-এর রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন হুজরা শরীফে প্রবেশ করার ইচ্ছা পোষণ করতেন, তখন আমরা উপস্থিত সকল ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহুমগণ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সম্মানে যথাযথ আদবের সহিত দাঁড়িয়ে গেলাম।
“মিরকাত শরীফ” কিতাবের ৯ম খণ্ডের ৮৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
وعن أبى أمامة رضى الله تعالى عنه قال خرج رسول الله صلى الله عليه وسلم متكيا أى معتمدا على عصا أى لمرض كان به فقمنا له أى لتعظيمه صلى الله عليه وسلم.
অর্থঃ- “হযরত আবূ উমামা রদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন; একদা আল্লাহ্ পাক-এর রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লাঠির উপর ভর দিয়ে হুজরা শরীফ থেকে বের হয়ে আসলেন, অতঃপর আমরা উপস্থিত সকল ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহুমগণ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর তা’যীমের জন্য বা সম্মানের জন্য যথাযথ আদবের সহিত দাঁড়িয়ে গেলাম।
উপরোক্ত হাদীছ শরীফ দ্বারা সুস্পষ্টভাবে এটাই প্রমাণিত হলো যে, নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সম্মানে বা তা’যীমার্থে ক্বিয়াম করার প্রমাণ সরাসরি খোদ হাদীছ শরীফেই উল্লেখ আছে। এবং হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহুমগণও একমাত্র নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সম্মানেই ক্বিয়াম করেছেন।
শুধু তাই নয় এছাড়াও হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহুমগণ একে অপরের জন্যও দাঁড়িয়েছেন। যেমন,
عن عبد الرحمن بن عبد الله بن كعب بن مالك عن ابيه عن جده كعب رضى الله عليه عنه …….. وانطلقت الى رسول الله صلى الله عليه وسلم حتى دخلت المسجد واذا برسول الله صلى الله عليه وسلم جالس حوله الناس فقال الى طلحة بن عبيد الله رضى الله تعالى عنه يهرول حتى صافحنى ……
অর্থঃ- “হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আব্দুল্লাহ তাঁর দাদা হযরত কা’ব রদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, হযরত কা’ব রদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু বলেন, আমি আল্লাহ্ পাক-এর রসূল হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দরবার শরীফে গেলাম, এমনকি মসজিদে নববীতে প্রবেশ করলাম, তখন হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহুমগণ, আল্লাহ্ পাক-এর রসূল হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে চতুর্দিকে বসা ছিলেন, অতঃপর ত্বলহা ইবনে উবায়দুল্লাহ রদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু আমার জন্য দাঁড়ালেন বা আমর জন্য ক্বিয়াম করলেন, এমনকি দ্রুতগতিতে এসে আমার সাথে মুছাফাহা করলেন ….।” (বুখারী শরীফ ২য় খণ্ড ৯২৬ পৃষ্ঠা, ইরশাদুস সারী লি র্শাহি ছহীহিল বুখারী ৯ম খণ্ড ১৫৪ পৃষ্ঠা, শোয়াবুল ঈমান লিল্ বায়হাক্বী ৬ষ্ঠ খণ্ডের ৪৬৭ পৃষ্ঠার ৮৯২৮ নং হাদীছ শরীফ)
প্রদত্ত সুওয়াল-জাওয়াবের টীকা ভাষ্যঃ
(ক) বিগত সংখ্যায় বলা হয়েছে, শুধুমাত্র বাদশাহ্ মুজাফ্ফার উদ্দীন রহমতুল্লাহি আলাইহি ও খাজা তকী উদ্দীন সুবুকী রহমাতুল্লাহি আলাইহি মীলাদ ক্বিয়ামের প্রবর্তক নন। বরং মীলাদ ও ক্বিয়ামের অস্তিত্ব আল্লাহ্ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহুমগণের যুগেই ছিল।
তবে বর্তমানে আমরা যে তরতীবে মীলাদ শরীফ পাঠ করে থাকি এরূপ তরতীব বা তর্জতরীকার প্রবর্তক হচ্ছেন হযরত শায়খ উমর ইবনে মুহম্মদ মুল্লা রহমাতুল্লাহি আলাইহি ও খাজা তকী উদ্দীন সুবুকী রহমাতুল্লাহি আলাইহি। আর সর্ব প্রথম রাজকীয়ভাবে ও জাকজমকপূর্ণ পরিবেশে ব্যাপক প্রচার-প্রসারের মাধ্যমে মীলাদ শরীফের আয়োজন করেণ আরবলের বাদশাহ্ মুজাফ্ফার উদ্দীন রহমতুল্লাহি আলাইহি।
আর উল্লিখিত বুযুর্গগণ মীলাদ শরীফ ও ক্বিয়ামের যে তরতীব প্রবর্তন করেছেন তা মোটেও কুরআন সুন্নাহর বিরোধী নয়।
(খ) বর্তমান সংখ্যায় উক্ত জবাবের মূল কথা হলো, নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সম্মানে ক্বিয়াম করার প্রমাণ খোদ হাদীছ শরীফেই উল্লেখ আছে। এবং হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণও নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সম্মানে ক্বিয়াম করেছেন।
(গ) পরবর্তী সংখ্যায় প্রমাণ করা হবে, মিশকাত শরীফে বর্ণিত হাদীছ শরীফে দাঁড়িয়ে সালাম করতে নিষেধ করা হয়নি। (চলবে)
মুসাম্মত সানজিদা আক্তার
সভানেত্রী- ছাত্রী আঞ্জুমানে আল বাইয়্যিনাত
মুহম্মদপুর, ঢাকা।
সুওয়াল: অখ্যাত মাসিক রাহমানী পয়গাম এপ্রিল/২০০৩ ঈসায়ী সংখ্যায় জিজ্ঞাসার-জবাব বিভাগে নিম্নোক্ত ১২৪৭নং জিজ্ঞাসার-জবাব ছাপা হয়-
জিজ্ঞাসা ঃ সাহাবী আবু সাঈদ খুদরী ও আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা বলেন যে, রাসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন আমার মৃত্যুর পর পূর্ব দেশগুলির মধ্য হতে কোন একটি দেশ থেকে আমার উম্মতের ভিতর হতে একটি দল বের হবে। এই দলের সদস্যগণ হবে অশিক্ষিত ও মূর্খ। এদের মধ্যে কোন শিক্ষিত লোক গেলে সেও হয়ে যাবে মূর্খের মত। তাদের বক্তৃতা হবে বহু বহু গুণের ফজিলতের। তাদের মত বক্তৃতা বা বয়ান কারো হবে না। …. তারা কুরআনের উপর আমল কিম্বা কুরআন প্রতিষ্ঠার একটু চেষ্টাও করবে না কখনো। ….
এর জবাবে উক্ত অখ্যাত পত্রিকায় বলা হয়েছে, প্রদত্ত হাদীছ শরীফ তাবলীগের জন্য নয়। তাবলীগের নিয়মনীতি ও কার্যক্রম পুরোপুরি শরীয়তসম্মত। ইসলামের পরিপন্থি কোন কিছুই এতে নেই।
উক্ত অখ্যাত পত্রিকার উল্লিখিত “জিজ্ঞাসা-জবাবের” প্রেক্ষিতে আমার সুওয়াল বা জানার বিষয় হলো-
….. “(৩) প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগীদের মধ্যে শরীয়ত বিরোধী বা ইসলাম পরিপন্থী কোন নিয়মনীতি বা আক্বীদা, আমল নেই, এটা কতটুকু সত্য?” ….
কুরআন, সুন্নাহ্, ইজমা ও ক্বিয়াসের দৃষ্টিতে উল্লিখিত সুওয়ালগুলোর দলীলভিত্তিক জাওয়াব দিয়ে আমাদের আক্বীদা, আমল হিফাযতে সহায়তা করবেন বলে আমরা আশাবাদী।
জাওয়াব: প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগ জামায়াত সম্পর্কে উক্ত অখ্যাত পত্রিকার জবাব শুদ্ধ হয়নি। বরং ভুল, মনগড়া ও দলীলবিহীন হয়েছে।
তারা তাদের জবাবে প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগীদের সাফাই বর্ণনা করতে যেয়ে বর্ণিত হাদীছ শরীফের অপব্যাখ্যা করেছে। সাথে সাথে “ছয় উছূলীদের মধ্যে কুরআন-সুন্নাহ্ বিরোধী কোন আক্বীদা-আমল নেই” বলে তাদের নির্লজ্জ দালালী করে নিজেদেরকে অপব্যাখ্যাকারী ও মিথ্যাবাদীরূপে সাব্যস্ত করেছে। সুওয়ালে উল্লিখিত বিষয়গুলোর ধারাবাহিক দলীলভিত্তিক আলোচনা করলেই তা আরো সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হবে।
তাই নিম্নে সুওয়ালে বর্ণিত বিষয়গুলোর দলীলভিত্তিক জাওয়াব দেয়া হলো-
(ধারাবাহিক)
প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগ সম্পর্কে অখ্যাত পত্রিকার ‘জিজ্ঞাসার জবাবের’ প্রেক্ষিতে আপনার তৃতীয় সুওয়াল হলো- “(৩) প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগীদের মধ্যে শরীয়ত বিরোধী বা ইসলাম পরিপন্থী কোন নিয়মনীতি বা আক্বীদা-আমল নেই, এটা কতটুকু সত্য?”
