সুওয়াল-জাওয়াব

সংখ্যা: ১৪৪তম সংখ্যা | বিভাগ:

মুহম্মদ আসিফ মহিউদ্দীন, পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম।

মুহম্মদ জাহিদ হুসাইন, মালিবাগ চৌধুরী পাড়া, ঢাকা।

সুওয়াল: ‘মাসিক আল বাইয়্যিনাত’ জুলাই-২০০২ ঈসায়ী সংখ্যায় আজ থেকে প্রায় দীর্ঘ তিন বৎসর পূর্বে মাসিক মুহীনুল ইসলামের মুনাজাত সম্পর্কে বক্তব্য খণ্ড করতে গিয়ে যে জাওয়াব প্রদান করা হয়েছে তার জবাবে ‘মাসিক মুহীনুল ইসলাম’ জুন-২০০৫ ঈসায়ী সংখ্যার ‘জিজ্ঞাসা-সমাধান’ বিভাগে যা লিখেছে তার মূল বিষয়বস্তু হলো-

১. মাসিক আল বাইয়্যিনাতে ‘মুছান্নাফে ইবনে আবী শায়বার’ বরাতে যে হাদীছ শরীফখানা উল্লেখ করা হয়েছে। তাতে নাকি رفع يديه ودعا. ‘রফায়া ইদাইহি ওয়াদা’য়া’ এ অংশটুকুর উল্লেখ নেই। প্রমাণস্বরূপ তারা কয়েকটি প্রকাশনার কথা উল্লেখ করেছে। যেমন, মুলতানের তৈয়ব একাডেমী, বোম্বাইয়ের দারুস্ সালাফিয়া ইত্যাদি।

২. “মুছান্নাফে ইবনে আবী শায়বায়” বর্ণিত হাদীছ শরীফখানা জঈফ। আর জঈফ বর্ণনাকে কোথাও প্রমাণ ও দলীল হিসেবে পেশ করা যায় না।

৩. হযরত ছাহাবায়ে কিরাম একটি নিম্ন শ্রেণীর কাজকেও বর্ণনা করতে সংকোচবোধ করেননি। আর মুনাজাত এমন এক কাজ যা দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাযান্তে প্রকাশ্যভাবে পাঁচবার যদি করতেন তবে কেন তার কোন বর্ণনা করা হয়নি।

৪. ইসলামী স্বর্ণযুগে এবং তৎপরবর্তীতে ফুক্বাহায়ে কিরাম ও হাদীছ বিশারদগণের কেউ ফরজ নামাযের পর সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করেননি। তাই তা হযরত মুফতিয়ানে কিরামের ঐক্যমতে বিদ্য়াত।

৫. ‘ফরয নামাযের পর সম্মিলিত মুনাজাতকে অত্যাবশ্যকীয় (ফরয) মনে করা হয় এবং যারা মুনাজাত করে না তাদেরকে তিরস্কার করা হয়।’- তাই এটা বিদ্য়াত।

৬. আল বাইয়্যিনাতে নাকি যাকে তাকে, অহেতুক কাফির ফতওয়া দেয়া হয়। তাছাড়া আল বাইয়্যিনাতে নাকি লেখা হয়েছে যে, ‘যারা ফরয নামাযের পর সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করবে না, তারা কাফির।’

৭. মক্কা শরীফ ও মদীনা শরীফে নাকি এখনও ফরয নামাযের পর মুনাজাত করা হয়না এবং পূর্বেও কখনো করা হতো না।

৮. ‘দোয়া-ইবাদতের মগজ’ এবং ‘উত্তম ইবাদত হলো দোয়া।’ এই হাদীছে তো প্রচলিত দোয়ার ব্যাপারে কোন উল্লেখ নেই এবং এ ধরনের কোন হাদীছ কেউ দেখাতে পারবে না। হাদীছে যে ধরনের দোয়ার কথা বলা হয়েছে এখানে তো ঐ ধরনের দোয়া ও মুনাজাতকে বিদ্য়াত বলা হচ্ছে না।

৯. তারা তাদের বক্তব্যের স্বপক্ষে দলীল হিসেবে তাদের নিজেদের লিখিত কিতাব “ফতওয়ায়ে দারুল উলুম হাটহাজারী ও ফয়জুল্লাহ্র লিখিত কিতাব এবং তাফসীরে ইবনে কাছীর, কবীর, বযলুল মাযহুদ, ফয়জুল বারী, মা’য়ারিফুস্ সুনান ও আল ই’তেছাম লিশশাতেবীর নাম উল্লেখ করেছে।

এখন সুওয়াল হলো- “ফরয নামাযের পর সম্মিলিতভাবে হাত তুলে মুনাজাত করা” সম্পর্কিত হাটহাজারীর খারিজী-ওহাবী মৌলবাদীদের উল্লিখিত বক্তব্য ও মন্তব্যসমূহ কতটুকু সঠিক, দলীলভিত্তিক ও গ্রহণযোগ্য? প্রতিটি বক্তব্যের দলীলভিত্তিক জবাব দিয়ে মুনাজাত বিরোধী বাতিল ফিরক্বার খপ্পর থেকে আমাদের ঈমান-আমল হেফাজত করবেন বলে আমরা গভীরভাবে আশাবাদি।

জাওয়াব: মাসিক আল বাইয়্যিনাতে প্রদত্ত ‘মুনাজাত’ সম্পর্কিত বক্তব্যের লোক দেখানো জবাব দিতে যদিও তারা দীর্ঘ তিনটি বছর ব্যয় করেছে। তবে এতে নতুন কিছুই তারা উল্লেখ করতে পারেনি। সেই পুরনো মিথ্যে বুলিই তারা আওড়িয়ে গেছে যে, ‘স্বর্ণযুগের কেউ ফরয নামাযের পর সম্মিলিতভাবে হাত তুলে মুনাজাত করেননি’- তাই এটা বিদ্য়াত।

হ্যাঁ, তাদের সেই পুরনো মিথ্যাচারিতার সাথে আরেকটি নতুন মিথ্যাচারিতা যোগ হয়েছে বটে। এ ধরনের মিথ্যাচারিতা এই ১৫শ’ বছরের মধ্যে কেউ দেখাতে সাহস পায়নি। সম্ভবত: সেই নতুন মিথ্যাচারিতার সকল ব্যবস্থাকে পাকাপোক্ত করতেই তাদের ৩টি বৎসর ব্যয় হয়ে গেছে। তাদের সেই মিথ্যাচারিতা হচ্ছে সুওয়ালে উল্লিখিত তাদের প্রথম বক্তব্য।

যেমন তারা লিখেছে, “মাসিক আল বাইয়্যিনাতে ‘মুছান্নাফে ইবনে আবী শায়বার’ বরাতে যে হাদীছ শরীফখানা উল্লেখ করা হয়েছে। তাতে رفع يديه ودعا ‘রফায়া ইদাইহি ওয়াদায়া’ এ অংশটুকু উল্লেখ নেই। প্রমাণস্বরূপ তারা কয়েকটি প্রকাশনার কথা উল্লেখ করেছে। যেমন, মুলতানের তৈয়ব একাডেমী, বোম্বাইয়ের দারুস্ সালাফিয়া ইত্যাদি। ….. ”

এর জবাবে বলতে হয়, তাদের উল্লিখিত প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত ‘মুছান্নাফে ইবনে আবী শায়বায়’ رفع يديه ودعا এ অংশটুকু না থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কারণ, এগুলো ওহাবী, সালাফী ও লা-মাযহাবীদের নিজস্ব প্রকাশনী। এরাই মুনাজাতের ঘোর বিরোধী।

 তাদের একটি বদ্ স্বভাব হলো- পূর্ববর্তী যে সকল কিতাবে ‘তাদের মতের খিলাফ’ মাসয়ালা উল্লেখ রয়েছে বর্তমান সংস্করণগুলোতে (যা তাদের নিজস্ব প্রকাশনীতে প্রকাশিত হয়) তা পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও কাট-সাট করে বা বাদ দিয়ে দেয়া। এর বহু প্রমাণ আমাদের নিকট বিদ্যমান রয়েছে।

যেমন, ১. ‘জাওহারাতুন্ নাইয়্যারাহ’ কিতাবের পুরাতন ছাপায় ‘কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করে উজরত গ্রহণ করাকে জায়িয বলা হয়েছে।’ নতুন সংস্করণ থেকে উক্ত অংশটুকু সম্পূর্ণ বাদ দেয়া হয়েছে।

২. ‘শরহে ফিক্বহুল আকবর’ পুরাতন ছাপায় উল্লেখ আছে, ما مات على الكفر..، অর্থাৎ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পিতা-মাতা কুফরীর উপর ইন্তিকাল করেননি।’ নতুন সংস্করণে উক্ত ইবরাত “ما” শব্দটি বাদ দিয়ে দেয়া হয়েছে।

৩. ‘ইলাউস্ সুনান’ কিতাবের পূর্ববর্তী সংস্করণের ‘মুকাদ্দিমায়’ থানবীর নামের পূর্বে ১৭টি লক্বব উল্লেখ রয়েছে।’ খারিজীরা যখন লক্ববের সমালোচনা করতে গিয়ে লিখলো যে, ‘এত লক্বব কেউ ব্যবহার করেনি’ জবাবে আমরা ‘ইলাউস্ সুনান’ থেকে দলীল পেশ করি তখন তারা লা-জাওয়াব হয়ে যায়। কিন্তু বর্তমান যে ‘ইলাউস্ সুনান’ ছাপা হয়েছে তা থেকে লক্ববগুলো বাদ দেয়া হয়েছে।

৪. ‘থানবীর পুরাতন ‘বেহেশতী জিওরে’ শায়খ, মুরশিদ বা উস্তাদকে ‘ক্বিবলা, কা’বা’ বলে সম্বোধন করার কথা উল্লেখ আছে।’ কিন্তু নতুন ছাপায় তা বাদ দেয়া হয়েছে।

৫. ‘মালাবুদ্দা মিনহু’ কিতাবের পুরাতন ছাপায় হালক্বী নফল বসে পড়াকে মুস্তাহাব বলা হয়েছে। নতুন কোন কোন সংস্করণে তা বাদ দেয়া হয়েছে।

৬. ‘শামসুল হক ফরীদপূরী ছাহেবের ‘তাছাউফ তত্ত্ব’ কিতাবে মীলাদ শরীফ ও ক্বিয়ামকে জায়িয বলা হয়েছে।’ বর্তমান এডিশনে তা বাদ দেয়া হয়েছে।

কাজেই, ওহাবী, খারিজী, লা-মাযহাবীদের কোন মতেই বিশ্বাস করা যায় না। এরা মূলত: ইহুদী-নাছারাদের এজেন্ট। তাই তাদের কাজগুলোও ইহুদী-নাছারাদের মত। ইহুদী-নাছারারাও তাওরাত ও ইঞ্জিলের যে সকল বিষয়গুলো তাদের মন মত ছিলনা সেগুলো পরিবর্তন, পরিবর্ধন, কাট-সাট করতো ও বাদ দিতো, এমনকি নিজ হাতে মন মত বিষয় লিখে দিয়ে আল্লাহ পাক-এর কথা বলে চালিয়ে দিতো।

যেমন, এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক তাঁর কালামে পাকে ‘সূরা বাক্বারা’-এর ৭৯নং আয়াত শরীফে ইরশাদ করেন,

ويل للذين يكتبون الكتب بايديهم ثم يقولون هذا من عند الله ليشتروا به ثمنا قليلا فويل لهم مما كتبت ايديهم وويل لهم مما يكسبون.

অর্থঃ- “যারা সামান্য অর্থের জন্য নিজ হাতে কিতাব লিখে এবং বলে এটা আল্লাহ পাক-এর পক্ষ থেকে এসেছে তাদের জন্য আফসুস্ জাহান্নাম। সুতরাং তারা যে কাজ করেছে এবং যা কামাই করেছে সেজন্য তাদের প্রতি আফসুস।”

কাজেই, ইহুদীদের এজেন্ট ওহাবী, খারিজী, লা-মাযহাবীরা ইহুদীদের পরামর্শেই মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করে নিজেদের দলে আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন কূটকৌশল খুঁঁজে খুঁজে বের করছে। তন্মধ্যে তাদের একটি অন্যতম কূটকৌশল হলো কিতাবের বক্তব্যে পরিবর্তন ঘটানো।

অতএব, মুলতানের তৈয়ব একাডেমী ও বোম্বের দারুস্ সালাফিয়া থেকে প্রকাশিত ‘মুছান্নাফে ইবনে আবী শায়বায়’ যে অনুরূপ কারসাজি করা হয়নি তারই বা কি প্রমাণ রয়েছে?

কাজেই, তাদের কথা তখনই গ্রহণযোগ্য হবে যখন তারা পুরতান ছাপার ‘মুছান্নাফে ইবনে আবী শায়বা’ থেকে প্রমাণ পেশ করতে পারবে।

কারণ পুরাতন ছাপায় আছে বলেই পূর্ববর্তী অনেকে এমনকি তাদের মুরুব্বীরাও নিজ নিজ কিতাবে رفع يديه ودعا. এ অংশটুকুসহই উক্ত হাদীছ শরীফখানা উল্লেখ করেছেন। যার প্রমাণ আগামী সংখ্যায় দেয়া হবে ইনশাআল্লাহ। (চলবে)

ক্বারী মুহম্মদ আব্দুল বারী, গোড়ান, ঢাকা।

মুহম্মদ সোহেলুর রহমান, রামপুরা, ঢাকা।

সুওয়ালঃ সম্প্রতি ‘আহলে হাদীছ লাইব্রেরী ঢাকা’-এর সৌজন্যে প্রকাশিত একটি হ্যান্ডবিলে ‘শবে বরাত’ সম্পর্কে বিভ্রান্তিমূলক কতিপয় উক্তি করা হয়েছে। কুরআন-সুন্নাহ্র নিরিখে সেসব কতটুকু সঠিক তা আপনাদের বহুল পঠিত, তাজদীদী মুখপত্র ‘মাসিক আল বাইয়্যিনাত’ পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশ করলে বিভ্রান্তির নিরসন হতো এবং সঠিক বিষয়টি উন্মোচিত হয়ে আওয়ামুন্ নাস খুবই উপকৃত হতো।

আপনাদের জ্ঞাতার্থে হ্যান্ডবিলের একটি মূল কপি প্রেরণ করা হলো। এতে আমাদের মনে যেসব প্রশ্নের উদয় হয়েছে তাহলো-

….. ১০. অর্ধ শা’বান উপলক্ষে আয়োজিত মাহ্ফিল বিদয়াত কি-না? ……

আশা করি উল্লিখিত প্রশ্নসমূহের দলীলভিত্তিক জাওয়াব দানে বাধিত করবেন।

জাওয়াবঃ  মহান আল্লাহ পাক স্বীয় কালাম পাকে ইরশাদ করেন,

فسئلوا اهل الذكر ان كنتم لاتعلمون.

