মুহম্মদ ছিদ্দীকুল আলম, কুমিল্লা।
মুহম্মদ আইয়ুব, সদর, রংপুর।
সুওয়ালঃ রেডিও ও টিভিতে এমনকি কিছু পত্র পত্রিকাতেও কতিপয় মাওলানা প্রচার করেছে যে, কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফে নাকি শবে বরাতের কোন অস্তিত্ব নেই। এ প্রচারণা কতটুকু সঠিক? দয়া করে দলীল সহকারে জানিয়ে বাধিত করবেন।
জাওয়াবঃ শবে বরাত সম্পর্কে উক্ত মাওলানাদের প্রচারণা আদৌ সঠিক নয়। বরং সম্পূর্ণ জিহালতপূর্ণ ও গোমরাহীমূলক যা কুফরীর অন্তর্ভুক্ত।
মূলতঃ শবে বরাত এবং এর ফযীলত কুরআন শরীফের আয়াত শরীফ ও অসংখ্য হাদীছ শরীফের দ্বারা প্রমাণিত।
যেমন, আল্লাহ্ পাক তাঁর কালাম পাকে ইরশাদ করেন,
حم والكتب المبين انا انزلنه فى ليلة مبركة انا كنا منذرين فيها يفرق كل امر حكيم امرا من عندنا انا كنا مرسلين رحمة من ريك انه هو السميع العليم.
অর্থঃ- “হা-মীম! (এটি হুরূফে মুক্বাত্তায়াত। এর অর্থ আল্লাহ্ পাক ও তাঁর রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামই বেহ্তর জানেন এবং ঐ সকল বান্দাগণ জানেন যাঁদেরকে আল্লাহ্ পাক কিংবা আল্লাহ্ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানিয়েছেন।) শপথ প্রকাশ্য কিতাবের, নিশ্চয়ই আমি কুরআন শরীফ নাযিল করেছি। অর্থাৎ নাযিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছি এক বরকতময় রাত্রিতে। নিশ্চয়ই আমিই ভীতি প্রদর্শনকারী। আমারই নির্দেশক্রমে উক্ত রাতে প্রতিটি প্রজ্ঞাসম্পন্ন বিষয় ফায়সালা করা হয়। নিশ্চয়ই আমি প্রেরণকারী । আপনার রবের পক্ষ হতে রহমত। নিশ্চয়ই তিনিই সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ।” (সূরা দুখান/১-৬)
এ আয়াত শরীফে মুফাস্সিরীন-ই-কিরাম বিশেষ করে রঈসুল মুফাস্সিরীন হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন,
قد اخبر الله سبحانه عن هذه الليلة المباركة التى هى ليلة النصف من شعبان انه تعالى يفرق فيها كل امر من اموره المحكمة.
অর্থঃ- “মহান আল্লাহ্ পাক ‘লাইলাতুম্ মুবারাকাহ্ অর্থাৎ বরকতময় রাত্রি বলতে শা’বান মাসের মধ্য রাত অর্থাৎ শবে বরাতকে বুঝিয়েছেন। আল্লাহ্ পাক এ রাতে সকল প্রজ্ঞা সম্পন্ন বিষয়ের ফায়সালা করে থাকেন।” (ছফওয়াতুত্ তাফাসীর)
কি কি বিষয়ের ফায়সালা করা হয়, সে সম্পর্কে হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,
عن عائشة رضى الله تعالى عنها عن النبى صلى الله عليه وسلم قال هل تدرين ما فى هذه الليلة يعنى ليلة النصف من شعبان قالت ما فيها يا رسول الله صلى الله عليه وسلم فقال فيها ان يكتب كل مولود بنى ادم فى هذه السنة وفيها ان يكتب كل هالك من ينى ادم فى هذه السنة وفيها ترفع اعمالهم وفيها تنزل ارزاقهم.
অর্থঃ- “হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা রদ্বিয়াল্লাহু রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা হতে বর্ণিত আছে, একদা আল্লাহ্ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হে আয়িশা ছিদ্দীকা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা! আপনি কি জানেন, এ রাত্রিতে অর্থাৎ শবে বরাতে কি সংঘটিত হয়? তিনি বললেন, হে আল্লাহ্ পাক-এর হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! এ রাত্রিতে কি সংঘটিত হয়? আল্লাহ্ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এ রাতে আগামী এক বৎসরে কতজন সন্তান জন্ম গ্রহণ করবে এবং কতজন লোক মৃত্যুবরণ করবে তা লিপিবদ্ধ করা হয়। আর এ রাতে বান্দার (এক বৎসরের) আমলসমূহ আল্লাহ পাক-এর নিকট পেশ করা হয় এবং এ রাতে বান্দার (এক বৎসরের) রিযিক নাযিল করা হয়।” (বাইহাক্বী, ইবনে মাজাহ, মিশকাত)
হাদীছ শরীফে আরো ইরশাদ হয়েছে,
عن على رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم اذا كانت ليلة النصف من شعبان فقوموا ليلها وصوموا يومها فان الله تعالى ينزل فيها لغروب الشمس الى السماء الدنيا فيقول الا من مستغفر فاغفرله الا مسترزق فارزقه الا مبتلى فاعافيه الا كذا الا كذا حتى يطلع الفجر.
অর্থঃ- “হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেন যে, আল্লাহ্ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যখন শা’বান মাসের ১৫ তারিখ উপস্থিত হয় তখন ঐ রাত্রিতে তোমরা নামায পড়বে এবং দিনে রোযা রাখবে। কেননা আল্লাহ্ পাক ঐ দিন সূর্যাস্তের পর থেকে পৃথিবীর আসমানে অবতরণ করে অর্থাৎ রহমতে খাছ নাযিল করে ঘোষণা করতে থাকেন, “তোমাদের মধ্যে কেউ ক্ষমাপ্রার্থী আছ কি? তাকে আমি ক্ষমা করে দিব। কেউ রিযিক প্রার্থী আছ কি? তাকে রিযিক দান করব। কেউ বিপদগ্রস্থ আছ কি? তার বিপদ দূর করে দিব। আল্লাহ পাক ফজর পর্যন্ত অর্থাৎ ছুবহে সাদিক পর্যন্ত এভাবে প্রত্যেক হাজতমান্দকে ডেকে বলতে থাকেন।” (ইবনে মাজাহ্, মিশকাত)
হাদীছ শরীফে আরো বর্ণিত রয়েছে,
عن ابى موسى الاشعرى رضى الله تعالى عنه عن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال ان الله تعالى ليطلع فى ليلة النصف من شعبان فيغفر لجميع خلقه الا لمشرك او مشاحن.
অর্থঃ- “হযরত আবূ মুসা আশারী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে বর্ণনা করেন, আল্লাহ্ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক অর্ধ শা’বানের রাত্রিতে (শবে বরাতে) ঘোষণা করেন তিনি তার সকল সৃষ্টিকে ক্ষমা করে দিবেন মুশরিক ও বিদ্বেষ ভাবাপন্ন ব্যক্তি ব্যতীত।” (ইবনে মাজাহ্, মিশকাত)
উল্লেখ্য, কেউ কেউ বলে ‘শবে বরাত’-এর কথা কুরআন শরীফ ও হাদীস শরীফে কোথাও নেই। তাই তারা শবে বরাতের রাতে ইবাদত-বন্দিগী করার ব্যাপারে অনীহা প্রকাশ করে থাকে। তাদের এরূপ ভুল বক্তব্য ও মন্তব্যের জবাবে বলতে হয় যে, হ্যাঁ, ‘শবে বরাত’ শব্দ দু’টি যেরূপ কুরআন শরীফ ও হাদীস শরীফের কোথাও নেই তদ্রুপ ‘নামায ও রোযা’ শব্দ দু’টিও কুরআন শরীফ ও হাদীস শরীফের কোথাও নেই। এখন ‘শবে বরাত’ বিরোধী লোকেরা কি নামায ও রোযা শব্দদ্বয় কুরআন শরীফ ও হাদীস শরীফে না থাকার কারণে ছেড়ে দিবে? মূলতঃ শবে বরাত, নামায, রোযা ইত্যাদি শব্দগুলো ফার্সী ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ফার্সীতে ‘শব’ অর্থ রাত্রি, আর বরাত অর্থ ভাগ্য বা মুক্তি। অর্থাৎ ভাগ্য রজনী বা মুক্তির রাত। তাই তা কুরআন শরীফ ও হাদীস শরীফে নেই। কারণ কুরআন শরীফ ও হাদীস শরীফের ভাষা হচ্ছে আরবী।
কুরআন শরীফে শবে বরাতকে ‘লাইলাতুম্ মুবারকাহ্’ বা বরকতময় রাত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আর হাদীস শরীফে ‘লাইলাতুন্ নিছফি মিন শা’বান’ বা শা’বান মাসের মধ্য রাত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
উপরোক্ত সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দ্বারাই সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হলো যে, শবে বরাত কুরআন-সুন্নাহ সম্মত তথা শরীয়ত সম্মত।
অতএব, শবে বরাত অস্বীকারকারী চরম জাহিল, গোমরাহ ও কাফিরের অন্তর্ভুক্ত।
{দলীলসমূহঃ (১) কুরতুবী, (২) ছফওয়াতুত্ তাফাসীর, (৩) তিরমিযী, (৪) ইবনে মাজাহ, (৫) আবূ ইয়া’লা, (৬) ইহ্ইয়াউ উলুমিদ্দীন, (৭) আত্ তারগীব ওয়াত্ তারহীব, (৮) দাইলামী, (৯) আয্যাওয়ায়িদ, (১০) আল বায্যার, (১১) জামিউল জাওয়ামি’, (১২) মাজমাউয্ যাওয়ায়িদ, (১৩) মিশকাত, (১৪) বাইহাক্বী, (১৫) দা’ওয়াতুল কবীর, (১৬) উরফুশ্ শাজী, (১৭) মিরকাত, (১৮) আশয়াতুল লুময়াত, (১৯) লুময়াত, (২০) শরহুত্ ত্বীবী, (২১) তালিক্বুছ্ ছবীহ্, (২২) মুযাহিরে হক, (২৩) মাসাবাতা বিস্ সুন্নাহ ইত্যাদি।}
মুহম্মদ ওবায়দুর রহমান
তেলিগাতা, বিআইটি, খুলনা।
সুওয়ালঃ আমরা জানি যে, তারাবীহ্র নামায ২০ রাকায়াত এবং তা আদায় করা সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ্। অথচ কেউ কেউ বলে ৮ রাকায়াত পড়াই সুন্নত। আবার কেউ কেউ বলে ১২ রাকায়াত পড়াই সুন্নত।
এখন আমরা কোন্ মতের উপর আমল করবো এবং কোন্ মতটি ছহীহ্?
