সুওয়াল-জাওয়াব

সংখ্যা: ১৩৯তম সংখ্যা | বিভাগ:

 ক্বারী মুহম্মদ আব্দুল বারী, গোড়ান, ঢাকা।

মুহম্মদ সোহেলুর রহমান, রামপুরা, ঢাকা।

সুওয়ালঃ সম্প্রতি ‘আহলে হাদীছ লাইব্রেরী ঢাকা’-এর সৌজন্যে প্রকাশিত একটি হ্যান্ডবিলে ‘শবে বরাত’ সম্পর্কে বিভ্রান্তিমূলক কতিপয় উক্তি করা হয়েছে। কুরআন-সুন্নাহ্র নিরিখে সেসব কতটুকু সঠিক তা আপনাদের বহুল পঠিত, তাজদীদী মুখপত্র ‘মাসিক আল বাইয়্যিনাত’ পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশ করলে বিভ্রান্তির নিরসণ হতো এবং সঠিক বিষয়টি উন্মোচিত হয়ে আওয়ামুন্ নাস খুবই উপকৃত হতো।

আপনাদের জ্ঞাতার্থে হ্যান্ডবিলের একটি মূল কপি প্রেরণ করা হলো। এতে আমাদের মনে যেসব প্রশ্নের উদয় হয়েছে তাহলো-

১. শবে বরাত কি? শবে বরাত-এর অর্থ কি? অর্ধেক ফারসী আর অর্ধেক আরবী সহযোগে শরীয়তে কোন নাম হতে পারে কি-না? শবে বরাত সম্পর্কে কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফে কোন তথ্য পাওয়া যায় কি-না?

২. কখন থেকে শবে বরাত শুরু হয়? শবে বরাত সম্পর্কে হযরত রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কোন নির্দেশ-বাণী আছে কি-না?

৩. অর্ধ শা’বানের রাতটি ভাগ্য রজনী নামে নামকরণ কি বিদ্য়াত?

৪. নফল ইবাদতের মাধ্যমে রাত্রি জাগরণ ও দিনের বেলায় রোযা পালন করা কি বিদ্য়াত?

৫. এর সমর্থনে সূরা দুখানের ৩-৪নং আয়াত শরীফ পেশ করা সঠিক কি-না? ‘লাইলাতুম্ মুবারাকাহ্’ বলতে ‘লাইলাতুল ক্বদরকে’ বুঝানো হয়েছে? না ‘শবে বরাতকে’ বুঝানো হয়েছে?

৬. শবে বরাতে রিযিক বৃদ্ধি করা হয় এবং কতজন জন্মগ্রহণ করবে ও কতজন মৃত্যুবরণ করবে তা ধার্য্য করা হয়। এটা কুরআন-সুন্নাহ্ সম্মত কি-না?

৭. অর্ধ শা’বানের রাতে আলফিয়াহ বা রাগায়িব নামক কোন নামায আছে কি-না?

৮. অর্ধ শা’বানের রাতে কবর যিয়ারত করা নাকি বিদ্য়াত?

৯. হালুয়া-রুটি ও রকমারি খাদ্য প্রস্তুত করা ও বিলি করা নাকি বিদ্য়াত?

১০. অর্ধ শা’বান উপলক্ষে আয়োজিত মাহ্ফিল বিদয়াত কি-না?

১১. শবে বরাত উপলক্ষে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও অফিস-আদালত ছুটি ঘোষণা করা নাকি বিদ্য়াত চর্চার সুযোগ দেয়া?

১২. সউদী আরবের দারুল ইফতার সাবেক প্রধান ‘আব্দুল আযীয আব্দুল্লাহ বিন বায’-এর  শবে বরাত পালন করা ও এদিনে রোযা রাখা বিদ্য়াত বলে অভিহিত করা কতটুকু সঠিক?

আশা করি উল্লিখিত প্রশ্নসমূহের দলীলভিত্তিক জাওয়াব দানে বাধিত করবেন।

জাওয়াবঃ মহান আল্লাহ পাক স্বীয় কালাম পাকে ইরশাদ করেন,

فسئلوا اهل الذكر ان كنذم لاذعلمون.

অর্থঃ- “তোমরা আহলে যিকির তথা আল্লাহওয়ালাগণকে জিজ্ঞাসা কর, যদি তোমরা না জান।” (সূরা আম্বিয়া/৭)

যামানার তাজদীদী মুখপত্র মাসিক আল বাইয়্যিনাত উপরোক্ত আয়াত শরীফের হাক্বীক্বী মিছদাক। আল্লাহ পাক রব্বুল আলামীন-এর লক্ষ্যস্থল ওলী, যামানার মুজাদ্দিদ, মুজাদ্দিদে আ’যম, রাজারবাগ শরীফের হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলী-এর ওছীলায় এ পত্রিকাটি উম্মাহ্র জন্য শ্রেষ্ঠতম নিয়ামত যার প্রতিটি লিখাই আক্বীদা-আমল হিফাযতকারী ও পরিশুদ্ধকারী। প্রসঙ্গতঃ সুওয়ালে উল্লিখিত প্রশ্নসমূহের ধারাবাহিক জাওয়াব পেশ করা হলো-

(ধারাবাহিক)

৫. এর সমর্থনে সূরা দুখানের ৩-৪নং আয়াত শরীফ পেশ করা সঠিক কি-না? ‘লাইলাতুম্ মুবারাকাহ্’ বলতে ‘লাইলাতুল ক্বদরকে’ বুঝানো হয়েছে? না ‘শবে বরাতকে’ বুঝানো হয়েছে?

এর জবাব হলো, হ্যাঁ, এর (লাইলাতুল বরাত বা শবে বরাত) সমর্থনে সূরা দুখানের ৩-৪নং আয়াত শরীফ পেশ করা অবশ্যই সঠিক এবং এটাই কুরআন শরীফ ও সুন্নাহ শরীফ সম্মত।

আর সূরা দুখানে ৩নং আয়াত শরীফ উনার মধ্যে উল্লিখিত ‘লাইলাতুম মুবারাকাহ’ বলতে ‘লাইলাতুল ক্বদরকে’ বুঝানো হয়নি বরং ‘লাইলাতুল বরাত’ বা ‘শবে বরাতকে’ বুঝানো হয়েছে।

কেননা, ‘লাইলাতুল ক্বদর’-এর মর্তবা ও ফযীলত সম্পর্কে মহান আল্লাহ পাক তিনি ‘সূরা ক্বদর’ নামে আলাদা একটি সূরাই নাযিল করেছেন। যার শানে নুযূল এবং ব্যাখ্যাও আলাদাভাবে বর্ণিত রয়েছে।

উক্ত ‘সূরা ক্বদরে’ মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন,

انا انزلنه فى ليلة القدر وما ادرك ما ليلة القدر ليلة القدر خير من الف شهر تنزل الملئكة والروح فيها باذن ربهم من كل امر سلم هى حتى مطلع الفجر.

অর্থঃ- “নিশ্চয়ই আমি কুরআন শরীফ নাযিল করেছি ক্বদরের রাত্রিতে। ক্বদরের রাত্রি সম্বন্ধে আপনি জানেন কি? শবে ক্বদর হলো এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। এ রাত্রিতে হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম ফেরেশতাগণ উনাদেরকে নিয়ে স্বীয় রবের নির্দেশক্রমে প্রত্যেক কাজের জন্য সালাম বা শান্তির পয়গাম নিয়ে অবর্তীণ হন এবং এ শান্তির পয়গাম ফযর পর্যন্ত অব্যাহিত থাকে।”

শানে নুযূল : হযরত ইবনে আবী হাতিম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার হতে বর্ণিত রয়েছে, হযরত রসূল নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি একবার বণী ইসরাইলের জনৈক মুজাহিদ সম্পর্কে আলোচনা করলেন। যিনি এক হাজার মাস পর্যন্ত অবিরাম জিহাদে মশগুল থাকেন এবং কখনো অস্ত্র সংবরণ করেননি। মুসলমানগণ একথা শুনে বিস্মিত হলে এ ‘সূরা ক্বদর’ অবর্তীণ হয়। এতে উম্মতে মুহম্মদীর জন্য শুধু এক রাত্রির ইবাদতই সেই মুজাহিদের এক হাজার মাসের ইবাদত অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ প্রতিপন্ন করা হয়েছে। (তাফসীরে মাযহারী)

ক্বদরের অর্থ ও ব্যাখ্যা : ‘ক্বদরের’ অর্থ হচ্ছে মাহাত্ম ও সম্মান। এ রাত্রির মাহাত্ম ও সম্মানের কারণে একে ‘লাইলাতুল ক্বদর’ তথা ‘মহিমান্বিত রাত’ বলা হয়। এ রাত্রিকে ‘ক্বদর’ বলার কারণ সম্পর্কে বর্ণিত রয়েছে, আমল না করার কারণে এর পূর্বে যার কোন সম্মান অর্জিত হয়না। যখন এ রাত্রিতে তওবা-ইস্তিগফার ও ইবাদত-বন্দিগী করা হয় তখনই ফযীলত ও সম্মান হাছিল হয়।

কাজেই লাইলাতুল ক্বদর বা শবে ক্বদর ও লাইলাতুল বরাত বা শবে বরাত একই রাত্রির নাম নয়। বরং উভয় রাত্রি দু’টিই আলাদা এবং যার বর্ণনাও কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আলাদাভাবেই বর্ণিত হয়েছে।

‘লাইলাতুল ক্বদরের’ কথা বর্ণিত রয়েছে সূরা ক্বদরে। আর ‘লাইলাতুল বরাতের’ কথা বর্ণনা করা হয়েছে সূরা দুখানে ‘লাইলাতুম মুবারাকাহ’ বা ‘বরকতময় রজনী’ হিসেবে।

সূরা দুখানে বর্ণিত ‘লাইলাতুম মুবারাকাহ’ দ্বারা যে ‘লাইলাতুল বরাত বা শবে বরাতকে’ বুঝানো হয়েছে তা প্রায় সকল বিশ্বখ্যাত ও নির্ভরযোগ্য তাফসীরে গ্রন্থেই বর্ণিত রয়েছে।

যেমন, সূরা দুখানে উল্লিখিত ليلة مباركة. (লাইলাতুম মুবারাকাহ)-এর ব্যাখ্যায় বিশ্বখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ “তাফসীরে মাযহারী”-এর ৮ম খণ্ডের ৩৬৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,

قال عكرمة هى ليلة النصف من شعبان يبرم فيه امر السنة.

অর্থাৎ- বিশিষ্ট ছাহাবী হযরত ইকরামা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন, ‘লাইলাতুম মুবারাকাহ’ হচ্ছে ‘শা’বানের মধ্যে রাত্রি’ অর্থাৎ ‘বরাতের রাত্রি’। এ রাতে সারা বছরের কাজ-কর্মের ফায়সালা করা হয়।

উক্ত আয়াত শরীফ উনার ব্যাখ্যায় রঈসুল মুফাসসিরীন হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন,

قد اخبر الله سبحانه عن هذه الليلة المباركة التى هى ليلة النصف من شعبان انه تعالى يفرق فيها كل امر من اموره المحكمة.

অর্থ: “মহান আল্লাহ পাক তিনি ‘লাইলাতুম মুবারাকাহ অর্থাৎ বরকতময় রাত্রি বলতে শা’বান মাসের মধ্য রাত অর্থাৎ শবে বরাতকে বুঝিয়েছেন। মহান আল্লাহ পাক তিনি এ রাতে সকল প্রজ্ঞা সম্পন্ন বিষয়ের ফায়সালা করে থাকেন।” (ছফওয়াতুত তাফাসীর)

বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ “তাফসীরে খাযিন’-এর ৪র্থ খণ্ডের ১১২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,

(انا انزلناه فى ليلة مباركة) هى ليلة النصف من شعبان.

অর্থ: “নিশ্চয়ই আমি এটা এক বরকতময় রাত্রিতে নাযিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ‘লাইলাতুম মুবারাকাহ’ হলো অর্ধ শা’বানের রাত তথা শবে বরাত।”

সুপ্রসিদ্ধ তাফসীর গ্রন্থ “তাফসীরে বাগবী”-এর ৬ষ্ঠ খণ্ডের ১৪৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,

(انا انزلناه فى ليلة مباركة) وقال اخرون ليلة النصف من شعبان.

অর্থাৎ “নিশ্চয়ই আমি এটা এক বরকতময় রাত্রিতে নাযিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। অসংখ্য রাবীগণ বলেন, ‘লাইলাতুম মুবারাকাহ’ তথা বরকতময় রাত্রি হচ্ছে অর্ধ শা’বানে রাত অর্থাৎ শবে বরাত।”

“তাফসীরে নাযমুদ দুরার”-এর ৭ম খণ্ডের ৬২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে, (ليلة مباركة) দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে, ليلة النصف من شعبان.

অর্থাৎ- অর্ধ শাবানের রাত তথা বরাতের রাত।”

তাফসীর জগতের সুবিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ “তাফসীরে কুরতুবী”-এর ৮ম খণ্ডের ১২৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,

قال عكرمة الليلة المباركة ههنا ليلة النصف من شعبان.

অর্থ: বিশিষ্ট ছাহাবী হযরত ইকরামা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন, লাইলাতুম মুবারাকাহ দ্বারা এখানে উদ্দেশ্যে হচ্ছে অর্ধ শাবানের রাত অর্থাৎ শবে বরাত।”

বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ “তাফসীরে লুবাব”-এর ১৭তম খণ্ডের ৩১০ ও ৩১১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,

(فيها) اى فى الليلة المباركة (يفرق) يفصل (كل امر حكيم) وقال عكرمة هى ليلة النصف من شعبان يقوم فيها امر السنة.

অর্থ: “ঐ বরকতময় রাত্রিতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ যাবতীয় বিষয়ের ফায়সালা করা হয়। বিশিষ্ট ছাহাবী হযরত ইকরামা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন, ‘লাইলাতুম মুবারাকাহ’ দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে অর্ধ শাবানের রাত তথা শবে বরাত। এ রাতে আগামী এক বছরের যাবতীয় বিষয়ের তালিকা প্রস্তুত করা হয়।”

তাফসীর জগতের সুবিখ্যাত ও সুপ্রসিদ্ধ তাফসীর “তাফসীরে ইবনে কাছীর”-এর ৪র্থ খণ্ডের ২১০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,

ومن قال انها ليلة النصف من شعبان كما روى عن عكرمة … والحديث الذى رواه عبد الله بن صالح عن الليث عن عقيل عن الزهرى اخبرنى عثمان بن محمد بن المغيرة الاخنس قال ان رسول الله صلى الله عليه وسلم قال تقطع الاجال من شعبان الى شعبان حتى ان الرجل لينكح ويولد له وقد اخرج اسمه فى الموتى.

অর্থ: “যারা বলেন যে, লাইলাতুম মুবারাকাহ দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে অর্ধ শাবানের রাত তথা শবে বরাত। যেমন, উনারা দলীল হিসেবে পেশ করেন হযরত ইকরামা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার বর্ণিত হাদীছ শরীফখানা।

তাছাড়াও আরো হাদীছ শরীফ রয়েছে যেমন, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ছারেহ রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত লাইছ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাদের থেকে বর্ণনা করেন, তিনি হযরত আক্বীদা রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার থেকে তিনি হযরত ইমাম যুহরী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার থেকে বর্ণনা করেন।

তিনি বলেন, আমাদের কাছে হযরত উছমান ইবনে মুহম্মদ ইবনে মুগীরা ইবনে আখনাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বর্ণনা করেছেন।

তিনি বলেন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, এক শাবান মাস থেকে পরবর্তী শাবান মাস পর্যন্ত অর্থাৎ ১৫ই শা’বান হতে পরবর্তী ১৫ই শা’বান পর্যন্ত মৃত্যুদের তালিকা প্রস্তুত করা হয়, এমনকি ব্যক্তির বিবাহ এবং সেই বৎসর তার কি সন্তান জন্মলাভ করবে এবং সেই বৎসর কখন মৃত্যুবরণ করবে তার যাবতীয় তালিকাও প্রস্তুত করা হয় এই শবে বরাতে।”

উপরোক্ত বিশ্বখ্যাত, সুপ্রসিদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য তাফসীরগ্রন্থসমূহ ছাড়াও তাফসীরে আবী সউদ, বাইযাবী, দুররে মানছূর, তাফসীরে জালালাইন কামালাইন, তাফসীরে তাবারী, তাফসীরে গরায়িব, রহুল বয়ান, রুহুল মায়ানী, যাদুল মাছীর, তাফসীরে আল মুহাররারুল ওয়াজিয, তাফসীরে মাওয়াহিব, .. হাশিয়ায়ে শিহাব, তাফসীরে ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, তাফসীরে দুররে মাছূন, তাফসীরে কাশশাফ, তাফসীরে দিয়াউল কুরআন, আহকামুল কুরআন, তাফসীরে কাসীমী, তাফসীরে মিযান, তাফসীরে মাওয়ারদী, নূরুল ইরফান, তাফহীমুল কুরআন ইত্যাদি তাফসীরগ্রন্থে ‘লাইলাতুম মুবারাকাহ’ দ্বারা ‘লাইলাতুল বরাত’ বা ‘শবে বরাতকে’ বুঝানো হয়েছে। (চলবে)

মুহম্মদ আলীনূর রহমান

রাঙ্গাদিয়া, চট্টগ্রাম।

সুওয়ালঃ  হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে প্রকাশিত অখ্যাত মাসিক পত্রিকা জানুয়ারী/২০০৪ ঈসায়ী সংখ্যায় জিজ্ঞাসা-সমাধান বিভাগে নিম্নোক্ত জিজ্ঞাসা-সমাধান ছাপা হয়-

জিজ্ঞাসাঃ আযান-ইক্বামতের সময় যখন ‘আশ্হাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ্’ বলা হয়, তখন কিছু লোককে দেখা যায়, তারা তাদের হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলদ্বয় চুম্বন করে চোখ মাসেহ্ করেন। এটা কতটুকু শরীয়ত সম্মত?

সমাধানঃ এ কাজটি সহীহ্ কোন হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত নয়। কাজেই ইবাদত ও সাওয়াবের নিয়্যাতে এটি করা বিদ্আত।…..

হাটহাজারীর উক্ত অখ্যাত মাসিক পত্রিকা এপ্রিল/২০০৪ ঈসায়ী সংখ্যায় জিজ্ঞাসা-সমাধান বিভাগে আরো বলা হয়েছে, “আযান-ইক্বামতে হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম শুনে বা দরূদ শরীফ পড়ে উভয় হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলিতে ফুঁ দিয়ে বা চুমু দিয়ে সুন্নাত জেনে সাওয়াব বা ফযিলতের উদ্দেশ্যে চোখে লাগানো জায়েয নেই। ….”

এখন আমার সুওয়াল হলো-  “আযান ও ইক্বামতে আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রসূলুল্লাহ্” (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলার সময় উভয় হাতের দুই বৃদ্ধাঙ্গুলীতে চুমু খেয়ে চোখে লাগানোর প্রমাণ সহীহ্ হাদীসে আছে কি? আর সহীহ্ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত না হলেই কি তা বিদ্য়াত? আর এ সম্পর্কে  হাটহাজারীর অখ্যাত পত্রিকার উক্ত বক্তব্য সঠিক হয়েছে কি? নির্ভরযোগ্য দলীল-আদিল্লার ভিত্তিতে সঠিক জাওয়াব  জানিয়ে বাধিত করবেন।

জাওয়াবঃ হাটহাজারী মাদরাসার উক্ত পত্রিকার উল্লিখিত বক্তব্য ডাহা মিথ্যা, মানগড়া, বিভ্রান্তিকর, জেহালতপূর্ণ ও ক্ষেত্র বিশেষে কুফরীমূলক হয়েছে। তাদের উক্ত বক্তব্য এটাই প্রমাণ করে যে, তারা হাদীছ শরীফ ও তার উছূল সম্পর্কে নেহায়েতই অজ্ঞ।

কাজেই মূর্খ বা অজ্ঞ লোককে কোন বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তার জবাব যেমন হওয়া দরকার এখানেও ঠিক তেমনি হয়েছে।

(ধারাবাহিক)

পূর্ববর্তী সংখ্যায় দলীলভিত্তিক আলোচনা দ্বারা সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হয়েছে যে, “আযান ও ইক্বামতে আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রসূলুল্লাহ” (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলার সময় উভয় বৃদ্ধাঙ্গুলী বুছা দিয়ে চোখে লাগানোর ব্যাপারে উল্লিখিত হাদীছ শরীফখানা ছহীহ।

অনুসরণীয় ইমাম-মুজতাহিদ, মুহাদ্দিসীন, সলফে-ছালেহীন, আউলিয়ায়ে কিরাম, ও ফুকাহায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণ উনাদের স্ব-স্ব কিতাবে “আযানের সময় অঙ্গুলী চুম্বন করা সম্পর্কিত হাদীছ শরীফ উনাকে মারফু ও মাওকুফ হিসেবে ছহীহ বলে উল্লেখ করেছেন।”

শুধু তাই নয়, যদি উক্ত হাদীছ শরীফ উনাকে জঈফও ধরে নেয়া হয় তথাপিও তার দ্বারা ‘অঙ্গুলী চুম্বন’ মুস্তাহাব-সুন্নত প্রমাণিত হয়। যার প্রমাণ পূর্বে পেশ করা হয়েছে। এছাড়াও আরো বহু প্রমাণ বিদ্যমান রয়েছে।

(৩)

তৃতীয়ত : উক্ত পত্রিকায় আরো লেখা হয়েছে, “… সুন্নাত জেনে সাওয়াব বা ফযিলতের উদ্দেশ্যে চোখে লাগানো জায়েয নেই। …..”

এর জবাবে বলতে হয় যে, তাদের উল্লিখিত বক্তব্যটি কুফরীমূলক হয়েছে। কারণ, আযান, ইক্বামতের সময় ‘অঙ্গুলী চুম্বন’ সুন্নত; যা ছহীহ হাদীছ শরীফ দ্বারাও প্রমাণিত।

তাই সুন্নতকে সুন্নত জেনেই আমল করতে হবে। কেননা, সুন্নতকে সুন্নত না জানা বা অস্বীকার করা কুফরী। ‘অঙ্গুলী চুম্বন’ যে খাছ সুন্নত নি¤েœ তার আরো কিছু প্রমাণ পেশ করা হলো-

যেমন, “তাফসীরে রুহুল বয়ানের” ৭ম খণ্ডের ২২৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,

উর্দূ কম্পোজ করতে হবে

অর্থ: “মুহীত” কিতাবে উল্লেখ আছে যে, হযরত নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি মসজিদে তাশরীফ এনে একটি স্তম্ভের নিকট বসেছিলেন, উনার পাশে হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক আলাইহিস সালাম তিনি বসেছিলেন। এর মধ্যে হযরত বিলাল রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি আযান শুরু করলেন, যখন-

اشهد ان محمدا رسول الله.

(আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রসূলুল্লাহ)

উচ্চারণ করলেন তখন হযরত আবু বকর ছিদ্দীক আলাইহিস সালাম তিনি আপন বৃদ্ধাঙ্গুলীদ্বয়ের নখ চুম্বন করে আপন দু’চোখের উপর রেখে বললেন,

قرة عينى بك يا رسول الله.

(কুররাতু আইনী বিকা ইয়া রসূলাল্লাহ)

অর্থ: “হে রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনি আমার চোখের মণি।”

হযরত বিলাল রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার আযান শেষ হওয়ার পর হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, “হে আবূ বকর ছিদ্দীক আলাইহিস সালাম! আপনি যা করেছেন, যে ব্যক্তি তদ্রুপ করবে, মহান আল্লাহ পাক তিনি তার সমূদয় গুণাহ মাফ করে দিবেন।” (সুবহানাল্লাহ)

উপরোক্ত বর্ণনা থেকে প্রমাণিত হলো যে, এ আমল সর্ব প্রথম করেন হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক আলাইহিস সালাম। তাই এটা সুন্নত অর্থাৎ সুন্নতে ছাহাবা।

এ প্রসঙ্গে ফিক্বাহের বিখ্যাত কিতাব “তাহতাবীতে” উল্লেখ আছে,

والسنة ما فعل النبى صلى الله عليه وسلم او واحد من اصحابه.

অর্থ: “সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিয়্যীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি অথবা উনার ছাহাবীগণ উনাদের মধ্য হতে কোন একজন ছাহাবী যে কাজ করেছেন সেটাই সুন্নত।”

আর হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে-

عليكم بسنتى وسنة الخلفاء الراشدين المهديين تمسكوابها وعضوا عليها بالنواجذ.

অর্থ: “আমার সুন্নত এবং হেদায়েতপ্রাপ্ত হযরত খোলাফায়ে রাশেদীন (তথা হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ উনাদের) এর সুন্নত পালন করা তোমাদের প্রতি ওয়াজিব। তোমরা তা মজবুত ভাবে মাড়ীর দাঁত দিয়ে আঁকড়ে ধর।” (মিশকাত শরীফ)

আরো উল্লেখ্য যে, উক্ত আমল শুধু সুন্নতে ছাহাবাই নয় বরং পরোক্ষভাবে তা সুন্নতে রসূলও। (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কেননা হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক আলাইহিস সালাম তিনি স্বয়ং নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার উপস্থিতিতে এবং উনারই সামনে আঙ্গুলী চুম্বন করে চোখে লাগিয়েছেন এবং হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি তা সমর্থন করেছেন এবং বলেছেন, হে আবূ বকর ছিদ্দীক আলাইহিস সালাম “আপনি যা করেছেন যে ব্যক্তি অনুরূপ করবে মহান আল্লাহ পাক তিনি তার সমস্ত গুণাহ মাফ করবেন। (সুবহানাল্লাহ)

তাই “আযান ও ইক্বামতে ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রসূলুল্লাহ” (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলার সময় উভয় হাতের দুই বৃদ্ধাঙ্গুলীতে চুমু খেয়ে চোখে লাগানো সুন্নত। অর্থাৎ সুন্নতে রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সুন্নতে ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং এটাকে সুন্নত জেনে বা মনে করে এবং ফযীলত তথা মহান আল্লাহ পাক ও উনার হাবীব নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার খাছ সুন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে আমল করা জায়িয তো অবশ্যই বরং খাছ সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত। আর সুন্নতের ফযীলত সম্পর্কে হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে,

من تمسك بسنتى عند فساد امتى فله اجر مأة شهيد.

অর্থ: “যে ব্যক্তি আমার উম্মতের ফিৎনা-ফাসাদের যামানায় একটি সুন্নতকে আঁকড়ে ধরে থাকবে, সে ব্যক্তি একশত শহীদের ফযীলত পাবে।” (বাইহাক্বী, মিশকাত, মিরকাত, লুময়াত, ত্বীবী, মুযাহিরে হক্ব)

এখন কেউ যদি সুন্নতকে ইহানত করে, অবজ্ঞা করে, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে, বিদয়াত-নাজায়িয বলে, তাহলে সেটা কুফরী হবে। এ প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে,

لو تركتم سنة نبيكم لكفرتم.

অর্থ: “যদি তোমরা তোমাদের নবী হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সুন্নতকে তরক (অস্বীকার) কর তাহলে অবশ্যই তোমরা কাফির হবে।” (আবূ দাউদ)

আরো ইরশাদ মুবারক হয়েছে,

لو تركتم سنة نبيكم لضللتم.

অর্থ: “যদি তোমরা তোমাদের নবী হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সুন্নতকে তরক (অস্বীকার) কর তাহলে অবশ্যই তোমরা পথভ্রষ্ট হয়ে যাবে।” (দারিমী)

আকাঈদের কিতাবে উল্লেখ আছে,

اهانة السنة كفر.

অর্থ: “সুন্নতকে ইহানত বা অবজ্ঞা করা কুফরী।”

উপরোক্ত দলীলভিত্তিক বর্ণনা দ্বারা এটাই প্রমানিত হলো, হাটহাজারী মৌলভী সাহেবদের উক্ত বক্তব্য সম্পূর্ণরূপে ডাহা মিথ্যা, এবং সুন্নত আমলকে নাজায়িয ও বিদয়াত বলার কারণে কুফরী হয়েছে।

[বি: দ্র:- এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হলে মাসিক আল বাইয়্যিনাত-এর ১ম বর্ষ ৩য় সংখ্যার “অঙ্গুলী চুম্বনের বিধান ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া” পাঠ করুন। এবং বিশেষ করে ১১, ১৪, ৩৭, ৪৭, ৫৩, ৭৬, ৮৩, ৯৯ ও ১২০তম সংখ্যাগুলো পাঠ করুন।]

[বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, এবার পঞ্চমবারের মত হাটজাহারীর পত্রিকার ভুল বক্তব্য খণ্ডন করে সঠিক জাওয়াব দেয়া হলো]

{দলীলসমূহ: (১) তাফসীরে জালালাইন, (২) তাফসীরে রুহুল বয়ান, (৩) দাইলামী শরীফ, (৪) মাজমাউল বিহার, (৫) মজমুয়ায়ে ফতওয়া, (৬) মুহীত, (৭) ইয়ানাতুত তারিবীন আলা হাল্লি আলফাযি ফাতহিল মুবীন, (৮) কিফায়াতুত তালিবির রব্বানী লি রিসালাতি আবি যায়িদিল কায়রুয়ানী, (৯) মুনিরুল আইন ফী তাকবীলুল ইবহামাইন (১০) নাহজুস সালামাহ ফী তাক্ববীলিল ইবহামাইনে ফিল ইক্বামাহ, (১১) ছলাতে নখশী, (১২) হুজ্জাতুল্লাহি আলাল আলামীন, (১৩) কুওয়াতুল কুলুব (১৪) কিতাবুন নিয়ামুল ইনতিবাহ (১৫) ফতওয়ায়ে খজানাতুর রিওয়ায়িত (১৬) ফতওয়ায়ে সিরাজুম মুনীর (১৭) ফতওয়ায়ে মিফতাহুল যিনান (১৮) জামিউর রুমুয (১৯) কানযুল ইবাদ (২০) কাহেস্তানী (২১) বাহরুর রায়িক (২২) শরহে নিকায়া (২৩) ফতওয়ায়ে ছিদ্দীক্বিয়া (২৪) ফতওয়ায়ে বরকতিয়া (২৫) মারাকিউল ফালাহ (২৬) হাওয়াশিউল বাহার লির রমলী (২৭) ফতওয়ায়ে সুফীয়া (২৮) মাকাসিদুল হাসানা (২৯) শরহে কবীর (৩০) শরহে ইলিয়াছ (৩১) ফতওয়ায়ে শামী (৩২) তরীকুল ইসলাম (৩৩) ফতওয়ায়ে দেওবন্দ (৩৪) আহসানুল ফতওয়া ইত্যাদি।}

মুসাম্মত সানজিদা আক্তার

সভানেত্রী- ছাত্রী আঞ্জুমানে আল বাইয়্যিনাত

মুহম্মদপুর, ঢাকা।

সুওয়ালঃ অখ্যাত মাসিক রাহমানী পয়গাম এপ্রিল/২০০৩ ঈসায়ী সংখ্যায় জিজ্ঞাসার-জবাব বিভাগে নিম্নোক্ত ১২৪৭নং জিজ্ঞাসার-জবাব ছাপা হয়-

জিজ্ঞাসা ঃ সাহাবী আবু সাঈদ খুদরী ও আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা বলেন যে, রাসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন আমার মৃত্যুর পর পূর্ব দেশগুলির মধ্য হতে কোন একটি দেশ থেকে আমার উম্মতের ভিতর হতে একটি দল বের হবে। এই দলের সদস্যগণ হবে অশিক্ষিত ও মূর্খ। এদের মধ্যে কোন শিক্ষিত লোক গেলে সেও হয়ে যাবে মূর্খের মত। তাদের বক্তৃতা হবে বহু বহু গুণের ফজিলতের। তাদের মত বক্তৃতা বা বয়ান কারো হবে না। তাদের সকল আমল হবে খুবই নিখূঁত ও সুন্দর। তাদের নামাযের তুলনায় তোমরা তোমাদের নামাযকে তুচ্ছ মনে করবে, তাদের রোযা দেখে তোমাদের রোযাকে তোমরা তুচ্ছ ও নগণ্য মনে করবে। তাদের আমল দেখে তোমরা তোমাদের আমলকে হেয় মনে করবে, তারা কুরআন পড়বে কিন্তু তা তাদের গলার নিচে যাবেনা। তারা কুরআনের উপর আমল কিম্বা কুরআন-প্রতিষ্ঠার একটু চেষ্টাও করবে না কখনো। এদলের আমল যতই তোমাদেরকে আকৃষ্ট করুক না কেন, কখনই তাদের দলে যাবেনা। কারণ প্রকৃতপক্ষে এরা হবে ইসলাম হতে খারিজ, দ্বীন হতে বহির্ভূত। তীর যেমন ধনুক হতে বের হয়ে যায় সে আর কখনও ধনুকের নিকট ফিরে আসেনা। তেমনিই এরা দ্বীন থেকে বেরিয়ে যাবে, আর কখনও দ্বীনের পথে, কুরআন ও সুন্নাহ্র পথে ফিরে আসবেনা।

আমার প্রশ্ন হল, উপরোক্ত হাদীছ ছহীহ্ কি-না? ছহীহ্ হলে এ দ্বারা উদ্দেশ্য কারা? উক্ত হাদীসের সাথে তাবলীগ জামাতের কোন সম্পর্ক আছে কি-না? অনেকে এই হাদীসের সাথে তাবলীগ জামাতকে জড়াতে চান। উক্ত হাদীসের সঙ্গে তাবলীগ জামাতকে জড়ানো সঠিক কি-না?