অর্থঃ- “তোমরা আহলে যিকির তথা আল্লাহওয়ালাগণকে জিজ্ঞাসা কর, যদি তোমরা না জান।” (সূরা আম্বিয়া-৭)

যামানার তাজদীদী মুখপত্র মাসিক আল বাইয়্যিনাত উপরোক্ত আয়াত শরীফের হাক্বীক্বী মিছদাক। আল্লাহ পাক রব্বুল আলামীন-এর লক্ষ্যস্থল ওলী, যামানার মুজাদ্দিদ, মুজাদ্দিদে আ’যম, রাজারবাগ শরীফের হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলী-এর ওসীলায় এ পত্রিকাটি উম্মাহ্র জন্য শ্রেষ্ঠতম নিয়ামত যার প্রতিটি লিখাই আক্বীদা-আমল হিফাযতকারী ও পরিশুদ্ধকারী।

প্রসঙ্গতঃ সুওয়ালে উল্লিখিত প্রশ্নসমূহের ধারাবাহিক জাওয়াব পেশ করা হলো-

(ধারাবাহিক)

১০. অর্ধ শা’বান বা শবে বরাত উপলক্ষে আয়োজিত মাহফিল বিদয়াত কি-না?

          এর জবাব হলো- অর্ধ শা’বান উপলক্ষে আয়োজিত মাহফিল বিদয়াত নয় বরং সুন্নত।  কারণ অর্ধ শা’বান রাতের বারাকাত, ফুয়ুজাত, নিয়ামত, রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের কথা খোদ কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফে বর্ণনা করা হয়েছে এবং তা হাছিলের জন্য উক্ত মুবারক রাতটিতে সারা রাতে জেগে ইবাদতদ্ধবন্দিগী করা এবং দিনের বেলায় রোযা রাখার জন্য আদেশ-নির্দেশ করা হয়েছে।

হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,

عن على رضى الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم اذا كانت ليلة النصف من شعبان فقوموا ليلها وصوموا يومها فان الله تعالى ينزل فيها لغروب الشمس الى السماء الدنيا فيقول الا من مستغفر فاغفرله الا مسترزق فارزقه الا مبتلى فاعافيه الا كذا الا كذا حتى يطلع الفجر.

অর্থঃ- “হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহ পাক-এর রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যখন অর্ধ শা’বানের রাত্রি উপস্থিত হবে তখন তোমরা উক্ত রাত্রিতে নামায আদায় করবে এবং দিনে রোযা রাখবে। কেননা নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক উক্ত রাত্রিতে সূর্যাস্তের সময় পৃথিবীর আকাশে আসেন। অর্থাৎ রহমত খাছ নাযিল করেন। অতঃপর ঘোষণা করেন, “কোন ক্ষমা প্র্রার্থনাকারী আছ কি? আমি তাকে ক্ষমা করে দিব।” “কোন রিযিক প্রার্থনাকারী আছ কি? আমি তাকে রিযিক দান করব।” “কোন মুছিবতগ্রস্ত ব্যক্তি আছ কি? আমি তার মুছিবত দূর করে দিব।” এভাবে ফজর বা ছুবহে ছাদীক পর্যন্ত ঘোষণা করতে থাকেন।” (ইবনে মাজাহ্, মিশকাত)

অর্ধ শা’বান বা শবে বরাতের রাতটির কি মাহাত্ম্য, কি হক্ব তা বান্দা ও উম্মত জানবে কিভাবে? তা জানার জন্য আয়োজিত মাহফিল বা মজলিসই হচ্ছে শ্রেষ্ঠতর মাধ্যম।

হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,

العلم امام العمل.

অর্থঃ- “ইল্ম হচ্ছে আমলের ইমাম।” অর্থাৎ কোন আমল করতে হলে ইল্মের প্রয়োজন। ইল্ম না থাকলে আমল বা ইবাদত করা আদৌ সম্ভব নয়।

বান্দা যখন কোন ইবাদত বা আমল করতে যাবে, তখন প্রথমে তাকে সে ইবাদত বা আমলের ইল্ম অর্জন করে নিতে হবে। অন্যথায় তার পক্ষে সে ইবাদত বা আমল করা সম্ভব হবে না।

সে উপলক্ষে মাহফিল বা মজলিসের আয়োজন করা হয়। সুতরাং তা বিদ্য়াত হবে কেন? মূলতঃ এটা বিদয়াত বলার অর্থই হচ্ছে মুসলমানদেরকে ইল্ম ও আমল থেকে সরিয়ে দেয়া, আল্লাহ পাক জাল্লা শানুহু ও তাঁর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সন্তুষ্টি-রিযামন্দি থেকে মাহরূম করা। যা সুস্পষ্ট কুফরী।

কারণ ইল্ম অর্জন করার জন্য, আমল করার জন্য এবং আল্লাহ পাক ও তাঁর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সন্তুষ্টি-রেযামন্দি হাছিল করার জন্য আল্লাহ পাক তাঁর কালামে পাকে এবং আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাদীস শরীফে আদেশ নির্দেশ করেছেন।

যেমন ইল্মের ব্যাপারে কালামুল্লাহ শরীফে ইরশাদ হয়েছে, قل رب زدنى علما.

অর্থঃ “বলুন, হে আমার রব পরওয়ারদিগার আল্লাহ পাক, আমার ইলম বৃদ্ধি করে দিন।” (সূরা ত্বা-হা-১১৪)

এখানে ইল্ম বৃদ্ধির জন্য আল্লাহ পাক-এর নিকট বান্দাকে দোয়া করতে বলা হয়েছে।

হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,

طلب العلم فريضة على كل مسلم.

অর্থঃ- “ইল্ম অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য ফরয।” (ইবনে মাজাহ)

হাদীছ শরীফে আরো ইরশাদ হয়েছে,

من يرد الله به خيرا يفقهه فى الدين.

অর্থঃ- “আল্লাহ পাক যার কল্যাণ-ভালাই চান তিনি তাঁকে দ্বীনের ছহীহ ইল্ম-সমঝ দান করেন।” (বুখরী, মিশকাত)

হাদীছ শরীফে আরো ইরশাদ হয়েছে,

تعلموا العلم فان تعلمه قربة الى الله عز وجل.

অর্থঃ- “তোমরা ইল্ম শিক্ষা কর। নিশ্চয়ই ইল্ম শিক্ষার দ্বারা আল্লাহ পাক-এর নৈকট্য হাছিল হয়।” (রবী’)

হাদীছ শরীফে আরো ইরশাদ হয়েছে,

لكل شيئ طريق وطريق الجنة العلم.

অর্থঃ- “প্রতিটা জিনিস অর্জনের জন্য একটা রাস্তা রয়েছে। আর জান্নাত লাভের রাস্তা হচ্ছে ইল্ম।” (দায়লামী শরীফ)

হাদীছ শরীফে আরো ইরশাদ হয়েছে,

اذا مررتم برياض الجنة فارتعوا قالوا يا رسول الله وما رياض الجنة قال مجالس العلم.

অর্থঃ- “যখন তোমরা (যমীনের বুকে কোথাও) বেহেশ্তের বাগান দেখতে পাবে তখন তোমরা সেখানে প্রবেশ করে সেখান থেকে ফল খেয়ে নিবে। ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, বেহেশ্তের বাগান কোনটি? তিনি বললেন, ইল্মের মজলিস বা মাহফিল।” (তবারানী)

ইল্মী বা দ্বীনি মাহফিল বা মজলিসের ফযীলত সম্পর্কে হাদীছ শরীফে আরো ইরশাদ হয়েছে,

ما اجتمع قوم فى بيت من بيوت الله يتلون كتب الله ويتدارسونه بينهم الا نزلت عليهم السكينة وغشيتهم الرحمة وحفتهم الملئكة وذكرهم الله فيمن عنده.

অর্থঃ- “যখন কোন এলাকার লোক আল্লাহ পাক-এর ঘরে অথবা কোন স্থানে একত্রিত হয়ে আল্লাহ্ পাক-এর কিতাব তিলাওয়াত করে অথবা পরস্পর দ্বীনী আলোচনা বা দরস্-তাদরীস করে তখন আল্লাহ পাক-এর তরফ থেকে তাদের উপর সাকিনা বা শান্তি বর্ষিত হয়। আল্লাহ পাক-এর রহমত তাদের উপর ছেয়ে যায় বা তাদেরকে আবৃত করে নেয়। আল্লাহ পাক-এর রহ্মতের ফেরেশ্তারা তাদেরকে বেষ্টন করে নেন এবং স্বয়ং আল্লাহ্ পাক রব্বুল আলামীন তাঁর নিকটবর্তী ফেরেশ্তাদের সাথে সেই মাহ্ফিলের লোকদের ছানা-ছিফত ও তাদের সম্পর্কে আলোচনা করেন।”  (মিশকাত)

হাদীছ শরীফে আরো ইরশাদ হয়েছে, “মাহ্ফিল যখন শেষ হয়ে যায়, তখন সকল মানুষ চলে যায়, ফেরেশ্তারাও চলে যান আল্লাহ্ পাক-এর দরবারে। আল্লাহ্ পাক-এর জানা থাকা সত্ত্বেও ফেরেশ্তাদেরকে জিজ্ঞাসা করেন,“হে ফেরেশ্তারা! তোমরা কোথা হতে আসলে?” ফেরেশ্তারা বলেন, “আল্লাহ্ পাক! অমুক মাহ্ফিল হতে।” তখন আল্লাহ্ পাক জিজ্ঞাসা করেন, “তারা কি চেয়েছে এবং কি থেকে পানাহ্ চেয়েছে?” ফেরেশ্তারা বলেন, “আল্লাহ্ পাক! তারা আপনার সন্তুষ্টি চেয়েছে। জান্নাত চেয়েছে এবং জাহান্নাম থেকে পানাহ চেয়েছে।” আল্লাহ্ পাক পুনরায় জিজ্ঞাসা করেন, “হে ফেরেশ্তারা! তারা কি আমাকে দেখেছে?” ফেরেশ্তারা বলেন, “না, তারা দেখেনি।” আল্লাহ্ পাক বলেন, “তারা কি জান্নাত-জাহান্নাম দেখেছে?” ফেরেশ্তারা বলেন, “না, তারা দেখেনি। যদি আপনাকে দেখতো তাহলে আপনার রেযামন্দি বা সন্তুষ্টির জন্য আরো বেশী বেশী কোশেশ করতো। আর জান্নাত ও জাহান্নাম দেখলে, জান্নাত বেশী বেশী তলব করতো এবং জাহান্নাম থেকে বেশী বেশী পানাহ্ তলব করতো।” ইত্যাদি অনেক কথোপকথনের পর আল্লাহ্ পাক বলেন,

فاشهدكم انى قدغفرت لهم.

“(হে ফেরেশ্তারা)! তোমরা সাক্ষী থাক, আমি এই মাহ্ফিলে যারা এসেছে, তাদের প্রত্যেককে ক্ষমা করে দিলাম।” (সুবহানাল্লাহ্)

قال ملك من الملائكة فيهم فلان ليس منهم انما جاء لحاجة.

“তখন একজন ফেরেশ্তা বলেন, “আল্লাহ্ পাক! এ মাহ্ফিলে এমন একজন লোক ছিল, যে মূলতঃ ওয়াজণ্ডছীহত শুনার উদ্দেশ্যে আসেনি। সে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল তার কাজে। তখন দেখলো যে, এখানে মাহ্ফিল হচ্ছে, সে দেখার জন্য এখানে বসেছিল প্রকৃতপক্ষে লোকটা খুব বদ্কার, গুনাহ্গার। আপনি কি তাকেও ক্ষমা করে দিয়েছেন?” قال هم الجلساء لايشقى جليسهم.

“তখন আল্লাহ্ পাক বলেন, এই মাহ্ফিলে যে সমস্ত নেককার লোক এসেছিল, আমি সেই নেক্কারদের উছীলায় ঐ বদ্কারের গুনাহ্-খতাও ক্ষমা করে দিয়েছি।” (সুবহানাল্লাহ্)

প্রকৃতপক্ষে দ্বীনি মাহ্ফিল হচ্ছে সাকীনা হাছিলের মাহ্ফিল। রহ্মত, বরকত হাছিলের মাহ্ফিল। সর্বোপরি ওয়াজ মাহ্ফিল হচ্ছে নিজের গুনাহ্-খতা মাফ করার মাহ্ফিল।

আমলের ব্যাপারে কালামুল্লাহ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,

واعبد ربك حتى يأتيك اليقين.

অর্থঃ- “আপনার রবের ইবাদত করুন ইন্তিকাল পর্যন্ত।” (সূরা হির্জ-৯৯)

আরো ইরশাদ হয়েছে,

ان الذين امنوا وعملوا الصلحت كانت لهم جنت الفردوس نزلا.

অর্থঃ- “নিশ্চয়ই যারা ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে তাঁদের জন্য জান্নাতুল ফিরদাউসে মেহমানদারীর ব্যবস্থা রয়েছে।” (সূরা কাহফ্-১০৭)

হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,

ان الله تعالى اذا اراد بعبد خيرا استعمله فقيل وكيف يستعمله قال يوفقه لعمل صالح قبل الموت.