জাওয়াবঃ আহ্লে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের ফতওয়া মুতাবিক তারাবীহ্র নামায ২০ রাকায়াত পড়াই সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ্। অতএব, কেউ যদি ২০ রাকায়াত থেকে এক রাকায়াতও কম পড়ে, তবে তার সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ্ তরক্ব করার গুণাহ্ হবে। অর্থাৎ তারাবীহ্র নামায ২০ রাকায়াতই পড়তে হবে। এবং এর উপরই আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের ইজ্মা হয়েছে।
যারা বলে, তারাবীহর নামায ৮ রাকায়াত, তারা বুখারী শরীফে বর্ণিত হযরত আয়েশা ছিদ্দীকা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা-এর হাদীছ শরীফখানা দলীলস্বরূপ পেশ করে থাকে। যাতে বর্ণিত আছে যে, “আল্লাহ্ পাক-এর রসূল, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমাদ্বান মাসে এবং রমাদ্বান ব্যতীত অন্যান্য মাসে (বিত্রসহ) ১১ রাকায়াত নামায আদায় করতেন।”
মূলতঃ এটি হচ্ছে তাহাজ্জুদ নামাযের বর্ণনা, তারাবীহ্র নামাযের বর্ণনা নয়। কারণ তারাবীহ্র নামায শুধু রমযান মাসের জন্যই নির্দিষ্ট। রমযান ব্যতীত অন্যান্য মাসে তারাবীহ্র নামায নেই। আর তাহাজ্জুদ নামায সারা বৎসরই পড়তে হয়।
উল্লেখ্য, খুলনা জেলা নিবাসী জনৈক লা-মাযহাবী তার প্রচারিত এক লিফলেটে তারাবীহ্র নামায ৮ রাকায়াত হওয়ার স্বপক্ষে এক লক্ষ টাকার চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করে। সে তার লিফলেটে তারাবীহ্ ও তাহাজ্জুদ নামাযকে এক ও অভিন্ন বলে উল্লেখ করেছে। আমরা তার সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করি এবং তার প্রতি পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেই যে, সে তারাবীহ্র নামায ৮ রাকায়াত এবং তারাবীহ্ ও তাহাজ্জুদ নামাযকে এক ও অভিন্ন প্রমাণ করতে পারলে তাকে দশ লক্ষ টাকা পুরস্কার দেয়া হবে। তখন সে গড়িমসি করতে থাকে এবং আমাদের সাথে আলোচনায় বসতে অসম্মতি জ্ঞাপন করে।
স্মর্তব্য, তারাবীহ্ ও তাহাজ্জুদ এক নামায নয়। বরং সম্পূর্ণ আলাদা এবং তার হুকুমও আলাদা। যেমন, তারাবীহ্ শুধুমাত্র রমাদ্বান মাসেই পড়তে হয় আর তাহাজ্জুদ রমাদ্বান ও গায়রে রমাদ্বান সব মাসেই পড়তে হয়। তারাবীহ্র নামায সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ্ আর তাহাজ্জুদ নামায সুন্নতে যায়িদা ইত্যাদি।
মূল কথা হলো- উক্ত জাহিল লা-মাযহাবীর কথিত চ্যালেঞ্জ ধোকা ও প্রতারণামূলক যা প্রকৃতপক্ষে বিভ্রান্তি সৃষ্টির উদ্দেশ্যও বটে।
এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হলে ‘মাসিক আল বাইয়্যিনাত’ পত্রিকার ২৫, ২৬, ২৭, ২৮, ২৯ ও ৩০তম সংখ্যা পাঠ করুন। সেখানে ৩০৪ খানা অকাট্য ও নির্ভরযোগ্য দলীলের ভিত্তিতে ছাবেত করা হয়েছে যে, তারাবীহ্র নামায ২০ রাকায়াত পড়াই সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ্। এবং এটাই গ্রহণযোগ্য ও ছহীহ্ মত।
{দলীলসমূহঃ (১) মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বা, (২) সুনানুল কুবরা লিল বাইহাক্বী, (৩) আল কবীর লিত্ তবারানী, (৪) আল জাওহারুন্নাকী, (৫) নাইনুল আওতার, (৬) ইরশাদুস্ সারী, (৭) মিরকাত, আওজাযুল মাসালিক, (৮) মা’আরিফে মাদানিয়া, (৯) ফতহুল বারী, (১০) উমদাতুল ক্বারী, (১১) বযলুল মাজহুদ, (১২) ফিক্হুস্ সুনান ওয়াল আছার, (১৩) নছবুর রাইয়াহ, (১৪) আইনী শরহে বুখারী, (১৫) আত্ তা’লীকুল হাছানাহ, (১৬) মুযাহিরে হক্ব, (১৭) আশয়াতুল লুময়াত, (১৮) ই’লাউস্ সুনান, (১৯) ফতওয়ায়ে আলমগীরী, (২০) খুলাছাতুল ফতওয়া, (২১) মজমুয়াতুল ফতওয়া, (২২) বাহ্রুর রায়িক, (২৩) মারাকিউল ফালাহ্, (২৪) ইহ্ইয়াউ উলুমিদ্দীন, (২৫) গুন্ইয়াতুত্ ত্বালিবীন ইত্যাদি}
হাফিয মুহম্মদ শফিকুস্ সালেহীন
মতলব, চাঁদপুর।
সুওয়ালঃ হাটহাজারী মাদ্রাসার অখ্যাত মাসিক পত্রিকা আগষ্ট/২০০৩ ঈসায়ী সংখ্যায় জিজ্ঞাসা-সমাধান বিভাগে ‘খতমে তারাবীহ্-এর বিনিময় গ্রহণ করা’ সম্পর্কে একটি জিজ্ঞাসার-সমাধানে বলা হয়েছে, “তারাবীহের নামাযে কুরআন খতম করে বিনিময় গ্রহণ করা নাজায়েয- এর উপর সকল ফুক্বাহায়ে কিরাম একমত। যেহেতু কুরআন খতম করা ইবাদত, আর ইবাদতের বিনিময় নেওয়া হারাম। কিন্তু পরবর্তী যুগের ফুক্বাহায়ে কিরাম কিছু কিছু ইবাদতের বিনিময় নেওয়াকে বৈধ বলে ফাতওয়া দিয়েছেন দ্বীন-ইসলাম রক্ষার স্বার্থে। যেমন, ইমামতী, আযান, কুরআনের তা’লীম প্রভৃতির ক্ষেত্রে বিনিময় গ্রহণ জায়িয বলে ফাত্ওয়া দেওয়া হয়েছে। কেননা, এগুলোর বিলুপ্তিতে ইসলামের বিলুপ্তি অবধারিত হয়ে পড়বে। পক্ষান্তরে তারাবীহ্রে নামাযে কুরআন খতম করার ইবাদতটি এ পর্যায়ের নয়। তাই এর বিনিময় নেওয়া শরীয়তের দৃষ্টিতে নাজায়েয।…..
আর অখ্যাত মাসিক রাহমানী পয়গাম আগস্ট/২০০৩ ঈসায়ী সংখ্যার এক জিজ্ঞাসার-জবাবে বলা হয়েছে, “… মৃত ব্যক্তির জন্য কুরআন খতম, ইছালে ছাওয়াব ও মাগফিরাতের দু’আ করে এর জন্য কোন প্রকার বিনিময় নেয়া বা দেয়া শরীয়তের দৃষ্টিতে জায়িয নেই, হারাম।” …
এছাড়া মাসিক মদীনা মার্চ/২০০৩ ঈসায়ী সংখ্যায় প্রশ্নোত্তর বিভাগে ৫৬নং প্রশ্নের উত্তরে বলা হয়েছে, “… পারিশ্রমিক নিয়ে খতম তারাবীহ্ পড়া বা পড়ানো আলেমগণ নিষিদ্ধ সাব্যস্ত করে থাকেন।”
অখ্যাত পত্রিকাত্রয়ের উল্লিখিত বক্তব্যে যে বিষয়গুলো আমার নিকট আপত্তিকর মনে হয়েছে তা নিম্নে উল্লেখ করা হলো-
(ক) তারাবীহ্ নামাযে কুরআন খতম করে বিনিময় গ্রহণ করা নাজায়িয এর উপর সকল ফুক্বাহা-ই-কিরাম একমত।
(খ) যেহেতু কুরআন খতম করা ইবাদত, আর ইবাদতের বিনিময় নেয়া হারাম।
(গ) কিছু কিছু ইবাদতের বিনিময় …… যেমন, ইমামতি, আযান, কুরআনের তা’লীম প্রভৃতির ক্ষেত্রে বিনিময় গ্রহণ করা জায়িয।
এখন আমার সুওয়াল হলো- অখ্যাত পত্রিকাত্রয়ে এবং বিশেষ করে হাটহাজারীর অখ্যাত পত্রিকায় বলা হয়েছে, ‘ইবাদতের বিনিময় নেয়া হারাম’ এবং এরপর বলা হয়েছে, ‘জায়িয।’
সুতরাং তাদের এই স্ববিরোধী বক্তব্যের কারণে আমি দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়েছি। দয়া করে দলীল-আদিল্লাহ্সহ সঠিক জাওয়াব দিয়ে আমার সংশয়-সন্দেহ দূর করবেন।
জাওয়াবঃ তারাবীহ্ নামাযে কুরআন শরীফ খতম করে বিনিময় গ্রহণ করা সম্পর্কে উপরোল্লিখিত পত্রিকাত্রয়ের বক্তব্য সঠিক হয়নি। বরং তাদের উক্ত বক্তব্য সম্পূর্ণই ভুল, অশুদ্ধ, স্ববিরোধী, বিভ্রান্তিকর ও অনুস্মরণীয় সকল উলামা-ই-মুতাআখ্খিরীন, ইমাম-মুজতাহিদ ও ফক্বীহগণের ফতওয়াগ্রাহ্য মতের বিপরীত হয়েছে।
কারণ তারাবীহ নামাযে কুরআন শরীফ খতম করে বিনিময় গ্রহণ করা নাজায়িয; এর উপর সকল ফুক্বাহা-ই-কিরাম একমত নন। কেননা সকল উলামা-ই-কিরাম দু’ভাগে বিভক্ত। (১) উলামা-ই-মুতাকাদ্দিমীন (২) উলামা-ই-মুতাআখ্খিরীন
এই মাসয়ালাটি সম্পর্কে উলামা-ই-মুতাকাদ্দিমীন ও উলামা-ই-মুতাআখ্খিরীনগণ ইখতিলাফ করেছেন। যেমন, উলামা-ই-মুতাকাদ্দিমীনগণ বলেছেন, “সর্বপ্রকার ইবাদতের বিনিময় গ্রহণ করা বাতিল তথা নাজায়িয।” আর উলামা-ই-মুতাআখ্খিরীনগণ বলেছেন, “সর্বপ্রকার ইবাদতের বিনিময় গ্রহণ করা জায়িয । তবে তা শর্ত সাপেক্ষে।”
যেমন, এ প্রসঙ্গে হানাফী ফিক্বাহের প্রসিদ্ধ কিতাব “জামিউর রুমূযে” উল্লেখ আছে,
تبطل الاجارة عند المتقدمين للعبادات كالاذان والامامة والتذكير والتدريس والحج والغزو وتعليم القران والفقه وقراتهما ويفتى البوم اى يفتى المتأخرون بصحتها اى الاجارة لهذا العبادات.
অর্থঃ- “পূর্ববর্তী আলিমগণের অর্থাৎ উলামা -ই-মুতাকাদ্দিমীনগণের মতে আযান, ইমামতি, ওয়াজ, শিক্ষকতা, হজ্জ্ব, জ্বিহাদ, কুরআন শরীফ ও ফিক্বাহ্ শিক্ষা দিয়ে ও ফিক্বাহ্ এবং কুরআন শরীফ পাঠ বা তিলাওয়াত করে ইত্যাদি ইবাদতসমূহের বিনিময়ে উজরত বা পারিশ্রমিক গ্রহণ করা বাতিল ও নাজায়িয।
কিন্তু বর্তমানে অর্থাৎ উলামা-ই-মুতাআখ্খিরীন (পরবর্তী) আলিমগণ ফতওয়া দেন যে, কুরআন শরীফ তিলাওয়াতসহ উল্লেখিত ইবাদতের বিনিময়ে অর্থাৎ আযান, ইমামতি, ওয়াজ, শিক্ষকতা, হজ্জ্ব, জ্বিহাদ, কুরআন শরীফ ও ফিক্বাহ্ শিক্ষা দিয়ে ও ফিক্বাহ্ এবং কুরআন শরীফ পাঠ বা তিলাওয়াত করে ইত্যাদি ইবাদতসমূহের বিনিময়ে উজরত বা পারিশ্রমিক গ্রহণ করা জায়িয ও ছহীহ্।”
উপরোক্ত দলীলের ভিত্তিতে যদি উলামা -ই-মুতাকাদ্দিমীনগণের মতকেই ফতওয়া হিসেবে গ্রহণ করা হয়, তাহলে তো ইমামতি, আযান, কুরআন শরীফ তা’লীম, শিক্ষকতা ইত্যাদি সমস্ত ইবাদতের বিনিময়ে উজরত বা পারিশ্রমিক গ্রহণ করা নাজায়িয ও হারাম হবে।
আর যদি উলামা-ই-মুতাআখ্খিরীনগণের মতকে ফতওয়া হিসেবে গ্রহণ করা হয়, তাহলে কুরআন শরীফ পাঠ করে উজরত গ্রহণসহ সকল প্রকার ইবাদতের উজরত বা পারিশ্রমিক গ্রহণ করা জায়িয ও হালাল হবে।
“ইবাদতের বিনিময় নেয়া হারাম” এ মতটি উলামা-ই-মুতাকাদ্দিমীনগণের মত। কিন্তু উলামা-ই মুতাকাদ্দিমীনগণের মতের উপর ফতওয়া নয়। বরং ফতওয়া হলো উলামা-ই-মুতাআখ্খিরীনগণের মতের উপর। আর তা হলো ইবাদতের বিনিময় নেয়া জায়িয।
এ প্রসঙ্গে “তাফসীরে রুহুল বয়ানে” উল্লেখ রয়েছে যে,
وافتى المتاخرون بصحة الاجرة للاذان والاقامة والتذكير والتدريس والحج والغزو وتعليم القران والفقه وقرأتهما لفتور رغبات اليوم.
অর্থঃ- “উলামায়ে মুতাআখ্খিরীনগণ বর্তমানকালে দ্বীনের খিদমতে আগ্রহ শিথিল হওয়ার কারণে আযান, ইক্বামত, ওয়াজ-নছীহত, শিক্ষকতা, হজ্জ্ব, জ্বিহাদ, কুরআন শরীফ ও ফিক্বাহ্ শিক্ষা দিয়ে এবং ফিক্বাহ ও কুরআন শরীফ পাঠ করে উজরত বা পারিশ্রমিক গ্রহণ করা ছহীহ্ বা জায়িয ফতওয়া দিয়েছেন।”
শুধুমাত্র কিছু কিছু ইবাদতের বিনিময়েই নয় বরং উলামা-ই-মুতাআখ্খিরীনগণ বলেন যে, “সময় বা স্থান নির্ধারণ করার শর্তে কুরআন শরীফ খত্ম করা তথা খ্ত্মে তারাবীহ ও সূরা তারাবীহ্সহ সকল প্রকার ফরয, ওয়াজিব ও সুন্নতে মুয়াক্কাদা ইত্যাদি সর্বপ্রকার ইবাদতের বিনিময়ে উজরত বা পারিশ্রমিক দেয়া এবং গ্রহণ করা জায়িয ও শরীয়তসম্মত।” এটাই গ্রহণযোগ্য মত এবং এ মতের উপরই ফতওয়া। এর বিপরীত ফতওয়া দেয়া নাজায়িয ও হারাম। ”
উল্লেখ্য, তারাবীহ্ নামাযে কুরআন শরীফ খতম করার ইবাদতটি হলো সুন্নতে মুয়াক্কাদায়ে কিফায়া অর্থাৎ ফিক্বাহ্বিদগণের রায় বা ফতওয়া হলো, তারাবীহ্ নামাযে কুরআন শরীফ কমপক্ষে একবার খতম করা সুন্নতে মুয়াক্কাদায়ে কিফায়া।
যেমন, এ প্রসঙ্গে ফিক্বাহ্র মশহুর কিতাব “রদ্দুল মুহতারে” উল্লেখ আছে যে,
والختم مرة سنة ومرتين فضيلة وثلاثا افضل ولا يترك الختم لكسل القوم.
