ক্বারী মুহম্মদ আব্দুল বারী, গোড়ান, ঢাকা
মুহম্মদ সোহেলুর রহমান, রামপুরা, ঢাকা
সুওয়ালঃ সম্প্রতি ‘আহলে হাদীছ লাইব্রেরী ঢাকা’-এর সৌজন্যে প্রকাশিত একটি হ্যান্ডবিলে ‘শবে বরাত’ সম্পর্কে বিভ্রান্তিমূলক কতিপয় উক্তি করা হয়েছে। কুরআন-সুন্নাহ্র নিরিখে সেসব কতটুকু সঠিক তা আপনাদের বহুল পঠিত, তাজদীদী মুখপত্র ‘মাসিক আল বাইয়্যিনাত’ পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশ করলে বিভ্রান্তির নিরসণ হতো এবং সঠিক বিষয়টি উন্মোচিত হয়ে আওয়ামুন্ নাস খুবই উপকৃত হতো।
আপনাদের জ্ঞাতার্থে হ্যান্ডবিলের একটি মূল কপি প্রেরণ করা হলো। এতে আমাদের মনে যেসব প্রশ্নের উদয় হয়েছে তাহলো-
১. শবে বরাত কি? শবে বরাত-এর অর্থ কি? অর্ধেক ফারসী আর অর্ধেক আরবী সহযোগে শরীয়তে কোন নাম হতে পারে কি-না? শবে বরাত সম্পর্কে কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফে কোন তথ্য পাওয়া যায় কি-না?
২. কখন থেকে শবে বরাত শুরু হয়? শবে বরাত সম্পর্কে হযরত রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কোন নির্দেশ-বাণী আছে কি-না?
৩. অর্ধ শা’বানের রাতটি ভাগ্য রজনী নামে নামকরণ কি বিদ্য়াত?
৪. নফল ইবাদতের মাধ্যমে রাত্রি জাগরণ ও দিনের বেলায় রোযা পালন করা কি বিদ্য়াত?
৫. এর সমর্থনে সূরা দুখানের ৩-৪নং আয়াত শরীফ পেশ করা সঠিক কি-না? ‘লাইলাতুম্ মুবারাকাহ্’ বলতে ‘লাইলাতুল ক্বদরকে’ বুঝানো হয়েছে? না ‘শবে বরাতকে’ বুঝানো হয়েছে?
৬. শবে বরাতে রিযিক বৃদ্ধি করা হয় এবং কতজন জন্মগ্রহণ করবে ও কতজন মৃত্যুবরণ করবে তা ধার্য্য করা হয়। এটা কুরআন-সুন্নাহ্ সম্মত কি-না?
৭. অর্ধ শা’বানের রাতে আলফিয়াহ বা রাগায়িব নামক কোন নামায আছে কি-না?
৮. অর্ধ শা’বানের রাতে কবর যিয়ারত করা নাকি বিদ্য়াত?
৯. হালুয়া-রুটি ও রকমারি খাদ্য প্রস্তুত করা ও বিলি করা নাকি বিদ্য়াত?
১০. অর্ধ শা’বান উপলক্ষে আয়োজিত মাহ্ফিল বিদয়াত কি-না?
১১. শবে বরাত উপলক্ষে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও অফিস-আদালত ছুটি ঘোষণা করা নাকি বিদ্য়াত চর্চার সুযোগ দেয়া?
১২. সউদী আরবের দারুল ইফতার সাবেক প্রধান ‘আব্দুল আযীয আব্দুল্লাহ বিন বায’-এর শবে বরাত পালন করা ও এদিনে রোযা রাখা বিদ্য়াত বলে অভিহিত করা কতটুকু সঠিক?
আশা করি উল্লিখিত প্রশ্নসমূহের দলীলভিত্তিক জাওয়াব দানে বাধিত করবেন।
জাওয়াবঃ মহান আল্লাহ পাক স্বীয় কালাম পাকে ইরশাদ করেন,
فسئلوا اهل الذكر ان كنتم لاتعلمون.
অর্থঃ- “তোমরা আহলে যিকির তথা আল্লাহওয়ালাগণকে জিজ্ঞাসা কর, যদি তোমরা না জান।” (সূরা আম্বিয়া-৭)
যামানার তাজদীদী মুখপত্র মাসিক আল বাইয়্যিনাত উপরোক্ত আয়াত শরীফের হাক্বীক্বী মিছদাক। আল্লাহ পাক রব্বুল আলামীন-এর লক্ষ্যস্থল ওলী, যামানার মুজাদ্দিদ, মুজাদ্দিদে আ’যম, রাজারবাগ শরীফের হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলী-এর ওসীলায় এ পত্রিকাটি উম্মাহ্র জন্য শ্রেষ্ঠতম নিয়ামত যার প্রতিটি লিখাই আক্বীদা-আমল হিফাযতকারী ও পরিশুদ্ধকারী। প্রসঙ্গতঃ সুওয়ালে উল্লিখিত প্রশ্নসমূহের ধারাবাহিক জাওয়াব পেশ করা হলো-
(ধারাবাহিক)
৮. অর্ধ শা’বানের রাতে কবর যিয়ারত করা নাকি বিদ্য়াত?
এর জবাব হলো- না, অর্ধ শা’বানের রাতে কবর যিয়ারত বিদয়াত নয় বরং সুন্নত। সুন্নতকে বিদয়াত বলা কাট্টা কুফরী। কোন মুসলমান যদি কুফরী করে সে মুরতাদ ও কাফিরে পরিণত হয়। তার যিন্দিগীর সমস্ত আমল বরবাদ হয়ে যায়। বিবাহ করে থাকলে স্ত্রী তালাক হয়ে যায়। হজ্জ করে থাকলে তা বাতিল হয়ে যায়। তার ওয়ারিছ সত্ত্ব রহিত হয়ে যায়। তওবার জন্য তার সময় মাত্র তিনদিন। এর মধ্যে সে তওবা না করলে খিলাফতের পক্ষ হতে তার একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদ-। সে মারা যাবার পর তার জানাযা পড়ানো ও তাতে শরীক থাকা জায়িয নেই। তাকে কোন মুসলমান কবর স্থানে দাফন করা যাবেনা। বরং তাকে কুকুর শৃগালের মত কোন স্থানে পুঁতে রাখতে হবে।
উল্লেখ্য, অর্ধ শা’বানের রাতটি বিভিন্ন নামে নাম করণ করা হয়েছে। তন্মধ্যে একটি হচ্ছে, ليلة الزيارة. (লাইলাতুয্ যিয়ারাতি) অর্থাৎ কবর যিয়ারতের রাত।
মূলতঃ অর্ধ শা’বানের রাতে যিয়ারত করা হয় বলেই এ রাতকে যিয়ারতের রাত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এ রাতে যিয়ারত করা খাছ সুন্নতে রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অন্তর্ভুক্ত। যেমন এ প্রসেঙ্গ হাদীছ শরীফে বর্ণিত রয়েছে,
عن عائشة رضى الله عنها قالت فقدت رسول الله صلى الله عليه وسلم ليلة فاذا هو بالبقيع فقال اكنت تخافين ان يحيف الله عليك ورسوله قلت يا رسول الله انى ظننت انك اتيت بعض نسائك فقال ان الله تعالى ينزل ليلة النصف من شعبان الى السماء الدنيا فيغفر من اكثر من عدد شعر غتم كلب.
অর্থঃ- “হযরত আয়িশা ছিদ্দীকা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি আল্লাহ পাক-এর হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে কোন এক রাত্রিতে রাত্রিযাপন করছিলাম। এক সময় তাঁকে বিছানায় না পেয়ে আমি মনে করলাম যে, তিনি হয়ত অন্য কোন আহলিয়ার হুজ্রা শরীফে গেছেন। অতঃপর আমি তালাশ করে তাঁকে জান্নাতুল বাক্বীতে পেলাম। সেখানে তিনি উম্মতের জন্য আল্লাহ্ পাক-এর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছেন। এ অবস্থা দেখে আমি স্বীয় হুজরা শরীফে ফিরে আসলে তিনিও ফিরে এসে আমাকে বললেন, তুমি কি মনে করেছ, আল্লাহ পাক ও তাঁর রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আপনার সাথে আমানতের খিলাফ করেছেন! আমি বললাম, ইয়া রসূলাল্লাহ্ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমি ধারণা করেছিলাম যে, আপনি হয়তো আপনার অপর কোন আহলিয়ার নিকটে গেছেন। অতঃপর হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক শা’বানের ১৫ তারিখ রাত্রিতে পৃথিবীর আকাশে অবতরণ করেন। অর্থাৎ রহমতে খাছ নাযিল করেন। অতঃপর তিনি বণী ক্বাল্বের মেষের গায়ে যত পশম রয়েছে তার চেয়ে অধিক সংখ্যক বান্দাকে ক্ষমা করে থাকেন।” (তিরমিযী, ইবনে মাজাহ্, রযীন, মিশকাত)
উপরোক্ত হাদীছ শরীফে স্বয়ং আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর শা’বানের অর্ধ রাতে অর্থাৎ শবে বরাতে জান্নাতুল বাক্বী কবরস্থানে গিয়ে উম্মতের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। তাদের জন্য দু’আ করেছেন।
কাজেই অর্ধ শা’বানের রাতে কবর যিয়ারত করা খাছ সুন্নতে রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
(চলবে)
খন্দকার সেলিম আহমদ
পাহাড়কাঞ্চনপুর, টাঙ্গাইল
সুওয়ালঃ হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে প্রকাশিত অখ্যাত মাসিক পত্রিকা ফেব্রুয়ারী/২০০৫ ঈসায়ী সংখ্যায় জিজ্ঞাসা-সমাধান বিভাগে, মাসিক আল বাইয়্যিনাত-অক্টোবর ২০০৩ ঈসায়ী সংখ্যায় প্রদত্ত মীলাদ-ক্বিয়ামের সমালোচনা করতে গিয়ে যে বক্তব্যগুলো পেশ করেছে তন্মধ্যে যে বিষয়গুলো আমার নিকট সন্দেহজনক তা নিম্নে উল্লেখ করা হলো-
১. প্রচলিত মীলাদ-ক্বিয়াম উভয়টি নাজায়েয। কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা, কিয়াসে এর কোন প্রমাণ নেই। বরং বূযুর্গদের আমল দ্বারা প্রমাণিত। তাই যদি কেউ মহাবুযুর্গ হন, কুরআন সুন্নাহর মুকাবিলায় তার আমল দলীল হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়।
২. বাদশাহ মুজাফ্ফার উদ্দিন কৌকুরী এবং খাজা তক্বী উদ্দীন সুবকী যারা এই মীলাদ- ক্বিয়ামের প্রবর্তন করেন তাদের এ আমলটি কুরআন সুন্নাহর বিরোধী বিধায় তা শরীয়তের দলীল হিসেবে গ্রহণ যোগ্য নয়।
৩. নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সম্মানে ক্বিয়াম করার প্রমাণ হাদীছ শরীফে উল্লেখ নেই। হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সম্মানে ক্বিয়াম করেননি। (নাউযুবিল্লাহ)
৪. বরং মিশকাত শরীফে বর্ণিত হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত আছে যে, রসূলুল্লাহ্ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার সম্মানে দাঁড়ানোকে অপছন্দ করেছেন। (নাউযুবিল্লাহ)
৫. হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম, তাবিয়ীন, তাবে-তাবিয়ীন, চার মাযহাবের ইমাম রহতুল্লাহি আলাইহিমগণ থেকে নিয়ে শুরু করে ৭০০ (সাতশত) বছর পর্যন্ত কোন নবী প্রেমিক নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সম্মানার্থে বা মুহববতে ক্বিয়াম করেননি।
৬. পীর, ওস্তাদ, পিতা, শ্বশুর-শ্বাশুড়ী প্রমুখ সম্মানিত ব্যক্তিগণের সম্মানে দাঁড়ানো জায়িয। কারণ, তারা সামনে উপস্থিত। আর মীলাদে দাঁড়ানো জায়িয নেই। কারণ, রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অনুপস্থিত। (নাউযুবিল্লাহ)
৭. একজন নবীর পক্ষে একাধিক মীলাদ মাহফিলে উপস্থিত হওয়া সম্ভব নয়। (নাউযুবিল্লাহ)
আর এপ্রিল/২০০৫ ঈসায়ী সংখ্যায় জিজ্ঞাসা-সমাধান বিভাগে বলা হয়েছে, “আমাদের দেশে প্রচলিত মীলাদ ও ক্বিয়াম ইসলামী শরীয়ত পরিপন্থী, যা সম্পূর্ণভাবে মাকরূহ্ েতাহ্রীমি। আইম্মায়ে মুজতাহিদীন কারো থেকে এই প্রচলিত মীলাদ ও ক্বিয়াম প্রমাণিত নয়। তাছাড়া মীলাদ ও ক্বিয়াম সম্পর্কে কোন প্রকার হাদীসও বর্ণিত নেই। …..”