আপনার উক্ত সুওয়ালের প্রেক্ষিতে বলতে হয় যে, অখ্যাত পত্রিকার উক্ত বক্তব্য মোটেও সত্য নয়, কেননা প্রচলিত ছয় উছূলীদের মধ্যে একটি দু’টি নয়, বরং অসংখ্য কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী নিয়মনীতি বা আক্বীদা-আমল ও বক্তব্য রয়েছে, যা তাদের মুরুব্বীদের লিখা কিতাবাদিতেই বিদ্যমান রয়েছে। তাই নিম্নে ধারাবাহিকভাবে, পর্যায়ক্রমে প্রচলিত ছয় উছূলীদের কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী ও কুফরীমূলক বক্তব্যগুলোর সাথে সাথে কুরআন-সুন্নাহ্র দৃষ্টিতে তার সঠিক ফায়সালা তুলে ধরা হলো।
প্রচলিত ছয় উছূলীদের কুরআন-সুন্নাহ
বিরোধী কুফরীমূলক বক্তব্য- ১৭
দাওয়াতে তাবলীগ কি ও কেন (মুহম্মদ ওবায়দুল হক রচিত) ১১৬ পৃষ্ঠা, পস্তী কা ওয়াহেদ এলাজ ৯ পৃষ্ঠা, মূলঃ- মাওঃ এহ্তেশামুল হাসান কান্দলভী, অনুবাদক- ছাখাওয়াত উল্লাহ। তাবলীগী নেছাব ১১ পৃষ্ঠা, ফাজায়েলে তাবলীগ (মূলঃ- হযরত মাওলানা জাকারিয়া, অনুবাদক- আম্বর আলী) ৯ পৃষ্ঠা, তাবলীগে ইসলাম, লেখক- আব্দুস সাত্তার ত্রিশালী ৯ পৃষ্ঠা ও মাওলানা শাহ্ মনিরুজ্জামান লিখিত- আমি কেন তাবলীগ করি ১৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে, “তাবলীগ তথা দ্বীনের দাওয়াত দেয়ার কারণেইহুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উম্মতকে শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া হয়েছে, অন্য কোন কারণে নয়।” দলীল স্বরূপ তারা সূরা ইমরানের ১১০নং আয়াত শরীফ পেশ করে থাকে।
(তৃতীয় অংশ)
এখানে স্মরণীয় যে, কুরআন শরীফের আয়াত এবং ছহীহ্ হাদীছ শরীফ দ্বারা প্রমাণিত আছে যে, আগেকার উম্মতগণের উপরও দাওয়াতের দায়িত্ব ছিলো। যেমন সূরা ইয়াসীনে উল্লেখ করা হয়েছে, “কোন এক জনপদে নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালামগণ আগমন করলে সেখানকার অধিবাসীরা তাঁদের (নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালামগণের) রিসালতকে অস্বীকার করে হত্যা করার জন্য উদ্যত হলো। তখন শহরের প্রান্তভাগ থেকে এক ব্যক্তি, যিনি ঈমান গ্রহণ করেছিলেন, তিনি দৌড়ে এলেন এবং তার সম্প্রদায়কে নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালামগণকে হত্যা করতে নিষেধ করলেন এবং তাঁদের অনুসরণ করার উপদেশ দিলেন।”
এছাড়া হাদীছ শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে যে, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, “আল্লাহ পাক হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস্ সালাম-এর নিকট ওহী পাঠালেন, অমুক শহরের সমগ্র বাসিন্দাসহ উল্টিয়ে দাও।” তখন হযরত জীব্রাঈল আলাইহিস্ সালাম আরজ করলেন, “হে পরওয়ারদিগার, এ শহরে আপনার অমুক বান্দা রয়েছে, যে মুহূর্তকালও আপনার নাফরমানীতে লিপ্ত হয়নি।” তখন আল্লাহ পাক ইরশাদ করলেন, “শহরটিকে ঐ ব্যক্তি এবং সমগ্র বাসিন্দাসহ তাদের উপর উল্টিয়ে দাও। কারণ আমার জন্য ঐ ব্যক্তির চেহারায় এক মুহূর্তের জন্য পরিবর্তন আসেনি, অর্থাৎ সে লোকদের নাফরমানী থেকে নিষেধ করা তো দূরের কথা, আফসোসও করেনি।” (বাইহাক্বী শরীফ)
বণী ইসরাঈল আমলের অনুরূপ আরো একটি ওয়াক্বেয়া তাফসীরে উল্লেখ করা হয়। আল্লাহ পাক হযরত ইউশা বিন নুন আলাইহিস্ সালাম-এর উপর ওহী নাযিল করলেন, “হে আমার নবী! আপনার উম্মতের মধ্যে এক লক্ষ লোককে ধ্বংস করে দেয়া হবে। যার মধ্যে ৬০ হাজার লোক সরাসরি গুণাহে লিপ্ত (গোমরাহ)।”
তখন হযরত ইউশা বিন নুন আলাইহিস্ সালাম বললেন, “আয় আল্লাহ পাক! ৬০ হাজার লোক সরাসরি গুণাহে লিপ্ত, তাই তাদের ধ্বংস করে দেয়া হবে। কিন্তু বাকী ৪০ হাজার লোককে ধ্বংস করা হবে কেন?” তখন আল্লাহ্ পাক বললেন, “যেহেতু তারা তাদের সাথে মিলা-মিশা, ওঠা-বসা করে এবং সম্পর্ক রাখে। আর গুণাহের কাজে বাধা প্রদান করেনা, তাই তাদেরকে সহ ধ্বংস করে দেয়া হবে।”
সুতরাং প্রমাণিত হলো যে, পূর্ববর্তী উম্মতগণের উপরও দাওয়াতের দায়িত্ব ছিল, কেননা দায়িত্ব থাকার কারণেই তা পালন না করায় ‘বনী ইস্রাঈলের’উল্লেখিত ব্যক্তি ও সম্প্রদায়কে শাস্তি পেতে হয়েছে।
অতএব, উপরোক্ত আয়াত শরীফ, হাদীছ শরীফ এবং তার আনুষাঙ্গিক ঘটনা ব্যতীত আরও অনেক আয়াত শরীফ, হাদীছ শরীফ এবং ঘটনার মাধ্যমে জানা যায় যে, পূর্ববর্তী উম্মতগণও দাওয়াতের কাজ করেছেন, যা তাফসীরে রূহুল মায়ানী, তাফসীরে মায্হারী, তাফসীরে আমিনিয়া, তাফসীরে খাযেন, তাফসীরে মা’আরেফুল কুরআন ইত্যাদি তাফসীরের কিতাবসমূহ এবং বিশুদ্ধ হাদীছ শরীফের কিতাব দ্বারাও প্রমাণিত।
এখানে উল্লেখ্য যে, অন্যান্য নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালামগণ, আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উম্মত হওয়ার জন্য আরজু করেছেন, তাই বলে কেউ যেন একথা মনে না করে যে, উম্মতে মুহম্মদীর শ্রেষ্ঠত্ব অন্যান্য নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালামগণ হতে বেশী। বরং শুধুমাত্র হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কারণে যে উম্মতে মুহম্মদীর শ্রেষ্ঠত্ব, তা বুঝানোর জন্যই সমস্ত নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালামগণ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উম্মত হওয়ার জন্য আরজু করেছেন।
অতএব, প্রমাণিত হলো যে, উম্মতে মুহম্মদী সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উম্মত হওয়ার কারণেই শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছে, তাবলীগ তথা দাওয়াতের কারনে নয়।
কাজেই যারা বলে তাবলীগ তথা দাওয়াতের কারণে উম্মতে মুহম্মদী শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছে, তাদের কথা সম্পূর্ণ মনগড়া, বানোয়াট ও বিভ্রান্তিকর এবং তাফসীর বিররায় হওয়ার কারণে কুফরীর অন্তুর্ভূক্ত।
আল্লাহ পাক আমাদের সকলকে এ ধরণের অবান্তর ও কুফরীমূলক কথাবার্তা বলা থেকে হিফাযত করুন। (আমীন)
প্রদত্ত সুওয়াল-জাওয়াবের টীকা ভাষ্যঃ
উল্লেখ্য, প্রদত্ত সুওয়াল জাওয়াবটিতে ধারাবাহিকভাবে প্রচলিত ছয় উছূলভিত্তিক তাবলীগ ওয়ালাদের ভূল ও কুফরী আক্বীদার উল্লেখ ও তার সঠিক জাওয়াব দেয়া হচ্ছে।
য প্রচলিত তাবলীগওয়ালাদের মধ্যে বিরাজকৃত অনেক কুফরী আক্বীদার মধ্যে একটি হচ্ছে যে, তাবলীগ বা দ্বীনের দাওয়াত দেয়ার কারণেই হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উম্মতকে শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া হয়েছে। অন্য কারণে নয়।
য গত ১৪৬তম সংখ্যায় উপরোক্ত গলদ আক্বীদার প্রেক্ষিতে তারা সূরা আলে ইমরানের ১১০নং আয়াত শরীফের যে ভুল ব্যাখ্যা দেয় তার জাওয়াব দেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে সূরা তওবার ১০০নং আয়াত শরীফের দলীল ও প্রাসঙ্গিক জবাব দেয়া হয়েছে।
য আর বর্তমান সংখ্যায়ও সে জাওয়াবের ধারাবাহিকতা এসেছে এবং এ সংখ্যার জাওয়াবের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো হযরত ইউশা নুন আলাইহিস্ সালাম-এর ৪০ হাজার লোককে ধ্বংস করা হয়েছিলো দাওয়াতের দায়িত্ব পালন না করার জন্যই। কাজেই দেখা যায় পূর্ববর্তী উম্মতদেরও দাওয়াতের দায়িত্ব ছিলো। অতএব, দাওয়াতের জন্যই উম্মতে মুহম্মদীর শ্রেষ্ঠত্ব নয়। বরং সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উম্মত হওয়ার জন্যই উম্মতে মুহম্মদীর শ্রেষ্ঠত্ব প্রদত্ত জাওয়াবে তাই বলা হয়েছে। (চলবে)
মুহম্মদ সুলতান মাহমুদ, মিরপুর, ঢাকা।
মুহম্মদ আহমদুল্লাহ কামালী, নরসিংদী।
সুওয়ালঃ মাসিক মদীনা ফেব্রুয়ারী ২০০৫ ঈসায়ী সংখ্যায় প্রশ্নোত্তর বিভাগে নিম্নোক্ত প্রশ্নোত্তর ছাপা হয়-
প্রশ্নঃ চুল…রাখার সুন্নত কি?……
উত্তরঃ…চুল রাখার দুই তরীকা, এক বাবরি রাখা, দুই মুণ্ডানো।….(শামী, আলমগীরী, বুখারী, মুসলিম)
আর হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে প্রকাশিত অখ্যাত মাসিক পত্রিকা এপ্রিল/২০০৫ ঈসায়ী সংখ্যায় জিজ্ঞাসা-সমাধান বিভাগে বলা হয়েছে, “মাথা মুন্ডানো যদিও রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে হজ্বের মৌসুম ব্যতীত পাওয়া যায় না, কিন্তু হযরত আলী (রাযি.) থেকে মাথা মুন্ডানোর বর্ণনা পাওয়া যায় এবং হযরত আলী (রাযি.)-এর এই আমলের উপর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্বীকৃতি পাওয়া যায়। তাই সাহাবীর আমল হিসেবে মাথা মুন্ডানো সুন্নাত।
অন্য এক রেওয়ায়াতে আছে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাথা মুন্ডন কারীদের জন্য তিন বার রহমতের দোয়া করেছিলেন। আর হানাফী মাযহাবের গ্রহণযোগ্য কিতাবাদিতেও মাথা মুন্ডানোকে সুন্নাত বলা হয়েছে। (ফাত্ওয়ায়ে আলমগীরি ও শামী)
