পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, পবিত্র ইজমা ও ক্বিয়াস উনাদের দৃষ্টিতে প্রাণীর মূর্তি তৈরি করা ও ছবি আঁকা, তোলা, তোলানো, রাখা, রাখানো, দেখা, দেখানো হারাম-নাজায়িয হওয়ার অকাট্য প্রমাণ ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া ৬০তম পর্ব

সংখ্যা: ২২৮তম সংখ্যা | বিভাগ:

পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র তাফসীর শরীফ থেকে প্রমাণিত যে, মূর্তি, ভাস্কর্য, প্রতিকৃতি, প্রাণীর ছবি ইত্যাদি হারাম, কুফরী ও শিরকী কাজ

 

মহান আল্লাহ পাক তিনি উনার পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফ উনার মধ্যে এবং ব্যাখ্যায়, তাফসীর গ্রন্থসমূহে মূর্তি, ভাস্কর্য, প্রতিকৃতি প্রাণীর ছবি ইত্যাদি তৈরি করা, এদের পূজা করা এগুলোর ব্যবসা করা এবং যে কোন অবস্থায় এগুলোর অনুশীলন করাকে নিষেধ করা হয়েছে। এগুলো তৈরি করা হারাম, এগুলোর পূজা করা কুফরী শিরকী এবং মহান আল্লাহ পাক উনার ইবাদতের বিপরীতে গাইরুল্লাহর ইবাদত করার শামিল।

লক্ষণীয় যে, পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখিত تماثيل জাতীয় শব্দগুলো দ্বারা কোন কোন অবস্থায় সরাসরি প্রাণীর ছবি বুঝানো না হলেও প্রাণীর ছবি মূর্তি-ভাস্কর্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ায় এগুলোও একপ্রকার মূর্তি বা ভাস্কর্য। পূর্ব যামানা থেকে প্রমাণিত যে, মূর্তি তৈরি হয় পাথর, কাচ, তামা, লোহা, কাঠ, মাটি, স্বর্ণ, রৌপ্য ইত্যাদি উপকরণ দ্বারা। আর প্রাণীর ছবিগুলো তৈরি হয় কলমের কালি, তুলি ও আলো দ্বারা। এই কালি, তুলি ও আলো এগুলোও তো পাথর কাচ ও মাটির মতোই একেকটি উপকরণ। সুতরাং পবিত্র কুরআন শরীফ উনার বর্ণিত تماثيل তামাছীল, শব্দ দ্বারা যদিও প্রাণীর ছবি সরাসরি নিষেধ হয় না। কিন্তু ব্যাখ্যা সাপেক্ষ্যে প্রাণীর ছবিগুলোও একপ্রকার মূর্তি হওয়ায় এগুলোর অনুশীলন পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার ভিত্তিতে হারাম, কুফরী ও শিরকী হিসেবে সাব্যস্ত। এটাই গ্রহণযোগ্য ফয়সালা।

নি¤েœ মূর্তি, ভাস্কর্য, প্রাণীর ছবি নিষেধ সম্পর্কিত আয়াত শরীফগুলো উল্লেখ করে বিশ্ববিখ্যাত সর্বজনমান্য পবিত্র তাফসীর শরীফ উনার কিতাব থেকে তার ছহীহ সমাধান তুলে ধরা হলো-

 

 

 

পবিত্র আয়াত শরীফসমূহ উনাদের তাফসীর

 

পবিত্র আয়াত শরীফ নম্বর : ১৩

(১০২২)

وَلِسُلَيْمَانَ الرّيْحَ غُدُوُّهَا شَهْر وَرَوَاحُهَا شَهْر وَاَسَلْنَا لَه عَيْنَ الْقِطْرِ وَمِنَ الْجِنِّ مَن يَّعْمَلُ بَيْنَ يَدَيْهِ بِاِذْنِ رَبِّه وَمَن يَّزِغْ مِنْهُمْ عَنْ اَمْرِنَا نُذِقْهُ مِنْ عَذَابِ السَّعِيْرِ. يَعْمَلُوْنَ لَه مَا يَشَاءُ مِن مَّحَارِيْبَ وَتَمَاثِيْلَ وَجِفَانٍ كَالْجَوَابِ وَقُدُوْرٍ رَّاسِيَاتٍ اِعْمَلُوْا الَ دَاوُودَ شُكرًا وَقَلِيْل مّنْ عِبَادِىَ الشَّكُوْرُ. (سورة سبا شريف ۱۲-۱۳ الايتان)

