সুওয়াল-জাওয়াব

সংখ্যা: ১৫০তম সংখ্যা | বিভাগ:

মুহম্মদ মনজুরুল হক, গুলবাগ, ঢাকা।

মুহম্মদ শরফুদ্দীন, দারোগাহাট রোড, চট্টগ্রাম।

সুওয়াল: ‘মাসিক আল বাইয়্যিনাত’ এবং ‘দৈনিক আল ইহসান’ পত্রিকার বরাত দিয়ে ঢাকা শহরসহ দেশের বিভিন্ন জিলায় দেয়াল লিখনিতে বেশ কিছু মাসয়ালা উল্লেখ করা হয়েছে। যে মাসয়ালাগুলো মূলত: মানুষের ঈমান-আক্বীদা ও আমলের ক্ষেত্রে অতীব জরুরী। যেমন, ‘ইসলামের নামে ভোট, গণতন্ত্র ও নির্বাচন করা, মৌলবাদী দাবী করা, বেপর্দা হওয়া, ছবি তোলা, টিভি দেখা, টিভিতে প্রোগ্রাম করা, কুশপুত্তলিকা দাহ করা, ব্লাসফেমী আইন চাওয়া হারাম, নাজায়িয ও কুফরী।’ ‘যে সব মাওলানা টিভি চ্যানেলে প্রোগ্রাম করে তারা উলামায়ে ‘ছূ’ বা ধর্মব্যবসায়ী আলিম’ ইত্যাদি।

কিন্তু হাটহাজারী মাদ্রাসার মুখপত্র মাসিক মুঈনুল ইসলাম আগস্ট-২০০৫ ঈসায়ী সংখ্যায় এক জিজ্ঞাসার সমাধানে দলীলবিহীন ও মনগড়াভাবে হরতাল করা, লংমার্চ করা, মৌলবাদী দাবী করাকে জায়িয বলা হয়েছে।

আরো বলা হয়েছে, ‘টিভি চ্যানেলে প্রোগ্রাম করার কারণে (প্রোগ্রামকারী মাওলানাদেরকে) উলামায়ে ‘ছূ’ বলা জায়িয হবে না।’

এখন আমাদের সুওয়াল হলো- মাসিক মুঈনুল ইসলাম পত্রিকার প্রদত্ত্ব সমাধান কতটুকু সঠিক? তা কুরআন-সুন্নাহ্র দৃষ্টিতে জানতে ইচ্ছুক।

জাওয়াব: মাসিক মুঈনুল ইসলাম পত্রিকার উল্লিখিত জিজ্ঞাসার সমাধান সম্পূর্ণরূপে কুফরী হয়েছে।

কারণ, শরীয়তে কোন হারাম বা নাজায়িয বিষয়কে হালাল বা জায়িয সাব্যস্ত করা কুফরী। যেমন, আকাঈদের কিতাবে বর্ণিত রয়েছে,

استحلال المعصية كفر.

অর্থঃ- “কোন গুনাহ্র বিষয়কে অর্থাৎ হারাম বা নাজায়িয বিষয়কে হালাল বা বৈধ জানা কুফরী।” (আক্বাইদে নছফী)

উল্লেখ্য, ‘মাসিক আল বাইয়্যিনাত’ এবং ‘দৈনিক আল ইহসান’ পত্রিকার বরাত দিয়ে যে সকল মাসয়ালা বা ফতওয়া দেয়াল লিখনিতে প্রচার করা হয়েছে, হচ্ছে ও হবে তা সবই কুরআন ও সুন্নাহ সম্মত। এবং উক্ত মাসয়ালা বা ফতওয়ার পিছনে রয়েছে অকাট্য ও অসংখ্য দলীল-আদিল্লাহ। যেমনঃ

(ধারাবাহিক)

৪. টিভিঃ শরীয়তে টিভি দেখা ও টিভিতে অনুষ্ঠান করা সম্পূর্ণ নাজায়িয ও হারাম। কারণ প্রথমতঃ টিভিতে জানদার প্রাণীর ছবির মাধ্যমে অনুষ্ঠান বা প্রগ্রাম করা হয়। অথচ শরীয়তে প্রাণির ছবি তোলা, আঁকা, রাখা, সম্পূর্ণ হারাম ও কবীরা গুণাহ্র অন্তর্ভুক্ত।

দ্বিতীয়তঃ টিভিতে যেহেতু ছবির সাহায্যে প্রোগ্রাম করা হয়, সেহেতু যারা প্রোগ্রাম করে এবং যারা দেখে পুরুষ-মহিলা প্রত্যেকেই পর্দা তরক করে থাকে। অথচ পর্দা তরক করা শক্ত হারাম ও কবীরা গুণাহ্র অন্তর্ভূক্ত।

কাজেই, যে সমস্ত মাওলানা টেলিভিশনে অনুষ্ঠান করে ও টেলিভিশন দেখে তারা দু’শ্রেণীতে বিভক্ত। এক. মুরতাদ, দুই. ফাসিক। যারা টেলিভিশন দেখা ও টেলিভিশনে অনুষ্ঠান করা জায়িয মনে করে শরীয়তের দৃষ্টিতে তারা কাফির ও মুরতাদের অন্তর্ভূক্ত। শরীয়তের দৃষ্টিতে মুরতাদের হুকুম ও তার পরিণাম ফল কিরূপ ভয়াবহ হবে সে সম্পর্কে গত সংখ্যাতে আলোচ্য সুওয়ালের জাওয়াবে বর্ণনা করা হয়েছে। আর এ সংখ্যাতে ফাসিকের হুকুম বর্ণনা করা হলো। অর্থাৎ যারা টেলিভিশনে অনুষ্ঠান করা ও টেলিভিশন দেখা হারাম জেনে করে ও দেখে শরীয়তের দৃষ্টিতে তারা ফাসিকের অন্তর্ভূক্ত।

আলিম হয়ে যারা হরাম বা ফাসিকী কাজ করে তারা উলামায়ে ‘ছূ’র অন্তর্ভূক্ত। উলামায়ে ‘ছূ’র পরিচয় ও  পরিণতি সম্পর্কে কুরআন শরীফে ইরশাদ হয়েছে,

واتل عليهم نبا الذى اتينه ايتنا فانسلخ منها فاتبعه الشيطن فكان من الغوين.

অর্থঃ- আর তাদেরকে সেই ব্যক্তির অবস্থা পাঠ করে শুনিয়ে দিন, যাকে আমি আমার আয়াতগুলো প্রদান করেছিলাম। অতঃপর সে তা হতে সম্পূর্ণরূপে বের হয়ে পড়লো, ফলে শয়তান তার পিছনে লেগে গেল, তাই সে বিপদগামীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল।”

অতঃপর ইরশাদ হয়েছে

فمثله كمثل الكلب.

অর্থাৎ- “ফলত তার অবস্থা কুকুরের মত হয়ে গেল।”  অর্থাৎ বনী ইসরাইলের পথভ্রষ্ট আলিম ‘বালআম বিন বাউরকে’ আল্লাহ পাক স্বীয় কিতাবের ইলম দান করেছিলেন, কিন্তু সে প্রবৃত্তির অনুসরণে নিমজ্জিত হয়ে গিয়েছিল।

এজন্য আল্লাহ পাক তাকে কুকুরের সাথে তুলনা করেছেন। উলামায়ে ‘ছূ’ সম্পর্কে হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,

ان اشد الناس عذابا يوم القيامة عالم لم ينفعه بعلمه.

অর্থঃ- “ক্বিয়ামতের দিন সর্বাপেক্ষা কঠিন আযাব হবে সেই আলিমের যে নিজের ইল্ম দ্বারা উপকৃত হয়নি।”

হাদীছ শরীফে আরো ইরশাদ হয়েছে,

لا يكون المرء عالما حتى يكون بعلمه عاملا.

অর্থঃ “কোন ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত আলিম হতে পারে না যতক্ষণ পর্যন্ত সে নিজের ইল্ম অনুযায়ী আমল না করবে।”

আখিরী রসূল, নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ্ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো ইরশাদ করেন,

ويل لامتى من علماء السوء يتخذون هذا العلم تجارة يبيعونها من امراء زمانهم ربحا لانفسهم لااربح الله تجارتهم.

অর্থঃ- “উলামায়ে ‘ছূ’দের কারণে আমার উম্মতের ক্ষতিসাধন হবে অর্থাৎ জাহান্নামী হবে। তারা ইল্মকে ব্যবসা হিসেবে গ্রহণ করতঃ তাদের যুগের শাসকদের নিকট থেকে অর্খ ও পদ লাভের প্রচেষ্টা চালাবে। আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ সকল উলামায়ে ছূ’দের বিরুদ্ধে এই বলে বদ্দোয়া করেন যে, “আয় আল্লাহ্ পাক! যারা নিজেদের ইল্ম দ্বারা দুনিয়াবী সরকারের সাথে ব্যবসা করতে চায় তাদের ব্যবসায় বরকত দিবেন না।” (কানযুল উম্মাল)

আখিরী রসূল, নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো  ইরশাদ করেন,

لأنا من غير الدجال أخوف عليكم من الدجال فقيل وما ذالك؟ فقال من الأيمة المضلين.

অর্থঃ- “আমি তোমাদের ব্যাপারে কতিপয় ব্যক্তিকে দাজ্জালের চেয়েও বেশি ভয়ঙ্কর মনে করি। জিজ্ঞাসা করা হলো, ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তারা কারা? তিনি বললেন, গোমরাহীর পথে পরিচালনাকারী সমাজ ও জাতির নেতারা।” (মুকাশাফাতুল কুলুব)

হাদীছ শরীফে আরো ইরশাদ হয়েছে,

عن ابى هريرة رضى الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم يكون فى اخر الزمان دجالون كذابون يأتونكم من الاحاديث بما تسمعوا انتم ولا اباؤكم فاياكم واياهم لايضلونكم ولايفتنونكم.

অর্থঃ- “হযরত আবূ হুরাইরা রদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, হযরত রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, আখিরী যামানায় কিছু সংখ্যক মিথ্যাবাদী দাজ্জাল বের হবে, তারা তোমাদের নিকট এমন সব (মিথ্যা-মনগড়া) কথা উপস্থাপন করবে, যা তোমরা কখনো শুননি এবং তোমাদের বাপ-দাদারাও শুনেনি। সাবধান! তোমরা তাদের থেকে দূরে থাকবে এবং তোমাদেরকে তাদের থেকে দূরে রাখবে। তবে তারা তোমাদেরকে গোমরাহ্ করতে পারবে না এবং ফিৎনায় ফেলতে পারবেনা।” (মুসলিম শরীফ, শরহুন্ নববী, ফতহুল মুলহিম)

ইমামুশ্ শরীয়ত ওয়াত্ তরীকত হযরত হাসান বসরী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন,

عقوبة العلماء موت القلب وموت القلب طلب الدنيا بعمل الاخرة.

অর্থঃ- “আলিমের শাস্তি হচ্ছে তার অন্তর মরে যাওয়া। আর অন্তর মরে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে, দ্বীন ও আখিরাতের কাজ করে দুনিয়া তলব করা।”

উপরোক্ত দলীলভিত্তিক বর্ণনা দ্বারা সাব্যস্ত হলো যে, টিভি চ্যানেলে প্রোগ্রামকারী মাওলানা, মুফতী, মুফাস্সির, পীর, খতীব, শাইখুল হাদীছ প্রমূখ উলামায়ে ‘ছূ’র অন্তর্ভুক্ত।

{দলীলসমূহঃ (১) আল্ ফিকুল আক্বার, (২) শরহে আকাঈদে নছফী, (৩) আকাঈদে হাক্কাহ, (৪) তাক্মীলুল ঈমান, (৫) তাফসীরে মাযহারী, (৬) রুহুল বয়ান, (৭) রুহুল মায়ানী, (৮) খাযিন, (৯) বাগবী, (১০) ইবনে কাছীর, (১১) তাবারী, (১২) বুখারী, (১৩) মুসনদে আহমদ, (১৪) মুসনদে আয়িশা, (১৫) আবূ দাউদ, (১৬) দারিমী, (১৭) ইবমে মাজাহ্, (১৮) মিশকাত, (১৯) মিরকাত, (২০) আশয়াতুল লুময়াত, (২১) লুময়াত, (২২) ত্বীবী, (২৩) তালীক্ব, (২৪) মোযাহেরে হক্ব, (২৫)  ফতহুল বারী, (২৬) উমদাতুল কারী, (২৭) বযলুল মাযহুদ (২৮) ইরশাদুস্ সারী, (২৯) ফতহুর রব্বানী, (৩০) আওনুল মা’বুদ, (৩১) আরবাঈন ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি (৩২) আল মুর্শিদুল আমীন, (৩৩) দুররুল মুখতার, (৩৪) খানিয়া, (৩৫) ফতওয়ায়ে কাজীখান, (৩৬) বাহরুর রায়িক, (৩৭) ফতওয়ায়ে আলমগীরী, (৩৮) ফতওয়ায়ে আল বারুরিয়া, (৩৯) জামিউল ফুছুলিন, (৪০) আল্ বায্যাজিয়া  ইত্যাদি।}

মুহম্মদ আসিফ মহিউদ্দীন, পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম।

মুহম্মদ জাহিদ হুসাইন, মালিবাগ চৌধুরী পাড়া, ঢাকা।

সুওয়াল: ‘মাসিক আল বাইয়্যিনাত’ জুলাই-২০০২ ঈসায়ী সংখ্যায় আজ থেকে প্রায় দীর্ঘ তিন বৎসর পূর্বে মাসিক মুহীনুল ইসলামের মুনাজাত সম্পর্কে বক্তব্য খণ্ডন করতে গিয়ে যে জাওয়াব প্রদান করা হয়েছে তার জবাবে ‘মাসিক মুহীনুল ইসলাম’ জুন-২০০৫ ঈসায়ী সংখ্যার ‘জিজ্ঞাসা-সমাধান’ বিভাগে যা লিখেছে তার মূল বিষয়বস্তু হলো-

….. ৩. হযরত ছাহাবায়ে কিরাম একটি নিম্ন শ্রেণীর কাজকেও বর্ণনা করতে সংকোচবোধ করেননি। আর মুনাজাত এমন এক কাজ যা দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাযান্তে প্রকাশ্যভাবে পাঁচবার যদি করতেন তবে কেন তার কোন বর্ণনা করা হয়নি। …….

