ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১৩৬)

সংখ্যা: ১৮৭তম সংখ্যা | বিভাগ:

-হযরত মাওলানা মুফতী সাইয়্যিদ মুহম্মদ আব্দুল হালীম

প্রসঙ্গ: স্বীয় শায়খ বা মুর্শিদ ক্বিবলা-এর মুহব্বত ও সন্তুষ্টির লক্ষ্যে নিম্নলিখিত দশটি মাক্বাম হাছিল করার কোশেশ করবে।

(৩) রিয়াজত-মাশাক্কাত

হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি সেই মুরীদকে উদ্দেশ্য করে আরো বললেন, প্রিয় বৎস! তুমি কি সেই হাদীছে কুদসী শুননি, যেখানে আল্লাহ পাক বলেন, “প্রকৃত নির্লজ্জ সেই ব্যক্তি, যে আমল ছাড়াই বেশেতের আশা করে। যে ব্যক্তি আমার ইবাদত-বন্দেগী করতে কার্পণ্য করে আমি কিভাবে তাকে রহমত বা অনুগ্রহ দান করতে পারি?”

একজন বুযূর্গ বলেছেন, শুধু আমল তরক করাই দোষণীয় নয়; বরং আমলের গুরুত্ব না দেয়াই প্রকৃত দোষণীয়। সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীছ শরীফ অত্যন্ত পরিষ্কার এবং সর্বাপেক্ষা উজ্জ্বল। তিনি ইরশাদ করেন, “বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান ঐ ব্যক্তি, যে স্বীয় নফসকে দমন করে এবং মৃত্যুর পরের অবস্থার জন্য আমল করতে থাকে। আর আহমক ঐ ব্যক্তি, যে খাহেশাতে নফছানীর (প্রবৃত্তির) অনুরসণ করে আর আল্লাহ পাক-এর রহমতের আশা করে।”

প্রিয় বৎস! তুমি কিতাব মুতায়ালা, পাঠ পর্যালোচনার উদ্দেশ্যে অনেক রাত জাগরণ করেছ। আমি বুঝতে পারছিনা যে, উহাতে তোমার কি উদ্দেশ্য ছিল? যদি দুনিয়া ও দুনিয়ার আসবাব সংগ্রহ, পদ-মর্যাদা লাভ এবং সমশ্রেণীদের নিকট শ্রেষ্ঠত্ব লাভ ও গর্ব-অহঙ্কার করা তোমার উদ্দেশ্য হয়ে থাকে; তাহলে ধিক শতধিক তোমার জন্য! শত আক্ষেপ তোমার উদ্দেশ্যে! তবে উহার দ্বারা তোমার উদ্দেশ্য যদি শরীয়তে ইসলামের প্রচার-প্রসার  এবং দ্বীন ইসলাম জিন্দা করা ও স্বভাব বা চরিত্রকে সংশোধন করা হয়ে থাকে, তাহলে উহা তোমার ধন্যবাদ ও সুসংবাদ বহন করে। আর তা সৌভাগ্যের বিষয়ও বটে। কোন কবি সত্যই বলেছেন,

سهر العيون لغير وجهك ضائع وبكائهن لغير فقدك باطل.

“একমাত্র তোমার উদ্দেশ্য ছাড়া রাত জাগরণ করা বেকার। তোমাকে ব্যতীত অন্যকে হারিয়ে তাদের কান্নাকাটি করা বৃথা।

সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, “পৃথিবীতে যতদিন ইচ্ছা জীবন যাপন কর; নিশ্চয়ই একদিন মরতে হবে। যাকে ইচ্ছা ভাল বাস নিশ্চয়ই উহাকে একদিন ছেড়ে যেতে হবে। তোমার যা ইচ্ছা আমল করো নিশ্চয়ই একদিন তার প্রতিদান পাবে।” তর্কশাস্ত্র, চিকিৎসা, জোতিষ, সাহিত্য-কাব্য প্রভৃতি বিদ্যা শিক্ষায় তোমার কি উপকার হলো? আল্লাহ পাক-এর শ্রেষ্ঠত্ব এবং কুদরতের অনুশীলন হতে গাফিল থেকে মূল্যবান জীবনকে অযথা নষ্ট করা ছাড়া আর কিছুই লাভ হলো না। কেননা আমি হযরত ঈসা আলাইহিস্ সালাম-এর ইনজীল শরীফ পাঠ করেছি। বান্দা যখন মারা যাবে এবং যখন তাকে কবরে রাখা হবে, তখন আল্লাহ পাক নিজে তাকে চল্লিশটি প্রশ্ন করবেন। তার মধ্যে প্রথম প্রশ্ন হলো, হে বান্দা! তুমি অনেক বছর যাবৎ সৃষ্ট জগতের চোখে নিজকে পবিত্র ও সুন্দর করেছিলে, এক মূহূর্তের জন্যও কি আমার লক্ষ্যস্থলকে (ক্বলব) পবিত্র করেছিলে?

