ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছারল ল মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১৩৪)

সংখ্যা: ১৮৫তম সংখ্যা | বিভাগ:

-হযরত মাওলানা মুফতী সাইয়্যিদ মুহম্মদ আব্দুল হালীম

প্রসঙ্গঃ স্বীয় শায়খ বা মুর্শিদ ক্বিবলা-এর মুহব্বত ও সন্তুষ্টির লক্ষ্যে নিম্নলিখিত দশটি মাক্বাম হাছিল করার কোশেশ করবে।

(৩) রিয়াজত-মাশাক্কাতঃ

 দশটি মাকাম হাছিলের অভিলাষী মুরীদের তৃতীয় করণীয় হচ্ছে রিয়াজত-মাশাক্কাত বা মুজাহাদা করা।

 رياضة (রিয়াজত) শব্দটি আরবী। অর্থঃ ইবাদতে আত্মনিয়োগ করা, দায়িমীভাবে আমল করা, আধ্যাত্মিক সাধনা করা, মেহনত করা।

مشقة (মাশাক্কাত) শব্দটিও আরবী। অর্থঃ কষ্ট, ক্লেশ বরণ করা, মেহনত করা।

আল্লাহ পাক এবং আল্লাহ পাক-এর হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মা’রিফাত-মুহব্বত, সন্তুষ্টি-রেজামন্দি, নৈকট্য লাভের জন্য বদ খাছলতগুলি দূর করতঃ নেক খাছলতগুলি স্বভাবে বদ্ধমুল করার কোশেশ করা এবং  সে লক্ষ্যে  সকল প্রকার দুঃখণ্ডকষ্ট, তাকলীফ সহ্য করাকে রিয়াজত-মাশাক্কাত বা আধ্যাত্মিক সাধনা বলে।

কোন কোন ইমাম মুজতাহিদ এই রিয়াজত-মাশাক্কাতকে মুজাহাদা নামে অভিহিত করেছেন।  মুজাহিদা ব্যতীত কামালত হাছিল হয় না। বিনা পরিশ্রমে কোন কাজেই সফলতা লাভ করা যায় না। সেটা দুনিয়াবী হউক অথবা উখরবী হউক। যারা বিনা পরিশ্রমে সফলতার উচ্চ শিখরে আরোহণ করার স্বপ্ন দেখে তারা যেন অসম্ভবের পথে সারা জীবন ব্যয় করলো।

দুনিয়াবী কোন কাজে সফলতা লাভের জন্য যদি রাত-দিন অবিরত পরিশ্রম করতে হয় তাহলে উখরুবী তথা আল্লাহ পাক এবং আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মা’রিফাত-মুহব্বত, সন্তুষ্টি-রেজামন্দি ও নৈকট্যের মত শ্রেষ্ঠতম নিয়ামত বিনা পরিশ্রমে  হাছিল হওয়ার আশা কিভাবে করা যেতে পারে? বিষয়টি সুস্পষ্ট করার জন্য হুজ্জাতুল ইসলাম, হযরত ইমাম গায্যালী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর মহামূল্যবান নসীহত খানা উল্লেখ করছি।

হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত ইমাম আবু হামিদ মুহম্মদ বিন মুহম্মদ গায্্যালী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর একজন মুরীদ ইল্ম শিক্ষার উদ্দেশ্যে অনেক বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন। অনেক ইল্মে পারদর্শি হয়ে যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি অর্জনও করেছিলেন।

তিনি একদিন মনে মনে চিন্তা করতে লাগলেন আর নিজের প্রতি লক্ষ্য করে বললেন, হায়! হায়!! আমি দীর্ঘকাল যাবৎ ঐ সকল ইল্ম অর্জনের  জন্য নফছকে অনেক কষ্ট- ক্লেশ দিয়েছি। কিন্তু এখনও আমি ঠিক করতে পারছিনা যে, সেগুলির মধ্যে আমার হিদায়েতের জন্য কোনটি বেশি উপকারী।

আর কিয়ামতের কঠিন সময় কোন ইল্ম আমাকে ফয়দা দান করবে।

আমি এটাও ঠিক করতে পারছি না যে, সে ইলম-এর মধ্যে কোনটি আমার পক্ষে অনিষ্টকারী।

কারণ, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, “এমন ইলম হতে আল্লাহ পাক-এর কাছে পানাহ চাচ্ছি, যা কোন উপকার করবে না”। এ সকল চিন্তা তাঁকে ভারাক্রান্ত করতে লাগলো।

শেষ পর্যন্ত তিনি স্বীয় মুর্শিদ ইমাম গায্যালী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর খিদমতে একখানা পত্র লিখতে বাধ্য হলেন। সে পত্রে তিনি কিছু নছীহত ও দোয়ার জন্যও অনুরোধ করলেন।

