[সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ পাক রব্বুল আলামীনের জন্যে এবং অসংখ্য দুরূদ ও সালাম আল্লাহ্ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি। আল্লাহ্ পাক-এর অশেষ রহ্মতে “গবেষণা কেন্দ্র মুহম্মদিয়া জামিয়া শরীফ”-এর ফতওয়া বিভাগের তরফ থেকে বহুল প্রচারিত, হক্বের অতন্দ্র প্রহরী, বাতিলের আতঙ্ক ও আহ্লে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের আক্বীদায় বিশ্বাসী এবং হানাফী মাযহাব-এর অনুসরণে প্রকাশিত একমাত্র দলীল ভিত্তিক যামানার তাজদীদী মুখপত্র “মাসিক আল বাইয়্যিনাত” পত্রিকায় যথাক্রমে- ১. টুপির ফতওয়া (২য় সংখ্যা) ২. অঙ্গুলী চুম্বনের বিধান (৩য় সংখ্যা) ৩. নিয়ত করে মাজার শরীফ যিয়ারত করা (৪র্থ সংখ্যা) ৪. ছবি ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় হারাম হওয়ার ফতওয়া (৫ম-৭ম সংখ্যা) ৫. জুমুয়ার নামায ফরযে আইন ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ফতওয়া (৮ম-১০ম সংখ্যা) ৬. মহিলাদের মসজিদে গিয়ে জামায়াতে নামায পড়া মাকরূহ্ তাহ্রীমী সম্পর্কে ফতওয়া (১১তম সংখ্যা) ৭. কদমবুছী ও তার প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া (১২তম সংখ্যা) ৮. তাহাজ্জুদ নামায জামায়াতে পড়া মাকরূহ্ তাহ্রীমী ও বিদ্য়াতে সাইয়্যিয়াহ্ এবং তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া (১৩তম সংখ্যা) ৯. ফরয নামাযের পর মুনাজাত ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া (১৪-২০তম সংখ্যা) ১০. ইন্জেকশন নেয়া রোযা ভঙ্গের কারণ ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া (২১-২২তম সংখ্যা) ১১. তারাবীহ্-এর নামাযে বা অন্যান্য সময় কুরআন শরীফ খতম করে উজরত বা পারিশ্রমিক গ্রহণ করা জায়িয ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া (২৩-২৪তম সংখ্যা) ১২. তারাবীহ্ নামায বিশ রাকায়াত ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া (২৫-২৯তম সংখ্যা) ১৩. দাড়ী ও গোঁফের শরয়ী আহ্কাম ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া (৩০-৩৪তম সংখ্যা) ১৪. প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া (৩৫-৪৬তম সংখ্যা) ১৫. আযান ও ছানী আযান মসজিদের ভিতরে দেয়ার আহ্কাম এবং তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া (৪৭-৫০তম সংখ্যা) ১৬. দোয়াল্লীন-যোয়াল্লীন-এর শরয়ী ফায়সালা এবং তার প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া (৫১-৫২তম সংখ্যা) ১৭. খাছ সুন্নতী টুপি ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া (৫৩-৫৯তম সংখ্যা) ১৮. নূরে মুহম্মদী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া (৬০-৮২তম সংখ্যা) ১৯. ইমামাহ্ বা পাগড়ী মুবারকের আহ্কাম ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কিত ফতওয়া (৮৩-৯৬তম সংখ্যা) ২০. শরীয়তের দৃষ্টিতে আখিরী যোহ্র বা ইহ্তিয়াতুয্ যোহ্রের আহ্কাম এবং তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া (৯৭-১০০তম সংখ্যা) ২১. জানাযা নামাযের পর হাত তুলে সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করার শরয়ী ফায়সালা ও তার প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া (১০১-১১১তম সংখ্যা) এবং ২২. হিজাব বা পর্দা ফরযে আইন হওয়ার প্রমাণ ও তার প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া (১১২-১৩১তম সংখ্যা) ২৩. খাছ সুন্নতী ক্বমীছ বা কোর্তা এবং তার প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া (১৪০তম সংখ্যা) ২৪. হানাফী মাযহাব মতে ফজর নামাযে কুনূত বা কুনূতে নাযেলা পাঠ করা নাজায়িয ও নামায ফাসিদ হওয়ার কারণ এবং তার প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া (১৩২-১৫২তম সংখ্যা) ২৫. ইসলামের দৃষ্টিতে বিশ্বকাপ ফুটবল বা খেলাধুলা’র শরয়ী আহকাম ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ফতওয়া (১৫৫তম সংখ্যা) ২৬. হানাফী মাযহাব মতে পুরুষের জন্য লাল রংয়ের পোশাক তথা রুমাল, পাগড়ী, কোর্তা, লুঙ্গি, চাদর ইত্যাদি পরিধান বা ব্যবহার করা হারাম ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া (১৫৩-১৬০তম সংখ্যা) ২৭. ইসলামের নামে গণতন্ত্র ও নির্বাচন করা, পদপ্রার্থী হওয়া, ভোট চাওয়া ও দেয়া হারাম ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া (১৬১-১৭৫তম সংখ্যা) পেশ করার পর ১৬৮তম সংখ্যা থেকে-
২৮তম ফতওয়া হিসেবে
“কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস-এর দৃষ্টিতে প্রাণীর মূর্তি তৈরী করা ও ছবি আঁকা, তোলা, তোলানো, রাখা, রাখানো, দেখা, দেখানো হারাম নাজায়িয হওয়ার অকাট্য প্রমাণ ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া” পেশ করে আসতে পারায় মহান আল্লাহ পাক-এর দরবার শরীফে শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি।
“কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস-এর দৃষ্টিতে প্রাণীর মূর্তি তৈরী করা, করানো ও ছবি আঁকা, তোলা, তোলানো, রাখা, রাখানো, দেখা, দেখানো হারাম নাজায়িয হওয়ার অকাট্য প্রমাণ ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া” দেয়ার কারণ
সুন্নতের পথিকৃত, হক্বের অতন্দ্র প্রহরী, দ্বীন ইসলামের নির্ভীক সৈনিক, সারা জাহান থেকে কুফরী, শিরক ও বিদ্য়াতের মূলোৎপাটনকারী, বাতিলের আতঙ্ক এবং আহ্লে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের আক্বীদায় বিশ্বাসী একমাত্র দলীলভিত্তিক তাজদীদী মুখপত্র- “মাসিক আল বাইয়্যিনাত” পত্রিকায় এ যাবৎ যত লেখা বা ফতওয়াই প্রকাশ বা পত্রস্থ হয়েছে এবং ইনশাআল্লাহ হবে তার প্রতিটিরই উদ্দেশ্য বা মাকছূদ এক ও অভিন্ন। অর্থাৎ “মাসিক আল বাইয়্যিনাত”-এ এমন সব লেখাই পত্রস্থ হয়, যা মানুষের আক্বীদা ও আমলসমূহ পরিশুদ্ধ ও হিফাযতকরণে বিশেষ সহায়ক।
বর্তমানে ইহুদীদের এজেন্ট হিসেবে মুসলমানদের ঈমান আমলের সবচেয়ে বেশী ক্ষতি করছে যারা, তারা হলো ‘ওহাবী সম্প্রদায়’। ইহুদীদের এজেন্ট ওহাবী মতাবলম্বী উলামায়ে ‘ছূ’রা হারাম টিভি চ্যানেলে, পত্র-পত্রিকা, কিতাবাদী ও বক্তব্য বা বিবৃতির মাধ্যমে একের পর এক হারামকে হালাল, হালালকে হারাম, জায়িযকে নাজায়িয, নাজায়িযকে জায়িয বলে প্রচার করছে। (নাউযুবিল্লাহ)
স্মরনীয় যে, ইহুদীদের এজেন্ট, ওহাবী মতাবলম্বী দাজ্জালে কায্যাব তথা উলামায়ে ‘ছূ’রা প্রচার করছে “ছবি তোলার ব্যাপারে ধর্মীয় কোন নিষেধাজ্ঞা নেই” (নাউযুবিল্লাহ)। সম্প্রতি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, “নির্বাচন কমিশনার বলেছে, ছবি তোলার বিরুদ্ধে বললে জেল-জরিমানা হবে, নির্বাচন কমিশনার ভোটার আই.ডি কার্ডের জন্য ছবিকে বাধ্যতামূলক করেছে এবং ছবির পক্ষে মসজিদে, মসজিদে প্রচারণা চালাবে বলেও মন্তব্য করেছে। আর উলামায়ে ‘ছূ’রা তার এ বক্তব্যকে সমর্থন করে বক্তব্য দিয়েছে যে, “রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে পুরুষ-মহিলা সকলের জন্যেই ছবি তোলা জায়িয।” (নাউযুবিল্লাহ)। শুধু তাই নয়, তারা নিজেরাও অহরহ ছবি তুলে বা তোলায়।
অথচ তাদের উপরোক্ত বক্তব্য সম্পূর্ণ মিথ্যা, চরম বিভ্রান্তিকর ও কুফরীমূলক। তাদের এ বক্তব্যের কারণে তারা নিজেরা যেরূপ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তদ্রুপ তাদের উক্ত কুফরীমূলক বক্তব্য ও বদ্আমলের কারণে সাধারণ মুসলমানগণ ই’তিক্বাদী বা আক্বীদাগত ও আ’মালী বা আমলগত উভয় দিক থেকেই বিরাট ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
কারণ, তাদের উক্ত বক্তব্যের কারণে যারা এ আক্বীদা পোষণ করবে যে, “রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে ছবি তোলা জায়িয” তারা ঈমানহারা হয়ে কাট্টা কাফির ও চির জাহান্নামী হবে। কারণ শরীয়তের দৃষ্টিতে হারাম বা নাজায়িযকে হালাল বা জায়িয বলা কুফরী। কেননা কিতাবে স্পষ্টই উল্লেখ আছে যে,
استحلال المعصية كفر.