এছাড়া মাসিক মদীনা পত্রিকা ফেব্রুয়ারী/২০০৫ ঈসায়ী সংখ্যায় প্রশ্নোত্তর বিভাগে একই ধরনের জবাব দেয়া হয়েছে।
উল্লিখিত বক্তব্যের স্বপক্ষে দলীল হিসেবে তারা তাদের নিজেদের লিখিত কিছু কিতাবের নাম উল্লেখ করেছে যা মুতাবার বা নির্ভরযোগ্য নয়; অনুসরনীয় ইমাম মুজতাহিদগণের কিতাব থেকে কোন কিতাবের নাম দলীল হিসেবে উল্লেখ করেনি বা করতে পারেনি।
এখন আমার সুওয়াল হলো, প্রচলিত মীলাদ-ক্বিয়াম সম্পর্কিত তাদের উল্লিখিত বক্তব্য কতটুকু দলীল সম্মত? কুরআন, সুন্নাহ্, ইজমা ও ক্বিয়াসের দৃষ্টিতে দলীলভিত্তিক জাওয়াব দিয়ে আমাদের আক্বীদা, আমল হিফাযতে সহায়তা করবেন বলে আমরা আশাবাদী।
জাওয়াবঃ প্রচলিত মীলাদ-ক্বিয়াম সম্পর্কে হাটহাজারী মাদ্রাসার অখ্যাত মাসিক পত্রিকার জিজ্ঞাসার সমাধানে এবং অপর একটি পত্রিকার প্রশ্নোত্তর বিভাগে যা বলা হয়েছে তা শুদ্ধতো হয়নি বরং সম্পূর্ণই ডাহামিথ্যা, ভুল, মনগড়া ও দলীলবিহীন এবং অনুসরণীয় ইমাম-মুজতাহিদ ও ফক্বীহ্গণের সর্বজনমান্য ও স্বীকৃত বিশ্ববিখ্যাত ফিক্বাহ্ ও ফতওয়ার কিতাব সমূহের বক্তব্যের বিপরীত ও বিরুদ্ধমত। যা ইতোপূর্বে আমাদের “মাসিক আল বাইয়্যিনাত শরীফ”-এর অনেক সংখ্যায় খ-ন করে সঠিক ও দলীলভিত্তিক জাওয়াব দেয়া হয়েছে। আর ‘মাসিক আল বাইয়্যিনাত শরীফ’-এর জাওয়াবকে খ-ন করা হাটহাজারী মৌলভী ছাহেবদের পক্ষে আদৌ সম্ভব হয়নি, হবেও না ইনশাআল্লাহ্।
দ্বিতীয়তঃ আমাদের “গবেষণা কেন্দ্র মুহম্মদিয়া জামিয়া শরীফ, রাজারবাগ শরীফ-এর পক্ষ থেকে মীলাদ-ক্বিয়াম বিরোধীদের প্রতি চ্যালেঞ্জ দেয়া হয় যে, “কেউ যদি কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস দ্বারা মীলাদ-ক্বিয়াম নাজায়িয প্রমাণ করতে পারে, তাহলে তাকে দুই হাজার পাউন্ড পুরস্কার দেয়া হবে।”
কিন্তু এখন পর্যন্ত মীলাদ-ক্বিয়াম বিরোধীতাকারীরা ‘মুহম্মদিয়া জামিয়া শরীফ’-এর সে চ্যালেঞ্জ গ্রহণের হিম্মত দেখাতে সমর্থ হয়নি, হবেও না ইনশাআল্লাহ্।
এরপরেও হাটহাজারী এবং তাদের সকল সমজাতীয়রা বারবার মীলাদ-ক্বিয়াম সম্পর্কে বিনা তাহক্বীকে ও বিনা দলীলে উক্ত ভুলেরই পুনরাবৃত্তি করে যাচ্ছে।
যেমন, উল্লিখিত প্রথম বক্তব্যের প্রথমেই তারা বলেছে, “প্রচলিত মীলাদ-ক্বিয়াম উভয়টি নাজায়েয।”
এর জবাবে বলতে হয় যে, তাদের উক্ত বক্তব্য সম্পূর্ণই দলীলবিহীন, ডাহামিথ্যা ও কুফরীমূলক হয়েছে। কারণ, কুরআন শরীফের কোন্ আয়াত শরীফে প্রচলিত মীলাদ-ক্বিয়াম উভয়টি নাজায়িয বলা হয়েছে এবং হাদীছ শরীফের কোন্ হাদীছ শরীফে প্রচলিত মীলাদ-ক্বিয়াম উভয়টি নাজায়িয বলা হয়েছে, এবং ইজমা- ক্বিয়াসের কোথায়, কোন্ ইবারতে প্রচলিত মীলাদ-ক্বিয়াম উভয়টি নাজায়িয বলা হয়েছে, তা হাটহাজারীর মৌলভী ছাহেবরা কুরআন শরীফের আয়াত শরীফ, হাদীছ শরীফ এবং ইজমা ও ক্বিয়াসের ইবারতসহ দলীল উল্লেখ করেনি।
সুতরাং তাদের দলীলবিহীন, ইবারতবিহীন, মনগড়া ও ডাহামিথ্যা বক্তব্য মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, মহান আল্লাহ্ পাক বলেছেন,
هاتوا برهالكم ان كنتم صدقين.
অর্থঃ- “যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাকো, তাহলে দলীল-প্রমাণ পেশ কর।” (সূরা বাক্বারা-১১১)
আর মিথ্যাবাদীদের উপর আল্লাহ পাক-এর লা’নত। কারণ আল্লাহ পাক বলেন,
لعنت الله على الكذبين.
অর্থঃ- “মিথ্যাবাদীদের উপর আল্লাহ পাক-এর লা’নত।” (সূরা আলে ইমরান-৬১)
দ্বিতীয়তঃ উল্লিখিত প্রথম বক্তব্যের দ্বিতীয় অংশে তারা বলেছে, “কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা, ক্বিয়াসে-এর কোন প্রমাণ নেই।”
এর জবাবে বলতে হয় যে, তাদের এ বক্তব্যও ডাহামিথ্যা ও কুফরীমূলক হয়েছে।
কারণ, তারা তাদের এ বক্তব্যে “কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা, কিয়াস অস্বীকার করেছে। অথচ কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা, কিয়াসে-এর অনেক প্রমাণ রয়েছে।
(ধারাবাহিক)
তৃতীয়তঃ উল্লিখিত প্রথম বক্তব্যের তৃতীয় অংশে তারা বলেছে, “বরং বূযুর্গদের আমল দ্বারা প্রমাণিত।”
এর জবাবে বলতে হয় যে, হ্যাঁ কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা, ক্বিয়াসের বর্ণনা ছাড়াও প্রচলিত মীলাদ ক্বিয়াম অবশ্যই বুযুর্গদের আমল দ্বারাও প্রমাণিত।
আর বুযুর্গগণ কখনো কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা, ক্বিয়াসের খিলাফ আমল করেন না। বরং প্রকৃত বুযুর্গগণ কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস সম্মত আমলই করে থাকেন। সুতরাং আবারো প্রমাণিত হলো যে, প্রচলিত মীলাদ ক্বিয়াম কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা, ক্বিয়াস সম্মত এবং বুযুর্গদের আমল দ্বারাও প্রমাণিত।
চতুর্থতঃ উল্লিখিত প্রথম বক্তব্যের চতুর্থ অংশে তারা বলেছে, “তাই যদি কেউ মহাবুযুর্গ হন, কুরআন সুন্নাহর মুকাবিলায় তার আমল দলীল হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়।”
এর জবাবে বলতে হয় যে, যদি কেউ প্রকৃতপক্ষে মহাবুযুর্গ হয়ে থাকেন, তাহলে তিনি কখনোই কুরআন সুন্নাহর খিলাফ আমল করবেন না। তবে হ্যাঁ, কেউ যদি মহাবুযুর্গ নাম দিয়ে কুরআন সুন্নাহর খিলাফ আমল করে, তাহলে কুরআন সুন্নাহর মুকাবিলায় তার আমল দলীল হিসেবে যে গ্রহণযোগ্য নয় একথা আমরাও বলে থাকি। যেমন, বর্তমানে কেউ কেউ মহাবুযুর্গ নাম দিয়ে ইসলামের নামে ভোট, নির্বাচন,গণতন্ত্র করছে। কেউ আলিম, দরবেশ, শাইখুল হাদীছ, মুফাস্সিরে কুরআন, পীর ছাহেব, খতীব ইত্যাদি নাম দিয়ে হারাম ছবি উঠাচ্ছে। বেগানা মহিলার সঙ্গে পাশাপাশি বসে মিটিং করছে। বেপর্দা হচ্ছে, লংমার্চ, হরতাল, ব্লাসফেমী, মৌলবাদ, টিভি চ্যানেলে প্রোগ্রাম করছে, মূর্তি বানিয়ে ও পুড়িয়ে অর্থাৎ কুশপুত্তলিকা দাহ করছে- এ সব তথাকথিত মহাবুযুর্গ, আলিম, দরবেশ, শাইখুল হাদীছ, মুফাস্সিরে কুরআন, নামধারী পীর ছাহেবের আমল দলীল হিসেবে যে গ্রহণযোগ্য নয়, এটা আমরাও বলে থাকি।
আরো উল্লেখ্য যে, কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ক্বিয়াসে প্রচলিত মীলাদ-ক্বিয়ামের প্রমাণ যদি নাও থাকে তবুও প্রচলিত মীলাদ-ক্বিয়াম নাজায়িয হবে না। কেননা, কেউ প্রমাণ করতে পারবেনা যে, প্রচলিত মীলাদ-ক্বিয়ামের মধ্যে যে সকল আমল রয়েছে, এর একটিও শরীয়ত বিরোধী বা নাজায়িয। বরং এর প্রত্যেকটাই শরীয়তসম্মত ও জায়িয। যেমন- প্রচলিত মীলাদ শরীফের প্রথমেই পবিত্র কালামে পাক হতে তিলাওয়াত করা হয়।
অতঃপর সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি ছলাত অর্থাৎ দরূদ শরীফ পাঠ করা হয়। বরকত লাভের উদ্দেশ্যে “তাওয়াল্লুদ শরীফ” অর্থাৎ পবিত্র বিলাদতের বর্ণনা আলোচনা করা হয় এবং সম্মানার্থে ও আদব রক্ষার্থে ক্বিয়াম করে বা দাঁড়িয়ে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযুরে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি সালাম পাঠ করা হয়।
অতঃপর দোয়া করার জন্য বসে ছওয়াব রেসানী করে আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ্ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ওছীলা দিয়ে মুনাজাত করা হয়। যাতে বান্দা আল্লাহ পাক-এর সন্তুষ্টি ও আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ্ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সন্তুষ্টি হাছিল করতে পারে। এক কথায় মীলাদ মাহ্ফিলে তাই করা হয়।
তাহলে এত দলীল-আদিল্লাহ্ থাকার পরও কি করে একথা বলা যেতে পারে যে, ‘কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা, ক্বিয়াসে এর কোন প্রমাণ নেই?’
