মানতিক শাস্ত্রের প্রখ্যাত ইমাম, হযরত ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর জীবনীতেও এর নজীর পাওয়া যায়। তিনি যখন মানতিক শাস্ত্রের ইমাম রূপে প্রসিদ্ধি লাভ করে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করলেন তখন তাঁর সুখ্যাতিতে বাদশাহও প্রীত হলেন। এত বড় একজন ইমাম তার দেশের অধিবাসী হওয়ায় দেশের গৌরব বহুগুণে বেড়েছে বলে বাদশাহ মনে করলেন এবং স্বগৌরবে সরাসরি শাহী দরবারের সাথে সম্পৃক্ত করার জন্য বাদশাহ ইচ্ছা পোষণ করলেন যে, আসন্ন ঈদে শাহী ঈদগাহে হযরত ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী রহমতুল্লাহি আলাইহি ঈদের নামায পড়াবেন। বাদশাহর এ অভিপ্রায় দূত মারফত পৌঁছানো হলো হযরত ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর কাছে।
তিনি অস্বীকার করলেন না। তবে বললেন, কিছু শর্ত রয়েছে যা যথাসময়ে ও পর্যায়ক্রমে জানানো হবে আর বাদশাহকে কিছুদিন অন্তর অন্তর লোক পাঠিয়ে তা জেনে নিতে হবে। এদিকে অন্য সব মাওলানা তো এমনিতেই বাদশাহ্র এতটুকু কৃপাদৃষ্টি লাভের জন্য ব্যাকুল থাকে। বাদশাহ্ যা বলেন তাতেই তারা সায় দেয়। সুতরাং নবাগত ইমাম ছাহেবের কি-ই বা আর শর্ত থাকতে পারে ভেবে বাদশাহ হযরত ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী রহমতুল্লাহি আলাইহি আসন্ন ঈদে শাহী ঈদগাহে ঈদের নামায পড়াবেন বলে সারাদেশে মহা ধুমধামে সে ঘোষণা দিয়ে দিতে বললেন। যথারীতি তা দেয়াও হলো; এবং সারাদেশের লোকজন তা খুব ভাল করে জানলো, বেশ একটা সাড়া পড়ে গেল।এরপর শর্ত মোতাবেক বাদশাহ আবারো দূত পাঠালেন ইমাম ছাহেবের কাছে, নতুন কোন কথা আছে কিনা। দূত আসলে ইমাম ছাহেব জানালেন, তাকে দিয়ে হবেনা, খোদ উজীরে আযমকে আসতে হবে, ইমাম ছাহেবকে দাওয়াত দেয়ার জন্য। ভিন দেশের বাদশাহর দরবারেও দূত মারফতেই রাজকীয় কাজ সম্পন্ন হয়, উজীরে আ’যমের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু ইমাম ছাহেবের সম্মানে বাদশাহ তাই মেনে নিলেন। উজীরে আ’যম আসলেন, ইমাম ছাহেবকে দাওয়াত দিলেন, ইমাম ছাহেব কবুল করলেন। কিন্তু বললেন, আরো শর্ত রয়েছে তবে তা ঈদের কয়েকদিন আগে জানানো হবে।
বাদশাহ তাও মেনে নিলেন। আর প্রচারণাও চললো খুব জোরদার ভাবে, রাজকীয় উদ্যোগে।
ঈদের কিছুদিন আগে উজীরে আ’যম আবারো গেলেন, ইমাম ছাহেবের কাছে নতুন শর্ত জানার জন্য। ইমাম ছাহেব বললেন, তিনি যেতে রাজী আছেন তবে তাকে বাদশাহর শাহী পালকি দিয়ে নিয়ে যেতে হবে; এবং আরো শর্ত আছে যা ঈদের অল্প কয়েকদিন আগে জেনে নিতে হবে।
বাদশাহর শাহী পালকি বাদশাহর জন্যই খাছ ছিল। বাদশাহর বাদশাহীর সাথেই তা সম্পৃক্ত ছিল। অপরদিকে হযরত ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী রহমতুল্লাহি আলাইহি শাহী ঈদগাহে নামায পড়াবেন এটাও এখন বাদশাহের বাদশাহী সম্মানের সাথে জড়িয়ে গেছে। অগত্যা বাদশাহ তাও কবুল করে নিলেন।