এখন সুওয়াল হলো- “ফরয নামাযের পর সম্মিলিতভাবে হাত তুলে মুনাজাত করা” সম্পর্কিত হাটহাজারীর খারিজী-ওহাবী মৌলবীদের উল্লিখিত বক্তব্য ও মন্তব্যসমূহ কতটুকু সঠিক, দলীলভিত্তিক ও গ্রহণযোগ্য? প্রতিটি বক্তব্যের দলীলভিত্তিক জবাব দিয়ে মুনাজাত বিরোধী বাতিল ফিরক্বার খপ্পর থেকে আমাদের ঈমান-আমল হিফাজত করবেন বলে আমরা গভীরভাবে আশাবাদি।

জাওয়াব: “ফরয নামাযের পর হাত উঠিয়ে সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করার স্বপক্ষে কোন বর্ণনা নেই” হাটহাজারী মৌলভী ছাহেবদের এ বক্তব্য ডাহা মিথ্যা, বিভ্রান্তিকর ও দলীলবিহীন। কেননা “ফরয নামাযের পর সম্মিলিতভাবে হাত উঠিয়ে মুনাজাত করা স্বপক্ষে একটি, দুটি নয় বরং অসংখ্য ফে’লী ও ক্বওলী হাদীছ শরীফ রয়েছে যে সকল হাদীছ শরীফ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, স্বয়ং আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাস্সাম, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুই হাত তুলে সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং নিজেও ফরয নামাযের পর হাত তুলে সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করেছেন।

(ধারাবাহিক)

“আইনুল হিদায়া” কিতাবের ১ম খণ্ডের ৬৮০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,

উর্দূ কম্পোজ করতে হবে

অর্থঃ- “এবং নামাযের পরে মুনাজাত করাই সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত। হযরত আবূ উমামাহ্ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেন, হযরত রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রশ্ন করা হলো, কোন্ দোয়া অধিক কবূলযোগ্য? তিনি উত্তর দিলেন, শেষ রাত্রের মধ্যখানে এবং ফরয নামাযের পরে মুনাজাত কবূল হয়। আর হযরত মুগীরা ইবনে শো’বা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রত্যেক নামাযের পর মুনাজাত করতেন। হযরত ইমাম বুখারী রহমতুল্লাহি আলাইহি এটা ‘তারীখুল আওসাত্ব’ কিতাবে বর্ণনা করেন।”

উর্দূ কম্পোজ করতে হবে

অর্থঃ- “প্রত্যেক ফরয নামাযের পর মুনাজাত করার আদেশ রয়েছে, কেননা ফরয নামাযের পর মুনাজাত কবূল হওয়ার স্থান। (অর্থাৎ এরপর মুনাজাত কবূল হয়।।” (আইনুল হিদায়া ১ম জিঃ, ৬৮৪ পৃষ্ঠা)

ان الدعاء بعد الصلوة المكتوبة مسنون.

অর্থঃ- “নিশ্চয় ফরয নামাযের পর মুনাজাত করা সুন্নত।” (মিনহাজুল উম্মাল ও আকায়িদুস সুন্নিয়া, তুহ্ফাতুল মারগুবাত)

قد اجمع العلماء على استحباب الذكر والدعاء بعد الصلوت وجاءت فيه احاديث كثيرة تهذيب الاذكار للرملى- كذا فى التحفة المرغوبة.

অর্থঃ- “আলিমগণ একমত যে, নামাযের পর যিকির ও মুনাজাত করা মুস্তাহাব। এ ব্যাপারে বহু হাদীছ শরীফ বর্ণিত রয়েছে।” (তাহ্যীবুল আয্কার র্লিরমলী, তুহ্ফাতুল মারগুবাত)

(يدعو) بعد المكتوبة اى قبل السنة (مفاتيح الجنان- كذا فى التحفة المرغوبة والسعاية.)

অর্থঃ- “ফরয নামাযের পর, সুন্নতের পূর্বে সকলে মুনাজাত করবে।” (মাফাতিহুল জিনান, তুহ্ফাতুল মারগুবাহ্ ও সায়াইয়াহ্)

وفى شرعة الاسلام ويغتنم اى المصلى الدعاء بعد المكتوبة. كذا فى التخفة المرغوبة.

অর্থঃ- “শরয়াতুল ইসলাম কিতাবে বর্ণিত রয়েছে- মুছল্লীগণ ফরয নামাযের পর মুনাজাত করাকে গণীমত মনে করবে।” (তুহ্ফাতুল মারগুবাহ্ত)

عن البستى. انه قال فى تفسير قوله تعالى فاذاقضيتم الصلوة فاذكروا الله ….. اى اذكروا الله تعالى وادعوا بعد الفراغ من الصلوة.

অর্থঃ- “হযরত বুস্তী রহমতুল্লাহি আলাইহি আল্লাহ পাক-এর কুরআন শরীফের আয়াত শরীফ فاذا قضيتم الصلوة فاذكروا الله -এর তাফসীরে বলেন, অর্থাৎ তোমরা নামায শেষ করে আল্লাহ পাক-এর যিকির কর এবং তাঁর নিকট মুনাজাত কর।” (ফতওয়ায়ে সূফীয়াহ্)

وان منها الدعاء اثر الصلوة وانكر الامام ابن عرفة وجود الخلاف فى ذالك وقال لا اعرف فيه كراهة دعاء الامام عقب الصلوة وتأمين الحاضرين على دعائه.

অর্থঃ- “এবং নিশ্চয় নামাযের পরক্ষণ মুনাজাত কবূলের উত্তম স্থান। ইমাম ইবনে আরফা এ বিষয়ে কোন মতানৈক্য আছে বলে মনে করেন না। তিনি আরো বলেন, নামাযের পর ইমাম ছাহেবের মুনাজাত ও এর উপর উপস্থিতগণের আমীন বলার মধ্যে কোন মাকরূহ্ আছে বলে আমি মনে করিনা।” (আল ইক্মাল লি আব্দিল হক্ব মুহাদ্দিছ দেহ্লভী, ইস্তিহবাবুদ্ দাওয়াত, ইমদাদুল ফতওয়া)

ان رجلا صاد ظبية فقالت يا رسول الله صلى الله عليه وسلم ارسالى حتى ارضع اولادى اعود اليه وان لم اعد اليه اكن كمن صلى ولم يدع واشر ممن ذكرت عنده ولم يصلى عليك.

অর্থঃ- “এক ব্যক্তি একটি হরিনী শিকার করে, (নিয়ে যাওয়ার সময় রাস্তায় হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে সাক্ষাত হলে) হরিনী বললো, ইয়া রসূলাল্লাহ্ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! এই শিকারীকে বলুন, আমাকে ছেড়ে দেয়ার জন্য, যেন আমি আমার বাচ্চাদেরকে দুধ পান করিয়ে ফিরে আসতে পারি। যদি আমি ফিরে না আসি, তবে আমি ঐ (হতভাগ্য) ব্যক্তির ন্যায় হবো, যে ব্যক্তি নামায পড়লো অথচ মুনাজাত করলো না। অথবা সেই নরাধমের ন্যায় হবো, যার সম্মুখে আপনার নাম মুবারক উচ্চারিত হয় অথচ সে আপনার প্রতি ছলাত (দুরূদ শরীফ) পড়েনা।” (নুয্হাতুল মাজালিস শায়খ আব্দুল হক্ব মুহাদ্দিস দেহলভী, আল ই’তিছামে বিছ্ছলাত আলান নবী)

اذا انصرف العبد من الصلوة ولم يحضر الدعاء تقول الملئكة انظروا الى هذا العبد استغنى عن الله.

অর্থঃ- “কোন বান্দা যখন নামায শেষ করে মুনাজাতে উপস্থিত না থেকে চলে যায়, তখন ফেরেশ্তাগণ তাকে লক্ষ্য করে বলতে থাকেন, এ বান্দার প্রতি লক্ষ্য কর, সে আল্লাহ পাক-এর রহ্মত বা নিয়ামত থেকে অমুখাপেক্ষী (বেপরোয়া) হয়ে গেল।” (গুনিয়াতুত্ তালিবীন লি শায়খ আব্দুল কাদির জ্বিলানী, নুয্হাতুল মাজালিসে)

প্রদত্ত সুওয়াল-জাওয়াবের টীকা ভাষ্যঃ

ড ফরজ নামাযের পর মুনাজাত করার স্বপক্ষে গত সংখ্যায় অনেক ফে’লী ও ক্বওলী হাদীছ শরীফের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। যথাঃ তিরমিযী, ইলাউস্ সুনান, নাসাঈ, বুখারী, মুসলিম, আবূ দাউদ শরীফসহ মোট ১০টি দলীল দেয়া হয়েছে।

ড এ সংখ্যা থেকে মুনাজাত বিরোধীরা হযরত আসওয়াদ আমেরী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর বর্ণিত হাদীছ শরীফ উল্লেখ করে সম্মিলিতভাবে মুনাজাতের বিপক্ষে যে কথা বলেছে তার শক্ত ও সঠিক জাওয়াব দেয়া হচ্ছে। (চলবে)

খন্দকার সেলিম আহমদ

পাহাড় কাঞ্চনপুর, টাঙ্গাইল।

সুওয়াল: হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে প্রকাশিত অখ্যাত মাসিক পত্রিকা ফেব্রুয়ারী-২০০৫ ঈসায়ী সংখ্যায় জিজ্ঞাসা-সমাধান বিভাগে, মাসিক আল বাইয়্যিনাত-অক্টোবর ২০০৩ ঈসায়ী সংখ্যায় প্রদত্ত মীলাদ-ক্বিয়ামের সমালোচনা করতে গিয়ে এবং একই বিষয়ে এপ্রিল-২০০৫ ঈসায়ী ও মে-২০০৫ ঈসায়ী সংখ্যায় এছাড়াও মাসিক মদীনা পত্রিকা ফেব্রুয়ারী-২০০৫ ঈসায়ী সংখ্যায় প্রশ্নোত্তর বিভাগে একই ধরনের জবাব দেয়া হয়েছে।

তাদের বক্তব্যগুলোর মধ্যে যে বিষয়গুলো আমার নিকট সন্দেহজনক তা নিম্নে উল্লেখ করা হলো-

৪. বরং মিশকাত শরীফে বর্ণিত হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত আছে যে, রসূলুল্লাহ্ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার সম্মানে দাঁড়ানোকে অপছন্দ করেছেন। (নাউযুবিল্লাহ)

এখন আমার সুওয়াল হলো,  মীলাদ-ক্বিয়াম সম্পর্কিত তাদের উল্লিখিত বক্তব্য কতটুকু দলীল সম্মত? কুরআন, সুন্নাহ্, ইজমা ও ক্বিয়াসের দৃষ্টিতে দলীলভিত্তিক জাওয়াব দিয়ে আমাদের আক্বীদা, আমল হিফাযতে সহায়তা করবেন বলে আমরা আশাবাদী।

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

জাওয়াবঃ “মীলাদ শরীফ-এর ক্বিয়াম” সম্পর্কে হাটহাজারী মৌলভী ছাহেবদের উক্ত বক্তব্য জিহালতপূর্ণ ও দলীলবিহীন। কারণ তারা মিশকাত শরীফের বরাত দিয়ে যে  হাদীস শরীফ উল্লেখ করেছে তা মোটেও সঠিক হয়নি বরং ভূল ও অশুদ্ধ হয়েছে। কারণ “মীলাদ শরীফ-এর ক্বিয়াম”-এর সাথে উক্ত হাদীস শরীফ-এর কোনই সম্পর্ক নেই। কেননা, মীলাদ শরীফ-এর যে ক্বিয়াম করা হয়, সেই ক্বিয়ামের অর্থ হলো, আল্লাহ্ পাক-এর রসূল সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খতামুন্নাবিয়্যীন, হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বরকতময় বিলাদত শরীফ শ্রবণ করতঃ দাঁড়িয়ে সালাম পাঠ করা।”

অথচ মিশকাত শরীফে বর্ণিত হাদীছ শরীফে দাঁড়িয়ে সালাম করতে নিষেধ করা হয়নি। শুধু তাই নয় বরং আমভাবে সমস্ত ক্বিয়ামকেও নিষেধ করা হয়নি।

           আমরা পর্যায়ক্রমে মিশকাত শরীফে বর্ণিত হাদীছ শরীফের সঠিক ব্যাখ্যা দলীল-আদিল্লাহ ্সহ বর্ণনা করবো ইনশাআল্লাহ্। আর সেই সাথে আমরা এটাও প্রমাণ করবো যে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খতামুন্নাবিয়্যীন, নূরে মুজাস্সাম হাবীবুল্লাহ্ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে আমভাবে সমস্ত ক্বিয়ামকে বা দাঁড়ানোকে নিষেধ করেননি বরং হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বয়ং নিজেও দাঁড়িয়েছেন এবং হযরত ছাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণকে  দাঁড়ানো বা ক্বিয়াম করার ব্যাপারে নির্দেশও দিয়েছেন। আর হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণও একে অপরের জন্যও দাঁড়িয়েছেন।

          তারা বলে থাকে যে, “প্রচলিত মীলাদ শরীফ আল্লাহ্ পাক-এর রসূল হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যামানায় ছিলনা।”

          যদি তাদের এ বক্তব্যকেই সঠিক ধরে নেয়া হয়, তাহলে তাদের বক্তব্য মোতাবিক এটাই প্রমাণিত হয় যে, হাদীস শরীফে “মীলাদ শরীফ-এর ক্বিয়াম” নিষিদ্ধ ও নাজায়েয হওয়ার বিষয়টি ভুল ও মিথ্যা।

          অতএব প্রমাণিত হলো, হাদীস শরীফে “মীলাদ শরীফ-এর ক্বিয়ামকে” নিষেধ করা হয়নি।

নিম্নে মিশকাত শরীফে বর্ণিত হাদীছ

শরীফের সঠিক ব্যাখ্যা তুলে ধরা হলো-

 শুরুতেই যে বিষয়টি জেনে রাখা জরুরী তাহলো “রদ্দুল মুহ্তার ও হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগাহ্” নামক কিতাবে উল্লেখ আছে যে, ক্বিয়াম তিন প্রকার-

(১) ক্বিয়ামে তাকাব্বুরীঃ যেমন, হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,

لا تقوموا كما يقوم الاعاجم.

অর্থাৎ “তোমরা আজমীদের মত (মাথা নীচু করে নমস্কারের ছূরতে) দাঁড়াইওনা।” এরূপ ক্বিয়াম শরীয়তে সম্পূর্ণ হারাম ও নাজায়েয।

(২) ক্বিয়ামে হুব্বীঃ যেমন, “হযরত ফাতেমা রদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহা, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হুযরা শরীফে আসলে, আল্লাহ্ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (হযরত ফাতেমা রদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহার মুহব্বতে) দাঁড়িয়ে কপাল মুবারকে চুম্বন করে বসতেন ও বসাতেন। একে ক্বিয়ামে হুব্বী বলে।”

(৩) ক্বিয়ামে তা’যীমীঃ যেমন, “হযরত ফাতেমা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা ও হযরত ছাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর তা’যীমের জন্যে দাঁড়াতেন।”

মুলতঃ ক্বিয়ামে তাকাব্বুরী শরীয়তে হারাম ও নাজায়েয। আর ক্বিয়ামে হুববী ও তা’যীমী শরীয়তে জায়েয ও সুন্নত।

ক্বিয়াম বিরোধী হাটহাজারী মৌলভী

ছাহেবদের বক্তব্য খন্ডন

উল্লেখ্য যে, তারা বলেছে, “প্রচলিত ক্বিয়াম  নাজায়েয।….”

          প্রথম দলীল হিসেবে নিম্নোক্ত হাদীস শরীফ খানা উল্লেখ করেছে যা হুবহু উল্লেখ করা হলো-    “হযরত আনাস (রাযি,) বলেন, সাহাবায়ে কিরামের নিকট রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চেয়ে অধিক প্রিয় আর কেউ ছিল না। তথাপি তারা তাকে দেখে দাঁড়িয়ে যেতেন না। কারণ, তিনি তা অপছন্দ করতেন।” (মিশকাত শরীফ- ৪০৩)

্এর জবাবে প্রথমত বলতে হয় যে, উক্ত হাদীস শরীফে মীলাদ শরীফ-এর ক্বিয়াম সম্পর্কে কোনই বর্ণনা নেই। যদি আমরা মীলাদ শরীফ-এর ক্বিয়াম ব্যতীত সাধারণ ক্বিয়ামকে ধরে নেই, সেক্ষেত্রেও বলতে হয় যে, উক্ত হাদীস শরীফ খানা ব্যাখ্যা স্বাপেক্ষ।

উক্ত হাদীস শরীফখানার সঠিক ব্যাখ্যা ঃ

 উল্লেখ্য, আল্লাহ্ পাক-এর রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাস্সাম হুযুর পাক ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হলেন, “বিশ্ববাসীর জন্য রহমত স্বরূপ।”

এ প্রসঙ্গে কালামুল্লাহ্ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,

وما ارسلنك الا رحمة للعلمين.