তবে বর্তমানে যেভাবে সুনির্দিষ্ট তর্জ-তরীকায় মীলাদ মাহ্ফিল হয় তা হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যামানাতে না থাকলেও বর্তমানে মীলাদ মাহ্ফিলে যেসব বিষয় পাঠ করা হয় সে সবগুলোই তাঁর যামানাতে ছিল। যেমন, দ্বীনি তা’লীম রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যামানাতে ছিল এবং উক্ত তা’লীম ছিল খাছ এবং সবদিক থেকে শ্রেষ্ঠ ও উত্তম।
কিন্তু বর্তমান কালের মত মাদ্রাসার ঘর, জামায়াত, রুটিন, সিলেবাস, কিতাবভিত্তিক পড়াশুনা ইত্যাদি সে যামানাতে ছিলনা। পরবর্তীতে ব্যাপকতার কারণে ইল্ম শিক্ষার উক্ত বিন্যস্ত তর্জ-তরীক্বার ইন্তিজাম করা হয়েছে। মূলতঃ মাদ্রাসার এই নিয়ম মাফিক শিক্ষার ব্যবস্থা এ জন্য করা হয়েছে, যাতে একজন শিক্ষার্থী অল্প দিনের মধ্যে ও সহজে ইল্ম হাছিলের যোগ্যতা অর্জন করতে পারে।
একইভাবে মীলাদ পাঠের নিয়ম করা হয়েছে এজন্য যে, যাতে কেউ অল্প সময়ের মধ্যে ও সংক্ষিপ্তভাবে আল্লাহ্ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ছানা-সিফত করতে পারে। মীলাদ মাহ্ফিলের ব্যাপারেও ঠিক তাই।
আর এটাকেই মূলত সুন্নতে উম্মত মুস্তাহাসান বলা হয়। যেমন, এর সমর্থনে হাদীছ শরীফে উল্লেখ আছে,
من سن فى الاسلام سنة حسنة فله اجرها واجر من عمل بها من بعده.
অর্থঃ- “যে কেউ দ্বীন ইসলামে উত্তম কোন পদ্ধতি উদ্ভাবন করবে (যা শরীয়ত সম্মত), তার জন্য সে ছওয়াব পাবে এবং তারপরে যারা এ পদ্ধতির অনুসরণ করবে, তার ছওয়াবও সে পাবে।” (মুসলিম, মিশকাত, শরহে নববী, ফতহুল মুলহিম, মিরকাত, আশয়াতুল লুময়াত, শরহুত্ ত্বীবী)
সুতরাং বর্তমানে যে পদ্ধতিতে মাদ্রাসায় ইল্মে দ্বীন শিক্ষা দেয়া হয়, যদি তা কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা, ক্বিয়াসসম্মত হতে পারে, তবে যার ছানা-সিফত করা ও যার প্রতি ছলাত-সালাম পাঠ করা আল্লাহ পাক-এর নির্দেশ ও সন্তুষ্টি পাওয়ার কারণ, তাঁর ছানা-সিফত ও তাঁর প্রতি ছলাত-সালাম পাঠ করার জন্য মীলাদ ক্বিয়ামের উক্ত পদ্ধতি কেন কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ক্বিয়াসসম্মত হবেনা? অবশ্যই এটা কুরআন শরীফ, হাদীস শরীফ, ইজমা, ক্বিয়াসসম্মত।
অতএব, উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা এটাই প্রমাণিত হলো যে, প্রচলিত মীলাদ-ক্বিয়াম উভয়টিতে যা পাঠ করা হয়, তা যেমন শরীয়াতের দৃষ্টিতে নাজায়িয নয়। তেমনি তা কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা, কিয়াসের নীতি বহির্ভূতও নয়।
আরো উল্লেখ্য, যা শরীয়তে নাজায়িয নয় এবং কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াসের নীতি বহির্ভূতও নয়; বরং বূযুর্গদের আমল দ্বারাও প্রমাণিত, তাকে নাজায়িয বলা কাট্টা কুফরী।
কারণ ইসলামী শরীয়তে তথা কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস এবং বূযুর্গদের আমল দ্বারা মীলাদ ও ক্বিয়ামের অস্তিত্ব প্রমাণ বা দলীলের অভাব নেই। চলমান জবাবে কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা, ক্বিয়াস তথা ফিক্বাহ্ ও ফতওয়ার অসংখ্য কিতাবের দলীল-আদিল্লাহ্ দ্বারা বিস্তারিতভাবে প্রমাণ করা হয়েছে যে, প্রচলিত মীলাদ-ক্বিয়াম সুন্নতে উম্মত মুস্তাহ্সান।”
সুতরাং প্রচলিত মীলাদ-ক্বিয়াম সম্পর্কে হাটহাজারী মাদ্রাসার অখ্যাত মাসিক পত্রিকার জিজ্ঞাসার সমাধানে যা বলা হয়েছে তা শুদ্ধ হয়নি। বরং সম্পূর্ণ ভুল, মনগড়া, ডাহামিথ্যা ও দলীলবিহীন এবং কাট্টা কুফরী হয়েছে। যা থেকে বেঁচে থাকা প্রত্যেক মুসলমানদের জন্য ফরজ, ওয়াজিবের অন্তর্ভূক্ত। (চলবে)
মুসাম্মত সানজিদা আক্তার
সভানেত্রী- ছাত্রী আঞ্জুমানে আল বাইয়্যিনাত
মুহম্মদপুর, ঢাকা
সুওয়ালঃ অখ্যাত মাসিক রাহমানী পয়গাম এপ্রিল/২০০৩ ঈসায়ী সংখ্যায় জিজ্ঞাসার-জবাব বিভাগে নিম্নোক্ত ১২৪৭নং জিজ্ঞাসার-জবাব ছাপা হয়-
জিজ্ঞাসা ঃ সাহাবী আবু সাঈদ খুদরী ও আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা বলেন যে, রাসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন আমার মৃত্যুর পর পূর্ব দেশগুলির মধ্য হতে কোন একটি দেশ থেকে আমার উম্মতের ভিতর হতে একটি দল বের হবে। এই দলের সদস্যগণ হবে অশিক্ষিত ও মূর্খ। এদের মধ্যে কোন শিক্ষিত লোক গেলে সেও হয়ে যাবে মূর্খের মত। তাদের বক্তৃতা হবে বহু বহু গুণের ফজিলতের। তাদের মত বক্তৃতা বা বয়ান কারো হবে না। তাদের সকল আমল হবে খুবই নিখূঁত ও সুন্দর। তাদের নামাযের তুলনায় তোমরা তোমাদের নামাযকে তুচ্ছ মনে করবে, তাদের রোযা দেখে তোমাদের রোযাকে তোমরা তুচ্ছ ও নগণ্য মনে করবে। তাদের আমল দেখে তোমরা তোমাদের আমলকে হেয় মনে করবে, তারা কুরআন পড়বে কিন্তু তা তাদের গলার নিচে যাবেনা। তারা কুরআনের উপর আমল কিম্বা কুরআন-প্রতিষ্ঠার একটু চেষ্টাও করবে না কখনো। এদলের আমল যতই তোমাদেরকে আকৃষ্ট করুক না কেন, কখনই তাদের দলে যাবেনা। কারণ প্রকৃতপক্ষে এরা হবে ইসলাম হতে খারিজ, দ্বীন হতে বহির্ভূত। তীর যেমন ধনুক হতে বের হয়ে যায় সে আর কখনও ধনুকের নিকট ফিরে আসেনা। তেমনিই এরা দ্বীন থেকে বেরিয়ে যাবে, আর কখনও দ্বীনের পথে, কুরআন ও সুন্নাহ্র পথে ফিরে আসবেনা।
আমার প্রশ্ন হল, উপরোক্ত হাদীছ ছহীহ্ কি-না? ছহীহ্ হলে এ দ্বারা উদ্দেশ্য কারা? উক্ত হাদীসের সাথে তাবলীগ জামাতের কোন সম্পর্ক আছে কি-না? অনেকে এই হাদীসের সাথে তাবলীগ জামাতকে জড়াতে চান। উক্ত হাদীসের সঙ্গে তাবলীগ জামাতকে জড়ানো সঠিক কি-না?
জবাবঃ প্রশ্নে বর্ণিত হাদীছ ছহীহ্। মুহাদ্দিছীনে কেরাম উক্ত হাদীছসহ এ জাতীয় হাদীছসমূহের ব্যাখ্যায় বলেছেন যে, এ সব হাদীছ দ্বারা একটি নির্ধারিত জামাত বা খারিজী ফেরক্বা নামে পরিচিত তাদেরকে বুঝানো হয়েছে।
হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এর খিলাফত আমলে এই হাদীছসমূহের বাস্তবতা এবং খাওয়ারেজদের অবস্থার সমন্বয় ঘটেছিল। যার দ্বারা একথা সুস্পষ্টভাবে বলা চলে যে, এ হাদীছসমূহ দ্বারা একমাত্র খাওয়ারেজদেরকেই বুঝানো হয়েছে। সুনির্দিষ্ট কোন প্রমাণাদি ছাড়া অন্য কোন জামাতকে এই হাদীসের অন্তর্ভুক্ত করা যাবেনা।
কোন প্রকার প্রমাণ ছাড়া তাবলীগ জামাতকে এই হাদীছসমূহের মেসদাক বা উদ্দেশ্য বানানো, তাদেরকে খাওয়ারেজ বলা শরীয়তের দৃষ্টিতে মারাত্মক অন্যায় ও অপরাধ। তাবলীগের নিয়মনীতি ও কার্যক্রম পুরোপুরি শরীয়তসম্মত। ইসলাম পরিপন্থী কোন কিছু এতে নেই। বর্তমান বিশ্বে আল্লাহ্ তা’আলা তাবলীগ জামাতের মাধ্যমে পথহারা, ঈমানহারা, হেদায়েত থেকে বঞ্চিত অসংখ্য মানুষকে হেদায়েত করেছেন, ঈমান আনার তাওফিক দান করেছেন। এছাড়া এ জামাতের পৃষ্ঠপোষকতায় রয়েছে অসংখ্য জগদ্বিখ্যাত আলেম ও ইসলামী চিন্তাবিদ।
অতএব, তাবলীগ জামাতকে খারেজী জামাত বলা, মিথ্যা অপবাদ বৈ কিছুই নয়। (ফতহুল বারী ১২ঃ৩৫০, আল মিরকাত ৭ঃ১০৭)
উক্ত অখ্যাত পত্রিকার উল্লিখিত “জিজ্ঞাসা-জবাবের” প্রেক্ষিতে আমার সুওয়াল বা জানার বিষয় হলো-
(১) উল্লিখিত হাদীছ শরীফে বর্ণিত গুণাবলী প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগীদের মধ্যে আছে কি?