পাশাপাশি শাহী প্রচারনাও চললো ব্যাপকভাবে। সবাই একটা আলাদা উৎসাহে আবেগে রোমাঞ্চিত হতে লাগলো। শর্ত মোতাবেক উজীরে আ’যম মাত্র কয়েকদিন পূর্বে আবারো হাজির হলেন, ইমাম সাহেবের কাছে, নতুন কি কথা তা জানার জন্যে। ইমাম ছাহেব এবার বললেন, ঈদের দিন খোদ বাদশাহকে আসতে হবে ইমাম ছাহেবকে নেয়ার জন্যে। তবে আরো একটি শর্ত রয়েছে সেটা ঈদের দিন বাদশাহ আসলেই অত:পর জানানো হবে। উল্লেখ্য, শাহী ঘোষণা তখন এত বিস্তার লাভ করেছে, সবাই এতটা উদ্দীপিত হয়েছে, লোকজনে এতটাই জানাজানি হয়েছে যে, ঈদের দিন হযরত ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী রহমতুল্লাহি আলাইহি নামায পড়াবেন না একথা বরদাস্ত করার ক্ষমতা তখন দেশবাসীর ছিলনা। অগত্যা বাদশাহ উজীরে আযমসহ ঈদের দিন সকাল বেলা হাজির হলেন ইমাম ছাহেবকে শাহী ঈদগাহে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
এদিকে পূর্ব থেকেই বাদশাহর শাহী পালকি হাজির ছিল, শাহী বেহারারাও হাজির ছিল। শাহী সাজেই পালকিকে সজ্জিত করা হয়েছিল। কিন্তু তার পরেও ‘ঈদের দিন নতুন শর্ত জানানো হবে’ একথা মোতাবেক ইমাম সাহেব নতুন কথা জানালেন যে, বেহারারাদের সাথে সাথে পালকির একদিক ধরতে হবে বাদশাহকে অপরদিকে ধরতে হবে উজীরে আ’যমকে। শর্ত যখন জানানো হলো শাহী ঈদগাহে তখন প্রায় গোটা দেশবাসী উপস্থিত। পিন-পতন নীরবতা নিয়ে অধীর আগ্রহে সবাই অপেক্ষা করছে কখন হযরত ইমাম ফকরুদ্দীন রাযী রহমতুল্লাহি আলাইহি আসবেন। একদিকে অপেক্ষার তীব্রতা যত তুঙ্গে উঠেছে অপরদিকে জামাতের সময় তত নিকটবর্তী হচ্ছে। এমতাবস্থায় ঈদের নামাযের জামাত হযরত ইমাম ফকরুদ্দীন রাযী রহমতুল্লাহি আলাইহি পড়াবেন না এ ঘোষণা দেয়া আর বাদশাহের সিংহাসন উল্টে যাওয়া সমান কথা হয়ে গেছে। সুতরাং আর কোন দিক চিন্তা না করে অবনত মস্তকে বাদশাহ তাই মেনে নিলেন।
অতঃপর তৈরী হলো এক অভাবনীয় দৃশ্য। শাহী পালকিতে চড়লেন মানতিক শাস্ত্রের ইমাম, হযরত ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী রহমতুল্লাহি আলাইহি। আর শাহী বেহারারা ছাড়াও পালকির একদিক ধরলেন স্বয়ং বাদশাহ আর অপরদিকে খোদ উজীরে আ’যম। যথাসময়ে বহু প্রতীক্ষিত, বহু আলোড়িত, বহুকাঙ্খিত ঈদের জামাত সম্পন্ন হল। নামায শেষ হওয়ার সাথে সাথে হযরত ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী রহমতুল্লাহি আলাইহি খুতবায় দাঁড়িয়ে বললেন, আজকে যে ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা হয়েছে তার পিছনে মূলতঃ একটি মহৎ নিয়ত ছিল। বাদশাহ বা উজীর-নাযিরকে পালকির বেহারা বানানো উদ্দেশ্য ছিলনা। তবে যেহেতু নামধারী মাওলানারা আলিমদের মর্যাদা ভুলুণ্ঠিত করে বাদশাহ্র তোষামুদি করে, বাদশাহ্র কাছে নিজেদের হেয় প্রতিপন্ন করেছিলো, নিজেদের বিলিয়ে দিয়েছিলো, তারা বাদশাহর আজ্ঞাবহ দাসে পরিণত হয়েছিলো তদপ্রেক্ষিতে আলিমের মর্যাদা কিরূপ হওয়া উচিত তা প্রতিপন্ন করতে ইমাম ছাহেব এ ঘটনা ঘটালেন। এর দ্বারা প্রতীয়মান করা হলো যে, ইসলামের ধারক বাহক আলিম সমাজের অবস্থান ও মর্যাদা দেশের বাদশাহ্র চেয়েও বেশী। আলিম সমাজ আল্লাহ পাক এবং তাঁর হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মুখপাত্র। আর দেশের বাদশাহ জনগণের মুখপাত্র। সুতরাং আলিম সমাজ বাদশাহ বা সরকারের অধীন নয়। আলিম সমাজ ইসলাম প্রদত্ত ক্ষমতা বলেই ইসলামের রায় প্রকাশ করতে পারেন, ফতওয়া দিতে পারেন এবং তা বাদশাহর স্বীকার বা অস্বীকারের মুখাপেক্ষী নয়। বলাবাহুল্য, এ মূল্যবোধটি এখন এদেশের প্রেক্ষাপটেও বিশেষ আলোচনার বিষয়। ……. ……. ……
গত ২রা ডিসেম্বর/২০০০ ঈসায়ী নওগাঁ সদর উপজেলার আতিয়া গ্রামের গোলাম মোস্তফার ছেলে ছাইফূল তার স্ত্রী শাহিদাকে তিন তালাক দেবার পরও আবার ঘর-সংসার করার প্রেক্ষিতে বিষয়টি পত্র-পত্রিকা ও আদালত পর্যন্ত গড়ায়। এতদ্বপ্রেক্ষিতে সম্পাদক দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকা ও অন্য দু’জন আবেদনকারীর রীট আবেদন নং ৫৮৯৭/২০০০ এ ০১-০১-২০০১ ঈসায়ী তারিখে হাইকোর্ট যে রায় দেন সে প্রসঙ্গে পত্রিকায় মন্তব্য করা হয়ঃ “হাইকোর্টের রায়ে ফতোয়া জারি অবৈধ ঘোষণাঃ ইউএনবি ও বিবিসিঃ দেশের হাইকোর্ট গতকাল এক রায়ে সব ধরণের ফতোয়া জারি করাকে অবৈধ ঘোষনা করেছে। আদালত একই সাথে এরকম ফতোয়া জারিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করে আইন প্রণয়নের সুপারিশ করেছে। নওগাঁর এক গ্রামে এক দম্পতির বিয়ের ব্যাপারে এখানকার গ্রাম্য সালিশে যে ফতোয়া দেয়া হয়েছিলো তার বিরুদ্ধে জারি করা সুয়োমোটো রুল এবং সুয়োমোটো রুলের ভিত্তিতে গতকাল এ রায় ঘোষণা করে।
নওগাঁর গৃহবধু শাহিদা ও তার স্বামী সাইফুলের বিয়েকে ধর্মীয় ব্যাখ্যার ভিত্তিতে সেখানকার গ্রাম্য সালিশে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ তাদের রায়ে বলেছে, ঐ বিয়ে অবৈধ নয়। আদালত রায়ে আরো বলেছে, তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেয়া হয় ঐ বিয়ে ভেঙ্গে গিয়েছিলো সে ক্ষেত্রেও শাহিদার আবার সাইফুলকে বিয়ে করার ক্ষেত্রে কোন আইনগত বাধা নেই। বাংলাদেশ মুসলিম দম্পতিদের মধ্যে বিচ্ছেদ হয়ে গেলে ধর্মীয় নেতারা হিল্লা দিয়ে ফতোয়া দিয়ে থাকেন। হিল্লা বিয়ের মানে হচ্ছে কোনো মেয়ের বিবাহ বিচ্ছেদের পর আবার তার স্বামীকে বিয়ে করতে চাইলে তাকে অন্য এক পুরুষকে বিয়ে করতে হবে। এরপর ঐ পুরুষকে তালাক দিয়ে তিনি তার আগের স্বামীকে বিয়ে করতে পারবেন। কিন্তু আদালত গতকাল তার রায়ে বলেছে, এ ধরনের বিধান ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনের পরিপন্থি। উল্লেখ্য, হাইকোর্ট কেবল ফতোয়াকে অবৈধ ঘোষণা করেনি ফতোয়ার বিরুদ্ধে সংসদের আইন প্রণয়নেরও সুপারিশ করেছে। ফতোয়া জারির ঘটনাগুলোকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটরা যেন দ্রুত আমলে নেন হাইকোর্ট সেজন্য তাদেরকেও সতর্ক করে দিয়েছে।