অর্থঃ- “আর আমি আপনাকে তামাম আলমের জন্য রহমত স্বরূপ পাঠিয়েছি।” (সূরা আম্বিয়া-১০৭)

অন্য আয়াত শরীফে ইরশাদ হয়েছে,

وكان بالمؤمنين رحيما.

অর্থঃ- “এবং তিনি (হুযূর পাক ছল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মু’মিনদের জন্য পরম দয়ালু।” (সূরা আহ্যাব-৪৩)

          সেহেতু হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সবসময়ই চাইতেন যেন উম্মতের কোন কষ্ট না হয়। তাই বার-বার দাঁড়ানোকে তিনি ছাহাবয়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ-এর জন্যে কষ্টকর মনে করে দাঁড়াতে নিষেধ বা অপছন্দ করেছেন। শরীয়তের খেলাফ মনে করে নিষেধ বা অপছন্দ করতেন না।

আর কষ্ট সম্পর্কে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

انا واتقياء امتى براء من التكلف.

অর্থঃ- “আমি এবং আমার মুত্তাকী উম্মতগণ কষ্ট দেয়া থেকে মুক্ত।” (মিশকাত শরীফ ৪০৩ পৃষ্ঠা ৫নং হাশিয়া, মিরকাত, মুযাহেরে হক্ব।)

          অথবা নিজের বিনয় প্রকাশ করার লক্ষ্যে কিংবা হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু আনহুমগণকে বিনয় শিক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যে দাঁড়াতে নিষেধ বা অপছন্দ করেছেন।

উক্ত হাদীস শরীফের ব্যাখ্যায় “মিশকাত শরীফে” ৪০৩ পৃষ্ঠার ৫নং হাশিয়ায় বলা হয়েছে,

قوله لذلك اى لقيامهم تواضعا لربه.

অর্থঃ- “অর্থাৎ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বীয় রবের প্রতি বিনয়ের কারণেই, হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের ক্বিয়াম বা দাঁড়ানোকে অপছন্দ করেছেন।”

এ হাদীস শরীফের ব্যাখ্যায় হাটহাজারী মৌলভী ছাহেবদের গুরু থানভী ছাহেবের “ইমদাদুল ফতওয়ায়” “মিরকাত শরীফের” বরাত দিয়ে লেখা হয়েছে যে,

উর্দূ কম্পোজ করতে হবে

অর্থঃ- “হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বীয় বিনয, সরলতা ও ভদ্রতা প্রকাশে দাঁড়ানো পছন্দ করেননি বা নিষেধ করেছেন। যেমন, মিরকাত শরীফে স্পষ্ট বর্ণিত হয়েছে।”

“তা’লীকুছ ছবীহ” কিতাবের ৫ম খন্ডের ১২৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,

قوله من كراهيته لذلك اى بقيامهم تواضعا لربه.

অর্থঃ- “হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বীয় রবের প্রতি বিনয়ের কারণে, হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের দাঁড়ানোকে অপছন্দ করেছেন।”

“মিরকাত শরীফ”-এর ৯ম খন্ডের ৮৪ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,

اى لقيامهم تواضعا لربه.

অর্থঃ- “অর্থাৎ আল্লাহ্ পাক-এর রসূল হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বীয় রবের প্রতি বিনয়ের কারণেই, হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ-এর ক্বিয়াম বা দাঁড়ানোকে অপছন্দ করেছেন।”

          উক্ত হাদীস শরীফের ব্যাখ্যায় “মিশকাত শরীফের” বিখ্যাত শরাহ্ “মুযাহিরে হক্ব” কিতাবের  ৪র্থ খন্ডের ৬৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,

উর্দূ কম্পোজ করতে হবে

অর্থঃ- “আল্লাহ্ পাক-এর রসূল হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিনয়ের কারণেই দাঁড়ানোকে অপছন্দ করেছেন।”

এ প্রকার বিনয় বা শিষ্টতা ইত্যাদির উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে, আমাদের ঘরে কোন মেহ্মান আসলে তাঁকে মেহ্মানদারী করাতে গিয়ে যখন কোন খাদ্যদ্রব্য তাঁর দিকে বাড়িয়ে দেয়া হয়, তখন ঐ মেহ্মান যেমন সৌজন্য ও ভদ্রতাসূচক “থাক, থাক” বা “না, না, আর দরকার নেই” ইত্যাদি বলে থাকেন। যার প্রকৃত অর্থ এই নয় যে, তাঁর খাওয়া শেষ হয়েছে, বরং তা শিষ্টাচার বা ভদ্রতাজনিত অনিচ্ছা মাত্র। এমতাবস্থায় আমরা কেউই তাঁর অনিচ্ছার প্রতি গুরুত্ব প্রদর্শন করিনা, বরং অধিক আগ্রহ সহকারে তাঁর খাওয়ার প্রতি যত¦বান হই। কেননা, মেহ্মানের সৌজন্য তাঁরই তরফ হতে এবং মেজবানের ভদ্রতা ও কর্তব্য তার তরফ হতে।

এখানে উল্লেখ্য যে, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যে সকল আদেশ বা নিষেধ এরূপ সৌজন্য এবং ভদ্রতা প্রকাশক ছিল হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ অনেক ক্ষেত্রে সে সকল আদেশ ও নিষেধ তার শব্দগত অর্থ গ্রহণ না করে হাক্বীক্বী অর্থ গ্রহণ করে তার উপর আমল করেছেন। শুধু তাই নয় বরং হাক্বীক্বী অর্থের উপর আমল করা মুস্তাহাবও মনে করেছেন।

যেমন, “বুখারী শরীফ”-এর ১ম খন্ডের ৯৪ পৃষ্ঠায় বর্ণিত আছে যে, “একদা রসূলুল্লাহ্ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বণী ওমর ইব্নে আওফের কোন (বিবাদ) মীমাংসা করতে যাওয়ায় নামাযের জন্য মসজিদে উপস্থিত হতে কিছুটা বিলম্ব হয়েছিল সেহেতু হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ইমাম হয়ে নামায পড়াতে শুরু করলেন। ইতিমধ্যে হুযূরে আক্রাম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তথায় এসে পৌঁছলেন। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আগমণ অনুভব করে, হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু পিছনে আসতে চাইলে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইশারা করে তাঁকে স্ব-স্থানে থাকার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু তা সত্বেও তিনি পেছনে সরে আসলেন। অতঃপর নামাযান্তে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে বললেন,

يا ابا بكر ما منعك ان تثبت اذ امرتك.

অর্থঃ- “হে আবূ বকর! আমি নির্দেশ দেয়া সত্বেও আপনি স্ব-স্থানে থাকলেন না কেন?”

উত্তরে হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বললেন,

ما كان لابن ابى قحافة ان يصلى بين يدى رسول الله صلى الله عليه وسلم.

অর্থঃ- “আবূ কুহাফার পুত্রের জন্য রাসূলুল্লাহ্ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সম্মুখে দাঁড়িয়ে নামায পড়া আদৌ শোভনীয় নয়।” (আবু কুহাফা তাঁর পিতার নাম, সেজন্য তিনি নিজেকে আবূ কুহাফার পুত্র বলে উল্লেখ করেছেন)

লক্ষণীয় যে, এখানে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নির্দেশ সত্বেও হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু যিনি নবীদের পরে আল্লাহ্ পাক-এর যমীনে সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ তিনিও শব্দগত অর্থ গ্রহণ না করে আদেশের হাক্বীক্বী অর্থ গ্রহণ করে আমল করলেন। কারণ তিনি জানতেন যে, তা সৌজন্যসূচক নির্দেশ মাত্র- প্রকৃত আদেশ নয়। সেক্ষেত্রে হাক্বীক্বী অর্থ পালন করাই শিষ্টতা বা ভদ্রতার পরিচায়ক। নতুবা, প্রকৃত আদেশসূচক কোন নির্দেশ পালনার্থে তিনি নিজের জীবন, ধন-সম্পদ ইত্যাদি সমস্তই নিতান্ত তুচ্ছ জ্ঞান করতেন। সেজন্য তাঁর উত্তর শুনে, হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অসন্তুষ্ট হননি বরং তাঁর এরূপ শিষ্টাচারপূর্ণ ব্যবহার ও জবাবে তিনি সন্তুষ্টই হয়েছিলেন।

          হযরত ইবনে হাজার রহমতুল্লাহি আলাইহি তদ্বীয় “আদ্দুররুল মানদুদ” কিতাবে উক্ত হাদীস শরীফের ব্যাখ্যায় বলেছেন,

فيه دليل اى دليل على ان سلوك الادب اولى من امتثال الامر الذى علم عدم الجزم بقضيته.

অর্থঃ- “যে আদেশ বাধ্যকর নয়, তা পালন করা অপেক্ষা আদব রক্ষা করাই যে উত্তম, এই হাদীস শরীফই তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।”

          অতএব, যে হাদীস শরীফে স্বকীয় সৌজন্য, নম্রতা ও শিষ্টতা বশতঃ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জন্য ক্বিয়াম করা নিষেধ করেছিলেন, তা পালন করা অপেক্ষা আদব রক্ষা করা এবং বিনীত হওয়াই অধিক উত্তম। এজন্যই ফিক্বাহ্র কিতাবসমূহে ক্বিয়ামে তা’যীমীকে এক বাক্যে মুস্তাহাব বলে উল্লেখ করা হয়েছে।”

উপরোক্ত আলোচনা ও ব্যাখ্যা দ্বারা এটাই প্রমাণিত হলো যে, আল্লাহ্ পাক-এর রসূল সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ্, হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণকে শুধুমাত্র নিজের বিনয়, ভদ্রতা ও শিষ্টতা প্রকাশেই ক্বিয়াম করতে নিষেধ করেছিলেন। শরীয়ত বিরোধী, নাজায়েয বা বিদ্য়াত হিসেবে নয়।

          আর হযরত আনাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর উক্ত হাদীস শরীফের ব্যাখ্যায় “শরহুত ত্বীবী” ও “মিরকাত শরীফে” উল্লেখ আছে,

ولعل الكراهية بسبب المحبة.

অর্থঃ- “নিশ্চয়ই মুহব্বতের কারণেই দাঁড়ানোকে অপছন্দ করেছেন। আর হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিাল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ যে অধিক মুহব্বত ছিল তার প্রমাণ উক্ত হাদীস শরীফেই রয়েছে যে, তাঁরাই হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সবচেয়ে বেশী মুহব্বত করতেন।

আর “আলমাদখাল কিতাবের” ১ম খন্ডের ১৩৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে,

ولا يصح الاحتجاج بهذا الحديث …… وقاموا بحضرته صلى الله عليه وسلم ولم يكره قيام بعضهم لبعض وانه عليه الصلاة والسلام قد قام لبعضهم.

অর্থঃ- “ক্বিয়াম না করার ব্যাপারে হযরত আনাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর বর্ণিত হাদীস শরীফ খানা দলীল হিসেবে গ্রহণ করা শুদ্ধ হবেনা। ………. কেননা হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ আল্লাহ্ পাক-এর রসূল হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপস্থিতিতে তাঁদের পরস্পরের জন্য দাঁড়িয়েছেন অথচ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁদের পরস্পরের ক্বিয়াম করাকে অপছন্দ করেননি। এমনকি স্বয়ং হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন কোন ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের জন্য দাঁড়িয়েছেন। যার বর্ণনা পরে আসছে।

          উপরোক্ত দলীল ভিত্তিক আলোচনা থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো যে, রহমতুল্লিল আলামীন  শাফিউল মুজনিবীন, হাবীবুল্লাহ্ আল্লাহ পাক-এর আখিরী রসুল হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ-এর জন্যে কষ্টকর মনে করে বা বিনয় প্রকাশ করার লক্ষ্যে বা বিনয় শিক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যে বা মুহব্বতের কারণে দাঁড়ানোকে অপছন্দ করছেন।

প্রদত্ত সুওয়াল-জাওয়াবের টীকা ভাষ্যঃ

(ক) বিগত সংখ্যায় বলা হয়েছে,স্বয়ং নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও ক্বিয়াম করেছেন। এবং ক্বিয়াম করার জন্য স্বয়ং আল্লাহ্ পাক-এর হাবীব, হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণকে নির্দেশও দিয়েছেন।

(খ) বর্তমান সংখ্যায়  উক্ত জবাবের মূল কথা হলো, আল্লাহ পাক-এর হাবীব, হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ-এর জন্যে কষ্টকর মনে করে বা বিনয় প্রকাশ করার লক্ষ্যে বা বিনয় শিক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যে বা মুহব্বতের কারণে দাঁড়ানোকে অপছন্দ করছেন।

(গ) পরবর্তী সংখ্যায়ও প্রমাণ করা হবে যে, মিশকাত শরীফে বর্ণিত হাদীছ শরীফে দাঁড়িয়ে সালাম করতে নিষেধ করা হয়নি। (চলবে)

মুসাম্মত সানজিদা আক্তার

সভানেত্রী- ছাত্রী আঞ্জুমানে আল বাইয়্যিনাত

মুহম্মদপুর, ঢাকা।

সুওয়াল: অখ্যাত মাসিক রাহমানী পয়গাম এপ্রিল/২০০৩ ঈসায়ী সংখ্যায় জিজ্ঞাসার-জবাব বিভাগে নিম্নোক্ত ১২৪৭নং জিজ্ঞাসার-জবাব ছাপা হয়-

জিজ্ঞাসা ঃ সাহাবী আবু সাঈদ খুদরী ও আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা বলেন যে, রাসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন আমার মৃত্যুর পর পূর্ব দেশগুলির মধ্য হতে কোন একটি দেশ থেকে আমার উম্মতের ভিতর হতে একটি দল বের হবে। এই দলের সদস্যগণ হবে অশিক্ষিত ও মূর্খ। এদের মধ্যে কোন শিক্ষিত লোক গেলে সেও হয়ে যাবে মূর্খের মত। তাদের বক্তৃতা হবে বহু বহু গুণের ফজিলতের। তাদের মত বক্তৃতা বা বয়ান কারো হবে না। …….. তারা কুরআনের উপর আমল কিম্বা কুরআন প্রতিষ্ঠার একটু চেষ্টাও করবে না কখনো।  …….

উক্ত অখ্যাত পত্রিকার উল্লিখিত “জিজ্ঞাসা-জবাবের” প্রেক্ষিতে আমার সুওয়াল বা জানার বিষয় হলো-

….. “(৩) প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগীদের মধ্যে শরীয়ত বিরোধী বা ইসলাম পরিপন্থী কোন নিয়মনীতি বা আক্বীদা, আমল নেই, এটা কতটুকু সত্য?” ….

