পূর্ব প্রকাশিতের পর
এ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার ব্যাখ্যায় হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত ইমাম গাযযালী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বর্ণনা করেন, যেহেতু তিনি উনার যামানায় উলামায়ে ‘সূ’দের হাক্কীক্বত প্রকাশ করেছেন। এ কারণে তিনি প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিলেন। উলাময়ে সূ দের দোষত্রুটি বর্ণনা করলে সেটা গীবত হবে কিনা? কারণ পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে তো বর্ণিত রয়েছে-
عن حضرة ابى سعيدن الـخدرى رضى الله تعالى عنه و حضرة جابر بن عبد الله رضى الله تعالى عنه قالا قال رسول الله صلى الله عليه و سلم الغيبة اشد من الزنى
হযরত আবু সাঈদ খুদরী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এবং হযরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাদের থেকে বর্ণিত। উনারা উভয়ে বলেন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হযরত নবী আলাইহিমুস সালাম উনাদের নবী, রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদের রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, গীবত করা হচ্ছে ব্যভিচার থেকেও কঠিন গোনাহ। এখন এই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে হযরত ইমাম গাযযালী রহমতুল্লাহি আলাইহি এবং অনেক ইমাম মুজতাহিদ উনারা এ বিষয় বিস্তারিত আলোচনা করেছেন যে, দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করলেই শুধু সেটা গীবত হবে না বরং ক্ষেত্র বিশেষে অর্থাৎ কোন কোন ক্ষেত্রে কোন কোন দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করা ফরয ওয়াজিবের অন্তর্ভুক্ত। সেটার ব্যাখ্যায় উল্লেখ করেছেন-
একনম্বর হচ্ছে, যারা রাজা-বাদশা আমীর-উমারা, যারা রাজা-বাদশাহ আমীর-উমারা রয়েছে এদের দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করলে সেটা কখনও গীবত হবে না। সমস্ত ইমাম মুজতাহিদ উনারা একমত। কারণ রাজা-বাদশা ওদের যদি দোষ-ত্রুটি বর্ণনা না করা হয় তাহলে তারা বেপরোয়া হয়ে যাবে। সাধারনত যারা বাদশা হয়ে থাকে এদের ইলম-কালামের অভাব থেকে থাকে। পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ সম্পর্কে তাদের সুস্পষ্ট ধারনা থাকে না। এদের ইলমে দ্বীন সম্পর্কে অনেক অজ্ঞতা রয়েছে যার কারণে এদেরকে এ বিষয় শক্ত নছীহত করা প্রয়োজন রয়েছে। যেমন দেখা যায় যিনি দ্বিতীয় উমর হিসেবে মাশহূর হযরত উমর ইবনে আব্দুল আযীয রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি যখন খলীফা হলেন, তিনি কিন্তু বড় আলিম বুযূর্গ মহান আল্লাহ পাক উনার খালিছ ওলিও ছিলেন। তিনি বড় আলিম ছূফী ফক্বীহ হওয়ার পরও তিনি যখন খিলাফত লাভ করলেন তখন উনার