জবাবঃ প্রশ্নে বর্ণিত হাদীছ ছহীহ্। মুহাদ্দিছীনে কেরাম উক্ত হাদীছসহ এ জাতীয় হাদীছসমূহের ব্যাখ্যায় বলেছেন যে, এ সব হাদীছ দ্বারা একটি নির্ধারিত জামাত বা খারিজী ফেরক্বা নামে পরিচিত তাদেরকে বুঝানো হয়েছে। হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এর খিলাফত আমলে এই হাদীছসমূহের বাস্তবতা এবং খাওয়ারেজদের অবস্থার সমন্বয় ঘটেছিল। যার দ্বারা একথা সুস্পষ্টভাবে বলা চলে যে, এ হাদীছসমূহ দ্বারা একমাত্র খাওয়ারেজদেরকেই বুঝানো হয়েছে। সুনির্দিষ্ট কোন প্রমাণাদি ছাড়া অন্য কোন জামাতকে এই হাদীসের অন্তর্ভুক্ত করা যাবেনা।

কোন প্রকার প্রমাণ ছাড়া তাবলীগ জামাতকে এই হাদীছসমূহের মেসদাক বা উদ্দেশ্য বানানো, তাদেরকে খাওয়ারেজ বলা শরীয়তের দৃষ্টিতে মারাত্মক অন্যায় ও অপরাধ। তাবলীগের নিয়মনীতি ও কার্যক্রম পুরোপুরি শরীয়তসম্মত। ইসলাম পরিপন্থী কোন কিছু এতে নেই। বর্তমান বিশ্বে আল্লাহ্ তা’আলা তাবলীগ জামাতের মাধ্যমে পথহারা, ঈমানহারা, হেদায়েত থেকে বঞ্চিত অসংখ্য মানুষকে হেদায়েত করেছেন, ঈমান আনার তাওফিক দান করেছেন। এছাড়া এ জামাতের পৃষ্ঠপোষকতায় রয়েছে অসংখ্য জগদ্বিখ্যাত আলেম ও ইসলামী চিন্তাবিদ।

অতএব, তাবলীগ জামাতকে খারেজী জামাত বলা, মিথ্যা অপবাদ বৈ কিছুই নয়। (ফতহুল বারী ১২ঃ৩৫০, আল মিরকাত ৭ঃ১০৭)

উক্ত অখ্যাত পত্রিকার উল্লিখিত “জিজ্ঞাসা-জবাবের” প্রেক্ষিতে আমার সুওয়াল বা জানার বিষয় হলো-

(১) উল্লিখিত হাদীছ শরীফে বর্ণিত গুণাবলী প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগীদের মধ্যে আছে কি?

(২) উল্লিখিত হাদীছ শরীফ দ্বারা কি শুধু খারিজী ফিরক্বার লোকদেরকেই বুঝানো হয়েছে? নাকি খারিজীদের ন্যায় আক্বীদা পোষণকারীদের ক্ষেত্রেও এ হাদীছ শরীফ প্রযোজ্য?

(৩) প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগীদের মধ্যে শরীয়ত বিরোধী বা ইসলাম পরিপন্থী কোন নিয়মনীতি বা আক্বীদা, আমল নেই, এটা কতটুকু সত্য?

(৪) প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগের পৃষ্ঠপোষকতায় বা পরিচালনায় যারা রয়েছে তারা সকলেই হক্কানী আলিম, এ দাবী কতটুকু সঠিক? আসলে হক্কানী আলিমের সংজ্ঞা বা পরিচিতি কি?

(৫) কুরআন-সুন্নাহ্র কোথাও প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগ করার নির্দেশ আছে কি? প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগ করা কুরআন-সুন্নাহ্ মতে জায়িয কিনা?

কুরআন, সুন্নাহ্, ইজমা ও ক্বিয়াসের দৃষ্টিতে দলীলভিত্তিক জাওয়াব দিয়ে আমাদের আক্বীদা, আমল হিফাযতে সহায়তা করবেন বলে আমরা আশাবাদী।

জাওয়াবঃ প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগ জামায়াত সম্পর্কিত উক্ত অখ্যাত পত্রিকার জবাব শুদ্ধ হয়নি। বরং ভুল, মনগড়া ও দলীলবিহীন হয়েছে।

শুধু তাই নয়, তারা প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগীদের সাফাই গাইতে গিয়ে বর্ণিত হাদীছ শরীফের অপব্যাখ্যা করেছে। সাথে সাথে “ছয় উছূলীদের মধ্যে কুরআন-সুন্নাহ্ বিরোধী কোন আক্বীদা-আমল নেই” বলে তাদের নির্লজ্জ দালালী করে নিজেদেরকে অপব্যাখ্যাকারী ও মিথ্যাবাদীরূপে সাব্যস্ত করেছে। সুওয়ালে উল্লিখিত বিষয়গুলোর ধারাবাহিক দলীলভিত্তিক আলোচনা করলেই তা আরো সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হবে।

তাই নিম্নে সুওয়ালে বর্ণিত বিষয়গুলোর দলীলভিত্তিক জাওয়াব দেয়া হলো-

(ধারাবাহিক)

ছয় উছূলী তাবলীগ সম্পর্কে প্রশ্নে

উল্লিখিত অখ্যাত পত্রিকার অপব্যাখ্যা

ও মিথ্যাচারীতার খণ্ডনমূলক জবাব-৩

প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগ সম্পর্কে অখ্যাত পত্রিকার ‘জিজ্ঞাসার জবাবের’ প্রেক্ষিতে আপনার তৃতীয় সুওয়াল হলো- “(৩) প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগীদের মধ্যে শরীয়ত বিরোধী বা ইসলাম পরিপন্থী কোন নিয়মনীতি বা আক্বীদা-আমল নেই, এটা কতটুকু সত্য?”

আপনার উক্ত সুওয়ালের প্রেক্ষিতে বলতে হয় যে, অখ্যাত পত্রিকার উক্ত বক্তব্য মোটেও সত্য নয়, কেননা প্রচলিত ছয় উছূলীদের মধ্যে একটি দু’টি নয়, বরং অসংখ্য কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী নিয়মনীতি বা আক্বীদা-আমল ও বক্তব্য রয়েছে, যা তাদের মুরুব্বীদের লিখা কিতাবাদিতেই বিদ্যমান রয়েছে। তাই নিম্নে ধারাবাহিকভাবে, পর্যায়ক্রমে প্রচলিত ছয় উছূলীদের কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী ও কুফরীমূলক বক্তব্যগুলোর সাথে সাথে কুরআন-সুন্নাহ্র দৃষ্টিতে তার সঠিক ফায়সালা তুলে ধরা হলো-

প্রচলিত ছয় উছূলীদের কুরআন-সুন্নাহ

বিরোধী কুফরীমূলক বক্তব্য- ১৩

প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকদের আক্বীদা হলো যে, “সূরা ফাতিহার মধ্যে দোয়াল্লীন-এর স্থলে যোয়াল্লীন পড়াই শুদ্ধ মত।” (তাবলীগে ইসলাম বা দ্বীনের দাওয়াত ৩৫ পৃষ্ঠা, লেখক- আ: সাত্তার ত্রিশালী)

“দোয়াল্লীন-যোয়াল্লীন” সম্পর্কে তাবলীগ জামায়াতের লোক মাওলানা আব্দুস সাত্তার ত্রিশালী যে বক্তব্য পেশ করেছে, তা সম্পূর্ণই কুরআন শরীফ সুন্নাহ শরীফ বিরোধী ও নির্ভরযোগ্য সকল ফতওয়া ও ফিক্বাহের কিতাবের সম্পূর্ণ বিপরীত। উপরন্তু নামায ফাসিদ বা বিনষ্ট হওয়ার কারণ। কেননা দোয়াল্লীনকে যোয়াল্লীন, মাগদুবকে মাগজুব অর্থাৎ ض (দোয়াদ) কে د (দাল) ইত্যাদি অক্ষর পরিবর্তন করে পড়লে অর্থের পরিবর্তন হওয়ার কারণে লাহনে জলী হবে ও নামায বাতিল হয়ে যাবে।

কেননা “শামী” কিতাবের ১ খণ্ডের ৬৫৯ পৃষ্ঠায় ও “মারাকিউল ফালাহ” কিতাবের টিকা “তাহতাবী” কিতাবের ১৯৮নং পৃষ্ঠায় লিখিত রয়েছে, “যদি কেউ এক অক্ষরের স্থলে অন্য অক্ষর পরিবর্তন করে, এক্ষেত্রে যদি উক্ত শব্দের মর্ম অতিরিক্ত বিকৃত হয়ে পড়ে কিংবা উক্ত শব্দ অর্থশূণ্য হয়ে পড়ে, তবে উক্ত শব্দ কুরআন শরীফ উনার অন্যস্থলে থাকুক আর না থাকুক তাতে নামায বাতিল হয়ে যাবে।”

কাজেই ضالين কে دالين পড়লে অর্থের পরিবর্তন হয়। যেমন- ولا الضالين অর্থ- ‘পথভ্রষ্টদের পথ নয়।’

আর ولا الدالين. অর্থ- ‘পথ প্রদর্শনকারীদের পথ নয়।’ যা সম্পূর্ণ উল্টো অর্থ। আর এরূপ পড়লে কুফরী হবে। যেমন “ফিক্বহে আকবর” কিতাবের টিকার ২০৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,

فى المحيط سئل الامام الفضلى عمن يقرأ الظاء المعجمة مكان الضاد المعجمة او يفرأ الصحاب الجنة مكان اصحاب النار او على العكس فقال لايجوز امامته ولو تعمد يكفر قلت اماكون تعمده كفرا فلا كلام فيه.

অর্থ: ‘মুহীত’ কিতাবে আছে, হযরত ইমাম ফজলী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি জিজ্ঞাসিত হয়েছিলেন, কোন ব্যক্তি দোয়াদ-এর স্থলে জোয়া পড়ে কিম্বা “আছহাবুল” জান্নাহ-এর স্থলে “আছহাবুন্নার” পড়ে অথবা তার বিপরীত (পড়ে) তার সম্পর্কে। তদুত্তরে তিনি বলেছিলেন, তার ইমামতি করা জায়িয নেই। আর যদি সে স্বেচ্ছায় এরূপ করে, তবে সে কাফির হবে।

আল্লামা মুল্লা আলী ক্বারী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, স্বেচ্ছায় এরূপ পড়লে সে কাফির হবে, এতে মতভেদ নেই।”

ফিক্বাহর বিখ্যাত কিতাব “তাহজীব” কিতাবে উল্লেখ আছে,

ولو قرأ الضاد مكان الظاء او على العكس تفسد صلاته عند ابى حنيفة ومحمد رحمة الله عليهما.

অর্থ: “যদি কেউ দোয়াদকে জোয়ার স্থলে অথবা জোয়াকে দোয়াদ-এর স্থলে পড়ে, তবে ইমাম আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি ও মুহম্মদ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাদের মতে তার নামায বাতিল হবে।”

প্রসিদ্ধ ফিক্বাহর কিতাব “ফতওয়ায়ে সিরাজিয়ার” ২১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,

ولا قرأ ولا الضالين بالدان او بالظاء عند عامة المشاتخ تفسد صلاته.

