‘বনফুল’ অভিজাত মিষ্টি হিসেবে সুপরিচিত ছিলো। মালিকের ছিলো সুনাম। ‘ইগলু’ আইসক্রীম দামী আইসক্রীম হিসেবে খ্যাত ছিলো। দেশীয় গলতীর বাইরে ম্যানেজমেন্টও ছিলো বিদেশী। ‘হোটেল সুন্দরবন’-এর ছিল অনেক নাম-ডাক। দেশীয় ‘থ্রি স্টার’ হোটেলে পরিচ্ছন্ন হোটেল খাবার খেত বলে সবাই আত্মতৃপ্তিতে আপ্লুত থাকতো। চাইনিজ রেস্তোরাঁগুলোতে শিক্ষিত, মার্জিত, স্মার্ট ওয়েটারদের পরিবেশিত খাবারে বিশ্বস্ত থাকতো সুধীজন। কিন্তু বাধ সেধেছে পত্রিকাওয়ালারা। এক বে-রসিক সাংবাদিক ‘বনফুল’ মিষ্টিঘরে মালিকের এযাবত কালের সুনাম ক্ষুণœ করেছেন। ‘ইগলু’ আইসক্রীমের অসততা উন্মোচিত করেছেন। হোটেল সুন্দরবন আর চাইনিজ হোটেলে রান্নাঘরে মলমূত্রের পাশে কিভাবে রান্না হয় সে চিত্র তুলে ধরে তাদের মালিককে দেশবাসীর সামনে চরম হেয় প্রতিপন্ন করেছেন ঐ সাংবাদিক। কিন্তু এক শ্রেণীর মৌলভীদের ভাষায় তিনি চরম-পরম গীবত করেছেন। গীবত করেছেন এম.পি, গোলান্দাজের স্ত্রী-পুত্ররা। তারা স্ত্রী-পুত্র হওয়া সত্ত্বেও তার জঘন্য চরিত্র ও চরম নির্যাতনের কথা তুলে ধরেছেন। দেশীয় স্বার্থ বিক্রিকারী টেংরাটিলার গ্যাসফিল্ড ধ্বংসকারী, নাইকোর গাড়ী ঘুষ গ্রহণকারী প্রতিমন্ত্রী মোশাররফ হোসেনের কাহিনী তুলে দিয়েও সাংবাদিকরা আরেক দফা গীবত করেছেন। এদিকে তথাকথিত ক্বারী হাবীবুল্লাহ বেলালীর স্ত্রী নির্যাতিত হয়ে কোর্টের কাছে তার স্বামীর নামায না পড়া, ভিসিআরে অশ্লীল ছবি দেখার মত বিবিধ কুকর্মের কাহিনী বর্ণনা করে গীবত করেছেন। এরশাদ বিদিশাকে তালাক দিয়েছেন। কিন্তু এই তালাক ঠিক হয়েছে কিনা তা জানার জন্য বিদিশা যে তার পূর্বের স্বামীকে তালাক না দিয়েই এরশাদকে বিয়ে করেছেন সে তথ্য কাজী বা মুফতী ছাহেবের কাছে পেশ করায় গীবত হয়েছে। দেশে দিন দিন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির পরও চালের দাম বাড়ার পরও, বাণিজ্যমন্ত্রী তথা প্রধানমন্ত্রীর ‘জিনিসপত্রের দাম তেমন কিছু বাড়েনি’- এ বক্তব্যের সমালোচনা করায় তাদের গীবত হয়েছে। জিনাত, মেরী, রওশন, বিদিশা, বিমান বালা, স্কুল ছাত্রী ইত্যাদি অসংখ্য মহিলার সাথে লাম্পট্যের অসংখ্য প্রমাণের প্রেক্ষিতে রমণীমোহন টাইটেল যুক্ত করার প্রেক্ষিতে এরশাদের গীবত করা হয়েছে। প্রখ্যাত মুসলিম লীগার, লেখক, গবেষক, বক্তা জীবনের শেষ পর্যায়ে অন্ধ হয়ে যাওয়ায় সর্বমহলে ‘কানা হাশিম’ বলে খ্যাত হয়েছিলেন। সুতরাং তাতে অসংখ্য লোক গীবত করেছেন। অসংখ্য মেয়ের আত্মহত্যার খবরে শঙ্কিত হয়ে রহিম উদ্দীন তাঁর প্রস্তাবিত মেয়ে জামাই-এর খোঁজ খবর নিতে যান। প্রতিবেশীরা জানালেন, ছেলের খারাপ রোগসহ মাদক গ্রহণের অভ্যাস রয়েছে। এটা জেনে তিনি সে বিয়ে ভেঙ্গে দেন। এটা জানিয়ে পাড়া প্রতিবেশীরা গীবত করেছেন। তথাকথিত শাইখুল হাদীছ গং নিজেরাই বলেছেন, ছবি তোলা নাজায়িয। নারী নেতৃত্ব হারাম। আর আজকে তারা নিজেরাই তা জায়িয করেছেন। সুতরাং তারা যে নাজায়িয কাজকে জায়িয করেছেন এটাও যেন গীবত হয়েছে। কুরআন শরীফে ইরশাদ হয়েছে, “তোমরা একজন আরেকজনের গীবত করো না। তোমরা কি তোমাদের মৃত ভাইয়ের গোশ্ত খাওয়া পছন্দ করো।” হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে, “গীবত ব্যভিচার থেকেও খারাপ। মিথ্যা বলা তোহমত সেটা আরো শক্ত গুনাহ্ গীবত থেকে।” এতদ্বপ্রেক্ষিতে একটি মহল বলে থাকে যে, কারো দোষত্রুটি বর্ণনা করা পাপ। কিন্তু দোষত্রুটি বর্ণনা না করলে যে কিভাবে মারাত্মক বিষও খাদ্য হিসেবে খেতে হবে বা কিভাবে খারাপ ছেলের কাছে মেয়ের বিয়ে দিয়ে জীবন নষ্ট হবে, হালাল হারামের মাসয়ালা কিভাবে জানা যাবে না, রাজা-বাদাশাহ্রা কতদূর স্বেচ্ছাচারী ও জালিম হয়ে উঠবে কিংবা কোন্ নামে মাশহুর লোককে মানুষ চিনতে ভুল করবে সর্বোপরি উলামায়ে ছূদের দ্বারা প্রতারিত হয়ে পরকালে নষ্ট করবে উপরের লেখায় তার ভিন্ন ভিন্ন উদাহরণ দেয়া হয়েছে। গীবত কাকে বলে? এবং কোনটা করলে গীবত হয়? কোনটা করলে গীবত হয় না? এর ব্যাখ্যায় উল্লিখিত আয়াত শরীফের তাফসীরে হযরত ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর “কিমিয়ায়ে সায়াদাত, ইহইয়াউ উলুমিদ্দীন” ইত্যাদি কিতাবে উল্লেখ করেছেন, “কয়েক প্রকার লোক রয়েছে যাদের দোষক্রটি বর্ণনা করলে গীবত হয়না। এছাড়া অন্যান্য লোকের দোষক্রটি বর্ণনা করলে গীবত হবে।” কারণ তা না হলে সে জুলূমের প্রতিকারই পাবেনা। এক নম্বরে বলা হয়েছে, “কোন লোক যদি কাজী ছাহেবের কাছে বিচার প্রার্থী হয় আর বিচারের জন্য সত্য কথা বলতে গিয়ে যদি বিপরীত পক্ষের দোষত্রুটি বর্ণনা করে, তাহলে সেটা গীবত হবে না।” কারণ সত্য কথা না বললে বিচার শুদ্ধ হবে না। দুই নম্বরে বলা হয়েছে, “কোন ব্যক্তি যদি কোন মুফতী ছাহেবের কাছে যায় ফতওয়ার জন্য, তখন সে ফতওয়ার জন্য