এখন আমার সুওয়াল হলো- মাথা মুণ্ডন করা সম্পর্কে মাসিক মদীনা ও হাটহাজারী মৌলভী ছাহেবদের উক্ত বক্তব্য সঠিক হয়েছে কি? আর সত্যিই কি মাথা মুণ্ডন করা সুন্নত বা চুল রাখার দুই তরীকার, এক তরীকা? দলীলসহ সঠিক জাওয়াব দিয়ে, আমাদের আক্বীদা আমল হিফাযতে সহায়তা করবেন বলে আমরা আশাবাদী।
জাওয়াবঃ মাথার চুল মুণ্ডন করা সম্পর্কে মাসিক মদীনা ও হাটহাজারী মৌলভী ছাহেবদের উক্ত বক্তব্য সঠিক হয়নি। বরং ভুল ও অশুদ্ধ হয়েছে।
কারণ, মাসিক মদীনা ও হাটহাজারী মৌলভী ছাহেব এবং তাদের সমজাতীয়রা এমন একটি হাদীছ শরীফও উল্লেখ করতে পারবে না, যেখানে উল্লেখ আছে যে, “আল্লাহ্ পাক-এর রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নুরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ্, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হজ্ব ও ওমরাহ ব্যতীত অন্য সময় নিজ মাথার চুল মুবারক মুণ্ডন করেছেন।” বরং অসংখ্য ছহীহ্ হাদীছ শরীফ দ্বারা প্রমাণিত যে, “আল্লাহ পাক-এর রসূল, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সব সময় বাবরী চুল মুবারক রাখতেন। সেহেতু সকল উম্মতে মুহম্মদীর জন্য সর্বদা বাবরী চুল রাখাই দায়িমী সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত।
(ধারাবাহিক)
চুল রাখা সম্পর্কে হাটহাজারীর জিহালতপূর্ণ বক্তব্যের খণ্ডন মুলক জবাব-৪
উল্লেখ্য, হাটহাজারীর মৌলভী সাহেবরা বলেছে, “আর হানাফী মাযহাবের গ্রহণযোগ্য কিতাবাদিতেও মাথা মুন্ডানোকে সুন্নাত বলা হয়েছে। (ফাত্ওয়ায়ে আলমগীরি ও শামী) ….।”
এর জবাবে বলতে হয় যে, হাটহাজারীর মৌলভী সাহেবদের উপরোক্ত বক্তব্যও চরম জিহালতপূর্ণ হয়েছে। কারণ হানাফী মাযহাবের গ্রহণযোগ্য কিতাবাদিতেও শুধুমাত্র মাথা মুন্ডানোকে সুন্নাত বলা হয়নি। বরং সিঁথি বিশিষ্ট বাবরী রাখাকেও সুন্নত বলা হয়েছে।
হাটহাজারীর দলীলের ভুল ব্যাখ্যা উদঘাটন
উল্লেখ্য, হাটহাজারীর মৌলভী সাহেবরা মাথা মুণ্ডন করা সুন্নত বলে তাদের স্বপক্ষে দলীল হিসেবে ফতওয়ায়ে আলমগীরী ও শামী, কিতাবের বরাত দিয়েছে। আর উক্ত কিতাবগুলোতে হযরত ইমাম ত্বহাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর মতটিই উল্লেখ করা হয়েছে।
মূলত: হাটহাজারীর মৌলভী সাহেবরা উল্লিখিত কিতাবের ইবারতের সঠিক ব্যাখ্যা বুঝতে না পারার কারণেই বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, আবূ দাউদ, নাসাঈ, ইবনে মাযাহ্ ইত্যাদি ছিহাহ্ সিত্তাহ্সহ অনেক হাদীছ শরীফের অসংখ্য ছহীহ্ হাদীছ শরীফকে উপেক্ষা করে এ ব্যাপারে ভুল সিদ্ধান্ত পেশ করে জিহালতের পরিচয় দিয়েছে।
নিম্নে উক্ত ফতওয়ার কিতাবের ইবারত উল্লেখ করে তার সঠিক ব্যাখ্যা তুলে ধরা হলো।
যেমন, “ফতওয়ায়ে আলমগীরী ও শামী” কিতাবে উল্লেখ আছে,
ان السنة فى شعر الرأس أما الفرق وأما الحلق وذكر الطحاوى سنة ونسب ذلك الى العلماء الثلاثة كذا فى التاتارخانية يستحب حلق الراس فى كل جمعة كدا فى الغرائب.
অর্থঃ- “নিশ্চয় মাথার চুলের ব্যাপারে সুন্নত হলো, সিঁথি বিশিষ্ট বাবরী রাখা। আর মুণ্ডন করা সে সম্পর্কে হযরত ইমাম ত্বহাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি উল্লেখ করেন, মুণ্ডন করা সুন্নত এবং তিনি তা তিনজন আলিমের দিকে নিছবত করেন। অনুরূপ তাতারখানীয়াতেও উল্লেখ আছে। প্রত্যেক জুমুয়ার দিন মাথা মুণ্ডন করা মুস্তাহাব। অনুরূপ গারায়েবে উল্লেখ আছে।”(ফতওয়ায়ে আলমগীরী ৫ম খণ্ড,৩৫৭ পৃষ্ঠা, শামী ৬ষ্ঠ খণ্ড, ৪০৭ পৃষ্ঠা)
“ফতওয়ায়ে আলমগীরী ও শামীর” উপরোক্ত ইবারতের প্রেক্ষিতে প্রথমতঃ বলতে হয় যে, হযরত ইমাম ত্বহাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি মাথা মুণ্ডনকে সুন্নত বলেছেন সত্য কথাই। তবে এর দ্বারা সুন্নতে রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রমাণিত হয় না, বরং কেউ কেউ বলেছেন, হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের মধ্যে হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ওজরবশত: কখনো মাথার চুল ছাঁটতেন বা মুণ্ডন করতেন।
এ প্রসঙ্গে “ফতওয়ায়ে আলমগীরী” কিতাবে উল্লিখিত উক্ত ইবারতের ব্যাখ্যায় “ফতওয়ায়ে হিন্দিয়া” কিতাবের ৯ম খণ্ডের ৯৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
উর্দূ কম্পোজ করতে হবে
অর্থঃ- “কেউ কেউ, অধিকাংশ সময় এরূপই করতেন অর্থাৎ মাথা মুণ্ডন করতেন যেন গোসলের মধ্যে সাবধানতা অবলম্বন করা যায়। সুতরাং এখানে সুন্নত বলতে সম্ভবতঃ হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর আমলকে বুঝানো হয়েছে।”
অর্থাৎ হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর মাথা মুবারকের চুল এত ঘন ছিল যে, ফরয গোসলের সময় পানি পৌঁছানোর ব্যাপারে সন্দেহের উদ্রেক হতো।
তাই তিনি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অনুমতি সাপেক্ষে কখনো মাথার চুল মুণ্ডন করতেন এবং কখনো মাথার চুল ছোট করে রাখতেন। তবে বিশুদ্ধ বর্ণনা মতে তিনি মাথার চুল ছোট করে রাখতেন। মুণ্ডন করতেন না।
সুতরাং উক্ত ইবারত থেকে এটাও প্রমাণিত হয় যে, হযরত ইমাম ত্বহাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি মাথা মুণ্ডনকে সুন্নত বলেছেন তবে এর দ্বারা হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর দিকেই ইঙ্গিত করেছেন, সুন্নতে রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নয়।
হজ্জের উপর ক্বিয়াস করে মাথা মুণ্ডন
করাকে সুন্নত বলা হয়েছে যা ছহীহ নয়
দ্বিতীয়তঃ হযরত ইমাম ত্বহাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি সুন্নত বলতে যদি সুন্নতে রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বুঝিয়ে থাকেন। তবে অবশ্যই তা সঠিক নয়। কারণ, আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ, নূরে মুজাস্সাম, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (হজ্জ ও ওমরাহ ব্যতীত) অন্য সময় মাথা মুণ্ডন করেছেন এ ধরনের একটি দলীলও তিনি পেশ করেনি। মূলত: কারো পক্ষে পেশ করাও সম্ভব নয়। যদি তাই হয়ে থাকে তবে হজ্ব ও ওমরাহ ব্যতীত অন্য সময় মাথা মুণ্ডন করা কি করে সুন্নতে রসূল হতে পারে?
আর যদি তিনি হজ্জের উপর ক্বিয়াস করে সর্বদাই মাথা মুণ্ডন করাকে সুন্নতে রসূল বলে থাকেন তবে তাও সঠিক ও গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ অসংখ্য ছহীহ হাদীছ শরীফ দ্বারা অকাট্টভাবে প্রমাণিত আছে যে, আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বদাই ‘বাবরী চুল মুবারক’ রেখেছেন। সম্পূর্ণ হায়াত মুবারকে শুধুমাত্র চারবার (ওমরাহ ও হজ্জ পালন কালে) মাথা মুণ্ডন করেছেন।
যেমন, এ সম্পর্কে “মিশকাত শরীফের” ২৩২ পৃষ্ঠায় হজ্জের আলোচনায় হাদীছ শরীফে উল্লেখ আছে,
عن يحيى بن الحصين عن جدته انها سمعت النبى صلى الله عليه وسلم فى حجة الوداع دعا للمحلقين ثلاثا وللمقصرين مرة واحدة.
অর্থঃ- “হযরত ইয়াহ্ইয়া ইবনে হুছাইন রহমতুল্লাহি আলাইহি থেকে বর্ণিত আছে। তিনি তাঁর দাদী থেকে বর্ণনা করেন, নিশ্চয়ই তাঁর দাদী বিদায় হজ্জে হযরত নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে দোয়া করতে শুনেছেন যে, আল্লাহ্ পাক-এর হাবীব, নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ্ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (ওমরাহ্ ও হজ্জের মধ্যে) যারা চুল মুণ্ডন করবে, তাদের জন্যে তিনবার দোয়া করেছেন। আর যারা চুল ছোট করবে, তাদের জন্যে একবার দোয়া করেছেন।”(বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ, আবূ দাউদ শরীফ, ইবনে মাজাহ্ শরীফ,)
সুতরাং উক্ত হাদীছ শরীফ খানা হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শুধুমাত্র ওমরাহকারী ও হাজীদের জন্যই বলেছেন।
হানাফী মাযহাবের গ্রহণযোগ্য কিতাবাদিতেও দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। যেমন, উক্ত “ফতওয়ায়ে হিন্দিয়া” কিতাবের ৯ম খণ্ডের ৯৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
উর্দূ কম্পোজ করতে হবে
অর্থাৎ- “চুল রাখার একমাত্র সুন্নত তরীক্বা এটাই যে, চুল মাথার মধ্যখান থেকে সিঁিথ করে রাখবে।” অর্থাৎ বাবরী রাখবে।
অতএব, উপরোক্ত অকাট্য দলীল আদিল্লাহ্র ভিত্তিতে দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো যে, হজ্বের উপর ক্বিয়াস করে সর্বদাই মাথা মুণ্ডন করাকে সুন্নত বলা মোটেও শুদ্ধ হয়নি। সুতরাং মাথা মুণ্ডন করা সম্পর্কিত হযরত ইমাম ত্বহাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি ও আলমগীরী, শামী, তাতারখানিয়া ও গারায়েব-এর উক্ত মতটি ছহীহ্ নয়। বরং ছহীহ্ ও গ্রহণযোগ্য মত হলো, “শুধু মাত্র বাবরী চুল রাখাই সুন্নত।”যেমন এ প্রসঙ্গে কিতাবে আরো উল্লেখ আছে,
وانما صح عند المترجم الفرق فقط ولم يصح ان الحلق سنة.