কুরআন, সুন্নাহ্, ইজমা ও ক্বিয়াসের দৃষ্টিতে উল্লিখিত সুওয়ালগুলোর দলীলভিত্তিক জাওয়াব দিয়ে আমাদের আক্বীদা, আমল হিফাযতে সহায়তা করবেন বলে আমরা আশাবাদী।

জাওয়াব: প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগ জামায়াত সম্পর্কে উক্ত অখ্যাত পত্রিকার জবাব শুদ্ধ হয়নি। বরং ভুল, মনগড়া ও দলীলবিহীন হয়েছে।

তারা তাদের জবাবে প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগীদের সাফাই বর্ণনা করতে যেয়ে বর্ণিত হাদীছ শরীফের অপব্যাখ্যা করেছে। সাথে সাথে “ছয় উছূলীদের মধ্যে কুরআন-সুন্নাহ্ বিরোধী কোন আক্বীদা-আমল নেই” বলে তাদের নির্লজ্জ দালালী করে নিজেদেরকে অপব্যাখ্যাকারী ও মিথ্যাবাদীরূপে সাব্যস্ত করেছে। সুওয়ালে উল্লিখিত বিষয়গুলোর ধারাবাহিক দলীলভিত্তিক আলোচনা করলেই তা আরো সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হবে। তাই নিম্নে সুওয়ালে বর্ণিত বিষয়গুলোর দলীলভিত্তিক জাওয়াব দেয়া হলো-

(ধারাবাহিক)

প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগ সম্পর্কে অখ্যাত পত্রিকার ‘জিজ্ঞাসার জবাবের’ প্রেক্ষিতে আপনার তৃতীয় সুওয়াল হলো- “(৩) প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগীদের মধ্যে শরীয়ত বিরোধী বা ইসলাম পরিপন্থী কোন নিয়মনীতি বা আক্বীদা-আমল নেই, এটা কতটুকু সত্য?”

আপনার উক্ত সুওয়ালের প্রেক্ষিতে বলতে হয় যে, অখ্যাত পত্রিকার উক্ত বক্তব্য মোটেও সত্য নয়, কেননা প্রচলিত ছয় উছূলীদের মধ্যে একটি দু’টি নয়, বরং অসংখ্য কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী নিয়মনীতি বা আক্বীদা-আমল ও বক্তব্য রয়েছে, যা তাদের মুরুব্বীদের লিখা কিতাবাদিতেই বিদ্যমান রয়েছে। তাই নিম্নে ধারাবাহিকভাবে, পর্যায়ক্রমে প্রচলিত ছয় উছূলীদের কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী ও কুফরীমূলক বক্তব্যগুলোর সাথে সাথে কুরআন-সুন্নাহ্র দৃষ্টিতে তার সঠিক ফায়সালা তুলে ধরা হলো।

প্রচলিত ছয় উছূলীদের কুরআন-সুন্নাহ

বিরোধী কুফরীমূলক বক্তব্য- ১৮

প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোক দ্বারা পরিচালিত ও প্রকাশিত “পাক্ষিক আত্ তুরাগ” পত্রিকার ১লা জুন ১৯৯৩ সংকেতঃ ৯০-এর ৬নং পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে, “প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের বিশিষ্ট আমীর মুফতী জয়নুল আবেদীন ১৯৯৩ সনের বিশ্ব ইজ্তেমার এক বয়ানে বলেন, ‘টঙ্গীর এই মাঠে যারা এখন আছেন, তারা যদি সবাই জোনায়েদ বাগদাদী হয়ে যান, আব্দুল কাদির জ্বিলানী আর হাসান বছরী হয়ে যান, তবুও আপনারা কখনো দ্বীনের উপরে টিকে থাকতে পারবেন না, যদি আপনাদের ঘরের মহিলারা বা স্ত্রী দ্বীনের উপর না আসে। যদি আপনিও হাসান বছরী হয়ে গেলেন আর আপনার স্ত্রীও রাবেয়া বছরী হয়ে গেলেন তবুও আপনি নিজের বাড়ীতে থাকতে পারবেন না, দূর গ্রামে গিয়ে বা জঙ্গলে গিয়ে ঝুপড়ীর ভিতর থাকতে হবে। যদি না আপনি নিজের ছেলেকে হেদায়েতের মেহনত না করান।”

এর জবাবে বলতে হয় যে, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকদের উপরোক্ত বক্তব্য ও আক্বীদা নেহায়েতই জিহালতপূর্ণ, সম্পূর্ণই কুরআন-সুন্নাহ্ বিরোধী ও কুফরীমূলক।

কারণ প্রথমতঃ তাদের উক্ত বক্তব্য দ্বারা বুঝা যায় যে, “হিদায়েতের মালিক মানুষ। অর্থাৎ কোন বাবা বা স্বামী যদি নিজ দ্বীনদারী টিকিয়ে রাখতে চায়, তবে নিজ সন্তান বা স্ত্রী, যারা দ্বীনের বা হিদায়েতের উপর নেই, তাদেরকে হিদায়েত করা উক্ত বাবা বা স্বামীর উপর ফরজ বা অবশ্য কর্তব্য।”

অথচ এটা কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজ্মা ও ক্বিয়াসের সম্পূর্ণ খিলাফ। কারণ কাউকে দ্বীনের উপর আনা বা হিদায়েত করার ক্ষমতা মানুষের হাতে দেয়া হয়নি।

বরং হিদায়েতের মালিক হচ্ছেন মহান আল্লাহ পাক। মানুষের দায়িত্ব হচ্ছে এ ব্যাপারে যোগ্যতা অনুযায়ী কোশেশ করা। যেমন এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কালামে পাকের “সূরা তাহ্রীম”-এর ৬নং আয়াত শরীফে ইরশাদ করেন,

قوا انفسكم واهليكم نارا.

অর্থঃ- “তোমরা নিজেকে এবং তোমাদের পরিবারবর্গকে জাহান্নামের আগুণ থেকে বাঁচাও।”

অর্থাৎ তাদেরকে দ্বীনের বা হিদায়েতের পথে আনার জন্য কোশেশ বা চেষ্টা কর। আর জাহান্নাম থেকে বাঁচানোর মালিক হচ্ছেন আল্লাহ পাক।

আর হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

الا كلكم راع وكلكم مسئول عن رعيته.

অর্থঃ- “সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই রক্ষক এবং তোমরা প্রত্যেকেই তোমাদের রক্ষিত বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে।” (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত, ফতহুল বারী, উমদাতুল ক্বারী, ইরশাদুস্ সারী, তাইসীরুল ক্বারী, শরহে নববী, মিরকাত, লুময়াত, আশয়াতুল লুময়াত, শরহুত্ ত্বীবী, তা’লীকুছ্ ছবীহ্, মুযাহেরে হক্ব, মিরআতুল মানাজীহ্)

অর্থাৎ প্রত্যেককেই তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে যে, তোমাদের অধীনস্থদেরকে দ্বীনে বা হিদায়েতে আনার জন্য কোশেশ বা চেষ্টা করেছ কিনা? তাকে একথা বলা হবেনা যে, তোমার অধীনস্থরা হিদায়েত বা দ্বীনদারী লাভ করলোনা কেন? কারণ হিদায়েতের মালিক মানুষ নয়, হিদায়েতের মালিক হচ্ছেন আল্লাহ পাক। যেমন আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন,

انك لاتهدى من احببت ولكن الله يهدى من يشاء.

অর্থঃ- “নিশ্চয়ই মানুষ যাকে ইচ্ছা মুহব্বত করবে তাকে হিদায়েত দান করতে পারবে না। বরং আল্লাহ পাক যাকে ইচ্ছা তাকে হিদায়েত দান করেন।” (সূরা কাছাছ-৫৬)

মানুষের দায়িত্ব হলো- তার সাধ্য ও যোগ্যতা অনুযায়ী নিজ অধীনস্থদেরকে দ্বীনে বা হিদায়েতে আনার কোশেশ করে যাওয়া। কোশেশের পর কেউ হিদায়েত লাভ করতে পারে, আর কেউ নাও লাভ করতে পারে। তাই বলে কোশেশের পরও যে ব্যক্তি হিদায়েত লাভ করবেনা, তার জন্য জবাবদিহি করতে হবে, তা নয়। যদি প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগ জামায়াতের বক্তব্য মোতাবেক কোশেশের পরও কেউ হিদায়েত লাভ না করার কারণে জবাবদিহি করতে হয়, তবে তাদের বক্তব্য মোতাবেক সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকেও জবাবদিহি করতে হবে, কেননা তাঁর কোশেশ করার পরও আবূ জেহেল, আবূ লাহাব ও আবু তালিব হিদায়েত লাভ করেনি। যা বিশেষ কুফরী। (নাউযুবিল্লাহ্)

মূলতঃ মানুষকে সাধ্যের বাইরে কোন দায়িত্ব দেয়া হয়নি। যে প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কালামে পাকে ইরশাদ করেন,

لايكلف الله نفسا الاوسعها.

অর্থঃ- “মহান আল্লাহ পাক কাউকেও তার সাধ্যের বাইরে কষ্ট দেননা।” (সূরা বাক্বারা-২৮৬)

সুতরাং যদি তাই হয়ে থাকে, তবে প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের এ বক্তব্য বা আক্বীদা কিরূপে কুরআন-সুন্নাহ্ সম্মত হতে পারে যে, প্রত্যেক বাবা বা স্বামী তার দ্বীনদারীকে টিকিয়ে রাখতে হলে সন্তান বা স্ত্রীকে অবশ্যই হিদায়েত বা দ্বীনদারী দান করতে হবে।

বস্তুতঃ প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকদের উপরোক্ত বক্তব্য, চরম বিভ্রান্তিকর, কুফরীমূলক ও সম্পূর্ণ কুরআন-সুন্নাহ্ বিরোধী।

দ্বিতীয়তঃ তাদের উক্ত বক্তব্য আখিরী রাসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাস্সাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাক্বীক্বী ওয়ারিছ হযরত আউলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণের প্রতি চরম ধৃষ্টতার শামিল। সাথে সাথে মানুষের অন্তর থেকে আউলিয়ায়ে কিরাম বা আহ্লে তাছাউফগণের মহব্বত ও তাযীম-তাকরীম দূরীভূত করার অপচেষ্টা বৈ কিছুই নয়, যা সূক্ষ্মভাবে ফিকির করলে বুঝা যায় যে, এটা নবী-রসূল ও ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের মুহব্বত নষ্টকরণের প্রচেষ্টা বৈ কিছুই নয়।

কারণ তারা যে বলেছে, “কোন ব্যক্তি যদি হযরত আব্দুল কাদির জ্বিলানী রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত জোনায়েদ বাগদাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত হাছান বছরী রহমতুল্লাহি আলাইহিগণের ন্যায় ওলীআল্লাহও হয়ে যায়, আর তার স্ত্রী বা সন্তান যদি দ্বীনের উপর না থাকে, তবে সে দ্বীনদার থাকতে পারবেনা। অর্থাৎ গোমরাহ্ হয়ে যাবে।”  (নাউযুবিল্লাহ)

তবে এ বক্তব্য দ্বারা কি এটা বুঝা যায় না যে, গাউছুল আ’যম, হযরত বড় পীর আব্দুল কাদির জ্বিলানী রহমতুল্লাহি আলাইহি, সাইয়্যিদুত্ ত্বাইফাহ্, হযরত জোনায়েদ বাগদাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি ও ইমামুশ্ শরীয়ত ওয়াত্ ত্বরীক্বত হযরত হাসান বছরী  রহমতুল্লাহি আলাইহি প্রমুখগণের স্ত্রী বা সন্তানগণ যদি দ্বীন বা হিদায়েতের উপর না থাকতেন, তবে তাঁরা এতবড় ওলীআল্লাহ হওয়া সত্বেও দ্বীনের উপর থাকতে পারতেন না বা গোমরাহ্ হয়ে যেতেন? (নাউযুবিল্লাহ)

আরো প্রমাণিত হয় যে, পূর্ববর্তী যে সকল নবী-রসূল, ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ ও আউলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণের স্ত্রী বা সন্তানগণ দ্বীনের উপর ছিলেন না, তাঁরা নিজেদের দ্বীনদারীকে টিকিয়ে রাখতে পারেননি বা গোমরাহ্ হয়ে গেছেন (নাউযুবিল্লাহ) এ ধরণের আক্বীদা পোষণ করা বা বক্তব্য পেশ করা মারাত্মক কুফরী।

মূলতঃ প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগ জামায়াতের লোকদের এ বক্তব্যঃ “স্ত্রী বা সন্তান দ্বীনের উপর না থাকলে দ্বীনদারী টিকিয়ে রাখা বা হিদায়েতের উপর থাকা সম্ভব নয়”- মারাত্মক আপত্তিকর, গোমরাহীমূলক ও নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালাম এবং আউলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণের শানের খিলাফ হওয়ার কারণে কুফরীর অন্তর্ভুক্ত।

কেননা হযরত আউলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম কেন, এমন অনেক নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালাম ছিলেন, যাঁদের অনেকের স্ত্রী বা সন্তান দ্বীনের উপর ছিলেন না। তাই বলে কি তাঁরা দ্বীনের উপর ছিলেন না বা গোমরাহ্ হয়ে গেছেন? তারা কি জংগলে বা ঝুপড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন? যেমন হযরত লুত আলাইহিস্ সালাম-এর স্ত্রী, হযরত নূহ্ আলাইহিস্ সালাম-এর স্ত্রী ও পুত্র কেনান, হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম-এর ছেলে কাবিল তারা দ্বীনের উপর ছিলনা বা হিদায়েত লাভ করেনি। অনুরূপ অনেক ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের মা-বাবা, ভাই-বোন অনেকে ইসলাম গ্রহণ করেনি বা হিদায়েত লাভ করেনি। আরো উল্লেখ করা যেতে পারে, হযরত মির্জা মাজহার জানজানান শহীদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর কথা, যিনি হাফেজে মাদারজাদ ছিলেন, অথচ তাঁর স্ত্রী হাক্বীক্বী দ্বীনের উপর ছিলেন না। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁরা সকলেই দ্বীনের উপর বা হিদায়েতের উপর পরিপূর্ণভাবে কায়িম ছিলেন।

আরো বলতে হয় যে, কারো স্ত্রী বা সন্তান দ্বীনের উপর থাকলেই যে স্বামী বা পিতা দ্বীনের উপর থাকবে, তাও শুদ্ধ নয়। কেননা ফেরাআউনের স্ত্রী হযরত আছিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা দ্বীনের উপর থাকা সত্ত্বেও ফেরাআউন কাফির হয়ে মারা গিয়েছে। অনুরূপ হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বিশিষ্ট ছাহাবী ও খোলাফায়ে রাশেদীনের অন্তর্ভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও তাঁর পিতা আবূ তালিব ইসলাম গ্রহণ করেনি, এরপর কাতিবে ওহী হযরত মুয়াবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর সন্তান ইয়াজিদ হিদায়েত থেকে চ্যুত হয়ে গোমরা হয়ে যায়। এরূপ আরো বহু মেছাল মওজুদ রয়েছে।

যদি তাই হয়ে থাকে, তবে প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগ জামায়াতের লোকদের উপরোক্ত বক্তব্য কি করে শরীয়তসম্মত হতে পারে? বরং তাদের উপরোক্ত বক্তব্য শরীয়তের খেলাফ তো অবশ্যই, উপরন্ত নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালাম, ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম ও আউলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণের শানের খেলাফ হওয়ার কারণে কুফরীর অন্তর্ভূক্ত।

এ ধরণের বক্তব্য প্রদান ও আক্বীদা পোষণ করা হতে বিরত থাকা ও খালেছ তওবা করা তাদেরসহ সংশ্লিষ্ট সকলের জন্যই ফরজ-ওয়াজিব।

অতএব, আবারও প্রমাণিত হলো যে, ছয় উছূলী তাবলীগ ওয়ালাদের মধ্যে বহু কুরআন-সুন্নাহ তথা শরীয়ত বিরোধী বা কুফরী আক্বীদা রয়েছে। (চলবে)

মুহম্মদ সুলতান মাহমুদ, মিরপুর, ঢাকা

মুহম্মদ আহমদুল্লাহ কামালী, নরসিংদী

সুওয়ালঃ মাসিক মদীনা ফেব্রুয়ারী ২০০৫ ঈসায়ী সংখ্যায় প্রশ্নোত্তর বিভাগে নিম্নোক্ত প্রশ্নোত্তর ছাপা হয়-