অর্থাৎ, “গুণাহের কাজ বা হারামকে হালাল মনে করা কুফরী।” (শরহে আক্বাঈদে নাসাফী।)
অতএব, বলার আর অপেক্ষাই রাখেনা যে, উলামায়ে “ছূ”দের উক্ত বক্তব্য সাধারণ মুসলমানদের আক্বীদা বা ঈমানের জন্য বিশেষভাবে হুমকিস্বরূপ।
অনুরূপ “ছবি তোলার ব্যাপারে ধর্মীয় কোন নিষেধ নেই বা রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে সকলের জন্যে ছবি তোলা জায়িয” উলামায়ে “ছূ”দের এ কুফরীমূলক বক্তব্য মুসলমানদের আমলের ক্ষেত্রেও বিশেষ ক্ষতির কারণ। কেননা যারা তাদের উক্ত বক্তব্যের কারণে ছবি তুলবে (যদিও হারাম জেনেই তুলুক না কেন) তারা আল্লাহ পাক ও তাঁর হাবীব কর্তৃক নিষিদ্ধকৃত কাজে তথা হারাম কাজে মশগুল হবে যা শক্ত আযাব বা কঠিন গুণাহের কারণ। কেননা হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে-
قال حدثنا الاعمش عن مسلم قال كنا مع مسروق فى دار يسار بن نمير فراى فى صفته تماثيل فقال سمعت عبد الله قال سمعت النبى صلى الله عليه وسلم يقول ان اشد الناس عذابا عند الله المصورون.
অর্থঃ হযরত আ’মাশ রহমতুল্লাহি আলাইহি মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি মাসরূক রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর সঙ্গে ইয়াসার ইবনে নুমাইয়-এর ঘরে ছিলাম, তিনি তাঁর ঘরের মধ্যে প্রাণীর ছবি দেখতে পেলেন, অতঃপর বললেন, আমি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর নিকট শুনেছি, তিনি বলেন, আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “নিশ্চয়ই মানুষের মধ্যে ঐ ব্যক্তিকে আল্লাহ পাক কঠিন শাস্তি দেবেন, যে ব্যক্তি প্রাণীর ছবি তোলে বা আঁকে।” (বুখারী শরীফ ২য় জিঃ, পৃঃ ৮৮০)
উক্ত হাদীছ শরীফ-এর ব্যাখ্যায় “উমদাতুল ক্বারী শরহে বুখারীতে” উল্লেখ আছে,
وفى التوضيح قال اصحابنا وغيرهم صورة الحيوان حرام اشد االتحريم وهم من الكبائر.
অর্থঃ ‘তাওজীহ’ নামক কিতাবে উল্লেখ আছে যে, হযরত উলামায়ে কিরামগণ প্রত্যেকেই বলেন, জীব জন্তুর ছবি বা প্রতিমূর্তি নির্মাণ করা হারাম, বরং কঠো হারাম এবং এটা কবীরাহ গুণাহর অন্তর্ভুক্ত।
অতএব, নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, উলামায়ে “ছূ”দের উক্ত বক্তব্য ও বদ আমলের কারণে সাধারণ মুসলমানগণ ছবি তুলে প্রকাশ্য হারাম কাজে মশগুল হয়ে কঠিন আযাবের সম্মুখীন হবে যা আমলের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে ক্ষতিকর।
কাজেই, যারা এ ধরণের কুফরী আক্বীদায় বিশ্বাসী ও কুফরী বক্তব্য প্রদানকারী তারা ও হক্ব সমঝদার মুসলমানগণ ঈমান ও আমলকে যেন হিফাযত করতে পারে অর্থাৎ মূর্তি বা ছবিসহ সকল বিষয়ে আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের আক্বীদা অনুযায়ী আক্বীদা পোষণ করতে পারে এবং কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস মোতাবেক আমল করে আল্লাহ পাক-এর রিযামন্দী হাছিল করতে পারে সে জন্যেই “কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস-এর দৃষ্টিতে প্রাণীর মূর্তি তৈরী করা ও ছবি আঁকা, তোলা, তোলানো, রাখা, রাখানো, দেখা, দেখানো হারাম নাজায়িয হওয়ার অকাট্য প্রমাণ ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কিত ফতওয়াটি” পূণরায় প্রকাশ করা হলো।
পূর্ব প্রকাশিতের পর
শরীয়তের দৃষ্টিতে টিভি চ্যানেলে ইসলামী প্রোগ্রাম করা ও দেখা হারাম
ইসলামী শরীয়তের ছহীহ ও গ্রহণযোগ্য ফতওয়া মতে, টেলিভিশনে প্রাণীর ছবি ভিত্তিক যে কোন প্রোগ্রাম দেখা ও ইসলামী বা অনৈসলামিক যে কোন প্রোগ্রাম করা সম্পূর্ণরূপেই হারাম ও নাজায়িয। কোন কোন জাহিল ও গোমরাহ লোক বলে থাকে যে, টেলিভিশন “আয়নার মত” আয়ানায় যা দেখা জায়িয টেলিভিশনেও তা দেখা জায়িয। নাউযুবিল্লাহ। আবার কেউ কেউ বলে, টেলিভিশনে পূর্বে ধারণকৃত অনুষ্ঠান করা ও দেখা হারাম। কারণ তা ছবি বা ফটোর অন্তর্ভুক্ত। আর যে সকল অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করা হয় তা দেখা বা করা হারাম নয়। কারণ তা ছবি বা ফটোর পর্যায় পড়ে না।
মূলতঃ টেলিভিশন ও ছবি সম্পর্কে আশাদ্দুদ দরজার জাহিল হওয়ার কারণেই তারা এরূপ জিহালতপূর্ণ মন্তব্য করে থাকে। এ ব্যাপারে সকলেই একমত যে, টেলিভিশনের পর্দায় যা দেখা যায় তা ধারণকৃত হোক বা সরাসরি সম্প্রচারিত হোক প্রত্যেকটাই ছবি। কেননা ছবির সংজ্ঞায় উল্লেখ আছে যে, “আলোর প্রতিফলণ বা প্রতিসরণ ব্যতীত অন্য যে কোন পদ্ধতিতেই হোক না কেন, যদি কোন বস্তু বা জীব যে কোন স্থানে আকার আকৃতিতে দৃশ্যমান হয়, তবে সেই আকার আকৃতিটিকে শরীয়তের দৃষ্টিতে উহার ছবি বলে। পক্ষান্তরে শরীয়তের দৃষ্টিতে কোন বস্তু বা জীব যেখানেই যে অবস্থায়ই থাকুক, আলোর প্রতিফলন বা প্রতিসরণ বা উভয়ের মাধ্যমে যদি তা যে কোন স্থানে আকার আকৃতিতে দৃশ্যমান হয় তবে সেই আকার আকৃতিটি ছবি নয়।
আর টেলিভিশনে প্রদর্শিত দৃশ্যাবলী যে ছবি তা বর্ণনা দ্বারাই প্রমানিত হয়। “টেলিভিশন (Television): টেলিভিশনের মাধ্যমে শব্দ শোনার সাথে সাথে বস্তুর ছবি দেখতে পাওয়া যায়। বৃটিশ বিজ্ঞানী লজি বেয়ার্ড ১৯২৩ সালে প্রথম টেলিভিশন আবিষ্কার করে। ১৯৪০ সালে টি. ভি বর্তমান অবস্থায় উন্নত হয়।
T.V/Closed Circuit T.V/Video Cassette Recorder/Video Cassette player ইত্যাদির কার্যাবলীকে তিনভাগে ভাগ করা যায়।
যথাঃ ১. Transmission বা প্রেরণ। ২. Medium বা মাধ্যম। ৩. Reception বা গ্রহণ T.V এবং V.C.R বা V.C.P এর ক্ষেত্রে প্রথমে কোন বস্তুর ছবি তুলে সেই ছবির বিভিন্ন অংশের, আর Closed Circuit T.V এর ক্ষেত্রে কোন বস্তুর সরাসরি বিভিন্ন অংশের প্রতিফলিত ফোটনের Frequency অনুযায়ী এক ধরনের Electrical Signal তৈরী হয়। সেই Signal কে আরও Processing এরপর Transmit করা হয়। T.V এর ক্ষেত্রে Transmit করা হয় বাতাসে। আর V.C.R এবং Closed Circuit T.V.এর ক্ষেত্রে তারের মধ্যে। মাধ্যম বাতাসই হোক আর তারই হোক সেটা Receiver (অর্থাৎ T.V) এ যখন আসে তখন সেটা Receive করার পর কিছু Processing করা হয়, এই Signal গুলো T.V তে অবস্থিত একটি Electronic Gun কে নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে এই Gun টি T.V এর পর্দার যে অংশে যতটুকু Electron ছাড়লে হুবহু Transmit করা ছবির মত হবে সে অংশে ততটুকু ইলেক্ট্রন ছাড়ে। এই ঊ Electron গুলো রাসায়নিক প্রলেপ পতিত হয়ে উজ্জ্বল ও অনুজ্জ্বল বিন্দুর সমন্বয়ে ছবি তৈরী করে। এই ছবি T.V এর পর্দায় দেখা যায়। অর্থাৎ T.V/V.C.R/V.C.P/Closed Circuit T.V. সবক্ষেত্রেই পর্দায় যা আসছে সেটা সুস্পষ্ট এবং বিশেষভাবে অঙ্কিত ছবি।
কাজেই, টেলিভিশন আয়নার মত এবং টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারিত দৃশ্যাবলী ছবি নয় তাদের একথা সম্পূর্ণ ভুল ও শরীয়ত বিরোধী। মূলতঃ তারা টেলিভিশনে কিভাবে ছবি আসে সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট জ্ঞান না থাকার কারণেই বিভ্রান্তিতে পড়েছে।
কোন কোন জাহিল বলে থাকে যে, টিভি চ্যানেল একটি ভাল প্রচার মাধ্যম। নাউযুবিল্লাহ। আবার কেউ কেউ বলে টিভিতে ইসলামী প্রোগ্রাম করা ও দেখা জায়িয। কারণ, এতে অনেক ফায়দা বা শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। নাউযুবিল্লাহ।
মূলতঃ কোন প্রচার যন্ত্র ভাল কিংবা মন্দ, সেটা কারো ব্যক্তিগত অভিমতের সাথে সম্পর্কযুক্ত নয়। বরং ভাল-মন্দ ফায়ছালা হবে শরীয়তের দৃষ্টিতে। টেলিভিশনের মূলেই হচ্ছে ছবি, যা দেখা এবং দেখানো শরীয়তে সম্পূর্ণরূপে হারাম ও নাজায়িয।
এ সম্পর্কে মুসলিম শরীফ ২য় জিঃ ২০১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-
عن ابى معاوية رضى الله تعالى عنه ان من اشد اهل النار يوم القيمة عذابا المصورون.