অর্থ : আমি হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম উনার অধীন করেছিলাম বাতাসকে, যা সকালে এক মাসের পথ এবং বিকেলে এক মাসের পথ অতিক্রম করতো। আমি উনার জন্য গলিত তামার এক ঝরনা প্রবাহিত করেছিলাম। উনার রব তায়ালা উনার অনুমতিক্রমে কতক জিন উনার সামনে কাজ করতো। তাদের যে কেউ আমার নির্দেশ অমান্য করবে, তাকে আমি জ্বলন্ত আগুনের শাস্তি আস্বাদন করাবো। তারা (জিনরা) হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম উনার ইচ্ছানুযায়ী মাসজিদ, প্রতিকৃতি (যা পূজার জন্য ছিল না), হাউজ সদৃশ বড় আকারের গামলা এবং চুলার উপর স্থাপিত বিশাল ডেগ নির্মাণ করতো। হে হযরত দাঊদ আলাইহিস সালাম উনার পরিবার! কৃতজ্ঞতার সাথে আপনারা কাজ করতে থাকুন। আমার বান্দাদের মধ্যে অল্প সংখ্যকই কৃতজ্ঞ থাকেন। (পবিত্র সূরাহ সাবা শরীফ: পবিত্র আয়াত শরীফ ১২-১৩)

অত্র আয়াত শরীফ উনার বিশদ তাফসীর অসংখ্য তাফসীর উনার কিতাব সমূহে বর্ণিত আছে। যাতে প্রাণীর ছবি, মূর্তি, প্রতিমা, ভাস্কর্য ইত্যাদী অনুশীলন করা হারাম, কুফ্রী ও র্শিক হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে।

নি¤েœ তাফসীর উনার কিতাব থেকে ইবারত অর্থসহ তুলে ধরা হলো-

(১০২২)

{ولسليمان الريح} اى وسخرنا لسليمان عليه السلام الريح وهي الصبا. {غُدُوُّهَا شَهْرٌ وَرَوَاحُهَا شَهْرٌ} جريها بالغداة مسيرة شهر وجريها بالعشي كذلك، وكان يغدو من دمشق فيقيل باصطخر فارس وبينهما مسيرة شهر ويروح من اصطخر فيبيت بكابل وبينهما مسيرة شهر للراكب المسرع . وقيل : كان يتغدى بالري ويتعشى بسمرقند {وَأَسَلْنَا لَهُ عَيْنَ القطر} أي معدن النحاس فالقطر النحاس وهو الصفر ولكنه أساله وكان يسيل في الشهر ثلاثة أيام كما يسيل الماء وكان قبل حضرت سليمان عليه السلام لا يذوب ، وسماه عين القطر باسم ما آل إليه {وَمِنَ الجن مَن يَعْمَلُ} ্রمنগ্ধ في موضع نصب أي وسخرنا من الجن من يعمل {بَيْنَ يَدَيْهِ بِإِذْنِ رَبّهِ} بأمر ربه {وَمَن يَزِغْ مِنْهُمْ} ومن يعدل منهم {عَنْ أَمْرِنَا} الذي أمرنا به من طاعة حضرت سليمان عليه السلام {نُذِقْهُ مِنْ عَذَابِ السعير} عذاب الآخرة. وقيل : كان معه ملك بيده سوط من نار فمن زاغ عن أمر حضرت سليمان عليه السلام ضرب ضربة أحرقته. {يَعْمَلُونَ لَهُ مَا يَشَاء مِن محاريب} أي مساجد أو مساكن {وتماثيل} أى صور السباع والطيور . وروي أنهم عملوا له أسدين في أسفل كرسيه ونسرين فوقه فإذا أراد أن يصعد بسط الأسدان له ذراعيهما وإذا قعد أظله النسران بأجنحتهما وكان التصوير مباحاً حينئذ. (مدارك التنزيل وحقائق التأويل اى تفسير النسفى سورة سبا ۱۲-۱۳ الاية الـمؤلف: الامام ابو البركات عبد الله بن احمد بن محمود النسفى الحنفى الماتريدى رحمة الله عليه المتوفى: ۷۱۰ هـجرى)