অর্থঃ- “নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা যখন কোন বান্দার কল্যাণ-ভালাই কামনা করেন তখন তাকে আমল করার ব্যাপারে সাহায্য করেন। বলা হলো, কিভাবে আমলে সাহায্য করা হয়। আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তাকে ইন্তিকালের পূর্বেই নেক আমল করার তাওফীক দান করা হয়।” (মাছাবীহুস্ সুন্নাহ)

হাদীছ শরীফে আরো ইরশাদ হয়েছে-

طوبى لمن عمل بعلم.

অর্থঃ- “সুসংবাদ ঐ ব্যক্তির জন্য যে ইল্ম অনুযায়ী আমল করে থাকে।” (শিহাব)

হাদীছ শরীফে আরো ইরশাদ হয়েছে,

قال رجل يا رسول الله اى الناس خير قال من طال عمره وحسن عمله.

অর্থঃ- “এক ব্যক্তি বললেন, হে আল্লাহ পাক-এর রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, কোন ব্যক্তি উত্তম? তিনি বললেন, যিনি দীর্ঘ হায়াত পেয়েছেন এবং নেক আমল করেছেন।” (তবারানী, আবূ নঈম)

হাদীছ শরীফে আরো ইরশাদ হয়েছে,

اكلفوا من الاعمال ما تطيقون فان الله لا يمل حتى تملوا.

অর্থঃ- “তোমরা যথাসাধ্য আমলের মধ্যে নিয়োজিত থাক বা লেগে থাক। কেননা তোমরা ক্লান্ত বা বিরাগ হলেও আল্লাহ পাক তা হন না।” (বুখারী শরীফ)

আল্লাহ পাক ও তাঁর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সন্তুষ্টি-রিযামন্দি অর্জনই হচ্ছে বান্দা ও উম্মতের আসল মাকছুদ।

আল্লাহ পাক তাঁর কালাম পাকে ইরশাদ করেন,

والله ورسوله احق ان يرضوه ان كانوا مؤمنين.

অর্থঃ- “তারা যদি মু’মিন হয়ে থাকে তাহলে তাদের দায়িত্ব-কর্তব্য হলো তারা যেন আল্লাহ পাক ও তাঁর রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সন্তুষ্ট করে। কারণ আল্লাহ পাক ও তাঁর রসূলই সন্তুষ্টি পাওয়ার সমধিক হক্বদার।” (সূরা তওবা-৬২)

স্মরণীয় যে, ইল্ম অর্জন করতে হয় আমল করার জন্য। আর আমল করতে হয় ইখলাছ তথা আল্লাহ পাক ও তাঁর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সন্তুষ্টি-রিযামন্দি হাছিলের জন্য। এক কথায় ইল্ম আমল ও ইখলাছ এ সবের সমষ্টিই হচ্ছে দ্বীন বা শরীয়ত। যা জানার বা বুঝার মাধ্যম হচ্ছে দ্বীনি মাহফিল বা মজলিস। সুতরাং এ মাহফিল বা মজলিসকে বিদ্য়াত বলে অভিহিত করা সম্পূর্ণ কুফরী। আর এটি মূলত: ইবলিস শয়তানের কাজ যে, মানুষকে কিভাবে ইল্ম থেকে, আমল থেকে দূরে সরানো যায়।

অতএব, বলার অপেক্ষ রাখেনা, যারা অর্ধ শা’বান তথা শবে বরাত উপলক্ষে মানুষকে ইবাদত-বন্দিগী থেকে সরানোর কূটকৌশলে নিয়োজিত, তারা নিঃসন্দেহে কুরআন শরীফে বর্ণিত شياطين الانس والجن

অর্থাৎ “মানুষ শয়তান ও জিন শয়তানের অন্তর্ভুক্ত।” (সূরা আনয়াম-১১২) এরাই হচ্ছে প্রকৃত ইবলিসের চেলা। এদের কার্যক্রম সম্পর্কে হাদীছ শরীফে একটা ওয়াক্বিয়া বর্ণিত হয়েছে যে, ইবলিসের মজলিস বসে পানির উপর। সে মজলিসে ইবলিস তার চেলাদের নিকট থেকে দৈনন্দিন কাজের হিসাব-নিকাশ গ্রহণ করে। একবার সে হিসাব নিচ্ছিল চেলাদের মধ্য থেকে কে কি কাজ করেছে? জবাবে এক চেলা বলে, আমি ওমুক স্থানে খুন খারাবি করিয়েছি। আরেক চেলা বলে, আমি ওমুক খানে মারা-মারি করিয়েছি। আরেক চেলা বলে, আমি ওমুক স্থানে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ঝগড়া বাধিয়ে দিয়ে তালাকের ব্যবস্থা পর্যন্ত করিয়েছি। এমনিভাবে একেক চেলা একেক অপকর্ম বা নাফরমানীর বিবরণ দিতে থাকে। পিছনে বসা এক চেলা সে নিশ্চুপ অবস্থায় বসে রয়েছে তা দেখে ইবলিস তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে, ওহে, তুমি কি কিছুই করনি? সে উত্তর করে, আমি সামান্য একটু করেছি। তা আপনার মন:পুত হয় কি-না, জানিনা। ইবলিস বলে, কি করেছিস? চেলা বলে, আমি মাদ্রাসার এক ছাত্রকে এমনভাবে ওয়াসওয়াসা দিয়েছি, সে আর কোনদিন মাদ্রাসায় যাবে না। এটা শোনার সাথে সাথে ইবলিস তার আসন থেকে উঠে সেই চেলাকে কোলে তুলে নিয়ে খুশিতে নাচতে থাকে এবং বলে, তুই সবচেয়ে বড় কাজ করেছিস। কারণ সেই মাদ্রাসার ছাত্র যদি মাদ্রাসায় গিয়ে ইল্ম অর্জন করতো তাহলে সে আলিম হয়ে আমার কাজের বিরূদ্ধে মানুষকে বুঝাতো, আমার শত্রু করে তুলতো। কাজেই ইল্মের মজলিস, মাহফিল থেকে ফেরানোই হচ্ছে ইবলিসের সবচেয়ে বড় কাজ।

বুঝা গেল, শবে বরাত উপলক্ষে আয়োজিত ইল্মী মাহফিলকে বিদয়াত সাব্যস্ত করা ইবলিস ও তার চেলাদের কাজ। ইবলিস ও তার চেলাদের অনুসরণ থেকে আল্লাহ পাক সকলকে হিফাযত করুন। (আমীন) (চলবে)

খন্দকার সেলিম আহমদ

পাহাড় কাঞ্চনপুর, টাঙ্গাইল।

সুওয়ালঃ  হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে প্রকাশিত অখ্যাত মাসিক পত্রিকা ফেব্রুয়ারী-২০০৫ ঈসায়ী সংখ্যায় জিজ্ঞাসা-সমাধান বিভাগে, মাসিক আল বাইয়্যিনাত-অক্টোবর ২০০৩ ঈসায়ী সংখ্যায় প্রদত্ত মীলাদ-ক্বিয়ামের সমালোচনা করতে গিয়ে এবং একই বিষয়ে এপ্রিল-২০০৫ ঈসায়ী ও মে-২০০৫ ঈসায়ী সংখ্যায় এছাড়াও মাসিক মদীনা পত্রিকা ফেব্রুয়ারী-২০০৫ ঈসায়ী সংখ্যায় প্রশ্নোত্তর বিভাগে একই ধরনের জবাব দেয়া হয়েছে।

তাদের বক্তব্যগুলোর মধ্যে যে বিষয়গুলো আমার নিকট সন্দেহজনক তা নিম্নে উল্লেখ করা হলো-

১. “প্রচলিত মীলাদ-ক্বিয়াম উভয়টি নাজায়েয। কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ,  ইজমা, কিয়াসে এর কোন প্রমাণ নেই। বরং বূযুর্গদের আমল দ্বারা প্রমাণিত। তাই যদি কেউ মহাবুযুর্গ হন, কুরআন সুন্নাহর মুকাবিলায় তার আমল দলীল হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। …….”

উল্লিখিত বক্তব্যের স্বপক্ষে দলীল হিসেবে তারা তাদের নিজেদের লিখিত কিছু কিতাবের নাম উল্লেখ করেছে যা মুতাবার বা নির্ভরযোগ্য নয়; অনুসরনীয় ইমাম মুজতাহিদগণের কিতাব থেকে কোন কিতাবের নাম দলীল হিসেবে উল্লেখ করেনি বা করতে পারেনি।

এখন আমার সুওয়াল হলো, প্রচলিত মীলাদ-ক্বিয়াম সম্পর্কিত তাদের উল্লিখিত বক্তব্য কতটুকু দলীল সম্মত? কুরআন, সুন্নাহ্, ইজমা ও ক্বিয়াসের দৃষ্টিতে দলীলভিত্তিক জাওয়াব দিয়ে আমাদের আক্বীদা, আমল হিফাযতে সহায়তা করবেন বলে আমরা আশাবাদী।

জাওয়াবঃ   প্রচলিত মীলাদ-ক্বিয়াম সম্পর্কে হাটহাজারী মাদ্রাসার অখ্যাত মাসিক পত্রিকার জিজ্ঞাসার সমাধানে এবং মাসিক মদীনার প্রশ্নোত্তর বিভাগে যা বলা  হয়েছে তা শুদ্ধ হয়নি বরং সম্পূর্ণই ভুল, মনগড়া ও দলীলবিহীন এবং কুরআন-সুন্নাহ, ইজমা ও ক্বিয়াসের সম্পূর্ণ খিলাফ হয়েছে।

আমাদের “গবেষণা কেন্দ্র মুহম্মদিয়া জামিয়া শরীফ-এর পক্ষ থেকে মীলাদ-ক্বিয়াম বিরোধীদের প্রতি চ্যালেঞ্জ দেয়া হয় যে, “কেউ যদি কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস দ্বারা মীলাদ-ক্বিয়াম নাজায়িয প্রমাণ করতে পারে, তাহলে তাকে দুই হাজার পাউন্ড পুরস্কার দেয়া হবে।” কিন্তু এখন পর্যন্ত মীলাদ-ক্বিয়াম বিরোধীরা সে চ্যালেঞ্জ গ্রহণের হিম্মত দেখাতে সমর্থ হয়নি, হবেও না ইনশাআল্লাহ্।

(ধারাবাহিক)

মীলাদ শরীফ ও ক্বিয়াম অবশ্যই

জায়িয ও কুরআন-সুন্নাহসম্মত

প্রচলিত মীলাদ-ক্বিয়াম যে নাজায়িয নয়। বরং প্রচলিত মীলাদ-ক্বিয়াম উভয়টি অবশ্যই একটি শরীয়তসম্মত ইবাদত। যা  কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ,  ইজমা,  ক্বিয়াস দ্বারাও প্রমাণিত।

নিম্নে এ সম্পর্কিত বিস্তারিত দলীল-আদিল্লাহ পেশ করা হলো-

স্মর্তব্য যে, মীলাদ শরীফে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন, নুরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ছানা-ছিফত, তা’রীফ, প্রশংসা, তাঁর মু’জিযা বর্ণনা, বিলাদত শরীফের আলোচনা, কুরআন শরীফ তিলাওয়াত, না’ত, শে’র, কাছিদা পাঠ ও তাঁর প্রতি ছলাত ও সালাম প্রেরণ করা হয়।

অর্থাৎ মীলাদ শরীফে যা কিছু করা হয় তার প্রত্যেকটাই কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াসসম্মত। যেমন- মীলাদ শরীফের প্রথমেই কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করা হয়।

এরপর মহান আল্লাহ্ পাক-এর নির্দেশ صلوا عليه (তোমরা হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপর দুরূদ শরীফ পাঠ কর) এ আয়াত শরীফের নির্দেশ পালনার্থে এবং হাদীছ শরীফে দুরূদ শরীফের প্রতি গুরুত্ব অনুধাবন করে মীলাদ শরীফে দুরূদ শরীফ পাঠ করা হয়।

অতঃপর “মীলাদ শরীফে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর শানে শরীয়ত সম্মত সুন্দর সুন্দর কাছীদা পাঠ করা হয়।  কারণ অসংখ্য হাদীছ শরীফ দ্বারাই প্রমাণিত যে, স্বয়ং হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর শানে কাছীদা পাঠ করতেন। যেমন, বিশিষ্ট ছাহাবী ও বিখ্যাত কবি, হযরত হাস্সান বিন ছাবিত রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে তাঁর স্বরচিত কাছীদা পাঠ করে শুনানোর জন্য স্বয়ং হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজ মিম্বর মুবারকের পাশে তাঁর জন্যে আরেকটি মিম্বর স্থাপন করে দিয়েছিলেন, যার উপর দাঁড়িয়ে হযরত হাস্সান বিন ছাবিত রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু কাছীদাসমূহ পাঠ করতেন।” (বুখারী শরীফ, মিশকাত শরীফ)

তারপর আল্লাহ পাক-এর নির্দেশ পালনার্থে ও বরকত লাভের উদ্দেশ্যে আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর “তাওয়াল্লুদ শরীফ” অর্থাৎ পবিত্র বিলাদত শরীফের বর্ণনা আরবী ভাষায় সংক্ষিপ্ত আকারে আলোচনা করা হয়। যেমন, কুরআন শরীফে ইরশাদ হয়েছে,

واذكروا نعمت الله عليكم.

অর্থঃ- “তোমাদেরকে আল্লাহ্ পাক-এর যে নিয়ামত দেয়া হয়েছে, তার আলোচনা কর।”(সূরা আলে ইমরান-১০৩) অর্থাৎ সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামই হচ্ছেন সে উল্লিখিত নিয়ামত। কাজেই তাঁরই আলোচনা কর।

মূলতঃ সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর তাওয়াল্লুদ শরীফ বা মুবারক বিলাদত শরীফ  আলোচনা করা  কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফেরই নির্দেশ আর তা শরীয়ত সম্মত তো অবশ্যই, সাথে সাথে অফুরন্ত রহ্মত, বরকত ও সন্তুষ্টি লাভের কারণ ও খাছ সুন্নতে ছাহাবাও বটে।

যেমন, এ প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফে উল্লেখ আছে,

عن ابى درداء رضى الله تعالى عنه انه مرمع النبى صلى الله عليه وسلم الى بيت عامر الانصارى وكان يعلم وقائع ولادته صلى الله عليه وسلم لابنائه وعشيرته ويقول هذا اليوم هذا اليوم فقال عليه الصلوة والسلام ان الله فتح لك ابواب الرحمة والملائكة كلهم يستغفرون لك من فعل فعلك نجى نجتك.

