ক্বারী মুহম্মদ আব্দুল বারী, গোড়ান, ঢাকা
মুহম্মদ সোহেলুর রহমান, রামপুরা, ঢাকা
সুওয়ালঃ সম্প্রতি ‘আহলে হাদীছ লাইব্রেরী ঢাকা’-এর সৌজন্যে প্রকাশিত একটি হ্যান্ডবিলে ‘শবে বরাত’ সম্পর্কে বিভ্রান্তিমূলক কতিপয় উক্তি করা হয়েছে। কুরআন-সুন্নাহ্র নিরিখে সেসব কতটুকু সঠিক তা আপনাদের বহুল পঠিত, তাজদীদী মুখপত্র ‘মাসিক আল বাইয়্যিনাত’ পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশ করলে বিভ্রান্তির নিরসণ হতো এবং সঠিক বিষয়টি উন্মোচিত হয়ে আওয়ামুন্ নাস খুবই উপকৃত হতো। আপনাদের জ্ঞাতার্থে হ্যান্ডবিলের একটি মূল কপি প্রেরণ করা হলো। এতে আমাদের মনে যেসব প্রশ্নের উদয় হয়েছে তাহলো- ১. শবে বরাত কি? শবে বরাত-এর অর্থ কি? অর্ধেক ফারসী আর অর্ধেক আরবী সহযোগে শরীয়তে কোন নাম হতে পারে কি-না? শবে বরাত সম্পর্কে কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফে কোন তথ্য পাওয়া যায় কি-না? ২. কখন থেকে শবে বরাত শুরু হয়? শবে বরাত সম্পর্কে হযরত রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কোন নির্দেশ-বাণী আছে কি-না? ৩. অর্ধ শা’বানের রাতটি ভাগ্য রজনী নামে নামকরণ কি বিদ্য়াত? ৪. নফল ইবাদতের মাধ্যমে রাত্রি জাগরণ ও দিনের বেলায় রোযা পালন করা কি বিদ্য়াত? ৫. এর সমর্থনে সূরা দুখানের ৩-৪নং আয়াত শরীফ পেশ করা সঠিক কি-না? ‘লাইলাতুম্ মুবারাকাহ্’ বলতে ‘লাইলাতুল ক্বদরকে’ বুঝানো হয়েছে? না ‘শবে বরাতকে’ বুঝানো হয়েছে? ৬. শবে বরাতে রিযিক বৃদ্ধি করা হয় এবং কতজন জন্মগ্রহণ করবে ও কতজন মৃত্যুবরণ করবে তা ধার্য্য করা হয়। এটা কুরআন-সুন্নাহ্ সম্মত কি-না? ৭. অর্ধ শা’বানের রাতে আলফিয়াহ বা রাগায়িব নামক কোন নামায আছে কি-না? ৮. অর্ধ শা’বানের রাতে কবর যিয়ারত করা নাকি বিদ্য়াত? ৯. হালুয়া-রুটি ও রকমারি খাদ্য প্রস্তুত করা ও বিলি করা নাকি বিদ্য়াত? ১০. অর্ধ শা’বান উপলক্ষে আয়োজিত মাহ্ফিল বিদয়াত কি-না? ১১. শবে বরাত উপলক্ষে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও অফিস-আদালত ছুটি ঘোষণা করা নাকি বিদ্য়াত চর্চার সুযোগ দেয়া? ১২. সউদী আরবের দারুল ইফতার সাবেক প্রধান ‘আব্দুল আযীয আব্দুল্লাহ বিন বায’-এর শবে বরাত পালন করা ও এদিনে রোযা রাখা বিদ্য়াত বলে অভিহিত করা কতটুকু সঠিক? আশা করি উল্লিখিত প্রশ্নসমূহের দলীলভিত্তিক জাওয়াব দানে বাধিত করবেন। জাওয়াবঃ মহান আল্লাহ পাক স্বীয় কালাম পাকে ইরশাদ করেন,
فاسئلوا اهل الذكر ان كنتم لاتعلمون.
অর্থঃ- “তোমরা আহলে যিকির তথা আল্লাহওয়ালাগণকে জিজ্ঞাসা কর, যদি তোমরা না জান।” (সূরা আম্বিয়া/৭) যামানার তাজদীদী মুখপত্র মাসিক আল বাইয়্যিনাত উপরোক্ত আয়াত শরীফের হাক্বীক্বী মিছদাক। আল্লাহ পাক রব্বুল আলামীন-এর লক্ষ্যস্থল ওলী, যামানার মুজাদ্দিদ, মুজাদ্দিদে আ’যম, রাজারবাগ শরীফের হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলী-এর ওসীলায় এ পত্রিকাটি উম্মাহর জন্য শ্রেষ্ঠতম নিয়ামত যার প্রতিটি লিখাই আক্বীদা-আমল হিফাযতকারী ও পরিশুদ্ধকারী। প্রেক্ষিত কারণে সুওয়ালে উল্লিখিত প্রশ্নসমূহের ধারাবাহিক জাওয়াব পেশ করা হলো- ১. শবে বরাত কি? শবে বরাত-এর অর্থ কি? অর্ধেক ফারসী আর অর্ধেক আরবী সহযোগে শরীয়তে কোন নাম হতে পারে কি-না? শবে বরাত সম্পর্কে কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফে কোন তথ্য পাওয়া যায় কি-না? “শবে বরাত কি?” এর জবাব হলো, ‘শবে বরাত’ হচ্ছে ইসলামের বিশেষ রাত্রিসমূহের মধ্যে একটি রাত্র। যা শা’বানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত্রিতে হয়ে থাকে। “শবে বরাত-এর অর্থ কি?” এর জবাব হলো, ‘শব’ ফার্সী শব্দ। যার অর্থ হচ্ছে “রাত্র।” আর “বরাত” আরবী শব্দ যা উর্দূ, ফার্সী ইত্যাদি সব ভাষাতেই ব্যবহার হয়ে থাকে। যার অর্থ ‘মুক্তি ও নাযাত। একত্রে ‘শবে বরাত’-এর অর্থ হচ্ছে ‘মুক্তির রাত্র’ বা “নাযাতের রাত্র।” কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফের ভাষা যেহেতু আরবী তাই ফার্সী “শব” শব্দটি কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফে না থাকাটাই স্বাভাবিক। “অর্ধেক ফারসী আর অর্ধেক আরবী সহযোগে শরীয়তে কোন নাম হতে পারে কি-না?” এর জবাব হলো, হ্যাঁ, অর্ধেক ফারসী আর অর্ধেক আরবী সহযোগে শরীয়তে নাম অবশ্যই হতে পারে। এ ব্যাপারে শরীয়তে কোনরূপ বাধা-নিষেধ নেই। সুতরাং যা শরীয়তে নিষেধ নয় তা নিষেধ বলে প্রচার করা শরীয়তের মধ্যে ইফরাত-তাফরীত তথা বাড়ানো-কমানোর শামীল, যা কুফরীর অন্তর্ভুক্ত। ‘অর্ধেক ফারসী আর অর্ধেক আরবী সহযোগে কোন নাম শরীয়তে হতে পারে না,’ এ বক্তব্য সম্পূর্ণরূপে শরীয়তের খিলাফ। এ বক্তব্যকে কেউ শরীয়ত সম্মত প্রমাণ করতে চাইলে তবে তাকে অবশ্যই শরীয়তের দলীল পেশ করতে হবে। অন্যথায় তার বক্তব্য বা দাবী আদৌ গ্রহণযোগ্য হবে না। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন,
هاتوا برهانكم ان كنتم صدقين.
অর্থঃ- “যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক তাহলে দলীল পেশ করো।” (সূরা বাক্বারা/১১১) অর্থাৎ দলীল-প্রমাণ ছাড়া কারো কোন কথা গ্রহণযোগ্য নয়। প্রকাশ থাকে যে, পৃথিবীতে যত ভাষা রয়েছে তন্মধ্যে একমাত্র আরবী ভাষাই স্বয়ং সম্পূর্ণ। এছাড়া অন্যান্য প্রতিটি ভাষাই একটি আরেকটির পরিপুরক। আর কোন ভাষাই শরীয়তের খিলাফ নয়। বরং প্রতিটি ভাষাই শরীয়ত সম্মত। যেমন এ প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন,
وما ارسلنا من رسول الا بلسان قومه ليبين لهم.
অর্থঃ- “আমি প্রত্যেক নবী-রসূলকেই তাঁদের নিজ নিজ ক্বওমের ভাষাভাষী করেই প্রেরণ করেছি যাতে তাদেরকে স্পষ্টভাবে বোঝাতে পারেন।” (সূরা ইবরাহীম/৪)
ومن ايته خلق السموت والارض واختلاف السنتكم والوانكم ان فى ذلك لايت للعلمين.
অর্থঃ- “তাঁর (আল্লাহ পাক-এর) আরো এক নিদর্শন হচ্ছে যে, আসমান ও যমীনের সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। নিশ্চয়ই এতে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শনাবলী রয়েছে।” (সূরা রূম/২২) তিনি আরো ইরশাদ করেন,
خلق الانسان علمه البيان.
অর্থঃ- “তিনি (আল্লাহ পাক) সৃষ্টি করেছেন মানবকে এবং তাঁকে বয়ান বা বর্ণনা শিক্ষা দিয়েছেন।” (সূরা আর রহমান/৩,৪) সূরা আর রহমাননের এ আয়াত শরীফের ব্যাখ্যায় বিশ্বখ্যাত ও নির্ভরযোগ্য তাফসীরগ্রন্থ “তাফসীরে মাযহারীতে” উল্লেখ রয়েছে,
فكان ادم عليه السلام يتكلم بسبع مأة الف لغة.
অর্থঃ- “হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম সাত লক্ষ ভাষায় কথা বলতে পারতেন।” তবে সর্বাধিক উত্তম ও শ্রেষ্ঠ ভাষা হচ্ছে আরবী। এরপর হচ্ছে ফারসী। যা অধিকাংশ ক্ষেত্রে আরবী ভাষার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। এ কারণে আরবী ভাষার সাথে ফারসী ভাষা মিশ্রিত হয়ে বহু শব্দের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। যেমন, গুম্বাদে খাদ্বরা (সবুজ গুম্বুজ), মাহে রমাদ্বান (রমযান মাস), শবে ক্বদর (ক্বদরের রাত), শবে মি’রাজ (মি’রাজের রাত), আবে যমযম (যমযমের কূপের পানি), কোহে তূর (তুর পর্বত), সিকান্দার যুল ক্বারনাইন, আলমগীর ইত্যাদি। উপরোক্ত উদাহরণে গুম্বাদে, মাহে, শবে, আবে, কোহে, সিকান্দার ও গীর শব্দসমূহ ফারসী ভাষার শব্দ যা যথাক্রমে আরবী শব্দ খাদ্বরা, রমাদ্বান, ক্বদর, মি’রাজ, যমযম, তূর, যুল ক্বারনাইন ও আলম শব্দের সাথে বা সহযোগে ব্যবহৃত হয়েছে এবং নাম হিসেবেই প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। উল্লেখ্য, এক ভাষায় অপর ভাষার শব্দের মিশ্রণ মূলতঃ একটি অনিবার্য ঐতিহ্য। প্রায় সব ভাষায়ই এর নিদর্শণ রয়েছে। আমাদের বাংলা ভাষায়ও এর নিদর্শণ অনেক। এবং এটি প্রায় সব ভাষারই প্রকৃতি। ব্যাকরণের ভাষায় একে বলা হয় মিশ্র শব্দ। প্রতি ভাষায়ই মিশ্র শব্দের ব্যবহার রয়েছে। কাজেই যারা বলবে যে, অর্ধৈক আরবী আর অর্ধেক ফারসী ভাষার শব্দের মিশ্রণ গ্রহণযোগ্য নয় তারা মূলতঃ শুধু ইসলাম সম্পর্কেই অজ্ঞ নয়। বরং দুনিয়াবী জ্ঞানের দিক থেকেও তারা প্রাইমারি স্তরের জ্ঞানও রাখেনা। “শবে বরাত সম্পর্কে কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফে কোন তথ্য পাওয়া যায় কি-না?” এর জবাব হলো, হ্যাঁ, শবে বরাত সম্পর্কে কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফে অবশ্যই তথ্য বা বর্ণনা রয়েছে। কুরআন শরীফের ভাষায় “শবে বরাতকে” “লাইলাতুম মুবারাকাহ বা বরকতময় রজনী” এবং হাদীছ শরীফ-এর ভাষায় শবে বরাতকে “লাইলাতুন নিছফি মিন শা’বান” বা শা’বানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত্রি” বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন যে,
انا انزلنه فى ليلة مبركة انا كنا منذرين فيها يفرق كل امر حكيم امرا من عندنا انا كنا مرسلين.
অর্থঃ- “নিশ্চয়ই আমি বরকতময় রজনীতে (শবে বরাতে) কুরআন নাযিল করেছি। আর আমিই ভয় প্রদর্শনকারী, উক্ত রাত্রিতে আমার পক্ষ থেকে সমস্ত প্রজ্ঞাময় কাজ গুলো ফায়সালা করা হয়। আর নিশ্চয়ই আমিই প্রেরণকারী।” (সূরা দুখান/৩-৫) এ আয়াত শরীফের ব্যাখ্যায় হযরত মুফাস্সিরীনে কিরাম বিশেষ করে রঈসুল মুফাস্সিরীন হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন,
قد اخبر الله سبحانه عن هذه الليلة المباركة التى هى ليلة النصف من شعبان انه تعالى يفرق فيها كل امر من اموره المحكمة.
অর্থঃ- “মহান আল্লাহ পাক ‘লাইলাতুম্ মুবারাকাহ্ অর্থাৎ বরকতময় রাত্রি বলতে শা’বান মাসের মধ্য রাত অর্থাৎ শবে বরাতকে বুঝিয়েছেন। আল্লাহ্ পাক এ রাতে সকল প্রজ্ঞা সম্পন্ন বিষয়ের ফায়সালা করে থাকেন।” (ছফওয়াতুত্ তাফাসীর) আর হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,
عن عائشة رضى الله عنها قالت فقدت رسول الله صلى الله عليه وسلم ليلة فاذا هو بالبقيع فقال اكنت تخافين ان يحيف الله عليك ورسوله قلت يا رسول الله صلى الله عليه وسلم انى ظننت انك اتيت بعض نسائك فقال ان الله تعالى ينزل ليلة النصب من شعبان الى السماء الدنيا فيغفر لاكثر من عدد شعر غنم كلب.
