সৃষ্টির শুরু থেকেই গণনায় মাসের সংখ্যা বারটি বলে, রব তায়ালা নির্ধারিত করে দিয়েছেন। এবং এক্ষেত্রে মুহাররামুল হারাম হিজরী সালের প্রথম মাস বা পয়লা মুহাররম নতূন হিজরী সালের প্রথম দিন। তাই মুহররমের আগমন মুসলমানদের জন্য যেমন বিগত এক বৎসরের জিন্দেগীর মূল্যায়নের অবকাশ রাখে তেমনি প্রেরণা দেয় পরিশুদ্ধ চেতনায় নতূর সালে পদার্পণ করার দীপ্ত অভিপ্রায়ের ও নব চেতনার। কিন্তু বেদনাদায়ক হলেও সত্য যে, মুর্হরম মাসে মুসলিম মানসিকতায় যে আলোড়ন আন্দোলিত হওয়ার কথা, তার খুব কম স্পন্দনই আমরা দেখতে পাই। এই মুর্হরম মাসেই বয়ে গেছে আশুরা- যে দিনটিতে পৃথিবী সৃষ্টি, প্রথম বৃষ্টি বর্ষণ, প্রথম রহ্মত নাযিলসহ অন্য হাজারো গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার সমাবেশে সমৃদ্ধ। অথচ সে সম্পর্কে আলোচনা, পর্যালোচনা ও তার প্রতিফলনের প্রচেষ্টার তেমন কোন পদক্ষেপই সঠিকভাবে লক্ষ করা যায় না। রাষ্ট্রীয়ভাবে তো বটেই সমাজ জীবনেও মুসলমানদের ধর্মীয় কেন্দ্রগুলোতে বা মসজিদসমূহে দিবসটি উদ্যাপনের উদ্যোগে কাঙ্খিত উৎসাহ পরিলক্ষিত হয়না। এজন্য অবশ্য এক শ্রেণীর উলামাদের গাফলতি এবং অজ্ঞতাই বিশেষভাবে দায়ী। আর এই অজ্ঞতার কারণেই এরা মুর্হরম সম্পর্কে কিছু বললেও তাতে আবার ঔদ্ধত্যপূর্ণ ভাষায় আম্বিয়া আলাইহিমুস্ সালাম ও হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণকে অহেতুক দোষারোপ করে। যার ফলশ্রুতিতে তারা নিজেরা যেমন ঈমান হারায় তেমনি সাধারণ লোকের ঈমানকেও ক্ষতিগ্রস্থ করে। কারণ ইসলামী আক্বীদা মতে আম্বিয়া আলাইহিমুস্ সালামগণ সম্পূর্ণরূপে নিস্পাপ, হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ সকল প্রকার সমালোচনার উর্দ্ধে, সম্পূর্ণরূপে সত্যের মাপকাঠি, যাদের সম্পর্কে কুরআনে কারীমায় বলা হয়েছে, “আল্লাহ্ পাক তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারাও আল্লাহ্ পাক-এর প্রতি সন্তুষ্ট।” উল্লেখ্য পবিত্র আশুরার দিবসে সবচেয়ে হৃদয়বিদারক, মর্মস্পর্শী ও ব্যাথাহত বিষয়টি হলো- হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কলজের টুকরা, নয়নের তারা, প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র, হযরত ইমাম হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর শাহাদাত বরণ। এ শাহাদাতের ঘটনা একদিকে যেমন আমাদের ভারাক্রান্ত করে, ন্যায়ের পথে অটল থাকার ও ত্যাগের মহান আদর্শে উজ্জীবিত করে, তেমনি অপরদিকে কিছু কিছু ফায়দালোভী, বিভ্রান্ত বা জাহিল সম্প্রদায়ের বিকৃত ব্যাখ্যা যারপর নাই বিস্মিত, আহত ও ক্ষুব্ধ করে তোলে। তারা চরম জিহালতের সাথে এই মন্তব্য করে যে, “ইমাম হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু গণতন্ত্রের জন্য শাহাদাত বরণ করেছেন।” (নাউযুবিল্লাহ্) বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, গণতন্ত্রে জনগণই সকল সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক। যদিও তথাকথিত ইসলামিক দলগুলো প্রকাশ্যে দাবী করে যে, তারা পাশ্চাত্য গণতন্ত্র এবং ‘সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ,’ এ কথায় তারা বিশ্বাসী নয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই বিশ্বাসই তারা তাদের কাজে প্রতিফলিত করে। যার প্রমাণ হচ্ছে- তাদের নির্বাচনে অংশ গ্রহণ। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায়, জনগণকে ভোট দানের মালিক করে সেই সার্বভৌম ক্ষমতারই অধিকারী করে দেয়া হয়। এ ক্ষমতা অবিভাজ্য যা প্রয়োগে কোন দায়বদ্ধতা থাকেনা। আর স্বেচ্ছাচারী এই ক্ষমতা প্রয়োগের ফলেই গণতন্ত্রে কোন সরকার গঠিত হয় বা পতিত হয়। এবং এভাবেই গণতন্ত্রে জনগণ, তাদের সার্বভৌম ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটিয়ে থাকে। অতএব স্বরণীয়, নির্বাচনে অংশগ্রহণই হচ্ছে- জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস- এ বিশ্বাসে স্বীকৃতি জ্ঞাপন। ইসলামের দৃষ্টিতে যা কুফরী এবং ঈমান হারাবার প্রত্যক্ষ কারণ। বলাবাহুল্য আল বাইয়্যিনাতে এ পর্যন্ত বহুবার গণতন্ত্র নাজায়িয, নির্বাচন নাজায়িয, ভোট দেয়া নাজায়িয, হাদীছ শরীফের বরাত সাপেক্ষে প্রার্থী হওয়া নাজায়িয ইত্যাদি বিষয়ে কুরআন-সুন্নাহ্র দলীল সমৃদ্ধ সারগর্ভ আলোচনা করা হয়েছে এবং তা থেকে বিরত থাকার জন্য বিশেষ করে ইসলামের দোহাই দানকারী দলগুলোকে বার বার আহ্বান জানানো হয়েছে। কিন্তু কুরআন পাক-এর সেই নছীহতের দিকে তারা মনোযোগী হয়নি। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ্ পাক বলেন, “তার চেয়ে অধিক জালিম আর কে আছে? যাকে তার পালন কর্তার কালাম দ্বারা বোঝানো হয়, অতঃপর সে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।” (সূরা কাহফ-৫৭) আল্লাহ্ পাক অন্যত্র বলেন, “আল্লাহ্র পথে চলতে অস্বীকার যারা করেছে, তাদের অবস্থা ঠিক এরূপ যেমন রাখাল পশুগুলিকে ডাকে কিন্তু তারা ঐ ডাকের আওয়াজ ব্যতীত আর কিছুই শুনতে পারেনা, এরা বধির, বোবা, অন্ধ। এজন্য কোন কথা এরা বুঝতে পারেনা।” (সূরা বাক্বারা-১৭১) আর এরূপ যেসব উম্মতে মুহম্মদী না বুঝে, জিহালতের পরিচয় দিয়ে ইহুদী, খৃীষ্টানদের রেওয়াজ নির্বাচনে শামিল হচ্ছে, তাদের সম্পর্কেই হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, “তোমরা তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের পদে পদে অনুসরণ করবে। এমনকি তারা যদি গোসাপের গর্তে প্রবেশ করে থাকে, তোমরা তাই করবে।” হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ জিজ্ঞেস করলেন, “হে আল্লাহ পাক-এর রাসূল (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পূর্ববর্তী লোকদের বলতে কি ইহুদী-নাছারা বুঝায়? তিনি বললেন, “তা ছাড়া আর কে?” (বুখারী শরীফ) মূলতঃ এরূপ নামধারী ইসলামী দলসমূহ যারা গণতন্ত্র, নির্বাচন ইত্যাদিসহ ইহুদী-নাছারাদেরই অনুসরণ করে তারা নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় বার বার করুনভাবে ব্যর্থ ও লাঞ্ছিত হয়ে আসলে ইসলামের চরম অবমাননা ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনা, আর এটাই তাদের অনিবার্য পরিণতি। কারণ যে পথ ইসলামসম্মত নয়, সে পথে আল্লাহ পাক-এর রহ্মত, কামিয়াবী আসা আকাশ কুসুম কল্পনা মাত্র। আর তাই আজ অবধি সারা বিশ্বে কোন দেশে নির্বাচনের মাধ্যমে ইসলামী সরকার হয়নি এবং হবেওনা। ফিকিরযোগ্য যে, সকল ইসলামী দলগুলো যদি একতাবদ্ধভাবে ইসলামের এই আদর্শ প্রচারে প্রচেষ্ট হয় যে, ইসলামে গণতন্ত্র ও নির্বাচন জায়িয নেই তাহলে শতকরা প্রায় নব্বইভাগ মুসলমানের এই দেশে আর কোন নির্বাচনই অনুষ্ঠিত হতে পারতো না। ইসলাম প্রিয় মুসলমানগণ নির্বাচন বয়কট করতেন এবং পাশ্চাত্য গণতন্ত্র ও নির্বাচন পর্যুদস্ত হতো এবং খিলাফত আলা মিন্হাজিন নুবুওওয়ার পথ প্রশস্ত হতো। কিন্তু তথাকথিত ইসলামী দলগুলো সর্বদাই জিহালতে মত্ত থাকায় কুরআন-সুন্নাহ্র এই সঠিক বুঝ উপলব্ধিতে ন্যাক্কারজনকভাবে ব্যার্থ হচ্ছে আর মানুষকে বিভ্রান্ত করছে এবং ইসলামের অবমাননা করছে। অতএব, আজ নতুন হিজরী সনের শুরুতে এসব মতলববাজ, ব্যবসায়ী, বাঁচাল, মুনাফিক এবং জাহিল, বিদ্য়াতী ও গোমরাহ্ ওলামায়ে ‘ছু’দের সম্পর্কে আমাদের সাবধান ও সচেতন হতে হবে। তাদেরকে প্রতিরোধ করার দীপ্ত শপথ নিতে হবে এবং উলামায়ে হক্কানী-রব্বানী তথা মুজাদ্দিদে আযমের স্বতঃস্ফূর্ত অনুসারী হতে হবে। তাতে করেই আল্লাহ্ পাক-এর রহ্মতে আমাদের কামিয়াবীর পথ প্রশস্ত হবে ইন্শাআল্লাহ্। (আমীন)