সমঝ ও বিচক্ষণতা
ইমামুল মুসলিমীন, মুজাদ্দিদে মিল্লাত ওয়াদ দ্বীন, সাইয়্যিদুনা ইমামে আ’যম রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি সব সমস্যার সমাধানদাতা। যত কঠিন ও জটিল মাসয়ালা-মাসায়িল হউক না কেন তিনি তার অতি সহজভাবে সমাধান দিতেন। উনার সমঝ ও বিচক্ষণতা যতদূর অগ্রসর হতো, সমসাময়িক ইমাম-মুজতাহিদগণ উনাদের পক্ষে তার নাগাল পাওয়া সম্ভব ছিল না। নি¤েœাক্ত কয়েকটি ঘটনা থেকে তার সত্যতা প্রমানিত হয়-
১। জনৈক ব্যক্তি তার দুই ছেলের বিয়ের আয়োজন করলো একই দিনে। ঘটনাক্রমে ধুমধামের মধ্যে কনে পরিবর্তন হয়ে গেল। একের স্ত্রী অন্যের কাছে চলে গেল। স্বামী স্ত্রীর পূর্ব পরিচয় ছিল না। তাই উভয়ের রাতযাপন সম্পন্ন হলো। সকালে বাস্তব অবস্থা জানার পর শুরু হলো কানাকানি। আনন্দ পরিনত হলো বিষাদে। অনেক ইমাম-মুজতাহিদ ও হযরত আউলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম উপস্থিত হয়েছিলেন অলিমায়। হযরত ইমাম ছুফিয়ান ছাওরী রহমতুল্লাহি আলাইহি আলাইহি তিনি ফতওয়া দিলেন, “প্রত্যেক স্ত্রী ‘ওয়াতী বিশ শুবা’ তথা সন্দেজনক নির্জনবাসের কারণে ইদ্দত পালন করবে এবং স্বামী থেকে পৃথক থাকবে। ইদ্দত শেষে গমন করবে আসল স্বামীর কাছে।” এ ফতওয়া যদিও সম্মানিত শরীয়তসম্মত; কিন্তু এ ফতওয়ার ফলে ধুলায় মিশে যায় বর-কণে উভয়ের বিয়ের আনন্দ। অতঃপর ইমামে আ’যম হযরত ইমাম আবু হানীফাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে ফতওয়া জিজ্ঞাসা করা হলো। তিনি উভয় বরকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, যেই কনের সাথে তুমি রাত যাপন করেছ সে কি তোমার পছন্দ হয়েছে? প্রত্যেকে বলল, আমার খুবই পছন্দ হয়েছে। তিনি বললেন, তোমরা প্রত্যেকে নিজ নিজ স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দাও। তারা তালাক দিয়ে দিল। যেহেতু প্রকৃত স্বামীর সাথে স্ত্রীদের খালওয়াতে সহীহা বা সঠিক অভিসার হয়নি, তাই ইদ্দতের কোনো প্রয়োজন নেই।
হযরত ইমামে আ’যম রহমতুল্লাহি আলাইহি তখনই প্রত্যেকের তালাকপ্রাপ্তা আহলিয়াকে অন্যের কাছে বিবাহ দিয়ে দিলেন এবং বললেন যাও সুখে থাক। এভাবে নির্বিঘেœ সমস্যার সমাধানও হয়ে গেল এবং তাদের আনন্দও ব্যহত হলো না বিন্দুমাত্র। হযরত ছুফিয়ান ছাওরী রহমতুল্লাহি আলাইহি এ ফতওয়া শুনে বিস্মিত হলেন এবং ইমামে আ’যম রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার কপাল মুবারকে বুছা দিলেন। (আল আশবাহ ওয়ান নাযায়ের)
