হযরত মাওলানা মুফতী সাইয়্যিদ মুহম্মদ আব্দুল হালীম
আওলিয়ায়ে কিরাম-এর নিয়মিত
ছোহবত ইখতিয়ার
আওলিয়ায়ে কিরামগণের ছোহবত ইখতিয়ার করা ফরয। আল্লাহ পাক-এর হাবীব, আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বীয় বিশিষ্ট ছাহাবী হযরত আবু রজীন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন- হে আবু রজীন!
الا ادلك على ملاك هذا الامرالذى تصيب به خير الدنيا والاخرة عليك بمجالس اهل الذكر واذا خلوت فهرك لسانك مااستطعت بذكر الله تعالى واحب فى الله وابغض فى الله
অর্থঃ “আমি কি তোমাকে এমন একটি আমলের সুসংবাদ দিব, যার মাধ্যমে তুমি দুনিয়া ও আখিরাতের শ্রেষ্ঠতম নিয়ামত লাভ করতে পারবে? আর সেই আমল হচ্ছে- আহলে যিকির তথা আউলিয়ায়ে কিরাম-এর ছোহবতকে লাযিম (আবশ্যক) করে নিবে। আর যখন একাকী থাকবে (ছোহবত পাবে না) তখন আল্লাহ পাক-এর যিকির দ্বারা সাধ্যমত তোমার জিহ্বাকে তরুতাজা রাখবে। আল্লাহ পাক-এর জন্যই মুহব্বত করবে এবং আল্লাহ পাক-এর জন্যই শত্রুতা করবে।” (বাইহাকী শরীফ, মিশকাত শরীফ, তাফসীরে মাযহারী-৫/৪০)
তিনি আরো বলেন- “হে আবু রজীন! তুমি কি জান? যখন কোন ব্যক্তি তার কোন (মুসলমান) ভাইয়ের সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হয় তখন তার পিছনে সত্তর হাজার ফেরেশ্তা চলতে থাকে। তারা সবাই তার জন্য দোয়া করে এবং বলে হে আমাদের রব! এই ব্যক্তি শুধুমাত্র আপনার সন্তুষ্টি লাভের জন্য (তার ভাইয়ের সাথে) সাক্ষাৎ করেছে। কাজেই আপনিও তাকে আপনার অনুগ্রহ দান করুন।”
“হে আবু রজীন! যদি তোমার পক্ষে সম্ভব হয় তাহলে এই কাজে সব সময় রত থাক।” (মিশকাত শরীফ-৯/১৫০)
উল্লেখ্য যে, যদি সাধারণ কোন মুসলমান ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ করলে এই ফযীলত পাওয়া যায় তাহলে আউলিয়ায়ে কিরামগণের সাথে সাক্ষাৎ করলে তথা ছোহবত ইখতিয়ার করলে কি পরিমাণ রহমত-বরকত সাকীনা, ক্ষমা এবং অনুগ্রহ লাভ হবে তা ফিকিরযোগ্য।
সাইয়্যিদুল আউলিয়া, মাহবুবে সুবহানী, কুতুবে রব্বানী, গাউসুল আযম, ইমামুশ শরীয়ত ওয়াত ত্বরীকত, মুজাদ্দিদুয্ যামান, খাজিনাতুর রহমাহ, ছহিবে কুন ফাইয়াকুন, লিসানুল উম্মাহ, সুলতানুল আরেফীন, সাইয়্যিদুনা হযরত বড় পীর ছাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন- “শায়খ বা মুর্শিদের ছোহবত ব্যতীত নফ্স ও শয়তানের ষড়যন্ত্র হতে মুক্তি পাওয়া কখনই সম্ভব নয়।” (তায্কিরাতুল আওলিয়া)
সুলতানুল আরেফীন, সিরাজুস্ সালিকীন, খলীফাতুল্লাহ, বাহরু ইলমিদ্ দ্বীন, কুতুবুল আলম, ইমামুর রাসিখীন, সাইয়্যিদুনা হযরত বাইজিদ বোস্তামী রহমতুল্লাহি আলাইহি সহ অনেক আওলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম বলেছেন, “আউলিয়ায়ে কিরাম-এর ছোহবতে থাকা, নির্জনে ইবাদত-বন্দেগী করার চেয়েও উত্তম। আর বদকার লোকের সংসর্গে থাকা বদকাজ করার চেয়েও নিকৃষ্ট।” (তাযকিরাতুল আওলিয়া)।