অর্থ : (আমি হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম উনার অধীন করেছিলাম বাতাসকে) অর্থাৎ আমি হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম উনার জন্য বাতাসকে অনুগত করে দিয়েছিলাম, এখানে ‘রীহ’ দ্বারা ‘ছাবা’ বা প্রবাহমান বাতাসকে বুঝানো হয়েছে, (যা সকালে এক মাসের পথ এবং বিকেলে এক মাসের পথ অতিক্রম করতো।) এই বাতাসের উপর ভর করে তখ্তে সুলাইমানী সকালে এক মাসের রাস্তা, অনুরূপ সন্ধাবেলায় এক মাসের রাস্তা অতিক্রম করতেন। হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম তিনি দামেস্ক নগরী (বর্তমান সিরিয়ার রাজধানী)তে সকাল যাপন করতেন এবং মুহুর্তেই পারস্য বা ইরানের ইছ্তাখার নামক জায়গায় চলে যেতেন। এই পারস্য ও দামেস্কের ইছ্তাখার নামক জায়গার মধ্যে দূরত্ব এক মাসের পথ। আর সন্ধা বেলা ইছ্তাখার নামক জায়গা থেকে রওয়ানা দিয়ে কাবিল নামক স্থানে গিয়ে রাত যাপন করতেন। এ দু’স্থানের মধ্যে দূরত্ব ছিল এক মাসের পথ। কতক মুফাসসির রহমাতুল্লাহি আলাইহিম উনারা বলেছেন, তিনি রায় নামক স্থানে সকাল যাপন করতেন আর সামারকান্দ এলাকায় যেয়ে রাত যাপন করতেন। (আমি উনার জন্য গলিত তামার এক ঝরনা প্রবাহিত করেছিলাম।) অর্থাৎ তামা, পিতল, কাঁসা-র খনি দিয়েছিলাম। এখানে ক্বিত্র দ্বারা নুহাস বা তামা, পিতল ও কাঁসাকে বুঝানো হয়েছে। এগুলো হলুদ বর্ণের হয়ে থাকে। পানি প্রবাহিত হওয়ার মতো এগুলো প্রতিমাসে তিন দিন ঝরনা আকারে প্রবাহিত হতো। হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম উনার পূর্ব যামানায় তামা, পিতল বা কাঁসা গলতো না। উনি এগুলো দিয়ে অস্ত্র তৈরী করতেন বলে এগুলোকে আইনাল্ ক্বিত্র বলা হয়েছে। (কতক জিন কাজ করতো) এখানে মিন র্হাফটি নছব-এর অবস্থায় রয়েছে। অর্থাৎ আমি জিনদেরকে অধীন করে দিয়েছিলাম যাতে তারা কাজ করে। (উনার রব তায়ালা উনার অনুমতিক্রমে উনার সামনে।) উনার রব তায়ালা উনার নির্দেশক্রমে। (তাদের যে কেউ অমান্য করবে) অগ্রাহ্য কবে (আমার নির্দেশ,) আমি হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম উনাকে আনুগত্য করার ব্যাপারে যে আদেশ করেছি তা না মানবে (তাকে আমি জ্বলন্ত আগুনের শাস্তি আস্বাদন করাবো।) আখিরাত দিবসের আযাব। কারো মতে, হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম উনার সাথে একজন হযরত ফেরেশতা আলাইহিস সালাম ছিলেন যাঁর হাতে একখানা আগুনের চাবুক থাকতো, যখনই কোন জিন হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম উনার অবাধ্য হতো তখনই হযরত ফেরেশতা আলাইহিস সালাম তাকে চাবুক মারতেন, ফলে অবাধ্য জিনটি জ্বলে ছাই হয়ে যেত। (তারা-জিনরা হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম উনার ইচ্ছানুযায়ী তৈরী করতো মাহারিব,) অর্থাৎ মাসজিদ সমূহ ও দালান-কোটা অট্রালিকা সমূহ। (প্রতিকৃতি।)

হিং¯্র প্রাণী-সিংহ ও পাখী সমূহ। যা পূজার জন্য ছিল না। বর্নিত রয়েছে যে, হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম উনার চেয়ার মুবারকের পিছনে দু’টি সিংহের আকৃতি ছিল এবং মাথা মুবারকের উপরে দুটি শকুন বা ঈগলের আকৃতি ছিল। তিনি যখন চেয়ার মুবারকে হেলান দিতে ইচ্ছা করতেন, তখন সিংহের উপর দু’হাত মুবারক প্রসারিত করে রাখতেন। আর যখন চেয়ার মুবারকে বসে থাকতেন, তখন ঈগল বা শকুন তার দুটি পাখা দিয়ে উনার উপর ছায়া দিতো।