প্রশ্নঃ চুল…রাখার সুন্নত কি?……

উত্তরঃ…চুল রাখার দুই তরীকা, এক বাবরি রাখা, দুই মুণ্ডানো।….(শামী, আলমগীরী, বুখারী, মুসলিম)

আর হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে প্রকাশিত অখ্যাত মাসিক পত্রিকা এপ্রিল/২০০৫ ঈসায়ী সংখ্যায় জিজ্ঞাসা-সমাধান বিভাগে বলা হয়েছে, “মাথা মুন্ডানো যদিও রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে  হজ্বের মৌসুম ব্যতীত পাওয়া যায় না, কিন্তু হযরত আলী (রাযি.) থেকে মাথা মুন্ডানোর বর্ণনা পাওয়া যায় এবং হযরত আলী (রাযি.)-এর এই আমলের উপর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্বীকৃতি পাওয়া যায়। তাই সাহাবীর আমল হিসেবে মাথা মুন্ডানো সুন্নাত।

অন্য এক রেওয়ায়াতে আছে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাথা মুন্ডন কারীদের জন্য তিন বার রহমতের দোয়া করেছিলেন। আর হানাফী মাযহাবের গ্রহণযোগ্য কিতাবাদিতেও মাথা মুন্ডানোকে সুন্নাত বলা হয়েছে। (ফাত্ওয়ায়ে আলমগীরি ও শামী)

এখন আমার সুওয়াল হলো- মাথা মুণ্ডন করা সম্পর্কে মাসিক মদীনা ও হাটহাজারী মৌলভী ছাহেবদের  উক্ত বক্তব্য সঠিক হয়েছে কি? আর সত্যিই কি মাথা মুণ্ডন করা সুন্নত বা চুল রাখার দুই তরীকার, এক তরীকা? দলীলসহ সঠিক জাওয়াব দিয়ে, আমাদের আক্বীদা আমল হিফাযতে সহায়তা করবেন বলে আমরা আশাবাদী।

জাওয়াবঃ মাথার চুল মুণ্ডন করা সম্পর্কে মাসিক মদীনা ও  হাটহাজারী মৌলভী ছাহেবদের উক্ত বক্তব্য সঠিক হয়নি। বরং ভুল ও অশুদ্ধ হয়েছে।

কারণ, মাসিক মদীনা ও হাটহাজারী মৌলভী ছাহেব এবং তাদের সমজাতীয়রা এমন একটি হাদীছ শরীফও উল্লেখ করতে পারবে না, যেখানে উল্লেখ আছে যে, “আল্লাহ্ পাক-এর রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন,  নুরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ্, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হজ্ব ও ওমরাহ ব্যতীত অন্য সময় নিজ মাথার চুল মুবারক মুণ্ডন করেছেন।” বরং অসংখ্য ছহীহ্ হাদীছ শরীফ দ্বারা প্রমাণিত যে, “আল্লাহ পাক-এর রসূল, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সব সময় বাবরী চুল মুবারক রাখতেন। সেহেতু সকল উম্মতে মুহম্মদীর জন্য সর্বদা বাবরী চুল রাখাই দায়িমী সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত।

(ধারাবাহিক)

চুল রাখা সম্পর্কে হাটহাজারীর জিহালতপূর্ণ বক্তব্যের খণ্ডন মুলক জবাব-৬

উল্লেখ্য, হাটহাজারীর মৌলভী সাহেবরা বলেছে, “আর হানাফী মাযহাবের গ্রহণযোগ্য কিতাবাদিতেও মাথা মুন্ডানোকে সুন্নাত বলা হয়েছে। (ফাত্ওয়ায়ে আলমগীরি ও শামী) ….।”

এর জবাবে বলতে হয় যে, হাটহাজারীর মৌলভী সাহেবদের উপরোক্ত বক্তব্যও চরম জিহালতপূর্ণ হয়েছে। কারণ হানাফী মাযহাবের গ্রহণযোগ্য কিতাবাদিতেও শুধুমাত্র মাথা মুন্ডানোকে সুন্নাত বলা হয়নি। বরং সিঁথি বিশিষ্ট বাবরী রাখাকেও সুন্নত বলা হয়েছে।

হাটহাজারীর দলীলের ভুল ব্যাখ্যা উদঘাটন

উল্লেখ্য, হাটহাজারীর মৌলভী সাহেবরা মাথা মুণ্ডন করা সুন্নত বলে তাদের স্বপক্ষে দলীল হিসেবে  ফতওয়ায়ে আলমগীরী ও শামী, কিতাবের বরাত দিয়েছে। আর উক্ত কিতাবগুলোতে হযরত ইমাম ত্বহাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর মতটিই উল্লেখ করা হয়েছে।

মূলত: হাটহাজারীর মৌলভী সাহেবরা উল্লিখিত কিতাবের ইবারতের সঠিক ব্যাখ্যা বুঝতে না পারার কারণেই বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, আবূ দাউদ, নাসাঈ, ইবনে মাযাহ্ ইত্যাদি ছিহাহ্ সিত্তাহ্সহ অনেক হাদীছ শরীফের অসংখ্য ছহীহ্ হাদীছ শরীফকে উপেক্ষা করে এ ব্যাপারে ভুল সিদ্ধান্ত পেশ করে মুর্খতার পরিচয় দিয়েছে।

হযরত ইমাম ত্বহাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি

যে শুধু হজ্বের উপর ক্বিয়াস করে মাথা মুন্ডন করাকে সুন্নত বলেছেন, নিম্নে তার

প্রমাণ পেশ করা হলো-

যেমন, “বুখারী শরীফের” বিখ্যাত শরাহ্ “ফত্হুল বারী” কিতাবের ১ম খন্ডের ৩৪৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে,

وقد رجح الطحاوى الحلق على القص بتفضيله صلى الله عليه وسلم الحلق على التقصير فى النسك.

অর্থঃ- “সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হজ্জের মধ্যে চুল মুন্ডন করাকে ছোট করার উপর ফযীলত দিয়েছেন বিধায় হযরত ইমাম ত্বহাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি মুন্ডন করাকে ছোট করার উপর প্রাধান্য দিয়েছেন।”

          অতএব, সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হলো যে, ইমাম ত্বহাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি হজ্বের উপর ক্বিয়াস করে মাথা মুন্ডন করাকে সুন্নত বলেছেন। মূলতঃ হযরত ইমাম ত্বহাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর উক্ত ক্বিয়াস গ্রহণযোগ্য নয়, কেননা হজ্বের হুকুম-আহ্কাম সম্পূর্ণই ভিন্ন ও আলাদা। হজ্বের সময় চুল মুন্ডন করা খাছ সুন্নতে রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু হজ্জ ও ওমরাহ্ ব্যতীত অন্য সময় চুল মুন্ডন করা সুন্নতে রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খিলাফ। কারণ আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ্ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হজ্ব ও ওমরাহ্ ব্যতীত কখনো চুল মুবারক মুন্ডন করেননি বরং সর্বদাই বাবরী চুল মুবারক রেখেছেন।

যেমন, এ প্রসঙ্গে মিশকাত শরীফের শরাহ্ “মিরকাত” শরীফের ২য় খণ্ডের ৩৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,

ولايخفى أن فعله كرم الله وجهه اذا كان مخالفا لسنته عليه الصلاة والسلام وبقية الخلفاء من عدم الحلق الا بعد فراغ النسك يكون رخصة لاسنة.

অর্থঃ- “এটা সুস্পষ্ট যে, নিশ্চয়ই হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর উক্ত আমল যেহেতু হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং প্রথম তিন খলীফা (হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক রদ্বিয়াল্লাহু আনহু,  হযরত উমর রদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও হযরত উছমান রদ্বিয়াল্লাহু আনহু) এর সুন্নতের খিলাফ। কেননা উনারা হজ্জ ও ওমরাহ্ ব্যতীত কখনো মাথা মুবারক মুণ্ডন করেন নাই। তাই হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর উক্ত আমল রোখ্ছত বা ওজর হিসেবে গণ্য হবে। সুন্নত হিসেবে নয়।

“মিশকাত শরীফ” কিতাবের ৩৮৪ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,

ليس بسنة لانه صلى الله عليه وسلم مع سائر اصحابه واظب على ترك حلقه الا بعد فراغ احد النسكين فالحلق رخصة وهذا هو الاظهر.

অর্থঃ-“মাথা মুণ্ডন করা সুন্নত নয়। কেননা হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সমস্ত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহুমগণ দায়েমী ভাবে বাবরী চুল রাখতেন, হজ্জ্ব ও ওমরাহ্ ব্যতীত কখনো মাথা মুবারক মুণ্ডন করেন নাই। সুতরাং (হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর)  কছর বা হলক করা সম্পর্কিত আমলটি রোখ্ছত বা ওজর হিসেবে গণ্য হবে। (সুন্নত হিসেবে নয়।) আর এ মতটি সর্বাধিক সুস্পষ্ট বা গ্রহণযোগ্য।

          সুতরাং সুন্নত যথাযথভাবে পালনার্থেই গভীরভাবে স্মরণ রাখা দরকার যে, শুধুমাত্র হজ্বের উপর ক্বিয়াস করে হজ্জ ও ওমরাহ্ ব্যতীত  অন্য সময় চুল মুন্ডন করা খিলাফে সুন্নত। তাছাড়া যেখানে অসংখ্য ছহীহ্ হাদীস শরীফ দ্বারা প্রমাণিত যে, বাবরী চুল রাখা সুন্নত, আর মুন্ডন করা খিলাফে সুন্নত; সেখানে শুধুমাত্র হযরত ইমাম ত্বহাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর উক্ত বক্তব্য যা তিনি হজ্জ ও ওমরার বর্ণনার উপর ক্বিয়াস করে বলেছেন তাই তা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়।

          তৃতীয়তঃ হজ্জ ওমরাহ্ ব্যতীত অন্য সময় মাথা মুন্ডন করা সম্পর্কে হযরত ইমাম ত্বহাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর উক্ত বক্তব্য যে বিশুদ্ধ নয় তার সুস্পষ্ট প্রমাণ হলো “ফতওয়ায়ে হিন্দিয়া” কিতাবের নিম্নোক্ত ইবারত যা আল্লামা মাওলানা সাইয়্যিদ আমীর আলী রহমতুল্লাহি আলাইহি “ফতওয়ায়ে আলমগীরী” কিতাবের উক্ত ইবারতের ব্যাখ্যায় উল্লেখ করেছেন।

          যেমন, “ফতওয়ায়ে হিন্দিয়া” কিতাবের ৯ম খন্ডের ৯৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,

وانما صح عند المترجم الفرق فقط ولم يصح ان الحلق سنة.

অর্থঃ- “আর মুতারজিম রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর নিকট নিশ্চয়ই ছহীহ্ (বিশুদ্ধ) মত হলো এই যে, শুধু মাত্র সিঁথি বিশিষ্ট বাবরী চুল রাখাই সুন্নত। (হজ্জ ওমরাহ্ ব্যতীত) মাথা মুন্ডন করা সুন্নত, এ মতটি ছহীহ্ বা গ্রহণযোগ্য নয়।”

          অতএব, উপরোক্ত অকাট্য দলীল আদিল্লাহ্র ভিত্তিতে দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো যে, মাথা মুন্ডন করা সম্পর্কিত ইমাম ত্বহাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর মতটি ছহীহ্ নয়। বরং ছহীহ্ ও গ্রহণযোগ্য মত হলো, “শুধু মাত্র বাবরী চুল রাখাই সুন্নত।”

          এছাড়াও “জামউল ওসায়িল ফি শারহিশ্ শামায়িল” কিতাবে উল্লেখ আছে, والفرق سنة. “সিঁথি বিশিষ্ট বাবরী চুল রাখা সুন্নত।

ছহীহ্ হাদীছ শরীফকে পাশ কাটিয়ে ব্যক্তি

মত গ্রহণ করতে যেয়ে হাটহাজারীর

মৌলভী  সাহেবরা বিভ্রান্ত হয়েছে

“মিশকাত শরীফের” বিখ্যাত শরাহ্ “মিরকাত শরীফে” উল্লেখ করেছেন, والفرق سنة “সিঁথি বিশিষ্ট বাবরী চুল রাখাই সুন্নত।”

মাসিক মদীনা ও হাট হাজারীর মৌলভী সাহেবরা বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, আবূ দাউদ, নাসাঈ, ইবনে মাযাহ্ ইত্যাদি ছিহাহ্ সিত্তাহ্সহ অনেক হাদীছ শরীফের কিতাবের অসংখ্য ছহীহ্ হাদীস শরীফকে পাশ কাটিয়ে একটি ইবারতের উপর ভিত্তি করে, জবাব দিতে গিয়ে উক্ত ইবারতের ব্যাখ্যা না জানার কারণে এ ব্যাপারে মারাত্মক বিভ্রান্তিতে পতিত হয়েছে। মূলতঃ শুধুমাত্র কোন এক কিতাবের কোন এক অংশ পাঠ করেই বা কোন একটি মতের উপর ভিত্তি করেই ফতওয়া দিলে এরূপ বিভ্রান্তিতে পতিত হওয়াই স্বাভাবিক।

          কাজেই কোন কথা বলতে হলে বা কোন ফতওয়া দিতে হলে তা ভালরূপে তাহ্ক্বীক্ব করে দিতে হবে, নচেৎ ভুল হওয়া এবং সমাজে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হওয়াটাই স্বাভাবিক।

          আল্লাহ্ পাক-এর খাছ রহ্মতে আমাদের “মাসিক আল বাইয়্যিনাত” পত্রিকার ফতওয়া বিভাগ হতে এ পর্যন্ত যতগুলো ফতওয়া প্রকাশ করা হয়েছে এবং সুওয়াল-জাওয়াব বিভাগে যতগুলো সুওয়ালের-জাওয়াব দেয়া হয়েছে, তার প্রত্যেকটিই পূর্ণ তাহ্ক্বীক্বসহ অনেক অকাট্য ও নির্ভরযোগ্য দলীলের ভিত্তিতে প্রকাশ করা হয়েছে। যার কারণে সকলেই তা ইচ্ছা ও অনিচ্ছায় মেনে নিতে বাধ্য।

          উপরোক্ত দলীল ভিত্তিক আলোচনা দ্বারা এটাই প্রমাণিত হলো যে, হজ্জ ও ওমরাহ্ ব্যতীত অন্য সময় বারবী চুল রাখা দায়েমী সুন্নত। আর মাসিক মদীনা ও হাটহাজারীর পত্রিকার মাথা মুন্ডন করা সম্পর্কিত উক্ত বক্তব্য বিভ্রান্তিকর, দলীল বিহীন, খিলাফে সুন্নত ও বিদ্য়াতের অন্তর্ভূক্ত।

প্রদত্ত সুওয়াল-জাওয়াবের টীকা ভাষ্যঃ

 (ক) বিগত সংখ্যায় বলা হয়েছে,“আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বদাই ‘বাবরী চুল মুবারক’ রেখেছেন। এবং হজ্জ ও ওমরাহ্ ব্যতীত অন্য সময় কখনোই মাথা মুবারক মুণ্ডন করেননি। ”

(খ) বর্তমান সংখ্যায় প্রমাণ করা হলো যে, হযরত ইমাম ত্বহাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি শুধু হজ্বের উপর ক্বিয়াস করে মাথা মুন্ডন করাকে সুন্নত বলেছেন। আর সেই সাথে এটাও প্রমাণ করা হলো যে, ইমাম ত্বহাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি -এর উক্ত ক্বিয়াস গ্রহণযোগ্য নয়। বরং ছহীহ্ ও গ্রহণযোগ্য মত হলো, “শুধু মাত্র বাবরী চুল রাখাই সুন্নত।”