(২) উল্লিখিত হাদীছ শরীফ দ্বারা কি শুধু খারিজী ফিরক্বার লোকদেরকেই বুঝানো হয়েছে? নাকি খারিজীদের ন্যায় আক্বীদা পোষণকারীদের ক্ষেত্রেও এ হাদীছ শরীফ প্রযোজ্য?
(৩) প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগীদের মধ্যে শরীয়ত বিরোধী বা ইসলাম পরিপন্থী কোন নিয়মনীতি বা আক্বীদা, আমল নেই, এটা কতটুকু সত্য?
(৪) প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগের পৃষ্ঠপোষকতায় বা পরিচালনায় যারা রয়েছে তারা সকলেই হক্কানী আলিম, এ দাবী কতটুকু সঠিক? আসলে হক্কানী আলিমের সংজ্ঞা বা পরিচিতি কি?
(৫) কুরআন-সুন্নাহ্র কোথাও প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগ করার নির্দেশ আছে কি? প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগ করা কুরআন-সুন্নাহ্ মতে জায়িয কিনা?
কুরআন, সুন্নাহ্, ইজমা ও ক্বিয়াসের দৃষ্টিতে দলীলভিত্তিক জাওয়াব দিয়ে আমাদের আক্বীদা, আমল হিফাযতে সহায়তা করবেন বলে আমরা আশাবাদী।
জাওয়াবঃ প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগ জামায়াত সম্পর্কিত উক্ত অখ্যাত পত্রিকার জবাব শুদ্ধ হয়নি। বরং ভুল, মনগড়া ও দলীলবিহীন হয়েছে।
শুধু তাই নয়, তারা প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগীদের সাফাই গাইতে গিয়ে বর্ণিত হাদীছ শরীফের অপব্যাখ্যা করেছে। সাথে সাথে “ছয় উছূলীদের মধ্যে কুরআন-সুন্নাহ্ বিরোধী কোন আক্বীদা-আমল নেই” বলে তাদের নির্লজ্জ দালালী করে নিজেদেরকে অপব্যাখ্যাকারী ও মিথ্যাবাদীরূপে সাব্যস্ত করেছে। সুওয়ালে উল্লিখিত বিষয়গুলোর ধারাবাহিক দলীলভিত্তিক আলোচনা করলেই তা আরো সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হবে।
তাই নিম্নে সুওয়ালে বর্ণিত বিষয়গুলোর দলীলভিত্তিক জাওয়াব দেয়া হলো-
(ধারাবাহিক)
ছয় উছূলী তাবলীগ সম্পর্কে প্রশ্নে
উল্লিখিত অখ্যাত পত্রিকার অপব্যাখ্যা
ও মিথ্যাচারীতার খ-নমূলক জবাব-৩
প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগ সম্পর্কে অখ্যাত পত্রিকার ‘জিজ্ঞাসার জবাবের’ প্রেক্ষিতে আপনার তৃতীয় সুওয়াল হলো- “(৩) প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগীদের মধ্যে শরীয়ত বিরোধী বা ইসলাম পরিপন্থী কোন নিয়মনীতি বা আক্বীদা-আমল নেই, এটা কতটুকু সত্য?”
আপনার উক্ত সুওয়ালের প্রেক্ষিতে বলতে হয় যে, অখ্যাত পত্রিকার উক্ত বক্তব্য মোটেও সত্য নয়, কেননা প্রচলিত ছয় উছূলীদের মধ্যে একটি দু’টি নয়, বরং অসংখ্য কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী নিয়মনীতি বা আক্বীদা-আমল ও বক্তব্য রয়েছে, যা তাদের মুরুব্বীদের লিখা কিতাবাদিতেই বিদ্যমান রয়েছে। তাই নিম্নে ধারাবাহিকভাবে, পর্যায়ক্রমে প্রচলিত ছয় উছূলীদের কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী ও কুফরীমূলক বক্তব্যগুলোর সাথে সাথে কুরআন-সুন্নাহ্র দৃষ্টিতে তার সঠিক ফায়সালা তুলে ধরা হলো-
প্রচলিত ছয় উছূলীদের কুরআন-সুন্নাহ
বিরোধী কুফরীমূলক বক্তব্য- ১৩
প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা বলে থাকে যে, “আলিম-জাহিল সকলেই দ্বীন প্রচার করবে এবং দ্বীনের তাবলীগের জন্য আলিম হওয়ার কোনই জরুরত নাই। কারণ, তারা মনে করে যে, দ্বীন প্রচার শুধু আলিমের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে দ্বীন ধ্বংস হয়ে যেত এবং এখনো যাবে। অর্থাৎ জাহিল লোক তাবলীগ করার কারণে দ্বীন টিকে ছিল এবং ভবিষ্যতেও টিকে থাকবে।” (তাবলীগ জামায়াতের সমালোচনা ও উহার সদুত্তর-৯৫ পৃষ্ঠা, মূলঃ শাঃ হাঃ জাকারিয়া সাহেব, অনুবাদক- মাওলানা মুহিব্বুর রহ্মান আহমদ এবং তাবলীগ গোটা উম্মতের গুরু দায়িত্ব নামক কিতাব-৯৪ পৃষ্ঠা, লেখক- মাওলানা ইসমাঈল হোসেন দেওবন্দী)
প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের এ বক্তব্য অত্যন্ত আপত্তিকর, বিভ্রান্তিমূলক ও কুরআন-সুন্নাহ্, ইজমা ক্বিয়াসের সম্পূর্ণ বিপরীত। যা স্পষ্টতঃ কুফরী।
দ্বিতীয়তঃ তারা লিখেছে যে, “শুধু আলিমদের মধ্যে দ্বীন প্রচার সীমাবদ্ধ থাকলে দ্বীন ধ্বংস হয়ে যেত আর জাহিলদের কারণে দ্বীন টিকে ছিল এবং টিকে থাকবে।”
তাদের এ বক্তব্যটি সরাসরি আল্লাহ পাক ও তাঁর রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি দোষারোপ করার শামীল। কারণ আল্লাহ পাক ও তাঁর রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামই তাবলীগে আমকে আলিমের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছেন। যা ইতিপূর্বের আলোচনা দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে। তবে কি আল্লাহ পাক ও তাঁর রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভুল করেছেন? (নাউযুবিল্লাহ্)
মূলতঃ কারো পক্ষেই প্রমাণ করা সম্ভব হবেনা যে, শরীয়ত সকল উম্মতের প্রতি তাবলীগে আমকে অপরিহার্য করেছে বা সকল উম্মতকেই দাওয়াতের কাজ করতে হবে সেকথা বলেছে। অবশ্য প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা সূরা আল্ ইমরান-এর ১১০নং আয়াত শরীফ-
كنتم خير امة اخرجت للناس تأمرون بالمعروف وتنهون عن المنكر.
অর্থঃ- “তোমরা শ্রেষ্ঠ উম্মত, তোমারদেরকে মানুষের জন্য বের করা হয়েছে তোমরা সৎ কাজে আদেশ ও বদ কাজে নিষেধ করবে।” এর ভিত্তিতে বলে থাকে যে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক, ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পর দ্বীনের দাওয়াতের দায়িত্ব সকল উম্মতের প্রতি অর্পিত হয়েছে।
বস্তুতঃ তাদের এ বক্তব্য সম্পূর্ণ ভুল হওয়ার কারণে তাদের প্রদত্ত দলীল মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ এ ব্যাপারে সকলেই একমত যে, উক্ত আয়াত শরীফখানা নাযিল হয়েছিল, হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুগণের শানে। অর্থাৎ হযরত ছাহাবায়ে কিরামরদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুগণকে বলা হয়েছে “তোমরা শ্রেষ্ঠ উম্মত তোমরা সৎকাজে আদেশ ও বদ কাজে নিষেধ করবে।” হযরত সাহাবা-ই-কিরাম যে, শ্রেষ্ঠ বা খায়রে উম্মত তার প্রমাণ হাদীছ শরীফেও রয়েছে।
যেমন হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,
خير امتى قرنى.
অর্থঃ- “শ্রেষ্ঠ বা খায়রে উম্মত হলো আমার যুগের উম্মতগণ।” অর্থাৎ হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুগণ। (বুখারী শরীফ, মিশকাত, ফাতহুল বারী, উমদাতুল ক্বারী, ইরশাদুস সারী, মিরকাত, লুময়াত, ত্বিবী, তালীক, আশয়াতুল লুময়াত, মুযাহিরে হক্ব)
মূলকথা হলো, উক্ত আয়াত শরীফে হযরত ছাহাবায়ে কিরামগণকে আমভাবে তাবলীগ বা দাওয়াতের কাজ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে আর এর মধ্যে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে, হযরত ছাহাবায়ে কিরামগণ প্রত্যেকেই দ্বীনের হাক্বীক্বী আলেম ছিলেন। অর্থাৎ মুবাল্লিগে খাছ ছিলেন।
অতএব, উক্ত আয়াত শরীফের দ্বারা আসলে একথাই বুঝানো হয়েছে যে, তাবলীগে আম আলিমদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আমভাবে সকল উম্মতের উপর তাবলীগে আমের দায়িত্ব দেয়া হয়নি।
সুতরাং প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের এ বত্তব্য “দ্বীন প্রচার আলিমের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে দ্বীন ধ্বংস হয়ে যেত” সম্পূর্ণই কুরআন, সুন্নাহ্, ইজমা, ক্বিয়াসের খেলাফ।
মূলতঃ মানুষের পক্ষে যেরূপ দ্বীন ধ্বংস করা সম্ভব নয়, তদ্রুপ দ্বীন হিফাজত বা টিকিয়ে রাখাও সম্ভব নয়। কাজেই “আলিমের মধ্যে দ্বীন প্রচার সীমাবদ্ধ থাকলে দ্বীন ধ্বংস হয়ে যেত বা মূর্খ লোকেরা দ্বীন প্রচার করার কারণেই দ্বীন টিকে আছে”- এ ধরণের বক্তব্য পেশ করা সম্পূর্ণ কুফরী-শিরকীর অন্তর্ভূক্ত।
কারণ এ দ্বীন যমীনে টিকিয়ে রাখার ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহ পাক-এর। যে কারণে আল্লাহ্ পাক কুরআন শরীফে ইরশাদ করেন,
انا نحن نزلنا الذكر وانا له لحفظون.