(মাসয়ালা:) হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম উনার যামানায় পূজা করা হয় না- এমন প্রতিকৃতি, মূর্তি বা প্রাণীর ছবি তৈরী করা মুবাহ ছিল। (কিন্তু আমাদের শরীয়াত তথা দীন ইসলাম উনার দৃষ্টিতে প্রাণীর ছবি, মূর্তি, ভাস্কর্য, প্রতিমা, প্রাণীর ছবি ইত্যাদী পূজার জন্য হোক বা পূজার জন্য না হোক সর্বাবস্থায় এগুলোর অনুশীলন বা চর্চা করা হারাম, র্শিকী ও কুফরী।) (মাদারিকুত্ তানযীল ওয়া হাক্বায়িকুত্ তা’বীল অর্থাৎ তাফসীরুন্ নাসাফী সূরাহ সাবা ১২-১৩ আয়াত শরীফ লেখক: ইমাম আবুল বারাকাত আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন মাহমূদ নাসাফী হানাফী মাতূরীদী রহমাতুল্লাহি আলাইহি)

(১০২৩)

وَتَماثِيلَ يدل على أن عمل التصاوير كان مباحا وهو محظور فى شريعة النبى صلّى اللّه عليه وسلّم. (احكام القرآن للجصاص المؤلف : احمد بن على الـمكنى بابى بكر الرازي الجصاص الحنفى الماتريدى رحمة الله عليه)

অর্থ : তামাছীল: নিশ্চয়ই পূজা করা হয় না এমন প্রাণীর ছবি, মূর্তি , প্রতিমা ইত্যাদীর অনুশীলন করা হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম উনার যামানায় মুবাহ ছিল। আর এখন নূরে মুজাস্সাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সম্মানিত শরীয়াত উনার ফায়সালা মুতাবিক এগুলো নিষিদ্ধ বা হারাম। (আহকামুল কুরআন লিল জাছ্ছাছ সূরাহ সাবা ১৩ আয়াত শরীফ লেখক: ইমাম আহমাদ বিন আলী মাকানী আবূ বকর রাযী জাছ্ছাছ হানাফী মাতূরীদী রহমাতুল্লাহি আলাইহি)

(১০২৪)

{وتماثيل} يعني : على صور الرجال من الصفر والنحاس لأجل الهيبة في الحرب وغيره . ويقال : ويجعلون صوراً للأنبياء ليستزيد الناس رغبة في الإسلام. (بحر العلوم اى تفسير السمرقندى المؤلف : ابو الليث نصر بن محمد بن أحمد بن ابراهيم السمرقندى الحنفى الماتريدى رحمة الله عليه المتوفى : ۳۷۳ هـجرى)

অর্থ : (তামাছীল) অর্থাৎ হলুদ রংধারী তামা, পিতল ও কাঁসা ধাতুর তৈরী মানবাকৃতি। যা যুদ্ধ ও কঠিন মুহুর্তে শত্রুকে ভয় দেখানোর জন্য তৈরী করা হতো। বলা হয় যে, সে সময় লোকেরা হযরত আম্বিয়া আলাইহিমুছ ছলাতু ওয়াস সালাম উনাদের আকৃতি তৈরী করতো এই জন্য যে, যাতে করে উনাদের আকৃতি মুবারক দেখিয়ে মানুষদেরকে ইসলাম উনার দিকে আকৃষ্ট করা যায়। (কিন্তু আমাদের শরীয়াতে এগুলোর চর্চা করা হারাম, র্শিক ও কুফরীর শামিল।) (বাহরুল উলূম অর্থাৎ তাফসীরুস্ সামারকান্দী সূরাহ সাবা ১৩ আয়াত শরীফ লেখক: ইমাম আবুল লাইছ নাছ্র বিন মুহাম্মদ বিন আহমাদ বিন ইবরাহীম সামারকান্দী হানাফী মাতূরীদী রহমাতুল্লাহি আলাইহি, ইন্তিকাল: ৩৭৩ হিজরী)

(১০২৫)

وَتَماثِيلَ أى صورا من نحاس وصفر وشبه وزجاج ورخام قيل كانوا يصورون السباع والطيور وقيل كانوا يتخذون صور الـملائكة والأنبياء والصالحين فى الـمساجد ليراها الناس فيزدادوا عبادة وكانت مباحة فى شريعتهم قلت ولعل المراد به تماثيل غير ذى الروح. (التفسير الـمظهرى الـمؤلف: حضرت علامة الامام محمد ثناء الله العثمانى الحنفى الـماتريدى الـمظهرى رحمة الله عليه(