অর্থঃ হযরত মুয়াবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত, “নিশ্চয়ই ক্বিয়ামতের দিন দোযখবাসীদের মধ্যে ঐ ব্যক্তির কঠিন আযাব হবে, যে ব্যক্তি প্রাণীর ছবি আঁকে বা তোলে।”
মিশকাত শরীফ এর ৩৮৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-
عن عبد الله بن مسعود رضى الله تعالى عنه قال سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول اشد الناس عذابا عند الله المصورون.
অর্থঃ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, আমি আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, আল্লাহ পাক ঐ ব্যক্তিকে কঠিন শাস্তি দিবেন, যে ব্যক্তি প্রাণীর ছবি তোলে বা আঁকে।
উমদাতুল ক্বারী, ফতওয়ায়ে ছিদ্দীক্বিয়া ৩৭৮ পৃষ্ঠা ও আজ জাওয়াজির ২য় জিঃ ৩৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-
وفى التوضيح قال اصحبنا وغيرهم صورة الحيوان حرام اشد التحريم وهم من الكبائر سواء صنعه لما يمتهن او لغيره فحرام بكل حال لان فيه مضاهاة لخلق الله وسواء كان فى ثوب او بساط او دينار اودرهم او فلس او اناء او حائط.
অর্থঃ ‘তাওজীহ’ নামক কিতাবে উল্লেখ আছে যে, জীব জন্তুর ছবি বা প্রতিমূর্তি নির্মাণ করা হারাম, বরং কঠোর হারাম। এটা কবীরাহ গুনাহ। চাই ওটাকে যতœ বা সম্মান প্রদর্শন করুক কিংবা অন্য যে কোন উদ্দেশ্যেই বানিয়ে থাকুক। কেননা এরূপ কাজে আল্লাহ পাক-এর সৃষ্টির অনুকরণ করা হয়। ওটা বস্ত্রে, বিছানায়, মোহরে, মুদ্রায়, পয়সায়, পাত্রে কিংবা প্রাচীর গাত্রে যে কোন স্থানে আঁকা বা নির্মাণ করা হারাম।
শরহে মুসলিম, নববী ও ফতওয়ায়ে ছিদ্দীক্¡িয়াহ কিতাবের ৩৭৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-
وهذه الاحاديث صريحة فى تحريم تصوير الحيوان وانه غليظة التحريم ايضا فيه وما من لم يقصد بها العبادة ولمضاهاة فهو فاسق صاحب ذنب كبير.
অর্থঃ উক্ত হাদীছ শরীফসমূহে প্রাণীর ছবি তৈরী করা বা মূর্তি নির্মাণ করা হারাম হওয়া সম্মন্ধে প্রকাশ্যেই বলা হয়েছে। এটা তৈরী বা নির্মাণ করা জঘন্যতম পাপের কাজ ও হারামও বটে। উক্ত কিতাবে আরও আছে, যদি কেউ মূর্তি বা প্রাণীর ছবি পূজা বা সৃষ্টির অনুকরণের জন্য নাও বানিয়ে থাকে তবুও সে ফাসিক হবে এবং কবীরাহ গুণাহে গুণাহগার হবে।
কাজেই, প্রচার যন্ত্র হিসেবে টেলিভিশন যতই ভাল হোক না কেন, আর তার দ্বারা প্রকাশ্যে দেশ ও জাতির যতবড় ফায়দা বা কল্যাণই সাধিত হোক না কেন, তা শরীয়তে গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ হাক্বীক্বীভাবে টেলিভিশনের মাধ্যমে মানুষের ঈমান, আমল, আখলাক সমস্ত কিছুই বরবাদ হয়ে যায়।
কুরআন শরীফে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন-
يَسْأَلُوْنَكَ عَنِ الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ قُلْ فِيْهِمَاۤ اِثْمٌ كَبِيْرٌ وَّمَنَافِعُ لِلنَّاسِ وَاِثْمُهُمَاۤ اَكْبَرُ مِنْ نَفْعِهِمَا.
অর্থঃ হে হাবীব! আপনাকে প্রশ্ন করা হয়, মদ ও জুয়া সম্পর্কে। আপনি বলে দিন, এ দু’টির মধ্যে রয়েছে কবীরাহ গুনাহ। এবং মানুষের জন্য ফায়দাও রয়েছে। তবে ফায়দার চেয়ে গুনাহই বড়। (সূরা বাক্বারা-২১৯)
এখানে লক্ষ্যণীয় যে, আল্লাহ পাক নিজেই স্বীকার করেছেন যে, মদ ও জুয়ার মধ্যে দুনিয়াবী ফায়দা রয়েছে। মদ পান করলে স্বাস্থ্য ভাল হয়, জুয়া খেললে রাতারাতি অনেক টাকা পাওয়া যায়। তথাপি এগুলোর মধ্যে ফায়দার চেয়ে গুণাহ বেশী বলে এগুলোকে হারাম করা হয়েছে। সুতরাং মদ ও জুয়ার মধ্যে উপকারিতা থাকা সত্বেও এগুলো গ্রহণযোগ্য নয়, এগুলো হারাম। মদ ও জুয়ার মধ্যে উপকারিতার জন্য কেউ যদি এটাকে জায়িয মনে করে, তবে সে কুফরী করলো। তদ্রুপ ছবির মাধ্যমে প্রচারিত শিক্ষণীয় বিষয়কে কেউ যদি জায়িয মনে করে তবে সেও কুফরী করলো।
আল্লাহ পাক আরো বলেন-
وَالَّذِىْ خَبُثَ لاَ يَخْرُجُ اِلاَّ نَكِدًا.
