সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান মহান আল্লাহ্ পাক এর জন্যই সব প্রশংসা। সতর্ককারী ও সুসংবাদ দাতা সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি অনন্তকালের জন্য অগণিত দরূদ ও সালাম।
ইসলাম আল্লাহ্ পাক-এর মনোনীত দ্বীন। ইসলাম স্বয়ং সম্পূর্ণ। ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ স্থান কাল পাত্রের মুখাপেক্ষী নয়। বরং ইসলাম সব সময় আপন মহিমায় ভাস্বর। সাধারণের মাঝে একটি ধারণা রয়েছে, পৃথিবীর সব দেশেই যদি ইসলাম প্রসার লাভ করে, সবাই যদি মুসলমান হয়, দুনিয়ার সর্বত্রই যদি ইসলামী হুকুমাত প্রতিষ্ঠিত হয় অথবা বিধর্মীরা যদি মুসলমানদের কাছে পরাস্ত হয় তবেই ইসলামের মহিমা প্রকাশ পায়, শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়। এ ধারাবাহিকতায় যামানার মুজাদ্দিদের ক্ষেত্রেও তারা একই চেতনার প্রেক্ষিতে মূল্যায়ণ করে থাকেন। তাদের সহজাত প্রশ্ন হচ্ছে, সত্যিই যদি কেউ মুজাদ্দিদে যামান হয়ে থাকেন তবে কেন সবাই তাঁর দিকে ঝুকছেন না, অথবা সব স্থানে ইসলামের বিজয় কেতন পত পত করে উড়ছেনা? উল্লেখ্য, এ মন্তব্যের বিপরীতে ছহীহ্ বক্তব্যের সাথে ইসলামের মৌলিক ধারণা; যথা- নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালাম, তাঁদের ওয়ারিছ হক্বানী রব্বানী আউলিয়া-ই-কিরাম বা মুজাদ্দিদে যামান-এর অস্তিত্ব তথা হক্ব নাহক্বের শর্ত সর্বোপরি ইসলামের সফলতা অসফলতার বিষয় সম্পৃক্ত। সঙ্গত কারণেই সমঝ ও সত্যতার আলোকে এটি আলোচনার গুরুত্ব রাখে।
মূলতঃ কুরআন-সুন্নাহ্য় এর জবাব স্পষ্ট। কুরআন শরীফে আল্লাহ্ পাক ইরশাদ ফরমান, “তোমরা যদি পৃথিবীর অধিকাংশ লোককে অনুসরণ কর তবে তারা তোমাদের গোমরাহ করে ফেলবে।”(সূরা আনয়াম/১১৬) এই আয়াত শরীফ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, পৃথিবীর অধিকাংশ লোকই গোমরাহ, কাফির, বেদ্বীন ও বদদ্বীন থাকবে। উদাহরণতঃ আজ পৃথিবীর ৬শ’ কোটিরও বেশী অধিবাসীর মাঝে মাত্র প্রায় দেড়শ’ কোটি মুসলমান। অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশেরও কম। অপরদিক থেকে এই মুসলমান নামধারীদের মাঝে আবার শিয়া, মুতাযিলা, রাফিজী, খারিজী, জামাতী, ওহাবী ইত্যাদি বিভিন্ন বাতিল ফিরক্বা বিদ্যমান। যে প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে যে, “বণী ইসরাঈলের মাঝে হয়েছিল বাহাত্তর ফিরক্বা; আর আমার উম্মতের মাঝে হবে তিয়াত্তর ফিরক্বা।” (মিশকাত, তিরমিযী)
এটা হাদীছ শরীফের কথা যা অকাট্ট ও অখণ্ডনীয়। এখন তুলনামূলক হিসেবে ৭৩ জন নামধারী মুসলমানের ভীড়ে একজন হকপন্থীকে খুঁজে পাওয়াও মুশকিল।
