আলীমুল হাকীম আল্লাহ পাকই সকল হাম্দ ও শুকরিয়ার মালিক। সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতিই সকল ছলাত ও সালাম। ইসলাম সচেতন সকলেই জানেন যে, আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ, নূরে মুজাস্সাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর রূপায়িত ইসলাম মাত্র এক হিজরী শতকের মাঝেই আরব উপদ্বীপ থেকে বিস্তার লাভ করে পূর্বে সিন্ধু, চীন ও তুর্কিস্তান এবং পশ্চিমে স্পেন পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিলো। গুটি কয়েক দেশ ব্যতীত তৎকালে উল্লেখযোগ্য সব দেশেই ইসলামের আলো ছড়িয়েছিল। ইসলামের স্বর্ণযুগের সেই স্মৃতি আজো তাই পথহারা, শোষিত বঞ্চিত মুসলমানের অমিয় চেতনার উৎস। পাশাপাশি বিগত দিনে ইসলামের রাহে দ্বিধাহীন চিত্তে জীবন বিসর্জন তথা শাহাদাতের অগণিত ঘটনা আজো ক্ষয়িষ্ণু ঈমানী চেতনায় আলোড়ন তৈরী করে। এখনো জীবন দান তথা শাহাদাত বরণের প্রেরণা প্রগাঢ়ভাবে উদ্দীপ্ত করে। এ বোধের স্পর্শকাতরতায় তাই ইসলামের নামে যেনোতেনো ইস্যুতেই বেশামাল জজবাধারীর উৎসাহের আধিক্যের অভাব হয় না। সাম্প্রতিককালের বোমাবাজরা এর উদাহরণ বটে। দ্বীনের পথে এ উৎসাহ ও জজবা অবশ্যই দ্বীনের এক বড় সম্পদ হিসেবে গণ্য হতে পারত। কিন্তু বলা প্রয়োজন, এ জজবার স্বরূপ অনুধাবণ এবং সঠিক পথে একে সুচারুরূপে পরিচালনা ও প্রয়োগের ব্যর্থতাই আমাদেরকে থেকে থেকে বোমাবাজির মত দুঃখজনক ঘটনা তথা করুণ পরিণতিতে পর্যবসিত করছে। তাই সুস্থ বোধের বিকাশ প্রয়োজন যে, স্থান-কাল-পাত্রের প্রেক্ষাপটে কেবল রক্তদানের মানসিকতায় অমিততেজা জিহাদী জজবাই কাঙ্খিত নয় বরং বাঞ্ছিত হচ্ছে হিকমত ও প্রজ্ঞার প্রতিফলন। অনুসরণীয় মুহাক্কিকগণ তার যথেষ্ট নজীর রেখেছেন। উৎসাহধারীদের পুনঃ পুনঃ অনুরোধের প্রেক্ষিতে হযরত শাহ ওয়ালীউল্লাহ্ মুহাদ্দিস দেহলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি জবাব দিয়েছিলেন, “এ মুহূর্তে জিহাদ ঘোষণা করা হলে জালিম ইংরেজ সরকার নিমিষে সব আলিমকে ক্বতল করে ফেলবে। এ যাবৎ পালিত ইসলামের অনুষঙ্গের উপর নতুন বিধি-নিষেধ আরোপ করবে এবং আরো কঠোরতা প্রয়োগ করবে।” সে সময়েই সরাসরি জিহাদে না গিয়ে ইল্মের বিস্তার ঘটিয়ে জনমত তৈরী করে জিহাদের বীজ বপন করে তিনি প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন। ফলশ্রুতিতে তাঁর উত্তরসূরী আমিরুল মু’মিনীন, মুজাহিদে আ’যম, হযরত সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরেলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি খিলাফত কায়েমে সমর্থ হয়েছিলেন। মাত্র কিছুদিন পূর্বে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ড. কিম হাওয়েলস বাংলাদেশ সফরে এসে বায়তুল মোকাররম মসজিদ এবং ঢাকা আলীয়া মাদ্রাসা ইত্যাদি পরিদর্শন করেন। এরও কিছুদিন পূর্বে প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রদূত হ্যারি কে টমাসের পৃষ্ঠপোষকতায় মাদ্রাসা ছাত্রদের পুরস্কারের ব্যবস্থা হয়। অর্থাৎ কিনা ইসলামিক অনুষঙ্গগুলোতে ইঙ্গ-মার্কিনীরা অনুপ্রবেশ করার প্রচেষ্টায় ইতোমধ্যে অনেকাংশেই সফল হয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে তাদের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ীই এদেশে ইসলামী শিক্ষার সিলেবাস ও মুসলমানী জিন্দিগীর পরিধি পরিচালিত হবে, সেই পরিকল্পনায় তারা অনেক দূরই এগিয়েছে।