(গ) পরবর্তী সংখ্যায় দলীল-আদিল্লাহ্ দ্বারা  ইনশাআল্লাহ প্রমাণ করা হবে যে, “মাথা মুণ্ডনকরা খারিজীদের আলামত।” (চলবে)

মুহম্মদ মুহিউদ্দীন

সভাপতি- আঞ্জুমানে আল বাইয়্যিনাত

সন্দ্বীপ শাখা, চট্টগ্রাম।

সুওয়ালঃ চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত রেযাখানী মাযহাবের অখ্যাত মাসিক মুখপত্র ডিসেম্বর- জানুয়ারী/২০০৩-০৪ ঈসায়ী সংখ্যায় প্রশ্নোত্তর বিভাগে ‘‘বিতিরের পর দু’রাকায়াত নফল নামায দাঁড়িয়ে পড়াই উত্তম এবং বসে পড়লে অর্ধেক ছওয়াব পাবে বলে উল্লেখ করেছে।’’ তারা তাদের উক্ত বক্তব্যের স্বপক্ষে বুখারী, মুসলিম, ইবনে মাজাহ্, নাসায়ী থেকে দলীল হিসেবে কয়েকখানা হাদীছ শরীফও উল্লেখ করেছে।

আর হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে প্রকাশিত অখ্যাত মাসিক পত্রিকা ডিসেম্বর/২০০৩ ঈসায়ী সংখ্যায় জিজ্ঞাসা-সমাধান বিভাগে বলা হয়েছে, ‘‘বিতির নামাযের পর দুই রাক্আত নফল নামায… দাঁড়িয়ে পড়া ভাল। কারণ, নফল নামায বিনা কারণে বসে পড়লে অর্ধেক সাওয়াব হয়।”

এখন আমার সুওয়াল হলো- তারা হালকী নফল নামায সম্পর্কে যে বক্তব্য পেশ করেছে তা কতটুকু সঠিক? এবং এ সম্পর্কে যে হাদীছ শরীফগুলো উল্লেখ করেছে তা কতটুকু গ্রহণযোগ্য।

তাদের প্রতিটি দলীলের খণ্ডনসহ হালকী নফল সম্পর্কে বিস্তারিত দলীল-আদিল্লাহ্ পেশ করে আমাদের ঈমান-আমল হিফাযত করবেন বলে আমরা আশাবাদী।

জাওয়াবঃ বিতির নামাযের পর দু’রাকায়াত নফল নামায যাকে “হালকী নফল” বলা হয়, তা দাঁড়িয়ে পড়া সম্পর্কে অখ্যাত মাসিক পত্রিকাদ্বয়ের উক্ত বক্তব্য সঠিক হয়নি। বরং ভুল, মনগড়া, দলীলবিহীন এবং কুরআন-সুন্নাহ্র খিলাফ হয়েছে। এবং ক্ষেত্রবিশেষে কুফরীমূলক হয়েছে।

স্মর্তব্য যে, সাধারণতঃ নফল নামায বসে পড়লে অর্ধেক ছওয়াব হলেও বিতির নামাযের পর দু’রাকায়াত নফল নামায বসে পড়াই মুস্তাহাব-সুন্নত, যা উত্তম ও পূর্ণ ছওয়াব এবং অধিক ফযীলতের কারণ।

কেননা আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন, নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিতির নামাযের পর দু’রাকায়াত নফল নামায কখনও দাঁড়িয়ে আদায় করেননি। বরং বসেই আদায় করেছেন। যা সরাসরি হাদীছ শরীফ দ্বারাই প্রমাণিত।

(ধারাবাহিক)

উল্লেখ্য, রেযাখানীরা ‘বুখারী, মুসলিম, ইবনে মাজাহ ও নাসায়ী শরীফ’ ইত্যাদি কিতাব থেকে দলীল হিসেবে যে বক্তব্য উল্লেখ করেছে, আসলে উক্ত কিতাবসমূহের বক্তব্য মোটেও সে রকম নয়। উল্লিখিত কিতাবসমূহের কোন কোন ইবারত কারচুপি করে নিজেদের বাতিল মতকে ছাবিত করার ব্যর্থ কোশেশ করেছে। তারা উল্লিখিত কিতাবের বরাত দিয়ে যে সকল মিথ্যাচারিতা, প্রতারণা ও কারচুপির আশ্রয় নিয়েছে সেগুলোর সঠিক ব্যাখ্যা ও ফায়সালা তুলে ধরে তার খণ্ডনমূলক আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ্।

রেযা খাঁর হাদীছ জালিয়াতি উদঘাটন

রেযা খাঁ তার লিখিত “রেজভীয়া” কিতাবের ৩য় খণ্ডে ইবনে মাজাহ্ শরীফের বরাতে দু’জন রাবী থেকে বর্ণিত পৃথক পৃথক দু’ খানা হাদীছ শরীফ একত্রে একখানা করে একজনের নামে চালিয়ে দিয়ে হাদীছ জালিয়াতি করেছে।

উল্লেখ্য, পূর্বের সংখ্যায় হযরত উম্মে সালামা রদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহা) থেকে বর্ণিত ইবনে মাজাহ্ শরীফের বরাতে প্রথম হাদীছ শরীফ খানা উল্লেখ করে আমরা প্রমাণ করেছি যে, রেযা খাঁ তার “রেজভীয়া” কিতাবের ৩য় খণ্ডের ৪৬৮ পৃষ্ঠায়, ইবনে মাজাহ্ শরীফের বরাত দিয়ে হযরত উম্মে সালামা রদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহা থেকে বর্ণিত হাদীছ শরীফ খানার শেষে وهو جالس এরপর فاذا اراد ان يركع قام فركع এই ইবারত গুলো সংযোজন করে বা জোড়া-তালি দিয়ে, হযরত উম্মে সালামা রদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহা-এর নামে চালিয়ে দিয়ে হাদীছ শরীফ জালিয়াতি করেছে।

অথচ فاذا اراد ان يركع قام فركع এই ইবারত গুলো হযরত উম্মে সালামা রদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহা থেকে নয়। বরং فاذا اراد ان يركع قام فركع এই ইবারত গুলো হচ্ছে, হযরত আয়িশা রদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহা থেকে।

যেমন, “ইবনে মাজাহ্ শরীফের” ৮৫ পৃষ্ঠায়  উল্লে্িরখত দ্বিতীয় হাদীছ শরীফ খানায় উল্লেখ আছে,

عن عائشة رضى الله عنها قالت كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يوتر بواحدة ثم يركع ركعتين يقرأ فيهما وهو جالس فاذا اراد ان يركع قام فركع.

অর্থঃ- “হযরত আয়িশা সিদ্দীকা রদ্বিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত আছে তিনি বলেন, আল্লাহ্ পাক-এর রসূল, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (পৃর্বের দু’রাকায়াতের সাথে) এক রাকায়াত বিত্র নামায আদায় করলেন। অতঃপর তিনি দু’রাকায়াত নামায আদায় করলেন, তাতে তিনি ক্বিরয়াত পাঠ করলেন বসা অবস্থায়। অতঃপর যখন রুকু করতে ইচ্ছা করলেন, তিনি দাঁড়ালেন অতঃপর রুকু করলেন।”

উপরোক্ত হাদীছ শরীফের ইবারত থেকে এটাই প্রমাণিত হলো যে, ইবনে মাজাহ্ শরীফের বরাতে  হযরত উম্মে সালামা রদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহা থেকে  নয়। বরং  ইবনে মাজাহ্ শরীফের বরাতে হযরত আয়িশা রদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহা থেকে বর্ণিত হাদীছ শরীফ খানার শেষে فاذا اراد ان يركع قام فركع এই ইবারত গুলো উল্লেখ আছে ।

সুতরাং প্রমাণিত হলো রেযা খাঁ তার “রেজভীয়া” কিতাবের ৩য় খণ্ডের ৪৬৮ পৃষ্ঠায়, ইবনে মাজাহ্ শরীফের বরাতে হযরত আয়িশা রদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহা থেকে বর্ণিত হাদীছ শরীফ খানার শেষের فاذا اراد ان يركع قام فركع এই ইবারত গুলো, হযরত উম্মে সালামা রদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহা থেকে বর্ণিত হাদীছ শরীফ খানার শেষে وهو جالس এরপর সংযোজন করে বা জোড়া-তালি দিয়ে, হযরত উম্মে সালামা রদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহা-এর নামে  চালিয়ে দিয়ে হাদীছ শরীফ জালিয়াতি করেছে। অর্থাৎ রেযা খাঁ তার “রেজভীয়া” কিতাবের ৩য় খণ্ডের ৪৬৮ পৃষ্ঠায়, ইবনে মাজাহ্ শরীফের বরাতে হযরত আয়িশা রদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহা থেকে বর্ণিত হাদীছ শরীফ খানার সর্বশেষ فاذا اراد ان يركع قام فركع এই ইবারত গুলো, হযরত উম্মে সালামা রদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহা-এর নামে চালিয়ে দিয়ে হাদীছ শরীফ জালিয়াতি করেছে।

প্রদত্ত সুওয়াল-জাওয়াবের টীকা ভাষ্যঃ

(ক) বিগত সংখ্যায় বলা হয়েছে, “রেযা খাঁ তার লিখিত “রেজভীয়া” কিতাবের ৩য় খণ্ডে ৪৬৮ পৃষ্ঠায়, ইবনে মাজাহ্ শরীফের বরাতে দু’জন রাবী থেকে বর্ণিত পৃথক পৃথক দু’ খানা হাদীছ শরীফ একত্রে একখানা করে একজনের নামে চালিয়ে দিয়ে হাদীছ জালিয়াতি করেছে।

(খ) পরবর্তী সংখ্যায় দলীল-আদিল্লাহ্ দ্বারা  ইনশাআল্লাহ প্রমাণ করা হবে যে, ‘বিতির নামাযের পর দু’রাকায়াত নফল নামায বসে পড়ার বর্ণনা খোদ রেযা খাঁই তার লিখিত  “রেজভীয়া” কিতাবেই উল্লেখ করেছে।    (চলবে)

নায়েক মির্জা মুহম্মদ আনোয়ারুল হক

ঢাকা সেনানিবাস, ঢাকা।

সুওয়াল: হানাফী মাযহাবে –

(১) নামাযের মুছল্লায় দাঁড়িয়ে অর্থাৎ জায়নামাযে দাঁড়িয়ে দোয়া পড়ে এবং নামাযের নিয়ত করে থাকে।

(২) ইমামের পিছনে মুক্তাদী সূরা ফাতিহাসহ কোন সূরা পাঠ করেনা।

(৩) জামায়াতে নামায আদায়কালে টাখনুর সাথে টাখনু বা গায়ের সাথে গা বা কাঁধের সাথে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ায়।

(৪) ‘আমীন’ চুপে চুপে বলে।

(৫) রুকু-সিজদায় যাওয়ার ও উঠার সময় হাত উত্তোলন করেনা।

(৬) ফরয নামাযের পর সম্মিলিতভাবে হাত তুলে মুনাজাত করে।

(৭) তিন রাকায়াত বিতির নামায দু’বৈঠকে আদায় করে এবং তৃতীয় রাকায়াতে সূরা-ক্বিরায়াত শেষে দু’য়া কুনূত পড়ে।

(৮) ইক্বামত আযানের মতোই তবে ইক্বামতে লফ্য বা শব্দগুলো জোড়া জোড়া এবং আযান অপেক্ষা কিছুটা নিম্নস্বরে পড়ে এবং দু’বার ক্বদক্বামাতিছ্ ছলাহ বলে।

(৯) তারাবীহ্র নামায বিশ রাকায়াত পড়ে।

(১০) ঈদের নামায অতিরিক্ত ছয় তাকবীরের সাথে আদায় করে।

(১১) জুমুয়ার ছানী বা দ্বিতীয় আযানের পর ইমাম জুমুয়ার খুৎবা দেন।

(১২) উন্নতমানের আটার মূল্যে ছদক্বাতুল ফিতর আদায় করে। ইত্যাদি।

কিন্তু লা-মাযহাবীরা উল্লিখিত মাসয়ালার বিপরীত আমল করে। আর ধারণা করে যে, হানাফী মাযহাবে হয়ত মাসয়ালাগুলোর কোন দলীল-প্রমাণ নেই।

অতএব, দয়া করে মাসয়ালাগুলোর দলীলভিত্তিক জাওয়াব দিয়ে বাধিত করবেন।

জাওয়াব:   আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন,

لقد كان لكم فى رسول الله اسوة حسنة.

অর্থঃ- “তোমাদের জন্য তোমাদের রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মধ্যেই রয়েছে উত্তম আদর্শ।” (দলীল)

অর্থাৎ আমলে-আখলাকে, সীরতে-ছূরতে প্রতিক্ষেত্রে আল্লাহ পাক-এর হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন, হাবীবুল্লাহ, নূরে মুজাস্সাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অনুসরণ-অনুকরণ করতে হবে। তথা সুন্নত মুতাবিক চলতে হবে। তবেই সঠিক পথের পথিক হওয়া যাবে।

উল্লেখ্য, যে কোন মানুষ ইসলামের বিধান পেশ করলেই তা গ্রহণ করা যাবে না। ইসলামের নামে যে কোন মতবাদ, তন্ত্র, মন্ত্র গ্রহণ করা যাবে না। কেবলমাত্র আল্লাহ পাক-এর হাবীব, নূরে মুজাস্সাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দেয়া বিধানকেই গ্রহণ করতে হবে। এটাই আল্লাহ পাক-এর নির্দেশ।  আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন,

ما اتاكم الرسول فخذوه وما نهاكم عنه فانتهوا واتقوا الله ان الله شديد العقاب.

অর্থঃ- “আমার রসূল তোমাদের নিকট যা নিয়ে এসেছেন তা গ্রহণ কর আর যা থেকে বিরত থাকতে বলেছেন তা থেকে বিরত থাক। এ বিষয়ে আল্লাহ পাককে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক কঠোর শাস্তিদাতা।”

হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,

عن العرباض بن سارية رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم من يعش من بعدى فسيرا اختلافا كثيرا فعليكم بسنتى وسنة الخلفاء الراشدين المهديين.

অর্থঃ- “হযরত ইরবায বিন সারিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, হযরত রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আমি দুনিয়া হতে বিদায় নেয়ার পর তোমাদের মধ্য হতে যে ব্যক্তি জীবিত থাকবে সে ইসলামের বহু বিষয়ে অনেক ইখতিলাফ বা মতবিরোধ দেখতে পাবে। সুতরাং তখন তোমাদের জন্য একান্ত জরুরী হবে আমার সুন্নত এবং খুলাফায়ে রাশিদীনগণের সুন্নতের উপর আমল করা।” (আবূ দাউদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ)

হাদীছ শরীফে আরো ইরশাদ হয়েছে,

عن عبد الله بن عمرو رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم ان بنى اسرائيل تفرقت على ثنتين وسبعين ملة وتفترق امتى على ثلث وسبعين ملة كلهم فى النار الا ملة واحدة قالوا من هى رسول الله صلى الله عليه وسلم قال ما انا عليه واصحابى.