অর্থ : এখানে তামাছীল দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে তামা (তা¤্র, পিতল, কাঁসা), সোনা, কাঁচ (কাচ, শিশা) ও মার্বেল পাথর (শ্বেত মর্মর, যাবতীয় যে কোন  প্রকার পাথর) তৈরীকৃত প্রতিকৃতি বা মূর্তি। কেউ কেউ বলেন, তৎকালীন লোকেরা হিং¯্র প্রাণী-সিংহ ও পাখিদের আকৃতি তৈরী করতো। আবার কারো মতে, তখনকার লোকেরা তাদের মাসজিদ সমূহে হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম, হযরত আম্বিয়া আলাইহিমুছ ছলাতু ওয়াস সালাম ও নেককার লোকগণের আকৃতি তৈরী করে রাখতো, উদ্দেশ্য ছিলো- যাতে করে লোকেরা উনাদের আকৃতি দেখে বেশি বেশি ইবাদত করতে উৎসাহ পায় (এতে তাদের পূজা বা উপাসনা করা উদ্দেশ্য ছিল না)। আর উনাদের শারীয়াতে এ উদ্দেশ্যে এগুলোর অনুশীলন করা মুবাহ বা বৈধ ছিল। আমি বলি: সম্ভবত এখানে তামাছীল দ্বারা প্রাণহীনের আকৃতিও বুঝানো হয়েছে। (আত-তাফসীরুল মাযহারী সূরাহ সাবা ১৩ আয়াত শরীফ লেখক: হযরত আল্লামা ইমাম মুহাম্মদ ছানাউল্লাহ উছমানী হানাফী মাতূরীদী মাযহারী রহমাতুল্লাহি আলাইহি)

(১০২৬)

{وتماثيل} جمع تمثال بالكسر وهو الصورة على مثال الغير اى وصور الـملائكة والانبياء على صورة القائمين والراكعين والساجدين على ما اعتادوه فانها كانت تعمل حينئذ فى الـمساجد من زجاج ونحاس ورخام… واعلم ان حرمة التصاوير شرع جديد وكان اتخاذ الصور قبل هذه الامة مباحا وانما حرم على هذه الامة… وهذا يدل على ان تصوير ذى الروح حرام. (تفسير روح البيان المولف إسماعيل حق بن مصطفى الإستانبولى الحنفى الـماتريدى الخلوتى رحمة الله عليه)

অর্থ : (তামাছীল) শব্দটি তা বর্ণে যেরসহ ‘তিমছাল’ শব্দের বহুবচন। কোন কিছুর অনুরূপ আকৃতিকে ‘তিমছাল’ বলা হয়। অর্থাৎ হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম ও হযরত আম্বিয়া আলাইহিমুছ ছলাতু ওয়াস সালাম উনাদের দাঁড়ানো, রুকূ’ করা ও সিজদাহ্রত অবস্থার দৃশ্যের আকৃতি, যা তারা তৈরী করতো। কেননা সেই সময়ের লোকেরা কাঁচ, পিতল ও পাথর দ্বারা এমন সব আকৃতি তৈরী করে তাদের মাসজিদ সমূহে রাখতো।… জেনে রাখুন! নিশ্চয়ই পূজা করা হয় না এমন মূর্তি, প্রতিকৃতি, প্রাণীর ছবি ইত্যাদীরও অনুশীলন করা আমাদের শারীয়াত তথা দ্বীন ইসলামে হারাম করা হয়েছে। এমন প্রতিকৃতি পূর্ববর্তী উম্মাত উনাদের জন্য মুবাহ বা বৈধ ছিল। আর বর্তমানে এই উম্মাত বা উম্মাতে হাবীবী উনাদের জন্য এটাকেও হারাম করা হয়েছে।… দলীল-আদিল্লাহ দ্বারা এটা প্রমাণীত যে, প্রাণীর আকৃতি, প্রতিকৃতি, মূর্তি, ভাস্কর্য, ছবি ইত্যাদী হারাম। (তাফসীরে রূহুল বায়ান অর্থাৎ তাফসীরুল হাক্কী সূরাহ সাবা ১৩ আয়াত শরীফ লেখক: হযরত আল্লামা ইসমাঈল হাক্কী বিন মুছ্তফা ইসতাম্বূলী হানাফী মাতূরীদী খালওয়াতী রহমাতুল্লাহি আলাইহি)