অর্থঃ “যা নাপাক তা থেকে নাপাক ব্যতীত কিছু বের হয় না। (সূরা আ’রাফ-৫৮)
যেমন পেশাবের মধ্যে এসিড রয়েছে যার কারণে তা দিয়ে ময়লা কাপড় ধৌত করলে পরিষ্কার হবে, কিন্তু পাক হবে না। যদিও বাহ্যিকভাবে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন দেখা যায়, তথাপিও আভ্যন্তরীণ নাপাকীর কারণে তা পরিধান করে নামায পড়া জায়িয হবে না।
সুতরাং টেলিভিশন, ভিসিআর ইত্যাদির মধ্যে যদিও কোন প্রকার শিক্ষণীয় বিষয় প্রচার অথবা ইসলামী প্রোগ্রাম অনুষ্ঠিত হয়, কিন্তু যেহেতু তার মূলই হলো ছবি যা স্পষ্টতই হারাম ও নাজায়িয। তাই টেলিভিশনও সম্পূর্ণরূপে হারাম ও নাজায়িয।
এছাড়াও বর্তমানে টেলিভিশনের অন্যান্য অশ্লীলতার কারণেও এগুলো হারামের অন্তর্ভুক্ত। কেননা আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন-
وَلَا تَلْبِسُوا الْحَقَّ بِالْبَاطِلِ
অর্থঃ “সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশ্রিত করো না। (সূরা বাক্বারা-৪২ )
আল্লাহ পাক আরো বলেন-
اَفَتُؤْمِنُوْنَ بِبَعْضِ الْكِتَابِ وَتَكْفُرُوْنَ بِبَعْضٍ
অর্থঃ “তোমরা কিতাবের কিছু অংশ মানবে, আর কিছু অংশ মানবে না, তা হবে না (সূরা বাক্বারা-৮৫)
সুতরাং টিভিতে বা ভিসিআর এ জ্ঞানমূলক, শিক্ষামূলক কিংবা ইসলামী অনুষ্ঠান প্রচার বা দেখার মধ্যে বাহ্যিকভাবে কিছু উপকারিতা থাকা সত্বেও, যেহেতু এসবের মূল হচ্ছে ছবি, যার ফায়দার চেয়ে গুণাহই বড়। তাই টিভি, ভিডিওতে কোন অনুষ্ঠান করা বা দেখা সম্পূর্ণরূপে হারাম ও নাজায়িয।
অতএব, টিভি বা যে কোন প্রচার মাধ্যমে ছবির সাহায্যে কোন কিছু প্রচার-প্রসার করা হলে, তা যতই শিক্ষণীয় হোক বা যে কোন ব্যক্তির মাধ্যমে পরিচালিত হোক না কেন, সেটা সম্পূর্ণরূপে হারাম ও নাজায়িয।
যারা আজ টিভিতে প্রোগ্রাম করছে তাদের কিতাবেও রয়েছে টিভিতে প্রোগ্রাম করা হারাম
উল্লেখ্য, আজকে যারা টিভি চ্যানেলে প্রোগ্রাম করছে যেমন তথাকথিত শাইখুল হাদীছ, মুফতে আমীনী গং অথচ তারাই তাদের কিতাবে টিভিতে যেকোন ধরনের প্রোগ্রাম এমনকি হজ্জ প্রচার করাকেও হারাম বলে ফতওয়া দিয়েছে। যেমন- তথাকথিত শাইখুল হাদীছের মাদরাসা থেকে প্রকাশিত ‘ফতওয়ায়ে রহমানিয়াতে’ লিখেছে,
জিজ্ঞাসাঃ মাসিক মুজাহিদ বার্তা অক্টোবর ’৯৯ সংখ্যায় ২৭নং প্রশ্নের উত্তরে লিখেছেন, বাদ্য ব্যতীত ইসলামী গান, গযল ও খবর রেডিওতে পরিবেশন ও শোনা যাবে। টেলিভিশনে মহিলা ব্যতীত পরিবেশিত খবর ও ইসলামী অনুষ্ঠান ও শিক্ষামূলক ধর্মীয় অনুষ্ঠান দেখা যাবে। অথচ মাসিক রাহমানী পয়গাম অক্টোবর ’৯৯ সংখ্যায় লিখছেন কোন অবস্থায়ই টেলিভিশনের কোন অনুষ্ঠান দেখা জায়িয হবে না। সঠিক উত্তর জানতে ইচ্ছুক।
জবাবঃ মুজাহিদ বার্তায় যে টেলিভিশনের কথা বলেছে তা আজ কোথায় আছে? স্যাটেলাইট ও ইন্টারনেটের এ যুগে মুজাহিদ বার্তার মাসয়ালা কল্পনা বিলাস ছাড়া আর কি হতে পারে? তাছাড়া টিভি দেখা না জায়িয হওয়ার উল্লেখযোগ্য একটি কারণ হলো ধারণকৃত প্রাণীর ছবি। কারণ শরীয়তের দৃষ্টিতে প্রাণীর ছবি ধারণ করে রাখা অঙ্কনের নামান্তর। আর ধারণ করা যেমন না জায়িয, তেমনি ইচ্ছাকৃতভাবে তা দেখাও না জায়িয। কারণ এতে ছবি দেখার সাথে সাথে হারাম কাজের সহযোগিতা করা হয়। অথচ কিছু খেলাধুলা ছাড়া টিভির প্রোগ্রাম সাধারণত পূর্ব থেকে ধারণকৃতই হয়ে থাকে। সুতরাং সর্বাবস্থায় এটা রাখা ও দেখা হারাম।
সর্বক্ষণ যার মধ্যে চরম বেহায়াপনাসহ হারাম প্রোগ্রাম চলতে থাকে তার মধ্যে সামান্য কিছু সময় ইসলামী প্রোগ্রাম করা দ্বীন অবমাননা এবং দ্বীন নিয়ে ঠাট্টা তামাশার শামিল। এর দৃষ্টান্ত এরূপ যে, নাচ-গানের আসরের ফাঁকে ফাঁকে দ্বীনের নছীহত করা, ওয়াজ করা বা নর্দমা দিয়ে মিষ্টান্ন ভেসে আসা। সুতরাং টিভিতে দ্বীনী প্রোগ্রাম করা নিঃসন্দেহে দ্বীনকে অপমান করা। যা স্বয়ং কুরআন শরীফেই নিষেধ করা হয়েছে এবং এটাকে ইহুদীদের চরিত্র বলা হয়েছে। সুতরাং বর্তমানে টিভিতে দ্বীনী প্রোগ্রাম জায়িয হওয়ার প্রশ্নই আসে না।
জিজ্ঞাসাঃ ভি.সি.আর দেখা শরীয়তের দৃষ্টিতে জায়িয কি না?
জবাবঃ প্রচলিত টিভি, ভিসিআর ইত্যাদি দেখা বা ঘরে রাখা সম্পূর্ণরূপে নাজায়িয, হারাম ও কবীরা গুণাহ। দুনিয়া ও আখিরাত উভয় দিক দিয়েই এসবের মধ্যে বহু ক্ষতি রয়েছে। এর বিস্তারিত ব্যাখ্যার জন্য একটি পুস্তক রচনার প্রয়োজন। ইসলাম বিদ্বেষীদের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে আজ সাধারণতঃ এগুলোতে যা কিছু প্রদর্শিত হচ্ছে, এসবের মাধ্যমে সমাজে হাজারো অপকর্ম ও গুণাহের দ্বার উম্মুক্ত করে দিয়ে পুরো সমাজটাকে ধ্বংস করে মুসলমানদের ঈমান নষ্ট করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এসব চরিত্র বিধ্বংসী উপকরণ কোন ঘরে প্রবেশ করলে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, সে ঘর থেকে কালক্রমে দ্বীন ইসলামের অস্তিত্ব মুছে যেতে বাধ্য। এখানেই শেষ নয়, এর কারণে আমাদের সমাজ থেকে ইসলামী সভ্যতা-সংস্কৃতি বিদায় নিয়ে বিজাতীয় নোংড়া সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। যার বিষক্রিয়ায় আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজ নির্লজ্জ ও নৈতিকতাহীনতার চরম বিপর্যয়ে নিপতিত হচ্ছে। সার্বক্ষনিক অসংখ্য নোংরামি মাঝে কখনো এক আধটু ধর্মীয় কিংবা সভ্যতার বাণী প্রচার করা হলেও তা অপবিত্র নোংরা ড্রেনের দুধের প্রস্রবন সদৃশ। সে দুধ যেমন কোন রুচিশীল মানুষ পান করতে পারে না, তেমনি ওদের এসব প্রচারণা জাতীয় কল্যান বয়ে আনতে পারে না। আর এগুলোতে যে চিত্র দেখানো হয় তা মূলতঃ ফিল্মের স্থির চিত্র যা যন্ত্রের সাহায্যে চলমান করা হয়। আর এধরনের ফিল্ম চিত্র ফটোর শামিল। কোন মানুষ বা প্রাণীর ছবি যেমন ঘরে সাজিয়ে রাখা, লটকানো বা প্রদর্শিত করা যায় না। তেমনিভাবে এগুলোও নাজায়িয। সুতরাং বাহ্যিকভাবে ভালো কোন অনুষ্ঠান চিত্র যেমন সংবাদ, তিলাওয়াত, ওয়াজ ও ইসলামী কোন প্রোগ্রাম-চিত্রও টিভিতে দেখা জায়িয নয়। এর দ্বারা গুনাহের কাজে সহযোগিতা করা হয়।
জিজ্ঞাসা: টিভিতে প্রচারিত হজ্জের কার্যসমূহ দেখার ব্যাপারে শরীয়তের দৃষ্টিতে কোন নিষেধ আছে কি না? যদি নিষেধ থাকে, তাহলে কেন? আর সরাসরি সম্প্রচার করা বা পূর্বে ভিডিও করে সম্প্রচার করার মাঝে কোন পার্থক্য আছে কিনা? বিস্তারিত জানতে ইচ্ছুক।
জবাব: বর্তমানে প্রচারিত টিভিতে কোন অনুষ্ঠান দেখা বা দেখানোর অনুমতি শরীয়তে নেই। বরং সকল প্রকার অনুষ্ঠান দেখাই কবীরাহ গুনাহ ও হারাম। যদিও সেটা ইসলামী অনুষ্ঠান হয়। সুতরাং হজ্জের কার্যাবলীও টিভিতে দেখা জায়িয হবে না। সরাসরি সম্প্রচার করা হোক অথবা পূর্বে উক্ত দৃশ্য যন্ত্রের সাহায্যে ধারণ করে পরে সম্প্রচার করা হোক। এতদুভয়ের মাঝে কোন তফাৎ নেই। কেননা ফিল্ম কোম্পানী এ কাজ করতে যে সকল যন্ত্র ব্যবহার করে থাকে, সবই খেল-তামাশার বস্তু। আর এমন বস্তুকে দ্বীনের মৌলিক ইবাদতের মধ্যে প্রবেশ করানো দ্বীনের অবমাননা ও দ্বীনকে তামাশার বস্তুতে পরিণত করার নামান্তর। আর এতদ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে ভয়াবহ আযাবের কথা ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