সমসাময়িক যারা বড় বড় ইমাম মুজতাহিদ ছিলেন উনাদের কাছে তিনি চিঠি পাঠালেন উনাকে যেনো নছীহত করা হয়, উনার চিঠি পেয়ে উনার সমসাময়িক যারা ইমাম মুজতাহিদ ছিলেন ফক্বীহ ছিলেন উনারা সকলেই জবাব দিলেন, হে হযরত উমর বিন আব্দুল আযীয রহমতুল্লাহি আলাইহি! আপনি নিজেও একজন ফক্বীহ একজন আলিম, ছূফী, বুযূর্গ, কাজেই আপনাকে অত নছীহত করার প্রয়োজন নেই তবে যতটুৃকু বলা প্রয়োজন আমরা ততটুকু আপনাকে বলবো, সেটা হচ্ছে আপনি যদি খিলাফত মুবারক পরিচালনা করে এর মাধ্যম দিয়ে মহান আল্লাহ পাক উনার সন্তুষ্টি মুবারক চান? মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হযরত নবী আলাইহিমুস সালাম উনাদের নবী, হযরত রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদের রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সন্তুষ্টি মুবারক চান? তাহলে একটা বিষয় লক্ষ্য রাখলেই আমরা মনে করি সেটা যথেষ্ট হবে। সেটা কি? প্রথম হচ্ছে সম্পূর্ণ খিলাফত মুবারক উনার অধীন যারা রয়েছে তাদেরকে আপনি মনে করবেন তারা আপনার পরিবারের অন্তর্ভুক্ত, অর্থাৎ সকলেই আপনার পরিবারের লোক একনম্বর, দু’নম্বর হচ্ছে যারা বয়স্ক পুরুষ মাহিলা রয়েছে তাদেরকে আপনি আপনার বাবা, মা, চাচা, চাচী, দাদা, দাদী তাদের মত মনে করবেন। আপনার সম বয়স্ক যারা রয়েছেন পুরুষ মহিলা তাদেরকে আপনার ভাই বোন মনে করবেন এবং যারা ছোট রয়েছে তাদেরকে আপনি ছেলে মেয়ে মনে করবেন। এটা মনে করে পুরা খিলাফত মুবারক উনাকে আপনার পরিবার মনে করবেন। এরপর আপনি পরিচালনা করুন। আশা করা যায় কোন অসুবিধা হবে না। আপনি মহান আল্লাহ পাক উনার সন্তুষ্টি মুবারক, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হযরত নবী আলাইহিমুস সালাম উনাদের নবী, হযরত রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদের রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের সন্তুষ্টি মুবারক লাভ করতে পারবেন। সুবহানাল্লাহ!
উল্লেখ্য, হযরত উমর বিন আব্দুল আযীয রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বড় ফক্বীহ, ওলী, বযুর্গ হওয়ার পরও নছীহত চাইলেন যে, কি করে পরিচালনা করা যেতে পারে। যাতে সঠিকভাবে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করে মহান আল্লাহ পাক উনার রিযামন্দী মুবারক এবং উনার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার রিযামন্দী মুবারক তিনি হাছিল করতে পারেন। কাজেই, রাজা-বাদশাহ আমীর-উমারা যারা হবে তাদেরকে নছীহত করা তাদের হাক্বীক্বত বলে দেয়া অর্থাৎ যদি কোন ভুল-ত্রুটি হয়ে যায় সেটা প্রকাশ করে দেয়াটা যারা সমসাময়িক হাদী থাকবেন আলিম উলামা থাকবেন উনাদের দায়িত্ব কর্তব্য, ফরয ওয়াজিবের অন্তর্ভুক্ত একনম্বার সেটা। যদিও কোন কোন ক্ষেত্রে রাজা-বাদশাহ আমীর উমারারা যুলুম করে থাকে যালিম হয়ে থাকে তারপরেও।
