গত ২৩.০১.২০১০ ঈসায়ী তারিখে ‘দৈনিক আল ইহসান’ পত্রিকায় খবর হেডিং হয়েছিলো, সূর্যের মুখ দেখা গেলেও তীব্র শীত, টানা শৈত্যপ্রবাহে বীজতলা নষ্ট।”খবরে বলা হয়: হিমেল হাওয়া আর কনকনে ঠা-ায় জনজীবন কাহিল। মানুষ ও পশু-পাখির অবস্থা জবুথবু। ঠাণ্ডা ও শীতজনিত রোগের প্রকোপ আশঙ্কাজনকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। চার দিন পর সূর্যের মুখ দেখা গেলেও তীব্র শীতে জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
শীতের তীব্রতা কিছুটা হ্রাস পেলেও মানুষের দুর্ভোগ এখনো কমেনি। দশ ঘণ্টার ব্যবধানে শীত ও শীতজনিত কারণে শরণখোলায় তিনজনের মৃত্যু হয়েছে।
তাছাড়া নতুন করে বীজতলা তৈরিতে কৃষকেরা এখন উদ্বিগ্ন। কৃষকরা তাদের জমিতে বোরো আবাদের জন্য যেসব বীজতলা তৈরি করেছিলেন দফায় দফায় শৈত্যপ্রবাহের কারণে জনদুর্ভোগের পাশাপাশি অধিকাংশ বীজতলা বিনষ্ট হয়ে গেছে। টানা শৈত্যপ্রবাহের কারণে অধিকাংশ বীজতলা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় চলতি মৌসুমে বোরো আবাদ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করছেন কৃষকরা। চলতি মৌসুমে বোরো ধানের বীজ চড়া মূল্যে কিনে বীজতলা তৈরি করেছিলেন। কিন্তু প্রবল শীতের কারণে বীজতলা প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে।”
বলাবাহুল্য, উপরোক্ত রিপোর্ট সংবাদ-পত্রের গণ্ডি পেরিয়েও কৃষিমন্ত্রী থেকে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে যাওয়ার কথা।
প্রধানমন্ত্রী অবশ্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে হালকা ধমকের সুরে সতর্ক ও সক্রিয় হতে বলেছিলেন যে, ‘পত্রিকায় খবর পড়ে তথ্য জানতে হবে কেন? গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নিজস্ব কার্যক্রম জোরদার ও পরিপূর্ণ নয় কেন?’
বলা চলে, প্রধানমন্ত্রীর সে ধমকের পর থেকে পত্রিকার রিপোর্ট বের হবার আগেই কৃষিমন্ত্রী তথা প্রধানমন্ত্রীর দফতরে শৈত্যপ্রবাহের কারণে বীজতলা নষ্ট হয়ে যাওয়ার খবর পৌঁছার কথা। এবং সেক্ষেত্রে কৃষকবান্ধব বর্তমান সরকারের জন্য সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে আগ বাড়িয়ে আসার কথা।
কিন্তু পত্রিকান্তরে বীজতলা এবং নি¤œমানের বীজ কিনে কৃষক প্রতারিত মর্মে যেরূপ সংবেদনশীল খবর বেরিয়েছে, সেরূপভাবে বীজতলা ও বীজ নিয়ে কৃষককে সরকারি সাহায্যের কোনো খবর দেখা যায়নি।
তবে গত ২৬.০১.২০১০ ইং তারিখের একটি খবর বলতে গেলে গোটা দেশবাসীকে নাড়া দিয়েছে।
‘দৈনিক আল ইহসান’ পত্রিকায় খবর হেডিং হয়: æগৌরীপুরে এক অসহায় কৃষকের কাণ্ড!”