অর্থঃ- “নিশ্চয় আমি কুরআন শরীফ (দ্বীন) নাযিল করেছি এবং নিশ্চয় আমিই তার হিফাযতকারী।” (সূরা হির্জ-৯)
অতএব, মানুষের পক্ষে দ্বীনের হিফাযত করা কখনোই সম্ভব নয়। এ দ্বীনের হিফাযতের দায়িত্ব যদি মানুষের উপর থাকতো তবে এ দ্বীন অনেক আগেই পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত।
এ প্রসঙ্গে ইমাম কুরতুবী রহমতুল্লাহি আলাইহি একটি ঘটনা বর্ণনা করেন, খলীফা মামুনুর রশীদের দরবারে, কুরআন হাদীছ, জ্ঞান-বিজ্ঞান ইত্যাদি নানা বিষয়ে জ্ঞানমূলক আলোচনা হতো, যাতে সর্ব বিষয়ে যারা বিশেষ জ্ঞানে জ্ঞানী, এ ধরণের আলেম, ফাযিল, জ্ঞানী, বিজ্ঞানীগণ অংশগ্রহণ করতো, এতে উপস্থিত থাকতো এক ইহুদী পন্ডিত, যে সর্ব বিষয়েই খুব জ্ঞানমূলক বক্তব্য রাখতো। তার জ্ঞানের পরিধি দেখে, মামুনুর রশীদ তাকে মুসলমান হওয়ার জন্য একথা বলেছিল যে, সে মুসলমান হলে তাকে সবদিক থেকে সুযোগ-সুবিধা দেয়া হবে। কিন্তু সে তার পৈত্রিক ধর্ম ত্যাগ করতে অস্বীকার করে সেখান থেকে চলে গেল।
এরপর সে পুণরায় এক বৎসর পরে মামুনুর রশীদের দরবারে আসলো, এসে যথারীতি আলোচনা সভায় যোগ দিয়ে, ইসলামী ফিক্বাহ্ সম্পর্কে খুব জ্ঞানমূলক বক্তব্য রাখলো। এ বক্তব্য শুনে মামুনুর রশীদ তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি কি গত বৎসর এখানে এসেছিলে? সে বললো হ্যাঁ, তখন খলীফা বললো, তখন তুমি দ্বীন ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকার করে এখান থেকে চলে গিয়েছিলে, এখন তুমি কি কারণে মুসলমান হলে?
সে বললো যে, এখান থেকে গিয়ে ধর্ম সম্পর্কে গবেষণা করতে ইচ্ছা করলাম। আর আমি হলাম একজন বিশিষ্ট হস্তলেখা বিশারদ। আমি নিজের হাতে কিতাব লিখে খুব উচ্চমূল্যে বিক্রয় করে থাকি। আমি পরীক্ষার উদ্দেশ্যে তাওরাতের তিন কপি খুব সুন্দর করে লিখলাম এবং প্রত্যেকটির মধ্যেই নিজ থেকে কিছু কম-বেশী করলাম। এগুলো নিয়ে ইহুদীদের উপাসনালয়ে যখন গেলাম, তারা খুব সুন্দর দেখে অত্যন্ত আগ্রহের সাথে কিনে নিল। এভাবে ইঞ্জিলের তিন কপি লিখলাম, তার প্রত্যেকটির মধ্যেও নিজ থেকে কিছু কম-বেশী করলাম এবং সেগুলো নিয়ে খ্রীষ্টানদের উপাসনালয়ে গেলাম। তারাও খুব সুন্দর দেখে কিনে নিল।
এরপর কুরআন শরীফেরও খুব সুন্দর করে তিন কপি লিপিবদ্ধ করলাম। তার মধ্যে প্রত্যেকটিতে নিজ থেকে কিছু কম-বেশী করলাম। সেগুলো নিয়ে মুসলমানদের কাছে গেলাম। তখন মুসলমানেরা উল্টিয়ে-পাল্টিয়ে যাচাই-বাছাই করে দেখলো, নির্ভুল কিনা? যখন সেগুলি তারা ভুল বা কম-বেশী দেখলো, তখন তারা তা ফেরত দিল। এই ঘটনা থেকে আমি এই শিক্ষাই গ্রহণ করলাম যে, কুরআন শরীফ হুবহুই সংরক্ষিত আছে। আল্লাহ পাক নিজেই এর সংরক্ষণ করছেন। এটি দেখেই আমি মুসলমান হলাম।
এ ঘটনার বর্ণনাকারী হযরত কাজী ইয়াহিয়া বিন আকতাম রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, ঘটনাক্রমে সে বছরই আমার হজ্ব করার সৌভাগ্য হয়। সেখানে বিশিষ্ট আলিম ইমাম সুফীয়ান ইবনে ওয়াইনা রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর সাথে সাক্ষাত হলে ঘটনাটি তার কাছে ব্যক্ত করলাম। তিনি বললেন, নিঃসন্দেহে এটাই স্বাভাবিক এবং কুরআন শরীফেও এর সমর্থন রয়েছে। কাজী ইয়াহিয়া বিন আকতাম জিজ্ঞাসা করলেন, কোন্ আয়াত শরীফে? ইমাম সুফিয়ান রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন যে, কুরআন শরীফে যেখানে তাওরাত,
ইঞ্জিলের আলোচনা করা হয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে,
بما استحفظوا من كتب الله.
অর্থঃ- “ইহুদী খ্রীষ্টানদেরকে আল্লাহ পাক-এর কিতাব তাওরাত ও ইঞ্জিলের হিফাযতের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।” (সূরা মায়িদা-৪৪)
যখন ইহুদী খ্রীষ্টানরা হিফাজতের কর্তব্য পালন করেনি তখন এ কিতাবদ্বয় বিকৃত ও পরিবর্তিত হয়ে বিনষ্ট হয়ে গেছে।
পক্ষান্তরে কুরআন শরীফ সম্পর্কে আল্লাহ্ পাক বলেন,
وانا له لحفظون.
অর্থঃ- “নিশ্চয় আমিই এর সংরক্ষক।” (সূরা হির্জ-৯)
অর্থাৎ আল্লাহ পাক স্বয়ং এর হিফাযতকারী হওয়ার কারণে কেউ হাজারো কোশেশ করেও এর একটা জের, জবর বা নক্তা পর্যন্ত পরিবর্তন করতে পারেনি।
অতএব, এ দ্বীনের হিফাযতকারী যেহেতু আল্লাহ্ পাক সেহেতু এ দ্বীন এখনো পৃথিবীতে বহাল অবস্থায় আছে এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত থাকবে। তবে মুবাল্লিগগণ যার যার ক্ষেত্র অনুযায়ী দ্বীনের দাওয়াত মানুষের নিকট পৌঁছে দিয়ে দ্বীনের খাদেম হতে পারেন, এর বেশী কিছুই নয়।
আর কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজ্মা, ক্বিয়াসের দ্বারা একথাই প্রমাণিত হয় যে, মূর্খ লোকের দ্বারা দ্বীনের খেদমত হওয়াতো দূরের কথা, দ্বীনের ক্ষতিই বেশী হয়ে থাকে। (চলবে)
মুহম্মদ সুলতান মাহমুদ, মিরপুর, ঢাকা
মুহম্মদ আহমদুল্লাহ কামালী
মাধবদী, নরসিংদী।
সুওয়ালঃ মাসিক মদীনা ফেব্রুয়ারী/ ২০০৫ ঈসায়ী সংখ্যায় প্রশ্নোত্তর বিভাগে নিম্নোক্ত প্রশ্নোত্তর ছাপা হয়-
প্রশ্নঃ চুল…রাখার সুন্নত কি?……
উত্তরঃ…চুল রাখার দুই তরীকা, এক বাবরি রাখা, দুই মুণ্ডানো।….(শামী, আলমগীরী, বুখারী, মুসলিম)
আর হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে প্রকাশিত অখ্যাত মাসিক পত্রিকা এপ্রিল/২০০৫ ঈসায়ী সংখ্যায় জিজ্ঞাসা-সমাধান বিভাগে বলা হয়েছে, “মাথা মুন্ডানো যদিও রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে হজ্বের মৌসুম ব্যতীত পাওয়া যায় না, কিন্তু হযরত আলী (রাযি.) থেকে মাথা মুন্ডানোর বর্ণনা পাওয়া যায় এবং হযরত আলী (রাযি.) এর এই আমলের উপর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্বীকৃতি পাওয়া যায়। তাই সাহাবীর আমল হিসেবে মাথা মুন্ডানো সুন্নাত। অন্য এক রেওয়ায়াতে আছে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাথা মুন্ডন কারীদের জন্য তিন বার রহমতের দোয়া করেছিলেন। আর হানাফী মাযহাবের গ্রহণযোগ্য কিতাবাদিতেও মাথা মুন্ডানোকে সুন্নাত বলা হয়েছে। (ফাত্ওয়ায়ে আলমগীরি ও শামী)
এখন আমার সুওয়াল হলো- মাথা মুন্ডন করা সম্পর্কে মাসিক মদীনা ও হাটহাজারী মৌলভীদের উক্ত বক্তব্য সঠিক হয়েছে কি? আর সত্যিই কি মাথা মুন্ডন করা সুন্নত বা চুল রাখার দুই তরীকার, এক তরীকা? দলীলসহ সঠিক জাওয়াব দিয়ে, আমাদের আক্বীদা আমল হিফাযতে সহায়তা করবেন বলে আমরা আশাবাদী।।
জাওয়াবঃ
মাথা মুণ্ডন করা সুন্নত নয় বা চুল
রাখার কোন তরীকাই নয়; বরং বাবরী
চুল রাখাই সুন্নত
মাথার চুল মু-ন করা সম্পর্কে মাসিক মদীনা ও হাটহাজারী মৌলভীদের উক্ত বক্তব্য সঠিক হয়নি। বরং ভুল ও অশুদ্ধ হয়েছে। কারণ, মাসিক মদীনা ও হাটহাজারী মৌলভী ছাহেব এবং তাদের সমজাতীয়রা এমন একটি হাদীস শরীফ উল্লেখ করতে পারবে না, যেখানে উল্লেখ আছে যে, “আল্লাহ্ পাক-এর রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নুরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ্ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হজ্ব ও ওমরা ব্যতীত অন্য সময় নিজ মাথার চুল মুবারক মুন্ডন করেছেন।”
বরং অসংখ্য ছহীহ্ হাদীস শরীফ দ্বারা প্রমাণিত যে, আল্লাহ্ পাক-এর রসূল, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সব সময় বাবরী চুল মুবারক রাখতেন। সেহেতু সকল উম্মতে মুহম্মদীর জন্য সর্বদা বাবরী চুল রাখাই দায়েমী সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত।
(ধারাবাহিক)
বাবরী চুল সুন্নত-এর পক্ষে কতিপয় দলীল
নিম্নে আমরা অসংখ্য হাদীস শরীফ থেকে কয়েকখানা হাদীস শরীফ পেশ করলাম।
যেমন, “বুখারী শরীফ” কিতাবের ২য় খন্ডের ৮৭৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
حدثنى عمروبن على قال حدثنا وهب ابن جرير قال حدثنا ابى عن قتادة سالت انس بن مالك رضى الله تعالى عنه عن شعر رسول الله صلى الله عليه وسلم فقال كان شعر رسول الله صلى الله عليه رجلا ليس بالسبط ولاالجعد بين اذنيه وعاتقيه.