এর হিকমত বা রহস্য সম্পর্কে আউলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণ বলেছেন, আমলের দ্বারা ফখর (গৌরব), রিয়া, (লৌকিকতা) ইত্যাদি পয়দা হতে পারে। আর নেককারগণের ছোহবতের দ্বারা ফখর, রিয়া ইত্যাদি সকল প্রকার বদ খাছলত দূর হয় এবং নেক খাছলত পয়দা হয়।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, সাইয়্যিদুত্ ত্বয়িফা, কুতুবুল মাশায়িখ, সুলতানুল আরিফীন হযরত জুনাইদ বাগদাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি বাগদাদ শরীফ-এ কাঁচের ব্যবসা শুরু করলেন। তিনি প্রতিদিন দোকানে গিয়ে সামনে পর্দা ফেলে দিতেন এবং উহার অন্তরালে চারশ’ রাকায়াত নামায পড়তেন। এরূপে কিছুদিন অতিবাহিত হলো। অবশেষে তিনি দোকান ছেড়ে দিলেন এবং সাইয়্যিদুল আউলিয়া, মাহবুবে সুবহানী, ইমামুর রাসিখীন হযরত র্সারী সাক্বতী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর দরবার শরীফ-এ গেলেন। দরবার শরীফ-এর একটি প্রকোষ্ঠে নির্জনে যিকির-ফিকির ও ইবাদতে মশ্গুল হলেন। নিজের আত্মার হিসাব-নিকাশ আরম্ভ করলেন। আস্তে আস্তে যিকির-ফিকির ও রিয়াজত-মাশাক্কাতে এতই মগ্ন হয়ে পড়লেন যে, মুরাকাবা অবস্থায় অনেক সময় আসনের নিচ হতে জায়নামায সরিয়ে ফেলতেন, যেন আল্লাহ পাক-এর যিকির ছাড়া অন্য কোন কিছুর কল্পনা অন্তরে আসতে না পারে। এরূপে তিনি চল্লিশ বৎসর পর্যন্ত ইশার নামাযের পর হতে ভোর পর্যন্ত দাঁড়িয়ে “আল্লাহ আল্লাহ” যিকির করতেন। আর ইশার ওযূ দ্বারাই ফজরের নামায আদায় করতেন।
তিনি বলেন, এক পর্যায়ে আমার মনে ধারণা জন্মাল যে, “আমার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে।”
এমন সময় গায়েবী আওয়াজ আসল, হে জুনাইদ! এখন কি তোমাকে তোমার পৈতার কোণ দেখাব? আরজ করলাম, আয় আল্লাহ পাক! জুনাইদের কি গুনাহ্ হলো? তখনই আবার গায়েবী আওয়াজ আসল, “তুমি এখনও আছ, এখনও তুমি তোমার অস্তিত্বকে ভুলে যাওনি, নিজকে বিলীন করে দিতে পারনি। এর চেয়ে বড় গুনাহ্ তুমি আর কি দেখতে চাও? সাইয়্যিদুত্ ত্বয়িফা হযরত জুনাইদ বাগদাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে কিছুক্ষণ মাথা নত করে রইলেন। অতঃপর বললেন,
من لم يكن للوصال اهلا فكل حسناته ذنوب
অর্থঃ ‘যে এখনও মা’শুকের সাথে মিলিত হওয়ার উপযুক্ত হয়নি বস্তুতঃ তার প্রত্যেকটি নেক কাজই গুনাহের অন্তর্ভুক্ত।’
অতঃপর পুনরায় তিনি সেই প্রকোষ্ঠে গিয়ে নির্জনতা অবলম্বন করলেন। সারা রাত তিনি সেখানে “আল্লাহ আল্লাহ্” যিকির করতে লাগলেন। (তাযকিরাতুল আউলিয়া)