খবরে বলা হয়: বীজের অভাবে বোরো জমি রোপণ করতে ব্যর্থ কৃষক অবশেষে রাতের আঁধারে অন্যের বীজতলা থেকে বোরো ধানের চারা তুলে নিয়ে গেছে। ‘আমি চোর না’। নিরুপায় হয়ে এ কাজ করেছি বলে চিরকুট লিখে রেখে গেছেন। এমনি একটি ঘটনা ঘটেছে ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার পল্লীতে।
জানা গছে, প্রচ- শীতে বোরো বীজতলায় ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার কারণে বোরো চারার সঙ্কট অভাবনীয় হওয়ায় কৃষকরা বোরো আবাদ করতে পারছে না। তাই এক কৃষক গত ২৩ জানুয়ারি মধ্য রাতে উপজেলার সদর ইউনিয়নের শালীহর গ্রামের তোতা মিয়ার বোরো বীজতলা থেকে চারা চুরি করে নিয়ে গেছে। যাবার সময় বীজতলায় একটি চিরকুট রেখে যায়। যার মধ্যে লিখা ‘আমি চোর না নিরুপায় হয়ে এ কাজ করেছি, আপনার চারার মূল্য বাবদ বাজার দর হিসাবে ৬শ টাকা রেখে গেলাম। আমাকে মাফ
করবেন।’ উল্লেখ্য, উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, এবছর গৌরীপুর উপজেলায় ইরি-বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা হয়েছে প্রায় সাড়ে ১৯ হাজার হেক্টর জমিতে। আর বীজতলা তৈরি করা হয়েছিল ১ হাজার হেক্টর জমিতে তবে হাইব্রিড-এর পরিমাণ খুবই কম।”
বলাবাহুল্য, বীজতলা সঙ্কটে কৃষক কতদূর অসহায় হয়ে পড়ছে সে বিষয়ে সরকারের অন্যতম উপদেষ্টা- কৃষি উপদেষ্টাও যে সরকার প্রধানকে কোনো পরামর্শ দিয়েছে তা কোথাও প্রকাশ পায়নি।
তবে যা প্রকাশ পেল তাহলো- অবস্থা এমনই ভয়াবহ সঙ্কটে যে, চুরির প্রতি আজ বীতশ্রদ্ধ ও চরম ঘৃণাবোধ থাকার পরও- অত্যন্ত সৎ মানসিকতার লোকও সঙ্কটের মুখে নীতির সাথে আপোস করতে মাজুর হলেন। (নাঊযুবিল্লাহ)
অথচ ঐ লোকটি সৎই থাকতে চেয়েছিলেন।
সৎ থাকার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা নিয়েছিলেন।
প্রয়োজনীয় সহযোগিতা চেয়েছিলেন।
যে সাহায্য করার কথা ছিলো সরকারের-
নির্দেশ দেয়ার কথা ছিল সরকার প্রধানের-
কিন্তু সরকার প্রধান নির্দেশ দেননি।
তিনিও সৎ থাকার সর্বোচ্চ কোশেশ করেও চূড়ান্তভাবে সৎ থাকতে পারেননি।
তবে সরকার প্রধান যে সৎ থাকার নির্দেশ দেননা তা নয়। বরং ২৬ জানুয়ারি ২০১০ ঈসায়ীর সব পত্র-পত্রিকায় এসেছে, দলীয় এমপি-মন্ত্রীদের প্রধানমন্ত্রী কিরূপ খোলামেলা শাসিয়েছেন।
æদলীয় সাংসদদের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি বিপুল বিজয় নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল, কিন্তু দুর্বৃত্ত হয়ে বিদায় নিয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট এ ধরনের কোন নজির সৃষ্টি করতে চায় না। তাই দলের কোন এমপির বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতি বা বড় কোন অভিযোগ বরদাশত করা হবে না। দলীয় এমপিসহ সহযোগী সংগঠনের উদ্দেশ্যে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে তিনি বলেন, আইন সবার জন্য সমান। কেউ-ই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। তাই কেউ যাতে আইনের ঊর্ধ্বে উঠার চেষ্টা না করে। করলে ক্ষমা করা হবে না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানিয়ে বলেন, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। কারো বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অনিয়ম, ভূমি দখল ও সরকারি সম্পত্তি লুটপাটের অভিযোগ উঠলে তাকে শাস্তি পেতে হবে।
শেখ হাসিনা দলীয় এমপিদের সতর্ক করে বলেন, সরকার দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ যেই হোক, আইন ভঙ্গ করলে শাস্তি তাকে পেতেই হবে।
