সম্পাদকীয়
সব হাম্দ কেবল সবকিছুর স্রষ্টা মহান আল্লাহ পাক-এর জন্য। যাঁর অশেষ রহ্মতে জুমাদাল উখ্রা মাসে, ‘মাসিক আল বাইয়্যিনাত’ প্রকাশিত হলো। সব ছলাত-সালাম সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম-এর প্রতি। তাঁর সম্মানিত আহ্লে বাইতের প্রতি। হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের প্রতি। সাইয়্যিদুস্ সিদ্দীক্বীন, হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর প্রতি। জুমাদাল উখ্রা মাসে এ মহান ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর ইন্তিকালের মাস হওয়ায় তা বিশেষ মর্যাদা ও তাৎপর্যের দাবী রাখে। মূলতঃ হুযূর পাক ল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সর্বোত্তম এ ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম-এর মর্যাদার মূল্যায়ণ করা আমাদের সাধ্যের বাইরে। যাঁর ভূয়সী প্রশংসায় বহু আয়াত শরীফই নাযিল হয়েছে। সূরা তওবার চল্লিশ নং আয়াত শরীফটি বিশেষ প্রনিধানযোগ্য। এই এক আয়াত শরীফেই তাঁর তিনটি প্রশংসার উল্লেখসহ তাঁকে ‘সানী ইসনাইন’ (দু’জনের দ্বিতীয়) বলে সুমহান মর্যাদা দেয়া হয়েছে। তিবরানী শরীফের হাদীছ শরীফে হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “নবী আলাইহিমুস্ সালামগণের পরে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুই সর্বোত্তম মানুষ।” রাসূল আক্বদাস্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে তাঁর সম্পর্কই ছিল প্রগাঢ়। অধিক পছন্দের, মর্যাদার ও অধিক আস্থার। তাঁর চিন্তা-চেতনা ও চরিত্রের সাথে সর্বাধিক সামঞ্জস্যশীল এবং একীভূত। যে কারণে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেননি, মুনাফিক সর্দার আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইর জানাযায়। বিমর্ষ হননি হুদাইবিয়ার সন্ধিতে। এমনকি হুঁশ হারাননি আজীবনের আঁকা হাবীবাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পবিত্র বেছাল শরীফে। স্মরণীয় যে, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বেছাল শরীফের অব্যাহতির পর পরই খলীফা হওয়ার প্রসঙ্গ উঠলে তিনি হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীছ শরীফ পেশ করে বলেন, ‘খলীফা হবে কুরাঈশগণ হতে’। আর স্বয়ং হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে ইমামতির দায়িত্ব দিয়েছিলেন। এই ছিল মূল মূল্যায়ন। এর ভিত্তিতেই দ্বিতীয় খলীফা হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-খলীফা-এর মুবারক অধিষ্ঠান। তিনি খলীফাতু রসূলিল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হিসেবে অভিহিত হন। অতএব, প্রতিভাত হয় যে, “তিনি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়েছেন।ইসলামে গণতন্ত্রের ভিত তিনিই সর্ব প্রথম স্থাপন করেন।” (নাউযুবিল্লাহ) এসব কথা সবৈব মিথ্যা। স্মরণীয় খোলাফা-ই-রাশেদার কেউ গণতন্ত্র করেননি। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিতও হননি। হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে সরাসরি নিয়োগ করেন হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু। তিনি ইন্তিকাল পূর্ব মুহুর্তে এক ফরমানে উল্লেখ করেন, “রাসূলাল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খলীফা, হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর পক্ষ হতে মু’মিন মুসলমানদের প্রতি। প্রশংসনীয় আল্লাহ্ পাক আপনাদেরকে নিরাপদ রাখুন। আমি হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে আপনাদের খলীফা নিযুক্ত করলাম। তাঁকে মানুন এবং তাঁর আদেশ পালন করুন। (তারিখে ইয়াকুব নজফ, কানজুল উম্মাল) এরপর হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু যখন নিজ শাহাদাতের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে পড়লেন, তখন তিনি হযরত উসমান রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত তাল্হা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত যুবায়ের রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ও হযরত আব্দুর রহ্মান ইবনে আওফ রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুসহ কুরাঈশদের মধ্য হতে ছয় জন বিশিষ্ট ব্যক্তির কথা উল্লেখ করে বলেন যে, তাঁদের মধ্য হতে খলীফা হবে। পরবর্তীতে এই ছয়জনের তিনজন স্বেচ্ছায় খলীফা হতেই অস্বীকৃতি জানালে, বাকী তিনজনের মধ্যে হযরত আব্দুর রহ্মান ইবনে আওফ রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু সিদ্ধান্ত দাতার ভুমিকায় অবতীর্ন হন। তিনি হযরত উসমান রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে খলীফা মনোনীত করেন। আর তাঁর পরবর্তীতে হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু খলীফা মনোনীত হন। উল্লেখ্য ইতিহাসে বর্ণিত দামেস্কের উমাইয়া ও বাগদাদের আব্বাসীয় খলীফাদের কথিত খেলাফাত ৬৫৬হিঃবা ১২৫৮ সালে ব্যাহত হয়। অতঃপর ১২৬২ সালে মিশরে এ খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হয়ে, ২৫০ বছরের বেশী অব্যাহত থাকে। এর পরে ১৫১৭ সালে তুর্কী সুলতান সেলিম সে খেলাফতের ধারাবাহিকতা জারী করেন। খেলাফতের ধারণা পরবর্তীতে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত বর্তমান থাকে। আর তুরষ্কে কামাল পাশার গণতন্ত্র চর্চার কারণেই সে ধারণা অবলুপ্ত হয়। অথচ সে গণতান্ত্রিক রীতিতেই, খেলাফাত প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করে বৃটিশ আমল থেকেই, উপমহাদেশের মুসলমানগন বিভ্রান্তির, বিড়ম্বনার স্বীকার হয়ে আসছেন। উল্লেখ করা যেতে পারে, ১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘নিখিল ভারত খেলাফাত কমিটি’ গঠন থেকে একইরূপে চালিত সকল জমিয়ত, আঞ্জুমান বা ইসলামিক পার্টি ঐক্যজোট, জামাত, শাসনতন্ত্র, খেলাফত আন্দোলন মজলিছ ইত্যাদি মুসলমানদের ভুল দিক নিদের্শনা, ব্যার্থতা আর হতাশা ছাড়া কিছুই দিতে পারেনি। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, পূর্বোক্ত কমিটির কার্যকলাপে প্রথম পর্যায়েই বাংলার আট হাজার এবং পরবর্তীতে পঞ্চাশ হাজার স্কুল-মাদ্রাসা বন্ধ হয়ে যায়। বহু লোক চাকুরী ছাড়ে, আশি হাজার লোক কারবরণ করে। অথচ যে হিন্দু গান্ধীর সাথে মিলে তারা হরতাল, ধর্মঘট ও অসহযোগ আন্দোলন করেছে,সে হিন্দুদের স্কুল-কলেজে হরতাল-ধর্মঘট হয়নি। চাকুরীচ্যুতদের মধ্যে ৯৫%ই ছিল মুসলমান, যা পরবর্তীতে হিন্দুদের দ্বারাই পূরণ হয় এবং গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে হিন্দুদের তালিকা, ক্ষেত্রে বিশেষে ছিল শুন্য। অপরদিকে যেসব মুসলিম নেতৃবৃন্দ বিদেশী পণ্য বর্জনের ডাক দিয়েছিলেন, তাদেরকেই আবার কোন কোন সভায় দেখা গিয়েছে বিদেশী সিগারেট টানতে। অর্থাৎ আমলহীন, ফাসেক বা আলেমরূপী মুনাফিকদের বিশেষ সমাবেশও তাদের মাঝে হয়েছিল। মূলতঃ খেলাফাত আল্লাহ্র দান। যে প্রসঙ্গে আল্লাহ্ পাক বলেন, “হে দাউদ আলাইহিস্ সালাম! আমি আপনাকে প্রতিনিধি (খলীফা) করেছি।” (সূরা যুমার) আর এ দান আল্লাহ্ পাক তাঁর লক্ষ্যস্থল খাছ ওলী আল্লাহ্ ব্যাতীত দান করেন না। আমাদেরকে তাই বর্তমান জামানার ইমাম ও মুজতাহিদ, মুজাদ্দিদে আ’যম-এর ছোহবতে যেতে হবে। তবেই যেমন জানা যাবে, গণতন্ত্র চর্চার কুফল, নেতার প্রকৃতগুণ। তার সাথে তেমনি সুগম হবে, খেলাফাত প্রতিষ্ঠার পথ। মহান আল্লাহ্ পাক আমাদেরকে তাঁর লক্ষ্যস্থল অলীআল্লাহর সান্নিধ্য ও খেলাফত নছীব করুন । (আমীন)