দু’নম্বর বলা হয়েছে, কোন বিচারকের কাছে কাজী ছাহিবের কাছে কেউ যদি বিচারের জন্য যায় তখন তার দৃষ্টিতে বিপরীত পক্ষের যে দোষ-ত্রুটি রয়েছে, সেটা সে বলতে পারবে তাতে তার গীবত হবে না। কারণ বিপরীত পক্ষের দোষ-ত্রুটি না বলে যদি সঠিক বিষয়টা তুলে না ধরে তাহলে বিচার শুদ্ধ হবে না। সেক্ষেত্রে সেটা গীবতের অন্তর্ভুক্ত হবে না।
তিন নম্বর বলা হয়েছে, কেউ যদি কোন ফতওয়ার জন্য কোন হক্কানী-রব্বানী আলিম মুফতী ছাহিব উনার কাছে যায় তাহলে সেখানেও ফতওয়ার বিষয় তাকে বিস্তারিত কথা বলতে হবে, এতে কারো দোষ-ত্রুটি প্রকাশ পেলে সেটাও বলতে হবে। কারণ এই মাসয়ালার ব্যাপারে, ফতওয়া ব্যপারে দোষ-ত্রুটি স্পষ্ট করে বলাটাও ফরয ওয়াজিবের অন্তর্ভুক্ত। কারণ সে যদি সঠিক কথা না বলে তাহলে মাসয়ালা বা ফতওয়া শুদ্ধ হবে না। যেমন দেখা যায় এখন অনেকেই তালাক দিয়ে থাকে। এখন দেয়ার সময় সে দিয়েছে এরপর সে কি করে, বাঁচার জন্য ঘুরিয়ে মিথ্যা কথা বলে থাকে। নাউযুবিল্লাহ! এতে কিন্তু মাসয়ালাটা ঘুরে গেলো। যার কারণে তার বিবাহ ছিন্ন হয়ে গেলো সে কিন্তু সেটা চুপিয়ে রাখলো, তার ফলে কি হলো আজীবন সে এই কঠিন গুনাহে গুনাহগার হবে ব্যভিচারী হিসেবে সে সাব্যস্ত হবে। নাঊযুবিল্লাহ! একটা কথা ঘুরিয়ে বলার কারণে। ঘটনাটা সঠিকভাবে বলা তার জন্য ফরয-ওয়াজিব ছিলো। কাজেই বিচারকের কাছে, কাজী ছাহিবের কাছে মুফতী ছাহিবের কাছে তাকে সঠিকভাবে বলতে হবে, যদিও কারো দোষ-ত্রুটি প্রকাশ পায় বা পাবে তাতে গীবত হবে না।
চতুর্থ নম্বর বলা হয়, কোন ফাসিক। ফাসিক বলে কাকে? যে ফরয-ওয়াজিব, সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ তরক করে। যে ফরয-ওয়াজিব, সুন্নতে মুুয়াক্কাদাহ তরক করে তাকে ফাসিক বলে। ফাসিকের কোন দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করা সেটা গীবতের অন্তর্ভুক্ত নয়। ফাসিকের কোন দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করা সেটা গীবতের অন্তর্ভুক্ত নয়। একটা লোক চুরি করলো তাকে চোর বললে সেটা গীবত হবে না। যে ছিনতাই করলো, তাকে ছিনতাইকারী বললে সেটা গীবত হবে না। কেউ লুটপাট করলো তাকে লুটেরা বললে সেটা গীবত হবে না। কোন হারাম কাজ করলো অবৈধ কাজ করলো এই শ্রেণীর লোক যারা চরম ফাসিক তাদের দোষ-ত্রুটি বললে সেটা গীবত হবে না।
পঞ্চম বলা হয়েছে, কোন লোক মাশহূর রয়েছে- লুলা, ল্যাংড়া, তোতলা, বোবা অনেক এলাকাতেই এমন অনেক লোক মাশহূর থাকে; এসমস্ত নামে তোতলা হিসেবে, লুলা লেংড়া হিসেবে, বোবা হিসেবে অথবা অন্য কোন মাশহূর নাম যেটা আসলেই আপত্তিজনক কিন্তু সে মাশহূর হয়ে গেছে সেখানে তাকে সেই নামে সম্বোধন করলে সেটা গীবত হবে না।