অর্থঃ- “তারাবীহ্ নামাযে একবার কুরআন শরীফ খতম করা সুন্নত অর্থাৎ সুন্নতে কিফায়া। দু’বার খতম করার মধ্যে ফযীলত রয়েছে। তিন বার খতম করা উত্তম। লোকদের গাফলতীর কারণে কুরআন শরীফ খতম তরক করা উচিৎ হবেনা।”
এছাড়াও বাহ্রুর রায়িক, আলমগীরী, শামী, দুররুল মুখতার, সিরাজুল ওয়াহ্হাজ, মারাক্বিউল ফালাহ্, কাফী, গায়াতুল আওতার, আইনুল হিদায়া, নিহায়া, ইনায়া, ফতওয়ায়ে দেওবন্দ ইত্যাদি আরো অনেক ফিক্বাহ্র কিতাবসমূহে তারাবীহ্ নামাযে কমপক্ষে একবার কুরআন শরীফ খতম করা সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ্ অর্থাৎ সুন্নতে মুয়াক্কাদায়ে কিফায়া বলা হয়েছে।
দ্বিতীয়তঃ অখ্যাত মাসিক রাহমানী পয়গাম পত্রিকায় বলা হয়েছে, “… মৃত ব্যক্তির জন্য কুরআন খতম, ইছালে ছাওয়াব ও মাগফিরাতের দু’আ করে এর জন্য কোন প্রকার বিনিময় নেয়া বা দেয়া শরীয়তের দৃষ্টিতে জায়িয নেই, হারাম। ….”
এর জবাবে বলতে হয়, অখ্যাত মাসিক রাহমানী পয়গামের উক্ত বক্তব্যও ভুল ও অশুদ্ধ হয়েছে।
কারণ, মৃত ব্যক্তির জন্য কুরআন শরীফ খতম করে, ইছালে ছওয়াব করে অথবা মাগফিরাতের জন্য দোয়া করে বিনিময় নেয়া-দেয়া জায়িয, হালাল এবং শরীয়ত সম্মত।
যেমন, এ প্রসঙ্গে ফতওয়ার বিখ্যাত কিতাব “বাহ্জাতুল ফতওয়াতে” উল্লেখ আছে যে,
উর্দূ কম্পোজ করতে হবে
অর্থঃ- “যায়েদ মসজিদের ইমাম ছাহেবকে এই হেতু এক গোরশ প্রদান করলো যে, সে (অর্থাৎ ইমাম ছাহেব) ইশার নামাযের পর সূরায়ে মূল্ক পাঠ করে যায়েদের মৃত আত্মীয়-স্বজনের রূহের উপর ছওয়াব পৌঁছিয়ে দিবে, এটা জায়িয হবে কিনা?
জাওয়াবঃ- জায়িয হবে।”
ফিক্বাহ্র মশহুর কিতাব “হাদীক্বায়ে নদিয়াহ্তে” আরো উল্লেখ আছে যে,
من تلا القران او ذكر الله تعالى لوجه الله واخذ شيا من الدنيا وجعل عبادته هذه للمعطى جاز و وجهه ان اخذ الدراهم صدقة من المعطى واخد الصدقة لايمنع الثواب.
অর্থঃ- “যে ব্যক্তি কুরআন শরীফ তিলাওয়াত, যিকির ইত্যাদি আল্লাহ্র ওয়াস্তে করে এবং কিছু টাকা-পয়সার বিনিময়ে কাউকে উক্ত ইবাদতগুলো প্রদান করে, তবে এটা জায়িয হবে। তার কারণ এই যে, টাকা-পয়সা দাতার পক্ষ হতে দান। দান গ্রহণ করাতে ছওয়াবের ক্ষতি হয়না।”
তৃতীয়তঃ মাসিক মদীনা পত্রিকায় বলা হয়েছে, “… পারিশ্রমিক নিয়ে খতম তারাবীহ্ পড়া বা পড়ানো আলেমগণ নিষিদ্ধ সাব্যস্ত করে থাকেন।”
এর জবাবে বলতে হয় যে, পারিশ্রমিক নিয়ে খতম তারাবীহ্ পড়া বা পড়ানো কোন্ কোন্ আলিমগণ নিষিদ্ধ করেছেন তা মাসিক মদীনার সম্পাদক সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেনি।
সুতরাং মাসিক মদীনার অস্পষ্ট ও দলীলবিহিন বক্তব্য মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়।
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, তারাবীহ্ নামাযে ও মৃত ব্যক্তির জন্য কুরআন শরীফ খতম করে বা ইছালে ছওয়াব করে বা মাগফিরাতের জন্য দোয়া করে বিনিময় নেয়া-দেয়া সম্পর্কে হাটহাজারী অখ্যাত মাসিক পত্রিকা, অখ্যাত মাসিক রাহমানী পয়গাম ও মাসিক মদীনার অল্প জ্ঞান সম্পন্ন মৌলভী ছাহেব এবং তাদের সমগোত্রীয়দের বক্তব্য সম্পূর্ণই ভুল যা ফতওয়াগ্রাহ্য মতের বিপরীত হওয়ার কারণে সেটা পরিত্যাজ্য।
(বিঃদ্রঃ তারাবীহ্ নামাযে কুরআন শরীফ খতম করে বিনিময় গ্রহণ করা জায়িয’ এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে হলে মাসিক আল বাইয়্যিনাত-এর ২৩ ও ২৪তম সংখ্যার ফতওয়া বিভাগ পড়ুন এবং বিশেষ করে ৩৬, ৪৭, ৬৬, ৭১, ৭৭, ৮৭, ৮৮, ৯০ ও ১১১তম সংখ্যা পাঠ করুন। সেখানে মাসিক মদীনা,অখ্যাত মাসিক রাহমানী পয়গাম এবং হাটহাজারীর অখ্যাত মাসিক পত্রিকার ভুল বক্তব্য খণ্ডন করে সঠিক জাওয়াব দেয়া হয়েছে। এবার ৮ম বারের মত অখ্যাত মাসিক রাহমানী পয়গামের, ২য় বারের মত মাসিক মদীনার এবং ৮ম বারের মতো হাটহাজারীর অখ্যাত মাসিক পত্রিকার ভুল বক্তব্য খণ্ডন করে সঠিক জাওয়াব দেয়া হলো।
এছাড়াও ১৩, ১৪, ২২, ২৫, ২৬, ৩০, ৩৬, ৪৭, ৫২, ৫৩, ৫৭ এবং ৫৮ থেকে ৬৯তম সংখ্যার মতামত বিভাগের উজরত সম্পর্কে তথাকথিত শায়খূল হাদীছের “ভণ্ডামী ফাঁস” মতামতটি পাঠ করুন।)
{দলীলসমূহঃ (১) তাফসীরে রুহুল বয়ান, (২) তাফসীরে ইকলীল, (৩) তাফসীরে আযীযী, (৪) আলমগীরী, (৫) তাতারখানিয়া, (৬) দুররুল মুখতার, (৭) আশবাহ ওয়ান্ নাজায়ির, (৮) জাওহারাতুন্ নাইয়্যারাহ্ (৯) বাহরুর রায়িক, (১০) তাহতাবী, (১১) বাহজাতুল ফতওয়া, (১২) কাশফুল গুম্মাহ, (১৩) ফতওয়ায়ে আলী আফেন্দী, (১৪) ফতওয়ায়ে ফয়জী, (১৫) ফতওয়ায়ে আবূ সাউদ ইমাদী, (১৬) ফতওয়ায়ে আব্দুর রহীম আফেন্দী, (১৭) মজমূয়ায়ে ফতওয়ায়ে আব্দুল হাই, (১৮) হাদিক্বায়ে নাদিয়াহ, (১৯) মাদারেজুন নবুওয়াত, (২০) রোবউল ইফাদাহ, (২১) হাশিয়ায়ে মিসকীন, (২২) জামিউর রুমূজ (২৩) শিফাউল আলীল, (২৪) ইয়াতীমাতুদ্দাহর লিল ইমাম আলাউদ্দীন হানাফী ইত্যাদি।}
মুসাম্মত সানজিদা আক্তার
সভানেত্রী- ছাত্রী আঞ্জুমানে আল বাইয়্যিনাত
মুহম্মদপুর, ঢাকা।
সুওয়ালঃ অখ্যাত মাসিক রাহমানী পয়গাম এপ্রিল/২০০৩ ঈসায়ী সংখ্যায় জিজ্ঞাসার-জবাব বিভাগে নিম্নোক্ত ১২৪৭নং জিজ্ঞাসার-জবাব ছাপা হয়-
জিজ্ঞাসা: সাহাবী আবু সাঈদ খুদরী ও আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা বলেন যে, রাসূল (সাঃ) বলেছেন আমার মৃত্যুর পর পূর্ব দেশগুলির মধ্য হতে কোন একটি দেশ থেকে আমার উম্মতের ভিতর হতে একটি দল বের হবে। এই দলের সদস্যগণ হবে অশিক্ষিত ও মূর্খ। এদের মধ্যে কোন শিক্ষিত লোক গেলে সেও হয়ে যাবে মূর্খের মত। তাদের বক্তৃতা হবে বহু বহু গুণের ফজিলতের। তাদের মত বক্তৃতা বা বয়ান কারো হবে না। তাদের সকল আমল হবে খুবই নিখূঁত ও সুন্দর। তাদের নামাযের তুলনায় তোমরা তোমাদের নামাযকে তুচ্ছ মনে করবে, তাদের রোযা দেখে তোমাদের রোযাকে তোমরা তুচ্ছ ও নগণ্য মনে করবে। তাদের আমল দেখে তোমরা তোমাদের আমলকে হেয় মনে করবে, তারা কুরআন পড়বে কিন্তু তা তাদের গলার নিচে যাবেনা। তারা কুরআনের উপর আমল কিম্বা কুরআন-প্রতিষ্ঠার একটু চেষ্টাও করবে না কখনো। এদলের আমল যতই তোমাদেরকে আকৃষ্ট করুক না কেন, কখনই তাদের দলে যাবেনা। কারণ প্রকৃতপক্ষে এরা হবে ইসলাম হতে খারিজ, দ্বীন হতে বহির্ভূত। তীর যেমন ধনুক হতে বের হয়ে যায় সে আর কখনও ধনুকের নিকট ফিরে আসেনা। তেমনিই এরা দ্বীন থেকে বেরিয়ে যাবে, আর কখনও দ্বীনের পথে, কুরআন ও সুন্নাহ্র পথে ফিরে আসবেনা।
আমার প্রশ্ন হল, উপরোক্ত হাদীছ ছহীহ্ কি-না? ছহীহ্ হলে এ দ্বারা উদ্দেশ্য কারা? উক্ত হাদীসের সাথে তাবলীগ জামাতের কোন সম্পর্ক আছে কি-না? অনেকে এই হাদীসের সাথে তাবলীগ জামাতকে জড়াতে চান। উক্ত হাদীসের সঙ্গে তাবলীগ জামাতকে জড়ানো সঠিক কি-না?
জবাবঃ প্রশ্নে বর্ণিত হাদীছ ছহীহ্। মুহাদ্দিছীনে কেরাম উক্ত হাদীছসহ এ জাতীয় হাদীছসমূহের ব্যাখ্যায় বলেছেন যে, এ সব হাদীছ দ্বারা একটি নির্ধারিত জামাত বা খারিজী ফেরক্বা নামে পরিচিত তাদেরকে বুঝানো হয়েছে। হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এর খেলাফত আমলে এই হাদীছসমূহের বাস্তবতা এবং খাওয়ারেজদের অবস্থার সমন্বয় ঘটেছিল। যার দ্বারা একথা সুস্পষ্টভাবে বলা চলে যে, এ হাদীছসমূহ দ্বারা একমাত্র খাওয়ারেজদেরকেই বুঝানো হয়েছে। সুনির্দিষ্ট কোন প্রমাণাদি ছাড়া অন্য কোন জামাতকে এই হাদীসের অন্তর্ভুক্ত করা যাবেনা।
কোন প্রকার প্রমাণ ছাড়া তাবলীগ জামাতকে এই হাদীছসমূহের মেসদাক বা উদ্দেশ্য বানানো, তাদেরকে খাওয়ারেজ বলা শরীয়তের দৃষ্টিতে মারাত্মক অন্যায় ও অপরাধ। তাবলীগের নিয়মনীতি ও কার্যক্রম পুরোপুরি শরীয়তসম্মত। ইসলাম পরিপন্থী কোন কিছু এতে নেই। বর্তমান বিশ্বে আল্লাহ্ তা’আলা তাবলীগ জামাতের মাধ্যমে পথহারা, ঈমানহারা, হেদায়েত থেকে বঞ্চিত অসংখ্য মানুষকে হেদায়েত করেছেন, ঈমান আনার তাওফিক দান করেছেন। এছাড়া এ জামাতের পৃষ্ঠপোষকতায় রয়েছে অসংখ্য জগদ্বিখ্যাত আলেম ও ইসলামী চিন্তাবিদ।
অতএব, তাবলীগ জামাতকে খারেজী জামাত বলা, মিথ্যা অপবাদ বৈ কিছুই নয়। (ফতহুল বারী ১২ঃ৩৫০, আল মিরকাত ৭ঃ১০৭)
উক্ত অখ্যাত পত্রিকার উল্লিখিত “জিজ্ঞাসা-জবাবের” প্রেক্ষিতে আমার সুওয়াল বা জানার বিষয় হলো-
(১) উল্লিখিত হাদীছ শরীফে বর্ণিত গুণাবলী প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগীদের মধ্যে আছে কি?
(২) উল্লিখিত হাদীছ শরীফ দ্বারা কি শুধু খারিজী ফিরক্বার লোকদেরকেই বুঝানো হয়েছে? নাকি খারিজীদের ন্যায় আক্বীদা পোষণকারীদের ক্ষেত্রেও এ হাদীছ শরীফ প্রযোজ্য?
(৩) প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগীদের মধ্যে শরীয়ত বিরোধী বা ইসলাম পরিপন্থী কোন নিয়মনীতি বা আক্বীদা, আমল নেই, এটা কতটুকু সত্য?
(৪) প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগের পৃষ্ঠপোষকতায় বা পরিচালনায় যারা রয়েছে তারা সকলেই হক্কানী আলিম, এ দাবী কতটুকু সঠিক? আসলে হক্কানী আলিমের সংজ্ঞা বা পরিচিতি কি?
(৫) কুরআন-সুন্নাহ্র কোথাও প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগ করার নির্দেশ আছে কি? প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগ করা কুরআন-সুন্নাহ্ মতে জায়িয কিনা?