হে প্রিয় সন্তান! আমল ছাড়া ইলম পাগলামী। আর ইল্্ম ছাড়া আমল মূল্যহীন। জেনে রেখ আজ যদি তোমার ইল্ম তোমাকে গুনাহের কাজ হতে ফিরাতে না পারে এবং আল্লাহ পাক ও উনার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আনুগত্যশীল বানাতে না পারে; তাহলে কোনক্রমেই তা আগামী কাল  তোমাকে দোযখের আগুন হতে বাঁচাতে পারবে না।

আজ যদি তুমি আমল না করতে পার; তাহলে তোমার জীবনের বিগত দিনে যা করতে পারনি কিয়ামতের দিনে উহার কোনই প্রতিকার করতে পারবে না। তাই তুমি বলবে, আয় আল্লাহ পাক! আমাকে একটু দুনিয়ায় ফিরিয়ে দিন, নেক কাজ করে আসি। তখন তোমাকে বলা হবে, হে আহমক! তুমি তো তথা হতে চলে এসেছ। কিভাবে তুমি আবার সেখানে যেতে চাও?

প্রিয় বৎস! মৃত্যুর মাধ্যমে দেহ-পিঞ্জর হতে পবিত্র রূহ বের হয়ে যাবার আগে যদি উহাকে আল্লাহ পাক-এর ইবাদত-বন্দেগীতে খরচ করতে পার সেটাই উন্নত সাহসের পরিচায়ক হবে। কেননা দুনিয়া তোমার কবরে পৌঁছা পর্যন্ত বাসস্থান মাত্র। কবরবাসীগণ, তুমি তাদের নিকট না পৌছা পর্যন্ত তোমার জন্য অপেক্ষা করতেছে। অতএব খবরদার! সাবধান! বিনা সম্বলে  সেখানে যেওনা।

হযরত ছিদ্দিকে আকবর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেছেন, দেহগুলি পাখির পিঞ্জিরা, অথবা চতুষ্পদ প্রাণীর আস্তাবলের মত। অতএব, তুমি মনে মনে চিন্তা করে দেখ, তুমি উহাদের কোনটি। অর্থাৎ তুমি পাখি, না পশু। তুমি যদি কোন বাসার পাখি হয়ে থাক, (যাকে পিঞ্জিরায় আবদ্ধ করা হয়েছে) যার কারণে

ارجعى الى ربك راضية مرضية

সন্তুষ্টচিত্তে (নিজের বাসায়) প্রভুর কাছে ফিরিয়ে আস।” (সূরা ফজর-২৮) এটা আওয়াজ পৌঁছিয়ে থাকে। তাহলে তুমি উন্নত স্থানে (নিজের আবাসের উদ্দেশ্যে) উড়তে থাক। আর তুমি যদি চতুষ্পদ জন্তুর কোনটি হও (নাঊযুবিল্লাহ) তাহলে তুমি ঐ দলভূক্ত হবে, যাদের বিষয়ে কুরআন শরীফে ইরশাদ হয়েছে,

اولئك كالانعام بل هم اضل

“তারা পশুর মত বরং তাদের চেয়েও অধিক পথভ্রষ্ট।” (সূরা আ’রাফ-১৭৯) এমতাবস্থায় তুমি সঠিক জেনে রাখ, তোমার অর্জিত ধনকে হাবিয়া (দোযখের) কোণে ফেলে রাখলে। (বা নিজেকে দোযখে ফেলে দিলে)।

বর্ণিত আছে, ইমামুশ শরীয়ত ওয়াত ত্বরীকত হযরত ইমাম হাছান বছরী রহমতুল্লাহি আলাইহি একদিন পিপাসায় কাতর হয়ে পড়েছিলেন। এ দিনটি দারুণ গরমও ছিল। তাকে এক গ্লাস ঠা-া পানি দেয়া হয়েছিল। যখন ঐ গ্লাসটি হাতে স্পর্শ করলেন, উহার (পানির) শীতলতা অনুভব করলেন। তখন এক ভীষণ চিৎকার করে বেহুশ হয়ে পড়লেন। আর গ্লাসটি হাত হতে পড়ে গেল। অতঃপর সম্বিৎ ফিরে পেলে তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো, হুযূর! আপনার কি হয়েছিল? তিনি উত্তর দিলেন; আমি দোযখবাসীদের সম্পর্কীয় এই আয়াত শরীফখানা স্মরণ করেছিলাম, “তারা যখন বেহেশ্তবাসীদেরকে ডেকে বলবে

افيضوا علينا من الماء

তোমরা আমাদেরকে একটু পানি দান কর।” (সূরা আ’রাফ-৫০) দোযখবাসীদের তখনকার অবস্থা সম্বন্ধে চিন্তা করেছিলাম।

