ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার: মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১৩৫)

সংখ্যা: ১৮৬তম সংখ্যা | বিভাগ:

-হযরত মাওলানা মুফতী সাইয়্যিদ মুহম্মদ আব্দুল হালীম

প্রসঙ্গঃ স্বীয় শায়খ বা মুর্শিদ ক্বিবলা-এর মুহব্বত ও সন্তুষ্টির লক্ষ্যে নিম্নলিখিত দশটি মাক্বাম হাছিল করার কোশেশ করবে।

(৩) রিয়াজত-মাশাক্কাতঃ

ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি সেই মুরীদকে উদ্দেশ্য করে বলেন, প্রিয় বৎস! আমলের ক্ষেত্রে তোমার গাফিল (অমনোযোগী) থাকা উচিত নয়। দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে জেনে রাখ, কিয়ামতের দিন শুধু ইলমই তোমাকে হাত ধরে পার করবে না। সে ব্যাপারে আরও একটি উদাহরণ দিচ্ছি। কোন ব্যক্তি যদি রুগ্ন হয়ে পড়ে, পিত্ত এবং অম্ল রসাধিক্যের কারণে খুব দুর্বলও হয়। আর ঐ ব্যক্তির এ কথা খুব ভালমত জানা থাকে যে, “সেকঞ্জাবীন” নামক অম্ল-পিত্ত রোধক ঔষধটি তার এ রোগের পক্ষে অব্যর্থ। কিন্তু সে উহা সেবন করলো না।

অতএব, এ ব্যক্তির উক্তরূপ জ্ঞান যেমন  তার রোগ মুক্তির পক্ষে কোন উপকারী হলো না, তেমন সে ঔষধ সেবন না করা পর্যন্ত তার রোগ মুক্তও হবে না।

প্রিয় বৎস! সৎকাজ করে আল্লাহ পাক-এর রহমত এবং অনুগ্রহ লাভের উপযুক্ত হতে না পারা পর্যন্ত তোমার প্রতি আল্লাহ পাক-এর রহমত পৌঁছবে না।

পবিত্র কুরআন শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে-

وان ليس للانسان الا ما سعى

অর্থ: “কোশেশের ফল ব্যতীত মানুষের জন্য আর কিছুই নেই। মানুষ আর কিছুই লাভ করবে না।” বৎস! তুমি এই আয়াত শরীফ সমন্ধে কি বলবে?

من كان يرجوا لقا ء ربه فليعمل عملا صالحا.

অর্থাৎ “যে ব্যক্তি স্বীয় রবের সাথে মুলাকাত করতে আকাঙ্খা রাখে, তার নেক আমল করা উচিৎ।” আরও একটি আয়াত শরীফ

جزاء بما كانوا يعملون

“তারা যে আমল করতো সেটা তার প্রতিফল স্বরূপ” (সকল প্রকার নিয়ামতে পরিপূর্ণ বেহেশ্তে মণি-মুক্তার মত হুর লাভ করবে)। আরো বর্ণিত আছে-

ان الذين امنوا وعملوا الصالحات كانت لهم جنت الفردوس نزلا. خالدين فيها.

অর্থ: “যারা নেক আমল করবে নিশ্চয়ই ফেরদাউস নামক বেহেশ্তে তাদের মেহমানদারী করা হবে এবং চিরকালই তারা তথায় থাকবে।”

আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন,

الا من تاب وامن وعمل عملا صالحا.

অর্থাৎ কিন্তু যারা গুনাহ হতে তওবা করবে, বিশ্বাস রাখবে এবং সৎকাজ করবে তারাই কামিয়াবী লাভ করবে।” অতঃপর তুমি এই হাদীছ শরীফ সম্পর্কে কি বলবে?

ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি স্তম্ভের উপর স্থাপিত হয়েছে। আল্লাহ পাক ছাড়া কোন ইলাহ নাই বলে সাক্ষ্য দেয়া। নামায কায়িম করা, যাকাত আদায় করা, রমাদ্বান শরীফ-এর রোযা পালন করা, সামর্থ্য থাকলে হজ্জ করা। অন্য একটি হাদীছ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে, মুখে স্বীকার করা, অন্তরে বিশ্বাস করা এবং রোকনগুলি কার্যে পরিণত করা বা আমল করা পূর্ণ ঈমান। বান্দাগণ যে আমল দ্বারা মুক্তি পাবে ইহার প্রমাণ অসংখ্য-অগণিত।