তাছাড়া হজ্জের অধিকাংশ কার্যক্রমই হল আমলে তা’আব্বুদী তথা শরীয়ত কর্তৃক অবধারিত হুকুম। যার মাঝে যুক্তির বিন্দুমাত্র অবকাশও নেই। সুতরাং ইসলাম বিরোধীরা যখন এ ধরনের বিষয় টিভিতে দেখবে, তখন তারা অহেতুক যুক্তির পেছনে পড়ে নিজেদের শরীয়ত বিরোধী দাবিসমূহ প্রমাণের অপপ্রয়াস চালাবে। আর দ্বীনের এসব বিষয় নিয়ে উপহাস করতে থাকবে।
শুধু তাই নয়, বরং হজ্জের অনুষ্ঠান দেখার সময় বেগানা মহিলাদের চেহারা থেকে মুক্তি থাকাও সম্ভব নয়। যেমন, অনুষ্ঠান আরম্ভ হওয়ার ঘোষণা সাধারণত মেয়েরাই দিয়ে থাকে। অতঃপর মাঝে মাঝে বিভিন্ন জিনিসের নাজায়িয বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়ে থাকে। যেগুলো দর্শন করা শরীয়তসম্মত নয়।
প্রকাশ থাকে যে, টিভি’র অনুষ্ঠানমালা যদি পূর্বে ধারণ করে সম্প্রচার করা হয়, তাহলে সেটা ফটো ও ছবি ব্যবহার করা হুকুমে পড়বে যা সম্পূর্ণ হারাম। পক্ষান্তরে যদি পূর্বে ধারণ না করে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়, তাহলে দ্বীন ও ইবাদতকে তামাশার বস্তুতে রূপান্তরিত করার কারণে তা নাজায়িয হবে।
যে সকল মাওলানারা ইসলামের নামে টিভি চ্যানেলে প্রোগ্রাম করে তারা উলামায়ে ‘ছূ’ বা ধর্মব্যবসায়ী। তাদের বক্তব্য শুনা ও তাদের পিছনে নামায পড়া হারাম
কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফের অকাট্য দলীলের দ্বারা সুস্পষ্ট ও অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, প্রাণীর ছবিভিত্তিক সর্বপ্রকার টিভি চ্যানেলই ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে হারাম ও নাজায়িয। চাই তা ইসলামের নামে হোক অথবা অনৈসলামিক হোক। কারণ ক্ষেত্র বিশেষে বেপর্দা ও গান-বাজনা থেকে বাঁচা সম্ভব হলেও ছবি তোলার গুনাহ থেকে বাঁচা কখনোই সম্ভব নয়। অথচ ছবি তোলা সম্পূর্ণ হারাম ও নাজায়িয। যার বহু প্রমাণ উপরে উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং যে সকল মাওলানা টিভি চ্যানেলে ইসলামের নামে প্রোগ্রাম করছে তারা ছবি তুলে প্রকাশ্য হারাম কাজ করছে। শুধু তাই নয়, যে টিভি চ্যানেলে ২৪ ঘণ্টা বেপর্দা, অশ্লীলতা, গান-বাজনা, সিনেমা, নাটকসহ অসংখ্য হারাম, কুফরী ও শরীয়ত বিরোধী কর্মকা- প্রচার হচ্ছে তার সাথে ‘ইসলামকে’ মিশ্রিত করছে। অর্থাৎ হক্বকে না হক্বের সাথে মিশ্রিত করছে।
কাজেই, যারা প্রকাশ্যে হারাম কাজে মশগুল, যারা হক্বকে নাহক্বের সাথে মিশ্রিত করে, তারা কি করে হক্কানী আলিম হতে পারে। কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াস-এর দৃষ্টিতে তারা কস্মিনকালেও হক্কানী আলিম নয়। বরং তারা হচ্ছে নাহক্ব আলিম তথা উলামায়ে ‘ছূ’ অর্থাৎ ধর্মব্যবসায়ী মৌলবী।
হক্ব আলিম ও নাহক্ব আলিমের সংজ্ঞা ও পরিচিতি তুলে ধরলেই বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে যাবে।
হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে-
عن الاحوص بن حكيم عن ابيه سئل رجل النبى صلى الله عليه وسلم عن الشر فقال لاتسئلونى عن الشر وسلونى عن الخير يقولها ثلاثا ثم قال الا ان شر الشر شرار العلماء وان خير الخير خيار العلماء.
অর্থ: হযরত আহওয়াছ ইবনে হাকীম রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর পিতা হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন,- এক ব্যক্তি সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট নিকৃষ্ট লোক সম্পর্কে জানার জন্যে প্রশ্ন করলেন। তখন সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “তুমি আমাকে খারাপ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করো না বরং ভাল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করো। তিনি উহা তিনবার বললেন। অতঃপর বললেন, সাবধান! নিশ্চয়ই নিকৃষ্টেরও নিকৃষ্ট লোক হলো- উলামায়ে ‘ছূ’ অর্থাৎ দুনিয়ালোভী ধর্মব্যবসায়ী মাওলানারা। আর নিশ্চয়ই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ হচ্ছেন হক্কানী-রব্বানী আলিমগণ। (দারেমী শরীফ)
উপরোক্ত হাদীছ শরীফে মূলতঃ দু’প্রকার আলিমের কথা বলা হয়েছে। যথা- ১. হক্ব আলিম। ২. নাহক্ব আলিম। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- হক্ব আলিম আর নাহক্ব আলিমের পরিচয় কি?
হক্ব আলিম কে?
দ্বীনে হক্ব মানুষের নিকট পৌঁছে দেয়ার জন্যে হক্ব আলিমের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। মূলতঃ এ দ্বীনকে মহান আল্লাহ পাক রব্বুল আলামীন পৃথিবীতে ক্বিয়ামত পর্যন্ত ক্বায়িম রাখবেন হক্কানী আলিমগণের মাধ্যমে। এ প্রসঙ্গে তাফসীরে উল্লেখ করা হয় যে, মহান আল্লাহ পাক যখন সকল রূহ বা আত্মা সৃষ্টি করলেন, তখন সকল রূহকে একত্রিত করে জিজ্ঞাসা করলেন, আমি কি তোমাদের রব নই? তখন রূহসমূহ জবাবে বললেন, হ্যাঁ, আপনি আমাদের রব।
আল্লাহ পাক রূহসমূহকে লক্ষ্য করে বললেন, “হে রূহ সম্প্রদায়! তোমরা যখন দুনিয়াতে যাবে, দুনিয়াতে গিয়ে আমার এ প্রতিজ্ঞার কথা ভুলে যেওনা। তখন রূহ সম্প্রদায় বললেন, বারে ইলাহী! আমরা আজ থেকে অনেকদিন পর দুনিয়াতে যাব। তখন কি এ প্রতিজ্ঞার কথা আমাদের স্মরণে থাকবে? হয়তো আমরা ভুলেও যেতে পারি। তখন আল্লাহ পাক বললেন, “তোমরা চিন্তা করবে না, মূলতঃ তোমাদেরকে আমার প্রতিজ্ঞার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্যেই আমি যুগে যুগে নবী-রসূলগণকে প্রেরণ করবো। অতঃপর নবী-রসূলগণ যখন আসা শেষ হয়ে যাবেন, তখন নায়িবে রসূল তথা হক্কানী আলিমগণকে ক্বিয়ামত পর্যন্ত পাঠাবো।”
সুতরাং উপরোক্ত বর্ণনা থেকে এটাই বুঝা যাচ্ছে যে, আল্লাহ পাক-এর হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেহেতু শেষ নবী, উনার পর আর কোন নবী দুনিয়াতে আগমন করবেন না, সেহেতু ছহীহ্্ দ্বীন তথা শরীয়তের সঠিক আক্বীদা ও আমল মানুষের নিকট পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব ন্যাস্ত করা হয়েছে হক্কানী আলিমগণের উপর। আর তাই হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে-
العلماء ورثة الانبياء
অর্থ: আলিমগণ নবীগণের ওয়ারিছ বা উত্তরাধিকারী।”
হাদীছ শরীফে আরো ইরশাদ হয়েছে-
ان الله يبعث لهذه الامة على رأس كل مائة سنة من يجدد لها دينا.
অর্থাৎ, “নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক আখিরী উম্মতের জন্যে প্রত্যেক শতকের শুরুতে একজন ব্যক্তিকে (মুজাদ্দিদকে) প্রেরণ করবেন, যিনি তাদের দ্বীন তথা আক্বীদা ও আমলের সংস্কার করবেন।” (আবূ দাউদ শরীফ)
অতএব, প্রমাণিত হলো যে, মানুষের আক্বীদা ও আমলের পরিশুদ্ধতার জন্যে আলিমগণের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু সে কোন আলিম? আর আলিম কে?