অর্থঃ- “হযরত আয়িশা ছিদ্দীকা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি আল্লাহ পাক-এর রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে কোন এক রাত্রিতে রাত্রি যাপন করছিলাম। এক সময় তাঁকে বিছানায় না পেয়ে আমি মনে করলাম যে, তিনি হয়ত অন্য কোন হুজরা শরীফে গেছেন। অতঃপর আমি তালাশ করে তাঁকে জান্নাতুল বাক্বীতে পেলাম। সেখানে তিনি উম্মতের জন্য আল্লাহ্ পাক-এর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছেন। এ অবস্থা দেখে আমি স্বীয় হুজরা শরীফে ফিরে আসলে তিনিও ফিরে এসে আমাকে বললেন, তুমি কি মনে করেছ, আল্লাহ পাক ও তাঁর রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তোমার সাথে আমানতের খেয়ানত করেছেন! আমি বললাম, ইয়া রসূলাল্লাহ্ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমি ধারণা করেছিলাম যে, আপনি হয়তো অপর কোন হুজরা শরীফে গেছেন। অতঃপর হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ্ পাক শা’বানের পনের তারিখ রাত্রিতে পৃথিবীর আকাশে অবতরণ করেন, অর্থাৎ খাছ রহমত নাযিল করেন। অতঃপর তিনি বণী ক্বাল্বের মেষের গায়ে যত পশম রয়েছে তার চেয়ে অধিক সংখ্যক বান্দাকে ক্ষমা করে থাকেন।” (তিরমিযী, ইবনে মাজাহ্, রযীন) অতএব, প্রমাণিত হলো যে, কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফেই শবে বরাতের কথা উল্লেখ আছে। তবে কুরআন শরীফে বরাতের রাত্রকে “লাইলাতুম্ মুবারকাহ্” আর হাদীছ শরীফে “লাইলাতুন্ নিছফি মিন্ শা’বান” বলা হয়েছে। (চলবে)
মুহম্মদ আলী হায়দার আঞ্জুমানে আল বাইয়্যিনাত, পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম
সুওয়ালঃ হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে প্রকাশিত অখ্যাত মাসিক পত্রিকা জানুয়ারী/ফেব্রুয়ারী/মে/২০০৪ ঈসায়ী সনে পরপর তিনটি সংখ্যায় জিজ্ঞাসা-সমাধান বিভাগে ফতওয়ায়ে শামী, আলমগীরী, বাহরুর রায়িক, হিন্দিয়া, তাতারখানিয়া, ইত্যাদি কিতাবের বরাত দিয়ে বলেছে, “সানি জামাআত করা জায়েয নেই …।” …নির্ভরযোগ্য উক্তি অনুযায়ী সানী বা দ্বিতীয় জামায়াত করা মাকরূহ্ তাহরীমী…।” আর আপনারা মাসিক আল বাইয়্যিনাত পত্রিকায় লিখেছেন, “জামে মসজিদে দ্বিতীয়বার জামায়াত কায়িম করা জায়িয সকল ফুক্বাহায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণের ইজমা বা ঐক্যমতে জামে মসজিদে দ্বিতীয়বার জামায়াত কায়িম করা মাকরূহ তাহরীমী নয়। যদি দ্বিতীয় জামায়াত প্রথম জামায়াতের ছূরতে না হয়।” এখন হাটহাজারীর বক্তব্য অথবা মাসিক আল বাইয়্যিনাত-এর ফতওয়া কোনটি সঠিক? দয়া করে দলীল-আদিল্লাহসহ বিস্তারিতভাবে সঠিক ও নির্ভরযোগ্য জাওয়াব দানে বাধিত করবেন।
জাওয়াবঃ মহল্লা বা জামে মসজিদে (অর্থাৎ যেসব মসজিদে ইমাম-মুয়ায্যিন ও জামায়াত নির্ধারিত আছে এবং নির্দিষ্ট সময়ে জামায়াত কায়িম হয় সেসব মসজিদে একবার জামায়াত হওয়ার পর) ছানী বা দ্বিতীয়বার জামায়াত কায়িম করা সম্পর্কে মাসিক আল বাইয়্যিনাত-এর মাধ্যমে যা জানতে পেরেছেন সে ফতওয়াই সঠিক, নির্ভরযোগ্য, দলীলভিত্তিক এবং গ্রহণযোগ্য ও ফতওয়াগ্রাহ্য। পক্ষান্তরে হাটহাজারীর মৌলভী ছাহেবদের উক্ত বক্তব্য সম্পূর্ণই ভুল, অশুদ্ধ, মনগড়া, দলীলবিহীন এবং ফতওয়াগ্রাহ্য মতের বিপরীত। উল্লেখ্য, হাটহাজারীর মৌলভী ছাহেবরা কয়েকটি কিতাবের নাম দিয়ে যে বক্তব্য প্রদান করেছে, আসলে উক্ত কিতাবসমূহের বক্তব্য মোটেও সে রকম নয়। বরং তার সম্পূর্ণ বিপরীত। তারা কিতাবের ইবারত, সঠিক অর্থ ও ব্যাখ্যা অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েই এরূপ বিভ্রান্তিকর ও ভুল বক্তব্য প্রদান করেছে। আর ক্ষেত্র বিশেষ নিজের মনগড়া ও ভ্রান্ত মতকে টিকিয়ে রাখতে কিতাবের ইবারত কারচুপি করেছে। (ধারাবাহিক) “মাসিক আল বাইয়্যিনাত” এর বিগত সংখ্যাগুলোতে ফতওয়ায়ে শামী, আলমগীরী, বাহরুর রায়িক, হিন্দিয়া, তাতারখানিয়া, ইত্যাদি কিতাব”-এর বক্তব্য বিস্তারিত ভাবে বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করে প্রমাণ করেছি যে, হাটহাজারীর মৌলভী ছাহেবরা কিতাবের নাম ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে ধোকা দিয়েছে। কেননা, ফতওয়ায়ে শামী, আলমগীরী, বাহরুর রায়িক, হিন্দিয়া, তাতারখানিয়া ইত্যাদি কিতাবেই উল্লেখ আছে, “মহল্লা বা জামে মসজিদে পুনরায় আযান ব্যতীত যদি দ্বিতীয়বার জামায়াত কায়িম করে, তাহলে সকলের ইজমা বা ঐক্যমতে দ্বিতীয়বার জামায়াত কায়িম করা জায়িয।” এই হুকুম রাস্তার মসজিদের জন্যও প্রযোজ্য। যেমন, তাদের উল্লিখিত “ফতওয়ায়ে তাতারখানিয়া” কিতাবের ১ম খণ্ডের ৫২৮ পৃষ্ঠাতেই উল্লেখ আছে,
وفى الولوالجية ولم يقام مقام الاول وبه نأخد.
অর্থঃ- “ওয়ালওয়ালিজীয়া’ কিতাবে উল্লেখ আছে, (দ্বিতীয়বার জামায়াত কায়িম করা মাকরূহ্ নয়) তবে প্রথম স্থানে দাঁড়ানো যাবেনা। (অর্থাৎ ইমাম ছাহেব যে স্থানে দাঁড়িয়ে প্রথম জামায়াত আদায় করেছেন সে স্থানে দ্বিতীয় জামায়াতের ইমাম ছাহেব দাঁড়াবেন না। বরং সেখান থেকে দূরে সরে দ্বিতীয় জামায়াতের ইমামতি করবেন।) আর এটাই আমরা গ্রহণ করেছি। অর্থাৎ এটাই গ্রহণযোগ্য মত।” অতএব, প্রমাণিত হলো যে, তাদের উল্লিখিত কিতাবেই ‘ছানী জামায়াত’ মাকরূহ নয় বলে উল্লেখ আছে। আর তাদের উল্লিখিত কিতাব ছাড়াও আরো বহু কিতাবেই ‘ছানী জামায়াতকে’ ফতওয়াগ্রাহ্য মতে জায়িয বলা হয়েছে। নিম্নে সর্বজনমান্য, বিশ্বখ্যাত ফিক্বাহ্ ও ফতওয়ার কিতাব থেকে কিছু দলীল পেশ করা হলো- “শরহুল মাজমা” কিতাবে উল্লেখ আছে,
يجوز تكرار الجماعة بلا اذان ولا اقامة ثانية اتفاقا.
অর্থঃ- “সকল ইমাম মুজতাহিদ ও ফুক্বাহায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণের ঐক্যমতে দ্বিতীয়বার আযান ও ইক্বামত ব্যতীত ছানী জামায়াত কায়িম করা জায়িয।” “হাশিয়ায়ে তাহতাবী আলা দুররিল মুখতার” কিতাবের ১ম খন্ডের ২৪০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
اما اذا كررت بغير اذان فلا كراهة مطلقا و عليه المسلمون.
অর্থঃ- “অতঃপর মহল্লার মসজিদে যদি আযান ব্যতীত দ্বিতীয়বার জামায়াত কায়িম করে তাহলে (مطلقا) সাধারণভাবে দ্বিতীয়বার জামায়াত কায়িম করা মাকরূহ হবেনা এবং এরই উপর সমস্ত মুসলমানগণ তথা সকল ইমাম-মুজতাহিদ ও ফুক্বাহায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণ ঐক্যমত পোষণ করেছেন।” “কিতাবুল হুজ্জাত আ’লা আহ্লিল মাদীনা” কিতাবের ১ম খণ্ডের ৮০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
اذا لم يكن على هيأته الأولى لايكره والا يكره وهو الصحيح.
অর্থঃ- “দ্বিতীয় জামায়াত যদি প্রথম জামায়াতের ছূরতে না হয় তাহলে দ্বিতীয়বার জামায়াত কায়িম করা মাকরূহ হবে না। (প্রথম জামায়াতের ছূরতে না হওয়ার অর্থ হলো, দ্বিতীয় জামায়াতের জন্য আযান ও ইক্বামত হবেনা, ইমামের নির্ধারিত স্থানে দাঁড়াতে পারবেনা, তাহলে দ্বিতীয়বার জামায়াত কায়িম করলে মাকরূহ হবে না) অন্যথায় মাকরূহ্ হবে। আর وهو الصحيح. এটাই ছহীহ্ বা বিশুদ্ধ ফতওয়া।” অর্থাৎ ছহীহ্ বা বিশুদ্ধ ফতওয়া মুতাবিক আযান-ইক্বামত ব্যতীত মহল্লার মসজিদে দ্বিতীয় জামায়াত জায়িয, মাকরূহ্ নয়।” এটাই ترجيح. (তারজীহ্) বা প্রাধান্যপ্রাপ্ত মাসয়ালা। আর প্রাধান্যপ্রাপ্ত মাসয়ালার বিপরীত ফতওয়া দেয়া সম্পূর্ণই নাজায়িয ও হারাম। আর হাটহাজারীরা সে নাজায়িয ও হারাম কাজ করে শক্ত গুণাহ্র কাজ করেছে। এ প্রসঙ্গে “শরহে উকুদে রস্মুল মুফ্তী” কিতাবের ৩য় পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়েছে,
ابن حجر المكى قال لايحل لهم الحكم والافتاء بغير الراجح لانه اتباع للهواء وهو حرام اجماعا.
অর্থঃ- “মুহাক্কিক ইবনে হাজার মক্কী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, ইখ্তিলাফযুক্ত মাসয়ালায় প্রাধান্যপ্রাপ্ত মাসয়ালার বিপরীত ফতওয়া দেয়া বা আমল করা ইজমা বা সর্বসম্মতিক্রমে হারাম। কেননা এটা নফসের অনুসরণ।” এটা ‘ফতওয়ায়ে কুবরা’ কিতাবেও উল্লেখ আছে। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, মহল্লা বা জামে মসজিদে দ্বিতীয়বার জামায়াত কায়িম করা মাকরূহ্ নয়। এটা যে, ترجيح (তারজীহ্) বা প্রাধান্যপ্রাপ্ত বা গ্রহণযোগ্য তার প্রমাণ কি? এটার উত্তর হলো, ইখতিলাফযুক্ত মাসয়ালায় যেটাকে
وبه نأخذ – وهو الصحيح – وبه يفتى – وهو المختار – وعليه الفتاوى.