কুরআন, সুন্নাহ্, ইজমা ও ক্বিয়াসের দৃষ্টিতে দলীলভিত্তিক জাওয়াব দিয়ে আমাদের আক্বীদা, আমল হিফাযতে সহায়তা করবেন বলে আমরা আশাবাদী।
জাওয়াবঃ প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগ জামায়াত সম্পর্কিত উক্ত অখ্যাত পত্রিকার জবাব শুদ্ধ হয়নি। বরং ভুল, মনগড়া ও দলীলবিহীন হয়েছে।
শুধু তাই নয়, তারা প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগীদের সাফাই গাইতে গিয়ে বর্ণিত হাদীছ শরীফের অপব্যাখ্যা করেছে। সাথে সাথে “ছয় উছূলীদের মধ্যে কুরআন-সুন্নাহ্ বিরোধী কোন আক্বীদা-আমল নেই” বলে তাদের নির্লজ্জ দালালী করে নিজেদেরকে অপব্যাখ্যাকারী ও মিথ্যাবাদীরূপে সাব্যস্ত করেছে। সুওয়ালে উল্লিখিত বিষয়গুলোর ধারাবাহিক দলীলভিত্তিক আলোচনা করলেই তা আরো সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হবে।
তাই নিম্নে সুওয়ালে বর্ণিত বিষয়গুলোর দলীলভিত্তিক জাওয়াব দেয়া হলো-
(ধারাবাহিক)
ছয় উছূলী তাবলীগ সম্পর্কে প্রশ্নে
উল্লিখিত অখ্যাত পত্রিকার অপব্যাখ্যা
ও মিথ্যাচারীতার খণ্ডনমূলক জবাব- (৩)
প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগ সম্পর্কে অখ্যাত পত্রিকার ‘জিজ্ঞাসার জবাবের’ প্রেক্ষিতে আপনার তৃতীয় সুওয়াল হলো- “(৩) প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগীদের মধ্যে শরীয়ত বিরোধী বা ইসলাম পরিপন্থী কোন নিয়মনীতি বা আক্বীদা-আমল নেই, এটা কতটুকু সত্য?”
আপনার উক্ত সুওয়ালের প্রেক্ষিতে বলতে হয় যে, অখ্যাত পত্রিকার উক্ত বক্তব্য মোটেও সত্য নয়, কেননা প্রচলিত ছয় উছূলীদের মধ্যে একটি দু’টি নয়, বরং অসংখ্য কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী নিয়মনীতি বা আক্বীদা-আমল ও বক্তব্য রয়েছে, যা তাদের মুরুব্বীদের লিখা কিতাবাদিতেই বিদ্যমান রয়েছে। তাই নিম্নে ধারাবাহিকভাবে, পর্যায়ক্রমে প্রচলিত ছয় উছূলীদের কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী ও কুফরীমূলক বক্তব্যগুলোর সাথে সাথে কুরআন-সুন্নাহ্র দৃষ্টিতে তার সঠিক ফায়সালা তুলে ধরা হলো-
প্রচলিত ছয় উছূলীদের কুরআন-সুন্নাহ
বিরোধী কুফরীমূলক বক্তব্য- ৩
“মাওলানা ইলিয়াছ সাহেবের মলফূযাতের ১৮ পৃষ্ঠার ২৯নং মলফূযে একথা উল্লেখ আছে যে, নামাজ-রোজা উচ্চাঙ্গের ইবাদত কিন্তু দ্বীনের সাহায্যকারী নয়। ”
মাওলানা ইলিয়াছ ছাহেবের ‘মালফুযাতের’ উল্লিখিত মন্তব্যটি জিহালতপূর্ণ, বিভ্রান্তির কারণ ও কুফরীমূলকও বটে। মূলতঃ সব ইবাদতই দ্বীনের সাহায্যকারী। যার কারণে হাদীছ শরীফে এসেছে, “কোন ইবাদতকেই ছোট মনে করোনা, তা যদি তোমার ভাইয়ের সাথে হাসিমুখে সাক্ষাতও হয়।”
আবার দ্বীনের সাহায্যকারী সব কাজই ইবাদত।
বর্ণিত আছে, হযরত শোয়াইব আলাইহিস্ সালাম যখন তাঁর জাতিকে তাওহীদের আহ্বানসহ সকল পাপাচার থেকে বিরত হওয়ার দাওয়াত দিলেন, তখন তারা বিস্ময়ে ভাবতো, কোন্ জিনিস তাকে এভাবে উৎসাহিত করলো। তারা দেখলো যে, তিনি ছলাত আদায় করেন। অতঃপর তাদের প্র্রশ্নটা কুরআন শরীফের ভাষায় বর্ণিত হয়েছে এভাবে-
قالوا ياشعيب اصلوتك تأمرك ان نترك ما يعبد ابائنا او ان نفعل فى اموالنا ما نشاؤ انك لانت الحليم الرشيد.
অর্থঃ- “আপনার ছলাত কি আমাদের এ নির্দেশই দেয় যে, আমরা আমাদের পুর্ব পুরুষদের পূজনীয় বিষয়গুলো ত্যাগ করবো? কিংবা আমরা বিরত থাকবো আমাদের ধন-সম্পদ নিয়ে যা ইচ্ছা তাই করা থেকে? আপনি তো বেশ বুদ্ধিমান, ধার্মিক?” (সুরা হুদ/৮৭)
হাদীছ শরীফে বর্ণিত আছে। ইসলাম-এর পাঁচটি ভিত্তি বা খুঁটি।
(১) স্বাক্ষ্য দেয়া- আল্লাহ্ পাক ব্যতীত কোন ইলাহ্ নেই এবং মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ্ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ্ পাক-এর বান্দা ও রসূল। (২) নামায ক্বায়িম করা। (৩) যাকাত দেয়া। (৪) রমাদ্বান মাসের রোযা রাখা। (৫) হজ্ব করা। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত, ফতহুল বারী, উমদাতুল ক্বারী, ফত্হুল মুলহিম, মিরকাত, আশয়াতুল লুময়াত, লুময়াত, শরহুত্ ত্বীবী ইত্যাদি।)
হাদীছ শরীফে আরো বর্ণিত আছে, “নামায দ্বীনের খুঁটি। যে নামায ক্বায়িম রাখলো, সে দ্বীন ক্বায়িম রাখলো এবং যে নামায তরক করলো, সে দ্বীন ধ্বংস করলো।”
উপরোক্ত আয়াত শরীফ ও হাদীছ শরীফসমূহ দ্বারা এ কথাই স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, নামায ও রোযা দ্বীনের স্তম্ভ বা খুঁটি। খুঁটি বা স্তম্ভই হচ্ছে দ্বীনের মূল সাহায্যকারী।
অতএব নামায, রোযা উচ্চাঙ্গের ইবাদত, কিন্তু দ্বীনের সাহায্যকারী নয়, একথাটি সম্পূর্ণ ভুল। মূলতঃ নামায, রোযা উচ্চাঙ্গের ইবাদতের সাথে সাথে দ্বীনের মূল সাহায্যকারীও বটে।
যে প্রসঙ্গে সূরা বাক্বারার ১৫৩ নং আয়াত শরীফে আল্লাহ্ পাক বলেন,
يا ايها الذين امنوا استعينوا بالصبر والصلوة.
অর্থঃ- “হে ঈমানদারগণ। তোমরা ধৈর্য ও ছলাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর।”
এই আয়াত শরীফের তাফসীরে আমরা দেখতে পাই স্বয়ং হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, বদরের জিহাদে এবং অন্যান্য জিহাদে দ্বীনকে বিজিত করার জন্য এবং দ্বীনের সাহায্যকারীদেরকে (হযরত ছাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণকে) হিফাযতের জন্য আল্লাহ্ পাক-এর কাছে নামাযের ও ছবরের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করেছেন। (সীরাতুন নবী, মাদারিজুন নুবুওওয়াত, সীরাতে হালবীয়া, যাদুল মায়াদ, ইবনে হিশাম ইত্যাদি)
তাহলে একথা কি করে শরীয়তসম্মত হতে পারে যে, “নামায, রোযা দ্বীনের সাহায্যকারী নয়?”
সূরা ‘আনকাবুতে’ ৪৫নং আয়াতে আল্লাহ্ পাক বলেন,
ان الصلوة تنهى عن الفحشاء والمنكر.
অর্থঃ- “নিশ্চয়ই ছলাত, অশ্লীল এবং অশোভনীয় কাজ থেকে মানুষকে বিরত রাখে।”
এই আয়াত শরীফের ব্যাখ্যায় হাদীছ শরীফে রয়েছে- একজন ছাহাবী এসে একদিন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে বললেন, “ইয়া রসূলাল্লাহ্ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! “অমুক ব্যক্তি সারা রাত নামায পড়ে কিন্তু সকাল হলেই চুরি করে।” তখন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “নিশ্চয়ই নামায অতি শীঘ্রই তাকে ফিরিয়ে রাখবে তুমি যা বলছ তা থেকে অর্থাৎ চুরি থেকে।” (আহ্মদ, বায়হাক্বী, মিশকাত, মিরকাত, শরহুত্ ত্বীবী, মিরআতুল মানাজীহ্, মুযাহিরে হক্ব, আশয়াতুল লুময়াত।)
আর রোযা সম্পর্কে আল্লাহ্ পাক কুরআন শরীফে বলেন,
كتب عليكم الصيام كما كتب على الذين من قبلكم لعلكم تتقون.
অর্থঃ- “তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হলো যেমন পূর্ববর্তীদের উপর করা হয়েছিল। আশা করা যায় (রোযা দ্বারা), তোমরা তাক্বওয়া হাছিল করতে পারবে।” (সূরা বাক্বারা/১৮৭)
অর্থাৎ রোযার দ্বারা তাক্বওয়া হাছিল হয়। হাদীছ শরীফে রয়েছে, “তাক্বওয়া হচ্ছে সমস্ত ইবাদতের মূল।”
আর কুরআন শরীফে সূরা হুজুরাতের ১৩নং আয়াত শরীফে আল্লাহ্ পাক বলেন,
ان اكرمكم عند الله اتقكم.
অর্থঃ- “নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি আল্লাহ্ পাক-এর কাছে সবচেয়ে বেশী সম্মানিত, যে সবচেয়ে বেশী পরহেযগার অর্থাৎ তাক্বওয়াধারী।”
আর হাদীছ শরীফে রয়েছে, الصيام جنة.
অর্থঃ- “রোযা হচ্ছে মু’মিনের জন্য (পাপাচার) থেকে বেঁচে থাকার ঢাল স্বরূপ।” (বুখারী, মুসলিম, ফতহুল বারী, উমদাতুল ক্বারী, শরহে নববী, ফতহুল মুলহিম)
হাদীছ শরীফে আরো বর্ণিত আছে,
من لم يدع قول الزور والعمل به فليس لله حاجة فى ان يدع طعامه وشرابه.
অর্থঃ- “যে মিথ্যা কথা ত্যাগ করলনা এবং অনুরূপ আমল (অশ্লীল, অশালীন, খিলাফে শরা’) থেকে বিরত থাকলনা, এ প্রকার লোকের খাদ্য, পানীয় থেকে বিরত থাকার কোন জরুরতই আল্লাহ্ পাক-এর কাছে নেই। অর্থাৎ যারা রোযা রেখে তাক্বওয়া হাছিল করতে পারেনা তাদের রোযার, আল্লাহ্ পাক-এর কোন দরকার নেই। (বুখারী শরীফ, মিশকাত, ফতহুল বারী, উমদাতুল ক্বারী, ইরশাদুস্ সারী, শরহুত্ ত্বীবী, তা’লীকুছ্ ছবীহ, মিরকাত)
অর্থাৎ রোযা রোযাদারকে সকল পাপাচার থেকে বিরত রাখবে। অর্থাৎ ছলাত ও রোযা সকল প্রকার পাপাচার বা অশ্লীল, অশোভনীয় কাজ থেকে বিরত রেখে মানুষের চরিত্রকে সুন্দর করে তোলে এবং তার চারিত্রিক সৌন্দর্য দ্বারা মুগ্ধ হয়ে মুসলমান, অমুসলমান সকলেই তার মাধ্যমে ইসলামের পরিচয় পেয়ে ইসলাম বা দ্বীনের প্রতি আকৃষ্ট হয়। এবং তারাও পাপাচার থেকে বিরত হয়ে নেক কাজে লিপ্ত হয়। এভাবে তার দ্বারা প্রকারান্তরে দ্বীনের প্রচার-প্রসারের কাজ হয় বা দ্বীনের বড় ধরণের সাহায্য হয়। অর্থাৎ দ্বীনের কাজে সাহায্য করার তাওফীক সে প্রাপ্ত হয় এবং তার দ্বারা দ্বীনের সাহায্য হয়।
তাহলে কেন একথা বলা শরীয়তের খিলাফ ও কুফরী হবেনা যে, “নামায, রোযা দ্বীনের সাহায্যকারী নয়।”
মূলতঃ তাদের উপরোক্ত বক্তব্য সম্পূর্ণরূপে জিহালতপূর্ণ, বিভ্রান্তিকর, শরীয়তবিরোধী ও কাট্টা কুফরী যার থেকে বিরত থাকা সকলের জন্যেই ফরয-ওয়াজিবের অন্তর্ভুক্ত।
অতএব, উপরোক্ত বক্তব্য দ্বারাও সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো যে, প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগের মধ্যে শরীয়তবিরোধী বা কুফরীমূলক বক্তব্য বা আমল রয়েছে। (চলবে)
সাইয়্যিদ মুহম্মদ তীতুমীর, সাতক্ষীরা।
মুহম্মদ নুরুল্লাহ্ খন্দকার, সিরাজগঞ্জ।
মুহম্মদ ফয়জুল্লাহ্, লালমনিরহাট।
সুওয়ালঃ আমরা আগে আলিমগণের মুখে শুনতাম যে, টিভি দেখা জায়িয নেই। কিন্তু বর্তমানে দেখতে পাচ্ছি অনেক মাওলানা ছাহেবরা টিভিতে অনুষ্ঠান করছে। বিশেষ করে মানুষ যাদেরকে বড় মাওলানা মনে করে তারাই সেটা করছে। তাদের সে অনুষ্ঠানগুলো এ.টি.এন টিভি চ্যানেলসহ আরো অনেক চ্যানেলে প্রায়ই দেখানো হয় এবং তাতে ইসলামের অনেক শিক্ষণীয় বিষয় আছে বলে অনেকেই তা দেখে থাকে।
এছাড়া মাসিক মদীনা মে/২০০৩ ঈসায়ী সংখ্যার ২১নং প্রশ্নের উত্তরে বলা হয়েছে, “টেলিভিশন একটি যন্ত্রমাত্র। খোলা চোখে যা কিছু দেখা জায়িয বা মুবাহ টেলিভিশনের পর্দাতেও সেগুলি দেখা জায়িয বা মুবাহ। শিক্ষণীয় কিছু দেখলে বা শুনলে পূণ্য হওয়ারই কথা। অপর দিকে পাপযুক্ত যেসব দৃশ্য দেখানো হয় সেগুলি দেখা ও শোনাতে অবশ্যই গোনাহ্ হবে।”
অনুরূপ মাসিক রাহমানী পয়গাম জুলাই/২০০৩ ঈসায়ী সংখ্যার এক জিজ্ঞাসার জবাবে বলা হয়েছে, “টিভি দেখার শরয়ী মূলনীতি হলো, যে সকল বস্তু বা বিষয়াবলী (টিভির পর্দা, রেডিও ইত্যাদির মাধ্যম ছাড়া) সরাসরি দেখা ও শুনা জায়িয সেগুলো টিভির পর্দা, রেডিও ইত্যাদিতেও দেখা বা শুনা জায়িয। আর যে সকল বস্তু বা বিষয়াবলী সরাসরি দেখা ও শুনা জায়িয নেই সেগুলো টিভি, রেডিও ইত্যাদিতেও দেখা-শুনা জায়িয নেই।”
এখন আমার জানার যে বিষয় তাহলো- (১) মাসিক মদীনা পত্রিকার প্রশ্নের উত্তর ও মাসিক রাহমানী পয়গাম পত্রিকার জিজ্ঞাসার জবাব শরীয়ত সম্মত হয়েছে কিনা?