(১০২৭)

وتماثيل قيل : إنها كانت على غير صور الحيوان وقيل على صور الحيوان وكان ذلك جائزاً عندهم. (التسهيل لعلوم التنزيل الـمؤلف : محمد بن احمد بن محمد بن جزى الكلبى الغرناطى الـمالكي الاشعرى رحمة الله عليه ۶۹۳-۷۴۱ هـجرى)

অর্থ : ‘তামাছীল’ কেউ বলেন, প্রাণহীনের আকৃতি বা ছবিকে বুঝায়। আবার কারো মতে, এ শব্দ দ্বারা এখানে প্রাণীর আকৃতি বা প্রতিকৃতিকে বুঝানো হয়েছে। কেননা, হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম উনার সময় উপাসনা করা হয় না এমন প্রাণীর আকৃতি-ছবি তৈরী করা জায়িয ছিল। কিন্তু আমাদের শরীয়ত তথা দ্বীন ইসলাম উনার দৃষ্টিতে তা নাজায়িয করা হয়েছে। (আত-তাসহীল লিউলূমিত্ তানযীল সূরাহ সাবা ১৩ আয়াত শরীফ লেখক: হযরত আল্লামা মুহাম্মদ বিন আহমাদ বিন মুহাম্মদ বিন জুযী কালাবী গারনাতী মালিকী আশয়ারী রহমাতুল্লাহি আলাইহি জন্ম: ৫৯৩ হিজরী, ইন্তিকাল: ৭৪১ হিজরী)

 

(১০২৮)

“وَتَمَاثِيل” جَمْع تِمْثَال وَهُوَ كُلّ شَيْء مُثْلَته بِشَيْءٍ أَيْ صُوَر مِنْ نُحَاس وَزُجَاج وَرُخَام وَلَمْ يَكُنْ اتِّخَاذ الصُّوَر حَرَامًا فِي شَرِيعَته. (تفسير الجلالين)

অর্থ : ‘তামাছীল’ শব্দটি তিমছাল শব্দের বহুবচন। কোন কিছুর অনুরূপ তৈরীকৃত আকৃতিকে তিমছাল বলা হয়। অর্থাৎ পিতল, কাঁচ ও পাথর দ্বারা যা তৈরী করা হতো। সেই সময় তাদের শারীয়াতে প্রাণীর ছবি, প্রতিকৃতি ইত্যাদীর চর্চা করা হারাম ছিল না। (তাফসীরুল জালালাঈন সূরাহ সাবা ১৩ আয়াত শরীফ)

(১০২৯)

وهذا يدلُّ على أن التصويرَ كان مُباحاً في ذلكَ الزمانِ، ثُم صارَ حَرَاماً فى شَريعةِ نبيِّنا مُحَمَّدٍ صلى الله عليه وسلم. (تفسير القرآن العظيم للطبرانى اى تفسير الطبرانى المؤلف : ابو القاسم سليمان بن احمد بن ايوب بن مطير اللخمى الشامي الطبرانى رحمة الله عليه) الـمؤلف: سليمان بن أحمد بن أيوب بن مطير اللخمى الشامي أبو القاسم الطبرانى رحمة الله عليه الـمتوفى : ۳۶۰ هجرى)

অর্থ : সেই যামানায় পূজা করা হয় না এমন প্রতিকৃতি বা প্রাণীর ছবির চর্চা করা মুবাহ বা বৈধ ছিল। অতপর তা আমাদের নবী নূরে মুজাস্সাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লøাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার শারীয়াতে হারাম করা হয়েছে। (তাফসীরুল কুরআনিল আযীম লিত্ ত্ববারানী অর্থাৎ তাফসীরুত্ ত্ববারানী সূরাহ সাবা ১৩ আয়াত শরীফ লেখক: হযরত আল্লামা আবুল ক্বাসিম সুলাইমান বিন আহমাদ বিন আইয়ূব বিন মুত্বীর লাখমী শামী আবুল ক্বাসিম ত্ববারানী রহমাতুল্লাহি আলাইহি  ইন্তিকাল মুবারক: ৩৬০ হিজরী)

(১০৩০-১০৩১)