অর্থঃ- “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহ পাক-এর রসূল, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, বণি ইস্রাঈল সম্প্রদায় পরস্পর দ্বিধাদ্বন্দ্বের কারণে বাহাত্তর দলে বিভক্ত হয়েছিলো। আর আমার উম্মত তেহাত্তর দলে বিভক্ত হবে। এই তেহাত্তর দলের মাত্র একটি দলই ভিন্ন আর বাহাত্তর দলই জাহান্নামে যাবে। হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ হযরত রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট জানতে চাইলেন, ঐ (জান্নাতী) দল কোনটি? আল্লাহ পাক-এর রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তর দিলেন, ‘আমি এবং আমার ছাহাবাগণকে যারা অনুসরণ করবে একমাত্র তারাই জান্নাতী হবে।” (তিরমিযী, মিশকাত)

হাদীছ শরীফে আরো ইরশাদ হয়েছে

عن عبد الله بن مسعود رضى الله تعالى عنه قال من كان مستنا فليستن بمن قد مات فان الحى لا تؤمن عليه الفتنة اولئك اصحاب محمد صلى الله عليه وسلم كانوا افضل هذه الامة ابرها قلوبا واعمقها علما واقلها تكلفا اختارهم الله لصحبة نبيه ولاقامة دينه فاعرفوالهم فضلهم واتبعوا على اثرهم وتمسكوابما استطعتم من اخلاقهم وسيرهم فانهم كانوا على الهدى المستقيم.

অর্থঃ- “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, যে ব্যক্তি শরীয়তের ছহীহ্ নিয়মের অনুসারী হতে চায় তার জন্য একান্ত কর্তব্য আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ছাহাবাগণের অনুসরণ করা। ছাহাবীগণই উম্মতের মধ্যে অতি উত্তম। তাঁরা আত্মার দিক দিয়ে অতি পবিত্র। ইলমের দিক দিয়ে গভীর জ্ঞানের অধিকারী। মানুষকে দেখানোর জন্য তাঁরা কোন কাজ করেননি। আল্লাহ পাক তাঁদেরকে মনোনীত করেছেন আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সোহবত অর্জনের জন্য এবং দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য। সুতরাং তোমরা তাঁদের মর্যাদা সম্পর্কে অবগত হও এবং তাঁদের কথা ও কাজের অনুসরণ কর এবং যথাসম্ভব তাঁদের গুণাবলী ও চরিত্র মুবারককে গ্রহণ করো। কারণ তাঁরা হেদায়াত ও সীরতে মুস্তাকীমের উপর দৃঢ় ছিলেন।” (মিশকাত)

عن عمران بن حصين رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم خير امتى قرنى ثم الذين يلونهم ثم الذين يلونهم.

অর্থঃ- “হযরত ইমরান হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহ পাক-এর রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, আমার উম্মতের মধ্যে সব চাইতে অতি উত্তম আমার যুগ। অর্থাৎ ছাহাবাগণ অতি উত্তম। এরপর তাবিয়ীনগণ। এবং তারপর তাবি তাবিয়ীনগণ উত্তম।” (বুখারী)

হাদীছ শরীফে আরো ইরশাদ হয়েছে,

عن جابر رضى الله تعالى عنه عن انبى صلى الله عليه وسلم قال لاتمس النار مسلما رانى او را من رانى.

অর্থঃ- “হযরত জাবির রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেন, হযরত নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আমার দর্শণপ্রাপ্ত মুসলমান তথা ছাহাবীগণ অথবা আমার ছাহাবাদের দর্শণপ্রাপ্ত তাবিয়ীনগণকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবেনা।” (তিরমিযী, মিশকাত)

রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর এই ঘোষণার সমর্থনে কুরআন শরীফের আয়াত শরীফও রয়েছে। যেমন, ইরশাদ হয়েছে,

السابقون الاولون من المهاجرين والانصار والذين اتبعواهم باحسان رضى الله عنهم ورضوا عنه واعدلهم جنت تجرى تحتها الانهار خالدين فيها ابدا ذلك الفوز العظيم.

অর্থঃ- “ঈমান ও আমলের সর্বপ্রথম স্থান অধিকারী মুহাজির ও আনসার ছাহাবাগণ  এবং উত্তমভাবে উক্ত ছাহাবাগণের অনুসারী সকলের প্রতি আল্লাহ পাক সন্তুষ্ট এবং তাঁরাও আল্লাহ পাক-এর প্রতি সন্তুষ্ট। ছাহাবা ও তাঁদের অনুসারী সকলের জন্য আল্লাহ পাক এমন জান্নাত নির্ধারণ করে রেখেছেন যার তলদেশ দিয়ে নহরসমূহ প্রবাহিত হবে। তাঁরা চিরদিন সেই জান্নাতে থাকবেন।” (সূরা তওবা-১০০)

আল্লাহ পাক এ আয়াত শরীফে স্পষ্টভাষায় জানিয়েছেন যে, ঈমান ও আমলে হযরত ছাহাবায়ে কিরামগণ প্রথম স্থান অধিকার করতঃ আল্লাহ পাক-এর সন্তুষ্টি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন এবং জান্নাতের সুসংবাদ পেয়েছেন। তদ্রুপভাবে উত্তমভাবে যারা ছাহাবীগণের অনুসরণ করবেন তাঁরাই একমাত্র সঠিক পথে আমল করে আল্লাহ পাক-এর সন্তুষ্টি লাভের তাওফীক পাবেন।

স্মরণীয় যে, আল্লাহ পাক-এর বিধান পালন করাই মুলতঃ মু’মিন ও মুসলমানের কাজ। আল্লাহ পাক-এর বিধানকে পাওয়া রসূল পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মাধ্যম ছাড়া সম্ভব নয়। এই কারণে আল্লাহ পাক নিজেই রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দেয়া বিধানকে গ্রহণ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন।

আবার রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দেয়া বিধান ছাহাবা ও মুজতাহিদ ইমামগণের মাধ্যম ছাড়া পাওয়া এবং সঠিকভাবে আমল করা সম্ভব নয়। কারণ এমনও কিছু বিষয় আছে যা ইসলামের প্রথম দিকে নিষিদ্ধ না থাকলেও তা পরবর্তীকালে রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিষিদ্ধ করেছেন। যেমন- শরাব পান করা। এমনি করে বহু বিষয় আছে যা প্রথমে করা নিষিদ্ধ না থাকলেও পরবর্তীকালে নিষিদ্ধ হয়ে যায়। সুতরাং প্রথম ও পরে কোন সময় কোন হুকুম হয়েছে এটা ছাহাবাগণের বর্ণনা ও তাঁদের আমলের মধ্যে পাওয়া যায়।

এ জন্য ইসলামের সঠিক বিধান হিসেবে উত্তমভাবে ছাহাবীগণের অনুসরণকারীদেরকে আল্লাহ পাক জান্নাতী মানুষ বলে ঘোষণা দিয়েছেন। ছাহাবীগণের থেকে সঠিক ইসলাম পাবার জন্য মুজতাহিদ ইমামগণের অনুসরণ করাটাই বিশেষ গুরুত্বের বিষয়। এর বহু কারণ রয়েছে।

তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য দু’টি বিষয় হচ্ছে- এক. ইসলামের পূর্বপর বিধান সঠিকভাবে নির্ধারণ ইমামগণই করেছেন। দুই. ইসলামী বিধানের মান নির্ধারিত নিয়মে তথা ফরয, ওয়াজিব ও সুন্নত হিসেবে ইমামগণের মাধ্যমেই পাওয়া যায়। যা কুরআন শরীফের আয়াত ও রসূল পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীছ শরীফে স্পষ্টভাবে পাওয়া যায় না।

উদাহরণ স্বরূপ- নামাযের কোন কাজটা ফরয, কোনটা ওয়াজিব এবং কোনটা সুন্নাত এর বর্ণনা হাদীছ শরীফে সরাসরি বলা হয়নি। অথচ সকলেই জানে এবং মানে যে, সব কাজগুলো ফরয নয় অথবা সব কাজগুলো ওয়াজিব বা সুন্নত নয়।

সুতরাং ইসলামের পূর্বপর বিধানকে যেমন ছাহাবীগণের মাধ্যমে পাবার জন্য তাবিয়ীন এবং তাবি তাবিয়ীন তথা মুজতাহিদ ইমামগণের বর্ণনা থেকেই গ্রহণ করতে হবে। তদ্রুপভাবে ইসলামী বিধানের মান নির্ধারণ করে আমল করার জন্য মুজতাহিদ ইমামগণের অনুসরণ ব্যতীত দ্বিতীয় কোন পথ নেই।

ইমামে আ’যম আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি তাবিয়ী ছিলেন। ছাহাবাগণের দর্শন লাভ করে ইসলামের সর্ববিধ বিষয় শিক্ষা গ্রহণ করেন। ছাহাবা ছাড়া বিশিষ্ট তাবিয়ীনদের থেকেও ইসলামী বিধানের শিক্ষা লাভ করেন। মাযহাবের ইমামগণের মধ্যে একমাত্র তিনিই তাবিয়ী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন।

পৃথিবীতে যদি অনুসন্ধান করা হয়, তবে দেখা যাবে যে, বর্তমানে আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতই একমাত্র সঠিক মু’মিন ও মুসলমান। আল্লাহ পাক ও তাঁর রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সঠিক ইসলামের উপর চলার যে নীতি নির্ধারণ করে দিয়েছেন সেটা একমাত্র আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের লোকেরা অনুসরণ করে চলেন।

ইসলামের নামে অন্য যারা পরিচয় দিচ্ছেন তারা আল্লাহ পাক ও তাঁর রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বিধান গ্রহণ করছেনা। যেমন, কাদিয়ানী, বাহাই, খারিজী, রাফিজী, মুতাজিলা, লা-মাযহাবী, সালাফী ইত্যাদি বাহাত্তর ফিরক্বা।

উল্লেখ্য, ইসলামের শত্রুপক্ষ সর্বদাই মানুষকে পথভ্রষ্ট করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। কুরআন শরীফ ও নবী পাকের অস্তিত্বকে মিটিয়ে দেয়ার জন্য যেমন কাদিয়ানী সম্প্রদায় আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে তদ্রুপভাবে আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের অস্তিত্ব মিটিয়ে দেয়ার জন্য এক শ্রেণীর লোক যথাসাধ্য চেষ্টা করে চলছে। কারণ, আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত সম্পর্কে যদি লোক সমাজে কু-ধারণা সৃষ্টি করা যায়, তবেই মানুষকে পথভ্রষ্ট করা সহজ।

বর্তমান বিশ্বে আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের অনুসারীগণ চার মাযহাবেরই অন্তর্ভুক্ত। হানাফী, মালিকী, শাফিয়ী, হাম্বলী। পৃথিবীতে হানাফী মাযহাবের লোক বেশী। বিশেষ করে এশিয়া মহাদেশে হানাফী মাযহাব ব্যতীত অন্য মাযহাবের অনুসারী নাই বললেই চলে। এই কারণে ইসলামের শত্রুপক্ষ সর্বদাই হানাফী মাযহাবের উপর আক্রমণ চালাচ্ছে। কাগজপত্রে কখনও লিখছে যে, মাযহাবে বিশ্বাসী হলে কাফির হবে, ইমাম আবু হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি কাফির ছিলেন। নাউযুবিল্লাহ্। হানাফীদের কোন আমল ঠিক নয় ইত্যাদি। ঈমানের পর যেহেতু নামাযের গুরুত্ব- এই কারণে হানাফীদের নামায সম্পর্কে বহু ভুল লিখা ছাপিয়ে অপপ্রচার করা হচ্ছে।

তবে সর্বসম্মত কথা এই যে, কেউ যদি সঠিকভাবে পূর্ণাঙ্গ ইসলামী আইন বা জীবনব্যবস্থা খোঁজ করে তবে তার হানাফী মাযহাবের ফিক্বাহ শাস্ত্রের সাহায্য নিতে হবে এবং হানাফী মাযহাবের ফিক্বাহ শাস্ত্রের কিতাবেই তা পাওয়া যাবে।

হানাফী মাযহাব কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফের সঠিকবিধান বাহক তাবিয়ীন ও তাবে তাবিয়ীনগণের মাধ্যমে ছাহাবায়ে কিরাম কর্তৃক সংরক্ষিত ইসলামী বিধানের অনুসরণ করার নাম।

সুতরাং তথাকথিত আহলে হাদীছ, লা-মাযহাবী, সালাফী ইত্যাদি কুচক্রী মহলের কলমে হানাফী মাযহাব, ইমামে আ’যম আবু হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি ও হানাফীদের বিরুদ্ধে যা কিছু লিখা হয়েছে সবই ইসলাম বিরোধী যড়যন্ত্রের শামীল। কাজেই প্রত্যেকের উচিত নিজেদের ঈমান-আমল হিফাযতের ব্যাপারে সাবধান ও সতর্ক থাকা।

স্মর্তব্য, সুওয়ালে উল্লিখিত হানাফী মাযহাবের মাসয়ালাগুলোর দলীলভিত্তিক জাওয়াব ধারাবাহিকভাবে পেশ করা হবে ইনশাআল্লাহ। তবে তার পূর্বে মাযহাব মানা ফরয, মাযহাব না মানা বিদ্য়াতী ও গোমরাহ, মাযহাব অস্বীকার করা বা মাযহাবের বিরোধিতা করা কুফরী- সে ফতওয়া সংক্ষিপ্তাকারে প্রদান করা হবে ইনশাআল্লাহ।

সাইয়্যিদা মুছাম্মত জাহানারা খাতুন

উলিপুর, কুড়িগ্রাম।

সুওয়ালঃ বর্তমান সময়ে বিভিন্ন দেশে নববর্ষ উপলক্ষে পহেলা তারিখে যেমন- ১লা বৈশাখ, ১লা জানুয়ারী ইত্যাদি তারিখে ভাল ভাল খাওয়ার জন্য উৎসাহ দেয়া হয়, এটা কতটুকু শরীয়তসম্মত? আর শরীয়তে কোন নির্দিষ্ট দিনে ভাল খাওয়ার জন্য উৎসাহ দেয়া হয়েছে কি?

জাওয়াবঃ শরীয়তের দৃষ্টিতে পহেলা বৈশাখ, পহেলা জানুয়ারীতে ভাল খাওয়ার জন্য আলাদাভাবে কোন তাগিদ করা হয়নি। বরং দশই মুর্হরমে প্রত্যেক পরিবারের প্রধান ব্যক্তিকে তার পরিবারের সদস্যদেরকে ভাল খাদ্য খাওয়ানোর জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

আল্লাহ পাক-এর হাবীব, নূরে মুজাস্সাম, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

من وسع على عياله فى النفقة يوم عاشوراء وسع الله عليه سائر سنته.

অর্থঃ- “যে ব্যক্তি তার পরিবারবর্গকে আশুরার দিন অর্থাৎ দশই মুর্হরমে ভাল খাদ্য খাওয়াবে, আল্লাহ্ পাক তাকে এক বৎসরের জন্য সচ্ছলতা দান করবেন।” (তবারানী শরীফ, মা-সাবাতা বিস্সুন্নাহ)

{দলীলসমূহঃ- জামিউল ফাওয়ায়েদ, তবারানী, বায়হাক্বী, ইবনে হাব্বান, মুসনদে আহমদ, দাইলামী মাসাবাতা বিস্ সুন্নাহ্ ইত্যাদি।}

মুহম্মদ হুমায়ুন কবীর, বানারিপাড়া, বরিশাল।

সুওয়ালঃ আশুরাকে কেন্দ্র করে কিছু লোক নবী-রসূল আলাইহিমুস সালামগণ সম্পর্কে এলোমেলো বক্তব্য পেশ করে থাকে। যেমন তারা বলে থাকে যে, হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম গন্ধম খেয়ে ভুল করেছিলেন ইত্যাদি।

এখন আমার প্রশ্ন হলো- সত্যিই কি নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালামগণ ভুল-ত্রুটি করেছিলেন অথবা করেননি? সঠিক জাওয়াব দানে বাধিত করবেন।

জাওয়াবঃ  আহ্লে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আক্বীদা হলো কোন নবী-রসূল আলাইহিমুস সালামগণ কখনও ভুল করেননি। ইচ্ছাকৃত তো নয়ই, অনিচ্ছাকৃতও নয়। অর্থাৎ নবী আলাইহিমুস সালামগণ কোন ভুলই করেননি। (শরহে আক্বাইদে নসফী, ফিক্বহে আকবর, তাকমীলুল ঈমান, আক্বাইদে হাক্কাহ)

অর্থাৎ সকল নবী-রসূল আলাইহিমুস সালামগণই ছিলেন আল্লাহ্ পাক-এর খাছ ও মনোনীত বান্দাহ্গণের অন্তর্ভুক্ত। তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন ওহীর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কুরআন শরীফের একাধিক স্থানে ইরশাদ  হয়েছে, نوحى اليهم.