অর্থঃ- “আর মুতারজিম রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর নিকট নিশ্চয়ই ছহীহ্ ও গ্রহণযোগ্য মত হলো এই যে, শুধু মাত্র সিঁথি বিশিষ্ট বাবরী চুল রাখাই সুন্নত। (হজ্জ ও ওমরাহ্ ব্যতীত) মাথা মুণ্ডন করা সুন্নত, এ মতটি ছহীহ্ বা গ্রহণযোগ্য নয়”। (ফতওয়ায়ে হিন্দিয়া)
সুতরাং মাথা মুণ্ডন করা সম্পর্কিত হাটহাজারীর জাহিল মৌলভী ছাহেবদের উক্ত বক্তব্য ছহীহ্ নয়।
বরং হানাফী মাযহাবের ছহীহ্ ও গ্রহণযোগ্য মত হলো, “শুধু মাত্র বাবরী চুল রাখাই সুন্নত।”
প্রদত্ত সুওয়াল-জাওয়াবের টীকা ভাষ্যঃ
(ক) বিগত সংখ্যায় বলা হয়েছে, “আল্লাহ্ পাক-এর হাবীব, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাথা মুন্ডন কারীদের জন্য যে, তিনবার রহমত ও মাগফিরাতের দোয়া করেছিলেন তা শুধুমাত্র হাজীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সুতরাং হজ্জ ও ওমরাহ্ ব্যতীত অন্য সময় শুধুমাত্র সিঁথি বিশিষ্ট বাবরী চুল রাখাই সুন্নত।
(খ) বর্তমান সংখ্যায় উক্ত জবাবের মূল কথা হলো, হানাফী মাযহাবের গ্রহণযোগ্য কিতাবাদিতেও শুধুমাত্র মাথা মুন্ডানোকে সুন্নাত বলা হয়নি। বরং হানাফী মাযহাবের গ্রহণযোগ্য কিতাবের ছহীহ্ ও গ্রহণযোগ্য মত হলো, “শুধু মাত্র সিঁথি বিশিষ্ট বাবরী চুল রাখাই সুন্নত।”
(গ) পরবর্তী সংখ্যায় ইনশাআল্লাহ প্রমাণ করা হবে যে, ফতওয়ায়ে আলমগীরী ও শামী, কিতাবে হযরত ইমাম ত্বহাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর মতটিই উল্লেখ করা হয়েছে। আর ইমাম ত্বহাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর মতটি ছহীহ্ নয়। বরং ছহীহ্ ও গ্রহণযোগ্য মত হলো, “শুধু মাত্র বাবরী চুল রাখাই সুন্নত।”(চলবে)
মুহম্মদ মুহিউদ্দীন
সভাপতি- আঞ্জুমানে আল বাইয়্যিনাত
সন্দ্বীপ শাখা, চট্টগ্রাম।
সুওয়ালঃ চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত রেযাখানী মাযহাবের অখ্যাত মাসিক মুখপত্র ডিসেম্বর- জানুয়ারী/২০০৩-০৪ ঈসায়ী সংখ্যায় প্রশ্নোত্তর বিভাগে ‘‘বিতিরের পর দু’রাকায়াত নফল নামায দাঁড়িয়ে পড়াই উত্তম এবং বসে পড়লে অর্ধেক ছওয়াব পাবে বলে উল্লেখ করেছে।’তারা তাদের উক্ত বক্তব্যের স্বপক্ষে বুখারী, মুসলিম, ইবনে মাজাহ্, নাসায়ী থেকে দলীল হিসেবে কয়েকখানা হাদীছ শরীফও উল্লেখ করেছে।
আর হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে প্রকাশিত অখ্যাত মাসিক পত্রিকা ডিসেম্বর/২০০৩ ঈসায়ী সংখ্যায় জিজ্ঞাসা-সমাধান বিভাগে বলা হয়েছে, ‘‘বিতির নামাযের পর দুই রাক্আত নফল নামায… দাঁড়িয়ে পড়া ভাল। কারণ, নফল নামায বিনা কারণে বসে পড়লে অর্ধেক সাওয়াব হয়।”
এখন আমার সুওয়াল হলো- তারা হালকী নফল নামায সম্পর্কে যে বক্তব্য পেশ করেছে তা কতটুকু সঠিক? এবং এ সম্পর্কে যে হাদীছ শরীফগুলো উল্লেখ করেছে তা কতটুকু গ্রহণযোগ্য।
তাদের প্রতিটি দলীলের খণ্ডনসহ হালকী নফল সম্পর্কে বিস্তারিত দলীল-আদিল্লাহ্ পেশ করে আমাদের ঈমান-আমল হিফাযত করবেন বলে আমরা আশাবাদী।
জাওয়াবঃ বিতির নামাযের পর দু’রাকায়াত নফল নামায যাকে “হালকী নফল”বলা হয়, তা দাঁড়িয়ে পড়া সম্পর্কে অখ্যাত মাসিক পত্রিকাদ্বয়ের উক্ত বক্তব্য সঠিক হয়নি। বরং ভুল, মনগড়া, দলীলবিহীন এবং কুরআন-সুন্নাহ্র খিলাফ হয়েছে। এবং ক্ষেত্রবিশেষে কুফরীমূলক হয়েছে।
স্মর্তব্য যে, সাধারণতঃ নফল নামায বসে পড়লে অর্ধেক ছওয়াব হলেও বিতির নামাযের পর দু’রাকায়াত নফল নামায বসে পড়াই মুস্তাহাব-সুন্নত, যা উত্তম ও পূর্ণ ছওয়াব এবং অধিক ফযীলতের কারণ।
কেননা আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন, নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিতির নামাযের পর দু’রাকায়াত নফল নামায কখনও দাঁড়িয়ে আদায় করেননি। বরং বসেই আদায় করেছেন। যা সরাসরি হাদীছ শরীফ দ্বারাই প্রমাণিত।
(ধারাবাহিক)
উল্লেখ্য, রেযাখানীরা ‘বুখারী, মুসলিম, ইবনে মাজাহ ও নাসায়ী শরীফ’ ইত্যাদি কিতাব থেকে দলীল হিসেবে যে বক্তব্য উল্লেখ করেছে, আসলে উক্ত কিতাবসমূহের বক্তব্য মোটেও সে রকম নয়। উল্লিখিত কিতাবসমূহের কোন কোন ইবারত কারচুপি করে নিজেদের বাতিল মতকে ছাবিত করার ব্যর্থ কোশেশ করেছে। তারা উল্লিখিত কিতাবের বরাত দিয়ে যে সকল মিথ্যাচারিতা, প্রতারণা ও কারচুপির আশ্রয় নিয়েছে সেগুলোর সঠিক ব্যাখ্যা ও ফায়সালা তুলে ধরে তার খণ্ডনমূলক আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ্।
উল্লেখ্য, রেযাখানীরা বলেছে, “আহমদ রেজা খান ব্রেলভী রচিত “ফতওয়ায়ে রেজভীয়া”-এর ৩য় খণ্ডে ……অন্যান্য নফল নামাযের ন্যায় বিত্রের পর দু’রাকায়াত নফল নামাযও দাঁড়িয়ে পড়া উত্তম বলে অভিমত ব্যক্ত করেছে।”
এর জবাবে বলতে হয় যে, হাদীছ শরীফ জালিয়াতি করে রেযা খাঁ প্রমাণ করলো, সে থানভীর সমগোত্রীয়।
হাদীছ শরীফ জালিয়াতিসহ অনেক বিষয়েই রেযা খাঁর থানভীর সাথে মিল রয়েছে। যেমন, (ক) থানভী সাহেব রোযা অবস্থায় ইন্জেকশন নেয়া জায়িয় বলেছে, একইভাবে থানভীর সমগোত্রীয় রেযা খাঁও রোযা অবস্থায় ইন্জেকশন নেয়া জায়িয় বলেছে।
(খ) থানভী সাহেব কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করে উজরত গ্রহণ করা নাজায়িয বলেছে, একইভাবে থানভীর সমগোত্রীয় রেযা খাঁও কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করে উজরত গ্রহণ করা নাজায়িয় বলেছে।
(গ) থানভী সাহেব ‘‘বিতির নামাযের পর দু’রাকায়াত নফল নামায দাঁড়িয়ে পড়া উত্তম এবং বসে পড়লে অর্ধেক ছওয়াব পাবে বলে উল্লেখ করেছে।’একইভাবে থানভীর সমগোত্রীয় রেযা খাঁও ‘‘বিতির নামাযের পর দু’রাকায়াত নফল নামায দাঁড়িয়ে পড়া উত্তম এবং বসে পড়লে অর্ধেক ছওয়াব পাবে বলে উল্লেখ করেছে।’
(ঘ) থানভী সাহেব ‘‘বিতির নামাযের পর দু’রাকায়াত নফল নামায বসে পড়া সম্পর্কিত ইবনে মাজাহ্ শরীফের প্রথম হাদীছ শরীফ খানা বাদ দিয়ে হাদীছ শরীফ জালিয়াতি করেছে, একইভাবে থানভীর সমগোত্রীয় রেযা খাঁও ‘বিতির নামাযের পর দু’রাকায়াত নফল নামায বসে পড়া সম্পর্কিত ইবনে মাজাহ্ শরীফের প্রথম হাদীছ শরীফ খানা জালীয়াতী করে নিজেকে থানভীর সমগোত্রীয় বলে প্রমাণ করলো ।
নিম্নে রেযা খাঁর হাদীছ জালিয়াতীর ফিরিস্তি, প্রমাণসহ হুবহু তুলে ধরা হলো, যেমন “রেজভীয়া”কিতাবের ৩য় খণ্ডের ৪৬৮ পৃষ্ঠায় রেযা খাঁ ইবনে মাজাহ্ শরীফের বরাত দিয়ে হযরত
ام سلمة رضى الله تعالى عنها.
(উম্মে সালামা রদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহা) থেকে হাদীছ শরীফ খানা এভাবে লিখিছে যে,
قلابن ماجة عن ام المومنين ام سلمة رضى الله تعالى عنها انه صلى الله تعالى عليه وسلم كان يصلى بعد الوتر ركعتين خفيفتين وهو جالس فاذا اراد ان يركع قام فركع.