وقال الضحاك كانت تماثيل حيوان، وكان هذا من الجائز فى ذلك الشرع. قال القاضى أبو محمد ونسخ بشرع محمد صلى الله عليه وسلم، وقال قوم: حرم التصوير لأن الصور كانت تعبد، وحكى مكى فى الهداية أن فرقة كانت تجوز التصوير وتحتج بهذه الآية وذلك خطأ. (الـمحرر الوجيز الـمؤلف : ابو محمد عبد الحق بن غالب بن عبد الرحمن بن تمام بن عطية الاندلسي الـمحاربى رحمة الله عليه  الـمتوفى : ۵۴۲ هـجرى)

অর্থ : তাবিয়ী হযরত দ্বহ্হাক রহমাতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, ঐ প্রতিকৃতি গুলো ছিল প্রাণীর। ইহা পূর্ব শারীয়াতে জায়িয ছিল। হযরত ক্বাযী আবূ মুহম্মদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, ইহা আমাদের রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সম্মানিত শারীয়াত দ্বারা রহিত করা হয়েছে। এক সম্প্রদায় বলেন: উপাসনা করা হয় এমন মূর্তি, প্রতিকৃতি বা প্রাণীর ছবির চর্চা করা সর্বযুগে হারাম ছিল। হযরত মাক্কী রহমাতুল্লাহি আলাইহি তিনি ‘আল-হিদায়াহ’ কিতাবে বলেন: ‘একটি দল বর্তমানে প্রাণীর ছবি, মূর্তি, প্রতিকৃতি ইত্যাদীর চর্চাকে হালাল বলে এবং এর সপক্ষে অত্র আয়াত শরীফ দলীল হিসেবে পেশ করে থাকে।’ অথচ এ ফায়সালা সম্পুর্ণ ভুল। অর্থাৎ প্রাণীর ছবি, মূর্তি, ভাস্কর্য, প্রতিকৃতি ইত্যাদীর অনুশীলন করা হারাম। (আল-মুহাররারুল ওয়াজীয অর্থাৎ তাফসীরে ইবনে আতিয়্যাহ সূরাহ সাবা ১৩ আয়াত শরীফ লেখক: হযরত আল্লামা আবূ মুহম্মদ আব্দুল হক্ব বিন গালিব বিন আব্দুর রহমান বিন তাম্মাম বিন আতিয়্যাহ উন্দুলুস মাহারাবী রহমাতুল্লাহি আলাইহি ইন্তিকাল: ৫৪২ হিজরী)

(১০৩২)

وأما التماثيل ، فهي الصُّوَر؛ قال الحسن : ولـم تكن يومئذ محرَّمة. (زاد المسير فى علم التفسير اى تفسير الجوزى الـمؤلف : جمال الدين عبد الرحمن بن علي بن محمد الجوزى الحنبلى الاشعرى رحمة الله عليه الـمتوفى : ۵۹۷ هـجرى)

অর্থ : তামাছীল হচ্ছে ছুওয়ার বা প্রাণীর আকৃতি। হযরত হাসান বছরী রহমাতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন: সেই সময় এগুলোর চর্চা করা হারাম ছিল না। অর্থাৎ আমাদের সম্মানিত শারীয়াতে তা হারাম বা নাজায়িয। (যাদুল মাসীর ফী ইলমিত্ তাফসীর অর্থাৎ তাফসীরুল জাওযী সূরাহ সাবা ১৩ আয়াত শরীফ লেখক: হযরত আল্লামা জামালুদ্দীন আব্দুর রহমান বিন আলী বিন মুহম্মদ জাওযী হাম্বালী আশয়ারী রহমাতুল্লাহি আলাইহি ইন্তিকাল: ৫৯৭ হিজরী)

উল্লেখিত পবিত্র আয়াত শরীফ ও পবিত্র তাফসীরগ্রন্থ উনাদের ইবারত ও তার অনুবাদ থেকে যেসকল বিধান ও বিষয় প্রমাণিত হলো তা হচ্ছে-

১. মহান আল্লাহ পাক উনার সম্মানিত নবী ও রসূল হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম উনার যামানায় পূজা করা হয় না এমন প্রাণীর ছবি, মূর্তি, প্রতিকৃতি ইত্যাদীর চর্চা করা জায়িয ছিল। কিন্তু আমাদের শরীয়াত তথা সম্মানিত দ্বীন ইসলাম উনার মধ্যে এগুলোকে হারাম করা হয়েছে। পূর্ব সম্মানিত শরীয়াত উনার হুকুম মানসূখ বা রহিত হয়েছে।