অর্থঃ “হযরত আবু দারদা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত আছে যে, একদা তিনি রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম-এর সাথে হযরত আবু আমের আনছারী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর গৃহে উপস্থিত হয়ে দেখতে পেলেন যে, তিনি তাঁর সন্তানাদি এবং আত্মীয় স্বজন, জ্ঞাতী-গোষ্ঠী, পাড়া-প্রতিবেশীদেরকে রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম-এর বিলাদত শরীফের ঘটনাসমূহ শুনাচ্ছেন এবং বলছেন, এই দিবস এই দিবস (অর্থাৎ এই দিবসে রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম যমীনে তাশরীফ এনেছেন)।

এতদ্বশ্রবণে রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু ওয়া সালাম বললেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা তাঁর রহমতের দরজা তোমার জন্য উন্মুক্ত করেছেন এবং সমস্ত ফেরেশতাগণ তোমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছেন এবং যে কেউ তোমার মত এরূপ কাজ করবে, তোমার মত সেও নাযাত (ফযীলত) লাভ করবে।”

(কিতাবুত তানবীর ফী মাওলিদিল বাশীর ওয়ান্ নাযীর, ছুবুলুল হুদা ফী মাওলিদে মুস্তফা ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, হাক্বীক্বতে মুহম্মদী ও মীলাদে আহ্মদী পৃষ্ঠা ৩৫৫)

এ সম্পর্কে হাদীছ শরীফে আরো ইরশাদ হয়েছে,

عن ابن عباس رضى الله تعالى عنهما انه كان يحدث ذات يوم فى بيته وقائع ولادته صلى الله عليه وسلم لقوم فيستبشرون ويحمدون الله ويصلون عليه صلى الله عليه وسلم فاذا جاء النبى صلى الله عليه وسلم قال حلت لكم شفاعتى.

অর্থঃ- “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি একদা তাঁর নিজগৃহে সমবেত ছাহাবীগণকে আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বিলাদত শরীফ-এর ঘটনাসমূহ শুনাচ্ছিলেন। এতে শ্রবণকারীগণ আনন্দ ও খুশী প্রকাশ করছিলেন এবং আল্লাহ পাক-এর প্রশংসা তথা তাছবীহ্-তাহ্লীল পাঠক করছিলেন এবং আল্লাহ্ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপর (ছলাত-সালাম) দুরূদ শরীফ পাঠ করছিলেন। এমন সময় রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম তথায় উপস্থিত হলেন এবং (মীলাদ শরীফ পাঠের অনুষ্ঠান দেখে)  তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, حلت لكم شفاعتى. অর্থাৎ তোমাদের জন্য আমার শাফায়াত ওয়াজিব।” (কিতাবুত তানবীর ফী মাওলিদিল বাশীর ওয়ান্ নাযীর, ছুবুলুল হুদা ফী মাওলিদে মুস্তফা ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম,হাক্বীক্বতে মুহম্মদী ও মীলাদে আহ্মদী পৃষ্ঠা ৩৫৫ )

উপরোক্ত বিস্তারিত ও দলীলভিত্তিক আলোচনা দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, মীলাদ শরীফের উল্লিখিত প্রতিটি আমল কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস অর্থাৎ শরীয়তসম্মত।

কাজেই কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফে মীলাদ শরীফের প্রমাণ নেই একথা বলা জিহালত বৈ কিছুই নয়। (চলবে)

মুসাম্মত সানজিদা আক্তার

সভানেত্রী- ছাত্রী আঞ্জুমানে আল বাইয়্যিনাত

মুহম্মদপুর, ঢাকা।

সুওয়ালঃ অখ্যাত মাসিক রাহমানী পয়গাম এপ্রিল/২০০৩ ঈসায়ী সংখ্যায় জিজ্ঞাসার-জবাব বিভাগে নিম্নোক্ত ১২৪৭নং জিজ্ঞাসার-জবাব ছাপা হয়-

জিজ্ঞাসা ঃ সাহাবী আবু সাঈদ খুদরী ও আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা বলেন যে, রাসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন আমার মৃত্যুর পর পূর্ব দেশগুলির মধ্য হতে কোন একটি দেশ থেকে আমার উম্মতের ভিতর হতে একটি দল বের হবে। এই দলের সদস্যগণ হবে অশিক্ষিত ও মূর্খ। এদের মধ্যে কোন শিক্ষিত লোক গেলে সেও হয়ে যাবে মূর্খের মত। তাদের বক্তৃতা হবে বহু বহু গুণের ফজিলতের। তাদের মত বক্তৃতা বা বয়ান কারো হবে না।  ….

…….. তারা কুরআনের উপর আমল কিম্বা কুরআন প্রতিষ্ঠার একটু চেষ্টাও করবে না কখনো।  …….

উক্ত অখ্যাত পত্রিকার উল্লিখিত “জিজ্ঞাসা-জবাবের” প্রেক্ষিতে আমার সুওয়াল বা জানার বিষয় হলো-

….. “(৩) প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগীদের মধ্যে শরীয়ত বিরোধী বা ইসলাম পরিপন্থী কোন নিয়মনীতি বা আক্বীদা, আমল নেই, এটা কতটুকু সত্য?” ….

কুরআন, সুন্নাহ্, ইজমা ও ক্বিয়াসের দৃষ্টিতে উল্লিখিত সুওয়ালগুলোর দলীলভিত্তিক জাওয়াব দিয়ে আমাদের আক্বীদা, আমল হিফাযতে সহায়তা করবেন বলে আমরা আশাবাদী।

জাওয়াবঃ  প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগ জামায়াত সম্পর্কে উক্ত অখ্যাত পত্রিকার জবাব শুদ্ধ হয়নি। বরং ভুল, মনগড়া ও দলীলবিহীন হয়েছে।

তারা তাদের জবাবে প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগীদের সাফাই গাইতে গিয়ে বর্ণিত হাদীছ শরীফের অপব্যাখ্যা করেছে। সাথে সাথে “ছয় উছূলীদের মধ্যে কুরআন-সুন্নাহ্ বিরোধী কোন আক্বীদা-আমল নেই” বলে তাদের নির্লজ্জ দালালী করে নিজেদেরকে অপব্যাখ্যাকারী ও মিথ্যাবাদীরূপে সাব্যস্ত করেছে। সুওয়ালে উল্লিখিত বিষয়গুলোর ধারাবাহিক দলীলভিত্তিক আলোচনা করলেই তা আরো সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হবে।

তাই নিম্নে সুওয়ালে বর্ণিত বিষয়গুলোর দলীলভিত্তিক জাওয়াব দেয়া হলো-

(ধারাবাহিক)

প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগ সম্পর্কে অখ্যাত পত্রিকার ‘জিজ্ঞাসার জবাবের’ প্রেক্ষিতে আপনার তৃতীয় সুওয়াল হলো- “(৩) প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগীদের মধ্যে শরীয়ত বিরোধী বা ইসলাম পরিপন্থী কোন নিয়মনীতি বা আক্বীদা-আমল নেই, এটা কতটুকু সত্য?”

আপনার উক্ত সুওয়ালের প্রেক্ষিতে বলতে হয় যে, অখ্যাত পত্রিকার উক্ত বক্তব্য মোটেও সত্য নয়, কেননা প্রচলিত ছয় উছূলীদের মধ্যে একটি দু’টি নয়, বরং অসংখ্য কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী নিয়মনীতি বা আক্বীদা-আমল ও বক্তব্য রয়েছে, যা তাদের মুরুব্বীদের লিখা কিতাবাদিতেই বিদ্যমান রয়েছে। তাই নিম্নে ধারাবাহিকভাবে, পর্যায়ক্রমে প্রচলিত ছয় উছূলীদের কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী ও কুফরীমূলক বক্তব্যগুলোর সাথে সাথে কুরআন-সুন্নাহ্র দৃষ্টিতে তার সঠিক ফায়সালা তুলে ধরা হলো।

প্রচলিত ছয় উছূলীদের কুরআন-সুন্নাহ

বিরোধী কুফরীমূলক বক্তব্য- ১৪

প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকদের অনেকের আক্বীদা হলো যে, “মাগরিব ও বিত্রের উমরী ক্বাজা, ক্বাজায়ে আদা’র ন্যায় আদায় করতে হবে।” (মাসিক আত্ তুরাগ পত্রিকা, সম্পাদক- হামীদ রশীদ, ১১তম খ- ১৫ পৃষ্ঠায়)

উমরী ক্বাযা সম্পর্কে প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের মুখপত্র ‘আত্ তুরাগ’ পত্রিকার উক্ত বক্তব্য সম্পূর্ণ ভুল ও অশুদ্ধ। কারণ তা সর্বজন স্বীকৃত ও নির্ভরযোগ্য ফিক্বাহ্ ও ফতওয়ার কিতাবের বর্ণনার সম্পূর্ণ বিপরীত।

উমরী ক্বাযা সম্পর্কে ফিক্বাহ্ ও ফতওয়ার কিতাবের সঠিক ও বিশুদ্ধ মত হলোঃ-    ক্বাযা নামায দু’প্রকার- (১) ক্বাযায়ে আদা ও (২) ক্বাযায়ে উমরী।

ক্বাযায়ে আদা আবার দুপ্রকার-

প্রথমতঃ যে সমস্ত ক্বাযা নামাযের ক্ষেত্রে তরতীব রক্ষা করতে হয়। আর এর হুকুম হলো নামায যদি পাঁচ ওয়াক্ত বা তার চেয়ে কম ক্বাযা হয়, তাহলে তরতীব অনুযায়ী ক্বাযা আদায় করে তারপর ওয়াক্তিয়া নামায পড়তে হবে। যেমন কারো যদি ফজর, যোহর, আছর, মাগরিব, ইশার নামায ক্বাযা হয়, তাহলে পরবর্তী ফজরের নামায পড়ার পূর্বে উক্ত পাঁচ ওয়াক্ত নামায পর্যায়ক্রমে ক্বাযা আদায় করে তারপর ফজর নামায পড়তে হবে, অন্যথায় ফজর নামায আদায় হবেনা। আর যদি ফজর থেকে ফজর পর্যন্ত ৬(ছয়) ওয়াক্ত বা তদুর্ধ নামায ক্বাযা হয়, তাহলে পরবর্তী যোহর পড়ার সময় ক্বাযা নামাযের তরতীব রক্ষা না করলেও চলবে। বরং ক্বাযা নামায সুযোগ সুবিধা অনুযায়ী হারাম ওয়াক্ত বাদে যেকোন সময় আদায় করলেই নামায শুদ্ধ হয়ে যাবে।

তবে তরতীবওয়ালা ক্বাযা আদায় করতে গেলে যদি ওয়াক্তিয়া নামাযের সময় কম থাকার কারণে ওয়াক্তিয়া নামায ফউত হওয়ার আশঙ্কা হয়, তাহলে তরতীব রক্ষা না করে বরং ওয়াক্তিয়া নামায পড়ে নিতে হবে। যেমন কারো মাগরিব ও ইশার নামায ক্বাযা হয়ে গিয়েছে এবং ফজরের ওয়াক্তে এমন সময় ঘুম থেকে উঠেছে, সুর্য উদয় হতে ৫/৭ মিনিট বাকী, এখন ওযু করে যদি ক্বাযা নামায আদায় করতে যায়, তাহলে আর ফজরের ফরজ নামায পড়া যায়না, এমতাবস্থায় তরতীব রক্ষা করার প্রয়োজন নেই। বরং ফজরের নামায পড়ে নিতে হবে।

এখানে উল্লেখ্য যে, তরতীব তিন কারণে ভঙ্গ হয়- (১) পাঁচ ওয়াক্তের বেশী ক্বাযা থাকলে, (২) নামাযের ওয়াক্ত কম থাকলে, (৩) তরতীবের কথা ভুলে গেলে।

উল্লেখ্য, উমরী ক্বাযা বলে এমন ক্বাযা নামাযকে, যে নামায ক্বাযা থাকা সম্বন্ধে নামাযী ব্যক্তি সন্দেহে রয়েছে, অর্থাৎ তার ক্বাযা নামায বাকী আছে কিনা? এ সন্দেহের কারণে যে ক্বাযা নামায পড়া হয়, তাকে উমরী ক্বাযা বলে।

উমরী ক্বাযা ক্ষেত্রে মাগরিব ও বিত্র নামায তিন রাকায়াতের স্থলে চার রাকায়াত পড়তে হয়। যেমন- মাগরিব এবং বিত্র নামায নিয়ম মুতাবিক যথারীতি শেষ করে সালাম ফিরানোর পূর্বে দাঁড়িয়ে আর এক রাকায়াত (চতুর্থ রাকায়াত) নামায সুরা মিলিয়ে পড়তে হবে। অতঃপর রুকু, সিজ্দা করে তাশাহুদ, দুরূদ শরীফ ও দোয়া মাছুরা পড়ে সালাম ফিরিয়ে নামায শেষ করতে হবে। (আলমগীরী, দুররুল মুখতার, বাহ্রুর রায়িক, হিদায়া, ফতহুল ক্বাদীর ইত্যাদি)

এ প্রসঙ্গে ফিক্বার্হ বিখ্যাত কিতাবসমূহে উল্লেখ আছে,

رجل يقض الفوائت فانه يقض الوتر وان لم استيقن انه هل بقى عليه وترا ولم يبق فانه يصلى ثلاث ركعات ويقنت ثم يقعد قدر التشهد ثم يصلى ركعة اخرى فان كان وترا فقد اداه وان لم يكن فقد صلى التطوع اربعا ولا يضره القنوت فى التطوع.