রেযা খাঁর লিখিত উক্ত ইবারতে এটাই প্রমাণিত হলো যে, ইবনে মাজাহ্ শরীফের বরাতে হযরত ام سلمة رضى الله تعالى عنها (উম্মে সালামা রদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহা) থেকে বর্ণিত হাদীছ শরীফে وهو جالس. এর পর فاذا اراد ان يركع قام فركع. এই ইবারত গুলোও উল্লেখ আছে।
অথচ “ইবনে মাজাহ্ শরীফের” ৮৫ পৃষ্ঠায় হযরত ام سلمة رضى الله تعالى عنها. (উম্মে সালামা রদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহা) থেকে যে হাদীছ শরীফ খানা বর্ণিত আছে, তাতে
كان يصلى بعد الوتر ركعتين خفيفتين وهو جالس.
পর্যন্তই ইবারত উল্লেখ আছে। এবং وهو جالس পর্যন্তই ইবারত শেষ। আর وهو جالس এর পর উক্ত হাদীছ শরীফে আর কোন ইবারত উল্লেখ নেই। এবং وهى جالسএর পর উক্ত হাদীছ শরীফে আর কোন বক্তব্যও উল্লেখ নেই।
সেহেতু পাঠকের সুবিধার্থে “ইবনে মাজাহ্ শরীফের হুবহু হাদীছ শরীফ খানা আবারো উল্লেখ করা হলো, আর এতেই প্রমাণিত হবে যে, রেযা খাঁ হযরত ام سلمة رضى الله تعالى عنها (উম্মে সালামা রদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহা) এর বরাত দিয়ে فاذا اراد ان يركع قام فركع. এই ইবারত গুলো সংযোজন করে বা জোড়া-তালি দিয়ে হাদীছ জালিয়াতি করেছে।
কেননা, “ইবনে মাজাহ্ শরীফের” ৮৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
عن ام سلمة رضى الله عنها ان النبى صلى الله عليه وسلم كان يصلى بعد الوتر ركعتين خفيفتين وهو جالس.
অর্থঃ- “উম্মুল মু’মিনীন হযরত উম্মু সালামা রদ্বিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত আছে যে, আখেরী রাসুল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিত্র নামাযের পর সংক্ষিপ্তাকারে দু’রাকায়াত নফল নামায বসেই আদায় করতেন।”
উপরোক্ত হাদীছ শরীফের ইবারত থেকে সুস্পষ্টভাবে এটাই প্রমাণিত হলো যে আল্লাহ্ পাক-এর হাবীব, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উক্ত নফল অর্থাৎ বিতির নামাযের পর দু’রাকায়াত নফল নামায বসেই আদায় করেছেন। এবং উক্ত হাদীছ শরীফে جالس. وهو পর্যন্ত ইবারত উল্লেখ আছে।
এবং وهو جالس পর্যন্তই ইবারত শেষ। আর وهو جالس এর পর উক্ত হাদীছ শরীফে আর কোন ইবারত উল্লেখ নেই।
এবং উক্ত হাদীছ শরীফে وهو جالس. এর পর আর কোন বক্তব্যও উল্লেখ নেই।
সুতরাং প্রমাণিত হলো রেযা খাঁ ইবনে মাজাহ্ শরীফের বরাতে হযরত ام سلمة رضى الله تعالى عنها (উম্মে সালামা রদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু) থেকে বর্ণিত হাদীছ শরীফ খানার শেষে وهو جالس এর পর فاذا اراد ان يركع قام فركع এই ইবারতগুলো সংযোজন করে বা জোড়া-তালি দিয়ে, হযরত ام سلمة رضى الله تعالى عنها. (উম্মে সালামা রদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু)-এর নামে চালিয়ে দিয়ে হাদীছ শরীফ জালিয়াতি করেছে।
সুতরাং রেযা খাঁর হাদীছ জালিয়াতির প্রমাণ সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো এবং সেই সাথে এটাও প্রমাণিত হলো যারা হাদীছ শরীফ জালিয়াতি করে তাদের ফতওয়া মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়।
প্রদত্ত সুওয়াল-জাওয়াবের টীকা ভাষ্যঃ
(ক) বিগত সংখ্যায় বলা হয়েছে, “রেযাখানীরা বিতির নামাযের পর দু’রাকায়াত নফল নামায দাঁড়িয়ে পড়া উত্তম বলে “রেজভীয়া”কিতাবের ৩য় খণ্ডের বরাত দিয়ে সাধারণ মানুষকে চরমভাবে ধোকা দিয়েছে। কারণ “রেজভীয়া”কিতাবের ৩য় খণ্ডে উর্দূ কম্পোজ করতে হবে
অর্থাৎ বিতরের পর দু’রাকায়ত নফলের কথা বলা হয়নি।
(খ) বর্তমান সংখ্যায় উক্ত জবাবের মূল কথা হলো, রেযা খাঁ ‘বিতির নামাযের পর দু’রাকায়াত নফল নামায বসে পড়া সম্পর্কিত ইবনে মাজাহ্ শরীফের প্রথম হাদীছ শরীফ খানা জালীয়াতী করে নিজেকে থানভীর সমগোত্রীয় বলে প্রমাণ করলো ।
(গ) পরবর্তী সংখ্যায় রেযা খাঁর হাদীছ জালিয়াতি উদঘাটন করা হবে। (চলবে)
মুহম্মদ জামান হোসেন
মগবাজার, ঢাকা।
সুওয়াল: হজ্বের ফরজ কয়টি ও কি কি?
জাওয়াব: হজ্বের ফরজ হচ্ছে- ৩টি।
(১) ইহরাম বাঁধা অর্থাৎ মীকাত হতে ইহরাম বাঁধা।
(২) ওকুফে আরাফা অর্থাৎ ৯ই জিলহজ্বের দ্বিপ্রহরের পর হতে অর্থাৎ সূর্য ঢলার পর হতে ১০ই জিলহজ্ব সুব্হে ছাদিকের পূর্ব পর্যন্ত যে কোন সময় আরাফার ময়দানে উপস্থিত থাকা।
(৩) তাওয়াফে জিয়ারত অর্থাৎ ১০, ১১ ও ১২ই জিলহজ্ব তারিখের মধ্যে কা’বা শরীফ তাওয়াফ করা।
মুহম্মদ মোস্তফা ত্বাসিন
নাচোল, নবাবগঞ্জ।
সুওয়াল: হজ্বের মধ্যে ওয়াজিব কি কি?
জাওয়াব: হজ্বের মূল ওয়াজিব ৭টি।
(১) ছাফা মারওয়া পাহাড়ের সাঈ করা।
(২) মুযদালিফায় অবস্থান।
(৩) রমী বা কঙ্কর নিক্ষেপ করা।
(৪) মাথা মুন্ডন করা।
(৫) তাওয়াফে বিদা বা বিদায়ী তাওয়াফ করা।
(৬) ৯ই জিলহজ্ব মাগরিব পর্যন্ত আরাফার ময়দানে অবস্থান করা।
(৭) কুরবানী করা।
মৌলভী মুহম্মদ শাহাবুদ্দীন
ষ্টেশন রোড, লালমনিরহাট।
সুওয়াল: হজ্ব আদায়ের ছহীহ্ পদ্ধতি বা নিয়ম কি? সবিস্তারে জানিয়ে বাধিত করবেন।
জাওয়াব: হজ্ব করতে হলে প্রথমে ইহ্রাম বাঁধতে হয়। ইহ্রাম বাঁধা হজ্বের অন্যতম রোকন বা ফরজ। বাংলাদেশ তথা পাক ভারত উপমহাদেশের লোকেরা সাধারণতঃ ইয়েমেন হয়ে হজ্বে গমন করে থাকে। সে হিসেবে তাদের “মীক্বাত”(ইহ্রাম বাঁধার স্থান) হচ্ছে- “ইয়ালামলাম।”
যারা সরাসরি হজ্ব করতে না গিয়ে আগে মদীনা শরীফ গিয়ে সেখানে অবস্থান করার পর হজ্ব আদায় করার ইচ্ছা পোষণ করে, তাদেরকে মদীনা শরীফের অধিবাসীদের মীক্বাত “জুলহুলাইফা” নামক স্থান হতে হজ্বের ইহ্রাম বাঁধতে হবে।
আমাদের হানাফী মাযহাব মোতাবেক তিন প্রকার হজ্বের মধ্যে ‘হজ্বে ক্বিরান’ হচ্ছে সুন্নত ও আফজল।
ইহ্রাম বাঁধতে হলে প্রথমে ওজু বা গোসল করে নিতে হয়, তবে গোসল করাটাই উত্তম। অতঃপর দু’খানা নতুন বা পরিস্কার কাপড় পরিধান করবে। একখানা সেলাইবিহীন ইযার বা লুঙ্গি অপরখানা চাদর। সাথে সুগন্ধি থাকলে মেখে নিবে। অতঃপর দু’রাকায়াত নামায পড়ে নিম্নের দোয়া পাঠ করবে যা হজ্বে কিরানের নিয়ত,
اللهم انى اريد الحج والعمرة فيسر همالى وتقبلهما منى.
অর্থঃ“হে আল্লাহ্ পাক! আমি হজ্ব ও ওমরার নিয়ত করলাম। আমার জন্য উভয়টি সহজ করুন এবং আমার পক্ষ থেকে উভয়টি কবুল করুন।”
আর যদি কেউ হজ্বে তামাত্তুর নিয়ত করে তাহলে তাকে প্রথমে ওমরার নিয়তে ইহরাম বাঁধতে হবে।
ওমরার নিয়তঃ,
اللهم انى اريد العمرة فيسرهالى وتقبلها منى.
অর্থঃ- হে আল্লাহ্ পাক! আমি ওমরা করার নিয়ত করছি। অতঃপর তা আমার জন্য সহজ করে দিন এবং তা আমার তরফ থেকে কবুল করে নিন।
আর যদি কেউ হজ্বে ইফরাদের নিয়ত করে তাহলে তাকে শুধু হজ্বের নিয়ত করতে হবে। হজ্বের নিয়ত,
اللهم انى اريد الحج فيسره لى وتقبله منى.
অর্থঃ- হে আল্লাহ্ পাক! নিশ্চয়ই আমি শুধু হজ্ব করার নিয়ত করছি। সুতরাং আপনি আমার জন্য তা পালন করা সহজ করুন এবং আমার পক্ষ হতে কবুল করুন।
অতঃপর তালবিয়া পাঠ করবে। তালবিয়া হচ্ছে-
لبيك اللهم لبيك لبيك لاشريك لك لبيك ان الحمد والنعمة لك والملك لاشريك لك.