এমনকি আল্লাহ্ পাক-এর রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যামানায়ও যদি আমরা দেখি তবে বলতে হয় বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্রানুযায়ী সে যুগে মানুষের সংখ্যা ছিল সর্বাধিক ত্রিশ কোটি। আর হযরত ছাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের সংখ্যা ছিল সোয়া লাখ। সব মিলে মুসলমানের সংখ্যা ছিল প্রায় তিন লাখ। অর্থাৎ অনুপাতিক হারে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ক্ষেত্রে হাজারে একজন।
প্রসঙ্গতঃ আরো উল্লেখ্য যে, বণী ইসরাঈলের সত্তর হাজার নবী আলাইহিমুস্ সালামগণ শহীদ হয়েছেন যাদের একজন উম্মতও ছিলনা। কিন্তু তাই বলে তাঁদের বা তাঁদের প্রচারিত দ্বীনের কোন অমর্যাদা হয়নি। বরং তারা দ্বীন প্রকাশ করেছেন, প্রচার করেছেন এখানেই তাদের কামিয়াবী। আর দ্বীন তার নিজস্ব গুণেই সফল ও সমৃদ্ধ। কারণ দ্বীনের মালিক স্বয়ং আল্লাহ্ পাক রব্বূল আলামিন। যিনিই সবকিছুর খালিক, মালিক বা মহামহিম রব। আর আল্লাহ্ পাক বান্দার মূল্যায়ণের বহু ঊর্ধ্বে। ঠিক একই ধারাবাহিকতায় একজন মুজাদ্দিদে যামান যখন আল্লাহ্ পাক-এর ওহীকৃত, আল্লাহ্ পাক-এর রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বিবৃত দ্বীন ইসলামকে হুবহু তুলে ধরেন- ইসলামের নামে অনৈসলামী কাজকে চিহ্নিত করেন, ছবি তোলা, লংমার্চ, হরতাল, মৌলবাদ, ব্লাসফেমী, ইসলামের নামে নারী নেতৃত্ব গ্রহণ, নির্বাচন ও দলীয় রাজনীতি করণ ইত্যাদি হারাম ফতওয়া দেন; এবং যাবতীয় প্রয়োজনীয় তাজদীদ প্রকাশ করেন তখন সেই তাজদীদই তাঁর বড় অবদান। ফিৎনা-ফাসাদের যামানায় তাঁর তরফ থেকে সত্য প্রকাশ পাওয়াটাই মুখ্য মূল্যায়ণের বিষয়।
স্মর্তব্য যে, যাদের অন্তরে নামধারী উলামাদের মত নিফাকী, কুফরী নেই বরং হিদায়েতের নূর আছে, তারা সবাই এক সময় যামানার মুজাদ্দিদের সাথে সম্পৃক্ত হবে ইনশাআল্লাহ্। বলাবাহুল্য, যামানার মুজাদ্দিদের ক্ষেত্রে এদিক থেকেও সুন্নতী নিয়ম প্রযোজ্য। যেমন, ২য় হিজরীতে বদর জিহাদে আল্লাহ পাক-এর রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে ৩১৩ জন, ৩য় হিজরীতে উহুদের জিহাদে ৭১০ জন, ৬ষ্ঠ হিজরীতে হুদাইবিয়ার সন্ধিতে ১৪০০ জন, ৮ম হিজরীতে মক্কা বিজয়ের সময় ১০ হাজার আর ১০ম হিজরীতে বিদায় হজ্বের সময় ছাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ-এর সংখ্যা সোয়া লাখ। আর ১১ হিজরীতে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বেছাল মুবারকের সময় মুসলমানের সংখ্যা প্রায় তিন লাখ। অর্থাৎ প্রথমে ধীরে হলেও শেষের দিকে ত্বরিৎগতিতে হক্ব সিলসিলার বিস্তার হওয়াই সুন্নত কিন্তু তারপরেও বলতে গেলে নাহক্বপন্থীর ভীড়ে সে সংখ্যা অতি নগণ্য।
এজন্যই হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে, “ইসলাম অল্পসংখ্যক লোকের দ্বারা শুরু হয়েছে, অল্পসংখ্যক লোকের দ্বারাই তা শেষ হবে। এবং অল্প সংখ্যক লোকের জন্যই সুসংবাদ।” মূলতঃ যামানার মুজাদ্দিদই সে সুসংবাদের ধারক-বাহক। মহান আল্লাহ্ পাক আমাদের সকলকে তাঁর মুবারক ছোহ্বত নছীব করুন। (আমীন)।