প্রসঙ্গতঃ আলিম ঐ ব্যক্তিই যার অন্তরে তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতি রয়েছে। অর্থাৎ যিনি আল্লাহ পাক-এর ভয়ে হারাম, নাজায়িয কাজ থেকে বিরত থাকেন। কেননা মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কালাম পাকে ইরশাদ করেন-
اِنَّمَا يَخْشَى اللهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ
অর্থ: “নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক-এর বান্দাদের মধ্য হতে শুধুমাত্র আলিমগণই আল্লাহ পাককে ভয় করেন।” (সূরা ফাতির-২৮)
এ আয়াত শরীফের তাফসীর জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল হাম্বলী মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা ও ইমাম, ইমামুল আইম্মাহ, ইমামুছ ছিদ্দীক্বীন, শায়খুল মুহাদ্দিছীন, হযরত আহমদ বিন হাম্বল রহমতুল্লাহি আলাইহিকে। তিনি এ আয়াত শরীফের ব্যাখ্যায় বলেন, “যাঁর ভিতর যত বেশী আল্লাহভীতি রয়েছে তিনি ততবড় আলিম।”
উক্ত আয়াত শরীফের ব্যাখ্যায় বিখ্যাত তাফসীরগ্রন্থ “তাফসীরে খোলাছায়” উল্লেখ আছে যে,
“العلماء” سے اصطلاحی عالم یعنی کتابیں پرہ لینے والے مراد نهى بلکہ کبریائے ذات وعظمت صفات کو نور ایمان شمع عرفان سے دیکھنے والے اسلئے کہ اصحاب رسول صلے اللہ علیہ وسلم وارباب ولایت وقبول سبکے سب علماء کتابی نہ تھی گو اونکا علم نافع اعلی درجے کا تھا.
অর্থঃ- উক্ত আয়াত শরীফে العلماء শব্দ দ্বারা কিতাবসমূহ পাঠকারী তথা (দাওরা বা টাইটেল পাশকারীদেরকে) বুঝানো হয়নি। বরং কুরআন শরীফে বর্ণিত “আলিম” তারাই, যারা মহান আল্লাহ পাক-এর মহিমাময় জাত ও অসীম গৌরবময় ছিফাতসমূহকে ঈমান ও মা‘রিফাতের নুরের আলোকে অবলোকন করেছেন। কেননা সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রিয়তম ছাহাবা আজমাঈন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ ও (পরবর্তী) বিলায়েতপ্রাপ্ত ও মকবুল ওলীআল্লাহগণ কিতাবী তথা দাওরা বা টাইটেল পাশ আলিম ছিলেন না। তথাপিও তাঁরা সর্বোচ্চ স্তরের উপকারী ইলমের অধিকারী ছিলেন। অর্থাৎ তাঁরাই কুরআন শরীফে বর্ণিত প্রকৃত আলিম ছিলেন।
উল্লেখিত আয়াত শরীফের ব্যাখ্যায় বিখ্যাত আলিম, ইমামুল মুফাসসিরীন, হযরত ইবনে কাছীর রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর প্রসিদ্ধ “তাফসীরে ইবনে কাছীরে” উল্লেখ করেন-
عن ابن مسعود رضى الله تعالى عنه انه قال ليس العلم عن كثرة الحديث ولكن العلم عن كثرة الخشية وقال احمد بن صالح المصرى عن ابن وهاب عن مالك قال ان العلم ليس لكثرة الرواية وانما العلم نور يجعله الله تعالى فى القلب.
অর্থঃ- “হযরত ইবনে মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, যে ব্যক্তি অধিক হাদীছ শরীফ জানে সে ব্যক্তি আলিম নয়। বরং যাঁর মধ্যে আল্লাহভীতি অধিক সে ব্যক্তিই আলিম। আর আহমদ বিন ছালেহ মিছরী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, অধিক রেওয়ায়েত শিক্ষা করলেই আলিম হওয়া যায়না। মূলতঃ ইলম হচ্ছে নূর বা জ্যোতিস্বরূপ। আল্লাহ পাক তা আলিমের অন্তকরণে দান করেন।’
উক্ত “তাফসীরে ইবনে কাছীরে” উল্লেখিত আয়াত শরীফের ব্যাখ্যায় আরো উল্লেখ আছে যে-
قال سفيان الثورى …. العلماء ثلاثة عالم بالله وعالم بامر الله وعالم بالله ليس بعالم بامرالله وعالم بامرالله ليس بعالم بالله. فالعالم بالله وبامرالله الذى يخشى الله تعالى ويعلم الحدود والفرائض.
অর্থঃ হযরত ইমাম সুফিয়ান ছাওরী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, আলিমগণ তিনভাগে বিভক্ত। (১) আলিম বিল্লাহ অর্থাৎ যারা শুধু আল্লাহ পাককেই জানেন। কিন্তু তাঁর হুকুম-আহকাম সম্পর্কে অজ্ঞ। (২) আলিম বিআমরিল্লাহ। অর্থাৎ যারা শুধু হুকুম-আহকাম সম্পর্কে জানেন। কিন্তু আল্লাহ পাক সম্পর্কে অজ্ঞ বা আল্লাহভীতি নেই। (৩) আলিম বিল্লাহ ওয়া বিআমরিল্লাহ। অর্থাৎ যাঁরা আল্লাহ পাক ও তাঁর শরীয়তের হুকুম-আহকাম ও ফারায়েজ সম্পর্কে পুর্ণ জ্ঞাত এবং আল্লাহ পাককে ভয় করেন। (তাঁরাই হাক্বীক্বী বা প্রকৃত আলিম)।
দ্বিতীয়তঃ ঐ ব্যক্তিই হাক্বীক্বী আলিম যিনি অর্জিত ইলম অনুযায়ী পরিপূর্ণ আমল করেন। যেমন এ প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে-
من ارباب العلم قال الذين يعملون بما يعلمون قال فما اخرج العلم من قلوب العلماء قال الطمع.
অর্থঃ- “(আমীরুল মু’মিনীন, হযরত উমর ইবনুল খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হযরত কা’বা ইবনুল আহবার রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে জিজ্ঞাসা করলেন) আলিম বা ইলমের অধিকারী কে? তিনি উত্তরে বললেন, যাঁরা ইলম অনুযায়ী আমল করেন। হযরত উমর ইবনুল খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু পুনরায় জিজ্ঞোসা করলেন, কোন জিনিস আলিমদের অন্তর থেকে ইলমকে বের করে দেয়? তিনি উত্তরে বললেন, লোভ অর্থাৎ দুনিয়ার সম্পদ, সম্মান ইত্যাদি হাছিলের আকাঙ্খা।’ (দারিমী, মিশকাত, মিরকাত, লুময়াত, আশয়াতুল লুময়াত, শরহুতত্বীবী, তা’লীকুছ ছবীহ, মুযাহিরে হক্ব, মিরয়াতুল মানাজীহ)
বিশিষ্ট তাবিয়ী, আমীরুশ্ শরীয়ত ওয়াত্ তরীক্বত ইমাম হাসান বছরী রহমতুল্লাহি আলাইহিকে জিজ্ঞাসা করা হলোÑ আলিম কে? তিনি জবাবে বলেন-
انما الفقيه الزاهد فى الدنيا والراغب الى الاخرة والبصير بذنبه والمداوم على عبادة ربه والورع الكاف عن اعراض المسلمين والعفيف عن اموالهم والناصح لجمعاعتهم.
অর্থঃ “ফক্বীহ্ বা আলিম হলেন ঐ ব্যক্তি, যিনি দুনিয়া হতে বিরাগ, পরকালের প্রতি ঝুঁকে আছেন, গুনাহের প্রতি সতর্ক, সর্বদা মহান আল্লাহ পাক-এর ইবাদতে মশগুল, পরহিজগার বা সুন্নতের পাবন্দ, মুসলমানের মান-সম্মান নষ্ট করেন না, তাদের সম্পদের প্রতি লোভ করেন না এবং তাঁর অধীনস্থদেরকে নছীহত করেন।”
উপরোক্ত দলীল ভিত্তিক বিস্তারিত আলোচনা দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, মুলতঃ হক্কানী আলিম বা সত্যিকার নায়িবে নবী তিনিই (১) যিনি দ্বীন ইসলামের প্রতিটি বিষয়ে আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত অনুযায়ী আক্বীদা পোষণ করেন, (২) ইলমে ফিক্বাহ অর্জন করার সাথে সাথে একজন হক্কানী শায়খ বা মুর্শিদের নিকট বাইয়াত হয়ে ইলমে তাছাউফ চর্চা করতঃ অন্তরকে পরিশদ্ধ করে আল্লাহভীতি বা তাক্বওয়া অর্জন করেছেন, (৩) অর্জিত ইলম অনুযায়ী পরিপূর্ণ আমল করেন, (৪) সুন্নতের পূর্ণ পায়রবী করেন, (৫) হারাম-নাজায়িয ও শরীয়তবিরোধী কাজে লিপ্ত হননা। কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফের দৃষ্টিতে তাঁরাই হক্কানী আলিম বা নায়িবে নবী।
নাহক্ব আলিম কে?