ইত্যাদি দ্বারা ফতওয়া দেয়া হবে, ওটাই প্রাধান্যপ্রাপ্ত বা গ্রহণযোগ্য। এ প্রসঙ্গে “শরহে উকুদে রসমুল মুফ্তী” কিতাবের ৩২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয় যে,
واما العلامات للافتاء فقوله وعليه الفتاوى وبه يفتى وبه نأخذ وعليه الاعتماد وعليه عمل اليوم وهو الصحيح وهو الاصح …….. لفظ الفتاوى اكد من لفظ الصحيح والاصح والاشبه وغيره. (شرح عقود رسم المفتى صفه ৩২)
অর্থঃ- “প্রাধান্যপ্রাপ্ত বা গ্রহণযোগ্য ফতওয়ার নিদর্শনগুলো হলো- وعليه الفتاوى এটার উপরই ফতওয়া, وبه يفتى এটা দ্বারাই ফতওয়া সাব্যস্ত হয়েছে, وبه نأخذ এটাই আমরা গ্রহণ করি, وعليه الاعتماد এটার উপরই নির্ভর, وعليه عمل اليوم এটার উপরই যামানার আমল বা উম্মতের আমল, وهو الصحيح এটাই ছহীহ্, وهو الاصح এবং এটাই অধিকতর ছহীহ্। …. তন্মধ্যে ফতওয়া (فتوى) শব্দটি الصحيح (ছহীহ্) (সঠিক), والاصح (আছাহ্হু) (অধিক সঠিক), والاشبه (আশবাহু) (অধিক সম্পূর্ণ) ইত্যাদি শব্দসমূহ হতে বেশী তাকীদপূর্ণ বা গ্রহণযোগ্য।” সুতরাং মহল্লা বা জামে মসজিদে দ্বিতীয়বার জামায়াত কায়িম করা মাকরূহ্ নয়। এটাকে যেহেতু وبه نأخذ – وهو الصحيح. ইত্যাদি শব্দ দ্বারা প্রাধান্য দেয়া হয়েছে সেহেতু এটাই গ্রহণযোগ্য ও অনুসরণীয়। এর বিপরীত ফতওয়া দেয়া নাজায়িয ও হারাম। অতএব, প্রমাণিত হলো, হাটহাজারী মাদ্রাসার মৌলভী ছাহেবরা মহল্লা বা জামে মসজিদে ছানী বা দ্বিতীয়বার জামায়াত কায়িম করার বিরুদ্ধে ফতওয়া দিয়ে হারাম ও নাজায়িয কাজ করেছে। এবং কিতাবের নাম ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে ধোকা দিয়েছে। উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটাই প্রমাণিত হলো যে, বিশুদ্ধ ফতওয়া হলো, মহল্লা বা জামে মসজিদে (অর্থাৎ যেসব মসজিদে ইমাম-মুয়ায্যিন ও জামায়াত নির্ধারিত আছে এবং নির্দিষ্ট সময়ে জামায়াত কায়িম হয় সেসব মসজিদে একবার জামায়াত হওয়ার পর) ছানী বা দ্বিতীয়বার জামায়াত কায়িম করা মাকরূহ্ নয় বরং জায়িয। [বিঃ দ্রঃ- এ সম্পর্কে আরো জানতে হলে মাসিক আল বাইয়্যিনাত-এর ৩২, ৫০, ৫৮, ৫৯, ৬১, ৭৭, ১০১, ১১২ ও ১১৬তম সংখ্যা পাঠ করুন। সেখানে মাসিক মদীনা, অখ্যাত মাসিক রাহমানী পয়গাম এবং হাটহাজারী মাদ্রাসার অখ্যাত মাসিক পত্রিকার ভুল বক্তব্য খ-ন করে সঠিক জাওয়াব দেয়া হয়েছে। এবার পঞ্চমবারের মত হাটহাজারী মাদ্রাসার অখ্যাত মাসিক পত্রিকার ‘মহল্লা বা জামে মসজিদে ছানী বা দ্বিতীয়বার জামায়াত কায়িম করা’ সম্পর্কিত ভুল বক্তব্য খন্ডন করে সঠিক জাওয়াব দেয়া হলো।] {দলীলসমূহঃ (১) মাওসূআতু ফিক্বহে আব্দিল্লাহ ইবনে মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, (২) আল ফিক্বহুল মুইয়াস্সার আলা মাযহাবিল ইমামিল আ’যম আবী হানীফা আন নু’মান, (৩) শরহে মাজমা, (৪) ওয়াল ওয়ালিজীয়া, (৫) মুনিয়া, (৬) খুলাছা, (৭) খাজানা, (৮) আল উবাব, (৯) শরহে মুনীয়া, (১০) বায্যাযীয়া, (১১) আল মূলতাক্বাত, (১২) বাহরুর রায়িক, (১৩) ফতওয়ায়ে আলমগীরী, (১৪) মিনহাতুল খালিক্ব, (১৫) দূরারুল আহ্কাম, (১৬) দুরারুল বিহার, (১৭) আল গুরার, (১৮) শরহে দুরারিল বিহার, (১৯) আল কাফী, (২০) আল মিফতাহ্, (২১) আল লুবাব লিল মায়দানী, (২২) হাশিয়ায়ে তাহতাবী আ’লা দুররিল মুখতার, (২৩) আইনুল হিদায়া, (২৪) তাতারখানিয়া, (২৫) ফতওয়ায়ে হিন্দিয়া, (২৬) গায়াতুল আওতার, (২৭) রদ্দুল মুহ্তার, (২৮) আল ফিকহুল হানাফীয়্যু ফী ছাওবীহিল জাদীদ, (২৯) বিনায়া শরহে হিদায়া, (৩০) জাওহারাতুন্ নাইয়ারাহ্, (৩১) হামিশুল খাযায়িন, (৩২) আল-মুগনী, (৩৩) শামী, (৩৪) আল ফিক্বহু আলাল মাযাহিবিল আরবায়া, (৩৫) আল-ফিকহুল ইসলামিয়্যু ওয়া আদাল্লাতুহু, (৩৬) হাফতে মাসায়িল ইত্যাদি।}(সমাপ্ত)
মুসাম্মত সানজিদা আক্তার সভানেত্রী- ছাত্রী আঞ্জুমানে আল বাইয়্যিনাত মুহম্মদপুর, ঢাকা
সুওয়ালঃ অখ্যাত মাসিক রাহমানী পয়গাম এপ্রিল/২০০৩ ঈসায়ী সংখ্যায় জিজ্ঞাসার-জবাব বিভাগে নিম্নোক্ত ১২৪৭নং জিজ্ঞাসার-জবাব ছাপা হয়- জিজ্ঞাসা: সাহাবী আবু সাঈদ খুদরী ও আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা বলেন যে, রাসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন আমার মৃত্যুর পর পূর্ব দেশগুলির মধ্য হতে কোন একটি দেশ থেকে আমার উম্মতের ভিতর হতে একটি দল বের হবে। এই দলের সদস্যগণ হবে অশিক্ষিত ও মূর্খ। এদের মধ্যে কোন শিক্ষিত লোক গেলে সেও হয়ে যাবে মূর্খের মত। তাদের বক্তৃতা হবে বহু বহু গুণের ফজিলতের। তাদের মত বক্তৃতা বা বয়ান কারো হবে না। তাদের সকল আমল হবে খুবই নিখূঁত ও সুন্দর। তাদের নামাযের তুলনায় তোমরা তোমাদের নামাযকে তুচ্ছ মনে করবে, তাদের রোযা দেখে তোমাদের রোযাকে তোমরা তুচ্ছ ও নগণ্য মনে করবে। তাদের আমল দেখে তোমরা তোমাদের আমলকে হেয় মনে করবে, তারা কুরআন পড়বে কিন্তু তা তাদের গলার নিচে যাবেনা। তারা কুরআনের উপর আমল কিম্বা কুরআন-প্রতিষ্ঠার একটু চেষ্টাও করবে না কখনো। এদলের আমল যতই তোমাদেরকে আকৃষ্ট করুক না কেন, কখনই তাদের দলে যাবেনা। কারণ প্রকৃতপক্ষে এরা হবে ইসলাম হতে খারিজ, দ্বীন হতে বহির্ভূত। তীর যেমন ধনুক হতে বের হয়ে যায় সে আর কখনও ধনুকের নিকট ফিরে আসেনা। তেমনিই এরা দ্বীন থেকে বেরিয়ে যাবে, আর কখনও দ্বীনের পথে, কুরআন ও সুন্নাহ্র পথে ফিরে আসবেনা। আমার প্রশ্ন হল, উপরোক্ত হাদীছ ছহীহ্ কি-না? ছহীহ্ হলে এ দ্বারা উদ্দেশ্য কারা? উক্ত হাদীসের সাথে তাবলীগ জামাতের কোন সম্পর্ক আছে কি-না? অনেকে এই হাদীসের সাথে তাবলীগ জামাতকে জড়াতে চান। উক্ত হাদীসের সঙ্গে তাবলীগ জামাতকে জড়ানো সঠিক কি-না? জবাবঃ প্রশ্নে বর্ণিত হাদীছ ছহীহ্। মুহাদ্দিছীনে কেরাম উক্ত হাদীছসহ এ জাতীয় হাদীছসমূহের ব্যাখ্যায় বলেছেন যে, এ সব হাদীছ দ্বারা একটি নির্ধারিত জামাত বা খারিজী ফেরক্বা নামে পরিচিত তাদেরকে বুঝানো হয়েছে। হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এর খিলাফত আমলে এই হাদীছসমূহের বাস্তবতা এবং খাওয়ারেজদের অবস্থার সমন্বয় ঘটেছিল। যার দ্বারা একথা সুস্পষ্টভাবে বলা চলে যে, এ হাদীছসমূহ দ্বারা একমাত্র খাওয়ারেজদেরকেই বুঝানো হয়েছে। সুনির্দিষ্ট কোন প্রমাণাদি ছাড়া অন্য কোন জামাতকে এই হাদীসের অন্তর্ভুক্ত করা যাবেনা। কোন প্রকার প্রমাণ ছাড়া তাবলীগ জামাতকে এই হাদীছসমূহের মেসদাক বা উদ্দেশ্য বানানো, তাদেরকে খাওয়ারেজ বলা শরীয়তের দৃষ্টিতে মারাত্মক অন্যায় ও অপরাধ। তাবলীগের নিয়মনীতি ও কার্যক্রম পুরোপুরি শরীয়তসম্মত। ইসলাম পরিপন্থী কোন কিছু এতে নেই। বর্তমান বিশ্বে আল্লাহ্ তা’আলা তাবলীগ জামাতের মাধ্যমে পথহারা, ঈমানহারা, হেদায়েত থেকে বঞ্চিত অসংখ্য মানুষকে হেদায়েত করেছেন, ঈমান আনার তাওফিক দান করেছেন। এছাড়া এ জামাতের পৃষ্ঠপোষকতায় রয়েছে অসংখ্য জগদ্বিখ্যাত আলেম ও ইসলামী চিন্তাবিদ। অতএব, তাবলীগ জামাতকে খারেজী জামাত বলা, মিথ্যা অপবাদ বৈ কিছুই নয়। (ফতহুল বারী ১২ঃ৩৫০, আল মিরকাত ৭ঃ১০৭) উক্ত অখ্যাত পত্রিকার উল্লিখিত “জিজ্ঞাসা-জবাবের” প্রেক্ষিতে আমার সুওয়াল বা জানার বিষয় হলো- (১) উল্লিখিত হাদীছ শরীফে বর্ণিত গুণাবলী প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগীদের মধ্যে আছে কি? (২) উল্লিখিত হাদীছ শরীফ দ্বারা কি শুধু খারিজী ফিরক্বার লোকদেরকেই বুঝানো হয়েছে? নাকি খারিজীদের ন্যায় আক্বীদা পোষণকারীদের ক্ষেত্রেও এ হাদীছ শরীফ প্রযোজ্য? (৩) প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগীদের মধ্যে শরীয়ত বিরোধী বা ইসলাম পরিপন্থী কোন নিয়মনীতি বা আক্বীদা, আমল নেই, এটা কতটুকু সত্য? (৪) প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগের পৃষ্ঠপোষকতায় বা পরিচালনায় যারা রয়েছে তারা সকলেই হক্কানী আলিম, এ দাবী কতটুকু সঠিক? আসলে হক্কানী আলিমের সংজ্ঞা বা পরিচিতি কি? (৫) কুরআন-সুন্নাহ্র কোথাও প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগ করার নির্দেশ আছে কি? প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগ করা কুরআন-সুন্নাহ্ মতে জায়িয কিনা? কুরআন, সুন্নাহ্, ইজমা ও ক্বিয়াসের দৃষ্টিতে দলীলভিত্তিক জাওয়াব দিয়ে আমাদের আক্বীদা, আমল হিফাযতে সহায়তা করবেন বলে আমরা আশাবাদী।
জাওয়াবঃ প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগ জামায়াত সম্পর্কিত উক্ত অখ্যাত পত্রিকার জবাব শুদ্ধ হয়নি। বরং ভুল, মনগড়া ও দলীলবিহীন হয়েছে। শুধু তাই নয়, তারা প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগীদের সাফাই গাইতে গিয়ে বর্ণিত হাদীছ শরীফের অপব্যাখ্যা করেছে। সাথে সাথে “ছয় উছূলীদের মধ্যে কুরআন-সুন্নাহ্ বিরোধী কোন আক্বীদা-আমল নেই” বলে তাদের নির্লজ্জ দালালী করে নিজেদেরকে অপব্যাখ্যাকারী ও মিথ্যাবাদীরূপে সাব্যস্ত করেছে। সুওয়ালে উল্লিখিত বিষয়গুলোর ধারাবাহিক দলীলভিত্তিক আলোচনা করলেই তা আরো সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হবে। তাই নিম্নে সুওয়ালে বর্ণিত বিষয়গুলোর দলীলভিত্তিক জাওয়াব দেয়া হলো- (ধারাবাহিক) ছয় উছূলী তাবলীগ সম্পর্কে প্রশ্নে উল্লিখিত অখ্যাত পত্রিকার অপব্যাখ্যা ও মিথ্যাচারীতার খণ্ডনমূলক জবাব-৩ প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগ সম্পর্কে অখ্যাত পত্রিকার ‘জিজ্ঞাসার জবাবের’ প্রেক্ষিতে আপনার তৃতীয় সুওয়াল হলো- “(৩) প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগীদের মধ্যে শরীয়ত বিরোধী বা ইসলাম পরিপন্থী কোন নিয়মনীতি বা আক্বীদা-আমল নেই, এটা কতটুকু সত্য?” আপনার উক্ত সুওয়ালের প্রেক্ষিতে বলতে হয় যে, অখ্যাত পত্রিকার উক্ত বক্তব্য মোটেও সত্য নয়, কেননা প্রচলিত ছয় উছূলীদের মধ্যে একটি দু’টি নয়, বরং অসংখ্য কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী নিয়মনীতি বা আক্বীদা-আমল ও বক্তব্য রয়েছে, যা তাদের মুরুব্বীদের লিখা কিতাবাদিতেই বিদ্যমান রয়েছে। তাই নিম্নে ধারাবাহিকভাবে, পর্যায়ক্রমে প্রচলিত ছয় উছূলীদের কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী ও কুফরীমূলক বক্তব্যগুলোর সাথে সাথে কুরআন-সুন্নাহ্ দৃষ্টিতে তার সঠিক ফায়সালা তুলে ধরা হলো- প্রচলিত ছয় উছূলীদের কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী কুফরীমূলক বক্তব্য- ১১ প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের সমর্থনপুষ্ট প্রায় কিতাবেই একথা লেখা আছে যে, নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালামগণ কোন কোন ক্ষেত্রে ভুল করেছিলেন। যেমন, হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম গন্দম খেয়ে ভুল করেছিলেন ও হযরত ইউনুস আলাইহিস্ সালাম দাওয়াত না দিয়ে ভুল করেছিলেন ইত্যাদি। (মালফুযাতে শায়খুল হাদীছ ২৩১ পৃষ্ঠা, তাবলীগ গোটা উম্মতের গুরু দায়িত্ব, লেখক- মাওলানা ইসমাইল হোসেন, দেওবন্দী ৬১ পৃষ্ঠা) প্রচলিত ছয় উছূলীদের কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী কুফরীমূলক বক্তব্য ১১-এর বাকি অংশ সে প্রসঙ্গে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পবিত্র সীরত মুবারক থেকে একটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়- “একবার আল্লাহ পাক-এর রসূল, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হুজরা শরীফে বসা ছিলেন। এমতাবস্থায় এক ব্যক্তি এসে আল্লাহ পাক-এর রসূল, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে সাক্ষাত করার অনুমতি চাইলেন। এ সংবাদ উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা ছিদ্দীকা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট পৌঁছালেন। তখন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘সে ব্যক্তিকে অপেক্ষা করতে বলো।’ একথা বলে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর পাগড়ী মুবারক, জামা বা কোর্তা মুবারক ইত্যাদি গুছগাছ করে নিলেন। এমন কি হুজরা শরীফ থেকে বের হওয়ার মূহুর্তে পানির গামলাতে নিজের চেহারা মুবারক দেখে গুছিয়ে নিচ্ছিলেন। তা দেখে সে সময় হযরত আয়িশা ছিদ্দীকা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা বললেন, ‘ইয়া রসূলাল্লাহ্ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনিও কি এরূপ করেন?’ তখন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘কিরূপ করি?’ তখন হযরত আয়িশা ছিদ্দীকা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম বললেন, ‘এরূপ পরিপাটি।’ এর জবাবে আল্লাহ পাক-এর রসূল, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘আমরা আল্লাহ্ পাক-এর নবী। আমাদের কোন কাজ কারো অপছন্দ হলে সে ঈমান হারা হয়ে যাবে।” (আল্ মুরশিদুল আমীন) অতএব, নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালামগণ যে কতটুকু অপছন্দনীয় কাজ থেকে বেঁচে থাকতেন, এ হাদীছ শরীফে বর্ণিত ঘটনা তারই প্রমাণ। তাহলে কি করে এ কথা বলা যেতে পারে বা বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে যে, নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালামগণ ভুল-ত্রুটি করেছিলেন? বস্তুতঃ এরূপ আক্বীদা পোষণ করা সম্পূর্ণই হারাম ও কুফরী। তদ্রুপ নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালামগণের সম্পর্কে ও তাঁদের শানের খিলাফ কোন অর্থ গ্রহণ করা যাবেনা বরং এমন অর্থ ব্যবহার বা গ্রহণ করতে হবে, যাতে তাঁদের শান সমুন্নত থাকে। উল্লেখ্য যে, আল্লাহ পাক-এর রসূল, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীছ শরীফ বর্ণনা কারীদেরকে রাবী বলা হয়। এই রাবীগণের মধ্যে যাঁরা প্রথম শ্রেণীর, তাঁদেরকে বলা হয় ছেক্বাহ্ রাবী। হাদীছ বিশারদগণ, ছেক্বাহ্ রাবী হওয়ার জন্য যে মানদন্ড নির্ধারণ করেছেন, তার মধ্যে মূল বিষয় হচ্ছে- (১) জব্ত ও (২) আদালত। জব্ত হচ্ছে- প্রখর স্মরণশক্তি। তা এমন যে, একবার শুনলে আর ভুলেনা। আর আদালত-এর মধ্যে চারটি শর্ত রয়েছে। তার মধ্যে প্রধান হলো দু’টি। যথাঃ (ক) তাক্বওয়া, (খ) মুরুওওয়াত। (ক) তাক্বওয়া হচ্ছে- কুফরী, শেরেকী, বিদ্য়াতী, ফাসিকী কাজ থেকে বেঁচে থাকার সাথে সাথে কবীরাহ্ গুণাহ্ থেকে, এমনকি ছগীরাহ্ গুণাহ্ও বার বার করা থেকে বেঁচে থাকা। (খ) আর মুরুওওয়াত হচ্ছে অশালীন, অশোভনীয়, অপছন্দনীয়, এমনকি দৃষ্টিকটু কাজ থেকে বিরত থাকা। যেমন, রাস্তায় হেঁটে হেঁটে খাদ্য খাওয়া, রাস্তায় অট্টহাস্য করা, চিৎকার করা ইত্যাদি। (তাদরীবুর রাবী, মুকাদ্দামাতুশ শায়খ, মীযানুল আখবার) এখন ফিকিরের বিষয় এই যে, হাদীছ শরীফ বর্ণনাকারী ছেক্বাহ্ রাবী যদি এত গুণ ও যোগ্যতাসম্পন্ন এবং তাক্বওয়াধারী হন অর্থাৎ হাদীছ বিশারদ উম্মতে মুহম্মদীর নিকট যদি ছেক্বাহ্ রাবী হিসেবে হাদীছ বর্ণনাকারী হওয়ার জন্য ছগীরাহ্ গুণাহ্ বার বার না করা ও দৃষ্টিকটু সাধারণ অপছন্দনীয় কাজও না করা শর্ত হয়, তাহলে যাঁরা আল্লাহ পাক-এর নবী হবেন এবং আল্লাহ পাক-এর কালাম বর্ণনা করবেন, তাঁদের জন্য আল্লাহ পাক কি মানদন্ড নির্ধারণ করেছেন বা তাঁদের ক্ষেত্রে কতটুকু মা’ছূম ও মাহ্ফুজ হওয়া নির্দিষ্ট করছেন তা অনুধাবনীয়। অতএব প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত এবং অন্যান্য যে কোন লোকের জন্যই নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালামগণের শানের বিন্দুমাত্র খিলাফ কথাবার্তা বলা সম্পূর্ণ নাজায়িয, হারাম ও কুফরী। এ ধরণের কুফরী আক্বীদা থেকে বেঁচে থাকা সমস্ত মুসলমান নর-নারীর জন্য ফরজ। অতএব, বলার অপেক্ষাই রাখেনা যে, হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম ও হযরত ইউনূছ আলাইহিস্ সালাম সম্পর্কিত ছয় উছূলী তাবলীগওয়ালাদের উপরোক্ত বক্তব্য সম্পূণই কুরআন-সুন্নাহ্র খিলাফ হওয়ার কারণে কুফরীর অন্তর্ভুক্ত। তাই প্রমাণিত হলো যে, প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগীদের মধ্যে কুরআন-সুন্নাহ্র খিলাফ তথা শরীয়ত বিরোধী আক্বীদা বিশ্বাস রয়েছে। তারা যে দাবী করে তাদের মধ্যে শরীয়ত বিরোধী কোন ঈমান-আমল নেই তা ডাহা মিথ্যা বৈ কিছুই নয়। (চলবে) [সংশোধনীঃ ১৩৪তম সংখ্যার ২৯ পৃষ্ঠার ২য় কলামের ৮, ৯ ও ২৩ নং লাইনে বর্ণিত ‘অনিচ্ছাকৃতভাবে’-এর স্থলে “অজান্তে” পড়তে হবে।]
ছূফী, মুহম্মদ তছলিমুদ্দীন বসুনিয়া উলিপুর, কুড়িগ্রাম
সুওয়ালঃ মাসিক মদীনা ফেব্রুয়ারী/২০০৪ ঈসায়ী সংখ্যায় প্রশ্নোত্তর বিভাগে নিম্নোক্ত প্রশ্নোত্তর ছাপা হয়- প্রশ্নঃ অনেকের মুখে শুনেছি যে, ঘরে মানুষ বা জীব-জন্তুর ছবি থাকলে সেই ঘরে নামায হয় না। দোকান ঘরে বিভিন্ন জিনিষের ঠোঙ্গায় মানুষ ও জীব-জন্তুর ছবি থাকে। এই দোকান ঘরেই নামায আদায় করতে হয়। অনেক দোকানে ৮/১০ জনে জামাত করেও নামায পড়তে দেখা যায়। এমতাবস্থায় এসব দোকানে নামায শুদ্ধ হবে কিনা? এবং করণীয় কি?
উত্তর: মানুষ বা জীব-জন্তুর ছবি ঘরে মজুদ থাকলেই সেই ঘরে নামায শুদ্ধ হবে না,বিষয়টা এমন নয়। ছবি যদি নামাযীর সামনে থাকে তবে অবশ্যই নামায শুদ্ধ হবে না। কিন্তু যদি ছবি দৃশ্যমান না থাকে এবং বিশেষভাবে নামাযী ব্যক্তির চোখের সামনে না থাকে তাহলে নামাযের ক্ষতি হবে না। উল্লেখ্য, মাসিক মদীনার উক্ত বক্তব্যে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, (১) মানুষ বা জীব-জন্তু ইত্যাদি প্রাণীর ছবি ঘরে মওজুদ রাখতে কোন অসুবিধা নেই। তবে নামাযীর সামনে না পড়লেই হলো। (২) শুধুমাত্র নামাযীর সামনে মানুষ বা জীব- জন্তু ইত্যাদি প্রাণীর ছবি মওজুদ থাকলে নামায মাকরূহ্ হবে। নামাযীর ডানে-বামে, উপরে-নীচে, পিছনে মানুষ বা জীব-জন্তুর ছবি মওজুদ থাকলে নামাযের কোন ক্ষতি হবে না। এখন আমার সুওয়াল হলো- মানুষ বা জীব-জন্তু ইত্যাদি প্রাণীর ছবি ঘরে মওজুদ থাকা সম্পর্কে মাসিক মদীনার উক্ত বক্তব্য সঠিক হয়েছে কি? আর সত্যিই কি মানুষ বা জীব-জন্তু ইত্যাদি প্রাণীর ছবি ঘরের ভিতরে নামাযীর চোখে পড়ে না, এমন কোন ঘরে প্রাণীর ছবি মওজুদ থাকলে নামাযের কোন ক্ষতি হবে না। দলীলসহ সঠিক জাওয়াব জানিয়ে বাধিত করবেন।
জাওয়াবঃ ঘরের ভিতরে নামাযরত অবস্থায় নামাযীর চোখে পড়ে না, এমন কোন ঘরে মানুষ বা জীব-জন্তুর ছবি মওজুদ রেখে নামায পড়া সম্পর্কে মাসিক মদীনার উক্ত বক্তব্য সঠিক হয়নি, বরং ভুল ও অশুদ্ধ হয়েছে। (ধারাবাহিক) উল্লেখ্য, বিগত সংখ্যায় আমরা ঘরে ছবি মওজুদ রেখে নামায পড়া সম্পর্কে মাসিক মদীনার ভুল বক্তব্য দলীল আদিল্লাহ্-এর মাধ্যমে খ-ন করে প্রমাণ করে দিয়েছি যে, “মানুষ বা জীব-জন্তু ইত্যাদি প্রাণীর ছবি ঘরে মওজুদ রাখা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ বা হারাম।” শুধু তাই নয়। বরং আমরা আরো প্রমাণ করে দিয়েছি যে, “যে ঘরে মানুষ বা জীব-জন্তুর ছবি মওজুদ থাকে, সে ঘরে প্রবেশ করা, বসা এবং পরিদর্শন করাটাও মাকরূহ্ তাহরীমী তথা নিষিদ্ধ বা হারাম।” সুতরাং যেখানে ঘরে মানুষ বা জীব-জন্তুর ছবি মওজুদ রাখাই হারাম, সেখানে ছবিযুক্ত ঘরে নামায শুদ্ধ হয় কি করে? অতএব, মানুষ বা জীব-জন্তুর ছবি ঘরে মওজুদ থাকলে,সেই ঘরে নামায পড়া শুদ্ধ হবে না। এটাই সঠিক, নির্ভরযোগ্য, দলীলভিত্তিক এবং গ্রহণযোগ্য ও ফতওয়াগ্রাহ্য মত। নিম্নে মাসিক মদীনার মনগড়া বক্তব্য খ-ন করা হলো- দ্বিতীয়তঃ মাসিক মদীনার উক্ত বক্তব্যে এটাও প্রতীয়মান হয় যে, “(২) শুধুমাত্র নামাযীর সামনে মানুষ বা জীব-জন্তু ইত্যাদি প্রাণীর ছবি মওজুদ থাকলে নামায মাকরূহ্ হবে। নামাযীর ডানে-বামে, উপরে, নীচে, পিছনে মানুষ বা জীব, জন্তুর ছবি মওজুদ থাকলে নামাযের কোন ক্ষতি হবে না।” এর জবাবে বলতে হয় যে, মাসিক মদীনার উক্ত বক্তব্যও ভুল হয়েছে। কারণ সর্বজনমান্য, বিশ্বখ্যাত ফিক্বাহ্ ও ফতওয়ার কিতাবসমূহে সুস্পষ্টভাবে এটাই উল্লেখ আছে যে, মানুষ বা জীব-জন্তুর ছবি ঘরে মওজুদ রেখে নামায পড়লে নামায মাকরূহ্ তাহরীমী হবে। চাই উক্ত প্রাণীর ছবি নামাযীর সামনে-পিছনে, ডানে-বামে, উপরে-নীচে, দৃষ্টির সামনে অথবা দৃষ্টির আড়ালে দৃশ্যমান থাকুক অথবা চোখের সামনে পড়ুক বা না পড়ুক সকল অবস্থাতেই প্রাণীর ছবি ঘরে মওজুদ থাকলে সে ঘরে নামায পড়া মাকরূহ্ তাহরীমী হবে। যেমন, “খুলাছাতুল ফতওয়া” কিতাবের ১ম খণ্ডের ৫৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
ويكره ان يصلى وفوق راسه فى السقف او بحذائه تصاوير اوبين يديه معلقة او فى البيت …. فالكراهة اشد وان كانت عن يمينه اوعن يساره دون ذلك وكذا فى السقف وفى موخر القبلة.
অর্থঃ- “নামায মাকরূহ্ হবে যদি নামাযীর মাথার উপর ছাদে, অথবা জুতার মধ্যে, সামনে ঝুলন্ত অবস্থায় অথবা ঘরের ভিতরে প্রাণীর ছবি থাকে …. অতঃপর নামায শক্ত মাকরূহ্ তাহরীমী হবে যদি প্রাণীর ছবি নামাযীর ডানে-বামে, নীচে-উপরে, ছাদে, ক্বিবলার পিছনে থাকে।” “আল বিনায়া” কিতাবের ২য় খণ্ডের ৫৪৬-৫৫০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
ويكره أن يكون فوق رأسه فى السقف أو بين يديه أو بحذائه تصاوير أو صورة معلقة ….. وأشدها كراهة أن تكون أمام المصلى ثم من فوق رأسه ثم على يمينه ثم على شماله ثم خلفه.
অর্থঃ- “নামায মাকরূহ তাহরীমী হবে, যদি ঞ্জনামাযীর মাথার উপর, ছাদের মধ্যে অথবা সামনে অথবা ডানে-বামে জুতায় অথবা ঝুলন্ত বা লটকানো অবস্থায় প্রাণীর ছবি অথবা মূর্তি থাকে। … এবং নামায শক্ত মাকরূহ তাহরীমী হবে, যদি প্রাণীর ছবি নামাযীর সামনে অথবা নামাযীর মাথার উপরে বা ডানে-বামে অথবা নামাযীর পিছনে থাকে।” “ফতওয়ায়ে কুবরা” কিতাবের ১ম খণ্ডের ১১৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
ان كان فيها صور لم يصل فيها.
