সংবিধানের বাধ্যবাধকতা, প্রয়োগ বা ব্যাখ্যা ইত্যাদি নিয়ে বিতর্ক এখন আর কথিত রাজনীতিবিদরা করছেন না। তবে কিছুদিন পূর্বে এ বিতর্ক যখন তুঙ্গে ছিল তখন এ সম্পর্কিত বক্তব্য তাদের কে কতটুকু সমঝদার তা প্রকাশ ও প্রমাণ করেছে। এমনকি আমাদের রাষ্ট্রপতি নির্দলীয় কেয়ারটেকার গভর্নমেন্ট পদ দখল করে অতঃপর এটাকেই রাষ্ট্রপতি শাসন বলেছিলেন সংবিধানে বোদ্ধাদের কাছে যুগপৎ বিস্ময় ও হাস্যরসের উদ্রেক করেছিল। তবে সংবিধান নিয়ে এতসব তুমুল বাদানুবাদের ডামাডোলে, জামায়াতীদের হঠাৎ সংবিধান প্রেমী সাজা ও সংবিধানের আক্ষরিক বাস্তবায়নের দাবীর প্রতি অটলতা তাদের তথাকথিত ইসলামী রাজনীতির ভিত্তিমূলকে করুণভাবে উপহাস করেছে এবং তাদের স্ববিরোধীতা প্রতারণা ও ক্ষমতালিঞ্ঝা, এবং তাদের তথাকথিত ইসলামী রাজনীতির ভিত্তিহীনতা তথা মুনাফেকীকে প্রকটভাবে প্রমাণিত করেছে। বলাবাহুল্য, দেশের প্রচলিত রাজনীতির বিপরীতে প্রচলিত সংবিধানকে পাল্টিয়ে কুরআন-সুন্নাহ্র আইন বিধিবদ্ধ ও বাস্তবায়ন করাটাই যে তথাকথিত ইসলামী রাজনীতির দাবী তা সাধারণেও এতদিন যাবত শুনে আসছে ও জেনে আসছে। আর প্রচলিত সংবিধানকে ইসলামীকরণের দাবীতেই তাদের দলের সাথেই ইসলামী শব্দের সংযোগ তাও বলার অপেক্ষা রাখেনা। এবং এ প্রেক্ষিতেই ধর্মপ্রাণদের কাছ থেকে তারা ইসলামী সেন্টিমেন্টে মূল্যায়িত হবার দাবী প্রচার করে আসছে। উল্লেখ্য, এদেশের জনগণ ইসলাম পছন্দ হবার কারণে এ সুযোগটি তারা বরাবরই লাভ করে আসছে। কিন্তু এদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষদের সরলতা অথবা তাদের ছলনার তীব্রতার প্রেক্ষিতে যেন আল্লাহ পাক-এর কুদরত প্রকাশ পেয়েছে। “আল্লাহ পাক আমার রব, রসূল (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের নেতা। এবং কুরআন আমাদের সংবিধান।” জন্মগত এ শ্লোগানের পরিমণ্ডল থেকে বেরিয়ে এসে প্রকাশ্যেই জামায়াতীরা প্রচলিত সংবিধানের একান্ত ফরমাবরদার বনে গেল। জামায়াত নেতা মুজাহিদ সাহেব বলেছেন, বাংলাদেশ পরিচালনার নিয়মের জন্য রয়েছে সংবিধান। এ সংবিধানের বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা কারো নেই। (সংগ্রাম ৮ই জানুয়ারী/০৭) (নাঊযুবিল্লাহ) নিজামী সাহেব বলেন, পাশ্চাত্যের কিছু মহলকে সন্তুষ্ট করার জন্য সরকার সংবিধান লংঘন করবে এমনটা আমরা ভাবতে পারি না।” (১২ জানুয়ারী/০৭) মজার কথা হলো যে, উপরের বক্তব্য দু’টিতে সংবিধানের প্রতি তাদের যে মুহব্বত ও ইস্তিকামত প্রকাশ পেয়েছে সত্যিই এটাই যদি তাদের আদর্শ ও বক্তব্য হয় তাহলে সে প্রেক্ষিতে প্রচলিত সংবিধানের ভিত্তিতে তাদের ইসলামী রাজনীতি কোথায় যায় তাদের পূজ্য সংবিধানের ভিত্তিতেই সে আলোচনা জোড়ালোভাবে করা যায়। উল্লেখ্য বাংলাদেশ সংবিধানে, সংবিধানকে প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, অন্য কোন আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসামঞ্জস্য হয়, তাহলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ হবে ততখানি বাতিল হয়ে যাবে। বলা হয়েছে জনগণ এই প্রজাতন্ত্রের মালিক এবং জনগণের পক্ষে সে ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এ সংবিধানের অধীনে ও কর্তৃত্বে কার্যকর আসবে। এ সম্পর্কে সংবিধানের ৭ (১) ও ৭ (২) ধারায় বলা হয়েছে: (১) প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীনের অধীন ও কর্তৃত্বের কার্যকর হইবে। (২) জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সবোঁচ্চ আইন এবং অন্য কোন আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসামঞ্জস্য হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে। অর্থাৎ প্রচলিত সংবিধানের অধীনে কোনদিন দেশে ইসলামীকরণ করা সম্ভব নয়। এমনকি সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ ভোটের দ্বারাও নয়। উল্লেখ্য, দেশে ইসলামীকরণ প্রয়োগ করতে চাইলেই তা হবে দেশে প্রচলিত সাংবিধানিক মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। অর্থাৎ পর্দা পালন, নাজায়িয আনন্দ পালন, সিনেমা-টিভি বন্ধ, নামায-রোযার বাধ্যবাধকতা ইত্যাদি প্রচলিত সংবিধানের অধীনে হবে মৌলিক অধিকার পরিপন্থী। আর এরূপ মৌলিক অধিকার খর্ব করার ক্ষেত্রে, বাংলাদেশ সংবিধানের ৪৪ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, কোন সংক্ষুদ্ধ ব্যক্তি মৌলিক অধিকার বলবৎ করার জন্য সংবিধানের ১০২(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের নিকট মামলা দায়ের করতে পারবে এবং হাইকোর্ট বিভাগ তা বলবৎ করার জন্য যে কোন ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষকে উপযুক্ত আদেশ বা নির্দেশ দিতে পারবেন। এ কারণে সুপ্রীম কোর্টকে মৌলিক অধিকারের অভিভাবক ও নিশ্চয়তা দানকারী বলা হয়। উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে প্রতিভাত হয়, বর্তমান সংবিধানকে অক্ষরে অক্ষরে পালনের প্রতিশ্রুতিকারী হয়ে জামায়াতীরা যা প্রমাণিত করেছে তা হলো: (১) তারা এদেশে প্রচলিত সংবিধানের প্রাধান্য চায় কিন্তু ইসলামের প্রাধান্য চায়না।
(২) তারা কুরআন-সুন্নাহর আইনকে পরিবর্তন করতে আগ্রহী কিন্তু সংবিধান পরিবর্তনে আদৌ আগ্রহী নয়।
(৩) কুরআন শরীফে সূরা নূর, সূরা আহযাব, সূরা নিসায় আল্লাহ পাক পর্দা পালনের জন্য শক্ত হুকুম দিয়েছেন। তারা সেটা না মানতে রাজী রয়েছে। কিন্তু সংবিধানে পর্দার বাধ্যবাধকতা আরোপে ৩৯ নং অনুচ্ছেদে যে নিষেধাবলী রয়েছে তা অমান্য করতে তারা রাজী নয়। একইভাবে তারা রাজী নয় সিনেমা-নাচ-গান, অশ্লীলতা, সুদ ইত্যাদি নাজায়িয কাজের পৃষ্ঠপোষকতাকারী বর্তমান সংবিধানকে পরিবর্তন করতে। কিন্তু তারা জান দিতে প্রস্তুত এ সংবিধানকে রক্ষা করতে। অথচ এ সংবিধানে যা বলা হয়েছে তা হলো: আল্লাহ পাক সব ক্ষমতার উৎস বা মালিক নন। সব ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং প্রজাতন্ত্রের মালিকও জনগণ। এবং জনগণের ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ রূপেই হয়েছে এ সংবিধান। আর জামায়াতীরা সে সংবিধানের প্রতিই তাদের একান্ত ইস্তিকামত ও মুহব্বত ব্যক্ত। যা প্রতীয়মান করল তা হলো আসলে তাদের মধ্যে ইসলাম বলতে কিছুই নেই। ইসলামী দলের ব্যানারে চললেও ইসলামের কোন কর্মসূচীই তাদের নেই। তাদের ব্যানারে ইসলাম আদৌ নিরাপদ নয়। তারা ইসলামের বিন্দু পরিমাণ সেবক নয়। বরং ইসলামের নামে তারা ভক্ষক, চরম প্রতারক ও শক্ত মুনাফিক।
-মুহম্মদ ওয়ালীউল্লাহ, ঢাকা।
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা-৩২