অর্থঃ- “হযরত ইমাম বুখারী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন হযরত আমর ইবনে আলী রহমতুল্লাহি আলাইহি। তিনি বলেন, আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন হযরত ওয়াহাব ইবনে জারীর রহমতুল্লাহি আলাইহি। তিনি বলেন, আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন আমার পিতা হযরত ক্বাতাদা রহমতুল্লাহি আলাইহি থেকে। আর হযরত ক্বাতাদা রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, আমি হযরত আনাস ইবনে মালিক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে আল্লাহ্ পাক-এর রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মাথার চুল মুবারক সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম, তিনি জবাবে বললেন; আল্লাহ্ পাক-এর রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বাবরী চুল মুবারক মধ্যম ধরণের ছিলো। না অধিক সোজা ছিলো এবং না অধিক কোঁকড়ানো ছিলো। বরং দু’অবস্থার মাঝামাঝি ছিলো। আর উক্ত বাবরী চুল মুবারক লম্বায় ছিলো, তাঁর উভয় কান ও তাঁর উভয় কাঁধ মুবারকের মাঝ বরাবর পর্যন্ত লম্বা।”
“বুখারী শরীফ” কিতাবের ২য় খন্ডের ৮৭৬ পৃষ্ঠায় আরো উল্লেখ আছে,
عن مالك ان جمته لتضرب قريبا من منكبه قال شعبة شعره يبلغ شحمة اذنيه.
অর্থঃ- “হযরত মালিক রহমতুল্লাহি আলাইহি থেকে বর্ণিত আছে। তিনি বলেন, নিশ্চয়ই নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জুম্মা বিশিষ্ট বাবরী চুল মুবারক অবশ্যই তাঁর কাঁধ মুবারকের কাছাকাছি পর্যন্ত লম্বা ছিলো। আর হযরত শু’বা রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বাবরী চুল মুবারক তাঁর দু’কানের লতি মুবারকে পৌঁছত।”
“মুসলিম শরীফ” কিতাবের ২য় খন্ডের ২৫৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
عن البراء رضى الله تعالى عنه قال ما رايت من ذى لمة احسن فى حلة حمراء من رسول الله صلى الله عليه وسلم شعره يضرب منكبيه.
অর্থঃ- “হযরত বারায়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত আছে। তিনি বলেন, গন্ধম রংয়ের ইয়ামানী চাদর পরিহিত অবস্থায় রসূল পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর চেয়ে অধিক সুন্দর আর কোন লিম্মা ওয়ালা বাবরী চুল বিশিষ্ট লোক দেখিনি। আর তাঁর মাথার বাবরী চুল মুবারক তাঁর দু’কাঁধ মুবারক পর্যন্ত লম্বা ছিলো।”
“তিরমিযী শরীফ” কিতাবের ১ম খন্ডের ২০৮ পৃষ্ঠা এবং “মিশকাত শরীফ” কিতাবের ৩৮২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
عن عائشة رضى الله تعالى عنها قالت كنت اغتسل انا ورسول الله صلى الله عليه وسلم من اناء واحد وكان له شعر فوق الجمة ودون الوفرة.
অর্থঃ- “হযরত আয়িশা ছিদ্দীকা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা হতে বর্ণিত আছে। তিনি বলেন, আমি এবং আল্লাহ্ পাক-এর রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একই পাত্র থেকে পানি নিয়ে গোছল করতাম। আর আল্লাহ্ পাক-এর রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বাবরী চুল মুবারক ছিলো জুম্মা বিশিষ্ট বাবরী চুল মুবারকের উপরে এবং ওয়াফরা বিশিষ্ট বাবরী চুল মুবারকের নিচে।”
অর্থাৎ আল্লাহ্ পাক-এর রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বাবরী চুল মুবারক দু’কানের লতি মুবারক থেকে দু’কাঁধ মুবারক পর্যন্ত লম্বা ছিলো।”
“আবূ দাউদ শরীফ” কিতাবের ২য় খন্ডের ২২৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
حدثنا مخلد بن خالد حدثنا عبد الرزاق اخبرنا معمر عن ثابت عن انس رضى الله تعالى عنه قال كان شعر رسول الله صلى الله عليه وسلم الى شحمة اذنيه.
অর্থঃ- “হযরত ইমাম আবূ দাউদ রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, আমাদের কাছে হাদীছ শরীফ বর্ণনা করেছেন হযরত মাখলাদ ইবনে খালিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি। তিনি বলেন, আমাদের কাছে হাদীছ শরীফ বর্ণনা করেছেন হযরত আব্দুর রাজ্জাক রহমতুল্লাহি আলাইহি। তিনি বলেন, আমাদের কাছে হাদীছ শরীফ বর্ণনা করেছেন হযরত মা’মার রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত ছাবিত রহমতুল্লাহি আলাইহি থেকে; তিনি হযরত আনাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে হাদীছ শরীফ বর্ণনা করে বলেন, হযরত আনাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেছেন আল্লাহ্ পাক-এর রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বাবরী চুল মুবারক তাঁর দু’কানের লতি মুবারক পর্যন্ত লম্বা ছিলো।”
“নাসাঈ শরীফ” কিতাবের ২য় খন্ডের ২৭৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
عن البراء رضى الله تعالى عنه قال ما رأيت احدا احسن فى حلة حمراء من رسول الله صلى الله عليه وسلم وجمته تضرب منكبيه.
অর্থঃ- “হযরত বারা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত আছে। তিনি বলেন, গন্ধম রংয়ের ইয়ামানী চাদর পরিহিত অবস্থায় রসূল পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর চেয়ে অধিক সুন্দর আমি আর কোন ব্যক্তিকে দেখিনি। আর আল্লাহ পাক-এর রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জুম্মা বিশিষ্ট বাবরী চুল মুবারক তাঁর দু’কাঁধ মুবারক পর্যন্ত লম্বা ছিলো।”
“ইবনু মাজাহ্ শরীফ” কিতাবের ২৬৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
عن انس رضى الله تعالى عنه قال كان شعر رسول الله صلى الله عليه وسلم شعرا رجلا بين اذنيه ومنكبيد.
অর্থঃ- “হযরত আনাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত আছে। তিনি বলেন, রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বাবরী চুল মুবারক তাঁর উভয় কান ও তাঁর উভয় কাঁধ মুবারকের মাঝ বরাবর মধ্যম ধরণের ছিলো। অর্থাৎ না অধিক কোঁকড়ানো ছিলো এবং না অধিক সোজা ছিলো। বরং দু’অবস্থার মাঝামাঝি ছিলো। আর উক্ত বাবরী চুল মুবারক লম্বায় ছিলো তাঁর উভয় কান ও তাঁর উভয় কাঁধ মুবারকের মাঝ বরাবর।”
“নাসাঈ শরীফ” কিতাবের ২য় খন্ডের ২৭৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
حدثنى البراء رضى الله تعالى عنه قال ما رأيت رجلا احسن فى حلة حمراء من رسول الله صلى الله عليه وسلم قال ورأيت له لمة تضرب قريبا من منكبيه.
অর্থঃ- “রাবী বলেন, আমাদের নিকট বর্ণনা করেছেন হযরত বারা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু। তিনি বলেন, গন্ধম রংয়ের ইয়ামানী চাদর পরিহিত অবস্থায় রসূল পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর চেয়ে অধিক সুন্দর আমি আর কোন লোককে দেখিনি। তিনি বলেন, আমি আল্লাহ্ পাক-এর রসূল পাক হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে লিম্মা বিশিষ্ট বাবরী চুল মুবারক অবস্থায় দেখেছি। আর উক্ত লিম্মা বিশিষ্ট বাবরী চুল মুবারক তাঁর দু’কাঁধ মুবারকের কাছাকাছি পর্যন্ত লম্বা ছিলো।” (চলবে)
মুহম্মদ মুহিউদ্দীন
সভাপতি- আঞ্জুমানে আল বাইয়্যিনাত
সন্দ্বীপ শাখা, চট্টগ্রাম।
সুওয়ালঃ চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত রেযাখানী মাযহাবের অখ্যাত মাসিক মুখপত্র ডিসেম্বর- জানুয়ারী/২০০৩-০৪ ঈসায়ী সংখ্যায় প্রশ্নোত্তর বিভাগে ‘বিতিরের পর দু’রাকায়াত নফল নামায দাঁড়িয়ে পড়াই উত্তম এবং বসে পড়লে অর্ধেক ছওয়াব পাবে বলে উল্লেখ করেছে।’ তারা তাদের উক্ত বক্তব্যের স্বপক্ষে বুখারী, মুসলিম, ইবনে মাজাহ্, নাসায়ী থেকে দলীল হিসেবে কয়েকখানা হাদীছ শরীফও উল্লেখ করেছে।
আর হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে প্রকাশিত অখ্যাত মাসিক পত্রিকা ডিসেম্বর/২০০৩ ঈসায়ী সংখ্যায় জিজ্ঞাসা-সমাধান বিভাগে বলা হয়েছে, ‘বিতির নামাযের পর দুই রাক্আত নফল নামায… দাঁড়িয়ে পড়া ভাল। কারণ, নফল নামায বিনা কারণে বসে পড়লে অর্ধেক সাওয়াব হয়।”
এখন আমার সুওয়াল হলো- তারা হালকী নফল নামায সম্পর্কে যে বক্তব্য পেশ করেছে তা কতটুকু সঠিক? এবং এ সম্পর্কে যে হাদীছ শরীফগুলো উল্লেখ করেছে তা কতটুকু গ্রহণযোগ্য। তাদের প্রতিটি দলীলের খ-নসহ হালকী নফল সম্পর্কে বিস্তারিত দলীল-আদিল্লাহ্ পেশ করে আমাদের ঈমান-আমল হিফাযত করবেন বলে আমরা আশাবাদী।