অর্থঃ- “যদি ঘরে প্রাণীর ছবি থাকে তাহলে সে ঘরে নামায পড়া যাবে না।” কিতাবে আরো উল্লেখ আছে, উর্দূ কম্পোজ করতে হবে অর্থঃ- “প্রাণীর ছবিযুক্ত কাপড় পরিধান করে নামায পড়া মাকরূহ্ তাহরীমী। নামাযের বাইরেও উক্ত কাপড় পরিধান করা নাজায়িয। এবং প্রাণীর ছবি নামাযীর মাথার উপর ছাদের মধ্যে অথবা ঝুলন্ত অবস্থায় অথবা সিজদার স্থানে থাকলে নামায মাকরূহ্ তাহরীমী হবে। এবং নামাযীর সামনে, ডানে, বাঁয়ে এবং পিছনে প্রাণীর ছবি থাকলেও নামায মাকরূহ্ তাহরীমী হবে।” (ফতওয়ায়ে আব্দুল হাই, নূরুল হিদায়া, সুন্নী বেহেস্তী জেওর, আহ্সানুল মাসায়িল, রুকনুদ্দীন, আইনুল হিদায়া, ইলমুল ফিক্বাহ্, বাহারে শরীয়ত, ফতওয়ায়ে দারুল উলূম দেওবন্দ, আশরাফী বেহেশ্তী জেওর, তরীকুল ইসলাম, নুরুল ইজাহ্, গায়াতুল আওতার ইত্যাদি।) “হিদায়া মা’য়াদ দিরায়া” কিতাবের ১ম খণ্ডের ১৪২ পৃষ্ঠার ৮ নং হাশিয়ায় উল্লেখ আছে,
تكره الصلوة فى بيت فيه كلب او صورة سواء كان بحذائه او لا.
অর্থঃ- “ ঘরে প্রাণীর ছবি অথবা কুকুর থাকলে নামায মাকরূহ তাহরীমী হবে। চাই উহা নামাযীর সামনে থাক অথবা না থাক।” অর্থাৎ ঘরের ভিতরে ছবি মওজুদ রেখে নামায পড়লে নামায মাকরূহ্ তাহরীমী হবে। চাই উক্ত প্রাণীর ছবি নামাযীর ডানে-বামে, সামনে-পিছনে, উপরে-নীচে, মাথার উপর যেখানেই থাকুক না কেন; সকল অবস্থাতেই প্রাণীর ছবি ঘরে মওজুদ থাকলে সে ঘরে নামায পড়া মাকরূহ্ তাহরীমী হবে।” নামায মাকরূহ তাহরীমী হলে দোহরানো ওয়াজিব। যেমন, “ফতওয়ায়ে আলমগীরী” কিতাবের ১ম খণ্ডের ১০৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
فان كانت تلك الكراهة كراهة تحريم تجب الاعادة او تنزيه تستحب.
অর্থঃ- “যদি নামায মাকরূহ্ তাহরীমী হয় তাহলে নামায পুনরায় আদায় করা ওয়াজিব। আর যদি নামায মাকরূহ্ তানযীহী হয়, তাহলে নামায পুনরায় আদায় করা মুস্তাহাব।” “আহসানুল ফতওয়ার” ৩য় খণ্ডের ৪২৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে, উর্দূ কম্পোজ করতে হবে অর্থঃ- “প্রাণীর ছবিযুক্ত স্থানে নামায পড়া মাকরূহ্ তাহরীমী এবং উক্ত নামায দোহ্রানো ওয়াজিব।” কেননা নামাযের মধ্যে মাকরূহ্ তাহরীমী হলে নামায দোহ্রানো ওয়াজিব। আর মাকরূহ তান্যীহী হলে নামায দোহ্রানো মুস্তাহাব। “সুন্নী বেহেশতী যীওর” কিতাবের ১ম খ-র ৮৯ পষ্ঠায় উল্লেখ আছে, উর্দূ কম্পোজ করতে হবে অর্থঃ- “কোন কারণে নামায মাকরূহ্ তাহরীমী হলে উক্ত নামায দোহরানো (জরূরী) ওয়াজীব। অন্যথায় গুনাহ্ তার মাথার উপরেই থাকবে।”
অতএব, উপরোক্ত দলীলভিত্তিক আলোচনা দ্বারা দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্টভাবে এটাই প্রমাণিত হলো, মানুষ বা জীব-জন্তু ইত্যাদি প্রাণীর ছবি নামাযী ব্যক্তির সামনে-পিছনে, ডানে-বামে, উপরে-নীচে অথবা দৃষ্টির সামনে, দৃষ্টির আড়ালে দৃশ্যমান থাকুক অথবা চোখের সামনে পড়ুক বা না পড়ুক সকল অবস্থাতেই প্রাণীর ছবি ঘরে মওজুদ থাকলে সে ঘরে নামায পড়া মাকরূহ্ তাহরীমী হবে এবং উক্ত নামায দোহ্রিয়ে পড়া ওয়াজিব হবে। শুধু তাই নয়, ঘরে প্রাণীর ছবি মজূদ রাখা এবং যে ঘরে প্রাণীর ছবি মওজুদ থাকে সে ঘরে প্ররেশ করা, বসা এবং পরিদর্শন করাটাও নিষিদ্ধ তথা হারাম। সুতরাং ‘মানুষ বা জীব-জন্তুর ছবি ঘরে মওজুদ থাকলেই সেই ঘরে নামায শুদ্ধ হবে না,বিষয়টা এমন নয়। … নামাযী ব্যক্তির চোখের সামনে না থাকলে নামাযের ক্ষতি হবে না।” মাসিক মদীনার এ বক্তব্য সম্পূর্ণরূপে ভুল, বিভ্রান্তিকর শরীয়তের খিলাফ বলে প্রমাণিত হলো। [বিঃ দ্রঃ- এ সম্পর্কে আরো জানতে হলে মাসিক আল বাইয়্যিনাত-এর ২, ৭, ১০৫তম সংখ্যা এবং বিশেষ করে ১৫, ৯৯ ও ১০৮তম সংখ্যা পাঠ করুন সেখানে মাসিক রাহমানী পয়গাম এবং মাসিক মদীনার বক্তব্য খন্ডন করা হয়েছে। এবার তৃতীয়বারের মত মাসিক মদীনার ভুল বক্তব্য খ-ন করে সঠিক জাওয়াব দেয়া হলো।} {দলীলসমূহঃ (১) ফতওয়ায়ে নাওয়াযিল, (২) আল ফিক্বহুল মুইয়াস্সার আ’লা মাযহাবিল ইমামিল আ’যম আবী হানীফা আন নু’মান, (৩) ফতওয়ায়ে তাতারখানিয়া, (৪) ফতওয়ায়ে কাযীখান, (৫) হিদায়া মায়াদ দিরায়া, (৬) বাহরুর রায়িক্ব, (৭) খুলাছাতুল ফতওয়া, (৮) ফতওয়ায়ে আলমগীরী, (৯) তানবীরুল আবছার, (১০) ফতওয়ায়ে বায্যাযিয়া, (১১) দুররুল মুখতার, (১২) আল কাফী, (১৩) আত্তাহ্যীব, (১৪) মাবছূত লিস সুরুখ্সী, ১৫) কানযুদ দাক্বায়িক, (১৬) মা’দানুল হাক্বায়িক্ব, (১৭) মিনহাতুল খালিক্ব, (১৮) শরহে বিক্বায়া, (১৯) শরহুন্ নিক্বায়া, (২০) শরহে ইলইয়াছ, (২১) আল্ জামিউছ্ ছগীর, (২২) জামিউর রুমুয, (২৩) আন্ নাহরুল ফায়িক, (২৪) ফতহুল ক্বাদীর, (২৫) আইনুল হিদায়া, (২৬) নূরুদ্ দিরায়া (২৭) আইনী শরহে হিদায়া, (২৮) আল বিনায়া, (২৯) হাশিয়ায়ে হিদায়া, (৩০) হাশিয়ায়ে তাহতাবী আ’লা দুররিল মুখতার, (৩১) হাশিয়ায়ে তাহতাবী আ’লা মারাক্বিইল ফালাহ্ (৩২) গায়াতুল আওতার, (৩৩) তুহ্ফাতুল আজম, (৩৪) উমদাতুর রিয়ায়া, (৩৫) ফতওয়ায়ে হিন্দিয়া, (৩৬) ফতওয়ায়ে শামী (রদ্দুল মুহতার, হাশিয়ায়ে রদ্দুল মুহতার, হাশিয়ায়ে ইবনে আবিদীন), (৩৭) নুরুল ইজাহ্, (৩৮) নূরুল হিদায়া, (৩৯) আহ্সানুল মাসায়িল, (৪০) কিতাবুল ফিক্বাহ্ আ’লাল মাযাহিবিল আরবায়া, (৪১) ইল্মুল ফিক্বাহ্, (৪২) আল ফিক্বহুল হানাফী ফী ছাওবিহিল জাদীদ, (৪৩) মালাবুদ্দা মিনহু, (৪৪) ফতওয়ায়ে আব্দুল হাই, (৪৫) মাজমুয়ায়ে ফতওয়া, (৪৬) দুররুল মুনতাক্বা ফী শরহিল মুলতাক্বা, (৪৭) মাজমাউল আনহুর ফী শারহি মুলতাক্বাল আবহুর, (৪৮) সুন্নী বেহেশ্তী জেওর, (৪৯) আল ফিক্বহুল ইসলামিয়্যূ ওয়া আদাল্লাতুহু, (৫০) বাহ্রে শরীয়ত, (৫১) রুকনুদ্দীন মুসাম্মা বিহি ইমাদুদ্দীন, (৫২) মুনীয়াতুল মুছাল্লী, (৫৩) কাশফুল হাকায়িক, (৫৪) নূরুল ইছবাহ্, (৫৫) ছলাতুর রহমান তরজমায়ে মুনীয়াতুল মুছাল্লী, (৫৬) ফতওয়ায়ে দারুল উলূম দেওবন্দ, (৫৭) আশরাফী বেহেশ্তী জেওর, (৫৮) আহ্সানুল ফতওয়া, (৫৯) আনওয়ারে মাহ্মূদা, (৬০) ফতওয়ায়ে কুবরা ইত্যাদি।} (সমাপ্ত)
মুহম্মদ মুহিউদ্দীন সভাপতি- আঞ্জুমানে আল বাইয়্যিনাত সন্দ্বীপ শাখা, চট্টগ্রাম
সুওয়ালঃ চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত রেযাখানী মাযহাবের অখ্যাত মাসিক মুখপত্র ডিসেম্বর- জানুয়ারী/২০০৩-০৪ ঈসায়ী সংখ্যায় প্রশ্নোত্তর বিভাগে ‘‘বিত্রের পর দু’রাকায়াত নফল নামায দাঁড়িয়ে পড়াই উত্তম এবং বসে পড়লে অর্ধেক ছওয়াব পাবে বলে উল্লেখ করেছে।’’ তারা তাদের উক্ত বক্তব্যের স্বপক্ষে বুখারী, মুসলিম, ইবনে মাজাহ্, নাসায়ী থেকে দলীল হিসেবে কয়েকখানা হাদীছ শরীফও উল্লেখ করেছে। আর হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে প্রকাশিত অখ্যাত মাসিক পত্রিকা ডিসেম্বর/২০০৩ ঈসায়ী সংখ্যায় জিজ্ঞাসা-সমাধান বিভাগে বলা হয়েছে, ‘‘বিতির নামাযের পর দুই রাক্আত নফল নামায… দাঁড়িয়ে পড়া ভাল। কারণ, নফল নামায বিনা কারণে বসে পড়লে অর্ধেক সাওয়াব হয়।” এখন আমার সুওয়াল হলো- তারা হালকী নফল নামায সম্পর্কে যে বক্তব্য পেশ করেছে তা কতটুকু সঠিক? এবং এ সম্পর্কে যে হাদীছ শরীফগুলো উল্লেখ করেছে তা কতটুকু গ্রহণযোগ্য। তাদের প্রতিটি দলীলের খ-নসহ হালকী নফল সম্পর্কে বিস্তারিত দলীল-আদিল্লাহ্ পেশ করে আমাদের ঈমান-আমল হিফাযত করবেন বলে আমরা আশাবাদী।
জাওয়াবঃ বিত্র নামাযের পর দু’রাকায়াত নফল নামায যাকে “হালক্বী নফল” বলা হয়, তা দাঁড়িয়ে পড়া সম্পর্কে অখ্যাত মাসিক পত্রিকাদ্বয়ের উক্ত বক্তব্য সঠিক হয়নি। বরং ভুল, মনগড়া, দলীলবিহীন এবং কুরআন-সুন্নাহ্র খিলাফ হয়েছে। এবং ক্ষেত্রবিশেষে কুফরীমূলক হয়েছে। স্মর্তব্য যে, সাধারণতঃ নফল নামায বসে পড়লে অর্ধেক ছওয়াব হলেও বিত্র নামাযের পর দু’রাকায়াত নফল নামায বসে পড়াই মুস্তাহাব-সুন্নত, যা উত্তম ও পূর্ণ ছওয়াব এবং অধিক ফযীলতের কারণ। কেননা বিত্র নামাযের পর দু’রাকায়াত নফল এবং অন্যান্য নফলের ক্ষেত্রে একই হুকুম নয়। বরং বিত্র নামাযের পর দুই রাকায়াত নফলের হুকুম অন্যান্য নফল থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। অর্থাৎ অন্যান্য নফল দাঁড়িয়ে পড়া উত্তম। অর্থাৎ দাঁড়িয়ে পড়লে পূর্ণ ছওয়াব, বসে পড়লে অর্ধেক ছওয়াব। আর হালক্বী নফল অর্থাৎ বিত্র নামাযের পর দু’রাকায়াত নফল নামায দাঁড়িয়ে পড়লে অর্ধেক ছওয়াব, আর বসে পড়লে পূর্ণ ছওয়াব। কারণ আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন, নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিত্র নামাযের পর দু’রাকায়াত নফল নামায কখনও দাঁড়িয়ে আদায় করেননি। বরং বসেই আদায় করেছেন। যা সরাসরি হাদীছ শরীফ দ্বারাই প্রমাণিত। (ধারাবাহিক) উল্লেখ্য,রেযাখানীরা ‘বুখারী, মুসলিম,ইবনে মাজাহ ও নাসায়ী শরীফ’ ইত্যাদি কিতাব থেকে দলীল হিসেবে যে বক্তব্য উল্লেখ করেছে, আসলে উক্ত কিতাবসমূহের বক্তব্য মোটেও সে রকম নয়। তারা কিতাবের ইবারত, সঠিক অর্থ ও ব্যাখ্যা অনুধাবনে চরমভাবে ব্যর্থ হওয়ার কারণেই ‘হালক্বী নফল’ সম্পর্কে এরূপ বিভ্রান্তিকর বক্তব্য উল্লেখ করেছে। শুধু তাই নয়, সাথে সাথে নিজেদের জিহালতীতে ধামাচাপা দেয়ার উদ্দেশ্যে উল্লিখিত কিতাবসমূহের কোন কোন ইবারত কারচুপি করে নিজেদের বাতিল মতকে ছাবিত করার ব্যর্থ কোশেশ করেছে। তারা উল্লিখিত কিতাবের বরাত দিয়ে যে সকল মিথ্যাচারিতা, প্রতারণা ও ইবারত কারচুপির আশ্রয় নিয়েছে সেগুলোর সঠিক ব্যাখ্যা ও ফায়সালা তুলে ধরে তার খণ্ডনমূলক আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ্। রেযাখানীদের কারচুপিমূলক বক্তব্য উদঘাটন ও খণ্ডন। উল্লেখ্য, রেযাখানীরা বলেছে, “বিতরের পর দু’রাকাত নামায…..দাঁড়িয়ে পড়া উত্তম ধারণাকারীগণকে কুফরীর ফতোয়া দেয়াটা চরম মুর্খতা এবং ধর্ম ও নৈতিকতা বিরোধী কাজ…। এর জবাবে প্রথমতঃ বলতে হয় যে, রেযাখানী মৌলভী ছাহেবদের উক্ত বক্তব্য কুফরীমূলক হয়েছে। কারণ ছহীহ্ ও নির্ভরযোগ্য হাদীস শরীফে বর্নিত আছে, বিত্র নামাযের পর দু’রাকায়াত নফল নামায স্বয়ং আল্লাহ্ পাক-এর হাবীব, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বসেই আদায় করেছেন।
অথচ রেযাখানীরা ছহীহ্ ও নির্ভরযোগ্য হাদীছ শরীফকে অস্বীকার করে একান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে বলেছে, “বিতরের পর দু’রাকাত নামায…..দাঁড়িয়ে পড়া উত্তম। যা হাদীস শরীফকে তথা সুন্নতকে ইহানত করায় কাট্টা কুফরী হয়েছে। সুতরাং পাঠকের সুবিধার্থে বিত্র নামাযের পর দু’রাকায়াত নফল নামায বসেই আদায় করা সম্পর্কিত ছহীহ্ ও নির্ভরযোগ্য হাদীছ শরীফখানা হুবহু আবারো তুলে ধরা হলো। যেমন, “ইবনে মাজাহ্ শরীফের” ৮৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
عن ام سلمة رضى الله عنها ان النبى صلى الله عليه وسلم كان يصلى بعد الوتر ركعتين خفيفتين وهو جالس.