হে প্রিয় সন্তান! শুধু তোমার বিদ্যাই যদি তোমার পক্ষে যথেষ্ট হয়, কোন আমলের আবশ্যকতা না থাকে তাহলে কেউ আছে কি প্রার্থনাকারী? কেউ আছে কি তওবাকারী? কেউ গুনাহের ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছে কি? প্রভৃতি আহ্বান সম্পর্কে তুমি কি বলতে চাও? পবিত্র হাদীছ শরীফে বর্ণিত আছে।

যখন মধ্য রাত অতিবাহিত হয়ে যায়, আর সকল মানুষ ঘুমে অচেতন থাকে, তখন আল্লাহ পাক  নিজে ডেকে ডেকে বলেন, কোন তওবাকারী আছ কি? তার তওবা কুবল করবো। কোন প্রার্থনাকারী আছ কি? আমি তার প্রার্থনা কবুল করবো। কে আছ ক্ষমা প্রার্থনাকারী? আমি তাকে ক্ষমা করে দিব। এ উদ্দেশ্যেই শেষ রাতের নামায পড়া এবং গুনাহ মাফ চাওয়াকে পছন্দ করা হয়েছে। রাত জাগরণ করে নামায ও ইস্তিগফারকারীদের প্রশংসায় আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন- “তারা রাতে অল্প সময় নিদ্রা যায় এবং (নামায ও যিকির-আযকারের পরে শেষ রাতে ক্ষমা প্রার্থনা করে)।” বর্ণিত আছে, হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের একটি জামাত একদিন সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দরবার শরীফে উপবিষ্ট ছিলেন, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর নফল আমলের কথা উল্লেখ করছিলেন। তখন সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করলেন, রাতে যদি তাহাজ্জুদের নামায পড়তো! সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন ছাহাবীকে ইহাও বলেছেন, রাতে বেশি ঘুমাইও না। কেননা যে ব্যক্তি বেশি ঘুমায় তার এই ঘুম কিয়ামতের দিনে তাকে মিছকীন করে দেয়।

হে প্রিয় বৎস! আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন,

ومن الليل فتهجد به نافلة لك

“রাতে তাহাজ্জুদ পড়, তোমার জন্য খাছ হুকুম (সূরা বানী ইসরাইল-৭৯) যা হচ্ছে ‘আমর’ বা নির্দেশ। এবং

وبالاسحار هم يستغفرون

“তারা ভোর রাতে ক্ষমা প্রার্থনা করতেছে” (সূরা জারিয়াত-১৮) ইহা শোকর,

والـمستغفرين بالاسحار

এর মর্ম হচ্ছে ‘যিকির’।

সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, “তিন প্রকারের আওয়াজকে আল্লাহ পাক ভালবাসেন। মোরগের আওয়াজ, কুরআন শরীফ তিলাওয়াতকারীর আওয়াজ এবং শেষ রাতে আল্লাহ পাক-এর কাছে ক্ষমা প্রার্থনাকারীর আওয়াজ।” হযরত ছুফিয়ান ছাওরী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, আল্লাহ পাক-এর এক ধরনের বিশেষ বাতাস আছে যা শুধুমাত্র শেষ রাতেই প্রবাহিত হয়। বান্দাদের যিকির-আযকার এবং ইস্তিগফার দোয়াগুলি বহন করে মহা পরাক্রমশালী মালিকের খিদমতে পৌঁছিয়ে দেয়। তিনি আরো উল্লেখ করেছেন, আরশে মুয়াল্লার নিম্নদেশ হতে রাতের প্রথমাংশে আহবানকারী ডেকে বলেন, হুঁশিয়ার! ইবাদতকারী নামাযে দাঁড়িয়ে যাও। তাই আল্লাহ পাক-এর ইচ্ছায় তারা নামায আদায় করতে থাকে। অতঃপর রাতের মধ্য ভাগে আবার কোন আহ্বানকারী ডেকে বলেন, বিনীত ব্যক্তিদের নামাযে দাঁড়িয়ে যাওয়া উচিত। তাই তারা দাঁড়িয়ে শেষ রাত পর্যন্ত নামায পড়তে থাকেন। রাত শেষ হয়ে আসলে আবার আওয়াজ দিয়ে বলতে থাকে। খবরদার! ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের দাঁড়িয়ে যাওয়া উচিত। তাই তারা দাঁড়িয়ে ছুবহে ছাদিকের আগমন পর্যন্ত (নামায ও দোয়া) ইস্তিগফার করতে থাকে। ছুবহি ছাদিক উপস্থিত হলে এক আহ্বানকারী ডেকে বলেন, এখন গাফিল লোকদের দাঁড়াবার সময়। তাই গাফিল লোকগুলি স্বীয় বিছানা হতে জেগে উঠে যেন মৃত দেহগুলি কবর হতে উঠে আসলো। (অসমাপ্ত)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (১০৯)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (১১০)

মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (১১১)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (১১২)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (১১৪)