হযরত আলী হাজবিরী দাতা গঞ্জে বক্শ রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন- আদব শিক্ষা বা চরিত্র গঠনের প্রধান মাধ্যম হচ্ছে আউলিয়ায়ে কিরামগণের ছোহবত। তাঁদের একান্ত সান্নিধ্যে থাকা আবশ্যক। একাকী থেকে কেহ কখনো আদব শিখতে বা চরিত্র গঠন করতে পারে না। বরং একা থাকা মুরীদের পক্ষে ক্ষতিকর। আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
الشيطان مع الواحد و هو من الاثنين ابعد
অর্থ: “মানুষ যখন একাকী থাকে তখন শয়তান তার সাথী হয়। আর দু’জন থাকলে পালিয়ে যায়।” (কাশফুল মাহজুব-১৮৯)
কুতুবুল মাশায়িখ, শায়খুশ শুয়ূখ হযরত খাজা উবাইদুল্লাহ্ আহরার রহমতুল্লাহি আলাইহি আওলিয়ায়ে কিরামগণের ছোহবত ইখতিয়ার প্রসঙ্গে বলেন, “একদা আমরা কতিপয় দরবেশ একত্রে ছিলাম। তখন জুমুয়ার দিনে দুয়া কবুল হওয়ার বিষয়ে আলোচনা হচ্ছিল যে, কারো ভাগ্যে যদি উহা লাভ হয়, অর্থাৎ কেহ যদি বুঝতে পারে যে, তার দোয়া কবুল হচ্ছে তখন আল্লাহ পাক-এর নিকট কি প্রার্থনা করা উচিত।
প্রত্যেকেই কিছু কিছু বললেন। যখন আমার পালা আসল, তখন আমি বললাম, ওলী আল্লাহগণের ছোহবত লাভের প্রার্থনা করা উচিত। কারণ, ইহার মাধ্যমে যাবতীয় সৌভাগ্য লাভ হয়।” (সুবহানাল্লাহ) (মাকতুবাত শরীফ-৫/২০৪)
আফযালুল আওলিয়া, মুজাদ্দিদে মিল্লাত ওয়াদ দ্বীন, ইমামে রব্বানী, গাউছে সামদানী হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আরো বলেন, আউলিয়ায়ে কিরামগণের ছোহবতের স্বল্পতা বা ছোহবত কম হলে পরিপূর্ণ ফায়দা লাভ হয় না। স্বীয় শায়খ বা মুর্শিদ-এর ছোহবত ইখতিয়ার করা বুযূর্গগণের নিকট অতীব জরুরী বিষয়। এই ত্বরীকার সরলচিত্ত মুরীদ বা প্রারম্ভকারীগণ প্রথম ছোহবতেই যে ফায়দা ও বরকত পায় তা প্রকৃত উদ্দিষ্ট বস্তু তথা আল্লাহ তায়ালার প্রতি ক্বলবের অবিচ্ছিন্ন লক্ষ্য থাকা। অতি অল্প সময়ের মধ্যে তা স্থায়ী লক্ষ্য তথা আল্লাহ পাক ব্যতীত অন্য সকল কিছুকে ভুলে যাওয়ার মাক্বামে (পর্যায়ে) পৌঁছে যাবে। মুরীদ এমন অবস্থায় পৌঁছবে যে, যদি হাজার বছর বয়স পায় তথাপি তার অন্তর জগতে আল্লাহ পাক ব্যতীত অন্য কোন চিন্তা উদয় হবে না। এমনকি ইচ্ছাপূর্বক স্মরণ করিয়ে দিলেও যেন স্মরণ হয় না। আর যখন এই নিছবত বা সমন্ধ হাছিল হয় তখন এ পথের প্রথম পদক্ষেপ লাভ হবে। দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ এবং আল্লাহ পাক-এর যতদূর ইচ্ছা; সে সকল পদক্ষেপের বিষয় আর কি বলবো। সামান্যই অনেকের প্রতি নির্দেশ করে থাকে এবং একবিন্দু পানিতে মহা সমুদ্রের সন্ধান পাওয়া যায়। (মাকতুবাত শরীফ-৪/২২৮)