অর্থ: “অধিকাংশ ফক্বীহগণ উনাদের মতে যদি কেউ ولا الضالين -এর (দোয়াদকে) ذ (যাল) অথবা ظ (জোয়া)-এর দ্বারা পরিবর্তন করে পড়ে, তবে তার নামায বাতিল হয়ে যাবে।”

বিশ্বখ্যাত ফিক্বাহর কিতাব “মুনইয়াতুল মুছাল্লী” কিতাবে লিখা হয়েছে,

أما اذا قرأ الضاد او على القلب تفسد صلاته عليه اكثر الائمة.

অর্থ: “অধিকাংশ ইমামগণ উনাদের মতে যখন কেউ ذال (যাল)-এর স্থলে ظاء (যোয়া) অথবা ض (দোয়াদ)-এর স্থলে ظاء (যোয়া) অথবা তার বিপরীত পড়ে, তবে তার নামায বাতিল হয়ে যাবে।”

ফিক্বাহর মশহুর কিতাব “খাজানাতুল আকমাল” কিতাবে উল্লেখ আছে,

اذ قرأ مكان الظاء ضادا او مكان الضاد ظاء فقال القاضى المحسن الاحسن ان يقال ان نعمد ذلك تبطل صلاته عالما كان او جاهلا.

অর্থ: “যদি কেউ ‘জোয়া’-এর স্থলে দোয়াদ কিম্বা দোয়াদ-এর স্থলে জোয়া পড়ে, তবে কাজী মুহসীন বলেছেন, (এ সম্বন্ধে) এরূপ মত প্রকাশ করা উত্তম যে, যদি স্বেচ্ছায় এরূপ করে, তবে আলেম হোক, আর বেইলম (নিরক্ষর) হোক, তার নামায বাতিল হয়ে যাবে।)

ফিক্বাহর নির্ভরযোগ্য কিতাব “কাজীখান” কিতাবের ৬৯ পৃষ্ঠায়, “কবীরী” কিতাবের ৪৪৯ পৃষ্ঠায়, “ছগীরী” কিতাবের ২৪৬/২৪৭ পৃষ্ঠায় ও “কুবীরী” কিতাবের হাশিয়া “হুলইয়ার” ৪৬০ পৃষ্ঠায় লিখিত আছে,

ولو قرأ غير المغضوب عليهم بالظاء والذال تفسد صلاته الخ.

অর্থ: “যদি কেউ জোয়া বা জাল দ্বারা মাগজুব পড়ে, তবে তার নামায বাতিল হবে, কেননা তা অর্থহীন শব্দ হয়ে পড়ে।”

“খুলাছাতুল ফতওয়া”-এর ১ম খ- ১০/১০৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,

لو قراء المغضوب بالظاء او بالذال يفسد والمغضوب بالزاء يفسد.

অর্থ: “যদি জোয়া, জাল কিম্বা যা দ্বারা মাগজুব পড়ে, তবে নামায বাতিল হবে।” অনুরূপ ফতওয়া “বুরহান” নামক কিতাবের ২৬২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে।

“কাজীখান” কিতাবের ৬৯ পৃষ্ঠায় লিখিত আছে,

ولو قرأ الدالين بالدال تفسد صلوته.

অর্থ: “যদি কেউ দাল দ্বারা দাল্লীন পড়ে, তবে তার নামায বাতিল হবে।”

মশহুর ফিক্বাহর কিতাব “শামী” কিতাবের ১ম খণ্ডের ৬৬২ পৃষ্ঠায উল্লেখ আছে যে,

وفى الخزانة الاكمل قال القاضى ابو عاصم ان تعمد تفسد.

অর্থ: “খাজানাতুল আকমাল” কিতাবে আছে, কাজী আবু আছেম বলেন, যদি স্বেচ্ছায় এরূপ অক্ষর পরিবর্তন করে, তবে নামায বাতিল হবে।”

বিখ্যাত ও গ্রহণযোগ্য কিতাব “ফতওয়ায়ে আলমগীরী” ৮৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে,

قال القاضى الامام ابو الحسن والقاضى الامام ابو عاصم ان تعمد فسدت وان جرى على لساله او كان لايعرف النميز لاتفسد وهو اعدل الاقاويل والمختار.

অর্থ: “কাজী ইমাম আবুল হাসান ও কাজী ইমাম আবু আছেম বলেছেন, যদি স্বেচ্ছায় এরূপ অক্ষর পরিবর্তন করে, তবে নামায বাতিল হবে। আর যদি (অনিচ্ছায়) তার মুখ হতে এরূপ বের হয়ে পড়ে, কিংবা পার্থক্য করতে না জানে (অর্থাৎ অজ্ঞতাবশতঃ এক অক্ষরের স্থলে অন্য অক্ষর উচ্চারণ করে ফেলে) তবে তার নামায বাতিল হবেনা। এটাই সমস্ত মতের মধ্যে উৎকৃষ্ট ও মনোনীত মত (অর্থাৎ ফতওয়া গ্রাহ্য মত)।”

উপরোক্ত কিতাবসমূহের বর্ণনা ছাড়াও নি¤েœাক্ত সকল কিতাবসমূহে দোয়াল্লীন-এর পক্ষে মত পেশ করা হয়েছে, যেমন- তাফসীরে আযীযী, জাযরী, গায়াতুল বয়ান, কাওয়ায়েদে সামারকান্দ, তাহতাবী, ফতওয়ায়ে সিরাজিয়া, হুলইয়া, আলমগীরী, খাজানাতুল আহকাম, খাজানাতুল আকমাল, কাজীখান, খুলাছাতুল ফতওয়া, কবীরী, ছগীরী, ফতহুল ক্বাদীর, তাহতাবী, বাযযাযীয়া, ফতওয়ায়ে বুরহান শাফিয়া, নিজামীয়া ইত্যাদি।)

অতএব, প্রমাণিত হলো যে, নামাযের মধ্যে দোয়াল্লীন-এর স্থলে জোয়াল্লীন পড়লে লাহনে জলী হবে, নামায ফাসিদ হবে, ইচ্ছাকৃতভাবে এরূপ অক্ষর পরিবর্তন করে পড়লে কুফরী হবে এবং যে এরূপ পড়বে, তার ইমামতি করা জায়িয হবেনা, তার পিছনে নামায পড়লে নামায হবে না। অর্থাৎ “দোয়াল্লীনের” মতটিই ছহীহ ও গ্রহণযোগ্য মত। এর বিপরীত মত পেশ করা সম্পূর্ণ হারাম। কাজেই এ ব্যাপারে প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকের উপরোক্ত বক্তব্য সম্পূর্ণ মনগড়া, বানোয়াট, বিভ্রান্তিকর, অজ্ঞতামূলক ও দলীলবিহীন এবং তা অনুসরণ করা নামায ফাসিদ হওয়া সহ খাছ কবীরা গুণাহের কারণ। আর ক্ষেত্র বিশেষে কুরআন শরীফ, সুন্নাহ বিরোধী হওয়ার কারণে কুফরীর অন্তর্ভুক্ত।

সুতরাং প্রমাণিত হলো যে, ছয় উছূলীদের এ আক্বীদা, বক্তব্য ও আমলটিও শরীয়তবিরোধী। (চলবে)

মুহম্মদ হামিদুর রহমান

ফতুল্লা, এনগঞ্জ।

সুওয়ালঃ মাসিক মদীনা নভেম্বর/২০০৪ ঈসায়ী সংখ্যায়  প্রশ্নোত্তর বিভাগে  এক প্রশ্নের উত্তরে বলা হয়েছে, “আযানের জবাব শাব্দিক ভাবে দেয়া সকলের জন্যই সন্নত”…..।

আর চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত রেযাখানী মাযহাবের অখ্যাত মাসিক মুখপত্র ডিসেম্বর-জানুয়ারী/২০০৩-০৪ ঈসায়ী সংখ্যায় প্রশ্নোত্তর বিভাগে বলা হয়েছে,…. “আযানের  মৌখিক জবাব দেয়া ওয়াজিব নয় বরং মুস্তাহাব।”…..

এখন আমার সুওয়াল হলো- মাসিক মদীনা ও রেযাখানী  মুখপত্রের উক্ত বক্তব্য সঠিক হয়েছে কি? আর  মৌখিক বা শাব্দিক ভাবে মুখে আযানের জবাব দেয়া সকলের জন্যই ওয়াজিব না সুন্নত-মুস্তাহাব। নির্ভরযোগ্য দলীল আদিল্লার মাধ্যমে সঠিক জাওয়াব জানাবেন।

জাওয়াবঃ সকলের জন্যই মৌখিক বা শাব্দিক ভাবে  আযানের জবাব দেয়া সম্পর্কে মাসিক মদীনা ও রেযাখানী মুখপত্রের উক্ত বক্তব্য সঠিক হয়নি। বরং ভুল ও অশুদ্ধ হয়েছে।

কারণ মৌখিক বা শাব্দিক ভাবে মুখে আযানের জবাব দেয়া আযান শ্রোতাদের সকলের জন্যই ওয়াজিব যা বহু হাদীছ শরীফ ও বিশ্ববিখ্যাত নির্ভরযোগ্য ফিক্বাহ্ ও ফতওয়ার কিতাবে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং এর উপরই ফতওয়া দেয়া হয়েছে।

উল্লেখ্য, মৌখিক বা শাব্দিকভাবে মুখে আযানের জাওয়াব দেয়া আযান শ্রোতাদের  সকলের জন্যই যে ওয়াজিব এ সম্পর্কে হাদীছ শরীফের কিতাবসমূহে সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে। যা নিম্নে প্রদত্ত হলো-

          যেমন হাদীছ শরীফের সহীহ কিতাব “বুখারী শরীফের” ১ম খন্ডের ৮৬ পৃষ্ঠায় ও মুসলিম শরীফের ১ম খন্ডের ১৬৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,

عن ابى سعيدن الخدرى رضى الله عنه ان رسول الله صلى الله عليه وسلم قال اذا سمعتم النداء فقولوا مثل ما يقول المؤذن.

অর্থঃ- “হযরত আবূ সাঈদ খুদরীঞ্জরদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু হতে বর্ণিত আছে। তিনি বলেন, নিশ্চয়ই  হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যখন  তোমরা আযান শুনবে, তখন মুয়াজ্জিন যা বলে, তোমরাও তাই বল।”

(অনুরূপ “মুয়াত্তা ইমাম মালিক রহমতুল্লাহি আলাইহি, মুয়াত্তা ইমাম মুহম্মদ রহমতুল্লাহি আলাইহি, মুসনাদুল ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহমতুল্লাহি আলাইহি, শরহু মা’য়ানীল আছার” কিতাবেও উল্লেখ রয়েছে)।

“নাসাঈ শরীফ উনার” ১ম খণ্ডের ১১০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,

عن عبد الله بن عمرو رضى الله عنهما يقول سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول اذا سمعتم النداء فقولوا مثل ما يقول.

অর্থ: “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা হতে বর্ণিত আছে। তিনি বর্ণনা করেন, আমি মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার কাছ থেকে শুনেছি। তিনি বলেছেন, যখন তোমরা মুয়াজ্জিনের আযান শুনবে, তখন তোমরাও অনুরূপ বল যা মুয়াজ্জিন বলে।” (অনুরূপ আবূ দাউদ শরীফ, ইবনে মাজাহ শরীফ, মুয়াত্তা ইবনে মালিক-এর ২৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে।)

“আবূ দাউদ শরীফ” কিতাবের ১ম খণ্ডের ৯৩ পৃষ্ঠায় আরো উল্লেক আছে,

وعن عبد الله بن عمرو بن العاص رضى الله عنهما انه سمع النبى صلى الله عليه وسلم يقول اذا سمعتم المؤذن اى اذان المؤذن فقولوا مثل ما يقول.