তিনি পত্রে লিখলেন, হে আমার প্রাণপ্রিয় শ্রদ্ধেয় শায়খ! আমার পত্রের উত্তর সম্বন্ধে যদিও আপনার বিভিন্ন কিতাবে  (ইহয়াউ উলূম, কিমিয়ায়ে ছায়াদাত, জাওয়াহিরুল কুরআন, মীযানুল আমল, কিছতাছুল মুস্তাকীম, মিরাজুল কুদুস, মিনহাজুল আবিদীন প্রভৃতি কিতাবে সন্ধান রয়েছে।

কিন্তু আপনার এ দুর্বল খাদিম সে সকল কিতাব দীর্ঘ মুতায়ালা করতে অক্ষম। অতএব আমার হিদায়েতের কাণ্ডারী ও মেহেরবান মুর্শিদ সমীপে সংক্ষিপ্ত কিছু কামনা করছি। যা আমি প্রতিদিন পাঠ করবো। ইহাতে যা কিছু থাকে তা আমল করবো।

হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গায্যালি রহমতুল্লাহি আলাইহি তার জাওয়াবে যা লিখে পাঠালেন, তা নিম্নরূপ-

হে প্রিয় বৎস! আল্লাহ পাক স্বীয় ইবাদতের সাথে তোমাকে দীর্ঘায়ু করুন! তাঁর প্রিয়জনের পথ তোমাকে প্রদর্শন করুন। জেনে রাখ, পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকল বুযূর্গানে দ্বীনের সমুদয় উপদেশাবলী সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীছ শরীফ-এ বর্ণিত আছে। উনাকে সমুদয় উত্তম বাণীসমষ্টি ইনায়েত করা হয়েছিল-

اعطيت بجوامع الكلم

তাই সকল উপদেশ দানকারী যা কিছু উপদেশ দান করবে, তা আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপদেশের খাঞ্চা হতে অনুগ্রহ নিয়েই বিস্তার করবে। তাই তোমার কাছে যদি সেই সব নববী উপদেশাবলীর কিছু মাত্র পৌঁছে থাকে তাহলে আমার উপদেশের কোনই আবশ্যকতা নেই।

পক্ষান্তরে উহার কিছুই যদি তোমার কাছে না পৌছে  থাকে, তাহলে আমাকে বল, তোমার জীবনের যে মূল্যবান সময় অতিবাহিত করলে তাতে কি লাভ হলো?

প্রিয় সন্তান! পূর্ববর্তী ও পরবর্তীদের উপদেশাবলী সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পবিত্র বাণীর মধ্যে লিখা আছে। উহার প্রতিটিই যথেষ্ট উপকারী।

বান্দার প্রতি আল্লাহ পাক-এর বিমুখ হওয়ার একটি লক্ষণ এই যে, সে (বান্দা) এমন কাজে মশগুল হবে, যাতে তার কোন উপকার হবে না। যার জীবনের একটি ঘন্টা এমন কাজে নষ্ট হবে, যে জন্য তাকে সৃষ্টি করা হয়নি, তার জন্য দীর্ঘ আক্ষেপ প্রকাশ করা উচিত।

যে ব্যক্তি চল্লিশ দিন অতিবাহিত করলো এবং এই দীর্ঘ  সময়ে যার মন্দ কাজ অপেক্ষা ভাল কাজ বেশি হল না, তার দোযখের জন্য প্রস্তুত থাকা উচিত। দুনিয়াবাসীর পক্ষে এই একটি মাত্র নছীহত ও উপদেশই যথেষ্ট।

হে প্রিয় বৎস! উপদেশ দেয়া খুব সহজ। তা কাজে পরিণত করা বা তদানুযায়ী আমল করা কঠিন।

কেননা, উপদেশ রূপখানা কু-প্রবৃত্তির দাসত্ব পূজারীর মুখে তিক্ত। নিষিদ্ধ কাজগুলি তার নিকট সাধারণতঃ প্রিয়। বিশেষতঃ যে ব্যক্তি পার্থিব মান-মর্যাদা লাভের জন্য এবং স্বীয় শ্রেষ্ঠত্ব ও নৈপুণ্য প্রকাশের নিমিত্বে ডিগ্রিযুক্ত বিদ্যার্জনে শক্তি খরচ করে। কেননা এ ধরনের লোক শুধু শিক্ষার জন্যই ইল্ম শিখে, আমলের জন্য নয়। তার উদ্দেশ্য ইল্মকে তার দিকে নিছবত করা হোক।