সাম্প্রতিককালের কথিত জেএমবি, জেএমজেবি নামধারী সংগঠনগুলোই যে এর পটভূমিকা রচনা করেছে, তা নয়। বরং ইসলামের নামধারী সব রাজনৈতিক দলগুলোর স্বার্থবাদিতা ও অদূরদর্শিতা এবং ভ্রান্ত ও আত্মঘাতী কর্মসূচীর জন্য এর দায় সমভাবে তাদের উপরও বর্তায়। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, ইসলামের নামে কারা এদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে? কারা মা-বোনের সম্ভ্রম বিকিয়ে দিয়েছে? কারা ইসলামের নামে প্রথম সন্ত্রাসী তৎপরতা তথা হাত-পায়ের রগ কাটার রাজনীতি শুরু করেছে? অথবা মাত্র কিছুদিন পূর্বেও কারা ‘আমরা সবাই তালেবান-বাংলা হবে আফগান’-এই শ্লোগান দিয়েছে? এসব অপতৎপরতার নীরব উত্তরণই যে আজকের বোমাবাজ ও জঙ্গীবাদীদের শক্ত ভিত তৈরী করেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। হাদীছ শরীফের ভাষ্য মতে, ‘যে কেউ একটা পাপ কাজের সূচনা করলো সেই পাপ কাজের রেশ ধরে যত পাপ হতে থাকবে সবই প্রারম্ভকারীর উপর বর্তাবে।’ ইসলামের আলোকে তাই আজকের বোমাবাজী জঙ্গীবাদী অপতৎপরতার সবই হাত-পায়ের রগকাটা দল অথবা তালেবানী সমর্থকদের উপর বর্তায়। মূলত: বিষয়টি এখন আর রাখ-ঢাকের মধ্যে মোটেও নেই।
ধৃত জঙ্গীদের অর্ধেকেরও বেশী অকপটেই স্বীকার করেছে যে, ‘তারা সবাই জামায়াত শিবিরের প্রোডাক্ট।’ ওদিকে শাইখুল হাদীছ নামধারীও ধৃত জঙ্গীদের ছাড়িয়ে দেবার জন্য ফোন করেন। হান্নান তথাকথিত ইসলামী পত্রিকা সম্পাদক মাহিউদ্দীনের সাথে সখ্যতার প্রমাণ পেশ করেন। ধৃত জঙ্গী কর্মীর উদাহরণ ছাড়াও শাসনতন্ত্র আন্দোলনের তথাকথিত পীর ধৃত সন্ত্রাসীদের মুক্তির পক্ষে ওকালতি করেন। অর্থাৎ তারা এখন বুঝে বুঝেই ইসলামের নাম ব্যবহার করে হালুয়া-রুটির জন্য অনৈসলামী কাজগুলো দ্বিধাহীন চিত্তে করে যাচ্ছেন। ইসলামের নামে ছবি তোলা, বেপর্দা হওয়া, হরতাল, লংমার্চ, মৌলবাদ, ব্লাসফেমী আইন, ভোট ও নির্বাচন করাসহ সন্ত্রাসী ও বোমাবাজী কোন কিছুই তাদের আটকায় না। এদের সম্পর্কে আল্লাহ পাক ইরশাদ ফরমান, “তারা অল্প মূল্যের বিনিময়ে আল্লাহ পাক-এর আয়াত শরীফ বিক্রি করেছে।” অর্থাৎ এরাই সাক্ষাত ধর্ম ব্যবসায়ী। ইসলামের নাম দিয়ে এরা আজকে এ দলে, কালকে ওদলে নিমিষে মিশে যেতে পারে। গিরগিটির ন্যায় ঘন ঘন রং বদলাতে বা বক্তব্য বদলাতে, নিজেদের দেয়া ফতওয়া পরিবর্তন করতে এরা খুবই পারঙ্গম। মুনাফিকী যেন এদের মজ্জাগত। এরা আত্মপ্রচার করে থাকে যে, এরাই এদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের তথা ইসলামের প্রতিনিধিত্ব করে এবং এ দাবীর সুবাদেই তারা ক্ষমতার ভাগ চেয়ে থাকে।
বলাবাহুল্য, এ প্রচারণাটা বহুকাল যাবত চলে আসলেও বর্তমান প্রেক্ষাপটে এর প্রকৃত সত্যতা অনুধাবন সহজ হয়ে পড়েছে। চট্টগ্রাম মেয়র নির্বাচনে তাদের জারিজুরি সব ধরা পড়েছে। সচেতন ধর্মপ্রাণ মুসলমান ভালভাবে হিসেব কষেছে, ক্ষমতার চার বছরে এরা ইসলামের পক্ষে কোন অনুষঙ্গের জন্য সরকারকে ক’বার চাপ দিয়েছে? তার বিপরীতে মন্ত্রীত্বের জন্য সরকারের সাথে কতবার মান-অভিমান করেছে বা খুদ-কুড়া সংগ্রহ করেছে।