অর্থঃ- “উম্মুল মু’মিনীন হযরত উম্মু সালামা রদ্বিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত আছে যে, আখিরী রসুল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
يصلى بعد الوتر ركعتين خفيفتين وهو جالس.
বিত্র নামাযের পর সংক্ষিপ্তাকারে দু’রাকায়াত নফল নামায বসেই আদায় করতেন।” কাজেই বিত্রের নামাযের পর দু’ রাকায়াত নফল নামায যেহেতু আল্লাহ্ পাক-এর রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন, হাবীবুল্লাহ্, নূরে মুজাস্সাম, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বসেই আদায় করেছেন, সেহেতু তা বসেই আদায় করা সুন্নত, উত্তম ও অধিক ফযীলতের কারণ। আর উক্ত নামায দাঁড়িয়ে পড়া উত্তম ধারনা করার অর্থই হলো উল্লিখিত হাদীছ শরীফকে অস্বীকার করা, সুন্নতকে ইহানত করা, সুন্নতকে অস্বীকার করা, সুন্নতের ফযীলত কম বলে দাবী করা যা কাট্টা কুফরীর অন্তর্ভুক্ত। দ্বিতীয়তঃ বলতে হয় যে, “বিতরের নামাযের পর দু’রাকায়াত নফল নামায দাঁড়িয়ে পড়া উত্তম ধারণা করাটাও কুফরীর অন্তর্ভুক্ত। কেননা আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন, নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিতর নামাযের পর দু’রাকায়াত নফল নামায কখনও দাঁড়িয়ে আদায় করেননি। বরং বসেই আদায় করেছেন। যা সরাসরি হাদীছ শরীফ দ্বারাই প্রমাণিত। সুতরাং যেখানে আল্লাহ্ পাক-এর হাবীব, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিতর নামাযের পর দু’রাকায়াত নফল নামায বসেই আদায় করেছেন বলে ছহীহ্ ও নির্ভরযোগ্য হাদীস শরীফে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে, সেক্ষেত্রে ছহীহ্ ও নির্ভরযোগ্য হাদীস শরীফকে অস্বীকার বা উপেক্ষা করে, দলীলবিহীন ও মনগড়াভাবে দাঁড়িয়ে পড়াকে উত্তম ধারণা করাটা কি কুফরীর অন্তর্ভুক্ত নয়? মূলতঃ একে কোনই সন্দেহ নেই যে, হাদীছ শরীফ দ্বারা প্রমাণিত বসে পড়ার বর্ণনাকে অমান্য করে বিত্রের পর দু’রাকায়াত নফল নামায দাঁড়িয়ে পড়াকে উত্তম ধারণা করা কাট্টা কুফরীর অন্তর্ভূক্ত। তৃতীয়তঃ বলতে হয় যে, ‘কোন বিষয়ে ধারণা করাটাও গুণাহের কারণ।’ কেননা আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন,
يايها الذين امنوا اجتنبوا كثيرا من الظن ان بعض الظن اثم.
অর্থঃ- “হে ঈমানদারগণ তোমরা অনেক ধারনা থেকে বেঁচে থাক, নিশ্চয়ই কতক ধারণা গুণাহ্র কারণ।” (সূরা হুজুরাত/১২)
قتل الخرصون.
অর্থঃ- “অনুমানকারীরা ধ্বংস হোক।” (সূরা যারিয়াত/১০) সুতরাং ধারণাপ্রসূত বা অনুমান নির্ভর কোন কথা শরীয়তে গ্রহণযোগ্য নয় বরং যা দলীল-প্রমাণ ভিত্তিক সেটাই গ্রহণযোগ্য এবং সেটাই আমলযোগ্য। এর বিপরীত যত কিছুই বলা হোক এবং যারাই বলুক তা কস্মিনকালেও গ্রহণযোগ্য ও আমলযোগ্য বলে বিবেচিত নয়। কারণ দলীল-প্রমাণ বিহীন শুধুমাত্র ধারণা বা অনুমান করে কোন কিছু বলা ও বিশ্বাস করা সম্পূর্ণরূপে কুরআন-সুন্নাহর খিলাফ এবং ক্ষেত্র বিশেষে কুফরীর শামীল। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন,
هاتوا برهانكم ان كنتم صدقين.
অর্থঃ- “তোমরা সত্যবাদী হলে দলীল-প্রমাণ পেশ কর।” (সূরা বাক্বারা/১১১) অর্থাৎ কেউ যদি তার ঈমান-আক্বীদা, আমল-আখলাক, বক্তব্য, লিখনী ইত্যাদি কোন বিষয়কে সঠিক বলে প্রমাণ করতে চায়, তাহলে তাকে কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়অসের দলীল দিয়ে প্রমাণ করতে হবে। বিতর নামাযের পর দু’রাকায়াত নফল নামায বসে পড়াই যে খাছ সুন্নত ও অধিক ফযিলতের কারণ তার পিছনে ছহীহ্ হাদীছ শরীফসহ অসংখ্য দলীল-আদিল্লাহ রয়েছে। পক্ষান্তরে দাঁড়িয়ে আদায় করার পিছনে একটি দলীলও নেই। যদি রেযাখানী ও হাটহাজারী মৌলভী ছাহেবদের মুরোদ থাকে তবে যেন এরূপ একখানা হাদীছ শরীফ উল্লেখ করে, যে হাদীছ শরীফে রয়েছে যে, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘হালক্বী নফল’ নামায দাঁড়িয়ে পড়েছেন। অথবা ‘হালক্বী নফল’ নামায বসে পড়লে অর্ধেক ছওয়াব হবে বলে উল্লেখ করেছেন। মূলতঃ তারা কস্মিনকালেও এরূপ একখানা দলীল পেশ করতে পারবে না। অতএব, বলার অপেক্ষাই রাখেনা যে, বিতর নামাযের পর দু’রাকায়াত নফল নামায অর্থাৎ ‘হালক্বী নফল’ নামায বসেই আদায় করা উত্তম, খাছ সুন্নত এবং অধিক ফযীলত ও বুযুর্গীর কারণ। যারা এটাকে ভুল, ভিত্তিহীন ও উত্তম নয় বলবে তারা মুসলমান থেকে খারিজ হয়ে মুরতাদ ও কাফির হয়ে যাবে। এটা কারো বানানো ফতওয়া নয় বরং শরীয়তেরই ফতওয়া। (সমাপ্ত) মুহম্মদ আব্দুল্লাহিল মাসউদ, নিলফামারী। সুওয়াল ই’তিকাফ করার ফযীলত কতটুকু? জাওয়াবঃ হাদীছ শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে, “যে ব্যক্তি রমযান শরীফের শেষ দশ দিন (সুন্নতে মুয়াক্কাদায়ে ক্বিফায়া) ই’তেকাফ করবে, আল্লাহ পাক তাকে দু’টি হজ্ব ও দু’টি ওমরাহ্ করার সমতুল্য সওয়াব দান করবেন।” আরো উল্লেখ করা হয়েছে যে, আল্লাহ পাক তার পিছনের গুণাহ্খতা ক্ষমা করে দিবেন।
আরো বর্ণিত রয়েছে, “যে ব্যক্তি একদিন ই’তেকাফ করবে, আল্লাহ পাক তাকে জাহান্নাম থেকে তিন খন্দক দূরে রাখবেন। প্রতি খন্দকের দূরত্ব পাঁচশত বছরের রাস্তা।”
মুহম্মদ ছিদ্দীকুল আলম, কুমিল্লা
সুওয়ালঃ অনেকে বলে থাকে, রমযান শরীফের শেষে তিনদিন বা একদিন ই’তিকাফ করলেই সুন্নাতে মুয়াক্কায়ায়ে কিফায়া ই’তিকাফ হয়ে যায়, এটা কতটুকু সত্য? জাওয়াবঃ রমযান মাসের শেষ দশদিন অর্থাৎ ২০ তারিখ বাদ আছর ও ২১ তারিখ মাগরীবের পূর্ব হতে ঈদের বা শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা পর্যন্ত ই’তিকাফ করলে সুন্নাতে মুয়াক্কাদায়ে ক্বিফায়া ই’তিকাফ আদায় হবে। অন্যথায় একদিন, তিনদিন, পাঁচদিন এবং সাতদিন ই’তেকাফ করলেও সুন্নাতে মুয়াক্কাদা ক্বিফায়া ই’তেকাফ আদায় হবেনা। অর্থাৎ ৩০শে রমযানের দশদিন কিংবা ২৯শে রমজানের নয়দিনের এক মিনিট কম হলেও সুন্নাতে মুয়াক্কাদায়ে ক্বিফায়া ই’তেকাফ আদায় হবেনা। (সমূহ ফিক্বাহ্র কিতাব)
মুহম্মদ মুজাফ্ফর হুসাইন, ঠাকুরগাঁও
সুওয়ালঃ ই’তিকাফের আহ্কাম সম্বন্ধে জানালে কৃতজ্ঞ হবো?
জাওয়াবঃ ই’তিকাফের অর্থ হলো- (১) গুণাহ হতে বেঁচে থাকা, (২) অবস্থান করা, (৩) নিজেকে কোন স্থানে আবদ্ধ রাখা, কোণায় অবস্থান করা। আর শরীয়তের পরিভাষায় রমযান মাসের শেষ দশ দিন দুনিয়াবী যাবতীয় কার্যকলাপ ও পরিবার-পরিজন হতে ভিন্ন হয়ে, আলাদাভাবে পুরুষের জন্য জামে মসজিদে ও মহিলাদের জন্য ঘরে ইবাদতে মশগুল থাকাকে ই’তিকাফ বলে। ই’তিকাফ তিন প্রকার- (১) ওয়াজিব, (২) সুন্নাতে মুয়াক্বাদাহ, (৩) নফল। যিনি ই’তিকাফ করেন, তাকে বলে মু’তাকিফ। রমযানের শেষ দশ দিন ই’তেকাফ করা সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ্ ক্বেফায়া। প্রতি মসজিদে এলাকার তরফ হতে একজন মুতাকিফ হলেই সকলের আদায় হয়ে যাবে, আর যদি কেউ ই’তিকাফ না করে, তাহলে সকলেরই সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ তরক করার গুণাহ্ হবে। ই’তিকাফের শর্ত তিনটি- (১) পুরুষের জন্য মসজিদে, মহিলাদের জন্য ঘরের মধ্যে। (২) ই’তিকাফের জন্য নিয়ত করা, হদসে আক্বর হতে পাক হওয়া। (৩) রোজা রাখা। ই’তিকাফের জন্য বালেগ হওয়া শর্ত নয়। ই’তিকাফ অবস্থায় জাগতিক ফায়দাদায়ক কাজ করা অবস্থাভেদে হারাম ও মাকরূহ্ তাহরীমী হবে। মুতাকিফ ব্যক্তি মসজিদে এসে কোন বেহুদা কথা বা কাজ করবে না বা চুপ করে বসে থাকবে না। বরং ঘুম ব্যতীত বাকি সময় ইবাদত কার্যে মশগুল থাকতে হবে। যেমন- নফল নামায, কুরআন শরীফ তিলাওয়াত, যিকির, ইল্ম অর্জন ইত্যাদি। ই’তিকাফকারী বাইরে বের হওয়ার দু’টি জরুরত হতে পারে- (১) শরয়ী, (২) তবঈ। শরয়ী জরুরত হলো- যে মসজিদে ই’তিকাফ করছে, সেখানে জুমুয়া হয় না, অন্য কোন মসজিদে যেখানে জুমুয়া হয়, সেখানে জুমুয়ার নামায পড়তে যাওয়া এবং নামায পড়ে চলে আসা। মুতাকিফ যদি অহেতুক এক সেকেন্ডের জন্য মসজিদের বাইরে অবস্থান করে, তাহলে ই’তেকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে। দ্বিতীয় তবঈ জরুরত হলো- পায়খানা, ইস্তেঞ্জা ইত্যাদির জন্য বের হওয়া এবং কাজ সেরে চলে আসা। হাদীছ শরীফে আছে, “যে ব্যক্তি রমযানের শেষ দশ দিন ই’তিকাফ করবে, সে দু’হজ্ব ও দু’ওমরার সমপরিমাণ সওয়াব পাবে।” (যাবতীয় ফিক্বহ্রে কিতাব দ্রষ্টব্য)
আমীন আহমদ, টাঙ্গাইল
সুওয়ালঃ যাকাত দেয়ার সময় নিয়ত করা শর্ত কিনা?