(১) মাসিক মদীনা পত্রিকার প্রশ্নের উত্তর ও মাসিক রাহমানী পয়গাম পত্রিকার জিজ্ঞাসার জবাব শরীয়ত সম্মত হয়েছে কিনা?
(২) ছবি কাকে বলে ও ছবির সংজ্ঞা কি?
(৩) শরীয়তে টি.ভি দেখা জায়িয কিনা?
(৪) নাজায়িয পদ্ধতিতে ইল্মে দ্বীন শিক্ষা করা অর্থাৎ ইল্মে দ্বীন শিক্ষার জন্য টিভি দেখা, শোনা ও টিভি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা শরীয়তসম্মত কিনা?
(৫) নাজায়িয হলে যে সকল মাওলানা ছাহেব অনুষ্ঠান করে ও দেখে তাদের সম্পর্কে শরীয়তের ফতওয়া কি? এদেরকে আলিম বলা যাবে কিনা? এদের পিছনে নামায পড়া যাবে কিনা?
কুরআন-সুন্নাহ্র দলীল সহকারে জাওয়াব দিলে খুবই উপকৃত ও খুশী হব।
জাওয়াবঃ সুওয়ালে বর্ণিত সুওয়ালকারীর পাঁচটি সুওয়ালের জাওয়াবই ধারাবাহিকভাবে দেয়া হবে ইনশাআল্লাহ্।
(ধারাবাহিক)
(২) ছবি কাকে বলে ও ছবির সংজ্ঞা কি?
এর জবাবে বলতে হয় যে, ছবি সম্পর্কে যাদের ছহীহ বুঝ নেই তাদের উচিৎ হবে প্রদত্ত ফতওয়া বুঝে তদানুযায়ী আমল করা। কেননা আল্লাহ পাক বলেন,
لسئلوا اهل الذكر ان كنتم لا تعلمون.
অর্থঃ- সুতরাং অভিজ্ঞ লোকদের নিকট জিজ্ঞাসা করে দেখ, যদি তোমাদের জানা না থাকে।” (সূরা নহল্/৪৩)
কিছু কিছু লোক কিল্লতে ইলম্, কিল্লতে ফাহম্ (কম জ্ঞান, কম বুঝ) এর কারণে ছবি সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে না পেরে সমাজে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করছে। অথচ আল্লাহ্ পাক-এর রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
عن ابى هريرة رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم من افتى بغير علم كان اثمه على من افتا.
অর্থঃ- হযরত আবু হুরাইরাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, হযরত রসূল পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তিকে ইল্ম ব্যতীত ফতওয়া দেয়া হয়েছে, অতঃপর সে তদানুযায়ী কাজ করেছে, তার গুনাহ যে তাকে ফতওয়া দিয়েছে তার উপরই পড়বে।” (আবু দাউদ শরীফ)
সুতরাং উপরোক্ত হাদীছ শরীফ দ্বারা বুঝা যাচ্ছে, ফতওয়া সব সময় কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াসের ভিত্তিতে দিতে হবে। মনগড়াভাবে দেয়া যাবেনা।
কুরআন শরীফে আল্লাহ্ পাক ইরশাদ করেন,
قل هاتوا برهانكم ان كنتم صدقين.
অর্থঃ- “আপনি বলে দিন, নিজ নিজ দলীল আন, যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক।” (সূরা বাক্বারা/১১১)
আমাদের আলোচ্য ফতওয়ার মূল বিষয় হচ্ছে ছবি। কোনটা ছবি আর কোনটা ছবি নয়; অনেকে অনেক ইখতিলাফ (মতভেদ) করেছেন। আল্লাহ্ পাক-এর খাছ রহমতে আমরা ছবির একটি শরীয়ত সম্মত সংজ্ঞা দিতে সক্ষম হয়েছি।
ছবির সংজ্ঞাঃ আলোর প্রতিফলন বা প্রতিসরণ ব্যতীত অন্য যে কোন পদ্ধতিতেই হোক না কেন, যদি কোন বস্তু বা প্রাণী (যেমন মানুষ,পশু পাখি, মাছ ইত্যাদি) যে কোন স্থানে আকার আকৃতিতে দৃশ্যমান হয়, তবে সেই আকার আকৃতিটিকে শরীয়তের দৃষ্টিতে ঐ বস্তু বা প্রাণীর ছবি বলে। পক্ষান্তরে শরীয়তের দৃষ্টিতে কোন বস্তু বা প্রাণী (যেমন মানুষ,পশু পাখি, মাছ ইত্যাদি) যেখানেই যে অবস্থায়ই থাকুক, আলোর প্রতিফলন বা প্রতিসরণ বা উভয়ের মাধ্যমে যদি তা যে কোন স্থানে আকার আকৃতিতে দৃশ্যমান হয় তবে সেই আকার আকৃতিটি ছবি নয়।
কোন জানদার বা প্রাণীর ছবি আকাঁ, ছবি তোলা, ছবি তৈরী করা, রাখা, দেখা, ছাপান শরীয়ত অনুযায়ী নাজায়িয, হারাম। ছবির ধারণাকে ভালভাবে বুঝানোর জন্য আনুষাঙ্গিক কিছু আলোচনা করা হল।
(ক) আলোর প্রতিফলনঃ আলোকরশ্মি যখন বায়ু বা অন্য কোন স্বচ্ছ মাধ্যমের ভিতর দিয়ে যাওয়ার সময় অন্য কোন মাধ্যমে বাধা পায়, তখন দুই মাধ্যমের বিভেদ তল থেকে কিছু পরিমাণ আলো প্রথম মাধ্যমে ফিরে আসে। আলোর বাধা পেয়ে এই ফিরে আসাকে আলোর প্রতিফলণ বলে।
ছক হবে
আরও সূক্ষ্মভাবে ব্যাখ্যা করলে বলা যায় যে, আলো হচ্ছে এক প্রকার Electromegnatic wave এই wave এর নির্দিষ্ট Frequency থাকে।
আলোর ক্ষুদ্রতম অংশকে বলে ফোটন (Photon)। এই আলো যখন কোন বস্তুর উপর পড়ে তখন সেই বস্তু থেকে অসংখ্য প্রতিফলিত ফোটন বের হয়। যাদের Frequency ভিন্ন রকম। ফলে আমরা বস্তুটির বিভিন্ন অংশকে বিভিন্ন রকম দেখতে পাই। অর্থাৎ বস্তুটিকে আমরা হুবহু ঐ বস্তুর মত দেখতে পাই। আলোর এই প্রতিফলণ নির্ভর করে প্রতিফলকের গুণাগুণের উপর। এগুলো হলো- (১) প্রতিফলকের স্বচ্ছতা ও মসৃনতা (২) আলোর গতিপথে বাধা সৃষ্টি করা এবং (৩) প্রতিফলকটির আলো শোষণ না করার ক্ষমতা । অর্থাৎ কোন বস্তু যত বেশী স্বচ্ছ ও মসৃণ হবে এবং সেটাতে যদি আলো ভেদ না করতে পারে এবং আলো শোষন করার ক্ষমতা যত কম হবে, সেই বস্তু তত ভাল আলোর প্রতিফলন ঘটাতে পারে। আলোর প্রতিফলন যত ভাল হবে প্রতিফলিত আলোর Frequency তত কাছাকাছি হবে।
(খ) আলোর প্রতিসরণ: আলোকরশ্মি এক স্বচ্ছ মাধ্যম থেকে অন্য স্বচ্ছ মাধ্যমে প্রবেশ করার সময় দুই মাধ্যমের বিভেদ তলে আলোকরশ্মি দিক পরিবর্তন করে। একে আলোর প্রতিসরণ বলে। একই মাধ্যমে ঘনত্বের তারতম্যের কারণেও প্রতিসরণ হয়ে থাকে।
ছক হবে
আলোর প্রতিফলন ও প্রতিসরণের ব্যবহারঃ (১) আয়না, স্থির পানি, মসৃণ ধাতবপৃষ্ঠ ইত্যাদিতে আলোর প্রতিফলন হয়। স্থির পানি, মসৃন ধাতবপৃষ্ঠ (যেমন, চকচকে লোহা) ইত্যাদি প্রতিফলকের চেয়ে রূপালী প্রলেপ দেয়া আয়না বেশী ভাল প্রতিফলকের কাজ করে। ফলে সূর্যের আলো আয়নার মধ্যে পড়ে অনেকটা একই Frequency তে প্রতিফলিত হয়। (অবশ্য ১০০% নয়)। মূলতঃ আয়না এত ভাল প্রতিফলক, যার মধ্যে অল্প আলো পড়লেও সেটা প্রতিফলিত হতে পারে। ফলে সূর্যের আলো যখন কোন বস্তুর উপর পড়ে, তখন সে বস্তু থেকে যে বিভিন্ন Frequency এর ফোটন বের হয়। সেটা যদি আবার আয়নার মধ্যে পড়ে, তবে এই পুণরায় প্রতিফলিত আলোর ফোটনের Frequency একই হয়। ফলে কোন বস্তুকে সরাসরি যে রকম দেখি, আয়নার মধ্যে সেটাকে একই রকম দেখি।
মূলকথা হলো, কোন বস্তুকে সরাসরি দেখা এবং আয়নার মধ্যে দেখার মধ্যে মৌলিক কোন পার্থক্য নেই। এক্ষেত্রে শুধুমাত্র প্রতিফলনের সংখ্যা একবার বৃদ্ধি পায়।
হাদীছ শরীফে বর্ণিত আছে, আল্লাহ্ পাক-এর রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গামলার পানির মধ্যে এবং দর্পনে নিজ চেহারা মুবারক দেখেছেন।
কাজেই আয়না, পানি এবং এ জাতীয় মসৃণ পৃষ্ঠে আমরা যা দেখি, তা কখনও ছবি হতে পারেনা।
(২) পেরিস্কোপের মাধ্যমে দূরবর্তী বস্তু বা জীবকে কাছে বা বড় এবং স্পষ্ট দেখা যায়। এই যন্ত্র আলোর প্রতিফলন ও প্রতিসরণ উভয়টিই ব্যবহৃত হয়। ম্যাগনিফাইং গ্লাসে এবং চশমার মাধ্যমে যথাক্রমে ক্ষুদ্র বস্তুকে বড় করে দেখা এবং অস্পষ্ট বস্তুকে স্পষ্ট করে দেখা হয়। এখানেও আলোর প্রতিসরণ ব্যবহৃত হয়।
অনুবীক্ষণ যন্ত্রেও (Microscope) আলোর প্রতিসরণের কারণে বস্তুর আসল আকারের চেয়ে অনেক বড় একটি চূড়ান্ত অবাস্তব প্রতিবিম্ব পাওয়া যায় ।
দূরবীক্ষণ যন্ত্র (Telescope) যার দ্বারা অনেক দূরবর্তী বস্তু খালী চোখে দেখা যায়, তাতে আলোর প্রতিফলন ও প্রতিসরণ দু’ পদ্ধতিই প্রয়োগ করা যায়। এজন্য দূরবীক্ষণ যন্ত্র দু’ প্রকারঃ-
(১) প্রতিসরণ দূরবীক্ষণ যন্ত্র (Refracting Telescope) (২) প্রতিফলক দূরবীক্ষণ যন্ত্র (Reflecting Telescope)
(গ) প্রতিবিধ: কোন বিন্দু থেকে নিঃসৃত আলোক রশ্মিগুচ্ছ প্রতিফলিত বা প্রতিসরিত হয়ে যদি দ্বিতীয় কোন বিন্দুতে মিলিত হয় বা দ্বিতীয় কোন বিন্দু থেকে অপসৃত হচ্ছে বলে মনে হয়, তাহলে ঐ দ্বিতীয় বিন্দুকে প্রথম বিন্দুর প্রতিবিম্ব (Image) বলে ।
(খ) ক্যামেরা (Camera): এই যন্ত্রের মাধ্যমে প্রথমে বস্তুর নেগেটিভ চিত্র পাওয়া যায়। থাকে পরে রাসায়নিক প্রক্রিয়ার দ্বারা পজিটিভ বা প্রকৃতচিত্র তৈরী করা
হয় ।
(3) টেলিভিশন (Television): টেলিভিশনের মাধ্যমে শব্দ শোনার সাথে সাথে বস্তুর ছবি দেখতে পাওয়া যায়। বৃটিশ বিজ্ঞানী লক্ষি বেয়ার্ড ১৯২৩ সালে প্রথম টেলিভিশন আবিষ্কার করে। ১৯৪০ সালে টি.ভি বর্তমান অবস্থায় উন্নত হয়। T. V / Closed Circuit. V/Video Cassette Recorder/ Video Cassette player! Video Phone ইত্যাদির কার্যাবলীকে তিনভাগে ভাগ করা যায়। যথাঃ- (১) Transmission বা প্রেরণ (2)