তবে, আমার কথা দ্বারা তুমি যদি বুঝে থাক যে, বান্দাগণ আল্লাহ পাক-এর রহমত এবং অনুগ্রহ ছাড়াই শুধু আমল দ্বারা বেহেশতে প্রবেশ করবে; তাহলে তুমি আমার কথা বুঝতে পারনি।  (আমি ঐ কথা বলিনি) জেনে রাখ আমি বলেছি যে, বান্দা আল্লাহ পাক-এর ফজল ও করম এবং রহমতে বেহেশ্ত লাভ করবে বটে, কিন্তু তাকে আল্লাহ পাক-এর দয়া বা রহমত লাভের উপযুক্ত পাত্রে পরিণত হতে হবে। (আবার আল্লাহ পাক-এর রহমত লাভের উপযুক্ত পাত্র হতে হলে) তার আদেশগুলোকে মান্য করতে হবে। নিষেধাবলীকেও পরিত্যাগ করতে হবে। আর উনার ইবাদত-বন্দেগীতে সর্বদা নিয়োজিত থেকে সমুদয় আমলে ইখলাছ ও একাগ্রতার সাথে তার নৈকট্যানুসন্ধান করতে হবে। (নতুবা আল্লাহ পাক-এর রহমত লাভের পাত্র হতে পারবে না)

যেমন পবিত্র কুরআন শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে,

ان رحمت الله قريب من المحسنين.

“নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক-এর রহমত সৎকর্মশীল লোকদের নিকটবর্তী।” পবিত্র আয়াত শরীফ-এ পরিষ্কার সংবাদ দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহ পাক-এর রহমত মুহসিন বা সৎকর্মশীল ব্যক্তিদের নিকটবর্তী।

সঙ্গত কারণে মুহসিন কে এবং ইহসান কাকে বলে? তা বুঝা দরকার। এ প্রসঙ্গে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন,

الاحسان ان تعبد الله كانك تراه فان لم تكن تراه فانه يراك

“ইহসান এই যে, তুমি আল্লাহ পাক-এর ইবাদত এমনভাবে করবে যেন তুমি উনাকে স্বচক্ষে দেখছো। আর যদি তুমি আল্লাহ পাককে দেখতে না পার তাহলে মনে করবে তিনি তোমাকে দেখছেন।

অতএব, উপরোক্ত হাদীছ শরীফখানা দালালত করে যে, সৎকর্মশীল বা মুহসিন  না হতে পারলে, আল্লাহ পাক-এর রহমত হতে দূরে থাকবে।

সে মতে উক্ত বর্ণনানুযায়ী তুমি আল্লাহ পাক-এর রহমত লাভে উপযুক্ত পাত্র (মুহসিন) না হতে পারলে আল্লাহ পাক-এর রহমত তোমার নিকট আসবে না। আর আল্লাহ পাক-এর রহমত লাভ করতে না পারলে বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না।

কেউ যদি বলে যে, একমাত্র ঈমানের জোরেই মানুষ বেহেশ্তে প্রবেশ করতে পারবে। তবে আমি বলব, হ্যাঁ। কিন্তু দোযখের ভীষণ আযাব ভোগ করার পরে। আর সেই আযাব নেক আমল ব্যতীত এতটুকুও সহজ হবার মত নয়।

কেননা বান্দা পুলছিরাত পার না হয়ে কঠিন শাস্তির এ স্তর অতিক্রম করতে সক্ষম হবে না। এই পৃথিবীতে আমরা আধ্যাত্মিক পথ যেভাবে অতিক্রম করে থাকি বা করবো, সে কঠিন পুলছিরাত সেরূপেই অতিক্রম করবো।

পার্থিব জীবনে আল্লাহ পাক-এর ইবাদত-বন্দেগীর ক্ষেত্রে অগ্রসর হওয়া বা পিছিয়ে থাকার উপর ভিত্তি করেই মানুষের পুলছিরাত পার হবার গতি বেশি বা কম হবে।

অতএব, যে ব্যক্তি দুনিয়াতে নিজেকে রক্ষা করতে পারবে, সে সেখানেও অর্থাৎ আখিরাতে পুলছিরাতেও নিরাপদ হবে। আর এই জীবনে যে ব্যক্তি পিছিয়ে থাকবে, ঐ পথে (অর্থাৎ পুলছিরাতে) সে পা পিছলিয়ে দোযখে পতিত হবে।

পবিত্র শরীয়তের প্রতি আমরা যে পরিমাণে আমল করবো, সে পরিমাণেই সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাউজে কাওছার-এর শরবত পানের সৌভাগ্য লাভ করতে পারবো।