মুসলমানদের ঈমানের শত্রু কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে তথাকথিত তোড়জোড় আন্দোলন দেখালেও, কাদিয়ানীদের কাছ থেকেই টাকা খাওয়ার তথ্য এখন নিজেরাই ফাঁস করেছে। মন্ত্রীত্বের প্রশ্নে এদের তথাকথিত ইসলামী ঐক্যজোটের ঐক্য খ-িত-বিখ-িত হয়েছে। আবার প্রত্যেকেই তাদের দেয় ফতওয়া, ‘নারী নেতৃত্বের কাছে যাওয়ার জন্য ছোক ছোক করছে।’ কাজেই ইসলাম পছন্দের বা পক্ষের রাজনীতিক দল বলে যারা ঐতিহ্য দাবী করেন তারা ইসলামের নাম ব্যবহারকারী এসব ধর্ম ব্যবসায়ী সম্পর্কে যত তাড়াতাড়ি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন তত তাড়াতাড়িই দেশ, জাতির মঙ্গল।
মূলত: এদের কাঁধে ভর করে ক্ষমতায় যাওয়ার কী যে অন্তঃজ্বালা তা যে এখন ক্ষমতাসীন সরকারও হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। সরকারের ভেতরে এদের অবস্থানের কারণেই যে জঙ্গীবাদী বিরোধী অভিযান সফল হচ্ছে না তা সরকারের বাইরেও সবাই সম্যক উপলব্ধি করতে পারছেন।
কাজেই এরা ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ির পরিবর্তে ক্ষমতাসীন সরকারই যে এদের সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরো করুণ ক্রীড়ানকে পরিণত হবে তা উপলব্ধির পরও এদের বিরুদ্ধে সরকারের নিষ্ক্রিয়তা দেশ-জাতিকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
স্মর্তব্য, সাম্প্রতিককালে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ভদ্রবেশী আওয়াজ তুললেও আসলে শান্তির প্রক্রিয়ায় কাজ করার যোগ্যতা ও ইল্ম তাদের মোটেও নেই। প্রচলিত বিচারকরা ‘আল্লাহ পাক-এর আইন মানছেন না’- একথা প্রচার করলেও ‘আল্লাহ পাক-এর আইনেই যে বিচারকদের এভাবে হত্যা করা জায়িয নেই’- সে ইল্ম ও ব্যাখ্যা তাদের জানা নেই। তথাকথিত জিহাদের নামে স্বেচ্ছাচারী প্রক্রিয়া বা হাত-পায়ের রগ কাটাসহ সন্ত্রাস আর বোমাবাজীর অপতৎপরতা ছাড়া তায়াল্লুক মায়াল্লা’র গায়েবী মদদে চলার রূহানী যোগ্যতা তাদের আদৌ নেই।
উল্লেখ করা যেতে পারে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জীবদ্দশায় অষ্টম হিজরী সাল পর্যন্ত খোদ মক্কা শরীফেই ৩৬০টি মূর্তি ছিলো। কিন্তু তিনি তজ্জন্য কোন গুপ্তঘাতক প্রেরণ করেননি। পাশাপাশি তিনি যখন মক্কা শরীফ বিজয় করলেন তখনও কোন রক্তপাত ঘটেনি।
মূলত: এটা সম্ভব হয়েছিলো তাঁর রূহানী শক্তির প্রতিফলনে। বলাবাহুল্য, সে রূহানী শক্তির সম্যক হিস্যা বিকশিত হচ্ছে বর্তমান জামানার মুজাদ্দিদ, মুজাদ্দিদে আ’যম, রাজারবাগ শরীফের হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলী-এর মাঝে।
কাজেই তাঁর উছীলায় প্রকৃতপক্ষে সম্ভব মৌলবাদী, জঙ্গীবাদী, বোমাবাজী আর ফিৎনা-ফাসাদের আড়ালে গায়িবী মদদে খিলাফত আলা মিনহাজিন নুবুওয়াহ’র প্রতিষ্ঠা। মহান আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে তাঁর নেক ছোহবত, সন্তুষ্টি ও কামিয়াবী তথা খেলাফতের নিয়ামত নছীব করুন। (আমীন)