যদি বিপরীত পক্ষের দোষ-ত্রুটি বলে, তাহলে সেটা গীবত হবে না।” কারণ সত্য কথা না বললে ফতওয়া শুদ্ধ হবে না। তিন নম্বরে বলা হয়েছে, “যদি রাজা-বাদশাহ, আমীর-ওমরাহ্দের ইছলাহ্ বা সংশোধন করার জন্য তাদের দোষত্রুটিগুলো বর্ণনা করা হয় বা ধরিয়ে দেয়া হয়, তাহলে সেটা গীবত হবে না।” চার নম্বরে বলা হয়েছে, “যারা ফাসিক। ফাসিক কাদেরকে বলা হয়? যে ব্যক্তি ফরয, ওয়াজিব, সুন্নতে মুয়াক্কাদা তরক করে তাকে ফাসিক বলা হয়। ফাসিকদের দোষত্রুটি বর্ণনা করলে, সেটা গীবত হয় না।” পাঁচ নম্বরে বলা হয়ে থাকে, “যখন কোন লোক মশহুর হয় লুলা-ল্যাংড়া, বোবা-তোতলা, কানা-অন্ধ ইত্যাদি নামে। তখন তাকে যদি সেই মশহুর নাম লুলা-ল্যাংড়া, বোবা-তোতলা ইত্যাদি বলে ডাকা হয়, তাহলে সেটা গীবত হবে না।” ছয় নম্বরে বলা হয়ে থাকে, “যদি কোন ছেলের পক্ষ অথবা মেয়ের পক্ষ অর্থাৎ কোন পিতা তার ছেলেকে বিয়ে করাতে চায় অথবা মেয়েকে বিয়ে দিতে চায়, তখন বিপরীত পক্ষ ছেলে বা মেয়ের বাড়ীতে গিয়ে তাদের প্রতিবেশীদের কাছে যদি ঐ ছেলে বা মেয়ে সম্বন্ধে সংবাদ নেয়। আর প্রতিবেশী লোকেরা যদি সত্য কথা বলে অর্থাৎ সেই ছেলে বা মেয়ের দোষত্রুটিগুলো বলে দেয়, তাহলে সেটা গীবত হবেনা। কারণ এখানে একজনের জীবন নিয়ে প্রশ্ন।” আর সপ্তম বলা হয়েছে, সেটা হলো “যারা উলামায়ে “ছূ” বা “দুনিয়াদার আলিম।” যারা দ্বীনকে বিক্রি করে দুনিয়া অর্জন করে, তাদের দোষত্রুটি বর্ণনা করলে, সেটা গীবত হবে না।” সুতরাং যারা উলামায়ে “ছূ” বা “দুনিয়াদার আলিম” তাদের দোষত্রুটি বর্ণনা করলে ও তাদেরকে মন্দ নামে সম্বোধন করলেও গীবত এবং গুনাহ্ কোনটাই হবেনা। বরং ছওয়াব হবে। এ প্রসঙ্গে হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, উর্দূ কম্পোজ করতে হবে “এক যামানা বদনামে উলামায়ে ‘ছূ’ বেহতেরাজ শস্ত সালে তোয়াত বেরিয়া” অর্থঃ- “কিছু সময় উলামায়ে “ছূ” বা দুনিয়াদার আলিমদের দোষত্রুটি বর্ণনা করা, ষাট বৎসর কবুল ইবাদত থেকে উত্তম।” তার কারণ উলামায়ে “ছূ” বা গোমরাহ্ লোকের কাছে গিয়ে মানুষ গোমরাহ্ হয়ে যায়। যদি কেউ তার দোষত্রুটি বর্ণনা করে দেয় বা তার হাক্বীক্বত প্রকাশ করে দেয় তাহলে হাজার হাজার লোকের ঈমান হিফাযত হয়ে যাবে।
-মুহম্মদ ওয়ালীউর রহমান, ঢাকা।
বিৃটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে বিৃটিশ ভূমিকা-১৫