সমস্ত প্রশংসা মহান রব্বুল আলামীনের জন্য। যিনি আলীমুন হাক্বীম। সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালনি, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি অফুরন্ত দরুদ ও সালাম যিনি সত্য দ্বীন ও কিতাবসহ আবির্ভূত হয়েছেন মানুষের কল্যাণ কল্পে।
মুসলমানের মূল তার ‘ঈমান’। এক হিসেব মতে কুরআন শরীফে ‘ঈমান’ শব্দটি বিভিন্নভাবে মোট ৭৫২ বার এসেছে। ‘ঈমান’ এক বিশাল বৃক্ষসদৃশ। সত্তরের উর্ধ্বে তার শাখা-প্রশাখা বিস্তৃত। স্থান, কাল, পাত্র ভেদে ‘ঈমানের’ গতিমেয়তা বিভিন্নভাবে হতে পারে কিন্তু মূল অর্থে ‘ঈমানের’ বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতি তথা মাপকাঠি একই।
তবে আখিরী জামানার প্রেক্ষাপটে ঈমান সম্পের্কে বেশ কিছু সতর্কবাণী রয়েছে। কুরআন শরীফে বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে, “যারা একবার মুসলমান হয়ে, পরে পূনরায় কাফির হয়ে গেছে, আবার মুসলমান হয়েছে এবঙ আবারো কাফির হয়েছেএবঙ কুফরীতেই নিমজ্জিত থেকেছে আল্লাহ পাক না তাদেরকে ক্ষমা করবেন, না পথ দেখাবেন।” (সূরা নিসা/২৭) হাদীস শরীফে বলা হয়েছে, “আখিরী জামানায় মানুষ সকালে ঈমানদার থাকবে কিন্তু বিকালে কাফির হয়ে যাবে। আবার সন্ধ্যায় ঈমানদার থাকবে কিন্তু সকালে কাফির হয়ে যাবে।” (নাউযুবিল্লাহ)
‘ঈমান’ অতি সূক্ষ্ম ও স্পর্শকাতর বিষয়। ঈমান মূলতঃ আক্বাঈদের উপর স্থাপিত। কাজেই বে-খেয়ালজনিত বা বে-ফাঁস কথার দ্বারাও তাৎক্ষনিকভাবে ঈমান াপসারিত হতে পারে। এদিকটির প্রতি লক্ষ্য রেখেই ঈমান তথা ঈমানী জজবা ঠিক রাখার জন্য বিভিন্ন আমলের প্রতি উৎসাহ দেয়া হয়েছে। যেমন, হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, “তোমরা বেশী বেশী ‘কালেমা শরীফ’ পাঠ করে ঈমানকে নবায়ন কর।”
বস্তুতঃ আখিরী জামানায় ইসলাম বিবর্জিত আবহ তথা সুদ-ঘুষ, দুর্নীতি, জঘণ্য বে-পর্দা, আর বে-শরাই নয় বরং কথিত আলিম দাবীদারদের উদ্ভাবিত অনেক বিজাতীয় আমল এবঙ বিদয়াতী এত্বেকাদের প্রচারও সাধারণ মানুষের ঈমানকে বাতাসে দোল খাওয়ার মত বার বার স্থানচ্যুত করছে। যে প্রসং্গে হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, “আখিরী জামানায় একদল মিথ্যাবাদী দাজ্জাল বের হবে; তারা এমন সব কথা বলবে, যা তোমরা শোননি, তোমাদের বাপ-দাদা চৌদ্দ পুরুষ শোনেনি।”
পক্ষান্তরে যেসব শব্দ, কথা, পারিভাষিক চেতনা, আবহমানকাল ধরে মুসলমানদের ঈমান-আমল, আখলাক, চেতনা ও মূল্যবোধ তথা জজবার ক্ষেত্রে প্রাণ সঞ্চার করে আসছে সেসব পারিভাষিক শব্দ অনুশীলন, প্রতিফলন ও মূল্যায়ণে তাদের আদেৌ কোন চেতনা বোধ নেই। মূলতঃ নিজেদের অযোগ্যতা, অসততা, অনাচারই তাদেরকে এরূপ গাফিলের পর্যায়ভূক্ত করেছে।
এদেশের ধর্মপ্রাণরা, আগে ধর্মবেত্তাদের চেহারায় নূর দেখতে পেত। যিনি ধর্ম যত সঠিক ভাবে পালন করেন, যিনি অধর্ম করেননা, পাশাপাশি আল্লাহ তায়ালার সাথে গোপন ও সুদৃঢ় তায়াল্লুক বা সম্পর্ক স্থাপনে যিনি সফল অর্থাৎ যিনি সত্যিকারের ওলী আল্লাহ তাঁর চেহারায় যে নূর থাকবে এবঙ ইন্তিকালে সে নূরের আরো মহিমা প্রকাশ পাবে আর তার বিপরীতে যাদের চেহারায় নূর অনুপস্থিত বরং এক প্রকার বিকৃতভাব তথা বদ লক্ষণ প্রায় সুস্পষ্ট, তারা যে ধর্মের লেবাসে থাকলেও আসলে ধর্মব্যবসায়ী এবঙ তাদের মৃত্যুতে তাদের চেহারার বিকৃতি ঘটবে এই বোধ ও