২। কিছু লোক বসে আছে একটি গৃহে। হঠাৎ উপর থেকে একটি সাপ পড়ে গেল। যার উপর সাপটি পড়ে, সে তা ছুড়ে মারে দ্বিতীয় ব্যক্তির উপর। দ্বিতীয় ব্যক্তি তৃতীয় ব্যক্তির উপর। তৃতীয় ব্যক্তি চতুর্থ ব্যক্তির উপর। চতুর্থ ব্যক্তি পঞ্চম ব্যক্তির উপর। পঞ্চম ষষ্ঠের উপর। ষষ্ঠ ব্যক্তির কাছে গিয়ে সাপটি তাকে দংশন করে। এখন তার দিয়াত (ক্ষতিপূরণ) কে বহন করবে? এ নিয়ে দেখা দেয় সঙ্কট। হযরত উলামায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনাদের মধ্যে আলোচনা চলতে থাকে। একেকজন একেক রকম জাওয়াব দেন। অতঃপর হযরত ইমামে আ’যম রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বললেন, দ্বিতীয় ব্যক্তির উপর নিক্ষেপ করার পর যেহেতু সাপ তাকে দংশন করেনি, তাই সে দিয়াতের দায়ভার থেকে মুক্ত। এভাবে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ ব্যক্তিও মুক্ত। কেননা তাদের নিক্ষেপের কারণে কোন ক্ষতি সৃষ্টি হয়নি। যখন পঞ্চম ব্যক্তি ষষ্ট ব্যক্তিকে নিক্ষেপ করলো, তখন যদি নিক্ষেপের সাথে সাথেই তাকে দংশন করে, তাহলে দিয়াত আরোপিত হবে পঞ্চম ব্যক্তির উপর। আর যদি নিক্ষেপ ও দংশনের মাঝে বিরতি হয়, তাহলে পঞ্চম ব্যক্তিও দায়মুক্ত থাকবে। কেননা তখন ষষ্ঠ ব্যক্তি নিজেই এর জন্য দায়ী। কেননা, সে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেনি।
৩। আল আশবাহ ওয়ান নাযায়ের কিতাবে বর্ণিত রয়েছে, হযরত ইমাম আবু ইউসুফ রহমতুল্লাহি আলাইহি এক সময় নিজের সম্মানিত শায়েখ হযরত ইমামে আ’যম রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার অনুমতি ব্যতিরেকেই শুরু করে দেন তা’লীম-তরবিয়ত। অথচ মুহাক্কিক পর্যায়ে পৌঁছতে উনার আরো কিছুদিন শায়েখ উনার ছোহবত বা সান্নিধ্যে থাকার প্রয়োজন ছিলো। ইমামে আ’যম হযরত আবু হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি হযরত ইমাম আবূ ইউসুফ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে এ কাজ থেকে বিরত রাখার জন্যে এক ব্যক্তিকে পাঁচটি মাসায়ালা ভালোভাবে বুঝিয়ে তার কাছে পাঠালেন এবং বললেন, তুমি এ মাসয়ালাগুলোর সমাধান তার নিকট জিজ্ঞাসা করো। লোকটি এসে এক একটি করে জিজ্ঞাসা করলো, যার বিবরণ নিম্নরূপ:
ক. এক ধোপা কাপড় গ্রহণের পর অস্বীকার করে বলে তোমার কোনো কাপড় আমার কাছে নেই। কিন্তু পরে মহান আল্লাহ পাক উনার ভয় সৃষ্টি হয় তার অন্তরে। তাই ধৌত কাপড় ফেরত দেয়। এখন উক্ত ধোপা পারিশ্রমিকের অধিকারী হবে কিনা? হযরত ইমাম আবূ ইউসুফ রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বললেন, অধিকারী হবে। লোকটি বলল, ভুল হয়েছে। তিনি আবার বললেন, অধিকারী হবে না। লোকটি বলল, তাও ভুল। অতঃপর সে নিজেই ব্যাখ্যা করে বলল, যদি কাপড় অস্বীকারের পূর্বেই ধুয়ে থাকে, পারিশ্রমিকের অধিকারী হবে। আর যদি পরে ধৌত করে, তাহলে পারিশ্রমিকের অধিকারী হবে না।