অন্যদিকে অমুসলিম পারিবারিক আইন সম্পর্কে জনগণকে শিক্ষিত করে তোলার জন্য হাইকোর্ট স্কুল-কলেজের পাঠ্যক্রমে এটি অন্তর্ভুক্ত করতে বলেছে।” (দৈনিক ইনকিলাব, ২রা জানুয়ারী ২০০১)
উল্লেখ্য, হাইকোর্টের এই রায়ের প্রেক্ষিতে তখন নামধারী মাওলানা সমাজ এবং তথাকথিত ইসলামী রাজনীতিকগণও দৃশ্যতঃ ফুঁসে উঠেছিলেন। তারা এটাকে খোদ ইসলামের উপর হামলা বলে উল্লেখ করেছিলেন এবং ইসলামকে রক্ষার জন্য তথা ফতওয়া বিরোধী রায়কে বানচাল করার জন্য তাদেরকে ভোট দেয়ার আহবান করেছিলেন। সহজ সরল ধর্মপ্রাণ মুসলমান তাদের কথায় আন্দোলিত হয়ে ভোট দিলেন। তারা ক্ষমতায়ও আসলেন কিন্তু কথিত ইসলাম পক্ষের সরকারের ছত্রছায়ায় তারা আজ পর্যন্ত ফতওয়া বিরোধী রায়কে ভণ্ডুল করতে পারলেন না। অবাঞ্ছিত কাঁটার মত এখনও তা জাতির গলায় আটকে রয়েছে। এদিকে ফতওয়া বিরোধী রায়ের বিরুদ্ধে তারা যে তোড়জোড় দেখিয়ে ছিলেন তা দিনে দিনে কার্যত অসার আর মেকী প্রমাণিত হয়েছে। তারা তখন পত্রিকান্তরে বলেছিলেন, (ক) “…… ফতোয়াকে অস্বীকার করা বা খাটো করে দেখার সাথে কুরআন এবং সুন্নাহকে অস্বীকার করা বা খাটো করে দেখার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।” (দৈনিক ইনকিলাব, ৫ জানুয়ারী/২০০১) (খ) “…. কিন্তু পহেলা কথাইতো হলো ফতোয়া প্রদানের জন্য আইনের (সরকারের) অনুমোদনের শর্ত ইসলাম সম্মত নয়। কোন অবস্থাতেই আইন দ্বারা ফতওয়া নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে না। এটা প্রকারান্তরে ইসলামকেই নিয়ন্ত্রণ করার শামীল।” (দৈনিক ইনকিলাব, ৮ জানুয়ারী/২০০১) (গ) “পবিত্র কুরআন শরীফে অন্যত্র বলা হয়েছে, …অর্থাৎ তারা আপনার কাছে সিদ্ধান্ত জানতে চায় (হে রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), আপনি বলে দিন এটাই তোমাদের জন্য আল্লাহ পাক-এর সিদ্ধান্ত।” (সূরা নিসা/১৭৬) এরপর ফতওয়া প্রদানের জন্য পৃথিবীর কোন কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের প্রয়োজন পড়ে না। (দৈনিক ইনকিলাব, ৬ই জানুয়ারি/২০০১ ঈসায়ী) বলাবাহুল্য, সে সময় তারা আন্দোলনের সুবাদে এসব কথা বললেও কার্যতঃ যে তারা এ মূল্যবোধে আন্তরিকভাবে বিশ্বাসী নন বরং তারা ইসলামের নামে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারে বিশ্বাসী, ইসলামী রাজনীতির নামে হালুয়া রুটির স্বাদ অন্বেষণে আগ্রহী এখন তা বিশেষভাবে প্রমাণ করেছেন। কাদিয়ানীদের নিয়ে তাদের কর্মকা- এরূপই একটি। কাদিয়ানীদের নিয়ে তাদের কানামাছি ভো ভো খেলা রীতিমত হাস্যকর। যার অন্তরালে তাদের রাজনৈতিক ময়দান গরম করার পাশাপাশি ভিতরে ভিতরে কাদিয়ানী তথা সরকার দু’পক্ষ থেকেই সুবিধা আদায়ের প্রবণতা পরিষ্কার ভাবে প্রতিভাত। কাদিয়ানী প্রতিহত করণের নামে তারা দেশি-বিদেশী বহু সংগঠন করেছেন। কিন্তু আন্দোলনটা করছেন থেমে থেমে। অর্থাৎ রাজহাঁস একবারে না খেয়ে আদর-যত্ন করে বাঁচিয়ে রেখে বহুদিন ধরে তার ডিম খাবার মত ব্যবস্থা। আন্দোলন শুরু করে এসপার কি ওসপার করার মত প্রবণতা বা প্রচেষ্টা কখনই তাদের মধ্যে দেখা যায়নি। আর তা হবেই বা কি করে। কারণ কাদিয়ানীদের বিরোধিতা করতে গিয়ে তারা নিজেরাই নিজেদের বিরোধিতা করেছেন।
দেয় বিবৃতি থেকে দেখা যায়, ২০০০ সাল থেকে ফতওয়ার রায় বিরোধী আন্দোলনে তারা ফতওয়ার উপর রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপকে অনৈসলামিক, অনর্থক, অসহনীয় ও অগ্রাহ্যকর বলছেন। তারা বলছেন যে, ফতওয়া রাষ্ট্র মানুক বা না মানুক তাতে কিছু আসে যায় না, ফতওয়া দিতে হলে রাষ্ট্রের বা পৃথিবীর কোন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন লাগবে একথাকে তারা চরমভাবে অগ্রাহ্য করেছেন এবং একে সরাসরি ইসলামের উপর আঘাত ও কুরআনী আইনের খেলাফ বলেছেন।
কিন্তু কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণার দাবীতে তারা আবার রাষ্ট্রের মুখাপেক্ষীই হয়েছেন এবং হতে চাইছেন। এক্ষেত্রে তারাই আবার কর্তৃপক্ষের অনুমোদন তথা রাষ্ট্রের অনুমোদন চাইছেন।
তালাকের ফতওয়ার ক্ষেত্রে তারা হাইকোর্ট ফতওয়ার বিরুদ্ধে সংসদের আইন প্রণয়নের যে সুপারিশ করেছে তার বিরোধিতা করলেও কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে আবার ঠিকই সংসদে আইন প্রণয়নের কথা বলছেন।
উল্লেখ্য, হাইকোর্টের ফতওয়ার রায়ের বিরুদ্ধে তারা যদি ফতওয়াকেই সর্বোচ্চ বলে মানেন, হাইকোর্টের তোয়াক্কা না করেন তবে একইভাবে কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে তার ব্যত্যয় ঘটবে কেন?
কেন তারা কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে তাদের নিজস্ব ফতওয়ার উপর আশ্বস্ত নন? ‘কাদিয়ানীরা কাফির’ ইসলামের দৃষ্টিতে তাদের এ ফতওয়াই তো যথেষ্ট ছিল। যেখানে তারাই বলেছেন যে, ফতওয়া মূল্যায়নের জন্য কোন রাষ্ট্র বা কর্তৃপক্ষের অনুমোদন প্রয়োজন পড়ে না তবে কাদিয়ানীদের ক্ষেত্রে কোন অনুমোদন প্রয়োজন পড়েছে? কাদিয়ানীদের ক্ষেত্রে কি তারা এটাই বলতে চান যে, রাষ্ট্র যদি তাদের অমুসলমান ঘোষণা না করে, কাফির ঘোষণা না করে ততক্ষণ পর্যন্ত তারা কাফির হবে না মুসলমান থেকে যাবে। (নাউযুবিল্লাহি মিন যালিক)
অর্থাৎ কাদিয়ানীদের ক্ষেত্রে কি তারা রাষ্ট্রের মর্যাদা, সরকারের মর্যাদা ইসলাম ও আলিমের উপর অধিষ্ঠিত করতে চান? অথচ এ লেখার প্রথমে বর্ণিত কাহিনীর দ্বারা কি চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে যে ইসলামে আলিমের মর্যাদা, ফতওয়ার মর্যাদা রাষ্ট্র ও সরকারের চেয়ে অনেক উর্ধ্বে। বলাবাহুল্য, হযরত ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী রহমতুল্লাহি আলাইহি সেরূপ প্রজ্ঞাবান ও নির্লোভ এবং খালিছ ইসলামের জন্য নিবেদিত ছিলেন বলেই তিনি এরূপ দৃষ্টান্ত তৈরী করতে পেরেছিলেন।