অনুভূতির প্রচার কিছুদিন আগে পর্যন্তও অব্যাহত ছিল। আর বর্তমানে নামধারী আলিমদের ক্ষেত্রে সে সূক্ষ্মনুভূতি প্রচারের ধারা একেবারেই শুন্যের কোঠায়। কিন্তু তার পরেও হক্কানী ওলী আল্লাহগণের হিদায়েতের সঞ্জীবিত ধারায়, বর্ষীয়ান ও সচেতন ধর্মপ্রাণগণ কথিত ধর্মবেত্তাদের চেহারায় নূর খোজার কোশেশ করে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হন। আর এই ব্যর্থতাই নামধারী আলিমদের এ বিষয়ে নিশ্চুপ থাকার প্রকৃত কারণ।
একইভাবে তারা নিশ্চুপ আরো অনেক বিষয়ে। খাহেশাতে নফস, ক্ষমতার লোভ, প্রচার ও পরিচিআকাঙ্খা, লোক দেখানো ইবাদত বা রিয়া, ছুফী বা আলিম পরিচয়ে থাকার পরও শয়তানের ধোকায় পড়ে বরবাদ হয়ে যাওয়ার হাজারো ঘটনার ইতিহাস ইত্যাদি বিশেষরূপে পর্যালোচনা এবঙ তদপ্রেক্ষিতে সমসাময়িক ক্ষেত্রগুলো থেকে নিজেদের হিফাযতের দিকে তাদের কোন ভ্রুক্ষেপ পরিলক্ষিত হয়না। খাহেশাতের কারণে প্রচার ও পরিচিতির আকাঙ্খায় তারা ছবি তোলে আর শয়তানের ধোকায় পড়ে তারা মাওসেতুং এর লংমার্চ, গান্ধীর হরতাল, খ্রীষ্টানদের মেৌলবাদ, ইহুদী-নাছারার গণতন্ত্র, ব্লাসফেমী আইন, কুশপুত্তলিকা দাহ ইত্যাদি হারাম কাজকে হালাল বলে কুফরী করে।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় আজকে তারা ঐ সমস্ত বিদয়াতী শব্দ ও আমলের সাথে মুসলমানদের ওতপ্রোতভাবে জড়িত করে চিরকালীন ঈমানী জজবার সাথে সম্পৃক্ত ইসলামী মূল্যবোধ যুক্ত পারিভাষিক চেতনাবোধ থেকে দূরে সরিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর।
তাই এদের মুখে, কলমে, পদক্ষেপে আদৌ আওয়াজ নেই, কালেমার বাতেনী উপলব্ধিতে, নামাযের খুশু-খুজু, রোযার-তাকওয়া, হজ্বের-মকবুলিয়াত, আত্মার ইছলাহ, ইখলাছ তথা মোরাকাবা-মোশাহাদা, রিয়াজত-মুশাক্কাত, আল্লাহ পাক-এর জাত ও সিফতের মারিফাত ও মুহব্বত লাভে ঈমানের ত্রিস্তর যথাক্রমে ইলমুল ইয়াকীন, আইনুল ইয়াকীন এবঙ হক্কুল ইয়াকীন ইত্যাদি অর্জন তথা চর্চার ক্ষেত্রে।
অথচ ইতিহাস স্বাক্ষী দেয়, যে যুগে যে সম্প্রদায় এসব ইসলামী পারিভাষিক চেতনা ও উপলব্ধির সাথে যত বেশী সম্পৃক্ত ছিল তাদের দ্বারাই তত বেশী ইসলামের সঠিক, সুন্দর ও সফল খিদমত সাধিত হয়েছিল। “খিলাফত আলা মিনহাজিন নুবুওওয়ার” নিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল্ আর যারাই এই চেতনাবোধ ও চর্চা থেকে গাফিল ছিল তারাই বিজাতীয় ও বিদয়াতী কর্মসূচীতে জড়িয়ে গোমরাহদের অন্তর্ভূক্ত হয়েছিল।
আর এখনও দেখা যাচ্ছে ধর্মব্যবসায়ীরা এই সব বিদয়াতী শব্দসূচী ও কর্মসূচীতেই আনন্দ লাভ করে। আল্লাহ পাক বলেন, “যখন খাটিভাবে আল্লাহ পাক-এর নাম উচ্চারণ করা হয়, তখন যারা পরকালে বিশ্বাস করেনা তাদের অন্তর সংকুচিত হয়ে যায়। আর যখন আল্লাহ পাক ব্যতীত অন্য উপাস্যদের নাম উচ্চারণ করা হয়, তখন তারা আনন্দে উল্লসিত হয়ে উঠে।” (সূরা আল যুমার/৪৫)
আল্লাহ পাক অন্যত্র বলেন, “যে ব্যক্তি তার পালনকর্তীার পক্ষ থেকে আগত নিদর্শন অনুসরণ করে সে কি তার সমান, যার কাছে তার মন্দ কর্ম শোভনীয় করা হয়েছে এবঙ যে তার খেয়াল খুশির অনুসরণ করে।” (সূরা মুহম্মদ/১৪)
স্মর্তব্য, খাহেশাতে নফসের অনুসরণকারী ওলামায়ে “ছূ” আর হক্কানী-রব্বানী ওলী আল্লাহ কখনও এক নয়্ আর কেবলমাত্র হক্কানী ওলীআল্লাহ তথা মুজাদ্দিদে আযমের ছোহবতেই ঈমানী চেতনা ও জজবাপ্রাপ্তি সম্ভব।