অর্থঃ- “আমি হাজির আছি হে আল্লাহ্ পাক! আমি হাজির আছি। আমি হাজির আছি, আপনার কোন শরীক নেই, আমি হাজির আছি। নিশ্চয়ই সমস্ত প্রশংসা ও সমস্ত নিয়ামত এবং সমস্ত রাজত্ব আপনারই, আপনার কোন শরীক নেই।”এ তালবিয়ার কোন শব্দ বাদ দেয়া যাবেনা। ইচ্ছা করলে বৃদ্ধি করা যেতে পারে। আর তালবিয়া পাঠ করা হলেই ইহ্রাম বাঁধা হয়ে গেল।
ইহ্রাম বেঁধে মক্কা শরীফ প্রবেশ করেই তাওয়াফের দ্বারাই কাজ শুরু করতে হবে। অর্থাৎ ক’াবা শরীফ ৭ বার প্রদক্ষিণ করে তাওয়াফের কাজ সমাধা করতে হবে।
তাওয়াফের নিয়মঃ
তাওয়াফের নিয়তের সহিত ওযু-গোসল করে কা’বা শরীফের হজ্বরে আসওয়াদের ঠিক বরাবর দাঁড়িয়ে হজরে আসওয়াদ চুম্বন করে আর ভীড়ের জন্য চুম্বন করতে না পারলে ইস্তেলাম (হাতে ইশারা করে চুম্বন করা) করে তাওয়াফ শুরু করবে।
(উল্লেখ্য, হজরে আসওয়াদ থেকে সামনে বেড়ে তাওয়াফ শুরু করলে তাওয়াফ শুদ্ধ হবেনা। আর তাওয়াফকালীন শুধুমাত্র হজরে আসওয়াদ চুম্বন করার সময় মুখ কা’বা শরীফের দিকে থাকবে, অন্যসময় মুখ সামনের দিকে থাকবে। আর বাইতুল্লাহ্ শরীফ বাম পার্শ্বে থাকবে। তাওয়াফের সময় মুখ বা পিঠ ক্বাবা শরীফের দিকে থাকলে তাওয়াফ শুদ্ধ হবেনা।)
পর্যায়ক্রমে হজরে আসওয়াদ থেকে শুরু করে মুলতাযিম এরপর বাইতুল্লাহ্ শরীফের দরজা, রুকনে ইরাকী হয়ে হাতিমের বাইর দিয়ে পর্যায়ক্রমে রুকনে শামী, রুকনে ইয়ামেন হয়ে এরপর হজরে আসওয়াদ পর্যন্ত পৌঁছলে এক চক্কর সমাধা হলো। অতঃপর হজরে আসওয়াদ চুম্বন করবে। ভীড়ের কারণে চুম্বন করতে না পারলে ইস্তেলাম করবে। পুণরায় হজরে আসওয়াদ থেকে তাওয়াফের দ্বিতীয় চক্কর শুরু করবে। প্রত্যেক চক্করের সময় খেয়াল রাখতে হবে, তাওয়াফকারী যেন কোন চক্করের সময়ই হজরে আসওয়াদ থেকে সামনে বেড়ে তাওয়াফ শুরু না করে।
তাওয়াফের মধ্যে প্রথম তিন চক্কর রমল (হাত বাঁকা করে বুক পর্যন্ত উঠিয়ে হাত নেড়ে নেড়ে বীরের ন্যায় মধ্য গতিতে দৌড়ানোকে রমল বলে) ও শেষ চার চক্কর মাশী (সাধারণ গতিতে চলাকে মাশী বলে।) করবে।
তাওয়াফ সমাধা করে ছাফা মারওয়াতে সা’ঈ (দৌড়ানো) করবে। এ সমস্ত কাজগুলি ওমরার। অর্থাৎ ওমরাহ্ সমাধা হলো।
যদি কেউ হজ্বে তামাত্তুর নিয়ত করে থাকে তাহলে চুল মুন্ডন করে ইহরাম ছেড়ে দিবে। অতঃপর তামাত্তুকারী ৮ই জিলহজ্ব হেরেম শরীফের সীমানা অন্তর্ভূক্ত কোন এক স্থান থেকে হজ্বের জন্য ইহ্রাম বেঁধে নিবে। এরপর যথারীতি হজের আহকামসমূহ পালন করবে। তামাত্তুকারীও যদি হজের পূর্বে নফল তাওয়াফ করে তার মধ্যে রমল, ইজতেবা আদায় করে এবং এরপর সাঈ করে তাহলে তামাত্তুকারীকেও তাওয়াফে যিয়ারতের মধ্যে রমল, ইজতেবা ও এরপর সাঈ করতে হবেনা। অতঃপর হজ্বের জন্য যথারীতি হজ্বে ইফরাদের মত তাওয়াফে কুদুম করতে হবে।
ক্বিরানকারী তাওয়াফে কুদুম করার সময় রমল ও ইজতেবার সহিত তাওয়াফ করবে। অতঃপর ছাফা ও মারওয়া সাঈ করবে। তাহলে তাওয়াফে যিয়ারতের সময় রমল ও ইজতেবা ও পরে সাঈ করতে হবেনা।
হজ্বে ইফরাদকারী যদি তাওয়াফে কুদুমের মধ্যে রমল, ইজতেবা ও সাঈ করে তাহলে তাওয়াফে যিয়ারতের মধ্যে রমল, ইজতেবা ও এরপর সাঈ করতে হবেনা। তবে ইফরাদ হজ্বে তাওয়াফে যিয়ারতের পর সাঈ করা উত্তম।
তাওয়াফ শুরু করার পূর্বে ইজতেবা করতে হবে। অর্থাৎ ইজতেবা হলো- চাদরকে ডান বগলের নীচে দিয়ে ও বাম কাঁধের উপর দিয়ে পরবে যাতে ডান কাঁধ খোলা থাকে এবং বাম কাঁধ ঢাকা থাকে।
উল্লেখ্য, প্রতিবার তাওয়াফ করার সময় হাতীমের বাইর দিয়ে তাওয়াফ করতে হবে। হাতীম হলো- ক’াবা শরীফের উত্তর পার্শ্বে দু’দিক খোলা কমর পর্যন্ত উঁচু দেয়াল দ্বারা ঘেরা স্থান। তাওয়াফ করার সময় প্রথম তিন চক্কর রমল করবে ও শেষ চার চক্কর মাশী করবে। তাওয়াফ করাকালীন প্রত্যেকবারই হজরে আসওয়াদের নিকট আসলে উহাকে চুম্বন করবে অথবা হাতে ইস্তেলাম করবে। ইস্তেলাম হলো- হাতে ইশারা করে চুম্বন করা। শেষবার চুম্বন বা ইস্তেলাম করে তাওয়াফ সমাধা করবে।
অতঃপর মাক্বামে ইব্রাহীমে এসে দু’রাকায়াত নামায আদায় করবে। যদি ভীড় বা অন্য কোন কারণে সেখানে নামায পড়া সম্ভব না হয় তাহলে মাকামে ইব্রাহীমের পিছনে মসজিদে হারামের যেখানে সম্ভব হয় সেখানেই দু’রাকায়াত নামায আদায় করবে। এই তাওয়াফকে তাওয়াফে কুদুম বলে। ইহা আদায় করা সুন্নত। ইহা মক্কাবাসীদের জন্য আদায় করতে হয়না।
অতঃপর মসজিদে হারামের বাবুস্সাফা নামক দরজা দিয়ে বের হয়ে সাফা পাহাড়ে গিয়ে আরোহণ করবে। সেখানে ক’াবা শরীফের দিকে মুখ করে তাছবীহ্-তাহ্লীল বলে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি দরুদ শরীফ পাঠ করে নিজের আরজু মোতাবেক দুয়া করবে। অতঃপর সেখান থেকে অবতরণ করে সাধারণ গতিতে মারওয়া পাহাড়ের দিকে চলবে।
তবে বত্নে ওয়াদীতে পৌঁছে মাইলাইনে আখজারাইনে (সবুজ রংয়ের মাইল দ্বারা চিহ্নিত স্থান) দৌঁড়াবে। অতঃপর সাধারণ গতিতে মারওয়া পাহাড়ে আরোহণ করবে। ছাফা পাহাড়ের অনুরূপ মারওয়া পাহাড়েও তাকবীর, তাহলীল, দরুদ শরীফ পাঠ ও দুয়া করবে। এতে একবার হলো। অনুরূপ সাতবার ছাফা মারওয়াতে দৌড়াবে। অর্থাৎ ছাফা হতে শুরু করবে মারওয়াতে শেষ করবে। অতঃপর ইহ্রাম অবস্থায় মক্কা শরীফে অবস্থান করবে এবং যত ইচ্ছা তাওয়াফ করবে।
উল্লেখ্য, হজ্ব উপলক্ষ্যে তিনটি খুৎবা দেয়া হয়। (১) জিলহজ্ব মাসের ৭ তারিখে যুহরের পর মসজিদে হারামে এক খুৎবা দিতে হয়। খুৎবার মধ্যে বসতে হয়না। (২) আরাফার ময়দানে জিলহজ্ব মাসের ৯ তারিখে দুই খুৎবার মধ্যে বসতে হবে। ইহ যুহরের নামাযের পূর্বে দিতে হয়। (৩) জিলহজ্বের ১১ই তারিখে মীনাতে যুহরের পরে এক খুৎবা দিতে হয়, মধ্যে বসতে হয়না।
হজ্ব আদায়কারী ৮ই জিলহজ্ব ফজর নামাজ মক্কা শরীফে পড়ে মিনার দিকে রওয়ানা হবে। মিনাতে যুহর, আছর, মাগরীব, ইশা ও ফজর আদায় করবে। অতঃপর সেখান থেকে আরাফার ময়দানে যাবে অর্থাৎ ৯ই জিলহজ্ব আরাফার ময়দানে সারাদিন অবস্থান করবে। আরাফার ময়দানে ইমাম সাহেব খুৎবার মাধ্যমে আরাফার কার্যসমূহ শুরু করবে। খুৎবান্তে যুহরের ওয়াক্তে ইমাম সাহেব এক আযান ও দু’ইকামতে যুহর ও আছরের নামাজ পড়াবেন।
যে ব্যক্তি নিজ স্থানে একা একা নামায আদায় করবে সে যুহরের ওয়াক্তে যুহরের নামায, আছরের ওয়াক্তে আছরের নামায আদায় করবে। ইহাই ইমাম আ’যম আবু হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর ফতওয়া।
নামাযের পরে আরাফার ময়দানে ওকুফ বা অবস্থান করবে যতটুকু সম্ভব জাবালে রহ্মতের নিকটে। আরাফার ময়দানে বত্নে আ’রানা ব্যতীত সমস্তটুকুই অবস্থানস্থল।
ওকুফ অবস্থায় ইমাম সাহেব বাহনের উপর থেকে হাত তুলে দোয়া করবে। আর অন্যান্যরাও যত বেশী সম্ভব দোয়া ইস্তিগফারে মশগুল থাকবে।