Medium বা মাধ্যম (3) Reception বা গ্রহণ। T. V. এবং V.C.R বা V.C.P এর ক্ষেত্রে প্রথমে কোন বন্ধুর ছবি ভুলে সেই ছবির বিভিন্ন অংশের, আর Closed circuit T. V. / Video Phone এর ক্ষেত্রে কোন বস্তুর সরাসরি বিভিন্ন অংশের প্রতিফলিত ফোটনের Frequency আনুযায়ী এক ধরণের Electrical Signal তৈরী হয়। সেই Signal কে আরও Processing এর পর Transmit করা হয়। TV. এর ক্ষেত্রে Transmit করা হয় বাতাসে। আর V.C.R Fm Closed Circuit TV / Video Phone এর ক্ষেত্রে তারের মধ্যে মাধ্যম বাতাসই হোক আর তারই হোক সেটা receiver (অর্থাৎ TV) এ যখন আসে তখন সেটা receive করার পর কিছু Processing করা হয়, এই Signal গুলো T. V. তে অবস্থিত একটি Electronic Gun কে নিয়ন্ত্রন করে। ফলে এই Gun টি T.V. এর পর্দার যে অংশে যতটুকু Electron ছাড়লে হুবহু Transmit করা ছবির মত হবে সে অংশে ততটুকু ইলেকট্রন ছাড়ে। এই Electron গুলো রাসায়নিক প্রলেপ পতিত হয়ে উজ্জ্বল ও অনুজ্জ্বল বিন্দুর সমন্বয়ে ছবি তৈরী করে। এই ছবি T. V. এর পর্দায় দেখা যায়। অর্থাৎ T. V/VC.R/ V.CP/Closed Circuit TV/Video Phone সব ক্ষেত্রেই পর্দায় যা আসছে সেটা সুস্পষ্ট এবং বিশেষভাবে অঙ্কিত ছবি ।
অনেকে টেলিভিশনকে পানি ও আয়নার সাথে তুলনা করেছেন। মূলতঃ টেলিভিশন পানি ও আয়নার মত নয়। তারা টেলিভিশনে কিভাবে ছবি আসে সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা না থাকার কারণে অজ্ঞতাপ্রসূত ফতওয়া দিয়েছেন। তাদের ফতওয়া নেহায়েতই মূর্খতাসূচক যা গ্রহণযোগ্য নয় ।
সিনেমা/ চলচ্চিত্র / ছায়াছবিঃ মুই ব্রীজ নামক বিজ্ঞানী ১৮৭২ সালে প্রথম চলচ্চিত্র তৈরী করে। সে একটি চলমান ঘোড়ার বিভিন্ন অবস্থানের ২৪টি ছবি তৈরী করে ছবিগুলোকে যখন দ্রুত চালানো হত, তখন ঘোড়াটা দৌড়াচ্ছে বলে মনে হত। ১৮৯৩ সালে টমাস এডিসন মুইব্রীজের আবিষ্কারকে আরও উন্নত করে। সেই সর্বপ্রথম সবাক চলচ্চিত্র আবিষ্কার করে।
চলচ্চিত্র প্রকৃতপক্ষে আলোকচিত্রেরই উন্নত সংস্করণ। কোন জিনিসের অনেকগুলো স্থির ছবি ধারাবাহিকভাবে Film বা এক প্রকার স্বচ্ছ পদার্থের উপর সাজান হয়। যন্ত্রের ( Projector) মাধ্যমে আলোর প্রক্ষেপণের ধারা এই সকল ছবি বৃহত্তররূপে প্রতিবিম্বিত হয়ে পর্দার (Screen) উপর পড়ে
চোখের মাধ্যমে যদি আমাদের মস্তিষ্কে কোন বস্তুর প্রতিবিম্ব অনুভূত হয়, তবে সেটা মুছে যেতে যতটুকু সময়ের প্রয়োজন তার পূর্বেই যদি আর একটা প্রতিবিম্ব তৈরী হয়, তবে এই প্রতিবিম্বগুলোর পার্থক্য নির্ণয় করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। একারণেই চলচ্চিত্রের স্থির ছবিগুলোর পার্থক্য দর্শকের কাছে ধরা পড়েনা। দর্শকের কাছে মনে হয় একই ছবি এবং ছবিতে যা দেখান হয় তা বুঝি চলমান।
মূলতঃ তা ঠিক নয়, বরং স্থির ছবিই একটার পর একটা আসে যায়। যে জন্য একে চলচ্চিত্র বলে। ছবির উপর আলোর প্রক্ষেপণের মাধ্যমে এর (ছবির) ছায়া পর্দার উপর নিক্ষিপ্ত হয়, সেজন্য চলচ্চিত্রকে ছায়াছবিও বলে।
উপরোক্ত আলোচনার পর বলা যায় যে, শরীয়তের দৃষ্টিতে সচলতা বা স্থিরতা, Direct tele cast, Indirect tele cast Film এর দ্বারা তৈরী বা Film ব্যতীত তৈরী, স্থায়ীত্বতা বা অস্থায়িত্বতা ইত্যাদি কোনটাই ছবি হওয়ার জন্য শর্ত নয়।
ছবিকে আরবীতে تصوير – صورة ইংরেজীতে Photo, Picture, Image ইত্যাদি বলা হয়।
কিন্তু যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন, এবং যে কোন পদ্ধতিতেই তৈরী, আঁকা বা তোলা হোক না কেন কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ও কিয়াস অর্থাৎ আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের আক্বীদা মুতাবিক জিন্দাই (জীবিত) হোক আর মুর্দাই (মৃত) হোক সমস্ত প্রাণীর ছবিই তৈরী করা, তোলা, আঁকা, দেখা, ছাপান রাখা ইত্যাদি নাজায়িয, হারাম।
অনেকে বলে থাকেন যে, ছবি আঁকা হারাম করা হয়েছে কিন্তু তোলা সম্বন্ধেতো এ রকম কোন উল্লেখ নেই এবং তাদের মতে আঁকা ও তোলা এক নয়। এর জবাবে বলা যায়, তোলা প্রকৃতপক্ষে আকারই বৈজ্ঞানীকরূপ। কেননা কোন বস্তু বা প্রাণীর ছবি হাতে তৈরী করাকে আঁকা বলে। আর আলোর দ্বারা, যন্ত্রের দ্বারা রাসায়নিক পদ্ধতিতে বা যে কোন প্রকারের আধুনিক পদ্ধতিতে কোন বস্তু বা প্রাণীর ছবি তৈরী করাকে তোলা বলে। কাজেই হাতে আঁকা বা তোলার মধ্যে মূলতঃ কোন পার্থক্যই নেই। পার্থক্য শুধু আধুনিকতার। অনেকে হাদীছ শরীফের বরাত দিয়ে বলে থাকেন বা ফতওয়া দেন যে, ছবির মাথা কাটলে সেটা আর ছবি থাকেনা। তার উত্তরে বলা যায় যে, মূলতঃ হাদীছ শরীফ খানা ছহীহ্। তবে ছহীহ্ সমঝের অভাবে তারা সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে না পারার কারণেই উপরোক্ত বক্তব্য পেশ করে থাকেন। কেননা মাথা কাটলে যদি ছূরত না বুঝা যায় বা গাছের মত মনে হয় তবেই সেটা ছবি হিসাবে গণ্য হবেনা। যদি ছূরত বোঝা যায় তবে অবশ্যই তা গুণাহ্র কারণ হবে এবং তা থেকে বিরত থাকতে হবে। প্রাণীর ছবি হারাম হওয়ার ব্যাপারে আহ্লে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের মধ্যে কোন প্রকার ইখতিলাফ(মতভেদ) নেই। কেননা ছবি হারাম হওয়ার ব্যাপারে একাধিক ছহীহ হাদীছ শরীফ, হাদীছ শরীফের শরাহ, সমস্ত মাশহুর ফিক্বাহ ও ফতওয়ার কিতাবে সরাসরি উল্লেখ রয়েছে।
{দলীলসমূহঃ (১) বুখারী, (২) মুসলিম, (৩) নাসাঈ, (৪) আবু দাউদ, (৫) তিরমিযী, (৬) ইবনে মাজাহ, (৭) মিশকাত, (৮) ফতহুল বারী, (৯) উমদাতুল ক্বারী, (১০) ইশরাদুস্ সারী, (১১) তাইসীরুল ক্বারী, (১২) শরহে কিরমানী, (১৩) ফতহুল মুলহিম, (১৪) শরহে নববী, (১৫) বযলুল মাজহুদ, (১৬) উরফুশ্ শাজী, মিরকাত, (১ঁ৭) মুযাহিরে হক্ব, (১৮) আশআতুল লুময়াত, (১৯) লুময়াত, (২০) মু’জামুল মুফহারিস, (২১) মুসনাদে আহমদ, (২২) রিয়াজুছ্ ছালিহীন, (২৩) ফিকহুস সুন্নাহ, (২৪) হাশিয়ায়ে সিন্দী, (২৫) মুয়াত্তায়ে মালিক, (২৬) আওজাযুল মাসালিক, (২৭) মুছান্নিফে ইবনে আবী শায়বা, (২৮) তহাবী, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ, (২৯) রদ্দুল মুহতার, (৩০) দুররুল মুখতার, (৩১) ফতওয়ায়ে ছিদ্দীক্বিয়াহ, (৩২) ফতওয়ায়ে আলমগীরী, (৩৩) ফতহুল ক্বাদীর, (৩৪) নূরুদ্ দিরায়া, (৩৫) খুলাছাতুল ফতওয়া, (৩৬) মা’দানুল হাক্বায়িক্ব, (৩৭) আইনী, (৩৮) হিদায়া, শরহে হিদায়া, (৩৯) বাহ্রুর রায়িক, (৪০) শরহে বিক্বায়া, (৪১) শরহে নিক্বায়া, (৪২) কিতাবুল ফিক্বাহ আলা মাযাহিবিল আরবাআ, (৪৩) মারাকিউল ফালাহ, (৪৪) জামিউছ্ ছগীর, (৪৫) মা-লা-বুদ্দা মিন্হু, (৪৬) আনোয়ারে মাহ্মূদ, (৪৭) ফতওয়ায়ে আঃ হাই, (৪৮) নূরুল হিদায়া, (৪৯) আইনুল হিদায়া, (৫০) তরীকুল ইসলাম, (৫১) নুরুল ইজাহ, (৫২) গায়াতুল আওতার, (৫৩) হাশিয়ায়ে তাহতাবী, (৫৪) ফতওয়ায়ে দারুল উলুম দেওবন্দ, (৫৫) তুহফায়ে খাওয়াতীন, (৫৬) বাহারে শরীয়ত, (৫৭) ফতওয়ায়ে রহীমিয়াহ, (৫৮) কিফায়াতুল মুফ্তী, (৫৯) আহ্সানুল মাসায়িল ইত্যাদি সমূহ হাদীছ শরীফ ও তার ব্যাখ্যাগ্রন্থ, তাফসীর, ফিক্বাহ ও ফতওয়ার কিতাব দ্রষ্টব্য}
উল্লেখ্য, ছবি হারাম এ সম্পর্কে ‘মাসিক আল বাইয়্যিনাত’ ৫ম, ৬ষ্ঠ ও ৭ম তিন সংখ্যায় ৩৫৩টি দলীল উল্লেখপূর্বক ফতওয়া দেয়া হয়েছে।
সাইয়্যিদ মুহম্মদ শাকেরুল ইসলাম
বেগমগঞ্জ, নোয়াখালী।
সুওয়ালঃ চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত রেযাখানী মুখপত্র ফেব্রুয়ারী-মার্চ/২০০৩ ঈসায়ী সংখ্যায় প্রশ্নোত্তর বিভাগে ফজর নামাযে ‘কুনূতে নাযিলা’ পড়া সম্পর্কে নিম্নোক্ত প্রশ্নোত্তর ছাপা হয়-
প্রশ্নঃ ফজর নামাযে ‘কুনূতে নাজেলা’ পড়ার ব্যাপারে শরঈ হুকুম ও বিধানাবলী জানতে আগ্রহী। দয়া করে আলোচনা করবেন।
উত্তরঃ মুসলমানগণ কোন বালা-মুছিবত বা কোন বিপর্যয়ের সম্মুখীন হলে ফজরের ফরজ নামাযের দ্বিতীয় রাকাতে রুকুর পর দাঁড়িয়ে সিজদায় যাওয়ার আগে ‘কুনুতে নাজেলা’ পড়ার বর্ণনা প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র পবিত্র আমল ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। যেমন হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন,
كان رسول الله صلى الله عليه وسلم لا يقتت فى الصبح الا ان يدعو لقوم او على قوم.