জাওয়াবঃ যাকাত আদায় করার সময় অথবা যাকাতের মাল অন্যান্য মাল হতে আলাদা করার সময় নিয়ত করতে হবে। বিনা নিয়তে দিলে যাকাত আদায় হবেনা। অর্থাৎ উক্ত আলাদাকৃত মাল সম্পর্কে কেউ জিজ্ঞাসা করলে বিনা চিন্তায় যেন বলতে পারে যে, এটা যাকাতের মাল। এমনকি নিয়ত ব্যতীত সারা বছর দান করল, অতঃপর দানকৃত মাল দ্বারা যাকাত আদায়ের নিয়ত করল, তাতে যাকাত আদায় হবেনা। (আলমগীরী)
মুহম্মদ নূরুল ইসলাম, সাতক্ষীরা।
সুওয়ালঃ যাকাত কাদের উপর ফরয?
জাওয়াবঃ যারা মালেকে নেছাব বা ছাহেবে নেছাব, তাদের উপর যাকাত ফরয। আর মালেকে নেছাব বা ছাহেবে নেছাব বলতে বুঝায়, যে মুসলমান, স্বাধীন, বালেগ বা বালেগার নিকট ‘হাওয়ায়েজে আছলিয়াহ্ (নিত্য প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র, মাল-সামানা) বাদ দিয়ে কর্জ ব্যতীত নিজ মালিকানাধীনে সাড়ে ৭ ভরি স্বর্ণ অথবা সাড়ে ৫২ ভরি রৌপ্য বা তার সমপরিমাণ মূল্য পূর্ণ এক বছর থাকে, তাহলে তার উপর যাকাত ফরয। অর্থাৎ নিম্ন বর্ণিত দশ প্রকার গুণ সম্পন্ন লোকের উপর যাকাত ফরয- (১) মুসলমান হওয়া। (২) বালেগ হওয়া। (৩) জ্ঞানবান হওয়া। (৪) স্বাধীন হওয়া। (৫) নেছাব পরিমান মালের মালিক হওয়া (৬) যাকাতের মালের পূর্ণ মালিকানা থাকা। (৭) নেছাব করমুক্ত হওয়া (৮) নেছাব পরিমান মাল হাওয়ায়েজে আছলিয়ার অতিরিক্ত হওয়া। (৯) মাল বর্ধনশীল হওয়া। (১০) নেছাবের মালের বৎসর শেষ হওয়া। (দলীলসমূহঃ (১) আলমগীরী, (২) আইনুল হেদায়া, (৩) বাহরুর রায়েক, (৪) ফতওয়ায়ে আমিনীয়া ইত্যাদি।)
মুহম্মদ মুহিবুর রব, এন.গঞ্জ
সুওয়ালঃ যাকাত কে কে গ্রহণ করতে পারে? কাদেরকে যাকাত দেয়া উত্তম? জানাবেন। জাওয়াবঃ যাকাত কাদেরকে দিতে হবে, এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক তাঁর কালাম পাকে ইরশাদ করেন,
انما الصدقت للفقراء والمساكين والعملين عليها والمؤلفة قلوبهم وفى الرقاب والغرمين وفى سبيل الله وابن السبيل فريضة من الله والله عليه حكيم.
অর্থঃ- “নিশ্চয়ই সদ্কা তথা যাকাত ফকির, মিসকীন, যাকাত আদায়কারী কর্মচারী, নও মুসলিম, গোলামদের আযাদকার্যে, ঋণগ্রস্থ, জ্বিহাদে লিপ্ত ব্যক্তি এবং মুসাফিরের জন্য। এটা আল্লাহ্ পাক-এর পক্ষ থেকে নির্ধারিত। আর আল্লাহ্ পাক সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময়।” (সূরা তওবা/৬০) মূলতঃ এ আয়াত শরীফের দ্বারাই যাকাত প্রদানের আটটি খাত নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। আর যেহেতু যাকাত প্রদানের সব খাতগুলি একই সাথে পাওয়া সম্ভব নয়, সেহেতু যে কোন একটি খাতে যাকাত প্রদান করলেই যাকাত আদায় হয়ে যাবে। এটাই ইমামে আ’যম আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর অভিমত। উল্লেখ্য যে, বর্তমানে যেহেতু দেশে খিলাফত কায়েম নেই। যাকাত বায়তুল মালেও জমা দেয়া হচ্ছে না এবং কুরআন শরীফে উল্লিখিত সর্ব প্রকার খাতও পাওয়া যাচ্ছে না। আর অনেক যাকাত দাতার গরীব আত্মীয়-স্বজন ও গরীব প্রতিবেশী রয়েছে এবং অনেক মাদ্রাসা রয়েছে যেখানে এতিমখানাও আছে। তাই যাকাত দেয়ার সহজ ও উত্তম পদ্ধতি হলো- যাকাতের মালকে তিনভাগ করে একভাগ গরীব আত্মীয়-স্বজন, একভাগ গরীব প্রতিবেশী ও একভাগ মাদ্রাসার এতিমখানায় প্রদান করা। আর যদি গরীব আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশী না থাকে, তবে সবটাই মাদ্রাসার এতিমখানায় দেয়া আফযল ও উত্তম। এ সম্পর্কে আফজালুল আউলিয়া, কাইউমে আউয়াল হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, যাকাত, ফেৎরা ইত্যাদি সর্ব প্রকার দান ছদকা অন্যান্য খাতে না দিয়ে কোন মাদ্রাসার এতিম গরীব ছাত্রদেরকে দান করলে অন্যান্য খাতের চেয়ে লক্ষ্যগুণ ছওয়াব বেশী হবে। কারণ উহাতে তাদের ইল্মে দ্বীন অর্জনের সহায়তা করা হয়। হ্যাঁ, এ তিন প্রকার ব্যতীত যদি কোরআন শরীফে উল্লেখিত যাকাতের হক্বদারদের মধ্যে আরো কাউকে পাওয়া যায়, তবে তাদেরকেও যাকাত দিয়ে কোরআন শরীফের উপর আমল করা উত্তম। (সমূহ ফিক্বহ্রে কিতাব)
মুহম্মদ ফারুক হুসাইন, ফুলবাড়ি, কুড়িগ্রাম
সুওয়ালঃ আপন আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে কাকে কাকে যাকাত দেয়া যাবে? জাওয়াবঃ নিজের পিতা, দাদা, পুত্র, নাতী, স্ত্রী, স্বামী ইত্যাদি পরস্পর পরস্পরকে যাকাত দিতে পারবে না। তবে পুত্রবধু, জামাতা, বিমাতা, স্ত্রীর অন্য ঘরের সন্তান অথবা স্বামীর অন্যান্য স্ত্রীর সন্তানদেরকে যাকাত দেয়া যায়। আর পিতা-মাতা যদি অভাবগ্রস্থ হয়, তবে হিলা করে তাদেরকে যাকাতের টাকা দেয়া জায়িয, তবে তা মাকরূহ্। অনুরূপভাবে হিলা করে নিজের সন্তানকেও যাকাত দেয়া মাকরূহের সাথে জায়িয। (দুররুল মুখতার, রদ্দুল মুহতার, আলমগীরী)
মীর মুহম্মদ আমজাদ আলী, কুষ্টিয়া
সুওয়ালঃ ধনী লোকের আপন আত্মীয় ও স্বামীহীন ধনী মহিলার সন্তানকে যাকাত দেয়া জায়েয হবে কিনা?
জাওয়াবঃ ধনী লোকের নাবালেগ সন্তানকে যাকাত দেয়া জায়িয নেই। কিন্তু ধনী লোকের বালেগ সন্তান যদি ফকির হয়, তাহলে তাকে যাকাত দেয়া জায়েয। এমনকি ধনী লোকের স্ত্রী ও পিতা যদি নেছাবের মালিক না হয়, তবে তাদেরকেও যাকাত দেয়া জায়িয আছে। আর পিতৃহীন শিশুর মাতা যদি নেছাবের মালিকও হয়, তবে সে শিশুকে যাকাত দেয়া জায়িয আছে। (দুররুল মুখতার, আলমগীরী, জাওহারাতুন্ নাইয়্যারা)
মুহম্মদ সাইফুল হাবীব, বগুড়া
সুওয়ালঃ যাকাতের টাকা মসজিদ, মাদ্রাসা ও কাফন-দাফনের কাজে ব্যবহার করা যাবে কিনা? জাওয়াবঃ যাকাতের টাকা মসজিদ, মাদ্রাসা ও কাফন-দাফনের কাজে ব্যবহার করতে পারবেনা। তবে মাদ্রাসার লিল্লাহ্ বোডিংয়ে ব্যবহার করতে পারবে। কারণ যাকাতের টাকা গরীব-মিসকিনের হক্ব। যদি তা মসজিদ, মাদ্রাসা বা কাফন-দাফনের কাজে ব্যবহার করতে চায়, তবে প্রথমে উক্ত টাকা কোন গরীব-মিসকিনকে দান করে তাকে এর মালিক করে দিবে। অতঃপর সে ব্যক্তি তা মসজিদ-মাদ্রাসা অথবা কাফন-দাফনের জন্য দান করে দিবে। তখন তা উক্ত কাজে ব্যবহার করতে পারবে। অন্যথায় তা ব্যবহার করা জায়েয হবেনা। এরূপ ক্ষেত্রে যাকাত দাতা ও উক্ত মিসকিন ব্যক্তি উভয়ই সমান সওয়াব পাবে। হাদীছ শরীফে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “শত হাত ঘুরেও যদি কোন দান-ছদ্কা করা হয়, তাতে প্রত্যেকেই সমান সওয়াব লাভ করবে।” (রদ্দুল মুহ্তার)
মুহম্মদ আবু ইয়াকুব ইসহাক, শেরপুর
য়ালঃ কোন কাফিরকে যাকাত দেয়া জায়েয আছে কিনা?
জাওয়াবঃ কোন কাফিরকেই ওয়াজিব সদ্কা যেমন যাকাত, ফিৎরা, ছদ্কা, মান্নত, কাফ্ফারা ইত্যাদি কোনটাই দেয়া জায়িয নেই। আর হরবী কাফিরকে কোন রকমের দান-খয়রাত দেয়াই জায়েয নেই। যদিও সে দারুল ইসলামে মুসলমান বাদশাহ্ হতে আমান এনে থাকে। উল্লেখ্য, হরবী কাফির হলো যে সমস্ত কাফের দেশের সাথে মুসলমানদের জ্বিহাদ হচ্ছে, সেই দেশের কাফের নাগরিককে হরবী কাফির বলা হয়।
মুহম্মদ সিরাজুদ্দীন, বরিশাল
সুওয়ালঃ খাঁদযুক্ত সোনা-চান্দির যাকাতের হুকুম কি? জাওয়াবঃ সোনা-চান্দির মধ্যে খাঁদ থাকলে এবং সোনা-চান্দীর পরিমাণ বেশী হলে একে সোনা-চান্দী হিসাবেই যাকাত দিতে হবে, যদি তা নেছাব পরিমাণ হয়। আর যদি নেছাব পরিমাণ না হয়, তবে এর মূল্য হিসাব করে অন্যান্য মালের সাথে মিলিয়ে নেছাব পূর্ণ হলে যাকাত আদায় করতে হবে। যদি সোনা-চান্দী কম হয় ও খাঁদ বেশী হয় এবং উভয় মিলে যদি এক নেছাব বা তার চেয়ে বেশী হয়, তবুও যাকাত দিতে হবে। খাদযুক্ত সোনা-চান্দী এত কম হয় যে, উভয়টি মিলেও এক নেছাব হয়না কিন্তু তার দ্বারা ব্যবসা করা হয়, তবে উহা ব্যবসার মালের নেছাব হিসাবে হলে যাকাত দিতে হবে; অন্যথায় যাকাত দিতে হবেনা। (দুররুল মুখতার)
হাফিয মুহম্মদ কবির হুসাইন, মৈশাদী, নরসিংদী
সুওয়ালঃ জনৈক ব্যক্তির প্রায় দশ লক্ষাধিক টাকার মুরগীর ফার্ম আছে। সে প্রতিদিন তিন/চার হাজার টাকার ডিম বিক্রি করে। অথচ সে কোনদিন এক টাকাও যাকাত দেয়না। তাকে যাকাত দেয়ার কথা বললে সে বলে, মুরগীর ফার্মের যাকাত দিতে হয়না। এখন আমার সুওয়াল হলো- উক্ত মুরগীর ফার্মের ব্যবসায় লভ্যাংশ টাকার যাকাত দিতে হবে কি না? দলীল দ্বারা জবাবদানে বাধিত করবেন।
জাওয়াবঃ যাকাত ফরয হয়- (১) নগদ (২) মালে তেজারত ও (৩) ছায়েমা। (১) নগদ হলো- স্বর্ণ, চান্দি ও টাকা-পয়সা ইত্যাদি নেছাব পরিমাণ এক বৎসর কারো মালিকানাধীনে থাকলে, তার উপর যাকাত ফরয হবে। (২) মালে তেজারত বা ব্যবসার মাল অর্থাৎ যে মালের ব্যবসা করা হয়, তা যদি নেছাব পরিমাণ হয় এবং এক বৎসর কারো মালিকানাধীনে থাকে, তবে তার উপর যাকাত ফরয হবে। (৩) ছায়েমা হলো- যে কোন পশু অর্থাৎ গরু, মহিষ, ছাগল, বকরী, ভেড়া, উট, দুম্বা, মেষ ইত্যাদি যদি চারণভূমিতে ছয় মাসের অধিককাল বিচরণ করে অর্থাৎ ফ্রি খায়, আর তা যদি নেছাব পরিমাণ হয়, তবে তার মালিকের উপর যাকাত ফরয হবে। উল্লেখ্য, উল্লিখিত ব্যক্তির ফার্মের মুরগীর কোন যাকাত দিতে হবেনা যেহেতু সে মুরগীর ব্যবসা করেনা, বরং মুরগীর থেকে ডিম উৎপাদন করে ডিমের ব্যবসা করে থাকে। এখন উক্ত ব্যক্তি ডিমের ব্যবসা করে যে টাকা উপার্জন করবে, তা যদি নেছাব পরিমাণ হয় এবং তার নিকট এক বৎসর থাকে তখনই তার উপর উক্ত টাকার যাকাত আদায় করা ফরয হবে।
আর যদি কোন মুরগীর ফার্মের মালিক মুরগী বেচা-কেনা করে, তবে যত টাকার মুরগী রয়েছে তা যদি নেছাব পরিমাণ হয়, আর এক বৎসর মালিকানাধীনে থাকে, তাহলে যত টাকার মুরগী রয়েছে, তত টাকারই যাকাত দিতে হবে। (আলমগীরী, শামী ইত্যাদি)
হম্মদ আব্দুল মালেক, মাদারীপুর
সুওয়ালঃ জমির ফসলের যাকাত বা ওশর আদায় করার জন্য বৎসর পূর্ণ হওয়া ও নেছাব পরিমাণ মাল হওয়া শর্ত কিনা?