৯ই জিলহজ্ব সূর্যাস্তের পর ইমাম সাহেব সকলকে নিয়ে সাধারণ গতিতে মুযদালিফায় রওয়ানা হবে। সেখানে কুজা নামক পাহাড় যার উপর মিকাদা রয়েছে তার নিকট অবতরণ করবে। সেখানে ইমাম সাহেব ইশার ওয়াক্তে একই আযান ও একই ইকামতে সকলকে নিয়ে মাগরীব ও ইশার নামায আদায় করবে। এর মধ্যে সুন্নত ও নফল পড়বেনা। পথে যদি কেউ মাগরীব পড়ে তবে সেটা আদায় হবেনা।
বত্নে মুহাস্সার ব্যতীত সকল স্থানই মুযদালিফায় অবস্থানস্থল।
ছুব্হে ছাদিক হওয়া মাত্রই ইমাম সাহেব সকলকে নিয়ে অন্ধকার থাকতেই ফজর নামায আদায় করে সকলকে নিয়ে দাঁড়িয়ে দোয়া করবে। আর সূর্যদ্বয়ের পূর্বে ইমাম সাহেব তার সাথে সকলকে নিয়ে মিনায় রওয়ানা হবে।
মুযদালিফা হতে মিনায় যাওয়ার পূর্বে বা পথে ৪৯টি বা ৭টি বা ৭০টি কঙ্কর নিয়ে তালবিয়া পাঠ করতে করতে মিনার দিকে রওয়ানা দিবে।
১০ই জিলহজ্ব সকালে শুধুমাত্র মিনাস্থ জমরাতুল আকাবাতে ৭টি কঙ্কর নিক্ষেপ করতে হবে। কঙ্কর নিক্ষেপ করতে প্রত্যেকবার তাকবির বলবে এবং কঙ্কর নিক্ষেপ করার পর সেখানে একটুও দাঁড়াবেনা। আর প্রথম কঙ্কর নিক্ষেপ করার সাথে তালবিয়া পাঠ বন্ধ করে দিবে।
অতঃপর কুরবানী করতে হবে। যারা শুধু হজ্বে ইফরাদ করবে তাদের জন্য এ কোরবানী করা মুস্তাহাব। আর যারা হজ্বে তামাত্তু ও হজ্বে ক্বিরান করবে তাদের জন্য এ কুরবানী করা ওয়াজিব। যা কুরবানী করতে হবে তা হচ্ছে- এক বকরী অথবা এক দুম্বা অথবা গরু, মহিষ বা উটের এক সপ্তমাংশ।
যদি তামাত্তু ও ক্বিরানকারী আর্থিক অনটনের কারণে ওয়াজিব কুরবানী করতে না পারে তাহলে তাদের জন্য ১০ই জিলহজ্বের পূর্বে ৩টি এবং ১৩ই জিলহজ্বের পরে ৭টি রোযা রাখা ওয়াজিব হবে।
যদি ১০ই জিলহজ্বের পূর্বে ৩টি রোযা রাখতে না পারে তাহলে কোরবানী অবশ্যই করতে হবে। কুরবানী করার পর পুরুষেরা মাথা মুন্ডন করে অথবা চুল ছেটে ইহ্রাম খুলে ফেলবে। মহিলারা চুল মুন্ডন না করে এক অঙ্গুলি বা এক ইঞ্চি পরিমাণ চুল ছাটবে।
এ অবস্থায় মুহরিমের জন্য নির্জন অবস্থান ছাড়া সবই হালাল হয়ে গেল। একই দিনে অর্থাৎ ১০ই জিলহজ্বে তাওয়াফে যিয়ারত করা উত্তম যা হজ্বের শেষ ফরয। তাওয়াফে জিয়ারত ১২ই জিলহজ্ব সূর্যাস্তের পূর্বে আদায় করতে হবে। অন্যথায় দম দেয়া ওয়াজিব হবে।
১০, ১১ এবং ১২ই জিলহজ্ব তারিখে মিনায় অবস্থান করা সুন্নত। ১১ এবং ১২ই জিলহজ্ব তারিখে মিনার জমরাতুল আকাবা, জমরাতুল উস্তা ও জমরাতুল উলাতে পর্যায়ক্রমে ৭টি করে কঙ্কর নিক্ষেপ করতে হবে।
১০ তারিখে সূর্য ঢলার পূর্বে ১১ ও ১২ তারিখে সূর্য ঢলার পরে কঙ্কর নিক্ষেপ করতে হবে।
১২ই জিলহজ্ব সূর্যাস্তের পূর্বেই মিনা হতে মক্কা শরীফে চলে আসা যায়। যদি আসতে রাত্র হয়ে যায় তাহলে আসাটা মাকরূহের সহিত জায়িয রয়েছে।
আর যদি ১৩ তারিখ সকাল হয়ে যায় তাহলে তিন স্থানে ৭টি করে ২১টি কঙ্কর নিক্ষেপ করে আসতে হবে। এটাই সুন্নাত। কঙ্কর নিক্ষেপের সময় হল সূর্য ঢলার পর হতে সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত।
মিনাতে কঙ্কর নিক্ষেপের জন্য থেকে মাল-ছামানা বা আসবাবপত্র মক্কা শরীফে পাঠিয়ে দেয়া মাকরূহ্। মিনাতে কঙ্কর নিক্ষেপ করা শেষ করে মক্কা শরীফে আসার পথে মুহাস্সার নামক স্থানে কিছুক্ষণ অবস্থান করা সুন্নত। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেখানে যুহর, আছর, মাগরীব ও ইশার নামায আদায় করেছেন। অতঃপর মক্কা শরীফে এসে তাওয়াফে বিদা বা তাওয়াফে সুদুর করবে। মক্কাবাসী ব্যতীত অন্যান্য সকলের জন্য এ তাওয়াফে বিদা ও তাওয়াফে সুদুর ওয়াজিব। যাদের উপর তাওয়াফে বিদা বা তাওয়াফে ছুদুর ওয়াজিব তারা এ তাওয়াফ না করলে তাদের জন্য দম দেয়া ওয়াজিব।
যে সমস্ত মহিলারা অসুস্থ হয়ে যায় অর্থাৎ যাদের স্বাভাবিক মাজুরতা দেখা দেয় তাদের জন্য তাওয়াফে সুদুর ওয়াজিব থাকেনা। এ তাওয়াফ ব্যতীতই তারা বাড়ীতে প্রত্যাবর্তন করবে।
মুছাম্মত ফারজানা আক্তার (লুকি)
উলিপুর, কুড়িগ্রাম।
সুওয়ালঃ ইহ্রাম অবস্থায় নাকি মেয়েদের চেহারা বা মুখমন্ডলে কাপড় লাগানো যায়না। কাপড় লাগলে বা স্পর্শ করলে দম ওয়াজিব হয়। তাহলে কি মেয়েরা চেহারা না ঢেকে খুলে রাখবে? অর্থাৎ ইহ্রাম অবস্থায় কি মেয়েদের জন্য পর্দা করার দরকার নেই।
জাওয়াবঃ ‘ইহ্রাম অবস্থায় মেয়েদের চেহারা বা মুখমন্ডলে কাপড় স্পর্শ করা বা লাগানো যাবেনা, এ কথা সত্য।’ তবে এক্ষেত্রে মাসয়ালা হলো, যদি একদিন বা এক রাত্রি মুখমন্ডলে কাপড় স্পর্শ করে তাহলে তাদের উপর দম অর্থাৎ একটি কুরবানী ওয়াজিব হবে। আর যদি এক দিন বা এক রাত্রির কম সময় কাপড় স্পর্শ করে তাহলে এক ফিৎরা পরিমাণ ছদকা করা ওয়াজিব হবে।
এর অর্থ এটা নয় যে মেয়েরা ইহ্রাম অবস্থায় মুখমন্ডল খোলা রেখে বে-পর্দা হবে। মেয়েদের সর্বাবস্থায় বেগানা পুরুষদের সামনে মুখমন্ডল খোলা রাখা হারাম যা কবীরা গুণাহ্রে অন্তর্ভূক্ত।
অতএব, ইহ্রাম অবস্থায় মেয়েদের করণীয় হচ্ছে তারা মুখমন্ডলের উপর এমনভাবে কাপড় ঝুলিয়ে রাখবে যাতে কাপড় মুখমন্ডলে স্পর্শ না করে। অর্থাৎ নেকাব মুখমন্ডল থেকে কিছুটা দূরে নেট (জালি) জাতীয় কোন কিছুর সাহায্যে ঝুলিয়ে রাখবে।
স্মরণ রাখতে হবে যে, কোন অবস্থাতেই পর্দার খিলাফ করা যাবেনা। কারণ মেয়েদের জন্য পর্দা রক্ষা করা করা হচ্ছে স্বতন্ত্র একটি ফরয। যা ফরযে আইন; এবং তা দায়েমী ফরযের অন্তর্ভূক্ত। যেমনিভাবে পুরুষের জন্য স্বতন্ত্র ও দায়েমী ফরয হচ্ছে হালাল কামাই করা।
এ প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,
عن عبد الله قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم طلب كسب الحلال فريضة بعد الفريضة.
অর্থঃ- “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহ পাক-এর রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, পুরুষের জন্য অন্যান্য ফরযের পর ফরয হচ্ছে হালাল কামাই করা।” (বাইহাক্বী, মিশকাত)
وللنساء الحجاب.
“আর মেয়েদের জন্য ফরয হচ্ছে পর্দা করা।”
অর্থাৎ কলেমা, নামায, রোযা, হজ্ব ও যাকাতের পর পুরুষের জন্য ফরয হলো হালাল কামাই করা আর মেয়েদের জন্য ফরয পর্দা করা। নামায, রোযা, হজ্ব ও যাকাতের ন্যায় এ দু’টি ফরয পালনের ক্ষেত্রেও কুরআন-সুন্নাহ্র কঠোর নির্দেশ আরোপিত হয়েছে।
যেমন, হালাল রুজীর ব্যাপারে হাদীছ শরীফে বর্ণিত হয়েছে, এক দিরহাম বা এক পয়সা-টাকা হারাম খেলে চল্লিশ দিন ইবাদত কবুল হয়না এবং আরো বর্ণিত হয়েছে,
عن جابر قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم لا يدخل الجنة لحم نبت من السحت وكل لحم نبت من السحت كانت النار اولى به.