পক্ষান্তরে আমাদের তথাকথিত কাদিয়ানী বিরোধিরা কিরূপ নজীর তৈরী করে তার বর্তমান উদাহরণ দেয়া গেলো।
এখানে উল্লেখ্য যে, কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে লোক দেখানো
সংগঠন একটি নয় বরং এক্ষেত্রে বিশেষ রকমের ফায়দার গন্ধ পেয়ে ব্যাঙের ছাতার মত অনেকগুলিই গজিয়েছে। এ ধরনেরই একটি হলো ‘আমরা ঢাকাবাসী।’ গত ২০ আগস্ট/২০০৪ ঈসায়ী এরা কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণা ও তাদের আস্তানাগুলো খুলে দেয়ার জন্য কাফন মিছিল ও ঘেরাওর কর্মসূচীর ডাক দেয়। দুপুর আড়াইটায় তারা সমাবেশ করে। সমাবেশে তারা ২৭ আগস্ট/২০০৪ ঈসায়ী যে কোন মূল্যে কাদিয়ানীদের উপসনালয় দখল করে নামায আদায়ের ঘোষণা দেয়। অতঃপর তাদের সভাপতির নেতৃত্বে কয়েক হাজার কর্মী আল্লাহ পাক-এর পথে শহীদ হওয়ার অঙ্গীকার করে কাফনের কাপড় পড়ে মিছিল করে বকশীবাজারের দিকে ছোটে। মিছিলে তারা শ্লোগান দেয়, ‘কাফির কাফির কাদিয়ানীরা কাফির।’ ‘ঢাকাবাসী জেগেছে, রক্তে আগুন লেগেছে।’ ‘আমরা সবাই মরতে রাজী, মরলে শহীদ বাঁচলে গাজী।’ ‘কাদিয়নীাদের আস্তানা ভেঙ্গে দাও গুড়িয়ে দাও।’
বেলা তিনটায় তারা কাদিয়ানীদের লোহার গেটের কাছে পৌঁছে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে এবং ধাক্কা দিয়ে গেট ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টা করে। জবাবে পুলিশও মিছিলকারীদের লাঠিপেটা করে। প্রায় দু’ঘণ্টাব্যাপী এই সংঘর্ষের এক পর্যায়ে পুলিশ দুই রাউন্ড শর্টগানের গুলি ও ছয় রাউন্ড টিয়ার গ্যাসের সেল নিক্ষেপ করলে তারা সব ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। (দৈনিক মানবজমিন, ২১শে আগস্ট ২০০৪)
উল্লেখ্য, মাত্র দুই ঘণ্টা আগে সেখানে তারা শহীদ হওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে যেখানে ‘মরলে শহীদ, বাঁচলে গাজী’ শ্লোগান ধরে সেখানে পুলিশের দুই রাউন্ড শর্টগানের গুলি ও ছয় রাউন্ড টিয়ার গ্যাসের সেল তাদের উচ্চকিত এ জিহাদকে সমূলে উৎপাটন করে দেয়।
এই হচ্ছে কাদিয়ানী বিরোধী স্বঘোষিত ‘আমরা ঢাকাবাসী’ মুজাহিদদের জিহাদী জজ্বার নমুনা ও ঈমানী তাকতের চিত্র।
এরপরের চিত্র আরো করুণ। এ সমাবেশে তারা ঘোষণা দিয়েছিলো যে, আগামী ২৭শে আগস্ট তারা যে কোন মূল্যে কাদিয়ানীদের উপাসনালয়ে নামায পড়বে। কিন্তু বাস্তবে যা হয় সে সম্পর্কে পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়, “আমরা ঢাকাবাসী আরও জঙ্গীরূপ ধারণ করে ২৭ আগস্ট কমপ্লেক্সটি দখলে নিয়ে সর্বস্তরের মুসল্লিদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ার কর্মসূচী ঘোষণা