অর্থঃ- “কোন ব্যক্তি যদি ফউত (অনাদায়ী নামাযের ক্বাযা আদায় করতে চায়, তবে তাকে বিত্র নামাযেরও ক্বাযা আদায় করতে হবে। আর যদি সে বিত্র নামায ফউত হওয়া বা না হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত না হয়, তাহলে সে তিন রাকায়াত নামায আদায় করবে এবং দোয়ায়ে কুনুতও পড়ে নিবে। অতঃপর তাশাহ্হুদ পরিমাণ বসার পর অতিরিক্ত এক রাকায়াত পড়বে। এক্ষেত্রে যদি বিত্র থাকে, তবে তা আদায় হয়ে যাবে। আর যদি বিত্র না থাকে, তবে চার রাকায়াতই নফল হিসেবে গণ্য হবে। নফল নামাযের ক্ষেত্রে দোয়ায়ে কুনুত কোন প্রকার ক্ষতি করবেনা।” (ফতওয়ায়ে আলমগীরী ১ম খ- ১২৫ পৃষ্ঠা) অনুরূপ মাগরিব নামাযের উমরী ক্বাযা সম্পর্কে ‘দুররুল মুখতার’ কিতাবে বর্ণিত আছে।

অতএব, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত সমর্থিত “আত্ তুরাগ” পত্রিকায় প্রকাশিত উমরী ক্বাযা সম্পর্কিত তাদের উক্ত ফতওয়া সম্পূর্ণ শরীয়ত বিরোধী। যা আমল করা থেকে বিরত থাকা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরয-ওয়াজিব। কারণ তা আমল করলে নামায শুদ্ধ হবেনা।

অপরদিকে প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকদেরও উচিত অনুরূপ ফতওয়া প্রদান করা হতে বিরত থাকা। কারণ, হাদীছ শরীফে বর্ণিত রয়েছে,

عن ابى هريرة رضى الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم من افتى بغير علم كان اثمه على من افتاه.

অর্থঃ- হযরত আবু হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “যে ব্যক্তিকে ইল্ম ব্যতীত ফতওয়া দেয়া হয়েছে, অতঃপর সে তদানুযায়ী আমল করেছে, তার গুনাহ্ যে তাকে ফতওয়া দিয়েছে তার উপরই পড়বে।” (আবু দাউদ, মিশকাত, বজলুল মাজহুদ, মিরকাত, শরহুত্ ত্বীবী, মুযাহিরে হক্ব, লুময়াত, তা’লীকুছ ছবীহ্)

তাই বিনা তাহ্ক্বীক্ব ও বিনা দলীল-আদিল্লায় কারো কোন ফতওয়া মুতাবিক আমল করা সম্পূর্ণরূপে শরীয়তের খিলাফ। (চলবে)

মুহম্মদ সুলতান মাহমুদ, মিরপুর, ঢাকা।

মুহম্মদ আহমদুল্লাহ কামালী, নরসিংদী।

সুওয়ালঃ মাসিক মদীনা ফেব্রুয়ারী-২০০৫ ঈসায়ী সংখ্যায় প্রশ্নোত্তর বিভাগে নিম্নোক্ত প্রশ্নোত্তর ছাপা হয়-

প্রশ্নঃ চুল…রাখার সুন্নত কি?……

উত্তরঃ…চুল রাখার দুই তরীকা, এক বাবরি রাখা, দুই মু-ানো।….(শামী, আলমগীরী, বুখারী, মুসলিম)

আর হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে প্রকাশিত অখ্যাত মাসিক পত্রিকা এপ্রিল/২০০৫ ঈসায়ী সংখ্যায় জিজ্ঞাসা-সমাধান বিভাগে বলা হয়েছে, “মাথা মুন্ডানো যদিও রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে হজ্বের মৌসুম ব্যতীত পাওয়া যায় না, কিন্তু হযরত আলী (রাযি.) থেকে মাথা মুন্ডানোর বর্ণনা পাওয়া যায় এবং হযরত আলী (রাযি.) এর এই আমলের উপর রাসূলুল্লাহ্  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্বীকৃতি পাওয়া যায়। তাই সাহাবীর আমল হিসেবে মাথা মুন্ডানো সুন্নাত। অন্য এক রেওয়ায়াতে আছে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাথা মুন্ডন কারীদের জন্য তিন বার রহমতের দোয়া করেছিলেন। আর হানাফী মাযহাবের গ্রহণযোগ্য কিতাবাদিতেও মাথা মুন্ডানোকে সুন্নাত বলা হয়েছে। (ফাত্ওয়ায়ে আলমগীরি ও শামী)

এখন আমার সুওয়াল হলো- মাথা মুণ্ড করা সম্পর্কে মাসিক মদীনা ও হাটহাজারী মৌলভী ছাহেবদের  উক্ত বক্তব্য সঠিক হয়েছে কি? আর সত্যিই কি মাথা মুণ্ড করা সুন্নত বা চুল রাখার দুই তরীকার, এক তরীকা? দলীলসহ সঠিক জাওয়াব দিয়ে, আমাদের আক্বীদা আমল হিফাযতে সহায়তা করবেন বলে আমরা আশাবাদী।

জাওয়াবঃ  মাথার চুল মুণ্ড করা সম্পর্কে মাসিক মদীনা  ও হাটহাজারী মৌলভী ছাহেবদের উক্ত বক্তব্য সঠিক হয়নি। বরং ভুল ও অশুদ্ধ হয়েছে।

কারণ, মাসিক মদীনা ও হাটহাজারী মৌলভী ছাহেব এবং তাদের সমজাতীয়রা এমন একটি হাদীছ শরীফও উল্লেখ করতে পারবে না, যেখানে উল্লেখ আছে যে, “আল্লাহ্ পাক-এর রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন,  নুরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ্, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হজ্ব ও ওমরাহ ব্যতীত অন্য সময় নিজ মাথার চুল মুবারক মুণ্ড করেছেন।” বরং অসংখ্য ছহীহ্ হাদীছ শরীফ দ্বারা প্রমাণিত যে, “আল্লাহ পাক-এর রসূল, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সব সময় বাবরী চুল মুবারক রাখতেন। সেহেতু সকল উম্মতে মুহম্মদীর জন্য সর্বদা বাবরী চুল রাখাই দায়িমী সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত।

(ধারাবাহিক)

বিগত সংখ্যায় আমরা হাদীছ শরীফের  কিতাব ছিহাহ্ সিত্তাহ্সহ অনেক হাদীছ শরীফের কিতাব থেকে ইবারত উল্লেখ করে মাসিক মদীনার জিহালতপূর্ণ বক্তব্য খণ্ড করে প্রমাণ করেছি যে, মাথা মুণ্ড করা সুন্নত নয় বা চুল রাখার কোন তরীকাই নয়; বরং বাবরী চুল রাখাই সুন্নত। এটাই হানাফী মাযহাবের ছহীহ্ বা বিশুদ্ধ অভিমত। কেননা মাথা মুণ্ড করলে তো মাথায় কোন চুলই থাকে না, সেক্ষেত্রে মাথা মুণ্ড করা চুল রাখার তরীক্বা হয় কি করে?

যেমন, “জামউল ওসায়িল ফি শারহিশ্ শামায়িল” কিতাবের ১ম খণ্ডের ৯৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,

ان المصطفى كان لايحلق شعره لغير نسك.

অর্থঃ- “নিশ্চয়ই নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হজ্জ ব্যতীত অন্য কোন সময় তাঁর মাথার চুল মুবারক মুণ্ড করেননি।”

কিতাবে আরো উল্লেখ আছে,

يحلق رأسه لاجل النسك.

অর্থাৎ- “একমাত্র হজ্জের কারণেই মাথা মুণ্ড করেছেন। (অন্য কোন কারণে নয়।)”

“ফতওয়ায়ে হিন্দিয়া” কিতাবের ৯ম খণ্ডের  ৯৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে, উর্দূ কম্পোজ করতে হবে

অর্থাৎ- “মাথা মুণ্ড করা সুন্নত নয়।”

অতএব, প্রমাণিত হলো, যেখানে হজ্জ, ওমরাহ্ ব্যতীত আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ্ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনই মাথার চুল মুবারক মুণ্ড করেননি সেখানে “মাথা মুণ্ড করা চুল রাখার দুই তরীক্বার একটি  তরীকা” এ প্রশ্নই আসতে পারেনা।

সুতরাং মাথা মুণ্ড করা চুল রাখার কোন তরীক্বাই নয় বা সুন্নতে রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নয়। বরং সর্বদা বাবরী চুল রাখাই খাছ সুন্নতে রসূল ছল্লৗাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।

যেমন উক্ত “ফতওয়ায়ে হিন্দিয়া” কিতাবের ৯ম খণ্ডের ৯৩ পৃষ্ঠায় আরো উল্লেখ আছে,

উর্দূ কম্পোজ করতে হবে

অর্থাৎ- “চুল রাখার একমাত্র সুন্নত তরীক্বা এটাই যে, চুল মাথার মধ্যখান থেকে সিঁিথ করে রাখবে।” অর্থাৎ বাবরী রাখবে।

মাসিক মদীনার দলীলের ভুল ব্যাখ্যা উদঘাটন

উল্লেখ্য, মাসিক মদীনা মাথা মুণ্ড করা চুল রাখার দুই তরীক্বার এক তরীক্বা বলে তাদের স্বপক্ষে দলীল হিসেবে ফতওয়ায়ে শামী, আলমগীরী, বুখারী, মুসলিম ইত্যাদি কিতাবের বরাত দিয়েছে। আর উক্ত কিতাবগুলোতে হযরত ইমাম ত্বহাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর মতটিই উল্লেখ করা হয়েছে।

মূলত: মাসিক মদীনার সম্পাদক ছাহেব উল্লিখিত কিতাবে ইবারতের সঠিক ব্যাখ্যা বুঝতে না পারার কারণেই বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, আবূ দাউদ, নাসাঈ, ইবনে মাযাহ্ ইত্যাদি ছিহাহ্ সিত্তাহ্সহ অনেক হাদীছ শরীফের অসংখ্য ছহীহ্ হাদীছ শরীফকে উপেক্ষা করে এ ব্যাপারে ভুল সিদ্ধান্ত পেশ করে জিহালতের পরিচয় দিয়েছে।

নিম্নে উক্ত ফতওয়ার কিতাবের ইবারত উল্লেখ করে তার সঠিক ব্যাখ্যা তুলে ধরা হলো।

যেমন, “ফতওয়ায়ে আলমগীরী ও শামী” কিতাবে উল্লেখ আছে,

ان السنة فى شعر الرأس أما الفرق وأما الحلق وذكر الطحاوى الحلق سنة ونسب ذلك الى العلماء الثلاثة كذا فى التاتار خانية يستحب حلق الراس فى كل جمعة كذا فى الغرائب.

অর্থঃ- “নিশ্চয় মাথার চুলের ব্যাপারে সুন্নত হলো, সিঁথি বিশিষ্ট বাবরী রাখা। আর মুণ্ড করা সে সম্পর্কে হযরত ইমাম ত্বহাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি উল্লেখ করেন, মুণ্ড করা সুন্নত এবং তিনি তা তিনজন আলিমের দিকে নিছবত করেন। অনুরূপ তাতারখানীয়াতেও  উল্লেখ আছে। প্রত্যেক জুমুয়ার দিন মাথা মুণ্ড করা মুস্তাহাব। অনুরূপ গারায়েবে উল্লেখ আছে।” (ফতওয়ায়ে আলমগীরী ৫ম খ-,৩৫৭ পৃষ্ঠা, শামী ৬ষ্ঠ খ-, ৪০৭ পৃষ্ঠা)

“ফতওয়ায়ে আলমগীরী ও শামীর” উপরোক্ত ইবারতের প্রেক্ষিতে প্রথমতঃ বলতে হয় যে, হযরত ইমাম ত্বহাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি মাথা মুণ্ডকে সুন্নত বলেছেন সত্য কথাই। তবে এর দ্বারা সুন্নতে রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রমাণিত হয় না, বরং কেউ কেউ বলেছেন, হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের মধ্যে হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ওজরবশত: কখনো মাথার চুল ছাঁটতেন বা মুণ্ড করতেন।

এ প্রসঙ্গে “ফতওয়ায়ে আলমগীরী” কিতাবে উল্লিখিত উক্ত ইবারতের ব্যাখ্যায় “ফতওয়ায়ে হিন্দিয়া” কিতাবের ৯ম খণ্ডের ৯৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,

উর্দূ কম্পোজ করতে হবে

অর্থঃ- “কেউ কেউ, অধিকাংশ সময় এরূপই করতেন অর্থাৎ মাথা মুণ্ড করতেন যেন গোসলের মধ্যে সাবধানতা অবলম্বন করা যায়। সুতরাং এখানে সুন্নত বলতে সম্ভবতঃ হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর আমলকে বুঝানো হয়েছে।”

অর্থাৎ হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর মাথা মুবারকের চুল এত ঘন ছিল যে, ফরয গোসলের সময় পানি পৌঁছানোর ব্যাপারে সন্দেহের উদ্রেক হতো। তাই তিনি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অনুমতি সাপেক্ষে কখনো মাথার চুল মুণ্ড করতেন এবং কখনো মাথার চুল ছোট করে রাখতেন। তবে বিশুদ্ধ বর্ণনা মতে তিনি মাথার চুল ছোট করে রাখতেন। মুণ্ড করতেন না।

সুতরাং উক্ত ইবারত থেকে এটাও প্রমাণিত হয় যে, হযরত ইমাম ত্বহাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি মাথা মুণ্ডকে সুন্নত বলেছেন তবে এর দ্বারা হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর দিকেই ইঙ্গিত করেছেন, সুন্নতে রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নয়।

হজ্জের উপর ক্বিয়াস করে মাথা মুণ্ড

করাকে সুন্নত বলা হয়েছে যা ছহীহ নয়

দ্বিতীয়তঃ হযরত ইমাম ত্বহাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি সুন্নত বলতে যদি সুন্নতে রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বুঝিয়ে থাকেন। তবে অবশ্যই তা সঠিক নয়। কারণ, আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ, নূরে মুজাস্সাম, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (হজ্জ ও ওমরাহ ব্যতীত) অন্য সময় মাথা মুণ্ড করেছেন এ ধরনের একটি দলীলও তিনি পেশ করেনি। মূলত: কারো পক্ষে পেশ করাও সম্ভব নয়। যদি তাই হয়ে থাকে তবে হজ্ব ও ওমরাহ ব্যতীত অন্য সময় মাথা মুণ্ড করা কি করে সুন্নতে রসূল হতে পারে?