অর্থাৎ- ‘রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফজরের নামাযে (বিশেষ কারণ ছাড়া) কুনুত পড়তেন না। কিন্তু যখন কোন গোত্রের জন্য দোয়া বা বদদোয়ার প্রয়োজন দেখা দিত তখন ফজরের নামাযে কুনূত পড়তেন।’ (মিরকাত, শরহে মিশকাত, কুনূত অধ্যায়, ৩য় খণ্ড,১৮২ পৃষ্ঠা)
তাই আমাদের হানাফী মাযহাব মতে, মুসলমানদের উপর কোন গুরুতর বিপদাপদ কলেরা, বসন্ত ইত্যাদি মহামারি বিনাশী সংক্রামক রোগ কিংবা দুশমনের আক্রমণ ছড়িয়ে পড়লে তখন ফজরের নামাযের ফরজের দ্বিতীয় রাকাতে রুকু-সিজদার মাঝামাঝি সময়ে (রুকুর পর দাঁড়িয়ে) ‘কুনূতে নাজেলা’ পড়া জায়েয। ফজরের নামায ছাড়া অন্য কোন নামাযে ‘কুনূতে নাজেলা’পড়া আমাদের হানাফী মাযহাব মত জায়েয নেই। তেমনিভাবে বিপদকালীন সময় ছাড়া সর্বদা ফজরের নামাযে কনূতে নাজেলা পড়াও জায়েযনেই। এটাই অধিকাংশ হানাফী ফক্বীহগণের অভিমত। ফজরের নামাযে কুনূত পড়া বা না পড়ার ক্ষেত্রে মাযহাবের ইমামগণের মতভিন্নতা সত্বেও অধিকাংশের মতই আমলযোগ্য।
এ ব্যাপারে বিস্তারিত দেখুন- উমদাতুল কারী, ফতহুল বারী, শরহে বুখারী ও আসাহ্হুস্ সিয়র ‘কুনূতে নাজেলা’ অধ্যায়।
আর মাসিক মদীনা জানুয়ারী/২০০৩ ঈসায়ী সংখ্যায় প্রশ্নোত্তর বিভাগে ১৭ নং প্রশ্নের উত্তরে বলা হয়েছে, “সম্ভব হলে প্রতিটি মসজিদে ফজরের নামাযে কুনুতে-নাযেলা পাঠ করা উচিত। উল্লেখ্য যে, জাতিগতভাবে মারাত্মক বিপদ দেখা দিলে হযরত নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ্ পাকের বিশেষ অনুগ্রহ প্রার্থনা করে কুনুতে-নাযেলা পাঠ করতেন।
এখন আমার সুওয়াল হলো- ফজর নামাযে ‘কুনূতে নাযিলা’ পড়া সম্পর্কে রেযাখানী মুখপত্রের এবং মাসিক মদীনার উক্ত বক্তব্য সঠিক হয়েছে কি?
আর সত্যিই কি বালা-মুছীবতের সময় ‘কুনূতে নাযিলা’ পড়ার অনুমতি শরীয়তে রয়েছে? দয়া করে দলীল-আদিল্লাহসহ সঠিক জাওয়াব জানিয়ে বাধিত করবেন।
জাওয়াবঃ ফজর নামাযে ‘কুনূতে নাযিলা’ পড়া সম্পর্কে রেযাখানী মাযহাবের এবং মাসিক মদীনার মৌলভী ছাহেবদের উক্ত বক্তব্য সঠিক হয়নি। বরং ভুল ও গোমরাহীমূলক হয়েছে।
কারণ, বর্তমানে ‘কুনূতে নাযিলা’ পড়ার অনুমতি হানাফী মাযহাবে নেই।
উল্লেখ্য, “বর্তমানে যে ‘কুনূতে নাযিলা’ পড়ার অনুমতি হানাফী মাযহাবে নেই” এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হলে আগে ইসলামী শরীয়ত সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান থাকতে হবে। সেহেতু নিম্নে ইসলামী শরীয়ত সম্পর্কে কিঞ্চিৎ আলোচনা করা হলো-
স্মর্তব্য যে, আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের দলীল হলো- কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস। এ চারটিকে শরীয়তের উছূলও বলা হয়। ইসলাম অনুযায়ী চলতে হলে মুসলমান হিসেবে শরীয়তের চারটি উছূলকেই স্বীকার করার পাশাপাশি সে মুতাবিক আমলও করতে হবে।
উক্ত চারটি উছূলের একটি উছূলও যদি কেউ অস্বীকার করে বা না মানে তাহলে তার পক্ষে শরীয়তের উপর চলা সম্ভব হবেনা। এ কারণে আহ্লে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের ইমামগণ ফতওয়া দিয়েছেন, শরীয়তের কোন উছূল অস্বীকার করা কুফরী ও গোমরাহী।
যেমন, কেউ যদি শুধুমাত্র কুরআন শরীফ মানে কিন্তু হাদীছ শরীফ না মানে তাহলে সে কুফরী করলো। শরীয়তের মাসয়ালায় তাকে কাফির বলা হয়েছে।
আবার কেউ কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ মানে কিন্তু ইজ্মা মানে না সেও কুফরী করলো আর যে ক্বিয়াস মানেনা তাকে শরীয়তের মাসয়ালায় গোমরাহ্ বা পথভ্রষ্ট বলা হয়েছে।
মোটকথা, শরীয়তের উছূলগুলো একটি অপরটির ব্যাখ্যা। সবগুলো মিলেই পূর্ণাঙ্গ শরীয়ত। কুরআন শরীফের ব্যাখ্যা হাদীছ শরীফ আর কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ উভয়টির ব্যাখ্যা ইজমা ও ক্বিয়াস।
অতএব, ফতওয়া দেয়া ও গ্রহণ করার ক্ষেত্রে শরীয়তের চারটি উছূলই দেখতে হবে। কেবল একটি আয়াত শরীফ কিংবা একটি হাদীছ শরীফ দেখেই ফতওয়া দেয়া ও আমল করা শরীয়তসম্মত নয়। কারণ, নামায, রোযা, শরাব, সুদ ইত্যাদি আদেশ-নিষেধ সংক্রান্ত প্রায় প্রতিটি আমল বা বিষয় একবারেই পূর্ণতায় পৌঁছেনি বা তার হুকুমটি চূড়ান্তভাবে সাব্যস্ত হয়নি বরং ওহী নাযিলের পূর্ণ তেইশ বছরের মধ্যে পর্যায়ক্রমে পূর্ণতায় পৌঁছেছে বা চূড়ান্তভাবে সাব্যস্ত হয়েছে। যেমন, ইসলামের শুরুর দিকে নামাযের মধ্যে কথা বলা জায়িয ছিলো কিন্তু পরবর্তীতে তা নিষিদ্ধ হয়ে যায়। রোযা রাখার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও রোযা না রেখে তার ফিদিয়া দিলেই চলতো। কিন্তু পরবর্তীতে এ হুকুম রহিত হয়ে যায়। এমনিভাবে শরাব পান ও সুদ দেয়া ও নেয়ার ফায়সালা জারি করা হয়। এছাড়া আরো অনেক আমল বা বিষয়ের শুরু ও শেষের হুকুম ছিলো সম্পূর্ণরূপে বিপরীত।
এখন কেউ যদি প্রথম যুগে নাযিলকৃত আয়াত শরীফ ও হাদীছ শরীফ উল্লেখ করে নামাযে কথা বলা জায়িয, রোযা রাখতে সক্ষম এমন ব্যক্তির রোযা রাখার পরিবর্তে ফিদিয়া দেয়ার কথা বলে, শরাব পান করা হালাল ও সুদ দেয়া-নেয়া জায়িয ফতওয়া দেয় তাহলে সে কাফির হয়ে যাবে। কারণ উক্ত হুকুম পরবর্তীতে নাযিলকৃত আয়াত শরীফ এবং বর্ণিত হাদীছ শরীফের হুকুম দ্বারা মনসূখ বা রহিত হয়ে গেছে।
অনুরূপ ‘কুনূতে নাযিলা’-এর বিষয়টিও হাদীছ শরীফে বর্ণিত রয়েছে, আখিরী রসূল, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন এক কাফির সম্প্রদায়ের প্রতি বদ্ দোয়ার জন্য এক মাস ফজরের নামাযে ‘কুনূতে নাযিলা’ পাঠ করেন। অতঃপর তা তিনি পরিত্যাগ করেন। তার পূর্বে কিংবা পরে তিনি তা কখনো পড়েননি।
একটি বর্ণনায় এসেছে, তিনি সারাজীবন ফজরের নামাযে কুনুত পাঠ করতেন এবং খাজিমীর এক ক্বওল মতে চার খলীফা ফজরের নামাযে কুনুত পাঠ করার কথা উল্লেখ আছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে হযরত ইমাম শাফিয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি ফজরের নামাযে ‘কুনূতে নাযিলা’ পাঠের পক্ষে বলেছেন।
কিন্তু আমাদের হানাফী মাযহাবের ফতওয়া হলো, একমাত্র বিত্র নামায ব্যতীত অন্য কোন নামাযে ‘কুনূত’ পড়া জায়িয নেই। জমহুর উলামা-ই-কিরামও এ মতেরই প্রবক্তা।
সুতরাং আমাদের হানাফী মাযহাবের ফতওয়া মুতাবিক ফজরের নামাযে ‘কুনূতে নাযিলা’ পাঠ করা নাজায়িয ও বিদয়াত এবং নামাযের বাইরের জিনিস পাঠ করার কারণে নামায ফাসিদ বা বাতিল হওয়ার কারণ।
যেমন, এ প্রসঙ্গে “শরহে মায়ানিল আছার” (তাহাবী শরীফ) নামক কিতাবে উল্লেখ আছে যে,
لاينبغى القنوت فى الفجر فى حال حرب ولاغيره وهذا قول ابى حنيفة وابى يوسف ومحمد رحمهم الله.
অর্থঃ- “যুদ্ধাবস্থায় এবং যুদ্ধাবস্থায় ছাড়া অন্যান্য সময়েও ফজরের নামাযে কুনুত পাঠ করা জায়িয নয়। এটা হানাফী মাযহাবের ইমাম, ইমামে আ’যম হযরত আবূ হানীফা, ইমাম আবূ ইউসুফ ও ইমাম মুহম্মদ রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণের মত।”
তবে ইমাম শাফিয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর মতে ফজরে কুনুত পাঠ করা জায়িয। যেমন এ প্রসঙ্গে “তাফসীরে কুরতুবীতে” উল্লেখ আছে যে,
يقنت فى الفجر دائما فى سانر الصلوات اذا نزل بالمسلمين نازلة قاله الشافعى.
অর্থঃ- “যখন মুসলমানদের মধ্যে বিপদ আসবে তখন ফজর নামাযে সর্বদা এমনকি সকল নামাযে কুনুত পাঠ করবে। এটা শাফিয়ী মাযহাবের ইমাম হযরত শাফিয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর মত।”
অতএব, প্রমাণিত হলো যে, ফজরের নামাযে ‘কুনূতে নাযিলা’ পড়া জায়িয এটা মূলতঃ শাফিয়ী মাযহাবের মত, হানাফী মাযহাবের নয়।
বরং হানাফী মাযহাবের ফতওয়া মতে ফজরের নামাযে ‘কুনূতে নাযিলা’ পড়া নাজায়িয ও বিদয়াত যদিও যুদ্ধ বা অন্যান্য বালা-মুছীবতের সময় হোকনা কেন।
এ প্রসঙ্গে কিতাবে বর্ণিত রয়েছে,
উর্দূ কম্পোজ করতে হবে
অর্থঃ- “আমাদের হানাফীদের নিকট ফতওয়া হলো ফজর নামাযে যে কুনূতে নাযিলা পাঠ করা হতো তা মানসুখ বা রহিত হয়েছে।”(আইনুল হিদায়া)
কেননা, আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ্ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফজর নামাযে কুনূতে নাযিলা পড়েছেন। অতঃপর পরবর্তীতে তা মানসূখ বা রহিত হয়েছে।
যেমন হাদীছ শরীফে উল্লেখ আছে,
روى ابن مسعود رضى الله تعالى عنه انه عليه السلام قنت فى صلوة الفجر شهرا ثم تركه.
অর্থঃ- “হযরত ইবনে মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ্ পাক-এর রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক মাস ফজরের নামাযে কুনূত পাঠ করেছেন। অতঃপর তিনি তা পরিত্যাগ করেছেন।” (আছার, বায্যার, ত্ববরানী, ইবনে আবী শাইবা)
عن انس رضى الله تعالى عنه ان النبى صلى الله عليه وسلم قنت شهرا ثم تركه فقوله ثم تركه يدل على ان القنوت فى القرائض كان ثم نسخ.
অর্থঃ- “হযরত আনাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নিশ্চয়ই নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একমাস ‘কুনূতে নাযিলা’ পড়েছেন। অতঃপর তিনি তা পরিত্যাগ করেছেন।”
অতঃপর হযরত আনাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর ثم تركه (অতঃপর তিনি তা পরিত্যাগ করেছেন) এ কথার দ্বারা এটাই দালালত করে যে, ফরয নামাযে ‘কুনূতে নাযিলা’ ছিল। অতঃপর তা মানসুখ বা রহিত হয়ে গেছে।” (বুখারী শরীফ, আবূ দাউদ শরীফ, হাশিয়ায়ে বুখারী শরীফ)
এ প্রসঙ্গে “হাশিয়াতুত্ তাহ্তাবী আলাদ্ দুররিল মুখতার” কিতাবের ১ম খণ্ডের ২৮১ পৃষ্ঠায় আরো উল্লেখ আছে,
(قوله لانه منسوخ) قال انس رضى الله تعالى عنه قنت رسول الله صلى الله عليه وسلم فى الصبح بعد الركوع يدعو على أحياء من العرب رعل وذكوال وعصية حين قتلوا القراء وهم سبعون او ثمانون رجلا ثم تركه لما ظهر عليهم فدل على نسخه.