অর্থঃ- “হযরত জাবির রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহ পাক-এর রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ঐ গোশ্তের টুকরা জান্নাতে প্রবেশ করবে না যা হারাম খাদ্যের দ্বারা তৈরি হয়েছে। শরীরের যে গোশতের টুকরা হারাম খাদ্যের দ্বারা তৈরী হয়েছে তার জন্য জাহান্নামের আগুনই যথেষ্ট। অর্থাৎ যে ব্যক্তি হারাম রুজী ভক্ষণ করে সে জাহান্নামী।” (আহমদ, দারিমী, বাইহাক্বী, মিশকাত)
আর পর্দার ব্যাপারে হাদীছ শরীফে বর্নিত হয়েছে,
عن الحسن مرسلا قال بلغنى ان رسول الله صلى الله عليه وسلم قال لعن الله الناظر والمنظور اليه.
অর্থঃ- “হযরত হাসান বছরী রহমতুল্লাহি আলাইহি মুরসাল সূত্রে বর্ণনা করেন, আমার নিকট এই হাদীছ শরীফ পৌছেছে, যে দেখে এবং দেখায় তার প্রতি আল্লাহ পাক-এর লা’নত।”(বাইহাক্বী, মিশকাত)
আরো বর্ণিত হয়েছে যে,
عن بريدة قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم لعلى يا على لاتتبع النظرة النظرة فان لك الاولى وليست لك الاخرة.
অর্থঃ- “হযরত বুরাইদা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহ পাক-এর রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে উদ্দেশ্য করে বলেন, হে আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, দৃষ্টিকে অনুসরণ করোনা। প্রথম দৃষ্টি যা অনিচ্ছা সত্ত্বে পতিত হয় তা ক্ষমা করা হবে; কিন্তু পরবর্তী দৃষ্টি ক্ষমা করা হবে না।” অর্থাৎ প্রতি দৃষ্টিতে একটি কবীরা গুণাহ্ লেখা হয়ে থাকে। (আহমদ, তিরমিযী, আবু দাউদ, দারিমী, মিশকাত)
পর্দা সম্পর্কে কুরআন শরীফের নির্দেশ
আল্লাহ্ পাক ইরশাদ করেন,
وقرن فى بيوتكن ولاتبرجن تبرج الجاهلية الاولى.
অর্থঃ- “হে মহিলাগণ! তোমরা তোমাদের ঘরে আবদ্ধ থাক এবং জাহিলিয়াতের যুগে যেভাবে মেয়েরা সৌন্দর্য্য প্রদর্শণ করে বেড়াত সেভাবে তোমরা সৌন্দর্য্য প্রদর্শণ করে বের হয়োনা।” (সূরা আহযাব-৩৩)
আল্লাহ্ পাক অন্যত্র ইরশাদ করেন,
وقل للمؤمنات يغضضن من ابصارهن.
অর্থঃ- “হে হাবীব (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! ঈমানদার মেয়েদেরকে বলুন, তারা তাদের দৃষ্টিকে অবনত রাখবে।”(সূরা নূর-৩১)
উপরোক্ত আয়াত শরীফের ব্যাখ্যায় সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হাবীবুল্লাহ্ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
عن ابن مسعود قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم المرأة عورة فاذا خرجت استشرفها الشيطن.
অর্থঃ- “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহ পাক-এর রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, মেয়েরা পর্দার অধীন থাকবে। কেননা তারা যখন কোথাও বের হয় তখন শয়তান উঁকি-ঝুঁকি দিতে থাকে পাপ কাজ সংঘটিত করানোর জন্য।”(তিরমিযী, মিশকাত)
মূলতঃ একজন মেয়ে যখন উপযুক্ত তথা বালেগা হয় তখন হতে তার উপর ব্যক্তিগতভাবে পর্দা করা ফরয। এ ফরয পালনে যাতে কোন প্রকার গাফলতী কিংবা ত্রুটি না হয় এজন্য মেয়ের অভিভাবকগণকেও শরীয়ত কঠোর নির্দেশবাণী আরোপ করেছে। হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,
الديوث لايدخل الجنة.
অর্থঃ- “দাইয়্যূস’বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবেনা। ‘দাইয়্যূস’ ঐ ব্যক্তি যে তার অধীনস্থ মেয়েদের পর্দা করায়না।”(দাইলামী, কানযুল উম্মাল)
قال عبد الله رضى الله عنه قال رسول الله صلى الله عليه وسلم ثلاث لا يدخلون الجنة ولا ينظر الله اليهم يوم القيامة العاق لوالديه والمرأة المترجلة المتشبهة بالرجال والديوث.
অর্থঃ- “হযরত আব্দুল্লাহ রদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, হযরত রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তিন প্রকার ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না এবং আল্লাহ পাক তাদের দিকে ক্বিয়ামতের দিন (রহমতের) দৃষ্টি দিবেন না। (১) পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান, (২) পুরুষের ছূরত ধারণকারি মহিলা, (৩) দাইয়্যূছ।”(মুসনাদে আহমদ বিন হাম্বল ২য় জিঃ ১৩৪ পৃষ্ঠা, নাসায়ী শরীফ কিতাবুয্ যাকাত বাব নং ৬৯)
উল্লেখ্য, মেয়েদের জন্য পর্দা এমন গুরুত্বপূর্ণ ফরয যে, তা কেবল জীবিতাবস্থায়ই করতে হবে তা নয় বরং তাদের ইন্তিকালের পরও পর্দা করা ফরয। অর্থাৎ মৃত্যুর পরও যেন কোন বেগানা পুরুষ না দেখে।
স্মরণযোগ্য যে, অন্যান্য ফরযের মত পর্দাও একটি ফরয এবং তার হুকুম-আহ্কামও আলাদাভাবে বর্ণিত রয়েছে। কাজেই শরীয়ত এ বিধান আরোপ করেনি যে, একটি ফরয পালন করার জন্য অন্য একটি ফরয পরিত্যাগ করতে হবে।
বরং শরীয়তের নির্দেশ হচ্ছে এটাই যে, প্রতিটি ফরয-ওয়াজিব যথাযথভাবে আদায় করা। একটার জন্য আরেকটা ছেড়ে দেয়া জায়েয নেই।
অতএব, পর্দা শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত একটি ফরয। কোন মেয়ে ইহ্রাম অবস্থায় হোক আর ইহ্রাম ব্যতীত অন্য অবস্থায়ই হোক পর্দা তরক্ব করা হারাম ও কবীরাহ্ গুণাহ্।
যে মেয়ে ইহ্রাম অবস্থায় মুখমন্ডল খোলা রাখবে সে ফরয তরক্ব করার কারণে ফাসিক হিসেবে সাব্যস্ত হবে। অথচ আল্লাহ্ পাক কুরআন শরীফে অশ্লীল-অশালীন ও ফিস্ক ফজুরী ইত্যাদি কাজ করতে নিষেধ করেছেন। আর যারা ইত্যাদি নিষেধ কাজ করে তাদের প্রকৃতপক্ষে হজ্বে মাবরুর নছীব হবে না।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ পাক ইরশাদ করেন,
فمن فرض فيهن الحج فلا رفث ولا فسوق ولاجدال فى الحج وما تفعلوا من خير يعلمه الله وتزودوا فان خير الزاد التقوى والتقون ياولى الالباب.
অর্থঃ- “যে ব্যক্তি হজ্বে মাসসমূহে হজ্ব করার নিয়ত করে সে যেন হজ্বের মধ্যে নির্জন অবস্থান ও তার সংশ্লিষ্ট কোন কাজ না করে এবং কোন প্রকার ফিস্ক-ফুজুরী কাজ এবং ঝগড়া-ঝাটি না করে। আর তোমরা যে উত্তম কাজ করো আল্লাহ্ পাক তা জানেন এবং তোমরা পাথেয় সংগ্রহ করো। নিশ্চয়ই উত্তম পাথেয় হচ্ছে তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতি। আর একমাত্র আমাকেই ভয় করো হে জ্ঞানীগণ।”(সূরা বাক্বারা-১৯৭)
উল্লেখ্য, ‘হজ্বে মাবরুর’অর্থ কবুল হজ্ব। এর ব্যাখায় বলা হয়েছে,
هو ما لايخالطه الاثم ولاسمعة ولارياء.
অর্থঃ- “যে হজ্বের মধ্যে কোন প্রকার পাপের সংমিশ্রণ ঘটবেনা, (বেপর্দা, বেহায়া-বেশরা কাজ করবেনা। অর্থাৎ কুফরী, শিরকী, বিদ্য়াতী হারাম, ফাসিকী, ফুজুরী, অশ্লীল-অশালীন কথা-বার্তা, আচার-আচরণ, ঝগড়া-ঝাটি, মারামারি, কাটাকাটি হেরেম শরীফে নিষিদ্ধ কার্যসমূহ করবেনা। এক কথায় ফরয-ওয়াজিব সুন্নতে মুয়াক্কাদা তরক্ব করবেনা।) লোককে শোনানোর উদ্দেশ্যে থাকবেনা এবং রিয়া বা লোক প্রদর্শণের জন্য করা হবেনা।”
এ সমস্ত প্রকার দোষত্রুটি হতে মুক্ত হজ্বকেই হজ্বে মাবরুর বলা হয়। আর বে-পর্দা হওয়া সাধারন বা ছগীরা গুণাহ্ নয়। বরং প্রকাশ্য হারাম ও কবীরা গুণাহ্র অন্তর্ভূক্ত। আর হারাম ও কবীরা গুণাহ্ করে হজ্ব সম্পাদন করা হলে তা কস্মিন কালেও হজ্বে মাবরুর হবেনা।
অতএব, এ ব্যাপারে সকল পুরুষ ও মেয়েদের সাবধান ও সর্তক থাকতে হবে।
{দলীলসমূহ ঃ (১) আহকামুল কুরআন জাস্সাস, (২) কুরতুবী, (৩) রুহুল মায়ানী, (৪) রুহুল বয়ান, (৫) খাযেন, (৬) বাগবী, (৭) তাবারী, (৮) কবীর, (৯) মাযহারী, (১০) দুররে মনছুর, (১১) বুখারী, (১২) মুসলিম, (১৩) আবূ দাউদ, (১৪) কানযুল উম্মাল, (১৫) মিশকাত, (১৬) মিরকাত, (১৭) আশয়াতুল লুময়াত, (১৮) লুময়াত, (১৯) ত্বীবী, (২০) তা’লিকুছ ছবীহ, (২১) মুযাহিরে হক্ব, (২২) আলমগীরী, (২৩) শামী, (২৪) দুররুল মুখতার, (২৫) রদ্দুল মুহতার, (২৬) আইনুল হিদায়া, (২৭) ফতহুল ক্বাদীর, (২৮) শরহে বিক্বায়া, (২৯) ফাযায়েলে হজ্ব, (৩০) আহ্কামে হজ্ব ও যিয়ারত, (৩১) হজ্ব ও যিয়ারত, (৩২) আহকামে হজ্ব, (৩৩) মক্কা ও মদীনার পথে ইত্যাদি।