দলের উপদেষ্টাম-লীর সদস্য তোফায়েল আহমেদ ও শেরপুর থেকে নির্বাচিত আতিউর রহমান আতিক স্বাস্থ্য সহকারী পদে সরকারি নিয়োগ নিয়ে চলমান প্রক্রিয়ার ব্যাপারে তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করে বক্তব্য দেন।
তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, বিএনপি-জামাত জোট সরকারের আমলে এমপিদের পক্ষ থেকে তালিকা দেয়া হয়েছিল। কর্তৃপক্ষ ওই তালিকা ধরে নিয়োগ সম্পন্ন করছেন। এখন যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে তাতে যাদের টাকা আছে তারা সুযোগ গ্রহণ করছেন।
প্রধানমন্ত্রী দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, বিএনপি-জামাত জোট যেভাবে দলীয়করণ করে গেছে, এবার তা হবে না। চাকরির ক্ষেত্রে দলীয় এমপিদের তদবির বাণিজ্য থেকে বিরত থাকতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী দু’বার ধাওয়া শব্দটি উচ্চারণ করে বলেন, ৩০ জানুয়ারি ঢাকায় যে বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হবে সেখানে তৃণমূল পর্যায়ের নেতারা এমপি-মন্ত্রীদের কাজের হিসাব চাইবে। তাদের ধাওয়া থেকে রক্ষা পেতে সবাইকে প্রস্তুত হয়ে আসতে হবে।”
পার্লামেন্টারী পার্টির ঐ বৈঠক থেকে যেসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে তাহলো যে,
এমপিরা তদবির বাণিজ্য করেন।
দুর্নীতিও হচ্ছে।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তার পরিণতি শুধু জনগণের ধাওয়া নয় বরং পার্টির তৃণমূল নেতাদের ‘ধাওয়া’ও হবে বলে এমপিদের সাবধান করেছেন। এবং তাদেরকে শাস্তি প্রদানের শক্ত কথাও শুনিয়েছেন।
তবে তার পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী এমপিদের শুল্কমুক্ত গাড়ি প্রদান- এর জন্য সহজ শর্তে ঋণ এবং ১৫ কোটি টাকা থোক বরাদ্দের কথাও বলেছেন।
প্রতিভাত হচ্ছে, প্রধামমন্ত্রী এমপিদের সুযোগ-সুবিধা পর্যাপ্ত পরিমাণে দিচ্ছেন কিন্তু তারপরেও তারা দুর্নীতির সাথে জড়িয়ে পড়েছে। আর প্রধানমন্ত্রী তাদেরকে সাবধান করে সৎ থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন।
অপরদিকে প্রান্তিক কৃষক- তাকে প্রধানমন্ত্রী সতর্ক করছেন না
সাবধান করছেন না
সে নিজ থেকেই সৎ থাকতে চেয়েছে
আপ্রাণ চেষ্টা করছে
কিন্তু সে তার নেহায়েত প্রয়োজনটুকু মেটানোর জন্য ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সরকারি সাহায্যটুকু পাচ্ছে না।
শেষ ধনটুকু বিলিয়েও, মাথার ঘাম পায়ে ফেলেও চাষাবাদের জন্য বীজ বা চারা গাছটুকু পর্যন্ত পাচ্ছে না।
এদিকে মন্ত্রী-এমপিদের সৎ থাকার জন্য হাজারো ধমক আর লাখো নছীহত-খয়রাত করলেও যারা দুর্নীতিপরায়ণ তারা কতটুকু সৎ থাকবে- সে সন্দেহ প্রধানমন্ত্রী নিজেও যে করেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
কিন্তু সৎ থাকার অদম্য উদ্দীপনা যে কৃষকের রয়েছে তাকে নিতান্ত ক্ষুদ্র সহযোগিতা করলেই যে সে সৎ থাকতে পারেতো- সে অবিশ্বাস বলতে গেলে সন্দেহবাতিকেরও হবে না।
কাজেই প্রধানমন্ত্রীকে উপলব্ধি করতে হবে যে, শুধু এমপি-মন্ত্রীদেরকেই সৎ থাকার ছবক দিলেই হবে না, পাশাপাশি প্রান্তিক কৃষক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, গরিব জনগণ তাদের ন্যূনতম প্রয়োজনের দিকেও অবিলম্বে সক্রিয় নজর দিতে হবে। তাহলে দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠী সহজেই সৎ থাকতে পারবে এবং দেশের সততা বিস্তারে সেটাই হবে প্রথম প্রজ্ঞাসম্পন্ন ও ফলপ্রসূ কর্মসূচি।
-আল্লামা মুহম্মদ ওয়ালীউল্লাহ।