অর্থাৎ যে ব্যক্তি যত বেশি পরিমাণে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পায়রবী করবে সে সেই পরিমাণেই ইলমে মা’রিফতে অগ্রগামী হতে পারবে।

এমতাবস্থায় আল্লাহ পাক-এর অনুগ্রহে বেহেশ্তে প্রবেশাধিকার লাভের অর্থ এই যে, তিনি স্বীয় অনুগ্রহে তোমাকে নেক আমলের তাওফীক দান করবেন, যেন তুমি আল্লাহ পাক-এর দয়া এবং অনুগ্রহ লাভের উপযুক্ত সৎকর্মশীল হতে পার। যেন তিনি তোমাকে বেহেস্তে প্রবেশ করিয়ে দেন।

প্রিয় বৎস! দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে জেনে রাখ! তুমি যদি কোন আমল না কর, তা হলে কোন পারিশ্রমিক পাবে না। বর্ণিত আছে, বণী ইসরাইলের মধ্যে আল্লাহ পাক-এর কোন এক বান্দা অনেক বৎসর যাবৎ ইখলাছের সাথে আল্লাহ পাক-এর ইবাদত-বন্দেগী করেছিলেন।

আল্লাহ পাক ফেরেশ্তাদের কাছে তার ইখলাছের পরীক্ষা নিতে ইচ্ছা করলেন। এক ফেরেশ্তাকে এ খবর দিয়ে পাঠালেন যে, (হে আবিদ) আল্লাহ পাক বলছেন- আমার ইবাদতে যতদিনই তুমি এরূপ কোশেশ করতে থাকবে, কোন উপকার হবে না। অথচ তুমি কিন্তু দোযখবাসী হবে। আল্লাহ পাক যা বললেন ফেরেশ্তা বান্দাকে তাই শুনালেন।

বান্দা তার উত্তরে (ফেরেশ্তার কাছে) বললেন, আমি প্রভুর গোলাম। আমার বা গোলামের কর্তব্য হলো রবের ইবাদত বা গোলামী করা। আর তিনি হচ্ছেন মা’বুদ বা মনিব। মা’বুদের অবস্থা এই যে, তার হিকমত কেউই জানে না। অতএব, আমার উক্তি করার আবশ্যকতা নেই।

ফেরেশ্তা স্বীয় মা’বুদের দরবারে ফিরে গিয়ে বললেন, আয় আল্লাহ পাক! গোপন এবং অতি গোপন সব কিছু আপনি জানেন। আপনার বান্দা যা বলেছে তা আপনি জানেন।

উত্তরে আল্লাহ পাক বললেন, দুর্বলতা থাকা সত্বেও যখন আমার বান্দা আমার দিক হতে ফিরে যাচ্ছে না, দয়ালু হয়ে কিভাবে আমি তার দিক হতে ফিরে থাকি? হে আমার ফেরেশ্তাগণ! তোমরা সাক্ষী থাক, আমি তাকে ক্ষমা করে দিলাম। (সুবহানাল্লাহ)

হে প্রিয় সন্তান! সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর একটি হাদীছ শরীফ শোন। তিনি বলেছেন,

حاسبوا انفسكم قبل ان تحاسبوا وزنوا قبل ان توزنوا

“তোমাদের যে হিসাব নেয়া হবে তার আগেই নিজেদের হিসাব নিজেরা গ্রহণ করো। আর তোমাদের নেকী-বদীর যে ওজন করা হবে তার আগেই তোমরা ওজন করে দেখ।” তোমার নেকীর অংশ ভারী, না গুনার অংশ ভারী। আমীরুল মু’মিনীন হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, “যে ব্যক্তি মনে করবে যে, বিনা পরিশ্রমেই বেহেস্তে প্রবেশ করবে, সে আশাবাদী। আর যে ব্যক্তি মনে করবে, পরিশ্রম করেই পৌঁছবে, সে শুধু পরিশ্রমী।” ইমামুশ্ শরীয়ত-ওয়াত্ ত্বরীকত ইমাম হযরত হাসান বছরী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, “আমল ব্যতীরেকে বেহেস্তের আকাঙ্খা করাও অন্যতম অপরাধ।” হাদীছে কুদসীতে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, “প্রকৃত র্নিলজ্জ  সেই ব্যক্তি, যে আমল ছাড়াই বেহেস্তের আকাঙ্খা করবে। যে ব্যক্তি আমার ইবাদত-বন্দেগী করতে কার্পণ্য করবে, আমি কিভাবে তাকে অনুগ্রহ দান করবো?

(অসমাপ্ত)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১২৭)

-ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার- মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১২৮)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১২৯)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছারল মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১৩০)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১৩১)