নাহক্ব আলিম হলো ঐ ব্যক্তি, যে দুনিয়ার সামান্য সম্পদ ও মান-সম্মান হাছিল করার জন্যে ঈমান ও আমল ধ্বংস করে দেয়। যেমন বর্তমানে কেউ কেউ দুনিয়াবী ফায়দা হাছিলের জন্যে বা ক্ষমতা লাভের উদ্দেশ্যে ইসলামের নামে গণতন্ত্র ভিত্তিক আন্দোলন করছে, যে গণতন্ত্র অনুসরণ করা শরীয়তের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ হারাম ও নাজায়িয। কারণ গণতন্ত্র হলো ইহুদী-নাছারা বা মানব রচিত মতবাদ। অথচ এক শ্রেণীর আলিম তাদের নিকট গণতন্ত্র হারাম একথা স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পরও তারা গণতন্ত্র চর্চা করছে। (নাউযুবিল্লাহ) মূলতঃ তাদের গণতন্ত্রভিত্তিক আন্দোলন করার উদ্দেশ্য হলো দুনিয়াবী কিছু ফায়দা লাভ করা।
তাদের মধ্যে আবার কেউ কেউ অহরহ পেপার-পত্রিকায় নিজের ছবি ছাপাচ্ছে এবং ইসলামের নামে টিভি চ্যানেলে প্রোগ্রাম করছে। (নাউযুবিল্লাহ) অথচ ছবি তোলা, আঁকা, রাখা ইত্যাদি সবই শরীয়তে কাট্যা হারাম। কিন্তু তারা বিনা দ্বিধায় এ হারাম কাজগুলো করে যাচ্ছে। মূলতঃ এরাই হলো উলামায়ে “ছূ” বা ধর্মব্যবসায়ী অর্থাৎ নাহক্ব আলিম। এদের প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,
عن زياد بن حدير رحمة الله عليه قال قال لى عمر رضى الله تعالى عنه هل تعرف ما يهدم الاسلام؟ قلت لا قال يهدمه زلة العالم وجدال المنافق بالكتاب وحكم الائمة المضلين.
অর্থঃ “হযরত যিয়াদ ইবনে হুদাইর রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, আমাকে হযরত উমর ইবনুল খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বললেন, তুমি বলতে পার কি, কোন জিনিস ইসলামকে ধ্বংস করবে? আমি বললাম না (আমি জানিনা)। তখন তিনি বললেন, আলিমদের পদস্খলন, মুনাফিকদের আল্লাহ পাক-এর কিতাব নিয়ে তর্ক-বাহাছে লিপ্ত হওয়া এবং গোমরাহ শাসকদের গোমরাহীমূলক হুকুম বা আদেশ-নিষেধ। (ইসলামকে ধ্বংস করবে)।” (দারিমী শরীফ)
মূলতঃ বর্তমানে তাই দেখা যাচ্ছে, কিছু সংখ্যক তথাকথিত আলিমদের পদস্খলনের কারণে মুসলমানদের ঈমান ও আমল হুমকির সম্মুখীন। তাদের কারণে সাধারণ লোক মনে করে গণতন্ত্র ইসলামেরই অংশ, ছবি তোলা শরীয়তে জায়িয, হরতাল করা শরীয়তে নিষিদ্ধ নয়, টেলিভিশন দেখা ও টেলিভিশনে প্রোগ্রাম করা জায়িয।’ (নাউযুবিল্লাহ)
অথচ শরীয়তের ফায়সালা হলো- হারামকে হালাল জানা আর হালালকে হারাম জানা কুফরী। অনুরূপ বিজাতীয় ও বেদ্বীনি মতবাদকে ইসলামের অংশ মনে করাও কুফরীর অন্তর্ভুক্ত। তবে কি প্রমাণিত হয় না যে, তাদের কারণে সাধারণ মুসলমানগণ কুফরী করে ঈমানকে ধ্বংস করছে? আর তাই তো হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,
صنفان من امتى اذا صلحت صلح الناس واذا فسدت فسد الناس الامراء والفقهاء
অর্থঃ “আমার উম্মতের দুই সম্প্রদায়, তারা যখন ইছলাহ বা সংশোধন হবে, তখন সকল মানুষ (মুসলমান) সংশোধন হবে। আর তারা যখন পথভ্রষ্ট হবে, তখন সকল মানুষ (মুসলমান) পথভ্রষ্ট হবে, তারা হলো- ১. রাজা-বাদশা, ২. আলিম-উলামা।
বস্তুতঃ হাদীছ শরীফে এরূপ দুনিয়াদার বা পথভ্রষ্ট আলিমদের ভয়াবহ পরিণাম উল্লেখ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,
عن ابى الدرداء رضى الله تعالى عنه قال ان من اشر الناس عند الله منزلة يوم القيامة عالم لا ينتفع بعلمه.
অর্থঃ “হযরত আবু দারদা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ক্বিয়ামতের ঐ ব্যক্তি মর্যাদার দিক থেকে সবচেয়ে নিকৃষ্ট হবে যে তার ইলমের দ্বারা উপকৃত হয়নি।” (দারিমী শরীফ)
অতএব, যারা ইল্ম্ অনুযায়ী আমল করবে না অর্থাৎ যারা জানে ছবি তোলা ও টিভি চ্যানেলে প্রোগ্রাম করা হারাম, তারপরও ছবি তোলে ও টিভি চ্যানেলে প্রোগ্রাম করে, যারা জানে গণতন্ত্র-হরতাল ইত্যাদি হারাম বা বিজাতীয় পন্থা, তারপরও তারা ইসলামের নামে গণতন্ত্র চর্চা করে ও হরতাল করে। মূলতঃ উপরোক্ত হাদীছ শরীফের মিছদাক তারাই অর্থাৎ তারা উলামায়ে “ছূ” বা দুনিয়াদার ধর্মব্যবসায়ী মাওলানা, আর তারাই উম্মতের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট।
নিম্নোক্ত ঘটনা দ্বারা আরো সুষ্পষ্টভাবে দ্বীনদার আলিম ও দুনিয়াদার আলিমের পরিচয় ফুটে উঠবে।
কিতাবে উল্লেখ আছে যে, বাদশাহ শাহজাহান একবার তার দরবারী আলিমদের নিকট ফতওয়া তলব করে বললেন, আমি অসুস্থ, অসুস্থার কারণে আমার জন্যে রেশমী কাপড় পরিধান করা জায়িয হবে কি? দরবারী আলিমরা বাদশাহর মনতুষ্টির জন্যেই হোক বা দুনিয়াবী ফায়দা লাভের জন্যেই হোক, তারা ফতওয়া দিল, বাদশাহ নামদার, যেহেতু আপনি অসুস্থ আর আপনি অসুস্থ হয়ে পড়লে রাজ্য অচল হয়ে পড়বে। কাজেই রাজ্য ও প্রজাদের বৃহত্তর স্বার্থে আপনার জন্যে এ অবস্থায় রেশমী কাপড় পরিধান করা জায়িয হবে। বাদশা তার দারবারী আলিমদের মৌখিক ফতওয়ায় আশ্বস্ত না হতে পেরে লিখিত ফতওয়ার নির্দেশ দিলেন। দরবারী আলিমরা বাদশাহকে এ ব্যাপারে লিখিত ফতওয়া দিল। বাদশাহ তাতেও নিশ্চিন্ত হতে পারলেন না। তাই তিনি বললেন, এ ফতওয়াতেও অন্যান্য আরো আলিমদের দস্তখত লাগবে। দরবারী আলিমরা তখন তাদের সমগোত্রীয় তিনশত আলিমের দস্তখত সংগ্রহ করে ফতওয়াটি বাদশাহর নিকট পেশ করলো। বাদশাহ ফতওয়াটি আদ্যপান্ত ভালরূপে পাঠ করে দেখলেন এবং বললেন যে, সেখানে তার শাহী মসজিদের যিনি খতীব, নুরুল আনোয়ার ও তাফসীরে আহমদীর ন্যায় বিশ্ববিখ্যাত কিতাবের মুছান্নিফ, তৎকালীন যামানার শ্রেষ্ঠতম আলিম, হযরতুল আল্লামা, মোল্লাযিয়ূন রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর দস্তখত ব্যতীত এ ফতওয়া গ্রহণযোগ্য হবে না।
তখন দরবারী আলিমরা উক্ত ফতওয়াটি হযরত মোল্লাযিয়ূন রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর দরবার শরীফে নিয়ে যায় উনার দসস্তখন বা সমর্থন নেয়ার জন্য। হযরত মোলাযিয়ূন রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, আমি আজ এ ব্যাপারে কোন মন্তব্য করবো না, বরং বাদশাহ আমার মসজিদে জুমুয়ার নামায পড়তে আসেন। তাই আমি বাদশাহ ও মুছল্লীগণের সম্মুখে এ ব্যাপারে ফতওয়া দিব। অতঃপর জুমুয়ার দিন বাদশাহ তাঁর উযীর-নাযীরসহ জুমুয়ার নামায পড়ার জন্য মসজিদে গেলেন । অনেক মুছল্লীও উপস্থিত হলেন এবং দরবারী আলিমরাও উপস্থিত। সকলেই অপেক্ষা করছে হযরত মোল্লাযিয়ূন রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর ফতওয়া শোনার জন্য। ইতমধ্যে হযরত মোল্লাযিয়ূন রহমতুল্লাহি আলাইহি মিম্বরে উঠে বসলেন এবং সমবেত সকল মুছল্লীদের উদ্দেশ্যে বললেন, আমার নিকট তিনশত আলিমের দস্তখত সম্বলিত একটি ফতওয়া এসেছে। যাতে বলা হয়েছে যে, বৃহত্তর স্বার্থে, বাদশার অসুস্থতার কারণে, বাদশার জন্যে রেশমী কাপড় পরিধান করা জায়িয। আর এ ব্যাপারে আমার ফতওয়া হলো-
مفتی اور مستفتی ہردو کافراند
অর্থঃ- “যারা এ ফতওয়া দিয়েছে এবং যে ফতওয়া চেয়েছে উভয়েই কাফির হয়ে গেছে।”
কারণ, ওহীর দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। হারাম হারাম হিসেবে সাব্যস্ত হয়ে গেছে এবং হালাল হালাল হিসেবে সাব্যস্ত হয়ে গেছে। তাই শরীয়তের দৃষ্টিতে হারামকে হালাল আর হালালকে হারাম বলা কাট্টা কুফরী। যারা বলবে তারা কাট্টা কাফির হবে।
উপরোক্ত ঘটনা দ্বারা যেরূপ উলামায়ে ‘ছূ’ তথা দুনিয়াদার বা ধর্মব্যবসায়ী মাওলানাদের মুখোশ সুস্পষ্টভাবে উম্মোচিত হলো, তদ্রুপ উলামায়ে হক্ব তথা দ্বীনদার আলিমগণের পরিচয় বা লক্ষণও সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো।
সুতরাং, যারা দ্বীনকে রক্ষা করার জন্যে সবকিছু বিসর্জন দেন, প্রতিক্ষেত্রে ছহীহ আক্বীদা পোষণ করেন, আল্লাহ পাক ও তাঁর হাবীবকে ভয় করেন, ইলম অনুযায়ী আমল করেন, সুন্নতের ইত্তিবা করেন, হারাম কাজ থেকে বেঁচে থাকেন। তাঁরাই হক্কানী আলিম। আর তাঁরাই হলেন, উম্মতের মধ্যে সর্বোত্তম। আর যারা দুনিয়াবী ফায়দা লাভের জন্য মনগড়া ফতওয়া দেয়, নফসের অনুসরণ করে, শরীয়তের খিলাফ কাজ করে, এককথায় না হক্ব বা হারামের উপর দৃঢ়চিত্ত, তারাই উলামায়ে ‘ছূ’ বা দুনিয়াদার তথা ধর্মব্যবসায়ী মাওলানা। আর তারাই উম্মতের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট লোক। আর এদের প্রসঙ্গেই হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,
عن انس رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم ويل لامتى من علماء السوء يتخدون هذا العلم تجارة يبيعونها من امراء زمانهم ربحا لانفسهم لا اربع الله تجارتهم.