অর্থঃ- “আমি তাঁদের (নবী-রসূল আলাইহিমুস সালামগণের) প্রতি ওহী পাঠাতাম।” (সূরা ইউসূফ-১০৯, নহল-৪৩, আম্বিয়া-৭)

অর্থাৎ নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালামগণের যাবতীয় কার্যাবলীই ওহীর দ্বারা (আল্লাহ পাক কর্তৃক) পরিচালিত হতো। যার পরিপ্রেক্ষিতে আক্বাইদের কিতাবে বর্ণিত হয়েছে,

الانبياء عليهم السلام كلهم معصومون.

অর্থঃ- “সকল আম্বিয়া আলাইহিমুস্ সালামগণ মা’ছূম বা নিস্পাপ।”

আরো উল্লেখ করা হয়েছে যে,

الانبياء عليهم السلام كلهم منزحون عن الصغائر والكبائر والكفر والقبائح.

অর্থঃ- “সকল আম্বিয়া আলাইহিমুস্ সালামগণই ছগীরা, কবীরা, কুফরী এবং অপছন্দনীয় কাজ হতেও পবিত্র।”

অতএব, যারা নবী আলাইহিমুস্ সালামগণের ভুল সম্পর্কে বলে থাকে, আক্বাইদ সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণেই তারা তা বলে থাকে। যেমন তারা বলে থাকে যে, হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম গন্দম খেয়ে ভুল করেছিলেন। (নাউযুবিল্লাহ্)

মূলতঃ তাদের একথা সঠিক নয়। প্রকৃত ঘটনা হলো- আল্লাহ পাক যখন হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম ও হযরত হাওয়া আলাইহাস্ সালামকে আদেশ করেছিলেন যে,

لاتقربا هذه الشجرة.

অর্থঃ- “তোমরা এই (গন্দমের) গাছের নিকটবর্তী হয়ো না।” (সূরা বাক্বারা/৩৫)

তখন তাঁরা আল্লাহ পাক-এর এ আদেশ অনুযায়ী সে গাছের নিকটবর্তী হননি। বরং উক্ত গাছের অনুরূপ বিপরীত দিকের অন্য একটি গাছ দেখিয়ে, ইবলিস শয়তান এসে হযরত হাওয়া আলাইহাস্ সালামকে মিথ্যা কছম খেয়ে বলেছিল যে, যদি আপনারা এ গাছের ফল খান, তবে আপনারা ফেরেশ্তা হয়ে যাবেন অথবা স্থায়ীভাবে বেহেশ্তে বসবাস করতে পারবেন। কোন কোন বর্ণনা মোতাবেক, তখন হযরত হাওয়া আলাইহাস্ সালাম সে গাছ হতে ফল এনে শরবত বানিয়ে হযরত আদম আলাইহিস্ সালামকে খাইয়েছিলেন। অপর বর্ণনায়, ফল কেটে খাইয়েছিলেন। এ ঘটনা হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম-এর অজান্তেই সংঘটিত হয়েছিল। সুতরাং যা অজান্তে সংঘটিত হয়, তা কি করে ভুল বা অপরাধ হতে পারে? বাস্তবিক তা কখনই ভুল  হতে পারেনা। (সমূহ তাফসীরের কিতাব)

এর মেছালস্বরূপ উল্লেখ করা যায়- হযরত ইমাম হাসান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর শাহাদতের ঘটনা। তিনি যে শাহাদত বরণ করেছিলেন, এ ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই। তাঁকে ইসলামের শত্রুরা শহীদ করার জন্য একে একে পাঁচবার বিষ পান করায়। কিন্তু আল্লাহ পাক-এর রহ্মতে তিনি প্রত্যেক বারই বেঁচে যান। ষষ্ঠবার তাঁকে শহীদ করার জন্য তাঁর পানির কলসিতে, যে কলসির মুখ কাপড় দিয়ে বেঁধে রাখতেন, (যেন তার ভিতর কিছু ফেলা না যায়,) সেই কাপড়ের উপর শত্রুরা হিরক চূর্ণ বিষ তাঁর অজান্তে মিশিয়ে দিয়েছিল। তিনি গভীর রাত্রিতে হিরক চূর্ণ বিষ মিশ্রিত পানি কলসি থেকে ঢেলে পান করেন, যার ফলশ্রুতিতে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। যা তাঁর অজান্তেই সংঘটিত হয়েছিল। (সিররুশ্ শাহাদাতাঈন, শুহাদায়ে কারবালা, সীরতে ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন (রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা)

এখন প্রশ্ন উঠে, শরীয়তের দৃষ্টিতে তাঁর শাহাদাতকে আত্মহত্যা বলতে হবে, না ভুল করার কারণে ইন্তিকাল করেছেন, তা বলতে হবে?

মূলতঃ উপরোক্ত দু’টির কোনটিই বলা যাবেনা। যদি কেউ কোন একটিও বলে, তবে সে মিথ্যা তোহ্মত দেয়ার গুণাহে গুণাহ্গার হবে, যা কুফরীর শামিল হবে। তদ্রুপ হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম-এর ঘটনাও। যা তাঁর অজান্তে সংঘটিত হলো।

অনুরূপ অন্যান্য নবী নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালামগণ-এর ঘটনাও। মানুষ সঠিক ইতিহাস না জানার কারণে এবং কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ-এর সঠিক ব্যাখ্যা না বুঝার কারণে, নবী আলাইহিমুস্ সালামগণের শানে বেয়াদবীমূলক কুফরী কথাবার্তা বলে থাকে।

হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালামগণের সাথে কতটুকু আদব রক্ষা করতে হবে, সে প্রসঙ্গে কিতাবে, ইমামুত তরীক্বত ওয়াশ্ শরীয়ত, হযরত ইমাম র্সারী সাক্তী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর ঘটনা উল্লেখ করা হয়, যিনি তাঁর যামানায় আল্লাহ পাক-এর লক্ষ্যস্থল ছিলেন। যিনি ইমামুশ্ শরীয়ত ওয়াত্ব তরীক্বত ছিলেন। তিনি একবার স্বপে¦ দেখেন আল্লাহ পাক-এর নবী হযরত ইয়াকুব আলাইহিস্ সালামকে। দেখে প্রশ্ন করেছিলেন, হে আল্লাহ্ পাক-এর নবী হযরত ইয়াকুব আলাইহিস্ সালাম! আপনার অন্তরে যদি আল্লাহ পাক-এর মহব্বত সত্যিকার ভাবেই প্রবল হতো, তাহলে আপনি কি করে আপনার ছেলে হযরত ইউসুফ আলাইহিস্ সালাম-এর জুদায়ীর (বিচ্ছেদের) কারণে তাঁর মহব্বতে চল্লিশ বছর যাবত কেঁঁদে কেঁদে আপনার চক্ষু নষ্ট করেছিলেন? একথা বলার সাথে সাথে গায়েব থেকে নেদা (আওয়াজ) হলো, “হে র্সারী সাক্তী! মুখ সামলিয়ে নবীদের শানে কথা বল।” এরপর হযরত ইউসুফ আলাইহিস্ সালামকে তাঁর সামনে পেশ করা হলে তিনি বেহুশ হয়ে পড়ে যান এবং এভাবে একাধারা তের দিন, তের রাত্রি বেহুশ থাকার পর হুঁশ ফিরে পান। তখন গায়েব থেকে পুনরায় নেদা হয়, “আল্লাহ পাক-এর নবীদের শানে আদবের খিলাফ কথা বললে এরূপই অবস্থা হয়ে থাকে।” (তাযকিরাতুল আওলিয়া)

উপরোক্ত ওয়াকেয়ার আলোকে প্রতিভাত হয় যে, আদব কত সূক্ষ্ম জিনিস এবং হযরত নবী আলাইহিস্ সালামগণের ক্ষেত্রে কি পরিমাণ আদবের সাথে কথা বলতে হবে এবং তাঁদের সাথে বেয়াদবির কি পরিণতি? সত্যিই তা চিন্তা-ফিকিরের বিষয়। বেয়াদব সম্পর্কে হযরত জালালুদ্দীন রুমী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন,

উর্দূ কম্পোজ করতে হবে

অর্থঃ- “বেয়াদব আল্লাহ পাক-এর রহ্মত থেকে বঞ্চিত।” (মসনবী শরীফ)

অতএব, প্রতীয়মান হয় যে, হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালামগণের প্রতি কতটুকু আদব রক্ষা করা দরকার।

উল্লেখ্য যে, হযরত র্সারী সাক্তী রহমতুল্লাহি আলাইহি ইমামুজ্জামান, ইমামুশ্ শরীয়ত ওয়াত্ব তরীক্বত ও আল্লাহ পাক-এর লক্ষ্যস্থল ওলী হওয়া সত্বেও তাঁর প্রতি সতর্কবাণী ও সাবধানবাণী উচ্চারিত হয়েছে। মূলতঃ নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালামগণ ভুল করা তো দূরের কথা, কোন প্রকার অপছন্দনীয় কাজও তাঁরা করতেন না। বরং সর্ব প্রকার অপছন্দনীয় কাজ থেকেও বেঁচে থাকতেন বা পবিত্র থাকতেন, সে প্রসঙ্গে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পবিত্র  সীরত মুবারক থেকে একটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়-

“একবার আল্লাহ পাক-এর রসূল  হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হুজরা শরীফে বসা ছিলেন। এমতাবস্থায় এক ব্যক্তি এসে আল্লাহ পাক-এর রসূল, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া  সাল্লাম-এর সাথে সাক্ষাত করার অনুমতি চাইলেন। এ সংবাদ উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট পৌঁছালেন। তখন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, সে ব্যক্তিকে অপেক্ষা করতে বল। একথা বলে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর পাগড়ী মুবারক, জামা বা কোর্তা মুবারক ইত্যাদি গুছগাছ করে নিলেন। এমন কি হুযরা শরীফ থেকে বের হওয়ার মূহুর্তে পানির গামলাতে নিজের চেহারা মুবারক দেখে গুছিয়ে নিচ্ছিলেন। তা দেখে সে সময় হযরত আয়েশা ছিদ্দীকা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ্ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনিও কি এরূপ করেন?

তখন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “কিরূপ করি?” হযরত আয়িশা ছিদ্দীকা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা বললেন, “এরূপ পরিপাটি।” এর জবাবে আল্লাহ পাক-এর রসূল, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “হ্যাঁ, আমরা আল্লাহ্ পাক-এর নবী। আমাদের কোন কাজ কারো অপছন্দ হলে, সে ঈমান হারা হয়ে যাবে।” (আল্ মুরশিদুল আমীন)

অতএব, নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালামগণ যে কতটুকু অপছন্দনীয় কাজ থেকে বেঁচে থাকতেন, এ হাদীছ শরীফের বর্ণিত ঘটনা তারই প্রমাণ। তাহলে কি করে এ কথা বলা যেতে পারে বা বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে যে, নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালামগণ ভুল-ত্রুটি করেছিলেন? বস্তুতঃ এরূপ আক্বীদা পোষণ করা সম্পূর্ণই হারাম ও কুফরী।

তদ্রুপ নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালামগণের সম্পর্কে ও তাঁদের শানের খিলাফ কোন অর্থ গ্রহণ করা যাবেনা বরং এমন অর্থ ব্যবহার বা গ্রহণ করতে হবে, যাতে তাঁদের শান সমুন্নত থাকে।

উল্লেখ্য যে, আল্লাহ পাক-এর রসূল, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীছ শরীফ বর্ণনা কারীদেরকে রাবী বলা হয়। এই রাবীগণের মধ্যে যাঁরা প্রথম শ্রেণীর, তাঁদেরকে বলা হয় ছেক্বাহ্ রাবী।

হাদীছ বিশারদগণ, ছেক্বাহ্ রাবী হওয়ার জন্য যে মানদন্ড নির্ধারণ করেছেন, তার মধ্যে মূল বিষয় হচ্ছে- (১) আদালত ও (২) জব্ত।

জব্ত হচ্ছে- প্রখর স্মরণশক্তি। তা এমন যে, একবার শুনলে আর ভুলেনা।

আর আদালত-এর মধ্যে চারটি শর্ত রয়েছে। তার মধ্যে প্রধান হলো দু’টি। যথা- (ক) তাক্বওয়া, (খ) মুরুওওয়াত।

(ক) তাক্বওয়া হচ্ছে- কুফরী, শেরেকী, বিদ্য়াতী, ফাসিকী কাজ থেকে বেঁচে থাকার সাথে সাথে কবীরাহ্ গুণাহ্ থেকে, এমনকি ছগীরাহ্ গুণাহ্ও বার বার করা থেকে বেঁচে থাকা। (খ) আর মুরুওওয়াত হচ্ছে- অশালীন, অশোভনীয়, অপছন্দনীয়, এমনকি দৃষ্টিকটু কাজ থেকে বিরত থাকা। যেমন- রাস্তায় হেঁটে হেঁটে খাদ্য খাওয়া, রাস্তায় অট্টহাস্য করা, চিৎকার করা ইত্যাদি। (তাদরীবুর রাবী, মুকাদ্দামাতুশ শায়খ, মীযানুল আখবার)

এখন ফিকিরের বিষয় এই যে, হাদীছ শরীফ বর্ণনাকারী ছেক্বাহ্ রাবী যদি এত গুণ ও যোগ্যতাসম্পন্ন এবং তাক্বওয়াধারী হন অর্থাৎ হাদীছ বিশারদ উম্মতে মুহম্মদীর নিকট যদি ছেক্বাহ্ রাবী হিসেবে হাদীস বর্ণনাকারী হওয়ার জন্য ছগীরাহ্ গুণাহ্ বার বার না করা ও দৃষ্টিকটু সাধারণ অপছন্দনীয় কাজও না করা শর্ত হয়, তাহলে যাঁরা আল্লাহ পাক-এর নবী হবেন এবং আল্লাহ্ পাক-এর কালাম বর্ণনা করবেন, তাঁদের জন্য আল্লাহ্ পাক কি মানদন্ড নির্ধারণ করেছেন বা তাঁদের ক্ষেত্রে কতটুকু মা’ছূম ও মাহ্ফুজ হওয়া নির্দিষ্ট করেছেন তা অনুধাবনীয়।

অতএব, যে কোন লোকের জন্যই নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালামগণের শানের বিন্দুমাত্র খেলাফ কথাবার্তা বলা সম্পূর্ণ নাজায়িয, হারাম ও কুফরী। এ ধরণের কুফরী আক্বীদা থেকে বেঁচে থাকা সমস্ত মুসলমান নর-নারীর জন্য ফরজ ।

 সুওয়াল-জাওয়াব

সুওয়াল-জাওয়াব

সুওয়াল-জাওয়াব

সুওয়াল-জাওয়াব বিভাগ

সুওয়াল জাওয়াব