অর্থ: “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর বিন আস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা হতে বর্ণিত আছে। তিনি নিশ্চয়ই নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার কাছ থেকে শুনেছেন, যখন তোমরা মুয়াজ্জিনের আযান শুনবে, তখন তোমরাও অনুরূপ বলা যা মুয়াজ্জিন বলে।” (অনুরুপ নাসাঈ শরীফ উনার ১ম খণ্ডের ১০৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে।)

উপরোক্ত হাদীছ শরীফ উনার বর্ণনা অনুসারে দিবালোকের ন্যায় একথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, আযানের শব্দ যা রয়েছে, আযান শ্রবণকারী তাই বলবে। আর বুখারী ও মুসলিম শরীফ উনার হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে রয়েছে, “হাইয়া আলাছ ছলাহ ও ফালাহ বাক্যদ্বয় শুনে লা-হাওলা-ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ বলতে হবে।” এটা হাশিয়ায়ে মুয়াত্তা ইমাম মুহম্মদ রহমতুল্লাহি আলাইহি” কিতাবের ৮৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে।

উক্ত হাদীছ শরীফ উনার বর্ণনা অনুসারে আমাদের হানাফী মাযহাবের ইমাম, ইমামে আযম আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি ও আসহাবে জাওয়াহিরের মত হচ্ছে- মৌখিক বা শাব্দিক ভাবে মুখে আযানের জাওয়াব দেয়া আযান শ্রোতাদের সকলের জন্যই ওয়াজিব।

কারণ হাদীছ শরীফ উনার ইবারতে فقولوا শব্দটি امر (আমর) এর ছীগাহ। আর আমাদের হানাফীগণ উনাদের নিকট উছূল হলো- امر (আমর) এর হুকুম হচ্ছে- وجوب (উজুব) অর্থাৎ ওয়াজিব। তাই যে পর্যন্ত এর বিপরীত কোন দলীল পাওয়া না যাবে, সে পর্যন্ত مطلقا (সাধারণভাবে) امر (আমর) -এর হুকুম وجوب বা (ওয়াজিব) হিসেবে বর্তাবে।

যেমন “বাদায়েউস সানায়ে” কিতাবের ১ম খণ্ডের ১৫৫ পৃষ্ঠায় উল্লেক আছে,

ومطلق الامر لوجوب العمل.

অর্থাৎ “সাধারণভাবে امر (আমর) আমলকে ওয়াজিব করে দেয়।”

সুতরাং সরাসরি হাদীছ শরীফ দ্বারাই মৌখিক বা শাব্দিকভাবে মুখে আযানের জাওয়াব দেয়া আযান শ্রোতাদের সকলের জন্যই ওয়াজিব সাব্যস্ত হলো।

এছাড়াও নি¤েœ সর্বজনমান্য, বিশ্বখ্যাত ফিক্বাহ ও ফতওয়ার কিতাব থেকে আরো কিছু অকাট্ট ও নির্ভরযোগ্য দলীল-আদিল্লা পেশ করা হলো-

যেমন, “মুয়াত্তা ইমাম মুহম্মদ রহমতুল্লাহি আলাইহি” কিতাবের ৮৫ পৃষ্ঠায় ৪নং হাশিয়ায় উল্লেখ আছে,

قوله فقولوا استدل به على وجوب اجابة المؤذن حكاه الطحاوى عن قوم من السلف وبه قال الحنفية.

অর্থ: “হাদীছ শরীফ উনার ইবারতে উল্লিখিত فقولوا শব্দটির ভিত্তিতে দলীল গ্রহণ করা হয়েছে যে, মৌখিক বা শাব্দিকভাবে মুখে মুয়াজ্জিনের আযানের জাওয়াব দেয়া ওয়াজিব।

আর মৌখিক বা শাব্দিকভাবে মুখে আযানের জাওয়াব দেয়া যে ওয়াজিব, তা ইমাম ত্বহাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি, সলফে-ছালেহীন রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণ উনাদের এক জামায়াত থেকেও বর্ণনা করেছেন। আর হাদীছ শরীফ উনার ইবারতে উল্লিখিত فقولوا শব্দটির ভিত্তিতে দলীল গ্রহণ করে, হানাফীগণ বলেন, মৌখিক বা শাব্দিকভাবে মুখে আযানের জাওয়াব দেয়া ওয়াজিব।

“মুয়াত্তা ইমাম মারেক রহমতুল্লাহি আলাইহি” কিতাবের ২৩ পৃষ্ঠায় ৪নং হাশিয়ায় উল্লেখ আছে, অর্থাৎ মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বলেছেন, যখন তোমরা আযান শুনবে, তখন মুয়াজ্জিন যেরূপ বলে তোমরাও অনুরূপ বল।” অর্থাৎ এই হাদীছ শরীফ উনার ভিত্তিতে আমাদের হানাফী মাযহাবের ইমাম, ইমামে আযম আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার নিকট মৌখিক বা শাব্দিকভাবে মুখে আযানের জাওয়াব দেয়া ওয়াজিব। আর শাফিয়ী মাযহাবে মুস্তাহাব।

“ইবনে মাজাহ শরীফ উনার” ৫৩ পৃষ্ঠার ৩নং হাশিয়ায় উল্লেখ আছে,

قوله فقولوا مثل ما يقول اى وجوبا عند ابى حنيفة و ندبا عند الشافعى.

অর্থ: “মুয়াজ্জিনের আযানের মৌখিক জবাব দেয়া ওয়াজিব। আর আযানের সময় কথা বলা মাকরূহ তাহরীমী।”

“গায়াতুল আওতার” কিতাবের ১ম খণ্ডের ১৮৩ পৃষ্ঠায় উল্লেক আছে,

উর্দূ কম্পোজ করতে হবে

অর্থ: “ঐ সকল ব্যক্তিদের সকলের জন্যই মৌখিক বা শাব্দিকভাবে মুখে আযানের জবাব দেয়া ওয়াজিব, যে সকল ব্যক্তিরা আযান শুনবে। যদিও সে নাপাকি অবস্থায় থাকে।”

“শামী” কিতাবের ১ম খণ্ডের ৩৯৯ পৃষ্ঠায়-

القول بوجوب الاجابة باللسان.

অর্থাৎ “মৌখিক বা শাব্দিকভাবে মুখে আযানের জবাব দেয়া, আযান শ্রবণকারী সকলের জন্যই ওয়াজিব।”

“গায়াতুল আওতার” কিতাবের ১ম খণ্ডের ১৮৫ পৃষ্ঠায় আরো উল্লেখ আছে,

উর্দূ কম্পোজ করতে হবে

অর্থ: “সুস্পষ্ট বর্ণনার ভিত্তিতে মৌখিক বা শাব্দিকভাবে মুখে আযানের জবাব দেয়া ওয়াজিব। কেননা হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে স্পষ্টভাবে আদেশ করা হয়েছে যে, যখন তোমরা মুয়াজ্জিনের আযান শুন, তখন তোমরাও তদ্রুপ বল, যেরূপ মুয়াজ্জিন বলে।” যেমন “বাহরুর রায়েক” কিতাবে উহার সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে এবং মুছান্নেফ রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি মৌখিক বা শাব্দিকভাবে মুখে আযানের জবাব দেয়া ওয়াজিব হিসেবে ছাবেত করেছেন। আর “নাহরুল ফায়েক” কিতাবে “মুহীত” ও অন্যান্য কিতাব থেকে বর্ণনা করে বলা হয়েছে যে, মৌখিক বা শাব্দিকভাবে মুখে আযানের জবাব দেয়া ওয়াজিব এবং ইহাকে শক্তিশালী মত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই মত প্রথম মতের উপর ভিত্তি করে বলা হয়েছে অর্থাৎ মৌখিক বা শাব্দিকভাবে মুখে আযানের জবাব দেয়া যেহেতু আযান শ্রবণকারী সকলের জন্যই ওয়াজিব, সেহেতু আযান শ্রবণকারীরা সালামের জবাব দিবেনা এবং অন্যকেও সালাম দিবেনা। কুরআন শরীফ পাঠ করবেনা, বরং কুরআন শরীফ তিলাওয়াত বন্ধ করে আযানের জবাব দিবে। আর আযানের জবাব দেয়া ব্যতীত কোন কাজেই মশগুল হবেনা।”

“আইনুল হিদায়া” কিতাবের নেছফে আউয়াল খণ্ডের ৩৮৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,

উর্দূ কম্পোজ করতে হবে

অর্থ: “আল্লামা ইবনে হুমাম রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেছেন, হাদীছ শরীফ উনার প্রকাশ্য বর্ণনা অনুযায়ী মৌখিক বা শাব্দিকভাবে মুখে আযানের জবাব দেয়া ওয়াজিব। কেননা হাদীছ শরীফ উনার সুস্পষ্ট বর্ণনার দ্বারা ওয়াজিব। ছাবেত হয়। আর ওয়াজিব না হওয়ার ব্যাপারে কোন কারণ নেই এবং আল্লামা ইবনে হুমাম রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি ইহাও লিখেছেন যে, মৌখিক বা শাব্দিকভাবে মুখে আযানের জবাব দেয়া যে ওয়াজিব, ইহা “খোলাছাতুল ফতওয়া” এবং “তোহফা” কিতাবের মধ্যেও সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। হযরত মুছান্নেফ রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, আমিও এটাকে সুস্পষ্টভাবে মনে করি যে, মৌখিক বা শাব্দিকভাবে মুখে আযানের জবাব দেয়া ওয়াজিব। ইহা “নেহায়া” ও “মুহীতে সারাখসী’ কিতাবের মধ্যে উল্লেখ আছে এবং “গারায়েব” কিতাবেরও মধ্যে উল্লেখ আছে যে, মৌখিক বা শাব্দিকভাবে মুখে আযানের জবাব দেয়া আযান শ্রবণকারী সকলের জন্যই ওয়াজিব। ইহাই সহীহ ও বিশুদ্ধ ফতওয়া।”

“ফতহুল ক্বাদীর” কিতাবের ১ম খণ্ডের ২১৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,

والسامع للاذان يجيب فيقول مثل مايقول المؤذن ………. اما الاجابة فظاهر الخلاصة والفتاوى والتحفة وجوبها ……. لكن ظاهر الامر فى قوله صلى الله عليه وسلم اذا سمعتم المؤذان فقولوا مثل ما يقول الوجوب اذ لا تظهر قرينة تصرفه عنه.