জাওয়াবঃ বিতির নামাযের পর দু’রাকায়াত নফল নামায যাকে “হালক্বী নফল” বলা হয়, তা দাঁড়িয়ে পড়া সম্পর্কে অখ্যাত মাসিক পত্রিকাদ্বয়ের উক্ত বক্তব্য সঠিক হয়নি। বরং ভুল, মনগড়া, দলীলবিহীন এবং কুরআন-সুন্নাহ্র খিলাফ হয়েছে। এবং ক্ষেত্রবিশেষে কুফরীমূলক হয়েছে।
স্মর্তব্য যে, সাধারণতঃ নফল নামায বসে পড়লে অর্ধেক ছওয়াব হলেও বিতির নামাযের পর দু’রাকায়াত নফল নামায বসে পড়াই মুস্তাহাব-সুন্নত, যা উত্তম ও পূর্ণ ছওয়াব এবং অধিক ফযীলতের কারণ। কেননা বিতির নামাযের পর দু’রাকায়াত নফল এবং অন্যান্য নফলের ক্ষেত্রে একই হুকুম নয়। বরং বিত্র নামাযের পর দুই রাকায়াত নফলের হুকুম অন্যান্য নফল থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। অর্থাৎ অন্যান্য নফল দাঁড়িয়ে পড়া উত্তম। অর্থাৎ দাঁড়িয়ে পড়লে পূর্ণ ছওয়াব, বসে পড়লে অর্ধেক ছওয়াব।
আর হালক্বী নফল অর্থাৎ বিতির নামাযের পর দু’রাকায়াত নফল নামায দাঁড়িয়ে পড়লে অর্ধেক ছওয়াব, আর বসে পড়লে পূর্ণ ছওয়াব।
কারণ আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন, নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিতির নামাযের পর দু’রাকায়াত নফল নামায কখনও দাঁড়িয়ে আদায় করেননি। বরং বসেই আদায় করেছেন। যা সরাসরি হাদীছ শরীফ দ্বারাই প্রমাণিত।
(ধারাবাহিক)
উল্লেখ্য, রেযাখানীরা ‘বুখারী, মুসলিম, ইবনে মাজাহ ও নাসায়ী শরীফ’ ইত্যাদি কিতাব থেকে দলীল হিসেবে যে বক্তব্য উল্লেখ করেছে, আসলে উক্ত কিতাবসমূহের বক্তব্য মোটেও সে রকম নয়। তারা কিতাবের ইবারত, সঠিক অর্থ ও ব্যাখ্যা বুঝতে না পারার কারণেই ‘হালক্বী নফল’ সম্পর্কে এরূপ বিভ্রান্তিকর বক্তব্য উল্লেখ করেছে। শুধু তাই নয়, সাথে সাথে নিজেদের জিহালতীকে ধামাচাপা দেয়ার উদ্দেশ্যে উল্লিখিত কিতাবসমূহের কোন কোন ইবারত কারচুপি করে নিজেদের বাতিল মতকে ছাবিত করার ব্যর্থ কোশেশ করেছে। তারা উল্লিখিত কিতাবের বরাত দিয়ে যে সকল মিথ্যাচারিতা, প্রতারণা ও ইবারত কারচুপির আশ্রয় নিয়েছে সেগুলোর সঠিক ব্যাখ্যা ও ফায়সালা তুলে ধরে তার খ-নমূলক আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ্।
রেযাখানীদের কারচুপিমূলক বক্তব্য
উদঘাটন ও খণ্ডন
উল্লেখ্য, রেযাখানীরা বলেছে, “যদি বিতরের পর দু’রাকাত নামায পড়া প্রিয় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দাওয়ামী সুন্নত, বিধায় বসে উত্তম, তা অস্বীকার করা কুফরী হয়, তবে যে সব মাযহাবের সম্মানিত ইমাম ও মুজতাহিদ যারা এ দু’রাকাত নামাযকে মোটেই স্বীকার করেননি তাঁদের ব্যাপারে কী ফতোয়া দেয়া হবে।”……
এর জবাবে বলতে হয় যে, তাহলে আমাদের বক্তব্য হলো বিতির নামাযের পর দু’রাকায়াত নফল নামায সম্পর্কিত যে হাদীছ শরীফকে রেযাখানীদের মতে ইমাম মালিক এবং ইমাম আহমদ রহমতুল্লাহি আলাইহিমা অস্বীকার করলেন, বিতির নামাযের পর দু’রাকায়াত নফল নামায সম্পর্কিত সেই হাদীছ শরীফকে রেযা খাঁ তার রেযভীয়া কিতাবে এবং মৌলভী আমজাদ আলী সাহেব তার বাহারে শরীয়ত কিতাবে কি করে স্বীকার করলেন? (দলীলের অপেক্ষায় থাকুন।)
তাতে কি বুঝা যায় না যে রেযা খাঁ এবং মৌলভী আমজাদ আলী সাহেবের ফতওয়া মুতাবেক ইমাম মালিক এবং ইমাম আহমদ রহমতুল্লাহি আলাইহিমা বিতির নামাযের পর দু’রাকায়াত নফল নামায সম্পর্কিত হাদীছ শরীফকে অস্বীকার করে কুফরী করেছেন। (নাউযুবিল্লাহ্)
রেযাখানীরা এটার কি জাওয়াব দিবে? নিশ্চয়ই তখন তারা বাঁচার জন্য বলবে যে এটা মালিকী মাযহাবের মত, এটা হানাফী মাযহাবের মত।
ঠিক তদ্রুপেই বিতির নামাযের পর দু’রাকায়াত হালকী নফল নামায বসে পড়াকে অনুত্তম বলা বা অস্বীকার করা হানাফী মাযহাব মতে কুফরী। মালিকী মাযহাব মতে কুফরী নয়।
দ্বিতীয়তঃ রেযাখানীরা যদি বিতির নামাযের পর দু’রাকায়াত হালকী নফল নামাযের ক্ষেত্রে অন্য মাযহাবের ইমামগণের মতকে গ্রহণ করে বা দলীল হিসেবে পেশ করতে চায়, তবে তাদেরকে ফতওয়া দিতে হবে যে, ওজুর ফরজ দশটি। কারণ হাম্বলী মাযহাবে ওজুর ফরজ দশটি। অথচ আমাদের হানাফী মাযহাবে ওজুর ফরজ চারটি।
তৃতীয়তঃ রেযাখানীরা যদি বিতির নামাযের পর দু’রাকায়াত হালকী নফল নামাযের ক্ষেত্রে অন্য মাযহাবের ইমামগণের মতকে গ্রহণ করে বা দলীল হিসেবে পেশ করতে চায়, তবে তাদেরকে ফতওয়া দিতে হবে যে, রক্ত ঝরলে ওজু ভঙ্গ হয় না। কারণ শাফেয়ী মাযহাবে রক্ত ঝরলে ওজু ভঙ্গ হয় না।
অথচ আমাদের হানাফী মাযহাবে রক্ত ঝরলে ওজু ভঙ্গ হবে এবং এ অবস্থায় নামায পড়লে কুফরী হবে।
চতুর্থতঃ রেযাখানীরা যদি বিতির নামাযের পর দু’রাকায়াত হালকী নফল নামাযের ক্ষেত্রে অন্য মাযহাবের ইমামগণের মতকে গ্রহণ করে বা দলীল হিসেবে পেশ করতে চায়, তবে তাদেরকে ফতওয়া দিতে হবে যে, আন্ডারওয়ার বা ছোট প্যান্ট পরিধান করলে ছতর ঢাকা ফরজ আদায় হবে। কারণ মালেকী মাযহাবে আন্ডারওয়ার বা ছোট প্যান্ট পরিধান করলে ছতর ঢাকা ফরজ আদায় হবে।
অথচ আমাদের হানাফী মাযহাবে পুরুষের ছতর হলো- নাভীর নীচ থেকে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত আবৃত করা।
পঞ্চমতঃ রেযাখানীরা যদি বিতির নামাযের পর দু’রাকায়াত হালকী নফল নামাযের ক্ষেত্রে অন্য মাযহাবের ইমামগণের মতকে গ্রহণ করে বা দলীল হিসেবে পেশ করতে চায়, তবে তাদেরকে ফতওয়া দিতে হবে যে, ইমামের পিছনে মুক্তাদির কিরাত পড়া ওয়াজিব। কারণ শাফেয়ী মাযহাবে ইমামের পিছনে মুক্তাদির কিরাত পড়া ওয়াজিব।
অথচ আমাদের হানাফী মাযহাবে ইমামের পিছনে মুক্তাদির কিরাত পড়া মাকরূহ্ তাহ্রীমী।
ষষ্ঠতঃ রেযাখানীরা যদি বিতির নামাযের পর দু’রাকায়াত হালকী নফল নামাযের ক্ষেত্রে অন্য মাযহাবের ইমামগণের মতকে গ্রহণ করে বা দলীল হিসেবে পেশ করতে চায়, তবে তাদেরকে ফতওয়া দিতে হবে যে, “ঈদের নামায সুন্নত। কারণ শাফেয়ী ও মালেকী মাযহাবে “ঈদের নামায সুন্নত। হাম্বলী মাযহাবে “ঈদের নামায ফরযে ক্বিফায়া।” অথচ আমাদের হানাফী মাযহাবে ঈদের নামায ওয়াজিব।
(চলবে)
মুহম্মদ শমসের আলী
কাছারী পাড়া, পাবনা।
সুওয়ালঃ আমাদের পাবনা শহরের কিছু লোক আপনাদের বহুল প্রচারিত, অকাট্য দলীলভিত্তিক মুখপত্র “মাসিক আল বাইয়্যিনাত”-এর ‘পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে’ শিরোনামে প্রকাশিত ৯৪, ১৩২, ১৩৩, ও ১৩৪তম সংখ্যায় প্রদত্ত নিম্নলিখিত বিষয়গুলো নিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। তারা লোকদেরকে বুঝাচ্ছে যে, এ সমস্ত বক্তব্য সম্পূর্ণরূপে কুফরী ও শিরকীর অন্তর্ভুক্ত। আবার কিছু কিছু বক্তব্য সন্দেহজনক। যেমন,
১. দরবার শরীফের আমানতসমূহের কখনো খিয়ানত না করা। প্রশ্ন হলো- ‘দরবার শরীফের আমানতসমূহ কি?’
২. “পীর ছাহেব ক্বিবলার দরবার শরীফ আল্লাহ পাক-এর ও তাঁর হাবীব, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দরবার শরীফের মত।” এ বক্তব্য কি কুফরী ও র্শিকীর অন্তর্ভুক্ত?
৩. দরবার শরীফের গোপনীয় বিষয়গুলো সর্বদা গোপন রাখা। জানার বিষয় হলে- ‘দরবার শরীফের গোপনীয় বিষয়গুলো কি?’
৪. “পীর ছাহেব ক্বিবলার দরবার শরীফে সেই রূপ ভয়ভীতি, আদব ও ইহতিরাম নিয়ে অবস্থান করতে হবে, যেরূপ ভয়ভীতি, আর আদব ও ইহতিরাম নিয়ে অবস্থান করতে হয় আল্লাহ পাক এবং তাঁর হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দরবার শরীফে। বরং পীর ছাহেব ক্বিবলার দরবার শরীফে কোন কোন ক্ষেত্রে তার চেয়েও বেশী ভয়ভীতি আর আদব ও ইহতিরাম সহকারে অবস্থান করতে হয়।”
তবে কি পীর ছাহেব আল্লাহ পাক ও তাঁর হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর চেয়েও বড় এবং অধিক মর্যাদা সম্পন্ন?
৫. “পীর ছাহেবের দরবার শরীফে অবস্থানকালীন সময় অন্তরে সর্বদা একথা বদ্ধমূল রাখতে হবে যে, এ দরবার শরীফ এমন আজিমুশ্ শান এবং মহান মর্যাদাপূর্ণ যে, এখানে সামান্য বেয়াদবীর কারণে জীবনের সমস্ত নেক আমল বরবাদ হয়ে যাবে।”
তবে কি পীর ছাহেবের দরবার শরীফ আল্লাহ পাক-এর হাবীব, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আরাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দরবার শরীফ হতেও বড়?