২. পবিত্র আয়াত শরীফ উনাদের থেকে জানা যায় যে, দুনিয়ার শুরু থেকে সর্বযুগেই মূর্তি, প্রতিকৃতি, প্রাণীর ছবি ইত্যাদীর পূজা করা হারাম কুফ্রী ও র্শিকী ছিল। এ জন্য দেখা যায় যে, সমস্ত হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুছ ছলাতু ওয়াস সালাম উনারা উনাদের জাতীকে এ কাজগুলো থেকে ফিরে থাকতে নির্দেশ করেছিলেন।

৩. মূর্তি পূজা করা, প্রাণীর ছবি তোলা, আঁকা, দেখা ইত্যাদী অনুশীলন করার অর্থই হলো মহান আল্লাহ তায়ালা উনার প্রতি অবিশ্বাস করা এবং উনার সাথে শরীক করা।

৪. মূর্তি, প্রতিমা, প্রতিকৃতি, ভাস্কর্য, ম্যানিকিন, পুতুল, প্রাণীর ছবি ইত্যাদীর পূজা করা, সম্মান করা, দেখা, ঘরে রাখা, দেখতে সাহায্য করা, এগুলো বিস্তারকারী যন্ত্র ঘরে রাখা, এগুলোর চর্চা করা ইত্যাদী সবই হারাম কুফ্রী র্শিক ও বড় ধরনের নাফরমানী। এগুলোর অনুশীলনকারী ব্যক্তি জাহান্নামী। ক্বিয়ামতের দিন এদের জন্য কোন সাহায্যকারী থাকবে না।

৫. কুফ্রী, র্শিকী ও যত বড় গুনাহই হোক না কেন, যদি বান্দা তার থেকে খাছ তাওবাহ করে ঈমান ও আমলে ছালেহ উনাদের দিকে ফিরে আসে, তাহলে মহান আল্লাহ তায়ালা তিনি তাদের জীবনের সকল গুনাহ-খতা ক্ষমা করে দিয়ে নিস্পাপ করে দেন এবং নেককার বান্দাহ-বান্দী হিসেবে কবূল করে নেন। সুবহানাল্লাহ।

এ জন্য সকল মু’মিন-মুসলমান ইনসান-জিন পুরুষ-মহিলা সকলের দায়িত্ব কর্তব্য হলো এই যে, উল্লেখিত ও যাবতীয় হারাম, কুফ্র, র্শিক ও নাফরমানীমূলক কাজ থেকে ফিরে এসে খাছ তাওবাহ করে ঈমান ও আমলে ছালেহ উনাদের দিকে ধাবিত হওয়া। আর মহান আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা উনার ও উনার হাবীব নূরে মুজাস্সাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের সন্তুষ্টি-রেযামন্দী মুবারক অর্জন করা। মহান আল্লাহ তায়ালা রব্বুল আলামীন তিনি সকলকে সেই তাওফীক্ব দান করুন। আমীন।

 

অসমাপ্ত-

পরবর্তী সংখ্যার অপেক্ষায় থাকুন

কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস-এর দৃষ্টিতে প্রাণীর মূর্তি তৈরি করা ও ছবি আঁকা, তোলা, তোলানো, রাখা, রাখানো, দেখা, দেখানো হারাম নাজায়িয হওয়ার অকাট্য প্রমাণ ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া-২৫

জুমুয়া ও ঈদাইনের খুৎবা আরবী ভাষায় দেয়া ওয়াজিব। আরবী ব্যতীত অন্য কোন ভাষায় খুৎবা দেয়া মাকরূহ তাহরীমী ও বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহ ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া

কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস-এর দৃষ্টিতে প্রাণীর মূর্তি তৈরি করা ও ছবি আঁকা, তোলা, তোলানো, রাখা, রাখানো, দেখা, দেখানো হারাম নাজায়িয হওয়ার অকাট্য প্রমাণ ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া-২৬

জুমুয়া ও ঈদাইনের খুৎবা আরবী ভাষায় দেয়া ওয়াজিব। আরবী ব্যতীত অন্য কোন ভাষায় খুৎবা দেয়া মাকরূহ তাহরীমী ও বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহ ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া-২

কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস-এর দৃষ্টিতে প্রাণীর মূর্তি তৈরি করা ও ছবি আঁকা, তোলা, তোলানো, রাখা, রাখানো, দেখা, দেখানো হারাম নাজায়িয হওয়ার অকাট্য প্রমাণ ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া-২৭