করে। ওই কর্মসূচীতে ঢাকার সর্বস্তরের মানুষকে অংশ নিতে আহ্বান জানানো হয়। অন্যদিকে বৃহস্পতিবার রাতে আমরা ঢাকাবাসীর সভাপতি হাজী শামসুল হক ও সাধারণ সম্পাদক জামাল নাসের চৌধুরীসহ ৪ জনকে পুলিশ গ্রেফতার করলে কর্মসূচীতে ভাটা পড়ে। শুক্রবার সরেজমিন দেখা গেছে, কোন লোক আহমদীয়া কমপ্লেক্স দখলে আসেনি। এ অবস্থায় চকবাজার শাহী মসজিদে জুমা নামাযের পর আকস্মিকভাবে কর্মসূচী স্থগিত করার ঘোষণা দেয়া হয়। ওই ঘোষণায় বলা হয়, দেশের সংঘাতময় পরিস্থিতিতে কর্মসূচী স্থগিত করা হচ্ছে। (দৈনিক জনকক্ত ২৮ আগস্ট/০৪)
পাঠক! অনুধাবনের বিষয় যে, ২০শে আগস্টে সামান্য পুলিশী চার্জ আর ২৬শে আগস্টে ৪ জনের সাময়িক গ্রেফতার তাদের তথাকথিত কাদিয়ানী বিরোধী আন্দোলনকে কিরূপ ধুলায় ধূসরিত করে দিলো। অথচ তারাই কাফন পড়ে নেমেছিলো। তারাই মুখে উচ্চারণ করেছিলো, ‘আমরা ঢাকাবাসী জেগেছে, রক্তে আগুন লেগেছে।’ ‘আমরা সবাই মরতে রাজী, মরলে শহীদ, বাঁচলে গাজী।’
মূলতঃ তাদের একথাগুলো যে কত বেশী লোক দেখানো, কত মরাত্মক ভাওতাবাজী, কত কপট, কত অসাঢ়, কত মেকী, কত বড় প্রতারণা, কত জঘন্য স্বার্থবাদী পায়তারা তা তাদের ঘটনাবলীর যত গভীরে যাওয়া যায় ততই পরিষ্কারভাবে উপলব্ধি করা যায়।
হাইকোর্টের ফতওয়া বিরোধী রায়ের ক্ষেত্রে তারা যেভাবে প্রতিবাদী দাবী করে ফতওয়ার উপর সরকারের তদারকি, সরকারের অনুমোদন কোন কিছু খাটবে না বলে তারা যেরূপ মেকী আন্দোলনের নামে মাঠ গরম করার পায়তারা করে। আবার সেই একই আন্দোলনকারীরা কাদিয়ানীদের ব্যাপারে সরকারের রায়ের জন্য কি নির্লজ্জকরভাবে দাবী জানাচ্ছে।
বলাবাহুল্য, এমন স্ববিরোধী মুনাফিকী চরিত্রের প্রকাশ হাল জামানায় দ্বিতীয়টি লক্ষ্য করা যায়না। মূলতঃ তাদের এরূপ স্বার্থবিরোধী উল্টো যবান আর কপট কাজের দ্বারা এটাই প্রতীয়মান হয় যে, আসলে ফতওয়া বিরোধী রায় বা কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণা কর্মসূচীর কোনটাতেই তাদের লিল্লাহিয়াত নেই, সত্যিকার ইসলামী মনোভাব বা নিঃস্বার্থ চেতনা নেই, খালিছ নিয়তে নেকী হাছিলের উদ্দেশ্য নেই। রয়েছে, কেবল এ দু’টো ইস্যুকে ব্যবহার করে যেখানে যেমন সেখানে তেমনভাবে খাটিয়ে সুবিধা আদায়ের লক্ষে তথাকথিত ইসলামী রাজনীতির ময়দান গরম করা, রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের কৌশল করা, দুনিয়াবী ফায়দা হাছিলের জন্য চাপ সৃষ্টি করা। যাদের সম্পর্কে হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে, “ঐসব নামধারী মাওলানা নিকৃষ্ট যারা দুনিয়া হাছিলের জন্য দ্বীন বিক্রি করে।” মূলতঃ এরাই আলিমের মর্যাদা লুক্তনকারী। এরাই ইসলামের মর্যাদা অবমাননাকারী। এদের নাক ধুলায় ধূসরিত হোক।
-মুহম্মদ মাহবুবুর রহমান, ঢাকা।
‘ইসলামের দৃষ্টিতে প্রাণীর ছবি তোলা, রাখা, আঁকা, দেখা হারাম’ মুজাদ্দিদে আ’যমের অনবদ্য তাজদীদ