আশা করি কুরআন শরীফ ও সুন্নাহ্ শরীফের আলোকে তাদের উত্থাপিত সেই প্রশ্নগুলোর সঠিক জাওয়াব দান করে এলাকাবাসী ধর্মপ্রাণ মুসলমানদেরকে বিভ্রান্তির কবল হতে মুক্তি পাওয়ার পথ দেখাবেন।
জাওয়াবঃ মাসিক আল বাইয়িনাতের ৯৪, ১৩২, ১৩৩ এবং ১৩৪ তম সংখ্যায় ‘ফিকহুল হাদীস ওয়াল আছার’ বিভাগে ‘পীর ছাহেব ও মুরীদের সর্ম্পক প্রসঙ্গে’ শিরোনামে পীর ছাহেব এবং দরবার শরীফের আমানতসমূহ ও তার স্বরূপ এবং গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। সত্যান্বেষী ইচ্ছা নিয়ে পাঠ করলে বিষয়টি সহজেই অনুধাবনীয় হবে ইনশাআল্লাহ।
মুলতঃ যারা বিপরীত মন এবং বক্রতার অধিকারী তথা ইলমে তাছাউফ শুন্য বা তাছাউফ বিরোধী তারা চিনির বলদের মতই কিতাবের বোঝা বহনকারীর উপমা হয়। তারা ফিৎনা ফাসাদ সৃষ্টিকারী ও সঠিক বক্তব্যরে মনগড়া, অপব্যাখ্যা দানকারী। তাই ফিৎনাকারীদের ফিৎনা নিরসনের উদ্দেশ্যে ও হক্ব তালাশীদের নিকট বিষয়টি আরো সুস্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তোলার লক্ষ্যে উপরোক্ত প্রশ্নসমূহের দলীলভিত্তিক বিস্তারিত জাওয়াব ধারাবাহিকভাবে নিম্নে উল্লেখ করা হলো-
(ধারাবাহিক)
৩. দরবার শরীফের গোপনীয় বিষয়গুলো সর্বদা গোপন রাখা। জানার বিষয় হলে- ‘দরবার শরীফের গোপনীয় বিষয়গুলো কি?’
(প্রথম অংশ)
এর জাওয়াব হলো, আম বা সর্বসাধারণের মাঝে যা প্রকাশ করার বিষয় নয় সেটাই হচ্ছে বাতিনী বা গোপনীয় বিষয়। সকল মানুষের আক্বল-সমঝ সমান নয়। সবাই সমানভাবে বুঝতেও সক্ষম নয়। খাছ (বিশেষ) লোক যত গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারে আম (সাধারণ) লোক তা পারে না। উপরন্ত হিতে বিপরীত হয়ে থাকে। সেজন্য সমস্ত বিষয়ই আমভাবে প্রকাশ করা নিষেধ।
হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,
كلموا الناس على قدر عقولهم ولاتكلموا الناس على قدر عقولكم وادعوا ماينكرون اتريدون ان يكذب الله ورسوله.
অর্থঃ- সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা লোকদের সাথে তাদের আক্বল (বোধশক্তি) অনুযায়ী কথা বলো। তোমাদের নিজেদের আক্বল অনুপাতে কথা বলো না। বুঝবে না বা না বুঝার কারণে অস্বীকার করবে এমন বিষয়কে পরিহার করো। তোমরা কি চাও যে, লোকেরা আল্লাহ পাক এবং তাঁর হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করুক?” (আদাবুশ্ শায়খ)
হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ এবং আউলিয়ায়ে কিরামগণ সেরূপ আমল করেছেন। সাধারণ লোক উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে না- এরূপ বিষয়গুলো তাঁরা প্রকাশ করেননি।
হযরত আবু হুরাইরা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন,
حفظت من رسول الله صلى الله عليه وسلم وعائين فاما احدهما فبثثته فيكم واما الاخر فلو بششته قطع هذا البلعوم يعنى مجرى الطعام.
অর্থঃ- সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছ থেকে আমি দুই পাত্র ইল্ম ইয়াদ (আয়ত্ব) করেছি। তার মধ্যে এক পাত্র তোমাদের মধ্যে বিস্তার করেছি; কিন্তু অপর পাত্র, তা যদি বিস্তার করি তাহলে আমার এ হলকুম অর্থাৎ গলা কাটা যাবে।” (বুখারী শরীফ, মিশকাত শরীফ)
ইমামে রব্বানী, সাইয়্যদুল আউলিয়া, গাউছুল আ’যম, হযরত বড় পীর ছাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, ‘আমার মুখে যদি শরীয়তের লাগাম না থাকতো তাহলে আমি সমস্ত হাক্বীক্বত প্রকাশ করে দিতাম।’
হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, আমি আল্লাহ পাক-এর মারিফাত-মুহব্বতের গোপন রহস্য যা উপলব্ধি করেছি তা যদি প্রকাশ করি তবে কাছের লোক দূরে সরে যাবে এবং দূরের লোক অবিশ্বাস করবে।
উল্লেখ্য যে, এটা মাসিক আল বাইয়্যিনাত-এর নিজস্ব কোন বক্তব্য নয়। খোদ আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা আদেশ করেছেন। তাছাড়া যে বিষয়টি আওয়ামুন্ নাস বা সাধারণ মানুষের বোধগম্য নয় সে সম্পর্কে তাদের সাথে কথা না বলাই নেক্কার বান্দাদের আমল বটে। আল্লাহ পাক বলেন,
واذا خاطبهم الجهلون قالوا سلما.
অর্থঃ- “(আল্লাহ পাক-এর নেক্কার বান্দাদের আমল হচ্ছে) জাহিল বা মূর্খ লোকেরা যখন তাদের মুখোমুখী হয় তখন তারা তাদেরকে বলে তোমাদেরকে সালাম।”(সূরা ফুরক্বান- ৬৩)
উল্লেখ্য যে, আউলিয়ায়ে কিরামগণের নিকট কোন কিছুই গোপন থাকে না। হযরত ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহিসহ অনেক আউলিয়ায়ে কিরাম স্বীয় রচিত কিতাবাদীতে উল্লেখ করেছেন যে, আসমান-যমীনে যা কিছু আছে আল্লাহ পাক তাঁদেরকে সবকিছুই দান করেন। তবে তাঁরা আল্লাহ পাক এবং তাঁর হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আদেশ-নিষেধ ব্যতীত কোন কিছুই প্রকাশ করেন না।” (ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন, যখীরায়ে কারামত)
সুলতানুল আরিফীন, মুজাদ্দিদে যামান, হযরত ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী রহমতুল্লাহি আলাইহি স্বীয় বিশ্বখ্যাত কিতাব “হাবী লিল ফাতওয়া”-এ উল্লেখ করেছেন, ‘মানুষ স্বপ্নে বা মুরাকাবায় যা দেখেন আউলিয়ায়ে কিরামগণ তা চাক্ষুষ দেখতে পান। সাধারণ লোকেরা আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে স্বপ্নে দেখেন আর আউলিয়ায়ে কিরামগণ তাকে জাহিরীভাবে চর্ম চোখে দেখতে পান। কেউ কেউ কবরের আযাব, জান্নাতের সুখ-শান্তি কিংবা জাহান্নামের আযাব-গযব স্বপ্নে অথবা মুরাকাবায় দেখতে পান আর বিশেষ ওলী-আউলিয়াগণ তা চর্ম চোখে জাহিরীভাবে দেখে থাকেন।
ইমামে আ’যম, হযরত আবু হানিফা রহমতুল্লাহি আলাইহি মানুষের গুনাহ্ দেখতে পেতেন। একদিন একজন ছেলেকে ওযূ করতে দেখলেন যে, তার পিতা-মাতার অবাধ্যতার গুণাহগুলো ওযূর পানির সাথে যমীনে গড়াচ্ছে। তা দেখে তিনি সেই ছেলেকে সতর্ক করে বললেন, “হে ছেলে! তুমি তোমার পিতা-মাতার নাফরমানী করনা। তাদের অনুগত হও।”
সে রাতে তিনি আল্লাহ পাক-এর দরবারে দোয়া করলেন, আয় আল্লাহ পাক! আমার ইলম কমিয়ে দিন। হয়তো মানুষের প্রতি বদগুমান বা খারাপ ধারণা জাগ্রত হতে পারে। সেই আশঙ্কায় ইমামে আ’যম, আবু হানিফা রহমতুল্লাহি আলাইহি এরূপ ইলম কমানোর জন্য দোয়া করতেন।
মূলতঃ আল্লাহ পাক আউলিয়ায়ে কিরামকে সেই ফিরাসাত দূরদর্শিতা দান করেন। যার ফলে তাদের নিকট কোন কিছুই গোপন থাকে না। হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,
اتقوا فراسة المؤمن فانه ينظر بنور ربه.
অর্থঃ- “আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমরা হাক্বীক্বী মু’মিন (আল্লাহওয়ালা)গণের ফিরাসাতকে ভয় কর। কারণ, তাঁরা তাঁদের রবের নূর দ্বারা সবকিছু অবলোকন করে থাকেন।” (তিরমিযী শরীফ, মু’জামুল কবীর, ফাত্হুল বারী, কাশফুল খেফা, তানজীহুশ্ শরীয়াহ)
আর আউলিয়ায়ে কিরামগণের দরবার শরীফে অবস্থানকারীগণের নিকটেও কখন কখন তার হাক্বীক্বত উন্মোচিত হতে পারে। কাজেই যাদের নিকট এরূপ তথ্য উন্মোচিত হবে তাদেরকে অন্যের নিকট তা প্রকাশ করতে নিষেধ করা হয়েছে। কারণ যদি কেউ প্রকাশ করে তাহলে জাহিরী-বাতিনী উভয় দিক দিয়েই মারাত্মক ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। তা প্রকাশ করার কারণে অতীতে অনেকে পাগল হয়েছে, বোবা হয়েছে। আবার কাউকে ফাঁসি কাষ্ঠে প্রাণ দিতে হয়েছে।
দরবার শরীফের গোপনীয় বিষয়গুলির মধ্যে জাহিরী বা বাহ্যিক দিকের গোপনীয়তাও রয়েছে। সেই জাহিরী দিকটি বুঝানোর জন্য হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের জীবন মুবারকের বরকতময় কিছু ঘটনা উল্লেখ করা প্রয়োজন। তবেই আউলিয়ায়ে কিরামগণের দরবার শরীফের গোপনীয় বিষয়ের জাহিরী বা বাহ্যিক দিকটি বুঝতে সহজ হবে।
উল্লেখ্য যে, হক্কানী-রব্বানী পীর ছাহেবগণ আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া স াল্লাম-এর নায়েব তথা প্রতিনিধি। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়ে দ্বীন ইসলাম প্রচার-প্রসার তথা মুসলিম উম্মাহকে তা’লীম-তরবীয়ত দিয়ে থাকেন। আখিরী নবী, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেমন সর্বদা শত্রুবেষ্টিত ছিলেন। তেমনি তারাও সর্বদা শত্রু বেষ্টিত থাকেন। আবু জাহিল, আবু লাহাব মুনাফিক সর্দার উবাই বিন সুলুলের উত্তরসূরীরা তাঁদের হিদায়েতের প্রধান প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী। দ্বীনের ক্ষতিসাধনকারী হিসেবেই বিরাজ করে। আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ছাহাবীগণ যেমন তাঁর এবং দরবারে নববী শরীফের গোপনীয় বিষয়গুলো গোপন রাখতেন। তেমনী মুরীদগণ স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলা এবং তাঁর দরবার শরীফের গোপনীয় বিষয়গুলো গোপন রাখবেন। (চলবে)