খলীফাতুল্লাহ, খলীফাতু রসূলিল্লাহ, ইমামুল আইম্মাহ, মুহইস্ সুন্নাহ, কুতুবুল আলম, মুজাদ্দিদে আ’যম, আশরাফুল আওলিয়া, হাকিমুল ইসলাম, সুলত্বানুল আরিফীন, শাইখুল উলামা ওয়াল মাশায়িখ, সাইয়্যিদুল মুজতাহিদীন, গাউছুল আ’যম, হুজ্জাতুল ইসলাম, নূরে মুর্কারাম, আওলাদে রসূল, সাইয়্যিদুনা ইমাম রাজারবাগ শরীফ-এর মামদূহ হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলী ছোহবতের তারতীব প্রসঙ্গে বলেন, “যারা নিকটে অবস্থান করে তারা প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাযে পাঁচবার ছোহবত ইখতিয়ার করবে। যারা একই শহর বা মহল্লায় থাকে তারা প্রতিদিন কমপক্ষে একবার। যারা সেই শহর বা মহল্লার বাইরে বসবাস করে তারা সপ্তাহে কমপক্ষে একবার। যারা পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোতে বসবাস করে তারা মাসে অন্ততপক্ষে একবার। যারা দূরবর্তী জেলাগুলোতে অবস্থান করে তারা কমপক্ষে তিন মাসে একবার। যারা নিকটবর্তী দেশে অবস্থান করে তারা কমপক্ষে ছয় মাসে একবার। আর যারা দূরদেশে বসবাস করে তারা কমপক্ষে বৎসরে একবার শায়খের ছোহবত ইখতিয়ার করবে। তবে যে ব্যক্তি তার শায়খ বা মুর্শিদ ক্বিবলার যতবেশি ছোহবত ইখতিয়ার করবে তার মর্যাদা-মর্তবা ততবেশি হবে। ইছলাহ বা পরিশুদ্ধি, তায়াল্লুক, নিসবত এবং নৈকট্য ও ততবেশি হবে।”
খলীফাতুল্লাহ, খলীফাতু রসূলিল্লাহ, মুবাশ্শার বিল জান্নাত, ছিদ্দীকে আকবর হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব রদ্বিয়াল্লাহ তায়ালা আনহু ছিলেন নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালামগণের পরে সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। তিনি আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সবচেয়ে বেশি ছোহবত ইখতিয়ার করেছেন। তিনি তাঁকে ছায়ার মত অনুসরণ করতেন। আল্লাহ পাক-এর হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আমার অন্তরে যা ছিল সবই হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর অন্তরে ঢেলে দিয়েছি।” (রওজাতুল কাইউমিয়াহ ইহ্য়াউলূমিদ্দীন, কিমিয়ায়ে সা’য়াদাত, গুনিয়াতুত্ ত্বলিবিন, ফাতহুর রব্বানী, আনীসূল আরওয়া, পীরী মুরীদী তত্ত্ব, মাকতুবাত শরীফ, কাশফুল মাহজুব।)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১২৭)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১২৯)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছারল মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১৩০)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১৩১)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছারল মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১৩২)