আর যদি তিনি হজ্জের উপর ক্বিয়াস করে সর্বদাই মাথা মুণ্ড করাকে সুন্নতে রসূল বলে থাকেন তবে তাও সঠিক ও গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ অসংখ্য ছহীহ হাদীছ শরীফ দ্বারা অকাট্টভাবে প্রমাণিত আছে যে, আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বদাই ‘বাবরী চুল মুবারক’ রেখেছেন। সম্পূর্ণ হায়াত মুবারকে শুধুমাত্র চারবার (ওমরাহ ও হজ্জ পালন কালে) মাথা মুণ্ডকরেছেন।

যেমন এ প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফে বর্ণিত হয়েছে,

عن انس رضى الله تعالى عنه قال اعتمر رسول الله صلى الله عليه وسلم اربع عمر كلهن فى ذى القعدة الا التى كانت مع حجته عمرة من الحد يبية فى ذى القعدة وعمرة من العام المقبل فى ذى القعدة وعمرة من الجعرانة حيث قسم غنائم حنين فى ذى القعدة وعمرة مع حجته.

অর্থঃ- “হযরত আনাছ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, হযরত রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চার বার ওমরাহ করেছেন। প্রত্যেকটি করেছেন যিলক্বদ মাসে। তবে হজ্জের সাথে যেটা আদায় করেছেন সেটা ব্যতীত। (কেননা তা ছিল যিলহজ্জ মাসে) একটি ওমরাহ করেছেন হুদায়বিয়া হতে যিলক্বদ মাসে ৬ষ্ঠ হিজরীতে। একটি তার পরবর্তী বছর (৭ম হিজরীর) জিলক্বদ মাসে, যাকে ওমরাতুল কাজ্বাও বলা হয়। একটি ওমরাহ করেছেন জি’রানা থেকে, যেখানে তিনি হুনাইনের গণিমত বণ্টন করেছেন; (৮ম হিজরীর) যিলক্বদ মাসে। আর একটি ছিল তাঁর হজ্জের সাথে অর্থাৎ ১০ম হিজরীতে বিদায় হজ্জে।” (বুখারী, মুসলিম)

আর শুধুমাত্র হজ্জ ও ওমরাহ পালন কালে মাথা মুণ্ড করা সুন্নত বিধায় তিনি হজ্জ ও ওমরাহ-এ মাথা মুণ্ডকারীদের জন্য তিনবার দোয়া করেছেন। যেমন, সম্পর্কে হাদীছ শরীফে উল্লেখ আছে যে,

دعا رسول الله صلى الله عليه وسلم للمحلقين ثلاث مرة وللمقصرين مرة واحدة

অর্থঃ- “সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, (হজ্জে মধ্যে) যারা চুল মুণ্ড করবে, তাদের জন্যে তিনবার দোয়া করেছেন। আর যারা চুল ছোট করবে, তাদের জন্যে একবার দোয়া করেছেন। অর্থাৎ হজ্জের মধ্যে মুণ্ড করাকে ছোট করার উপর ফযীলত বা প্রাধান্য দেয়া হয়েছে।” (মিশকাত, মুসলিম, শরহে নববী, ফতহুল মুলহিম, মিরকাত, আশয়াতুল লুময়াত, লুময়াত, শরহুত্ ত্বীবী, তা’লীকুছ্ ছবীহ্, মুযাহিরে হক্ব ইত্যাদি)

এ হাদীছ শরীফ খানা হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাজীদের জন্য বলেছেন। অর্থাৎ হজ্জের মধ্যে হাজীদের জন্য চুল ছোট করা ওয়াজিব এবং চুল মুণ্ডকরা সুন্নত। যেহেতু হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হজ্জ ও ওমরার সময় চুূল মুবারক মুণ্ড করেছেন। সেহেতু হজ্জ ও ওমরায় চুল মুণ্ড করা সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত।

যেসব হাজী ছাহেবগণ চুল মুণ্ড করেন তারা ওয়াজিব আদায় করার সাথে সাথে সুন্নতও আদায় করে থাকেন। আর এ সুন্নত আদায় করার কারণেই হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁদের জন্য তিনবার দোয়া করেছেন। আর যারা চুল ছোট করে শুধু ওয়াজিব আদায় করেন, সুন্নত আদায় করেন না তাদের জন্য একবার দোয়া করেছেন।

অতএব, উপরোক্ত অকাট্য দলীল আদিল্লাহ্র ভিত্তিতে দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো যে, হজ্বের উপর ক্বিয়াস করে সর্বদাই মাথা মুণ্ড করাকে সুন্নত বলা মোটেও শুদ্ধ হয়নি। সুতরাং মাথা মুণ্ড করা সম্পর্কিত হযরত ইমাম ত্বহাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি ও আলমগীরী, শামী, তাতারখানিয়া ও গারায়েব-এর উক্ত মতটি ছহীহ্ নয়। বরং ছহীহ্ ও গ্রহণযোগ্য মত হলো, “শুধু মাত্র বাবরী চুল রাখাই সুন্নত।”

যেমন এ প্রসঙ্গে কিতাবে উল্লেখ আছে,

وانما صح عند المترجم الفرق فقط ولم يصح ان الحلق سنة.

অর্থঃ- “আর মুতারজিম রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর নিকট নিশ্চয়ই ছহীহ্ ও গ্রহণযোগ্য মত হলো এই যে, শুধু মাত্র সিঁথি বিশিষ্ট বাবরী চুল রাখাই সুন্নত। মাথা মুণ্ড করা সুন্নত, এ মতটি ছহীহ্ বা গ্রহণযোগ্য নয়”। (ফতওয়ায়ে হিন্দিয়া) (চলবে)

মুহম্মদ মুহিউদ্দীন

সভাপতি- আঞ্জুমানে আল বাইয়্যিনাত

সন্দ্বীপ শাখা, চট্টগ্রাম।

সুওয়ালঃ চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত রেযাখানী মাযহাবের অখ্যাত মাসিক মুখপত্র ডিসেম্বর- জানুয়ারী/২০০৩-০৪ ঈসায়ী সংখ্যায় প্রশ্নোত্তর বিভাগে ‘‘বিতিরের পর দু’রাকায়াত নফল নামায দাঁড়িয়ে পড়াই উত্তম এবং বসে পড়লে অর্ধেক ছওয়াব পাবে বলে উল্লেখ করেছে।’’ তারা তাদের উক্ত বক্তব্যের স্বপক্ষে বুখারী, মুসলিম, ইবনে মাজাহ্, নাসায়ী থেকে দলীল হিসেবে কয়েকখানা হাদীছ শরীফও উল্লেখ করেছে।

আর হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে প্রকাশিত অখ্যাত মাসিক পত্রিকা ডিসেম্বর/২০০৩ ঈসায়ী সংখ্যায় জিজ্ঞাসা-সমাধান বিভাগে বলা হয়েছে, ‘‘বিতির নামাযের পর দুই রাক্আত নফল নামায…  দাঁড়িয়ে পড়া ভাল। কারণ, নফল নামায বিনা কারণে বসে পড়লে অর্ধেক সাওয়াব হয়।”

এখন আমার সুওয়াল হলো- তারা হালকী নফল নামায সম্পর্কে যে বক্তব্য পেশ করেছে তা কতটুকু সঠিক? এবং এ সম্পর্কে যে হাদীছ শরীফগুলো উল্লেখ করেছে তা কতটুকু গ্রহণযোগ্য। তাদের প্রতিটি দলীলের খণ্ডসহ হালকী নফল সম্পর্কে বিস্তারিত দলীল-আদিল্লাহ্ পেশ করে আমাদের ঈমান-আমল হিফাযত করবেন বলে আমরা আশাবাদী।

জাওয়াবঃ   বিত্র নামাযের পর দু’রাকায়াত নফল নামায যাকে “হালকী নফল” বলা হয়, তা দাঁড়িয়ে পড়া সম্পর্কে অখ্যাত মাসিক পত্রিকাদ্বয়ের উক্ত বক্তব্য সঠিক হয়নি। বরং ভুল, মনগড়া, দলীলবিহীন এবং কুরআন-সুন্নাহ্র খিলাফ হয়েছে। এবং ক্ষেত্রবিশেষে কুফরীমূলক হয়েছে।

স্মর্তব্য যে, সাধারণতঃ নফল নামায বসে পড়লে অর্ধেক ছওয়াব হলেও বিত্র নামাযের পর দু’রাকায়াত নফল নামায বসে পড়াই মুস্তাহাব-সুন্নত, যা উত্তম ও পূর্ণ ছওয়াব এবং অধিক ফযীলতের কারণ। কেননা বিত্র নামাযের পর দু’রাকায়াত নফল এবং অন্যান্য নফলের ক্ষেত্রে একই হুকুম নয়। বরং বিত্র নামাযের পর দুই রাকায়াত নফলের হুকুম অন্যান্য নফল থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। অর্থাৎ অন্যান্য নফল দাঁড়িয়ে পড়া উত্তম। অর্থাৎ দাঁড়িয়ে পড়লে পূর্ণ ছওয়াব, বসে পড়লে অর্ধেক ছওয়াব।

আর হালকী নফল অর্থাৎ বিতির নামাযের পর দু’রাকায়াত নফল নামায দাঁড়িয়ে পড়লে অর্ধেক ছওয়াব, আর বসে পড়লে পূর্ণ ছওয়াব।

কারণ আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন, নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিতির নামাযের পর দু’রাকায়াত নফল নামায কখনও দাঁড়িয়ে আদায় করেননি। বরং বসেই আদায় করেছেন। যা সরাসরি হাদীছ শরীফ দ্বারাই প্রমাণিত।

(ধারাবাহিক)

উল্লেখ্য, রেযাখানীরা ‘বুখারী, মুসলিম, ইবনে মাজাহ ও নাসায়ী শরীফ’ ইত্যাদি কিতাব থেকে দলীল হিসেবে যে বক্তব্য উল্লেখ করেছে, আসলে উক্ত কিতাবসমূহের বক্তব্য মোটেও সে রকম নয়। তারা কিতাবের ইবারত, সঠিক অর্থ ও ব্যাখ্যা বুঝতে না পারার কারণেই ‘হালক্বী নফল’ সম্পর্কে এরূপ বিভ্রান্তিকর বক্তব্য উল্লেখ করেছে। শুধু তাই নয়, সাথে সাথে নিজেদের জিহালতীকে ধামাচাপা দেয়ার উদ্দেশ্যে উল্লিখিত কিতাবসমূহের কোন কোন ইবারত কারচুপি করে নিজেদের বাতিল মতকে ছাবিত করার ব্যর্থ কোশেশ করেছে। তারা উল্লিখিত কিতাবের বরাত দিয়ে যে সকল মিথ্যাচারিতা, প্রতারণা ও ইবারত কারচুপির আশ্রয় নিয়েছে সেগুলোর সঠিক ব্যাখ্যা ও ফায়সালা তুলে ধরে তার খণ্ডমূলক আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ্।

রেযাখানীদের কারচুপিমূলক

বক্তব্য উদঘাটন ও খণ্ড

উল্লেখ্য, রেযাখানীরা আহমদ রেজা খান ব্রেলভী রচিত “ফতওয়ায়ে রেজভীয়া”-এর ৩য় খণ্ডে এবং আমজাদ আলী কর্তৃক উর্দূ ভাষায় রচিত “বাহারে শরীয়ত”-এ অন্যান্য  নফল নামাযের ন্যায় বিত্রের পর দু’রাকায়াত  নফল নামাযও দাঁড়িয়ে পড়া উত্তম বলে অভিমত ব্যক্ত করেছে।”

এর জবাবে বলতে হয় যে, রেযাখানীরা বিত্র নামাযের পর দু’রাকায়াত নফল নামায দাঁড়িয়ে পড়া উত্তম বলে প্রথমতঃ “রেজভীয়া” কিতারের ৩য় খণ্ডের বরাত দিয়েছে। অথচ রেজভীয়া কিতাবের ৩য় খণ্ডে এ ব্যাপারে দু’টি বক্তব্য বর্ণনা করা হয়েছে। একটি হলো ১৩২৫ হিজরীর এবং অপরটি হলো ১৩২৬ হিজরীর। আমরা পর্যায়ক্রমে উভয়টি খণ্ড করবো ইন্শাআল্লাহ্।

 নিম্নে “রেজভীয়া” কিতারের ৩য় খণ্ডের  প্রথম বক্তব্যটির হুবহু ইবারত তুলে ধরা হলো। যেমন, “রেজভীয়া” কিতারের ৩য় খণ্ডের ৪৬০-৪৬১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,

উর্দূ কম্পোজ করতে হবে

অর্থঃ- “মাসয়ালাঃ ইশার নামায বা’দ দু’রাকায়াত নফল  নামায বসে পড়বে না দাঁড়িয়ে পড়বে। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বদা উক্ত নফল নামায কিভাবে আদায় করতেন এবং কিভাবে আদায় করা অধিক ছওয়াবের কারণ?