অর্থঃ- (ফজর নামাযে ‘কুনূতে নাযিলা’ পাঠ করা সম্পর্কিত বর্ণনা মানসুখ হয়েছে) হযরত আনাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, রসূলুল্লাহ্ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফজরের নামাযের রুকুর পর আরবের কতিপয় গোত্র, ‘রা’ল’ ‘যাকওয়ান’ ও ‘আছিয়া’-এর প্রতি বদ্দোয়ার জন্য এক মাস ‘কুনূতে নাযিলা’ পাঠ করেন। যখন তারা সত্তর অথবা আশিজন হাফিযে কুরআন ছাহাবীকে শহীদ করেছিলো। অতঃপর রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফজর নামাযে ‘কুনূতে নাযিলা’ পড়া বন্ধ করেন।”
উক্ত হাদীছ শরীফ এটাই দালালত করে যে, ফজর নামাযে ‘কুনূতে নাযিলা’ পাঠ করা সম্পর্কিত বর্ণনা মানসুখ বা রহিত হয়ে গেছে।
“হিদায়া মা’য়াদ দিরায়া” কিতাবের ১ম খণ্ডের ১৪৫ পৃষ্ঠার ৮নং হাশিয়ায় উল্লেখ আছে,
انه منسوج لما روينا ان النبى صلى الله عليه وعلى اله وسلم قنت شهرا ثم ترك.
অর্থঃ- “নিশ্চয়ই এটা অর্থাৎ ফজরের নামাযে কুনূতে নাযিলা পড়া সম্পর্কিত বর্ণনা মানসুখ বা রহিত হয়ে গেছে। কেননা আমাদের দলীল যেটা আমরা বর্ণনা করেছি সেটা হলো, নিশ্চয়ই নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একমাস কুনূতে নাযিলা পড়েছিলেন। অতঃপর তিনি তা পরিত্যাগ করেছেন।” (অনুরূপ ইনায়া কিতাবে উল্লেখ আছে)
“গায়াতুল আওতার” কিতাবের ১ম খণ্ডের ৩১১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
উর্দূ কম্পোজ করতে হবে
অর্থঃ- “ফজরের নামাযে কুনূত পড়বে না। এজন্য যে, ফজরের নামাযে কুনূত পড়া মানসূখ হয়েছে।”
“আশরাফুল হিদায়া” কিতাবের ১ম খণ্ডের ১৯৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
উর্দূ কম্পোজ করতে হবে
অর্থঃ- “তরফাইনের দলীল অর্থাৎ ইমামে আ’যম হযরত আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি এবং ইমাম মুহম্মদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর দলীল হলো এই যে, ফজর নামাযে ‘কুনূতে নাযিলা’ পড়া মানসুখ বা রহিত হয়ে গেছে। কেননা আল্লাহ্ পাক-এর রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফজর নামাযে এক মাস ‘কুনূতে নাযিলা’ পড়েছেন। অতঃপর তা ছেড়ে দিয়েছেন।
বস্তুতঃ উক্ত হাদীছ শরীফখানা আমাদের হানাফীদের মতে ‘মান্সূখ’ হয়ে গেছে। যেমন, উক্ত হাদীছ শরীফের ব্যাখ্যায় স্পষ্টই উল্লেখ আছে যে,
والقنوت فى صلوت الفجر منسوخ عندنا.
অর্থাৎ- “আমাদের হানাফীদের নিকট ফজরের নামাযে ‘কুনূতে নাযিলা’ পাঠ করা (সম্পর্কিত শরীফখানা) মান্সুখ হয়ে গেছে।” (বুখারী শরীফ, আবূ দাউদ শরীফ, নাওয়াযিল, ইনায়া, নিকায়া, দিরায়া, হিদায়া)
আর মানসূখ হয়ে যাওয়ার কারণেই পরবর্তীতে হযরত ছাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের সময়ে বহু যুদ্ধ-জিহাদ ও বালা-মুছীবত সত্ত্বেও হযরত ছাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ ফজরের নামাযে ‘কুনূতে নাযিলা’ পাঠ করেননি।
যেমন এ প্রসঙ্গে “আছার” নামক কিতাবে উল্লেখ আছে,
ان ابن مسعود لم يقنت هو ولا احد من اصحابه حتى فارق الدنيا يعنى فى صلوة الفجر سنده صحيح.
অর্থাৎ- “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুসহ অন্যান্য হযরত ছাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের কেউ জীবনে কখনো ফজরের নামাযে কুনুত পাঠ করেননি।” এর সনদ ছহীহ্।
এ কারণেই হযরত ছাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ এটাকে “বিদয়াত ও গোমরাহীমূলক বলে উল্লেখ করেছেন।
যেমন, এ প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফে উল্লেখ আছে,
اِنَّهَا بِدْعَةٌ
অর্থাৎ “ফজরের নামাযে কুনুত পাঠ করা বিদয়াত।” (কুরতুবী, বুখারী, নাসাঈ)
উপরোল্লিখিত সংক্ষিপ্ত আলোচনা দ্বারাই স্পষ্টরূপে প্রমাণিত হলো যে, হানাফী মাযহাবে ফজরসহ সকল ফরয নামাযে ‘কুনূতে নাযিলা’ পাঠ করা নাজায়িয ও হারাম। কারণ, কুনূতে নাযিলা পাঠ করা সম্পর্কিত হাদীছ শরীফের হুকুম মানসূখ হয়ে গেছে।
অতএব, ‘কুনূতে নাযিলা’ পড়া সম্পর্কে রেযাখানী মুখপত্র এবং মাসিক মদীনা পত্রিকার প্রদত্ত্ব বক্তব্য সম্পূর্ণ ভুল ও গোমরাহীমূলক বলে প্রমাণিত হলো।
{দলীলসমূহ ঃ (১) বুখারী, (২) মুসলিম, (৩) আবূ দাউদ, (৪) তিরমিযী, (৫) ইবনে মাজাহ্, (৬) নাসাঈ, (৭) ইবনে আবি শাইবা, (৮) বায্যার, (৯) তাবারানী, (১০) ফতহুল বারী, (১১) উমদাতুল ক্বারী, (১২) হিদায়া, (১৩) আল মুখতাছারুল কুদুরী, (১৪) জাওহারাতুন্ নাইয়্যারাহ্, (১৫) তানবীরুল আবছার, (১৬) দুররুল মুখতার, (১৭) ফতওয়ায়ে নাওয়াযিল, (১৮) ফতওয়ায়ে তাতারখানিয়া, (১৯) ফতওয়ায়ে কাজিখান, (২০) ফতহুল ক্বাদীর, (২১) ইনায়া, (২২) শরহে ইনায়া, (২৩) কিফায়া, (২৪) শরহুন্ নিকায়া, (২৫) শরহে ইলিয়াস, (২৬) আল লুবাব লিল মায়দানী, (২৭) বাহর্রু রায়িক, (২৮) মিনহাতুল খালিক্ব, (২৯) আলমগীরী, (৩০) আল মাতুন, (৩১) হাশিয়াতুত্ তাহ্তাবী আলা দুররিল মুখতার, (৩২) শরহে বিকায়া, (৩৩) নূরুল ইজাহ্, (৩৪) নূরুল হিদায়া, (৩৫) নূরুদ্ দিরায়া, (৩৬) মারাকিউল ফালাহ্, (৩৭) আইনুল হিদায়া, (৩৮) গায়াতুল আওতার, (৩৯) আল মাউনা আলা মাযহাবে আলিমিল মদীনা, (৪০) আশরাফুল হিদায়া ইত্যাদি)
[ এ সম্পর্কে আরো জানতে হলে মাসিক আল বাইয়্যিনাত-এর ১০২, ১১৪ ও ১১৭তম সংখ্যা পাঠ করুন। আরো বিস্তারিত জানতে হলে ফতওয়া প্রকাশের অপেক্ষায় থাকুন। অচিরেই মাসিক আল বাইয়্যিনাতে ‘কুনূতে নাযিলা’ সম্পর্কে বিস্তারিত ফওতয়া দেয়া হবে ইনশাআল্লাহ্। ]
মুছাম্মত রেহানা আখতার রীনা
রামপুরা, ঢাকা।
সুওয়ালঃ রমাদ্বান মাস আসলেই কেউ কেউ পেপার-পত্রিকায় ও প্রচার মাধ্যমে প্রচার করে থাকে যে, “রোযা অবস্থায় ইন্জেকশন এমনকি স্যালাইন নিলেও রোযা ভঙ্গ হয়না।”
এখন আমার সুওয়াল হলো- তাদের উক্ত বক্তব্যের স্বপক্ষে নির্ভরযোগ্য কোন দলীল আছে কি?
জাওয়াবঃ যারা বলে থাকে যে, “রোযা অবস্থায় ইনজেকশন, স্যালাইন ও ইনহেলার নিলেও রোযা ভঙ্গ হয়না” তাদের এ বক্তব্য সম্পূর্ণই ভুল ও জিহালতপূর্ণ।
তারা তাদের উক্ত বক্তব্যের স্বপক্ষে নির্ভরযোগ্য একটি দলীলও পেশ করতে পারবেনা। পক্ষান্তরে রোযা অবস্থায় যে কোন ইনজেকশন, স্যালাইন ও ইনহেলার নিলে রোযা ভঙ্গ হয়ে যাবে এ ফতওয়াটিই ছহীহ্ ও গ্রহণযোগ্য। কারণ এর স্বপক্ষে ফিক্বাহ্ ও ফতওয়ার নির্ভরযোগ্য কিতাবসমূহের অসংখ্য দলীল বিদ্যমান রয়েছে।
যেমন, “হিদায়া মা’য়াদ দিরায়া” কিতাবের ১ম খন্ডের ২২০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
ومن احتقن … افطر لقوله صلى الله عليه وسلم الفطر مما دخل.
অর্থঃ- “যদি কোন ব্যক্তি ইন্জেকশন নেয় … তাহলে রোযা ভঙ্গ হবে। কারণ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “কিছু ভিতরে প্রবেশ করলে রোযা ভঙ্গ হবে।”
“বাহ্রুর রায়িক” কিতাবের ২য় খন্ডের ২৭৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
واذا احتقن … افطر لقوله عليه السلام الفطر مما دخل وليس مما خرج.
অর্থঃ- “যদি কোন ব্যক্তি ইন্জেকশন নেয় … তাহলে রোযা ভঙ্গ হবে। কারণ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, কিছু ভিতরে প্রবেশ করলে রোযা ভঙ্গ হবে এবং বের হলে রোযা ভঙ্গ হবেনা।”
“ফতওয়ায়ে আলমগীরী” কিতাবের ১ম খন্ডের ২০৪ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে, ومن احتقن ……. الفطر.
অর্থঃ- “ যদি কোন ব্যক্তি ইন্জেকশন নেয় … তাহলে রোযা ভঙ্গ হবে।”
“ফতওয়ায়ে শামী” কিতাবের ২ খন্ডের ৪০২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে,
من حقن المريض دواءه بالحقنة وبالضم احتقن غير جائز.
অর্থঃ- “যদি কেউ রোগাক্রান্ত (রোযাদার) ব্যক্তিকে ইন্জেকশনের মাধ্যমে ঔষধ প্রদান করে বা রোগাক্রান্ত ব্যক্তি কারো দ্বারা ইন্জেকশন নেয় তবে তা জায়িয হবেনা।” অর্থাৎ ইন্জেকশন নিলে রোযা ভঙ্গ হবে।”
স্মরণীয় যে, রোযা ভঙ্গের শর্ত হলো- ‘মগজ কিংবা পাকস্থলীতে কিছু পৌঁছা। আর চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে, ইনজেকশন, স্যালাইন ও ইনহেলার ইত্যাদি মগজ ও পাকস্থলীতে পৌঁছে থাকে। তাই ইমাম-মুজতাহিদ ও ফক্বীহগণ ফতওয়া প্রদান করেছেন যে, এগুলো প্রত্যেকটিই রোযা ভঙ্গের কারণ।
অতএব, উপরোক্ত দলীলভিত্তিক আলোচনা থেকে প্রমাণিত হলো যে, ইন্জেকশন নিলে অবশ্যই রোযা ভঙ্গ হবে।
[বিঃ দ্রঃ এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হলে, মাসিক আল বাইয়্যিনাত-এর ২১, ২২, ৪৬ ও ৪৭তম সংখ্যা পাঠ করুন। ]
{দলীলসমূহঃ (১) বুখারী, (২) মুসলিম, (৩) মিশকাত, (৪) ফতহুল বারী, (৫) উমদাতুল ক্বারী, (৬) ইরশাদুস্ সারী, (৭) শরহে নববী, (৮) ফতহুল মুলহিম, (৯) মুফহিম, (১০) মিরকাত, (১১) আশয়াতুল লুময়াত, (১২) লুময়াত, (১৩) শরহুত্ ত্বীবী, (১৪) তালিক্বুছ্ ছবীহ্, (১৫) মুযাহিরে হক্ব, (১৬) মাবছুত, (১৭) মাবছুত্ লি সারাখসী, (১৮) ফতহুল ক্বাদীর, (১৯) আলমগীরী, (২০) বাহ্রুর রায়িক্ব, (২১) ফতওয়ায়ে হিন্দিয়া, (২২) হিদায়া মায়াদ্ দিরায়া, (২৩) শামী, (২৪) বাদায়েউছ্ ছানায়ে, (২৫) খুলাছাতুল ফতওয়া, (2) Biopharmaceuties & Semisolids Chapter from the theory and practice of Industrial Pharmacy by leon Lachman/Herbert. A. Lieberman/Joseph L.Kanig. (29) Guyton’s medical physiology. (b) Remington’s pharmaceutical. (3) Goodman Gilman pharmacology. (0) Cunningham’s manuals of practical anatomy, (3) Martindate Extra Pharmacoppera. ইত্যাদি।