অর্থাৎ সে চায় লোকে বলুক, অমুক মহা বিদ্যান হাফিজ সাহেব, ক্বারী সাহেব, মাওলানা সাহেব ইত্যাদি। এরূপ আক্বীদা একান্ত ভ্রান্ত ও ক্ষতিকর। ইহাই আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শনের শিক্ষা, (নাঊযুবিল্লাহ) কেননা শুধু শিক্ষাই উহার উদ্দেশ্য। আমলের প্রতি এদের আদৌ ভ্রুক্ষেপ নেই।

এদের এ জ্ঞানও নেই যে, এই ইল্মই তাদের বিরুদ্ধে একদিন সাক্ষ্য দিবে। তাদের বিপক্ষে একটি শক্তিশালী প্রমাণ হয়ে দাড়াবে।

সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পবিত্র বাণী হতে তারা গাফিল। তিনি ইরশাদ করেছেন- “কিয়ামতের দিন সবচেয়ে কঠিন শাস্তি হবে ঐ ব্যক্তির, যে তার ইল্ম দ্বারা ফায়দা লাভ করতে পারেনি।”

হযরত ইমাম আহমদ রহমতুল্লাহি আলাইহি ও বায়হাকী রহমতুল্লাহি আলাইহি, মানছুর বিন যাজান রহমতুল্লাহি আলাইহি হতে বর্ণনা করেছেন- আমাদের কাছে (এ মর্মে হাদীছ শরীফ) পৌঁছেছে যে, (পারলৌকিক জীবনে) দুনিয়াদার আলিমকে তার ইল্ম যখন কোনই উপকার করবে না। (উপরন্তু দোযখের কঠিন শাস্তি ভোগ করতে থাকবে) তখন দোযখবাসীরা তার শরীরের দুর্গন্ধে চিৎকার করতে থাকবে। আর বলবে, হে খবীছ! দুনিয়াতে তুমি কি কাজ করেছিলে?

তোমার দুর্গন্ধ দ্বারা আমাদেরকে ভীষণ কষ্ট দিচ্ছো?

তখন সে উত্তরে বলবে, দুনিয়াতে আমি এমন একজন আলিম ছিলাম যে, ইল্ম আমার কোনই উপকার করেনি অর্থাৎ আমি ইল্ম আনুযায়ী আমল করিনি।

সাইয়্যিদুত ত্বয়িফা, হযরত জুনায়িদ বাগদাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর ইন্তিকালের  পরে উনার একজন মুরীদ উনাকে স্বপ্নে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, “আল্লাহ পাক আপনার সাথে কিরূপ ব্যবহার করেছেন”? সাইয়্যিদুত্ ত্বয়িফা হযরত জুনায়িদ বাগদাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, আমার সেসব সঙ্কেতগুলি উল্টে-পাল্টে গেছে। লেখা-পড়াগুলি অদৃশ্য হয়ে গেছে। সমস্ত ইল্ম শেষ হয়ে গেছে। নিয়ম-পদ্ধতি সব কিছু খতম হয়েছে।

গভীর রাতে যে কয়েক রাকায়াত নামায আদায় করতাম তাছাড়া আর কোন কিছুই আমাকে উপকার করতে পারেনি।

প্রিয় বৎস! আমলের ক্ষেত্রে তোমার গাফিল থাকা উচিত নয়। পবিত্র শরীয়তের আদেশ-নিষেধ ও তার মর্ম-রহস্য হতেও রিক্তহস্ত হইও না।

দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে জেনে রাখ, কিয়ামতের কঠিন দিনে শুধু ইল্মই তোমাকে হাত ধরে পার করবে না। আমার এ কথাটি একটি উপমা দিয়ে বুঝাচ্ছি।

তুমি কি মনে করো? যুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শি একজন লোক যদি কোন ভয়াবহ প্রান্তরে চলতে থাকে, তার সাথে দশ খানা তীক্ষè তরবারী আছে।

অতি উত্তম কতগুলি তীর-ধনুকও গলার সাথে ঝুলিয়ে নিয়েছে। এমতাবস্থায় একটি বিরাট সিংহ হঠাৎ এসে সম্মুখে দাঁড়ায়। তখন তার ঐ সকল অস্ত্র-শস্ত্র শুধু সাথে থাকলেই কি সিংহের অনিষ্ট হতে সে রক্ষা পাবে?

বোধ হয় তোমার দৃঢ় বিশ্বাস আছে যে, ঐ সকল অস্ত্রের যা কাজ তা না করা হলে ঐ ব্যক্তির কোন উপকারই হবে না। তেমনি কোন ব্যক্তি যদি হাজার হাজার মাসয়ালা শিক্ষা করে এবং উহার একটির উপরও আমল না করে, তার অবস্থাও ঠিক তদ্রুপ। তার ঐ ইল্ম তাকে মোটেই উপকার করবে না।  (অসমাপ্ত)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে-১২০

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (১২১)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (১২২)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে-১২৪

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১২৫)