অর্থ: “আযান শ্রবণকারী সকলেই মৌখিক আযানের জবাব দিবে। অতঃপর শ্রবণকারী সকলেই তদ্রুপ বলবে যেরূপ মুয়াজ্জিন বলে।” …… আর মৌখিক আযানের জবাব দেয়া যে ওয়াজিব এ সম্পর্কে “খুলাছা” “ফাতাওয়া” এবং “তুহফা” ইত্যাদি কিতাবসমূহে সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, ……. মৌখিক বা শাব্দিকভাবে মুখে আযানের জবাব দেয়া ওয়াজিব। কেননা হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে সুস্পষ্টভাবে আদেশ করেছেন যে, যখন তোমরা মুয়াজ্জিনের আযান শুনবে; তখন মুয়াজ্জিন যেরূপ বলে তদ্রুপ তোমরাও বল।”

হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে فقولوا শব্দটি امر (আমর) যা (وجوب) ওয়াজিব অর্থ প্রদান করে। আর (وجوب) ওয়াজিব-এর মধ্যে সুস্পষ্টভাবে করীনা প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত ওয়াজিব থেকে বিরত থাকা যাবে না।

“বাদায়েউস সানায়ে” কিতাবের ১ম খণ্ডের ১৫৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,

فالواجب عليهم الاجابة …… والاجابة ان يقول مثل ما قال المؤذن …. ولاينبغى ان بتكنم السامع فى حال الاذان والاقامة ولايشتغن يرائة القران ولابشئ من الاعمال سوى الاجابة.

অর্থ: “আযান শ্রবণকারী সকলের জন্যই মৌখিক বা শাব্দিকভাবে মুখে আযানের জবাব দেয়া ওয়াজিব। … আর আযান শ্রবণকারী সকলেই আযানের জবাব অনুরূপভাবে বলবে, যেরূপভাবে মুয়াজ্জিন বলে।” …. “সুতরাং আযান ও ইক্বামতের সময় শ্রবণকারীর সকলের জন্যই কথা বলা উচিত হবেনা, কুরআন শরীফ পাঠে মশগুল হবেনা, এমনকি আযান ও ইক্বামতের জবাব দেয়া ব্যতীত কোন কাজ করা যাবেনা।”

“বিনায়া ফি হিদায়া” কিতাবের ২য় খণ্ডের ১০৮ পৃষ্ঠায় উল্লেক করেছেন,

انه يجب عليه الاجابة …. وجه الوجوب قوله عليه الصلاة والسلام اذا سمعتم الاذان فقولوا مثل ما يقول المؤذن.

অর্থ: “আযান শ্রবণকারীর সকলের জন্যই ওয়াজিব মৌখিক বা শাব্দিকভাবে মুখে আযানের জবাব দেয়া …… আর আযান শ্রবণকারীর সকলের জন্যই মৌখিক বা শাব্দিকভাবে মুখে আযানের জবাব দেয়া ওয়াজিব হওয়ার কারণ হলো এই যে, আখেরী রাসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খতামুন্নাবিয়্যীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে সুস্পষ্ট আদেশ করেছেন যে, যখন তোমরা মুয়াজ্জিনের আযান শুনবে, তখন মুয়াজ্জিন যেরূপ বলে, তদ্রুপ তোমরাও বল।”

“দুররুল মুখতার” কিতাবে উল্লেখ আছে,

واما عندنا ويجيب بلسانه مطلقا والظاهر وجوبها باللسان لظاهر الامر فى حديث اذا سمعتم المؤذن فقولوا مثل مايقول كما بط فى البحر واقوه المصنف وقواه فى النهر ناقلا عن المحيط وغيره بانه على الاول لايرد السلام ولا يسلم ولا يقرأ بل يقطعها ويجيب ولا يشتغل بغير الاجابة.

অর্থ: “আমাদের হানাফী মাযহাব মতে (مطلقا) সাধারণভাবে আযান শ্রবণকারী সকলেই মৌখিক বা শাব্দিকভাবে মুখে আযানের জবাব দিবে। আর জাহের রেওয়ায়েত মোতাবেক মৌখিক বা শাব্দিকভাবে মুখে আযানের জবাব দেয়া আযান শ্রবণকারী সকলের জন্যই ওয়াজিব। কেননা হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি সুস্পষ্টভাবে আদেশ করেছেন। যখন তোমরা মুয়াজ্জিনকে যেরূপ বলতে শুন, তখন তোমরাও তদ্রুপ বল।”

যেমন, “বাহরুর রায়েক” কিতাবে সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে এবং মুছান্নেফ রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি এটাকেই স্বীকৃতি দিয়েছেন যে, “মৌখিক বা শাব্দিকভাবে মুখে আযানের জবাব দেয়া আযান শ্রবণকারী সকলের জন্যই ওয়াজিব।” আর “নাহরুল ফায়েক” কিতাবে “মুহীত” এবং অন্যান্য কিতাব থেকে বর্ণনা করে বলা হয়েছে যে, মৌখিক বা শাব্দিকভাবে মুখে আযানের জবাব দেয়া সকলের জন্যই ওয়াজিব, ইহাই শক্তিশালী মত। তবে প্রথম মতে অর্থাৎ মৌখিক বা শাব্দিকভাবে মুখে আযানের জবাব দেয়া যেহেতু সকলের জন্যই ওয়াজিব, সেহেতু আযান অবস্থায় সালামের জবাব দিবেনা, অন্য কাউকে সালাম দিবেনা, কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করা বন্ধ করে আযানের জবাব দিবে। এক কথায় আযানের জবাব দেয়া ব্যতীত কোন কাজই করা যাবেনা।”

উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা এটাই সুস্পষ্টভাবে প্রমানিত হলো যে, আযান শ্রবণকারীর আযানের জবাব মৌখিক বা শাব্দিকভাবে মুখে দেয়া সকলের জন্যই ওয়াজিব এবং এর উপরই ফতওয়া।

সুতরাং মাসিক মদীনা ও রেযাখানী মুখপত্র যে বলেছে, “আযানের জবাব মৌখিক বা শাব্দিকভাবে দেয়া সকলের জন্যই সুন্নত-মুস্তাহাব।” তাদের এ বক্তব্য সম্পূর্ণ ভুল ও দলীলবিহীন বলেই প্রমাণিত হলো।

{বি: দ্র: আযান শ্রবণকারীর সকলের জন্যই মৌখিক বা শাব্দিকভাবে মুখে আযানের জওয়াব দেয়া ওয়াজিব। এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হলে মাসিক আল বাইয়্যিনাত-এর ৫৩, ৮১, ৮৫, ৯৬তম সংখ্যা পাঠ করুন। সেখানে অখ্যাত মাসিক রাহমানী পয়গাম ও অখ্যাত মাসিক মুঈনুল ইসলামের ভুল বক্তব্য খণ্ডন করে সঠিক জাওয়াব দেয়া হয়েছে।}

{দলীলসমূহ : (১) মুয়াত্তা ইমাম মালেক রহমতুল্লাহি আলাইহি (২) মুয়াত্তা ইমাম মুহম্মদ রহমতুল্লাহি আলাইহি (৩) মুসনাদুল ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহমতুল্লাহি আলাইহি (৪) শরহু মা’য়ানীল আছার (৫) বুখারী শরীফ (৬) মুসলিম শরীফ (৭) তিরমিযী শরীফ (৮) আবূ দাউদ শরীফ (৯) নাসাঈ শরীফ (১০) ইবনে মাযাহ শরীফ (১১) মিশকাত শরীফ (১২) লুময়াত (১৩) আশয়াতুল লুময়াত (১৪) কুনিয়া (১৫) শরহে মুনিয়া (১৬) নেহায়া (১৭) মুহিত (১৮) জখীরা (১৯) শরহুছ ছগীর (২০) শরহুল কবীর (২১) আল কাওয়ানী নুল ফিক্বাহিয়্যাহ (২২) আল মাজমু (২৩) মুগনিউল মুহতাজ (২৪) আল মাযহাব (২৫) কাশশাফুল কিনা (২৬) আল মুগনী (২৭) বাহরুর রায়েক (২৮) নাহরুল ফায়েক (২৯) আল ফাওয়ায়েদ (৩০) বাদায়েয়ুছ ছানায়া (৩১) বেনায়া (৩২) তোহফা (৩৩) ফাতাওয়া (৩৪) খোলাছাতুল ফতওয়া (৩৫) আলমগীরী (৩৬) ফতহুল ক্বাদীর (৩৭) মূহীতে সারাখসী (৩৮) গারায়েব (৩৯) আইনুল হিদায়া (৪০) গায়াতুল আওতার (৪১) তানবীরুল আবছার (৪২) দুররুল মুখতার (৪৩) রদ্দুল মুহতার (৪৪) হাশিয়ায়ে তাহতাবী আলা দুররিল মুখতার (৪৫) মারাকিউল ফালাহ (৪৬) ফতওয়ায়ে কাজীখান (৪৭) মাযমাউল আনহুর (৪৮) জাওহারাতুন নাইয়ারাহ (৪৯) ফতওয়ায়ে হিন্দিয়া (৫০) শরহে ইলিয়াস (৫১) জামিউর রুমুজ (৫২) শামী (৫৩) কাশফুল গোম্মা (৫৪) আরকানে আরবায়া (৫৫) কবীরী (৫৬) হাশিয়ায়ে তাবিনুল হাকায়েক্ব (৫৭০ ফিক্বাহুল ইসলামী ওয়া আদিল্লাহ (৫৮) জাওয়াহের ইত্যাদি}

মুহম্মদ মুহিউদ্দীন

সভাপতি- আনজুমানে আল বাইয়্যিনাত

সন্দ্বীপ শাখা, চট্টগ্রাম।

সুওয়াল : চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত রেযাখানী মাযহাবের অখ্যাত মাসিক মুখপত্র ডিসেম্বর-জানুয়ারি/২০০৩-০৪ ঈসায়ী সংখ্যায় প্রশ্নোত্তর বিভাগে “বিতরের পর দু’রাকায়াত নফল নামায দাঁড়িয়ে পড়াই উত্তম এবং বসে পড়লে অর্ধেক ছওয়াব পাবে বলে উল্লেখ করেছে।” তারা তাদের উক্ত বক্তব্যের স্বপক্ষে বুখারী, মুসলিম, ইবনে মাজাহ, নাসায়ী থেকে দলীল হিসেবে কয়েকখানা হাদীছ শরীফও উল্লেখ করেছে।

আর হাটহাজারী মাদরাসা থেকে প্রকাশিত অখ্যাত মাসিক পত্রিকা ডিসেম্বর/২০০৩ ঈসায়ী সংখ্যায় জিজ্ঞাসা-সমাধান বিভাগে বলা হয়েছে, “বিতির নামাযের পর দুই রাকআত নফল নামায … দাঁড়িয়ে পড়া ভাল। কারণ, নফল নামায বিনা কারণে বসে পড়লে অর্ধেক সাওয়াব হয়।”

এখন আমার সুওয়াল হলো- তারা হালকী নফল নামায সম্পর্কে যে বক্তব্য পেশ করেছে তা কতটুকু সঠিক? এবং এ সম্পর্কে যে হাদীছ শরীফগুলো উল্লেখ করেছে তা কতটুকু গ্রহণযোগ্য। তাদের প্রতিটি দলীলের খণ্ডনসহ হালকী নফল সম্পর্কে বিস্তারিত দলীল-আদিল্লাহ পেশ করে আমাদের ঈমান-আমল হিফাযত করবেন বলে আমরা আশাবাদী।

জাওয়াব : বিতর নামাযের পর দু’রাকায়াত নফল নামায যাকে “হালক্বী নফল” বলা হয়, তা দাঁড়িয়ে পড়া সম্পর্কে অখ্যাত মাসিক পত্রিকাদ্বয়ের উক্ত বক্তব্য সঠিক হয়নি। বরং ভুল, মনগড়া, দলীলবিহীন এবং কুরআন শরীফ, সুন্নাহ শরীফ উনাদের খিলাফ হয়েছে। এবং ক্ষেত্রবিশেষে কুফরীমূলক হয়েছে।