অর্থঃ হযরত আনাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেন, আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, আমার উম্মতের মধ্যে যারা উলামায়ে “ছূ” তাদের জন্য আফ্সুস অর্থাৎ তারা জাহান্নামী হবে। তারা ইলমকে ব্যবসা হিসেবে গ্রহণ করতঃ তাদের যুগের শাসকদের নিকট থেকে অর্থ ও পদ লাভের প্রচেষ্টা চালিয়ে থাকে। আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এসকল উলামায়ে ছু’দের বিরুদ্ধে এই বলে বদদোয়া করেন যে, “আয় আল্লাহ পাক! যারা নিজেদের ইলম দ্বারা দুনিয়াবী সরকারের সাথে ব্যবসা করতে চায় তাদের ব্যবসায় বরকত দিবেন না। (কানযুল উম্মাল)
এ সকল উলামায়ে ছূ’ বা দুনিয়াদার তথা ধর্মব্যবাসায়ী মৌলবীদেরকে হাদীছ শরীফে দাজ্জালে কাযযাব বা মিথ্যাবাদী দাজ্জাল বলে এদের থেকে উম্মতদেরকে দূরে থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যেমন হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে-
عن ابى هريرة رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم يكون فى اخر الزمان دجلون كذابون ياتونكم من الاحاديث بما لم تسمعوا انتم ولا ابائكم فاياكم واياهم لايضلونكم ولايفتنونكم.
অর্থঃ হযরত আবূ হুরাইরা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আখিরী যামানায় কিছু সংখ্যক মিথ্যাবাদী দাজ্জাল বের হবে, তারা তোমাদের নিকট এমনসব (মিথ্যা-মনগড়া) কথা উপস্থাপন করবে, যা তোমরা কখনো শুননি এবং তোমাদের বাপ-দাদারাও শুনেনি, সাবধান! তোমরা তাদের কাছ তেকে দূরে থাকবে, তবে তারা তোমাদেরকে গোমরাহ করতে পারবে না এবং ফিৎনায় ফেলতে পারবে না। (মুসলিম শরীফ)
উপরোক্ত দলীলভিত্তিক বিস্তারিত আলোচনা দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, হক্কানী আলিম বা সত্যিকার নায়িবে নবী তিনিই (১) যিনি দ্বীন ইসলামের প্রতিটি বিষয়ে আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত অনুযায়ী আক্বীদা পোষণ করেন, (২) ইলমে ফিক্বহ অর্জন করার সাথে সাথে একজন হক্কানী শায়খ বা মুর্শিদের নিকট বাইয়াত হয়ে ইলমে তাছাউফ চর্চা করতঃ অন্তরকে পরিশুদ্ধ করে আল্লাহভীতি বা তাক্বওয়া অর্জন করেন, (৩) অর্জিত ইলম অনুযায়ী পরিপূর্ণ আমল করেন, (৪) সুন্নতের পূর্ণ পায়রবী করেন, (৫) হারাম-নাজায়িয় ও শরীয়ত বিরোধী কাজে লিপ্ত হননা। কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফের দৃষ্টিতে তাঁরাই হক্কানী আলিম বা নায়িবে নবী।
অতএব, বলার অপেক্ষা রাখে না যে, যারা প্রকাশ্যে ছবি তোলে, বেপর্দা হয়, ইসলামের নামে টিভি চ্যানেলে প্রোগ্রাম করে, দুনিয়ার লোভে হক্বকে নাহক্বের সাথে মিশ্রিত করে তারা কস্মিনকালেও হক্কানী আলিম নয়। বরং তারাই হচ্ছে হাদীছ শরীফে বর্ণিত দাজ্জালে কাযযাব তথা উলাময়ে ছূ’। এদের ওয়ায শোনা ও এদেরকে অনুসরণ করা সম্পূর্ণ হারাম। কেননা আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন,
ولاتطع من اعفلنا قلبه عن ذكرنا واتبع هواه وكان امره فرطا.
অর্থঃ তোমরা ঐ ব্যক্তিকে অনুসরণ করো না যার অন্তর আমার যিকির থেকে গাফিল। এবং যে ব্যক্তি নফসের অনুসরণ করে এবং যে ব্যক্তির কাজগুলো শরীয়তের খিলাফ। (সূরা কাহাফ-২৮)
অর্থাৎ যাদের আমল শরীয়তের খিলাফ তাদেরকে অনুসরণ করা হারাম।
আর হাদীছ শরীফৈ ইরশাদ হয়েছে,
فانظروا عمن تاخذون دينكم.
অর্থাৎ তোমরা কার নিকট থেকে দ্বীন বা ইলম গ্রহণ করছো তা লক্ষ্য করো।“
অর্থাৎ যার আমল শরীয়তের খিলাফ তার ওয়াজ শোনা ও তাকে অনুসরণ করা যাবে না। আর তাদের পিছনে নামায পড়ার ব্যাপারে ফায়ছালা হলো- যদি তারা হারাম জেনে টিভি চ্যানেলে প্রোগ্রাম করে তবে তারা চরম ফাসিক। আর ফাসিকের পিছনে নামায পড়া মাকরূহ তাহরীমী। পড়ে থাকলে নামায দোহরায়ে পড়া ওয়াজিব। আর যদি তারা হালাল বা বৈধ মনে করে টিভি চ্যানেলে প্রোগ্রাম করে তবে তাদের পিছনে নামায পড়া সম্পূর্ণ হারাম। কারণ শরীয়তের দৃষ্টিতে হারামকে হালাল মনে করা কুফরী। আর যে কুফরী করে সে মুরতাদ হয়ে যায়। আর শরীয়তে মুরতাদের ফায়ছালা হলো-
তার স্ত্রী তালাক হবে যদি বিয়ে করে থাকে এবং এক্ষেত্রে পুনরায় তওবা না করে বিয়ে না দোহরানো ব্যতীত তার স্ত্রীর সাথে বসবাস করা বৈধ হবে না। আর এ অবৈধ অবস্থায় সন্তান হলে সে সন্তানও অবৈধ হবে। হজ্জ বাতিল হয়ে যাবে যদি হজ্জ করে থাকে। সমস্ত নেক আমল বরবাদ হয়ে যাবে। তার ওয়ারিশ সত্ত্ব বাতিল হবে। তাকে তিন দিন সময় দেয়া হবে তওবা করার জন্য এবং যদি তওবা করে, তবে ক্ষমা করা হবে। অন্যথায় তার একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
কেননা হাদীছ শরীফে রয়েছে, তিন কারণে মৃত্যুদ- দেয়া জায়িয। যথা- ১. ঈমান আনার পর কুফরী করলে অর্থাৎ মুরতাদ হলে। ২. ঐ যিনাকার বা যিনাকারিণী যারা বিবাহিত বা বিবাহিতা। ৩. যে অন্যায়ভাবে কাউকে ক্বতল করে তাকে।
আর মুরতাদ মারা যাবার পর যারা জানাযার নামায পড়ে বা পড়ায় বা জানাযার নামাযে সাহায্য-সহযোগিতা করে, তাদের সকলের উপরই মুরতাদের হুকুম বর্তাবে এবং এ সকল মুরতাদ মরলে বা নিহত হলে তাকে মুসলমানগণের কবরস্তানে দাফন করা যাবে না। বরং তাকে কুকুরের ন্যায় একটি গর্তের মধ্যে পুঁতে রাখতে হবে।
(অসমাপ্ত)
পরবর্তী সংখ্যার অপেক্ষায় থাকুন