জাওয়াবঃ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উক্ত নফল নামায বসেই আদায় করেছেন। তবে সাথে সাথে একথাও বলেছেন যে, আমি তোমাদের মত নই। আমার দাঁড়িয়ে এবং বসে নামায আদায় করা উভয়ের মধ্যেই সমান ছওয়াব। উম্মতের জন্য দাঁড়িয়ে নামায পড়া আফযল ও দ্বিগুন ছওয়াব এবং বসে পড়ার ব্যাপারেও কোন বিতর্ক নাই।

“রেজভীয়া” কিতারের ৩য় খণ্ডে উল্লিখিত উক্ত ইবারতে প্রথমতঃ এটাই প্রমাণিত হলো যে, রেযাখানীদের গুরু মৌলভী রেযা খাঁ সাহেব  প্রথমতঃস্বীকার করেছে যে,

উর্দূ কম্পোজ করতে হবে

হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঞ্জউক্ত নফল অর্থাৎ বিত্র নামাযের পর দু’রাকায়াত নফল নামায  বসেই আদায় করেছেন।

 আর আমরাও সেটাই বলে থাকি যে, বিত্র নামাযের পর দু’রাকায়াত নফল নামায যেহেতু আল্লাহ্ পাক-এর রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন, হাবীবুল্লাহ্, নূরে মুজাস্সাম, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আদায় করেছেন এবং তা বসেই আদায় করেছেন, সেহেতু বিত্র নামাযের পর দু’রাকায়াত নফল নামায বসেই আদায় করা সুন্নত, উত্তম ও অধিক ফযীলতের কারণ।

কেননা, “ইবনে মাজাহ্ শরীফের” ৮৫ পৃষ্ঠায়  উল্লেখ আছে,

عن ام سلمة رضى الله عنها ان النبى صلى الله عليه وسلم كان يصلى بعد الوتر ركعتين خفيفتين وهو جالس.

অর্থঃ- “উম্মুল মু’মিনীন হযরত উম্মু সালামা রদ্বিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত আছে যে, আখেরী রাসুল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিত্র নামাযের পর সংক্ষিপ্তাকারে দু’রাকায়াত নফল নামায বসেই আদায় করতেন।”

 উক্ত হাদীছ শরীফে وهو جالس. জুমলাটিই প্রমাণ করে যে, উক্ত নামায বসেই আদায় করা সুন্নত। আর উক্ত হাদীছ শরীফ সমূহের উপর ভিত্তি করেই ইমাম, মুজতাহিদ ও ফুক্বাহা-ই-কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণ বিতির নামাযের পর দু’রাকায়াত নফল নামায বসে পড়াকেই মুস্তাহাব সুন্নত,অধিক ফযীলতের কারণ বলে ফতওয়া দেন।

অতএব, উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটাই প্রমাণিত হলো যে, রেযাখানীরা বিত্র নামাযের পর দু’রাকায়াত নফল নামায দাঁড়িয়ে পড়াই উত্তম বলে যে রেজভীয়া কিতাবের ৩য় খণ্ডের  বরাত দিয়েছে, সেই রেজভীয়া কিতাবের ৩য় খণ্ডেই উল্লেখ আছে,

উর্দূ কম্পোজ করতে হবে

“হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উক্ত নফল অর্থাৎ বিত্র নামাযের পর দু’রাকায়াত নফল নামায বসেই আদায় করেছেন।”

সুতরাং, রেযাখানীদের জালিয়াতি, ধোঁকাবাজী, প্রতারণা, মিথ্যা ও ইবারত কারচুপি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো। (চলবে)

মুহম্মদ শমসের আলী

কাছারী পাড়া, পাবনা।

সুওয়ালঃ আমাদের পাবনা শহরের কিছু লোক আপনাদের বহুল প্রচারিত, অকাট্য দলীলভিত্তিক মুখপত্র “মাসিক আল বাইয়্যিনাত”-এর ‘পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে’ শিরোনামে প্রকাশিত ৯৪, ১৩২, ১৩৩, ও ১৩৪তম সংখ্যায় প্রদত্ত নিম্নলিখিত বিষয়গুলো নিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। তারা লোকদেরকে বুঝাচ্ছে যে, এ সমস্ত বক্তব্য সম্পূর্ণরূপে কুফরী ও শিরকীর অন্তর্ভুক্ত। আবার কিছু কিছু বক্তব্য সন্দেহজনক। যেমন,

…… ৪. “পীর ছাহেব ক্বিবলার দরবার শরীফে সেই রূপ ভয়ভীতি, আদব ও ইহতিরাম নিয়ে অবস্থান করতে হবে, যেরূপ ভয়ভীতি, আর আদব ও ইহতিরাম নিয়ে অবস্থান করতে হয় আল্লাহ পাক এবং তাঁর হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দরবার শরীফে। বরং পীর ছাহেব ক্বিবলার দরবার শরীফে কোন কোন ক্ষেত্রে তার চেয়েও বেশী ভয়ভীতি আর আদব ও ইহতিরাম সহকারে অবস্থান করতে হয়।” তবে কি পীর ছাহেব আল্লাহ পাক ও তাঁর হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর চেয়েও বড় এবং অধিক মর্যাদা সম্পন্ন?……

আশা করি কুরআন শরীফ ও সুন্নাহ্ শরীফের আলোকে তাদের উত্থাপিত সেই প্রশ্নগুলোর সঠিক জাওয়াব দান করে এলাকাবাসী ধর্মপ্রাণ মুসলমানদেরকে বিভ্রান্তির কবল হতে মুক্তি পাওয়ার পথ দেখাবেন।

জাওয়াবঃ মাসিক আল বাইয়িনাতের ৯৪, ১৩২, ১৩৩ এবং ১৩৪ তম সংখ্যায় ‘ফিকহুল হাদীস ওয়াল আছার’ বিভাগে ‘পীর ছাহেব ও মুরীদের সর্ম্পক প্রসঙ্গে’ শিরোনামে পীর ছাহেব এবং দরবার শরীফের আমানতসমূহ ও তার স্বরূপ এবং গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। সত্যান্বেষী ইচ্ছা নিয়ে পাঠ করলে বিষয়টি সহজেই অনুধাবনীয়। (ইনশাআল্লাহ)

আর যারা বিপরীত মন এবং মননের অধিকারী ও ইল্মে তাছাউফ শূন্য বা তাছাউফ বিরোধী তারাই কেবল চিনির বলদের মত কিতাবের বোঝা বহনকারীর উপমা হয়। তারা ফিৎনা ফাসাদ সৃষ্টিকারী ও সঠিক বক্তব্যরে মনগড়া, অপব্যাখ্যা দানকারী। তাই ফিৎনাকারীদের ফিৎনা নিরসনের উদ্দেশ্যে ও হক্ব তালাশীদের নিকট বিষয়টি আরো সুস্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তোলার লক্ষ্যে উপরোক্ত প্রশ্নসমূহের দলীলভিত্তিক বিস্তারিত জাওয়াব ধারাবাহিকভাবে নিম্নে উল্লেখ করা হলো-

(ধারাবাহিক)

৪. “পীর ছাহেব ক্বিবলার দরবার শরীফে সেই রূপ ভয়ভীতি, আদব ও ইহতিরাম নিয়ে অবস্থান করতে হবে, যেরূপ ভয়ভীতি, আর আদব ও ইহতিরাম নিয়ে অবস্থান করতে হয় আল্লাহ পাক এবং তাঁর হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দরবার শরীফে। বরং পীর ছাহেব ক্বিবলার দরবার শরীফে কোন কোন ক্ষেত্রে তার চেয়েও বেশী ভয়ভীতি আর আদব ও ইহতিরাম সহকারে অবস্থান করতে হয়।”

তাহলে পীর ছাহেব কি আল্লাহ পাক ও তাঁর হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর চেয়েও বড় এবং অধিক মর্যাদা সম্পন্ন?

এর জাওয়াব হলো- ট্যারা চোখ সম্পন্ন ব্যক্তি যেমন কোন জিনিস স্বাভাবিকভাবে দেখতে পায়না বরং সবকিছু বাঁকা ভাবে দেখে থাকে তেমনি বিদ্য়াতী, বাতিল আক্বীদাপন্থী, তাসাউফ শূন্য ব্যক্তিবর্গও স্বাভাবিক অবস্থায় খুব কম জিনিসই দেখে থাকে। তাছাউফপন্থী আল্লাহ ওয়ালাগণের সাথে বিদ্বেষ পোষণের কারণে তাদের ছহীহ সমঝই বিনিষ্ট হয়েছে।

ইমাম-মুজতাহিদ এবং আউলিয়ায়ে কিরামগণের অভিমত হচ্ছে, শিয়াদের মধ্যে হাফিযে কুরআন নেই। শিয়ারা কুরআন শরীফ হিফয করতে পারেনা। আর বাতিল আক্বীদাপন্থীরা কখন ওলীআল্লাহ হতে পারে না।

কিতাবে বর্ণিত আছে যে, হক্কুল্লাহর (আল্লাহ পাক-এর হক্ব) চেয়ে হক্কুল ইবাদের (বান্দার হক্ব) বিষয়টি অধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং জটিল। তবে সেক্ষেত্রে ইল্মে তাছাউফ বিরোধীরা কি বলবে যে, এখানে আল্লাহ পাক-এর চেয়ে বান্দার মর্যাদা অধিক বুঝানো হয়েছে?

মূলতঃ তা নয়। আল্লাহ পাক হচ্ছেন রহমান, রহীম পরম করুণাময় দয়ালু। ইচ্ছা করলে আল্লাহ পাক স্বীয় হক্ব বান্দাকে ক্ষমা করতে পারেন। কিন্তু বান্দার হক্বের বিষয়টি বান্দার সাথে সংশ্লিষ্ট থাকার কারণে সংশ্লিষ্ট বান্দা ক্ষমা না করা পর্যন্ত আল্লাহ পাক ক্ষমা করেন না। সুতরাং এ বিষয়টি অত্যন্ত জটিল। যদিও বা ইচ্ছা করলে আল্লাহ পাক সেই বিষয়টিও ক্ষমার ব্যবস্থা করতে পারেন। সঙ্গতকারণেই বলা হয়, বান্দার হক্বের বিষয়টি হক্কুল্লাহর চেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ।

স্মর্তব্য যে, পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে মাসিক আল বাইয়্যিনাতের সেই শিরোনাম দেখলেই বিষয় পরিস্কার হয়ে উঠে যে, নিশ্চয়ই যারা তাছাউফ পন্থী। ইল্মে তাছাউফ যারা শিক্ষা করতে চায়, বিষয়টি তাদের সংশ্লিষ্ট। সেক্ষেত্রে ইল্মে তাছাউফ সম্পর্কে ন্যুনতম ইলম যারা রাখেনা তারা কিভাবে সেই বিষয়টি অনুধাবন করবে? কাজেই সেই বিষয়টি বুঝতে হলে ইল্মে তাছাউফ হাছিল করতে হবে এবং হক্কানী-রব্বানী কোন পীর ছাহেবের নিকট বাইয়াত হয়ে, ছোহবত ইখতিয়ার করে, যিকির-ফিকির, রিয়াজত-মুশাক্কাত করলে উক্ত বিষয়টি বুঝা যাবে। সাথে সাথে এটা উপলব্ধি করতে পারবে, কোন্ কোন্ সময় স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলার বিষয়টিকে বেশী প্রাধান্য দিতে হবে।

মূলতঃ হাক্বীক্বী ঈমানদার, হাক্বীক্বী মু’মিন, মুত্তাকী হওয়ার জন্য পীর ছাহেবের নিকট বাইয়াত হতে হয়।

আল্লাহ পাক এবং তাঁর হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মারিফাত, মুহব্বত হাছিল করার উদ্দেশ্যে হক্কানী-রব্বানী পীর ছাহেবের কাছে বাইয়াত হওয়া ফরয। অন্তরের যাবতীয় বদ্ স্বভাব দূর করে অন্তর বিশুদ্ধ করতঃ ইখলাছ হাছিল করার জন্যই বাইয়াত হতে হয়। কারণ বাইয়াত হওয়া, যিকির-ফিকির করা ব্যতীত অন্তর পরিশুদ্ধ হওয়ার কল্পনাও করা যায়না। রিয়াজত-মুশাক্কাত ছাড়া কখনও বদ স্বভাব দূর হয়না। সর্বোপরি হক্কানী-রব্বানী পীর ছাহেবের নিকট বাইয়াত হওয়া, ছোহবত ইখতিয়ার করার নির্দেশ আল্লাহ পাকই দিয়েছেন, আল্লাহ পাক-এর হাবীব, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আরাইহিই নির্দেশ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে,

يايها الذين امنوا اتقوا الله وكونوا مع الصدقين.

অর্থঃ- “হে ঈমানদারগণ! আল্লাহ পাককে ভয় কর আর সত্যবাদী তথা আল্লাহওয়ালাগণের ছোহবত ইখতিয়ার কর।” (সূরা তওবা-১১৯)

আর বাইয়াত হওয়ার ও ছোহবত ইখতিয়ার করার জন্য শর্ত হচ্ছে স্বীয় ইরাদাত বা  ইচ্ছাকে ফানা তথা বিলীন করা।

এ প্রসঙ্গে “তাফসীরে রুহুল বয়ান”-এর ৪র্থ খ-, ৬২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,

السلوك الارادة لاجل الفناء فان المريد من يفنى ارادته فى ارادة الشيخ فمن عمل برأيه امرا فهو ليس بمريد.

অর্থঃ- “সুলূক হচ্ছে সমস্ত ইরাদাত বা ইচ্ছাকে ফানা (বিলীন) করার নাম। প্রকৃত মুরীদ ঐ ব্যক্তি যে তার ইরাদাকে স্বীয় পীর ছাহেবের ইরাদার নিকট ফানা করে দেয়। সুতরাং যে ব্যক্তি স্বীয় ইচ্ছানুরূপ আমল করে সে ব্যক্তি মুরীদ নয়।”

আর যারা মুরীদ হতে পারে না তারা নফসানিয়ত থেকে মুক্তি পায়না। ইখলাছ (একনিষ্টতা) ইবাদতের মূল সেই ইখলাছ হাছিল করতে পারে। ফলে তাঁর সমস্ত নেক আমলই গাইরুল্লাহ’র মধ্যে পর্যবসিত হয়। যত ইবাদত-বন্দিগী করুক না কেন তাদের পরিচয় হচ্ছে তারা ফাসিক।

হযরত ইমাম মালিক রহমতুল্লাহি আলাইহি যে অভিমত পেশ করেছেন তাঁর সেই অভিমতের উপর অন্যান্য সকল ইমাম-মুজতাহিদ ও আউলিয়ায়ে কিরামগণ একমত। তিনি বলেন, من تفقه ولم يتصوف فقد تفسق.