স্মর্তব্য যে, সাধারণত: নফল নামায বলে পড়লে অর্ধেক ছওয়াব হলেও বিতর নামাযের পর দু’রাকায়াত নফল নামায বসে পড়াই মুস্তাহাব-সুন্নত, যা উত্তম ও পূর্ণ ছওয়াব এবং অধিক ফযীলতের কারণ। কেননা বিতর নামাযের পর দু’রাকায়াত নফল এবং অন্যান্য নফলের ক্ষেত্রে একই হুকুম নয়। বরং বিতর নামাযের পর দুই রাকায়াত নফলের হুকুম অন্যান্য নফল থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। অর্থাৎ অন্যান্য নফল দাঁড়িয়ে পড়া উত্তম। অর্থাৎ দাঁড়িয়ে পড়লে পূর্ণ ছওয়াব, বসে পড়লে অর্ধেক ছওয়াব। আর হালক্বী নফল অর্থাৎ বিতর নামাযের পর দু’রাকায়াত নফল নামায দাঁড়িয়ে পড়লে অর্ধেক ছওয়াব, আর বসে পড়লে পূর্ণ ছওয়াব।

কারণ আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিয়্যীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বিতর নামাযের পর দু’রাকায়াত নফল নামায কখনও দাঁড়িয়ে আদায় করেননি। বরং বসেই আদায় করেছেন। যা সরাসরি হাদীছ শরীফ দ্বারাই প্রমাণিত।

(ধারাবাহিক)

উল্লেখ্য, রেযাখানীরা ‘বুখারী, মুসলিম, ইবনে মাজাহ ও নাসায়ী শরীফ’ ইত্যাদি কিতাব থেকে দলীল হিসেবে যে বক্তব্য উল্লেখ করেছে, আসলে উক্ত কিতাবসমূহের বক্তব্য মোটেও সে রকম নয়। তারা কিাতবের ইবারত, সঠিক অর্থ ও ব্যাখ্যা বুঝতে না পারার কারণেই ‘হালক্বী নফল’ সম্পর্কে এরূপ বিভ্রান্তিক বক্তব্য উল্লেখ করেছে। শুধু তাই নয়, সাথে সাথে নিজেদের জিহালতীকে ধামাচাপা দেয়ার উদ্দেশ্যে উল্লিখিত কিতাবসমূহের কোন কোন ইবারত কারচুপি করে নিজেদের বাতিল মতকে ছাবিত করার ব্যর্থ কোশেশ করেছে। তারা উল্লিখিত কিতাবের বরাত দিয়ে যে সকল মিথ্যাচারিতা, প্রতারণা ও ইবারত কারচুপির আশ্রয় নিয়েছে সেগুলোর সঠিক ব্যাখ্যা ও ফায়সালা তুলে ধরে তার খণ্ডনমূলক আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।

রেযাখানীদের কারচুপিমূলক

বক্তব্য উদঘাটন ও খণ্ডন

উল্লেখ্য, রেযাখানীরা বলেছে, “যদি বিতরের পর দু’রাকাত নামায পড়া প্রিয় রসূল নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার দাওয়ামী সুন্নত, বিধায় বসে উত্তম, তা অস্বীকার করা কুফরী হয়, তবে যে সব মাযহাবের সম্মানিত ইমাম ও মুজতাহিদ যারা এ দু’রাকাত নামাযকে মোটেই স্বীকার করেননি উনাদের ব্যাপারে কী ফতোয়া দেয়া হবে।” …..

এর জবাবে বলতে হয় যে, রেযাখানী মৌলভী সাহেবরা উক্ত বক্তব্যের পিছনে ইবনে মাজাহ শরীফ উনার ৮৫ পৃষ্ঠার হাশিয়ার বরাত দিয়ে যে ইবারত উল্লেখ করেছে, এতেই প্রমাণিত হয় তারা কিতাবের অর্ধেক পড়েই ফতওয়া দিয়েছে। কারণ তারা শুধুমাত্র ইমাম মালেক রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার অস্বীকার সম্পর্কিত ইবারত টুকু উল্লেখ করেছে এবং উক্ত ইবারতের পূর্বের এবং পরের ইবারতগুলো তারা কারচুপি করেছে।

অথচ তাদের উল্লিখিত ইবারত গুলোর পূর্বের ইবারতেই উল্লেখ আছে, মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বিতর নামাযের পর দু’রাকায়াত নফল নামায বসেই আদায় করেছেন।

যেমন “ইবনে মাজাহ” শরীফ উনার ১ম খণ্ডের ৮৫ পৃষ্ঠার ২নং হাশিয়ায় উল্লেখ আছে,

قوله كان يصلى ركعتين بعد الوتر وهذا البيان لجواز الصلوة بعد الوتر وقد جاء ذلك فى الصحيحين عن عائشة رضى الله عنها كان يصلى ثلث عشرة ركعة يصلى ثمان ركعات ثم يوتر ثم يصلى ركعتين وهو جالس.

অর্থাৎ- “হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত আছে, নিশ্চয়ই নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বিতর নামাযের পর সংক্ষিপ্তাকারে দু’রাকায়াত নফল নামায বসেই আদায় করেছেন। আর এই বর্ণনাটি হলো বিতরের পর নামায পড়া জায়েয। আর বিতরের পর দু’রাকায়াত নামায পড়া সম্পর্কিত হাদীছ শরীফ বুখারী ও মুসলিম শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত আছে যে, হযরত আয়িশা ছিদ্দীকা আলাইহাস সালাম উনার হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি (রাতে) তের রাকায়াত নামায আদায় করতেন। আট রাকায়াত (তাহাজ্জুদ) পরে তিন রাকায়াত বিতর পড়তেন। অতঃপর দু’রাকায়াত (নফল) নামায وهو جالس. বসেই আদায় করতেন।”

“ইবনে মাজাহ” শরীফ উনার ১ম খণ্ডের ৮৫ পৃষ্ঠায় ২নং হাশিয়ায় রেযাখানীদের উল্লিখিত ইবারতের পূর্ববর্তী ইবারতে আরোও উল্লেখ আছে,

وروى احمد فى مسنده عن ام سلمة رضى الله عنها وابى امامة رضى الله عنه ان رسول الله صلى الله عليه وسلم يصلى بعد الوتر ركعتين الخ (اى وهو جالس.) وروى ذلك عن جماعة من الصحابة غير من ذكر.

অর্থ: “ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল” রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার “মুসনাদ” কিতাবে উল্লেখ করেছেন, উম্মুল মু’মিনীন হযরত উম্মু সালামা আলাইহাস সালাম এবং হযরত আবু উমামা আলাইহাস সালাম উনাদের হতে বর্ণিত আছে যে, নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বিতর নামাযের পর দু’রাকায়াত নফল নামায (বসেই) আদায় করতেন।”

উক্ত হাদীছ শরীফ খানা উল্লিখিত রাবীগণ ছাড়াও হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ উনাদের একটি জামায়াত থেকে বর্ণিত আছে।

“মুসনাদুল ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল” কিতাবের ৫ম খণ্ডের ২৬০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,

حدثنا عبد الله حدثنى أبى حدثنا عبد الصمد حدثنى ابى حدثنا عبد العزيز يعنى ابن صهيب عن ابى غالب عن ابى امامة رضى الله عنه ان النبى صلى الله عليه وسلم كان يصليهما بعد الوتر وهو جالس يقرأ فيهما اذا زلزلت الارض وقل يايها الكافرون.

অর্থ: “হযরত ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, আমাদের কাছে হাদীছ শরীফ বর্ণনা করেছেন হযরত আব্দুল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি। তিনি বলেন, আমার কাছে হাদীছ শরীফ বর্ণনা করেছেন আমার পিতা। তিনি বলেন, আমাদের কাছে হাদীছ শরীফ বর্ণনা করেছেন হযরত আব্দুছ ছমাদ রহমতুল্লাহি আলাইহি। তিনি বলেন, আমার কাছে হাদীছ শরীফ বর্ণনা করেছেন আমার পিতা। তিনি বলেন, আমাদের কাছে হাদীছ শরীফ বর্ণনা করেছন হযরত আব্দুল আযীয রহমতুল্লাহি আলাইহি, অর্থাৎ ইবনে ছুহাইব রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত আবূ গালিব রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার থেকে বর্ণনা করেন, হযরত আবূ উমামা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার হতে বর্ণিত আছে যে, নিশ্চয় নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বিতর নামায আদায়ের পর দু’রাকায়াত নফল নামায বসেই আদায় করেছেন। আর উক্ত দু’রাকায়াত নামাযে اذا زلزلت الارض এবং قل يا يها الكافرون. অর্থাৎ সূরা যিলযাল এবং সূরা কাফিরুন পাঠ করতেন।”

“মুসনাদুল ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল” কিতাবের ৬ষ্ঠ খণ্ডের ২৯৮-২৯৯ পৃষ্ঠায় উল্লেক আছে,

حدثنا عبد الله حدثنى أبى حدثنا حماد بن مسعدة حدثنا ميمون بن موسى المرائى عن الحسن عن أمه عن أم سلمة رضى الله عنها ان النبى صلى الله عليه وسلم كان يركع ركعتين بعد الوتر وهو جالس.

অর্থ: “হযরত ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, আমাদের কাছে হাদীছ শরীফ বর্ণনা করেছেন, আব্দুল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি। তিনি বলেন, আমার কাছে হাদীছ শরীফ বর্ণনা করেছেন আমার পিতা। তিনি বলেন, আমাদের কাছে হাদীছ শরীফ বর্ণনা করেছেন হাম্মাদ ইবনে মাসয়াদা রহমতুল্লাহি আলাইহিমা। তিনি বলেন, আমাদের কাছে হাদীছ শরীফ বর্ণনা করেছেন মায়মূনা ইবনে মূসা আল-মারায়ী রহমতুল্লাহি আলাইহিমা হযরত হাসান রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার থেকে। তিনি উনার মা থেকে বর্ণনা করেন, উম্মুল মু’মিনীন হযরত উম্মু সালামা আলাইহাস সালাম উনার হতে বর্ণিত আছে, নিশ্চয় নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বিতর নামাযের পর দু’রাকায়াত নফল নামায বসেই আদায় করতেন।”

উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটাই প্রমানিত হলো যে, রেযাখানীরা হাশিয়ায়ে ইবনে মাজাহ এর বরাত দিয়ে যে ইবারত গুলো কারচুপি করেছে, হাশিয়ায়ে ইবনে মাজাহ এর’ উল্লিখিত সেই ইবারতেই উল্লেখ আছে, মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বিতর নামাযের পর দু’রাকায়াত নফল নামায বসেই আদায় করেছেন। যা হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে উল্লিখিত وهو جالس. ইবারতটিই প্রমাণ করে।

সুতরাং রেযাখানীরা হাশিয়ায়ে ইবনে মাজাহ-এর’ বরাত দিয়ে ইবারত কারচুপি করে, সাধারণ মানুষকে ধোকা দিয়েছে। (চলবে)

সুওয়াল-জাওয়াব বিভাগ

সুওয়াল-জাওয়াব বিভাগ

সুওয়াল-জাওয়াব বিভাগ

 সুওয়াল-জাওয়াব

সুওয়াল-জাওয়াব