ষষ্ঠ বলা হয়েছে, কেউ যদি কারো মেয়েকে বিয়ে দিতে চায় অথবা ছেলেকে বিয়ে করাতে চায় তাহলে বিপরীত পক্ষ অর্থাৎ মেয়েকে যদি বিয়ে দিতে চায় তাহলে বিপরীত যে ছেলে রয়েছে তার যারা নিকট আত্মীয়স্বজন আর যদি ছেলেকে বিয়ে করাতে চায় তাহলে তার বিপরীত যে মেয়ে রয়েছে তার আত্মীয়স্বজন প্রতিবেশী যারা রয়েছে তাদের কাছে যেয়ে যদি সেই মেয়ে বা ছেলে সম্পর্কে সে যদি জিজ্ঞাসা করে, প্রতিবেশী বা আত্মীয় স্বজন যদি সেই মেয়ে বা ছেলে সম্পর্কে সঠিক তথ্যটা বলে দেয় সেটা কিন্তু গীবত হবে না। এখানে কিন্তু সঠিক তথ্যটা বলে দেয়াটাই ফরয-ওয়াজিবের অন্তর্ভুক্ত। কারণ একজন মেয়েকে বিয়ে দেয়া হবে তার জীবন নিয়ে প্রশ্ন, আরেকজন ছেলেকে বিয়ে করানো হবে তারো এখানে জীবনের এবং সংসারের প্রশ্ন রয়েছে। এখন মহান আল্লাহ পাক তিনি না করুন, সেই লোকটা যে মেয়েকে বিয়ে দিলো, তার স্বামী অর্থাৎ ছেলেটা যদি খারাপ হয়ে থাকে তবে তার সংসারটা নষ্ট হয়ে যাবে। আবার ঠিক যে ছেলেকে বিয়ে করানো হলো মহান আল্লাহ পাক না করুন, তার স্ত্রী অর্থাৎ মেয়েটা যদি খারাপ হয় তাতেও তার সংসারে অশান্তি সৃষ্টি হবে, ফিৎনা সৃষ্টি হবে। এখন এই দোষগুলি যারা চুপিয়ে রাখলো অর্থাৎ সঠিক কথা বললো না, ফলে আজীবন তাদের যত ফিৎনা-ফ্যাসাদ হবে, যত দ্বন্দ্ব কলহ হবে, এই সমস্ত গোনাহর অংশীদার হবে ঐসমস্ত লোক যারা তাদের দোষ-ত্রুটি চুপিয়ে রেখেছিলো। নাউযুবিল্লাহ! এজন্য এসমস্ত ক্ষেত্রে এদের দোষত্রুটি বর্ণনা করা ফরয-ওয়াজিব। সেটা বললে কখনও গীবতের অন্তর্ভুক্ত হবে না।
আর সপ্তম বলা হয়েছে, উলামায়ে ‘সূ’ যারা দ্বীন বিক্রি করে দুনিয়া হাছিল করে, এদের দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করলে সেটাও গীবত হবে না বরং ইমাম গায্যালী রহমতুল্লাহি আলাইহি যিনি হুজ্জাতুল ইসলাম। তিনি যে তাহক্বীক্ব করে ফতওয়া দিয়েছেন এই সমস্ত উলামায়ে ‘সূ’দের দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করলে মকবুল ষাট বৎসর নফল ইবাদত থেকেও সেটা আফযল এবং উত্তম হবে। সুবহানাল্লাহ! কাজেই উলামায়ে ‘সূ’দের দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করে দেয়াটা যাদের জানা রয়েছে তাদের জন্য ফরয-ওয়াজিবের অন্তর্ভুক্ত। সেজন্য উলামায়ে ‘সূ’দের হাক্বীক্বত মহান আল্লাহ পাক তিনি প্রকাশ করেছেন, করতে বলেছেন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হযরত নবী আলাইহিমুস সালাম উনাদের নবী, হযরত রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদের রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি করেছেন এবং করতে বলেছেন। যে প্রসঙ্গে পবিত্র আয়াত শরীফ এসেছে, মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, এটা মুসলমান উনাদের জন্য এ পবিত্র আয়াত শরীফ মুবারক নাযিল হয়েছে এবং কাফিরদের জন্যও হয়েছে। এটা সকলের জন্য নাযিল হয়েছে। (অসমাপ্ত)