অর্থঃ- “যে ব্যক্তি ইল্মে ফিক্বাহ্ শিক্ষা করলো কিন্তু ইল্মে তাছাউফ শিক্ষা করলো না সে ফাসিকের অন্তর্ভুক্ত।” (মিরকাত)

আর ইলমে তাছাউফের মৌলিক বিধান হচ্ছে ইরাদত্কে (ইচ্ছা) বিলীন করা। শায়খ তথা পীর ছাহেবের মতের সাথে নিজের মতকে  মিলিয়ে দেয়া। যা ইল্মে তাছাউফের প্রধান আদবও বটে। তাই কামিল পীর ছাহেবগণ স্বীয় মুরীদকে তার ইরাদতকে বিলীন করার তা’লীম-তরবিয়ত দান করেন। সেক্ষেত্রে মুরীদের সেই ইরাদত কতটুকু বিলীন হলো তার পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন হয়। তাঁরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন, কেউ আগে কেউ বা পরে।

ইমামুল মুহাক্কিকীন হযরত আবূ বকর শিবলী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর নিকট এক ব্যক্তি মুরীদ হতে আসলেন। তিনি পূর্বেই তাকে পরীক্ষা করার প্রয়োজন অনুভব করলেন। তিনি উক্ত ব্যক্তিকে কালিমা তাইয়্যিবা পাঠ করতে বললেন। উক্ত ব্যক্তি পড়লেন,

لا اله الا الله محمد رسول الله صلى الله عليه وسلم.

তিনি বললেন, তোমার কালিমা শরীফ পাঠ শুদ্ধ হয়নি; পড়,

لا اله الا الله ابو بكر شبلى رسول الله.

সে ব্যক্তি বললো, হুযূর! আমার পক্ষে এ কলেমা পাঠ করা এবং বিশ্বাস করা সম্ভব নয়।

ইমামুল মুহাক্কিকীন হযরত আবূ বকর শিবলী রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, তাহলে তুমি অন্য কোথাও বাইয়াত হও। সে ব্যক্তি  চলে গেলো। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে উক্ত কালিমা পাঠ করলো। তখন তিনি বললেন, তুমি তওবা কর। কারণ, আমি নবীও নই, রসূলও নই। তোমাকে সে কালিমা তালক্বীন দেয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে যে, তুমি আমার ইরাদাতের সাথে তোমার ইরাদাতকে ফানা করতে পারবে কিনা তার পরীক্ষা নেয়া। কেননা, যারা নিজের ইরাদতকে ফানা করতে না পারে পীর ছাহেবের আদেশ-নিষেধের ক্ষেত্রে প্রশ্ন তোলে তারা আল্লাহ পাক ও তাঁর হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মারিফাত-মুহব্বত হাছিল করতে পারে না। হাক্বীক্বী মু’মিন হওয়া, হাক্বীক্বী মুসলমান হওয়াও তাদের পক্ষে সম্ভব হয়না। বাইয়াত হলেও তা হয় রছম-রেওয়াজ। ইবলিসের মত এক সময় বিতাড়িত হয়ে যায়। (তাযকিরাতুল আউলিয়া)

অনুরূপভাবে আবূ ইসহাক শামী চিশতী রহমতুল্লাহি আলাইহিও স্বীয় মুরীদকে প্রথমেই অনুরূপ কলেমার তালক্বীন দিতেন।

সাইয়্যিদুশ্ শুয়ারা হযরত জালালুদ্দীন রূমী রহমতুল্লাহি আলাইহি সেই ইরাদত বিলীনের পরীক্ষা নেয়া হয়েছিলো অন্যভবে। হযরত শামছে তাবরিযী রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁকে বাইয়াত করার শর্ত দিলেন যে, আমাকে কয়েক বোতল শরাব (মদ) দিতে হবে। দু’জন যুবতী মেয়ে এবং দু’জন আমরাদ (বালেগের নিকটবর্তী) বালক যারা হবে খুবই সুশ্রী আমার নিকট হাজির করতে হবে। আর আমি যা বলবো তাই করতে হবে।

হযরত জালালুদ্দীন রূমী রহমতুল্লাহি আলাইহি জগৎ বিখ্যাত আলিম হওয়ার পরেও সেই শর্ত বিনা দ্বিধায় মেনে নিলেন এবং পূর্ণ করলেন। যদিও তা ছিল প্রকাশ্য শরীয়ত বিরোধী। আল্লাহ পাক এবং তাঁর হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মতের সম্পূর্ণ খিলাফ। তবু সেই মতের উপর একজন বান্দার মতকে প্রাধান্য দিয়ে তা পালন করলেন।  কবি হাফিয আরো সুস্পষ্ট এবং হৃদয়গ্রাহী করে বর্ণনা করেছেন,

উর্দূ কম্পোজ করতে হবে

অর্থঃ- “তোমার জ্ঞানবৃদ্ধ পীর ছাহেব যদি আদেশ করেন, তোমারা জায়নামাযকে শরাবের দ্বারা রঙ্গীন করে নাও তবে তা করিও। কারণ, তুমি তো জাননা যে, আল্লাহ পাক-এর মারিফাত-মুহব্বত হাছিলের সঠিক পথ কোন্টি? আর তিনি এ ব্যাপারে পূর্ণ অভিজ্ঞ।”

আর এই বিষয়টি বুঝানোর জন্যই মাসিক আল বাইয়্যিনাতে সংক্ষেপে বলা হয়েছে যে, কোন কোন ক্ষেত্রে আল্লাহ পাক ও তাঁর হাবীব, হুযর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আদেশ-নিষেধের উপর স্বীয় পীর ছাহেবের মতকে প্রধান্য দিতে হয়। আর আদব-ইহতিরাম, ভয়-ভীতি রক্ষা করার ব্যাপারটি ঠিক সেই পর্যায়ের।

তবে যারা হক্কানী-রব্বানী আলিম হবেন, হাক্বীক্বী পীর ছাহেব হবেন তাঁরা অবশ্যই কোন নাজায়িয-হারাম কিংবা সুন্নতের খিলাফ আমলের আদেশ করবেন না। আর পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য যদি হয় তা অবশ্যই স্বল্প সময়ের জন্য হবে অথবা অনতিবিলম্বে তার প্রকৃত অবস্থা জানবেন। এক তওবা-ইস্তিগ্ফার করার নির্দেশ দিবেন।

উল্লেখ্য যে, বর্তমানে যারা নাজায়িয ও হারাম কাজে লিপ্ত তারা পীর ছাহেবই নয়। কাজেই পরীক্ষা করা তো দূরের কথা তাদের নিকট গমন করা বা বাইয়াত হওয়াই জায়িয নেই। তাছাড়া আল্লাহ পাক এবং তাঁর হাবীব, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দরবার শরীফের আদবের সাথে পীর ছাহেব-এর দরবার শরীফের আদবের যে তাশবীহ বা তুলনা দেয়া হয়েছে তা মূলত সেই গুরুত্ব ও তাৎপর্যকে উপলব্ধির জন্যই দেয়া হয়েছে। যেমন, আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাদীছ শরীফের গুরুত্ব-তাৎপর্যকে বুঝার জন্য কুরআন শরীফের সাথে তাশবীহ বা তুলনা দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন,

الا انى اوتيت القران ومثله معه.

অর্থঃ- “জেনে রাখ! আমাকে কুরআন শরীফ দেয়া হয়েছে এবং তার সাথে সাথে এর অনুরূপ হাদীছ শরীফ দেয়া হয়েছে।” (আবূ দাউদ, মিশকাত)

انها لمثل القران او اكثر.

অর্থঃ- “নিশ্চয় এটা (হাদীছ শরীফ) কুরআন শরীফের অনুরূপ বরং তার চেয়েও অধিক গুরুত্বপূর্ণ।” (মিশকাত)

মাসিক আল বাইয়্যিনাত বিরোধীরা উক্ত বাণীকে কুফরী, শিরকী বলে তাহলে তারা চরম পর্যায়ের কাফির ও মুশরিকের অন্তর্ভুক্ত হবে এবং তাদের সমমনা ব্যক্তিরাও সেই পর্যায়ে পড়বে। এমনকি এ ব্যাপারে যারা সন্দেহ পোষণ করবে তারাও কাফির ও মুশরিকের অন্তর্ভুক্ত হবে।

কাজেই যারা আল বাইয়্যিনাতের সেই বক্তব্যকে শিরক্ ও কুফর বলে জনমনে বিভ্রান্তি ছড়ায় এবং তাদের সমর্থন যোগায় তারা সকলেই কাফির এবং মুশরিকের অন্তর্ভুক্ত। (চলবে)

মুহম্মদ আব্দুল আলীম

বদলগাছী, নওগাঁ।

সুওয়াল: জনৈক পীরের মুরীদেরা গরুর গোশ্ত খায়না। তারা গরু কুরবানীও দেয় না। অন্য কেউ গরু কুরবানী করে তাদেরকে গোশ্ত দিলেও তারা তা গ্রহণ করে না। তারা বলে, ‘গরুর গোশ্ত খেলে পীরের দেয়া সবক বা ওযীফা আমলে আসেনা।’ আবার বলে, ‘তাদের পীর খায়না তাই তারাও খায়না।’

আমার সুওয়াল হলো- গরুর গোশ্ত সম্পর্কে তাদের উক্ত আমল ও বক্তব্য শরীয়তসম্মত কিনা? দয়া করে জানাবেন।

জাওয়াব: শরীয়ত তথা কুরআন-সুন্নাহ মতে, গরুর গোশ্ত খাওয়া জায়িয ও সুন্নত। আল্লাহ পাক তাঁর কালাম পাকে ইরশাদ করেন,

كلوا مما رزقكم الله ولا تتبعوا خطوت الشيطن انه لكم عدو مبين، ثمنية ازواج من الضان اثنين ومن المعز اثنين، ومن الابل اثنين ومن البقر اثنين.

অর্থঃ- “আল্লাহ পাক যে রিযিক তোমাদেরকে দিয়েছেন তা তোমরা ভক্ষণ করো। আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করোনা। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। উহা আটটি (পশু)। ছাগল হতে দু’টি (পুরুষ ও স্ত্রী), মেষ হতে দু’টি, উট হতে দু’টি এবং গরু হতে দু’টি।” (সূরা আনয়াম- ১৪২, ১৪৩, ১৪৪)

উপরোক্ত আয়াত শরীফে আল্লাহ পাক গরুর গোশ্ত খাওয়ার জন্য আদেশ করেছেন।

হাদীছ শরীফে বর্ণিত রয়েছে, “আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনা শরীফে উপস্থিত হয়ে গরু যবেহ করেছিলেন এবং ঈদুল আযহার দিনে গরু কুরবানী করেছিলেন।”

হাদীছ শরীফে আরো ইরশাদ হয়েছে,

عن عائشة رضى الله تعالى عنها قالت اتى النبى صلى الله عليه وسلم بلحم بقر فقيل هذا ما تصدق به على بريرة فقال حولها صدقة ولنا هدية.

অর্থঃ- “হযরত আয়িশা ছিদ্দীকা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, হযরত রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট গরুর গোশ্ত আনয়ন করা হয়েছিলো। এতে বলা হয়েছিলো, এটা বারীরা নাম্নী দাসীকে ছদকা দেয়া হয়েছে। তা শুনে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেন, সেটা তার জন্য ছদকা আর আমাদের জন্য হাদিয়া।” (মুসলিম শরীফ)

এ সকল বর্ণনা থেকে বুঝা যায় যে, স্বয়ং আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গরুর গোশ্ত খেয়েছেন।

অতএব, প্রমাণিত হলো, গরুর গোশ্ত খাওয়া সম্পর্কে উক্ত পীরের মুরীদের আমল ও বক্তব্য সম্পূর্ণরূপে কুরআন-সুন্নাহ তথা শরীয়তের খিলাফ।

আর কুরআন-সুন্নাহর খিলাফ কারো কোন আদেশ-নিষেধ মান্য করা বা কারো কোন আমল অনুসরণ করা সেটাও সম্পূর্ণরূপে হারাম। হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,

لاطاعة لمخلوق بمعصية الخالق.

অর্থাৎ- “আল্লাহ পাক-এর নাফরমানী করে কোন সৃষ্টির অনুসরণ করা জায়িয নেই।”

{দলীলসমূহ: সমূহ হাদীছ শরীফ, তাফসীর ও ফিক্বাহ্র কিতাব}

মুহম্মদ ফুরকান মিঞা

মুর্দারিস, হাবিবুল্লাহ আবাদ কামিল মাদ্রাসা

মোড়লগঞ্জ, বাগেরহাট।

সুওয়ালঃ এক লোক ঢাকাতে চাকুরী করে। তার বাড়ী চট্টগ্রাম। বাড়ী থেকে ঢাকা- কর্মস্থলে আসতে ৪৮ মাইলের মধ্যেই তার শশুর বাড়ী। ঐ ব্যক্তি যদি তার চট্টগ্রামের বাড়ী থেকে তার স্ত্রীসহ রওয়ানা হয়ে স্ত্রীকে শশুর বাড়ীতে রেখে আসে এবং ঐ ব্যক্তি তার ঢাকা আসার পথে শশুর বাড়ীতে কিছু সময় অবস্থান করে, তাহলে তার উপর শশুর বাড়ীর সময়টুকু মুছাফিরের হুকুম বর্তাবে কিনা?

জওয়াবঃ হ্যাঁ, উক্ত ব্যক্তি তার শশুর বাড়ীতে যে সময়টুকু কাটিয়েছে তা ছফর হিসেবেই গণ্য হবে। অর্থাৎ তার উপর মুছাফিরের হুকুমই বর্তাবে। (দলীলঃ- সমূহ ফিকাহ কিতাব)

 সুওয়াল-জাওয়াব

সুওয়াল-জাওয়াব

সুওয়াল-জাওয়াব

সুওয়াল-জাওয়াব বিভাগ

সুওয়াল জাওয়াব