জাওয়াবঃ ওশর বা জমির যাকাত আদায় করার জন্য বৎসর পূর্ণ হওয়া ও নেছাব পরিমাণ মাল হওয়া শর্ত নয়। বরং একই জমিতে প্রতি মৌসুমে যে পরিমাণ ফসলই হোক তার দশ ভাগের একভাগ যাকাত আদায় করা ফরয। তবে যদি পরিশ্রম করে ফসল ফলানো হয়, তবে বিশ ভাগের এক ভাগ ফসলের যাকাত দিতে হবে। (দুররুল মুখতার)
খন্দকার মুহম্মদ আব্দুল হান্নান, সেগুনবাগিচা, ঢাকা
সুওয়ালঃ খাজনা দেয়া হয়, এমন জমির যাকাত দিতে হবে কিনা? জাওয়াবঃ যে জমির খাজনা দেয়া হয়, উক্ত জমির ফসলের যাকাত দিতে হবে। এমনকি উক্ত জমি বিক্রি করলেও বিক্রিত টাকা নেছাব পরিমাণ হলে এবং উক্ত টাকা পূর্ণ এক বছর হাতে থাকলে অথবা অন্যান্য টাকার সাথে মিলিয়ে নেছাব পূর্ণ হলে তার যাকাত দিতে হবে। (ফতওয়ায়ে আলমগীরী) মুহম্মদ ইসমাঈল হুসাইন, প্যারিদাস রোড, ঢাকা। সুওয়ালঃ এ বছর সদ্কাতুল ফিত্র কত? জাওয়াবঃ আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সদ্কাতুল ফিত্রের পরিমাণ সম্পর্কে ইরশাদ করেন,
صاع من بر على كل اثنين.
অর্থঃ- “প্রতি দু’জনের জন্য এক ‘সা’ গম। অর্থাৎ একজনের জন্য অর্ধ ‘সা’।” (আবূ দাউদ, বযলুল মাযহুদ) আমাদের হানাফী মায্হাব মুতাবিক অর্ধ ‘সা’ বলতে ১ সের সাড়ে ১২ ছটাক বুঝানো হয়েছে, যা গ্রাম হিসাবে ১৬৫৭ গ্রাম (প্রায়) হয়। কাজেই যাদের উপর সদ্কাতুল ফিত্র ওয়াজিব অর্থাৎ ঈদের দিন সুব্হে সাদিকের সময় নেছাব পরিমাণ (সাড়ে ৫২ তোলা রূপা অথবা সাড়ে ৭ ভরি স্বর্ণ অথবা সমপরিমাণ টাকা) সম্পদ থাকে, তাদের প্রত্যেকক্যেই উল্লিখিত ১ সের সাড়ে ১২ ছটাক বা ১৬৫৭ গ্রাম আটা বা তার মূল্য দান করতে হবে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় আটার দাম বিভিন্ন রকম। কাজেই যাদের উপর সদ্কাতুল ফিত্র ওয়াজিব, তাদেরকে তাদের নিজ নিজ এলাকার বর্তমান মূল্য হিসাবে একসের সাড়ে বার ছটাক বা ১৬৫৭ গ্রাম আটার মূল্য দিতে হবে। এ বছর ঢাকা শহরে ১৮.০০ টাকা কেজি হিসাবে এক সের সাড়ে বার ছটাক বা ১৬৫৭ গ্রাম আটার মূল্য- ৩০.০০ টাকা (প্রায়)। এর কম দেয়া যাবেনা, তবে ইচ্ছা করলে বেশী দিতে পারবে।
মুহম্মদ ফযলুর রহমান, বরিশাল
সুওয়ালঃ ঈদের রাতের ফযীলত কি? জাওয়াবঃ বছরে পাঁচ রাতে দোয়া বিশেষভাবে কবুল হয়। তার মধ্যে দু’ঈদের দু’রাত। এ রাতে জাগ্রত থেকে ইবাদত-বন্দিগী, তাস্বীহ্ পাঠ, কুুরআন শরীফ তিলাওয়াত, দুরূদ শরীফ ও যিকির-আয্কার করে রাত অতিবাহিত করা অতি উত্তম। দিলের নেক মকসুদসমূহ আল্লাহ্ পাক-এর নিকট জানালে আল্লাহ পাক তা কবুল করবেন। হাদীছ শরীফে আছে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি ঈদুল ফিত্র ও ঈদুল আয্হার রাতে জাগ্রত থেকে ইবাদতে মশগুল থাকবে, যেদিন অন্য সমস্ত দিল মরবে, সেদিন তার দিল মরবে না।” এর অর্থ হলো- ক্বিয়ামতের দিন অন্যান্য দিল পেরেশানীতে থাকলেও দু’ঈদের রাতে জাগরণকারী ব্যক্তির দিল শান্তিতে থাকবে। (তিবরাণী শরীফ)
মুহম্মদ বদরুজ্জামান, কিশোরগঞ্জ
সুওয়ালঃ ঈদের দিনের সুন্নতসমূহ কি? জানালে কৃতার্থ হবো। জাওয়াবঃ ঈদের দিনের সুন্নত হলো- (১) খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠা, (২) গোসল করা, (৩) মিস্ওয়াক করা, (৪) সামর্থ অনুযায়ী নতুন ও পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন পোশাক পরিধান করা, (৫) আতর ব্যবহার করা, (৬) নামাযের পূর্বে সদকাতুল ফিৎর আদায় করা, (৭) ঈদুল ফিত্র নামাযের পূর্বে কিছু মিষ্টান্ন খাওয়া (৮) তিন, পাঁচ বা বেজোড় সংখ্যক খেজুর বা খুরমা খাওয়া, (৯) মহল্লার (এলাকার) মসজিদে গিয়ে ফজরের নামায পড়া, (১০) ঈদগাহে হেঁটে যাওয়া, (১১) এক রাস্তা দিয়ে যাওয়া এবং অন্য রাস্তা দিয়ে ফিরে আসা, (১২) সকাল সকাল ঈদের নামায পড়ার জন্য যাওয়া, (১৩) ঈদের নামায, ঈদগাহে গিয়ে পড়া। সম্ভব না হলে মহল্লার (এলাকার) মসজিদে গিয়ে ঈদের নামায পড়া, (১৪) আস্তে আস্তে নিম্নলিখিত দোয়া পড়তে পড়তে ঈদগাহে যাওয়া
الله اكبر الله اكبر
لا اله الا الله والله اكبر
الله اكبر ولله الحمد.
(১৫) শরীয়তের সীমার মধ্যে থেকে খুশী প্রকাশ করা ইত্যাদি ঈদের সুন্নত। (আলমগীরী, নূরুল ইজা ও অন্যান্য ফিক্বাহ্রে কিতাব) মুছাম্মত রাবেয়া আখতার (লিজা), জামালপুর সুওয়ালঃ ঈদের নামাযের পূর্বে কোন নফল ইবাদত বা কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করা যাবে কি? জাওয়াবঃ ঈদের নামাযের পূর্বে পুরুষ, মহিলা প্রত্যেকের জন্য নফল নামায আদায়, কুরআন শরীফ তিলাওয়াত ইত্যাদি মাকরূহ্। (মারাকিউল ফালাহ্, তাহ্তাবী, তাতারখানিয়া)
মুহম্মদ শাহিনুর ইসলাম, পঞ্চগড়
সুওয়ালঃ ঈদের নামায পড়া ফরয না ওয়াজিব? ঈদের নামায কখন পড়া সুন্নত? আজকাল অনেক জায়গায় দেখা যায় কেউ কেউ সকাল সকাল ঈদের নামায পড়েন আবার কেউ কেউ দেরী করে ঈদের নামায পড়েন। যেমন সকাল ১১টায়, ১২টায় পড়েন, কোন্ সময় নামায আদায় করলে সুন্নত হবে জানতে বাসনা রাখি। জাওয়াবঃ আমাদের হানাফী মাযহাব মুতাবিক ঈদের নামায পড়া ওয়াজিব। সকালে সূর্য পূর্ণভাবে উদিত হবার পর থেকে (অর্থাৎ মাকরূহ্ ওয়াক্ত শেষ হবার পর থেকে অথবা সূর্য উদয়ের শুরু থেকে ঘড়ির মিনিট অনুযায়ী ২৩মিঃ পর) ঈদের নামাযের ওয়াক্ত শুরু হয়। আর যাহওয়াতুল কোবরা বা যাওয়াল অথবা শরয়ী অর্ধদিন বা দ্বিপ্রহর অর্থাৎ সূর্যের এস্তাওয়া আরম্ভ হবার পূর্ব পর্যন্ত ঈদের নামাযের ওয়াক্ত থাকে। ফজরের ওয়াক্ত শেষ হবার পর, ২৩মিঃ পর্যন্ত মাকরূহ্ ওয়াক্ত এবং এরপর ঈদের নামাযের ওয়াক্ত শুরু হয়। আর যোহরের ওয়াক্ত শুরু হবার ১ ঘন্টা পূর্ব পর্যন্ত ঈদের নামাযের ওয়াক্ত থাকে। অর্থাৎ মাকরূহ্ ওয়াক্ত শুরু হবার আগ পর্যন্ত। সূর্য পূর্ণভাবে উদিত হবার পর থেকে অর্থাৎ মাকরূহ্ ওয়াক্ত যা ঘড়ির হিসাব অনুযায়ী ২৩ মিঃ অতিক্রম হবার পূর্বে ঈদের নামায আদায় করলে নামায হবে না এবং যোহরের নামাযের ওয়াক্ত হবার পূর্বের ১ ঘন্টা যা মাকরূহ্ ওয়াক্ত নামে পরিচিত অর্থাৎ যাহওয়াতুল কোবরা বা সূর্যের এস্তাওয়া আরম্ভ হবার পর ঈদের নামায আদায় করলে তা আদায় হবে না। অর্ধদিন বা নিসফুন্নাহার দু’ভাবে বর্ণিত। একটি হলো শরয়ী অর্ধদিন আরেকটি ওরফী (প্রচলিত) অর্ধদিন। সূর্য উদয় হতে সূর্য অস্ত পর্যন্ত সময়কে দু’ভাগে ভাগ করলে প্রথম ভাগকে শরয়ী অর্ধদিন বলা হয়। প্রথম ভাগের শেষ অংশকে বলা হয় শরয়ী দ্বিপ্রহর বা যাহওয়াতুল কোবরা। যাহওয়াতুল কোবরা হতে সূর্য ঢলা পর্যন্ত সময়কে এস্তাওয়ায়ে শাম্স বলা হয়। ওটার মধ্যবর্তী সময় নামায পড়া মাকরূহ্। আর প্রচলিত অর্ধদিন বলতে বেলা ১২টা বুঝানো হয়। ঈদের নামাযের ওয়াক্ত শরয়ী অর্ধদিনের পূর্ব পর্যন্ত থাকে। মেসালস্বরূপ সকাল ৬টায় যদি সূর্য উদিত হয়, তাহলে ৬টা ২৩মিঃ হতে ঈদের নামাজের ওয়াক্ত শুরু হয় এবং ১২টায় যদি যোহরের ওয়াক্ত শুরু হয়, তাহলে তার পূর্বে ১ঘন্টা বাদ দিয়ে অর্থাৎ ১১টা পর্যন্ত ঈদের নামাযের ওয়াক্ত থাকে। আর নিম্নবর্ণিত হাদীছ শরীফের মাধ্যমে আমরা ঈদের নামায কোন সময় আদায় করলে তা সুন্নত হবে, তা জানতে পারবো। হযরত আবুল হোয়ারেস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আমর ইবনে হাযম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে (তিনি নাজরানের গভর্ণর থাকা অবস্থায়) চিঠি দিয়ে আদেশ করেছেন, ঈদুল আযহার নামায খুব সকাল সকাল পড়বে এবং ঈদুল ফিত্রের নামায ঈদুল আযহার চেয়ে অল্প একটু দেরীতে পড়বে এবং নামাযের পরে মানুষকে নসীহত করবে। আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদের দিন ফজরের নামায পড়ে হুজরা শরীফে গিয়ে সকাল সকাল গোসল করতেন এবং ঈদুল ফিত্র হলে বেজোড় সংখ্যক (৩,৫,৭) খোরমা, খেজুর খেয়ে ঈদগাহে যেতেন। আর ঈদুল আযহার সময় কিছু না খেয়ে সরাসরি ঈদগাহে যেতেন এবং ঈদের নামাযের ওয়াক্ত হবার সাথে সাথে ঈদের নামায আদায় করতেন এবং তারপর খুৎবা দিতেন ও নসীহত করতেন। সে জন্য ঈদের নামায সকাল সকাল পড়া সুন্নত। ঈদের নামাযের সম্মানার্থে এবং ঈদের নামায যাতে আদায়ে দেরী না হয়, সেজন্য ঈদের দিন ইশরাকসহ অন্যান্য নফল নামায পড়া নিষিদ্ধ ।
মুহম্মদ আব্দুল মালেক, পিরোজপুর
সুওয়ালঃ ঈদের নামাযের খুৎবার পরে মুসাফাহা করা জায়িয কি?
জাওয়াবঃ হ্যাঁ, ঈদের নামাযের খুৎবার পর মুছাফাহা করা জায়িয। (মুছাওওয়া/ শাহ্ ওয়ালী উল্লাহ্ মুহাদ্দিস দেহলবী রহমতুল্লাহি আলাইহি, ফতওয়ায়ে আমিনিয়া)